09-03-2023, 06:14 PM
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বিশালত্ব আমার চোখে পরল । বিশাল বলতে সত্যি বিশাল , একটা ফুটবল মাঠের চেয়ে কম হবে না । আমাদের যে ঘরে রাখা হয়েছে সেটা হচ্ছে বাইরের ঘর , চৌচালা টিনের ঘর সামনে বারান্দা । ঘরটা দুই ভাগে ভাগ কড়া , এক ভাগে আমি আর মতিন অন্য পাশে মসজিদের ইমাম সাহেব থাকেন । রাতের বেলাই ইমাম সাহেবেরসাথে দেখা হয়েছে । উনি এই বাড়িতেই থাকেন অবসর সময়ে বাড়ির বাচ্চাদের পড়ান । বয়স আমার চেয়ে কয়েক বছরের কম হবেন , স্বল্প তবে বেশ মিষ্ট ভাষী লোকটা , সেই সাথে মনে হলো একটু লাজুক টাইপ , মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলে সব সময়। ইমাম সাহেব কে আমার বেশ ভালো লেগেছে লোকটাকে দেখলে কেমন জানি মনে এক ধরনের শান্তি চলে আসে ।
মতিনের সাথে রাতে খুব তর্ক হয়েছে , তর্ক বলতে আমি ই একতরফা রাগারগি করলাম ওর সাথে । অবশ্য পাশের ঘরে ইমামা সাহেব থাকায় তেমন উচ্চস্বরে কথা হয়নি আমাদের মাঝে । সিদ্ধান্ত হয়েছে রাতটা থেকে আজ চলে যাবো । কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাড়াতেই মনে হলো আরও কিছুদিন থেকে গেলে ভালো হতো ।এতো সকালে আমি ঘুম থেকে উঠি না , তবে এখানে বেলা করে ঘুমানো গেলো না , আলো ফোটার আগেই পাখিদের কিচির মিচিরে ঘুমানো মুশকিল বারান্দা থেকে উঠানে নামার জন্য দুই ধাপের একটা সিঁড়ি আর সেই সিঁড়ির দু পাশে সাড়ি করে ফুলের গাছ লাগানো । কয়েকটা রঙ্গন গাছ , একটা বেলি ফুল গাছ আর দুটো পাতা গাছ ।
আর এই গাছের যত্ন নিচ্ছে ইমাম সাহেব , একটা লুঙ্গি আর হাফ হাতা সেন্ডো গেঞ্জি ওনার গায়ে , কোমরে গামছা প্যাঁচানো। উনাকে দেখেই আমি সালাম দিলাম । আসলে সচরাচর কাউকে সালাম দেয়া হয় না , তবে একটু হুজুর টাইপ লোক দেখলেই আপনা আপনি সালাম বেড়িয়ে আসে । এটা হয় ছোট বেলা থেকে শিক্ষা পাওয়ার কারনে । ছোট বেলায় বাসায় এই টাইপ মানুষ এলেই মা অথবা বাবা বলতো “সালাম দাও উনাকে” সেই শিক্ষা আমার মগজে বসে গেছে হয়ত ।
ইমাম সাহবে ঘুরে তাকালেন , লোকটার হাসি বেশ সুন্দর , একটা সরলতা আছে এনার মাঝে । সালামের উত্তর নিলেন দাড়িয়ে। দেখে মনে হচ্ছে উনাকে সালাম দিয়েছি তাই বেশ লজ্জা পাচ্ছেন ।
“ভাই সাহবে আপনার শরীর ভালো আছে” হাতের মাটি গামছায় মুছতে মুছতে জিজ্ঞাস করলেন উনি ।
কেউ আমার শরীর ভালো আছে কিনা জিজ্ঞাস করলেই আমার অসুখের কথা মনে হয়ে যায় । আমার কাছে মনে হয় এ বুঝি জানে আমার অসুখের কথা । তাই এই টাইপ প্রশ্ন আমি পছন্দ করি না, সচরাচর উত্তর না দেয়ার চেষ্টা করি । কিন্তু এই লোকটার প্রশ্নের সাথে যে হাসি ঠোঁটে ধরে রেখছে সেটা নেগেটিভ পজেটিভের কাজ করছে , দুটোয় কাটাকাটি গয়ে প্রশ্নটি নর্মাল হয়ে গেছে । তাই উত্তর দিলাম আমি ।
