Thread Rating:
  • 38 Vote(s) - 3.37 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোপন কথাটি রবে না গোপনে
#96
চতুর্থ অধ্যায়ঃ

পদ্মাবতীর উপাখ্যান -

পরিচ্ছেদ - ১ সাক্ষাৎকার (অন দ্যা ক্যামেরা)

রাজনারায়ণ নিজের শোয়ার ঘরে প্রবেশ করলে বিপাশা সেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সে এ বাড়িতে নিজের জন্য নির্ধারিত ঘরে গিয়ে বসে। আর সে ভাবে নীলু কখন আসবে। নীলুকে একবার ফোন করলে কেমন হয় ?
তারপর ভাবে কথা অনুসারে এ বাড়ির পুরুষদের সাক্ষাৎকার নীলু নেবে। আর মহিলাদের অন্তরের গোপন কথা টেনে বাইরে আনার দায়িত্বটা তার। তাই এখন একাই সে না হয় চালাবে তার এই অভিযান। এখনো পর্যন্ত এই পরিবারের সবচেয়ে বর্ণময় দুটি চরিত্রের সঙ্গে সে কথা বলতে পারেনি। এদেরই মধ্যে একজন হলেন রাজনারায়ণের প্রায় অন্ধ বোন পদ্মাবতী। সে ভাবছে এই ভদ্রমহিলাটির সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত এই ভিডিও ফ্লিমটির চিত্রনাট্যের একটা বড় অংশ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

সুতরাং উঠে আসতে হয় বিপাশাকে। তারপর বাড়ির কাজের মেয়ে মালতীর নির্দেশ মতো সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সে পৌঁছে যায় এক তলার একটি ঘরে। এই ঘরেই থাকেন রাজনারায়ণের প্রায় অন্ধ হতে বসা বোন পদ্মাবতী।
ঘরে ঢুকে অত্যন্ত অবাক হয়ে যায় বিপাশা। চারদিকের প্রাচুর্য ও আধুনিকতার মধ্যে এই ঘরটি একেবারেই বেমানান। মনে হলো বিপাশার পৃথিবী এখানে যেন থেমে আছে। সময় এখানে যেন কোনো অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে স্তব্ধ। ঘরের কুলুঙ্গিতে একটি তৈলহীন ধূলি ধূসরিত সন্ধ্যা প্রদীপ এবং তার পাশে ধুলোর আবরণে ঢাকা একটি ছোট্ট বাক্স। দেখে বোঝা যাচ্ছে বহুদিন কেউ প্রদীপটা জ্বালিয়ে সন্ধ্যারতি করেনি। ঘরের দেয়াল জুড়ে এক দিকে হেলে রয়েছে কালীঘাটের কালী মূর্তির ছবি , যার ওপর একটি মাকড়সা তার জাল বুনতে আত্মমগ্ন রয়েছে। ঘরের এক কোণে একটি পালিশ ওঠা খাটে ফুলের ছাপ তোলা চাদরে মোড়া তেলচিটে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। আধ ময়লা সাদা শাড়ি পড়া বৃদ্ধার চেহারার আভিজাত্য বলে দিচ্ছে তিনিই পদ্মাবতী।
অসময়ে ঘরের মধ্যে পদশব্দে সচকিত হয়ে পদ্মাবতী একটু উৎকন্ঠিত গলায় বলে ওঠেন , " কে ? কে ওখানে?"

বিপাশা বললো , " মাসীমা , আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না। আমি বিপাশা।"

পদ্মাবতী বিছানায় উঠে বসতে চেষ্টা করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে তাঁর হাতে পায়ে এখন খিল ধরে গেছে। বিপাশা তাঁর হাত ধরে তাঁকে বসতে সাহায্য করে।
পদ্মাবতী মনে করতে পারেন যে দাদা বলেছিল চৌধুরী ভিলায় এক দল লোক আসবে। তারা এই পরিবারের সকলের সঙ্গে কথা বলবে এবং ক্যামেরায় তা ধরে রাখবে। তারপর বিদেশী পর্দার ওপর বায়োস্কোপের মতো সব কিছু মেলে ধরা হবে।

তিনি উঠে বসে বলেন , " কে তুমি এসেছো মা? তুমি কি বায়োস্কোপ কোম্পানির মেয়ে?"

