03-03-2023, 07:10 PM
(02-03-2023, 06:03 PM)ddey333 Wrote: ৪
বয়স হলে মানুষ কিছু কিছু অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। কারো অবহেলা গায়ে মাখার শক্তি থাকে না। তখন শুধু সে ভালবাসাই ভালো বোঝে অবহেলা বোঝে না। বাবার এখন সেই বয়স।
বাবা রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায় আমি বাঁধা দেই না। সিগারেট খেয়ে শরিরের যে ক্ষতি হচ্ছে বাধা দিলে মনে যে কষ্ট পাবে তা হয়তো আরও বেশী ক্ষতি হবে। আমার বিরক্তি যদি প্রকাশ পেয়ে যায় সেও এক ভয়!
শীত চলে যাচ্ছে। পাখি গুলো চলে যাওয়ার সময় হল। বাবা এর আগেও জানতে চেয়েছেন,
-- 'আমরা কবে যাচ্ছি?' আমি বললাম,
-- 'যাবো সময় করে, দুই দিনের জন্য।'
তারপর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। আমি ভুলে গেছি কিন্তু বাবা অপেক্ষায় আছে গ্রামে যাওয়ার জন্য। সামনে আমার অফিসের অনেক কাজ। এক দিনের জন্যও ছুটি নেয়া সমস্যা। বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা কখনো তারও বেশী হয়।
সেদিন বাসায় ফিরতেই বাবা সামনে এসে বললেন,
-- 'তুই কয়েক দিনের জন্য আমাকে গ্রামে রেখে আসতে পারবি?'
আমার আসলে তখন খুব ক্লান্ত লাগছিলো। মেজাজটাও ভালো ছিল না। হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলি,
-- 'গ্রামে গিয়ে তুমি করবেটা কি শুনি? কে আছে তোমার ওখানে?'
-- 'আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি?' বাবা বললেন।
-- 'কি করবে তুমি টাকা দিয়ে?'
-- 'রাত বারোটায় হাওড়া এক্সপ্রেসে ট্রেন চলে। আমি একা চলে যেতে পারবো বাবা।'
-- 'ঠিক আছে এখন ঘুমাও কাল দেখা যাবে।'
বাবা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। সারা রাত আমার আর ঘুম হলো না। আমি জীবনে প্রথম বাবার সাথে এতোটা উত্তেজিত হলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো বাবার সাথে একটু কথা বলি। সেই অদৃশ্য শক্তিটা আমাকে পিছন থেকে আটকে রাখলো। আমাকে বিছানা থেকে উঠতে দিল না।
মানুষ যখন পরনির্ভরশীল হয়ে যায় তখন তার ইচ্ছে গুলো তার চার পাশে কেমন ঘুরঘুর করে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী শুক্রবারে বাবাকে গ্রামে নিয়ে যাবো। দুই চার দিন থাকবো সেখানে বাবাকে নিয়ে।
পরদিন অফিসে বসের সাথে কথা বলে ছুটি নিলাম। কিন্তু আমি বাসায় এলে বাবা আর তার ইচ্ছের কথা বলে না। আমাকে দেখে ভয়ে ভয়ে দূরে সরে থাকে।
হাওড়া এক্সপ্রেসের টিকিট কাটলাম। তিন দিন পর বৃহস্পতি বার রাত বারোটায় ট্রেন। বাবাকে বললাম, কিন্তু বাবা খুব আগ্রহ দেখালো না।
মলি বাবার কাপড় ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে দুই দিন আগেই। সকালে বাবার স্নানের জল গরম করে বাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাবা ঘুমিয়ে আছে। বাবা এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। গায়ের কম্বলটায় অর্ধেক শরীর ঢাকা। ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে।
মলি বাবার কাঁধে হাত দিয়ে ঘুম থেকে জাগাতে চেষ্টা করে, শরীর ভীষণ শক্ত। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। খানিকটা ভিজে গেছে বালিশ। মলি আমাকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলে। অফিস থেকে ছুটে আসি আমি। বাবার খাটের নীচে পড়ে আছে ছাইদানি তার চারপাশে কয়েকটি সিগারেটের ফিল্টার।
আমার বাবা দলছুট ঋতুবিহারী পাখি দেখতে চেয়ে ছিল তা আর দেখা হল না। নিজের সাথে দলছুট পাখির কোথাও কি মিল খুঁজে পেয়ে ছিল? হয়তো পেয়ে ছিল।
আমার ভবিষ্যত সন্তানের একটা কাল্পনিক মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সেও কি একদিন এভাবে আমাকে কষ্ট দিবে? আমাকে অবহেলা করবে? বিরক্ত হবে? আমাকেও তার বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে কয়েকটা দিন?
আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম দলছুট পাখিদের দলে। মানুষের ভিড়ে আমিও নিঃসঙ্গ এক মানুষ। সম্পর্ক আর ভালোবাসার মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গাটুকু থাকে সেখানে কিছু একটা অজ্ঞাত কারণ বসবাস করে।
তাই হয়তো সবাই একদিন দলছুট ঋতুবিহারী পাখি হয়ে নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়ায় উড়ে যাওয়ার আগে।
লেখকের নাম নেই কেন?