লোকটা দাড়িয়েই রইলো , আর কোন কথা বলছে না তবে নিজের কাজেও যাচ্ছে না । বুঝলাম আমি বিদায় না বললে উনি যাবেন না । তবে আমার বিদায় নেয়ার কোন জায়গা নেই । মতিন এখনো ঘুমাচ্ছে , তাই যাওয়ার ও কোন জায়গা নেই । মতিন উঠলে অবশ্য ওকে জিজ্ঞাস করে , বাথরুমের সন্ধান নিতে হবে । এখনো প্রাতরাশ সারা হয়নি , ইমাম সাহেব কেও জিজ্ঞাস করা যায় , তবে ইচ্ছে হচ্ছে না । এই ধরনের লোকের কাছে সচরাচর “ভাই বাথরুম কোথায়” টাইপ প্রশ্ন করা যায় না । তাই আমি অন্য কথা জিজ্ঞাস করলাম , “হুজুর আপনার নাম কি?” উনার নাম জানা হয়নি আমার এখনো , কথা বার্তা চালানোর জন্য নাম জানা অনেক জরুরি ।
প্রশ্নটা শুনেই দাত দিয়ে জিভ কাটলেন উনি , বললেন “ হুজুর বলার দরকার নাই ভাই সাহেব , আমার নাম সফিকুল, আমাকে সফিকুল বলেই ডাকবেন”
হুজুর শব্দের অর্থ কি আমি জানি না , তবে ইমান সাহেবদের আমরা হুজুর বলেই ডাকি । এটাই নিয়ম হয়ে গেছে , কিন্তু ইনি দেখছি হুজুর ডাকটা পছন্দ করছেন না । আমি হেসে বললাম “আচ্ছা ঠিক আছে সফিকুল সাহেব , এই বাগান আপনি করেন?”
“ জী ভাই সাহেব , ফজরের পর , ছেলে পেলে পড়ানর পর আর কাজ থাকে না , তাই টুকটাক করি” সাফিকুল সাহেব হাসি মুখে উত্তর দিলেন , আমি বেশ অবাক হলাম , একটা মানুষ কি করে এতক্ষন ঠোঁটে হাসি লাগিয়ে রাখতে পারে , ঠোঁট ব্যাথা করে না?
“ আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?”
“ জী ভাই সাহেব” আবারো হাসি
“ মসজিদ কি ওনাদের?”
“ জিনা ভাই সাহেব”
“ তাহলে?”
“ মসজিদে থাকার ভালো ব্যাবস্থা নাই , তাই ইনারা জায়গা দিয়েছে , আমি ইনাদের ছেলে মেয়েদের পড়াই” এতো বড় একটা লম্বা লাইন বলার সময় ও লোকটার ঠোঁটে হাসি !!!! এখন বেশ বিরক্ত লাগছে আমার । তবে কথা চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে , কারন মতিন না উঠলে আমি বাথরুমের খোঁজ পাবো না ।
“ আরবি পড়ান?”
“ জী না ভাই সাহেব , বাংলা ইংরেজি অঙ্ক ও পড়াই”
হঠাত করেই যেন আমার কি হলো , আমি জজ্ঞাস করলাম “নিলুরাফর কেও কি আপনি পড়ান?” প্রশ্নটা করে একটু লজ্জায় পরে গেলাম । হয়ত সফিকুল সাহেব জানেন যে কি কারনে আমাকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে । বাড়িতে থাকানে যেহেতু জানা থাকাটা অস্বাভাবিক না । তাই ওনার কাছে এমন সরাসরি জানতে চাওয়াটা লজ্জা জনক ।
প্রশ্নটা করেও যেমন লজ্জা পেয়েছি , ঠিক আবার এই লজ্জা পাওয়ার জন্য নতুন ভাবে লজ্জিত হচ্ছি । এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে ? বাড়ির একটা মানুষ কে আমি নামে চিনি , তাই তার কথা জিজ্ঞাস করতেই পারি !!!
