08-03-2023, 08:48 PM
![[Image: Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg]](https://i.ibb.co/Z6t5Q2f/Picsart-22-12-06-20-20-08-119.jpg)
৭ম পর্ব
"থ্যাংক ইউ স্যার, তবে এখনো কাজ শেষ হয়নি এটা সবে শুরু এখনো আসল অপরাধীদের ধরা বাকী"
শান্ত অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে কথাগুলো বললো নীলাদ্রি, একটু থেমে আবার বলে "যেদিন এই পুরো স্মাগলিং র্যাকেটটাকে শেষ করতে পারবো সেদিন আমি শান্তি পাবো তার আগে নয়"।
"আমি জানি তুমি পারবে, তোমার উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে,কিন্তু সাবধানে কারণ এবার ওই র্যাকেটের মাথায় যারা বসে আছে তারা সতর্ক হয়ে যাবে তাই"
"যতই সতর্ক হোক ওদের পরিণতি হবে হয় জেলের ভিতরে আর নাহয় আমার গুলিতে মরবে"
"তোমার থেকে এটাই আশা করেছিলাম, আরো একটা ইনফরমেশন আছে তোমার জন্য"
"কি স্যার?"
"আমাদের নিজস্ব সোর্স খবর দিয়েছে যে এই স্মাগলিং র্যাকেটের মেইন মাথা বর্তমানে এই এলাকাতেই আছে"
"এটা তো জানা কথাই, এই কাজের মাথা প্রতাপ সরকার তো এই এলাকার বহুদিনের বাসিন্দা"
"উঁহু তুমি ভুল করছো নীলাদ্রি"
"মানে?"
"আমার সোর্সের ইনফরমেশন অনুযায়ী এই গ্যাংএর মেইন মাথা অন্য লোক, প্রতাপ সরকার এই এলাকায় ওদের এজেন্ট মাত্র, আসল যে সে নাকি এই এলাকায় এসেছে"
"কে সে?"
"সেটা এখনো জানতে পারিনি তবে আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবো। পুরো উত্তরবঙ্গ ছাড়াও বাংলাদেশ, নেপাল ,ভুটান, সবজায়গাতেই সে তার শুঁড় ছড়িয়েছে"
"ঠিক আছে স্যার সব শুঁড় কেটে দেবো"
"আরেকটা খবর আছে"
"বলুন"
"বিগত কয়েকবছরে এই এলাকায় আরো একটা নাম উঠে এসেছে তবে ক্রিমিনাল নয় বরং উল্টো বলতে পারো প্রতাপ সরকারের শত্রু সে"
"কে?"
"আদিত্য, আদিত্য সিংহ রায়"
নামটা শুনে যেন একটু চমকে উঠলো অফিসার নীলাদ্রি সান্যাল, তারপর নিজেকে সামলে বললো "কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব, আদিত্য তো."
"কিভাবে সম্ভব এখনো জানিনা, কিন্তু সম্ভব যে হয়েছে সেটা তো সত্যি"
"আপনি দেখেছেন?"
"দেখেছি"
"কিছু বুঝতে পেরেছেন?"
"ছেলেটা অসম্ভব ধূর্ত, তাছাড়া নিজের চারিপাশে গাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে রেখেছে কাউকেই সে দেয়াল ভাঙতে দেয়না"
"আর?"
"নিজেদের এলাকায় রবিন হুড বলতে পারো খুব নাম ডাক খাতির আছে ওখানকার লোকেদের মধ্যে, এছাড়া."
"এছাড়া?"
"খবর পেয়েছি কিছুদিন আগে এক সকালে মর্ণিং ওয়াক করার সময় প্রতাপ সরকারের ছেলেকে কয়েকজন গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় যদিও সেইদিনই আবার ছেড়েও দেয় আবার এদিকে সেইদিন ওই সকালেই আদিত্যকে সরকার ভিলাতে দেখা গেছে"
"প্রতাপ সরকার ডায়রী করেছিল?