বিপাশা নিঃশব্দে হাসে। সত্যিই তো এ বাড়িতে তার পরিচয় সে বায়োস্কোপ কোম্পানির মেয়ে। সে পদ্মাবতীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে , " মাসীমা , আপনি আমাকে আপনার মেয়ের মতো ভাববেন।"

-- " তুমি এখানে কেনো এসেছো মা? এ বাড়ির কেউ তো এখানে আর আসে না। সকলের কাছে আমি বাতিলের খাতায়। বাড়ির কাজের মেয়ে মালতী রোজ আসে চোখের মলম আর খাবার দিতে। কালেভদ্রে দাদা আসে খোঁজ খবর নিতে। বাকীরা আমার খোঁজই রাখে না , আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। "
বিপাশা পদ্মাবতীর অভিমানের জায়গাটা বুঝতে পারে। সে বলতে থাকে - " মাসীমা, আমি কিন্তু আপনার সাথে শুধু গল্প করবো বলেই এসেছি।"
-- " আমার সাথে গল্প!!! আমার তো সব গল্প শেষ হয়ে গেছে মা , আমার আর কি বলার আছে?"
বিপাশা বলে , " গল্পের কি কোনো শেষ হয় মাসীমা? যত দিন সকাল হবে , সন্ধ্যা হবে, রোদ উঠবে, বৃষ্টি পড়বে , ততদিন অবিরাম চলতে থাকবে মানুষের গল্পকথা।"

--" বাঃ! বেশ সুন্দর কথা বলো তো তুমি? কতটা পড়াশুনা করেছো ? তোমাদের মতো মেয়েদের দেখলেও ভালো লাগে। আমার চোখ ঠিক থাকলে তোমার মতো এযুগের ঝকঝকে মেয়েদের দেখতাম।"

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ পদ্মাবতী। বিপাশা তাঁর চোখ ও মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছে হারিয়ে যাচ্ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন পদ্মাবতী তাঁর অতীতের দিনগুলোতে।

হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, " আমরা তিন বোন ছিলাম। তার মধ্যে আমি দাদার একেবারে পিঠোপিঠি। আমরা তিন বোনই বেথুন স্কুলে পড়তাম এবং ফিটন গাড়িতে যাতায়াত করতাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করার। কিন্তু কোলকাতার এক অভিজাত কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ এলে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। তুমি এক কাজ করো তো মা , ঐ কুলুঙ্গিতে একটা ছোট্ট বাক্স আছে। তুমি সেটা এনে দাও তো।"

বিপাশা উঠে গিয়ে কুলুঙ্গি থেকে ধূলি ধূসরিত একটা ছোট্ট একটা বাক্স নিয়ে এসে পদ্মাবতীর হাতে দেয়। পদ্মাবতী বাক্সটা খোলেন। একগোছা চিঠি , অন্য আরো কত কিছু। সাধারণের চোখে সেগুলো অপাংক্তেয় মনে হলেও তিনি বেশ সযত্নে রেখে দিয়েছেন। চোখে ভালো দেখতে পান না বলে সব কিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিনি কোনো কিছু খুঁজছিলেন। শেষে হাতড়ে হাতড়ে একটা ছোট সোনার লকেট খুঁজে বের করলেন। সেই লকেটের মাঝ বরাবর কাঁপা কাঁপা হাতে চাপ দিলেন। লকেটটা খুলে গেল। বিপাশা দেখলো তাতে রয়েছে প্রায় বিবর্ণ ও হলুদ হয়ে যাওয়া একজন রূপবান পুরুষের ছবি। বিপাশা দেখে পদ্মাবতী পরম মমতায় ছবিটাতে হাত বোলাচ্ছেন এবং তার প্রায় নিভে আসা চোখ দুটো দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে। এরপর বিপাশা অবাক হয়ে দেখে পদ্মাবতী ছবিটা মাথায় ঠেকালেন এবং তার দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। একটুখানি স্তব্ধতা , তারপর পদ্মাবতী হাত বাড়িয়ে ছবিটা বিপাশার হাতে দিয়ে বললেন, "এই মেয়ে , এনার সঙ্গেই আমার মালাবদল হয়েছিল। দেখো, দেখো মা, কত সুন্দর দেখতে ছিলেন।"

বিপাশা এযুগের মেয়ে। সে এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম , বিচ্ছেদ দেখেছে। প্রকৃতপক্ষে তার নিজেরই এরকম অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আজ বহু বছর আগে মৃত স্বামীর প্রতি পদ্মাবতীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে হতবাক হয়ে যায়। যতই সে চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি অ্যাকসেন্টে কথা বলুক না কেন ? যতই বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে ছুটে যাক শীতের সকালে পিকনিক করতে, যতই নারী প্রগতি বা অন্যান্য আধুনিক তত্ত্ব নিয়ে ডিবেট করুক না , হেরে যাবে, জীবনের খেলায় বারংবার হেরে যাবে সে পদ্মাবতীদের মতো প্রবীণাদের কাছে।

কিছুক্ষণের নিঃস্তব্ধতার পর পদ্মাবতী বলতে থাকেন , " জানো মা, আমার যাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তিনি নবদ্বীপে তাঁদের পারিবারিক টোলের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ছিলেন শান্ত, ধীর, স্থির, ভাবুক প্রকৃতির ও কম কথার মানুষ। যখন কথা বলতেন তখন খুব আস্তে নীচু স্বরে কথা বলতেন। অত্যন্ত পন্ডিত মানুষ তিনি। বিয়ে , অষ্টমঙ্গলার পর আমাকে নিয়ে তিনি কোলকাতা থেকে নবদ্বীপ চলে যান। ওখানে টোলে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ নিজেকে করতে হতো বলে ওনার খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তাই শ্বশুর মশাই ও শ্বাশুড়ি মা আমাকে স্বামীর সঙ্গে নবদ্বীপ পাঠিয়ে দিলেন। বিয়ের পর পরই নিজের একটা স্বাধীন সংসার পেয়ে আমি নিজেকে
অত্যন্ত ভাগ্যবতী মনে করেছিলাম।