“ জী ভাই সাহেব , আগে পড়াতাম , এখন পড়াই না , বড় ক্লাসের ছাত্রী আমার আয়ত্ত্বের বাইরে,”
দেখলাম সফিকুল সাহেবের হাসি একটু মলিন হয়েছে , মনে হয় ঠোঁটে ব্যথা হচ্ছে । এরি মাঝে মতিন চলে এসেছে ,
“ কি বন্ধু এতো সকালে? অবশ্য এইখানে এসে আরামে ঘুমানো যায় না সকাল বেলা পাখিরা ডাকা ডাকি করে ডিস্টার্ব করে খুব” এই বলে মতিন বড় করে আড়মোড়া ভাংলো , তারপর সফিকুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল “আরে সফিক হুজুর , গাছ লাগাইলেন নাকি , সুন্দর গাছ হইসে তো”
আমি বেশ আশ্চর্য হলাম সফিকুল সাহেব মতিনের কথার উত্তর দিলো না , নিঃশব্দে নিজের কাজে চলে গেলো ।
আমাকে ভেতর বাড়ির বাথরুম ব্যাবহার করতে দেয়া হলো , বেশ লজ্জা হচ্ছিলো আমার , বাড়ির বাচ্চা গুলো আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে । আড়ালে যে কিছু মহিলা আমাকে দেখছে সেটাও বুঝতে পারলাম । দারুন অস্বস্তি হচ্ছিলো , প্রাতরাশ ও ঠিক মত করতে পারলাম না ।
বাহির ঘোরে এসেই আমি মতিন কে ধরলাম , বললাম “এবার চল যাই”
“কই?” মতিন যেন আসমান থেকে পরল , গত রাতের কথা গুলো যেন বেমালুম ভুলে গেছে ।
“ কই মানে !!! চলে যাবো”
এই শুনে মতিন দুই চোখ কপালে উঠালো , বললে “এইটা কোন কথা বললি , এভাবে কেউ যায় , শোন এইটা গ্রামের বাড়ি , এইখানে অনেক নিয়ম কানুন আছে , তুই বিয়ে না করলে না করবি , কিন্তু অন্তত দুইটা দিন থাকতে হবে”
আমি মতিনের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম , মতিনের কণ্ঠ স্বর বলে দিচ্ছে ও দরকার হলে আমার উপর জোড় খাটাবে কিন্তু এই বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না । আমি কিছু বলতে জাচ্ছিলাম , কিন্তু বলতে পারলাম না , দুটো কিশোর বয়সী ছেলে এসেছে নাস্তার ট্রে নিয়ে । দুজন মানুষের নাস্তা আনার জন্য দুটো বিশাল ট্রে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম । জামাই আদর শুরু করেছে ইতিমধ্যে , যেই করেই হোক আমাকে চলে যেতে হবে ।
নাস্তার বহর দেখে আমি অবাক , পরটা , ভাজি , ডিম , সাথে কয়েক ধরনের পিঠা , এদের বাড়িতে মনে হয় পিঠা সব সময় বানানোই থাকে । খাবার নিয়ে আমার কোন সময় ই কোন আগ্রহ নেই , খেতেও পারি কম । তাই এই সব নাস্তার কিছুই খেতে পারলাম না । ওই দুই কিশোর ছেলের শত আব্দার সত্ত্বেও ।
<><><>
নাস্তা খেয়ে আমি আর মতিন বের হলাম , মাটির উপর ইটা বিছানো রাস্তা , দু পাশে বিশাল বিশাল গাছ । বেশ মনোরম পরিবেশ , অন্য সময় হলে হয়ত আমি এই পথে অনেক্ষন হাটতে চাইতাম , কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না । মতিনের এমন বিশ্বাস ঘাতকতায় মন বিষিয়ে আছে ।
“ কিরে কেমন লাগছে? শহরে এমন জিনিস পাবি?” হাটতে হাটতে মতিন জিজ্ঞাস করে । এর কোন উত্তর আমি দেই না ।
“ ইচ্ছা আছে এই গ্রামে একটা বাড়ি করে তোর ভাবি কে নিয়া আসবো , শহরে ভালো লাগেনা” মতিন উদাস হয়ে বলে , কিন্তু ওর এই উদাস ভাব আমাকে ছোঁয় না ।
“ মতিন কাজটা কি তুই ঠিক করছিস?” কিছুক্ষন পর আমি বললাম ,
“ কোন কাজটা”
“ এই যে তুই আমাকে এখানে নিয়ে এলি”
“ দেখ সৌরভ তুই আসলি আর তোর লগে বিয়া দিয়া দিবে , এমন কিন্তু না ব্যাপারটা , তুই থাক দুইটা দিন , ঘুইরা বেড়া , সময় হইলে বলবি মাইয়া পছন্দ হয় নাই”
আমি মতিনের দিকে তাকালাম , রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে মতিন , রস্তাটা ছায়া শীতল হলেও ধান ক্ষেতে ভিন্ন চিত্র , প্রচণ্ড রোদ । সূর্যের সোনালী আলোয় সবুজ ধান ক্ষেতের উপর মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে । সেই সাথে বাতস এসে কিছুক্ষন পর পর ঢেউ তুলে দিয়ে যাচ্ছে । আশ্চর্য সুন্দর !!!