"না, সেখানেই খটকা দুজনের মধ্যে যে শত্রুতা এটা পুরো নর্থবেঙ্গল জানে অথচ নিজের ছেলের ক্ষেত্রে প্রতাপ সরকার একদম চুপ, অবশ্য এটাও ঠিক সেইদিনের ঠিক আগের রাতে সিংহ রায় প্যালেসে কয়েকজন আততায়ী গভীর রাতে হামলা করে, তাতে আদিত্য আহত হয়"
"আপনার ধারণা সেই হামলার প্রতিশোধ নিতেই প্রতাপ সরকারের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল? এবং সেটা করেছিল আদিত্য"
"ঠিক তাই কিন্তু কথা হলো তাহলে আবার অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিল কেন?"
"বোধহয় এই আদিত্য নিজের ক্ষমতা দেখাতে গিয়েছিল তাই, থ্রেট করে এসেছে বা অন্য কোনো ডিল হয়েছে ওদের মধ্যে"
"হয়তো"
"ঠিক আছে আমি দেখবো ব্যাপারটা"
"এই কাজটা হয়তো তোমাকে অফ ডিউটিও করতে হতে পারে"
"তাতে কোনো প্রবলেম নেই স্যার"
"ভেরি গুড তাহলে কাজে লেগে পড়ো, এই নাও আদিত্যর ছবি ক্লোজ স্ন্যাপ নয় কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে"
"ওকে স্যার"
কমিশনারের অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ জিপে উঠে বসেন নীলাদ্রি সান্যাল, তারপর ছবিটা বার করেন, ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্বগোতোক্তি করেন অফিসার নীলাদ্রি সান্যাল,
"খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে মিস্টার আদিত্য সিংহ রায়"।
রাতের ডিনারের আগে সিংহ রায় প্যালেসের ড্রয়িংরুমে রীতিমতো গল্পের আসর বসেছে মনোহরবাবু আর মলয়ই মূলত তাদের এতদিনে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছে আর উমাদেবী এবং অতীন্দ্র বাবু শুনছেন, মনোহরবাবু মাঝে মাঝে এমন সব হাসির কথা বলছেন যে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠছেন শুধুমাত্র আদিত্য একটা সোফায় পা গুটিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে বসে গম্ভীরমুখে ওদের দুজনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। হটাৎ বাইরে গাড়ির আওয়াজ আর একটু পরেই প্রীতি ঘরে ঢোকে সঙ্গে সঙ্গেই আদিত্যর চোখে পরে দুই বাপ-ব্যাটায় চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা হয় আর দুজনের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি এসেই মিলিয়ে যায়।
"কি রে প্রীতি তোর মুখ গম্ভীর কেন কিছু হয়েছে?"
প্রীতির মুখে প্রায় সবসময়ই হাসি থাকে কিন্তু আজ মেয়ের মুখে হাসির বদলে গাম্ভীর্য দেখে উমাদেবী প্রশ্ন করেন কিন্তু প্রীতি সে কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ উপরে নিজের রুমে চলে যায় দেখে উমাদেবী প্রথমে স্বামীর দিকে তাকান অতীন্দ্র বাবু সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন "আহ্ উমা মেয়েটা সবে এসেছে আগে ওকে একটু ফ্রেশ হতে দাও তারপর তোমার জেরা শুরু করো, কেমন?"
"কিন্তু ওর মুখ এত গম্ভীর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে"
"ওহ ডাক্তার, কোনো কঠিন কেস দেখে এসেছে বোধহয়, বললাম তো ও ফ্রেশ হয়ে আসুক তারপর জিজ্ঞেস করো"
"দাদা ঠিকই বলেছে বৌদি, ওকে একটু ফ্রেশ হতে দাও তারপর তোমার প্রশ্ন করবেন"
মনোহরবাবু ও অতীন্দ্র বাবুর কথার সমর্থন করেন, উমাদেবী স্বামীকে আর কিছু না বলে ছেলের দিকে তাকান, আদিত্য বোঝে মা কি বলতে চায় সে সোফা ছেড়ে উঠে পরে, মায়ের কাছে এসে তার সামনে বসে মায়ের দুগালে হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে "ঠিক আছে আমি দেখছি" বলে উপরে চলে যায়।
নিজের রুমে এসে প্রীতি আগে ওয়াশরুমে ঢোকে সেখানে চোখে মুখে য়জল দিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিজের বিছানায় হাঁটু মুড়ে তার মাঝে মাথা গুঁজে বসে থাকে হটাৎ দরজায় টোকা পরে, প্রীতি মাথা তুলে দেখে দাদা দাঁড়িয়ে আছে,
"দাদা তুই?"