প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর তিনি কোনো দিন আমাকে কুমারসম্ভব , কোনোদিন অভিজ্ঞান শুকুন্তলম , আবার কোনোদিন রঘুবংশম থেকে পাঠ করে শোনাতেন। বেশ সুখেই কাটছিল দিনগুলো। তাঁর আর একটা অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকালে তিনি গঙ্গা স্নান করে সূর্য প্রণাম করতেন। বিয়ের প্রায় মাস সাতেক পর এক দিন এরকমই এক সকালে গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে তিনি গঙ্গায় তলিয়ে গেলেন।
আমি বিধবা হলাম। আমি তখন সবেমাত্র ঊনিশে পা রেখেছি। আমার জীবনে নেমে এলো অকাল বৈধব্যের অভিশাপ। আমার মাথার চুল কেটে দিয়ে কদম ছাঁট করে দেওয়া হলো। পরনে সাদা থান। সবই আমি ধীরে ধীরে বিধির বিধান বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু লজ্জার কথা তোমাকে কি বলবো মা , বংশের একমাত্র প্রদীপ নিভে যাওয়ায় এবং শ্বাশুড়ি মা আর সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম হওয়ায় তাঁরা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমার গর্ভে শ্বশুর মশাইয়ের ঔরসে ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার। এই উদ্দেশ্যে শ্বশুর মশাই পর পর আমার সঙ্গে জোর করে শারীরিকভাবে মিলিত হতে লাগলেন। আমি মন থেকে এই অত্যাচার মানতে না পেরে বাড়ির কাজের মেয়েকে দিয়ে দাদার কাছে খবর পাঠালাম। তুমি জানো না মা , দাদা আমাকে কতটা ভালোবাসেন।
আমার ওই অবস্থার কথা জানতে পেরে দাদা আমার শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে শ্বশুর মশাইকে উত্তম মধ্যম দিয়ে আমাকে আবার এই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তারপর এতোদিন এখানেই আছি। সত্যের অপলাপ করবো না , দাদা আমায় কোনোদিন অপমান করেনি। বলা যেতে পারে আমাকে মাথায় করে রেখেছিল। সংসারের সব দায়িত্ব ছিল আমার উপর।

তারপর দাদা বিয়ে করলো। লক্ষ্মী প্রতিমার মতো আমার এক বৌদি এলো। সেও কিন্তু আমার সঙ্গে কখনো ঝগড়া করেনি। বরং আমিই উদ্যোগী হয়ে ধীরে ধীরে তার আঁচলে বেঁধে দিয়েছি সংসারের রূপোর চাবি গোছা। তারপর একদিন বললাম, "আমি কি চিরদিন এইভাবে তোমাদের সংসার পাহারা দেবো ? এবার আমাকে ছুটি দাও। আমি কাশীবাসী হবো। জীবনের শেষ কটা দিন বাবার চরণেই কাটিয়ে যেতে চাই।"

দাদা ও বৌদি তাতে বাধ সাধলো। তাদের সাফ জবাব কোথাও যাওয়া হবে না। বৌদি বললো , " আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি ? আপনি আছেন বলে কতটা নিশ্চিন্তে আছি আমরা।"
বুঝলে মা , সেই থেকে রয়ে গেলাম এই সংসারে। তারপর কালের নিয়মে আস্তে আস্তে বয়সজনিত কারণে সংসারের সব কাজ থেকে অবসর নিলাম। চোখ দুটোও কমজোরি হতে লাগলো। প্রথম দিকে নিয়ম করে দাদা-বৌদি এসে খবর নিয়ে যেত। আজ আমি এই সংসারের বোঝা।

নিঃশ্চুপে বসে থাকলো বিপাশা। তার মনের মধ্যে উঠছে আবেগের তুফান। সে ভাবে বর্তমানে কোনো মেয়ের একজন স্বামী মারা গেলে, আর একজন চলে আসে। জীবিত থাকতেই কতো নারীর জীবনে বিভিন্ন পুরুষের আনাগোনা। অথচ, এই ভদ্রমহিলা, পদ্মাবতী - স্বামীর সাথে , ক'দিনই বা কাটিয়েছেন সুখী দাম্পত্য জীবন, কিন্তু কি আশ্চর্য, এখনো সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান! কি অদ্ভুত ভালোবাসা! আর রজত , যাকে বিপাশা ভালোবেসে সবকিছু দিয়েছিল সে কত সহজেই না তাকে মাড়িয়ে চলে গেছে।
[+] 4 users Like কলমচি৪৫'s post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোপন কথাটি রবে না গোপনে - by কলমচি৪৫ - 16-03-2023, 08:13 PM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)