কিন্তু এই সৌন্দর্য কতটা কষ্টকর তা হয়ত ওই উদলা গায়ের কৃষক ভাইটিকে জিজ্ঞাস করলে জানা যাবে । পিঠ পুরে কয়লার মত কালো হয়ে হয়ে গিয়েছে , এমন তেল চকে চকে যে দেখে মনে হচ্ছে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে । ছায়ায় দাড়িয়ে আমাদের কাছে রোদ স্নাত ধান ক্ষেত দেখে যতটা আনন্দ হচ্ছে , তার উল্টোটা হচ্ছে সেই কৃষক ভাইয়ের ।
আমি মতিনের দিকে তাকালাম , বেশ ভালো করেই তাকালাম । আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে চাই , এসব ও কেনো করছে ? আমার জন্য ? নিলুফারের জন্য ? নাকি নিজের জন্য?
নিজের জন্য কেনো করবে , এখানে ওর কি লাভ ? ওর লাভ হয়ত সেই কবির মত যে কিনা ছায়া ঢাকা গাছের নিচে দাড়িয়ে , কড়া রোদের সোনালী আলোয় শান্ত ধান ক্ষেত নিয়ে কবিতা লেখে , অথবা সেই শিল্পর মত । যে কিনা রোদ স্নাত ধান ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ তোলা তুলির আচরে ক্যানভাস বন্দি করে রাখে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে ।
মতিন নিশ্চয়ই সেরকম কিছুই করতে চাইছে , এই ছন্ন ছাড়া আমিকে একটা ঘর দিতে চাইছে । কিন্তু ও বুঝতে পারছে না কতটা রোদে পুড়তে হবে আমাকে আর আমার জীবন সঙ্গিনী কে এই ছন্নছাড়া খোলা মাঠে ঘর নামক ফসলের অংকুর ফোটাতে ।
<><><>
মতিনের সাথে রাতে খুব তর্ক হয়েছে , তর্ক বলতে আমি ই একতরফা রাগারগি করলাম ওর সাথে । অবশ্য পাশের ঘরে ইমামা সাহেব থাকায় তেমন উচ্চস্বরে কথা হয়নি আমাদের মাঝে । সিদ্ধান্ত হয়েছে রাতটা থেকে আজ চলে যাবো । কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাড়াতেই মনে হলো আরও কিছুদিন থেকে গেলে ভালো হতো ।এতো সকালে আমি ঘুম থেকে উঠি না , তবে এখানে বেলা করে ঘুমানো গেলো না , আলো ফোটার আগেই পাখিদের কিচির মিচিরে ঘুমানো মুশকিল বারান্দা থেকে উঠানে নামার জন্য দুই ধাপের একটা সিঁড়ি আর সেই সিঁড়ির দু পাশে সাড়ি করে ফুলের গাছ লাগানো । কয়েকটা রঙ্গন গাছ , একটা বেলি ফুল গাছ আর দুটো পাতা গাছ ।
আর এই গাছের যত্ন নিচ্ছে ইমাম সাহেব , একটা লুঙ্গি আর হাফ হাতা সেন্ডো গেঞ্জি ওনার গায়ে , কোমরে গামছা প্যাঁচানো। উনাকে দেখেই আমি সালাম দিলাম । আসলে সচরাচর কাউকে সালাম দেয়া হয় না , তবে একটু হুজুর টাইপ লোক দেখলেই আপনা আপনি সালাম বেড়িয়ে আসে । এটা হয় ছোট বেলা থেকে শিক্ষা পাওয়ার কারনে । ছোট বেলায় বাসায় এই টাইপ মানুষ এলেই মা অথবা বাবা বলতো “সালাম দাও উনাকে” সেই শিক্ষা আমার মগজে বসে গেছে হয়ত ।