"কেন আসা বারণ আছে?"
"না, ভিতরে আয়"
আদিত্য ভিতরে এসে বোনের বিছানার কাছে আসে প্রীতি দাদাকে বসার জায়গা দিয়ে একটু সরে বসে আদিত্য প্রীতির করে দেওয়া জায়গায় বসে নরম স্বরে বোনকে বলে, "মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে চলে এলি, কিছু হয়েছে?"
"না রে দাদা এমনি আজ কঠিন কেস দেখলাম তো তাই একটু"
আদিত্য বোঝে প্রীতি কিছু একটা লুকোচ্ছে তাই আবার বলে,
"মায়ের মনে হয়েছে তোর কিছু একটা হয়েছে আর মায়ের যখন মনে হয়েছে তখন সেটা ভুল হতে পারে না তুই বল যা হয়েছে সেটাই বল, তোর দাদা যতদিন বেঁচে আছে তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না"
"দাদা..আসলে.."
"ভয় পাসনা কি হয়েছে?"
"আজ হাসপাতালে পুলিশ এসেছিল"
"পুলিশ কেন?"
"কোনোভাবে তারা খবর পেয়েছে যে আমাদের হাসপাতালে হিউম্যান অর্গ্যান স্মাগলিং চালু হয়েছে অপারেশনের নামে পেশেন্টের বডি থেকে কিডনি নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া বা কেউ মারা গেলে তার বডি পার্টস নিয়ে নেওয়া"
"তাতে তোর কি? পুলিশ তোর কাছে এসেছিল কেন?"
"পুলিশের সন্দেহের তালিকায় আমার নাম আছে, এর আগেও কয়েকবার এসেছে আজ এসে রীতিমতো জেরার নামে থ্রেট করে গেছে কিন্তু বিশ্বাস কর দাদা আমি এসব কিছু জানিনা আমি এসব কিছু করিনি"
বলতে বলতে প্রীতি দাদার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলে "আমার নামে যদি একবার এই মিথ্যা বদনাম রটে যায় তাহলে তো বাবা-মার.."
প্রীতি কথা শেষ করতে পারে না কাঁদতে থাকে আদিত্য বোনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে "তোদের সিনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিলি?"
"আমার সিনিয়র তো সুবিমল আঙ্কেল, পুলিশ ওনাকেও সন্দেহ করছে উনিও খুব টেনসড্"
"আর এই কথাটা তুই এতদিন আমাকে বলিসনি? আমি কি তোর কেউ হই না?"
"আসলে দাদা আমি তোদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি আর ভয়ও পাচ্ছিলাম"
"ভুলটা আমারই তোর দিকে আরেকটু নজর দেওয়া উচিত ছিল আমার"
"দাদা.."
"ঘাবড়াস না আমি আছি তো কিছু হবে না, কিন্তু তুই আমার থেকে কথা লুকোচ্ছিস বোন?"
"সরি দাদা"
আদিত্য বোনের মুখটা তুলে ধরে চোখ মুছিয়ে বলে "বলেছি না তোর চোখে আমি জল সহ্য করতে পারি না, তুই শুধু হাসবি"।
প্রীতি দাদার বুকে মাথা রাখে, আদিত্য বোনের মাথায় হাত বুলোতে থাকে কিন্তু মুখটা তার কঠিন হয়ে গেছে একটু পর প্রশ্ন করে "আচ্ছা পুলিশের এই সন্দেহ হলো কেন কোনো আইডিয়া আছে তোর?"
"কেউ একজন কমপ্লেন করেছে কে তার পরিচয় পুলিশ গোপন রেখেছে"।
"হাসপাতালে তোর কাউকে সন্দেহ হয় যে এই কাজ করতে পারে কোনো ডাক্তার নার্স বা কোনো স্টাফ?"
"দাদা আমি এখানে নতুন কাকে সন্দেহ করি বলতো?"
"ঠিক আছে বাদ দে আমি দেখে নেবো ও নিয়ে আর ভাবিস না, এবার একটা হাসি দে তো দেখি এখনো, কিন্তু হাসি দেখলাম না তোর মুখে নাকি আমার উপর বিশ্বাস নেই?"
প্রীতি কোনো কথা না বলে দুহাতে দাদাকে জড়িয়ে ধরলো, আদিত্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা নাম্বার ডায়াল করলো কিন্তু ওপাশের ফোন বন্ধ দেখে বিরক্ত মুখে আবার পকেটে রেখে দিল।
আজ একটু বেলা করেই হাসপাতালে গেলেন সুবিমল বাবু এমনিতে তিনি প্রতিদিনই সকাল সকালই যান হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের একজন তিনি কত কাজ তার প্রতিদিন এসে আগে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ওখানে ভর্তি থাকা পেশেন্টদের দেখেন তাদের সাথে কথা বলেন, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরেই পুলিশ এসে জেরা করছে কাল তো রীতিমতো থ্রেট করে গেছে পারলে এখনই তাকে ফাঁসিতে ঝোলায়, মনটা তার খারাপ গতকাল বাড়ি ফিরেও চুপচাপ ছিলেন, একজন সৎ মানুষের উপরে যদি এ রকম ক্রাইমের অভিযোগ আনা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার মনটা ভেঙে যায়, সাথে পুলিশ তার মেয়েকেও সন্দেহ করছে।
হাসপাতালে এসে নিজের আলাদা কেবিনে ঢুকেই দেখলেন সেখানে এক অপরিচিত গৌরবর্ণ সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক বসে আছে, তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো বললো "আসুন ডক্টর চক্রবর্তী, সেই কখন থেকে আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম"।
"আপনি?"
সুবিমল বাবু যে এনাকে দেখে অবাক হয়েছেন সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার কথার উত্তরে আগন্তুক যুবকটি একটু হেসে উত্তর দেয় "আমি ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল, এই এলাকার থানার ইনচার্জ"
"তো হটাৎ আমার কেবিনে?"
"কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল"
"কি ব্যাপারে?"
"সেকি সেটা তো আপনার জানা উচিত, কালও তো থানা থেকে লোক এসেছিল"
"যা বলার তা তো বলেছি ওদের"
"তবুও আমি নতুন করে শুনতে চাই"
"আমার নতুন করে কিছুই বলার নেই"
"তাহলে পুরনোগুলোই আরেকবার বলুন"
"কি জানতে চাইছেন আপনি যে আমি এই র ্যাকেটের সঙ্গে জড়িত কি না?তাহলে আমি বারবার একই কথি বলবো আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না"
"আপনার কথা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না আপনি এই হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের একজন আর এখানে এত বড়ো ক্রাইম চলছে অথচ আপনি কিছুই জানতে পারেননি বা বুঝতে পারেননি এটা ঠিক বিশ্বাস হয় না"
"বিশ্বাস করা না করা আপনার হাতে"
"বা এটাও হতে পারে আপনি নিজেই এই ক্রিমিনালদের একজন"
নীলাদ্রির এই শ্লেষ মাখা কথাটার উত্তরে সুবিমল বাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলেন,
"যাকে ক্রিমিনাল বলছেন তার বিরুদ্ধে আপনার কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আছে তো অফিসার?"
আওয়াজটা শুনে সুবিমলবাবু দরজার দিকে তাকালেন, নীলাদ্রি সান্যালও একটু চমকে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকালো, সুবিমলবাবুর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি আগন্তুককে এইসময় এখানে আশা করেননি কিন্তু তাকে দেখতে পেয়ে তিনি সবথেকে বেশী আশ্বস্ত এবং খুশী হয়েছেন, তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে আগন্তুককে বললেন, "আরে আদিত্য যে এসো এসো, এইসময় এখানে?"
"আপনার সাথে একটু দরকার ছিল, কাল রাতে ফোন করেছিলাম কিন্তু আপনার ফোন সুইচড অফ ছিল তাই এখানে চলে এলাম"
আদিত্য সুবিমলবাবুর কথার উত্তর দিয়ে নীলাদ্রির দিকে তাকালো, নীলাদ্রি তখনও চেয়ারে বসে সোজা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে। আদিত্য এবার নীলাদ্রির পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় তার মুখোমুখি বসে একটা পা অপর পায়ের উপরে তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসলো তারপর আবার নীলাদ্রিকে প্রশ্ন করলো,
"কি হলো উত্তর দিলেন না আপনার কাছে প্রমাণ আছে?"