ইমাম সাহবে ঘুরে তাকালেন , লোকটার হাসি বেশ সুন্দর , একটা সরলতা আছে এনার মাঝে । সালামের উত্তর নিলেন দাড়িয়ে। দেখে মনে হচ্ছে উনাকে সালাম দিয়েছি তাই বেশ লজ্জা পাচ্ছেন ।
“ভাই সাহবে আপনার শরীর ভালো আছে” হাতের মাটি গামছায় মুছতে মুছতে জিজ্ঞাস করলেন উনি ।
কেউ আমার শরীর ভালো আছে কিনা জিজ্ঞাস করলেই আমার অসুখের কথা মনে হয়ে যায় । আমার কাছে মনে হয় এ বুঝি জানে আমার অসুখের কথা । তাই এই টাইপ প্রশ্ন আমি পছন্দ করি না, সচরাচর উত্তর না দেয়ার চেষ্টা করি । কিন্তু এই লোকটার প্রশ্নের সাথে যে হাসি ঠোঁটে ধরে রেখছে সেটা নেগেটিভ পজেটিভের কাজ করছে , দুটোয় কাটাকাটি গয়ে প্রশ্নটি নর্মাল হয়ে গেছে । তাই উত্তর দিলাম আমি ।
লোকটা দাড়িয়েই রইলো , আর কোন কথা বলছে না তবে নিজের কাজেও যাচ্ছে না । বুঝলাম আমি বিদায় না বললে উনি যাবেন না । তবে আমার বিদায় নেয়ার কোন জায়গা নেই । মতিন এখনো ঘুমাচ্ছে , তাই যাওয়ার ও কোন জায়গা নেই । মতিন উঠলে অবশ্য ওকে জিজ্ঞাস করে , বাথরুমের সন্ধান নিতে হবে । এখনো প্রাতরাশ সারা হয়নি , ইমাম সাহেব কেও জিজ্ঞাস করা যায় , তবে ইচ্ছে হচ্ছে না । এই ধরনের লোকের কাছে সচরাচর “ভাই বাথরুম কোথায়” টাইপ প্রশ্ন করা যায় না । তাই আমি অন্য কথা জিজ্ঞাস করলাম , “হুজুর আপনার নাম কি?” উনার নাম জানা হয়নি আমার এখনো , কথা বার্তা চালানোর জন্য নাম জানা অনেক জরুরি ।
প্রশ্নটা শুনেই দাত দিয়ে জিভ কাটলেন উনি , বললেন “ হুজুর বলার দরকার নাই ভাই সাহেব , আমার নাম সফিকুল, আমাকে সফিকুল বলেই ডাকবেন”
হুজুর শব্দের অর্থ কি আমি জানি না , তবে ইমান সাহেবদের আমরা হুজুর বলেই ডাকি । এটাই নিয়ম হয়ে গেছে , কিন্তু ইনি দেখছি হুজুর ডাকটা পছন্দ করছেন না । আমি হেসে বললাম “আচ্ছা ঠিক আছে সফিকুল সাহেব , এই বাগান আপনি করেন?”
“ জী ভাই সাহেব , ফজরের পর , ছেলে পেলে পড়ানর পর আর কাজ থাকে না , তাই টুকটাক করি” সাফিকুল সাহেব হাসি মুখে উত্তর দিলেন , আমি বেশ অবাক হলাম , একটা মানুষ কি করে এতক্ষন ঠোঁটে হাসি লাগিয়ে রাখতে পারে , ঠোঁট ব্যাথা করে না?
“ আপনি এই বাড়িতেই থাকেন?”
“ জী ভাই সাহেব” আবারো হাসি
“ মসজিদ কি ওনাদের?”
“ জিনা ভাই সাহেব”
“ তাহলে?”