নীলাদ্রি তখনও একদৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে কিছুক্ষণ সেইভাবে তাকিয়ে বললো "আপনি?"
নীলাদ্রির প্রশ্নের উত্তর সুবিমলবাবু দিলেন "পরিচয় করিয়ে দিই ও আদিত্য, আদিত্য সিংহ রায় আর আদিত্য উনি হলেন ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল আমাদের এখানকার থানার ইনচার্জ"
"ওহ তাহলে আপনিই সেই ফেমাস আদিত্য সিংহ রায়? আপনার কথা তো অনেক শুনেছি এই এলাকায় তো আপনার অনেক ক্ষমতা"
"ফেমাস কি না জানিনা তবে হ্যাঁ আমার নাম আদিত্য আর ক্ষমতা বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না তবে এখানকার লোকজন আমাকে ভালোবাসেআমার কথা শোনে, আমাকে ভরসা করে এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? ওনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে?"
"এখনো না, থাকলে ওনাকে আমি.."
"প্রমাণ না থাকলে কাউকে ক্রিমিনাল বলা যায় না এটা আপনাকে কেউ শেখায়নি?"
নীলাদ্রিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আদিত্য কথাটা বললো তার দৃষ্টি এখনও সোজা নীলাদ্রির দিকে, নীলাদ্রিও কম যায়না সেও সোজা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো, "আপাতত সন্দেহ আছে তাই.."
"তাই আপাতত সুবিমলবাবু অভিযুক্ত অপরাধী নয়, দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা নিশ্চয়ই জানা আছে?"
এবারেও নীলাদ্রিকে কথা শেষ করতে দিল না আদিত্য, সবথেকে বড়ো কথা আদিত্যর কথাগুলো যথেষ্ট শ্লেষ মাখা নীলাদ্রির মুখ ধীরে ধীরে রাগে লাল হয়ে উঠছে কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো তারপর সুবিমলবাবুর উদ্দেশ্যে বললো "তদন্ত কিন্তু সবে শুরু হয়েছে আমি কিন্তু আবার আসবো ডক্টর চক্রবর্তী"।
"নিশ্চয়ই আসবেন কিন্তু তদন্তের নামে নিরপরাধদের বিরক্ত করবেন না, নিজের টীমের অন্য অফিসারদেরও বারণ করে দেবেন"।
এবারেও সুবিমলবাবু কিছু বলার আগে আদিত্য কথাটা বলে, নীলাদ্রি অগ্নিদৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলে "কেন কি করবেন? তদন্তের জন্য যা করা দরকার সেটা আমি আর আমার টীম করবো"।
"তাহলে তার ফল ভোগ করতেও তৈরী থাকবেন আপনি ক্ষমতার কথা বললেন না আমি অযথা ক্ষমতা দেখাতে বা তার অপপ্রয়োগ করতে পছন্দ করি না করিও না কিন্তু যদি দরকার পরে তাহলে করতে পিছপাও হই না"
"আপনি একজন অনডিউটি পুলিশ অফিসারকে থ্রেট করছেন এই অপরাধে আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারি"
"আপনার অফিসার আমার বোনকে বিরক্ত করেছে কাজটা ঠিক করেনি প্রথম ভুল ভেবে ছেড়ে দিলাম নেক্সট টাইম ছাড়বো না"
"আপনি.."