“ মসজিদে থাকার ভালো ব্যাবস্থা নাই , তাই ইনারা জায়গা দিয়েছে , আমি ইনাদের ছেলে মেয়েদের পড়াই” এতো বড় একটা লম্বা লাইন বলার সময় ও লোকটার ঠোঁটে হাসি !!!! এখন বেশ বিরক্ত লাগছে আমার । তবে কথা চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে , কারন মতিন না উঠলে আমি বাথরুমের খোঁজ পাবো না ।
“ আরবি পড়ান?”
“ জী না ভাই সাহেব , বাংলা ইংরেজি অঙ্ক ও পড়াই”
হঠাত করেই যেন আমার কি হলো , আমি জজ্ঞাস করলাম “নিলুরাফর কেও কি আপনি পড়ান?” প্রশ্নটা করে একটু লজ্জায় পরে গেলাম । হয়ত সফিকুল সাহেব জানেন যে কি কারনে আমাকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে । বাড়িতে থাকানে যেহেতু জানা থাকাটা অস্বাভাবিক না । তাই ওনার কাছে এমন সরাসরি জানতে চাওয়াটা লজ্জা জনক ।
প্রশ্নটা করেও যেমন লজ্জা পেয়েছি , ঠিক আবার এই লজ্জা পাওয়ার জন্য নতুন ভাবে লজ্জিত হচ্ছি । এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে ? বাড়ির একটা মানুষ কে আমি নামে চিনি , তাই তার কথা জিজ্ঞাস করতেই পারি !!!
“ জী ভাই সাহেব , আগে পড়াতাম , এখন পড়াই না , বড় ক্লাসের ছাত্রী আমার আয়ত্ত্বের বাইরে,”
দেখলাম সফিকুল সাহেবের হাসি একটু মলিন হয়েছে , মনে হয় ঠোঁটে ব্যথা হচ্ছে । এরি মাঝে মতিন চলে এসেছে ,
“ কি বন্ধু এতো সকালে? অবশ্য এইখানে এসে আরামে ঘুমানো যায় না সকাল বেলা পাখিরা ডাকা ডাকি করে ডিস্টার্ব করে খুব” এই বলে মতিন বড় করে আড়মোড়া ভাংলো , তারপর সফিকুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল “আরে সফিক হুজুর , গাছ লাগাইলেন নাকি , সুন্দর গাছ হইসে তো”
আমি বেশ আশ্চর্য হলাম সফিকুল সাহেব মতিনের কথার উত্তর দিলো না , নিঃশব্দে নিজের কাজে চলে গেলো ।
আমাকে ভেতর বাড়ির বাথরুম ব্যাবহার করতে দেয়া হলো , বেশ লজ্জা হচ্ছিলো আমার , বাড়ির বাচ্চা গুলো আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে । আড়ালে যে কিছু মহিলা আমাকে দেখছে সেটাও বুঝতে পারলাম । দারুন অস্বস্তি হচ্ছিলো , প্রাতরাশ ও ঠিক মত করতে পারলাম না ।
বাহির ঘোরে এসেই আমি মতিন কে ধরলাম , বললাম “এবার চল যাই”
“কই?” মতিন যেন আসমান থেকে পরল , গত রাতের কথা গুলো যেন বেমালুম ভুলে গেছে ।
“ কই মানে !!! চলে যাবো”
এই শুনে মতিন দুই চোখ কপালে উঠালো , বললে “এইটা কোন কথা বললি , এভাবে কেউ যায় , শোন এইটা গ্রামের বাড়ি , এইখানে অনেক নিয়ম কানুন আছে , তুই বিয়ে না করলে না করবি , কিন্তু অন্তত দুইটা দিন থাকতে হবে”
আমি মতিনের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম , মতিনের কণ্ঠ স্বর বলে দিচ্ছে ও দরকার হলে আমার উপর জোড় খাটাবে কিন্তু এই বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না । আমি কিছু বলতে জাচ্ছিলাম , কিন্তু বলতে পারলাম না , দুটো কিশোর বয়সী ছেলে এসেছে নাস্তার ট্রে নিয়ে । দুজন মানুষের নাস্তা আনার জন্য দুটো বিশাল ট্রে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম । জামাই আদর শুরু করেছে ইতিমধ্যে , যেই করেই হোক আমাকে চলে যেতে হবে ।
নাস্তার বহর দেখে আমি অবাক , পরটা , ভাজি , ডিম , সাথে কয়েক ধরনের পিঠা , এদের বাড়িতে মনে হয় পিঠা সব সময় বানানোই থাকে । খাবার নিয়ে আমার কোন সময় ই কোন আগ্রহ নেই , খেতেও পারি কম । তাই এই সব নাস্তার কিছুই খেতে পারলাম না । ওই দুই কিশোর ছেলের শত আব্দার সত্ত্বেও ।
<><><>
নাস্তা খেয়ে আমি আর মতিন বের হলাম , মাটির উপর ইটা বিছানো রাস্তা , দু পাশে বিশাল বিশাল গাছ । বেশ মনোরম পরিবেশ , অন্য সময় হলে হয়ত আমি এই পথে অনেক্ষন হাটতে চাইতাম , কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না । মতিনের এমন বিশ্বাস ঘাতকতায় মন বিষিয়ে আছে ।
“ কিরে কেমন লাগছে? শহরে এমন জিনিস পাবি?” হাটতে হাটতে মতিন জিজ্ঞাস করে । এর কোন উত্তর আমি দেই না ।
“ ইচ্ছা আছে এই গ্রামে একটা বাড়ি করে তোর ভাবি কে নিয়া আসবো , শহরে ভালো লাগেনা” মতিন উদাস হয়ে বলে , কিন্তু ওর এই উদাস ভাব আমাকে ছোঁয় না ।
“ মতিন কাজটা কি তুই ঠিক করছিস?” কিছুক্ষন পর আমি বললাম ,
“ কোন কাজটা”
“ এই যে তুই আমাকে এখানে নিয়ে এলি”
“ দেখ সৌরভ তুই আসলি আর তোর লগে বিয়া দিয়া দিবে , এমন কিন্তু না ব্যাপারটা , তুই থাক দুইটা দিন , ঘুইরা বেড়া , সময় হইলে বলবি মাইয়া পছন্দ হয় নাই”
আমি মতিনের দিকে তাকালাম , রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে মতিন , রস্তাটা ছায়া শীতল হলেও ধান ক্ষেতে ভিন্ন চিত্র , প্রচণ্ড রোদ । সূর্যের সোনালী আলোয় সবুজ ধান ক্ষেতের উপর মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে । সেই সাথে বাতস এসে কিছুক্ষন পর পর ঢেউ তুলে দিয়ে যাচ্ছে । আশ্চর্য সুন্দর !!!
কিন্তু এই সৌন্দর্য কতটা কষ্টকর তা হয়ত ওই উদলা গায়ের কৃষক ভাইটিকে জিজ্ঞাস করলে জানা যাবে । পিঠ পুরে কয়লার মত কালো হয়ে হয়ে গিয়েছে , এমন তেল চকে চকে যে দেখে মনে হচ্ছে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে । ছায়ায় দাড়িয়ে আমাদের কাছে রোদ স্নাত ধান ক্ষেত দেখে যতটা আনন্দ হচ্ছে , তার উল্টোটা হচ্ছে সেই কৃষক ভাইয়ের ।
আমি মতিনের দিকে তাকালাম , বেশ ভালো করেই তাকালাম । আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে চাই , এসব ও কেনো করছে ? আমার জন্য ? নিলুফারের জন্য ? নাকি নিজের জন্য?
নিজের জন্য কেনো করবে , এখানে ওর কি লাভ ? ওর লাভ হয়ত সেই কবির মত যে কিনা ছায়া ঢাকা গাছের নিচে দাড়িয়ে , কড়া রোদের সোনালী আলোয় শান্ত ধান ক্ষেত নিয়ে কবিতা লেখে , অথবা সেই শিল্পর মত । যে কিনা রোদ স্নাত ধান ক্ষেতে বাতাসের ঢেউ তোলা তুলির আচরে ক্যানভাস বন্দি করে রাখে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে ।
মতিন নিশ্চয়ই সেরকম কিছুই করতে চাইছে , এই ছন্ন ছাড়া আমিকে একটা ঘর দিতে চাইছে । কিন্তু ও বুঝতে পারছে না কতটা রোদে পুড়তে হবে আমাকে আর আমার জীবন সঙ্গিনী কে এই ছন্নছাড়া খোলা মাঠে ঘর নামক ফসলের অংকুর ফোটাতে ।
<><><>