নীলাদ্রি চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু এবারেও কথা শেষ করতে পারে না কারণ আদিত্য তাকে থামিয়ে নিজে কথা বলতে শুরু করেছে, "আপনি আমার সাথে যা খুশি করতে পারেন কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমার বোনকে যদি কেউ কষ্ট দেয় তাহলে তার জন্য অশেষ দুর্গতি আছে, আমার বোনের খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি"।
"আপনার বোনের উপরেও আমাদের সন্দেহ আছে"
"ও নির্দোষ"
"সেটা আপনার কথা"
"এটাই সত্যি"
"সত্যিটা আমি খুঁজে বার করবো
"আমিও সেটাই চাই কিন্তু তার জন্য আমার বোনকে যদি কষ্ট পেতে হয় তাহলে আমি আপনাকেও ছেড়ে কথা বলবো না"
"আর যদি আমিও ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাই তাহলে আমিও ছেড়ে দেবো না"
"গুড লাক"
"লাক আপনাদের দরকার, গুড বাই" বলে আর অপেক্ষা না করে নীলাদ্রি বেরিয়ে গেল।
সুবিমলবাবু একটুক্ষণ চুপ করে নীলাদ্রির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন "লোকটা সুবিধার নয় মনে হচ্ছে ,যাকগে আমার সাথে কি দরকার বলো"।
"প্রীতি আমাকে সব বলেছে সেই বিষয়েই কথা বলতে এসেছিলাম"।
"কিন্তু আমি কি বলবো তোমাকে আমার তো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই হাসপাতালে এরকম একটা জঘন্য কারবার চলছিল"
"চলছিল নয় চলছে আর আপনি বিশ্বাস না করলেই সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না"
"সেটা ঠিকই বলেছো তুমি, পুলিশ তো আমাকে এমনকি অদ্রিকে পর্যন্ত সন্দেহ করছে"
"আপনি তো অনেকদিন ধরেই এই হাসপাতালে আছেন"
"হ্যাঁ তা আছি"
"এখানে কে এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?"
সুবিমলবাবু প্রশ্নটা শুনে বেশকিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন "দেখো প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলাটা হয়তো ঠিক হবে না তবে কয়েকজন ডাক্তার যে জড়িয়ে আছেন এটা তো নিশ্চিত সাথে নার্স আর স্টাফরাও থাকতে পারে"
"থাকতে পারে নয় আছে কিন্তু কোন ডাক্তারদের আপনি সন্দেহ করেন"
"মূলত দুজনকে ডক্টর অধিকারী আর ডক্টর মিত্র।"
"এদের দুজনকে সন্দেহ করার কারণ?"
"এদের হাবভাব, চালচলন কথাবার্তা সবকিছুই অদ্ভুত ধরনের বিশেষ করে ডক্টর মিত্র উনি এখানে আমার থেকে জুনিয়র কিন্তু হাবভাব যেন উনি আমার বস, অবশ্য পিছনে পলিটিক্যাল সাপোর্ট থাকলে সবারই ওরকম হয়"
"পলিটিক্যাল সাপোর্ট?"
"হ্যাঁ, পলিটিক্যাল কানেকশনের জন্যই এখানে জয়েন করতে পেরেছেন এর আগে যেখানে করতেন সেখানে যেন কি একটা ঝামেলা হয় ফলে ওখানের চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হন তারপর এখানে"
"আগে কোথায় করতেন?'
"নট শিওর বাট শুনেছি পুরুলিয়ার কোনো এক গ্ৰামে"
"গ্রামের নামটা জানেন?"
"না, সরি"
"
ইটস্ ওকে আর ডক্টর অধিকারী?"
"উনিও একই ধরনের আমার তো সন্দেহ হয় ওনার আদৌ ডাক্তারি পড়া আছে কিনা'
"সে কি কথা?'
"হ্যাঁ, ওনার কোনো এক রিলেটিভ রুলিং পার্টিতে আছেন তাই"
"কিন্তু শুধু এইজন্যই কি ওনাদের উপর সন্দেহ?
"না, একবার ওনাদের কিছু কথাবার্তা আমি শুনে ফেলেছিলাম যেখানে ওনারা প্রচুর টাকা ইনকামের বিষয়ে আলোচনা করছিলেন"
"তাতে কি?"
"জানিনা আদিত্য হয়তো আমার সন্দেহ ভুল তবে তুমি জিজ্ঞেস করলে তাই বললাম আর আমি তো আগেই বলেছি প্রমাণ ছাড়া বলাটা ঠিক হবে না"
দুজনের কথোপকথন হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলতো কিন্তু একজন নার্স এসে সুবিমলবাবুকে একটা এমার্জেন্সির বিষয়ে বলায় উনি আদিত্যর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আদিত্যও উঠে পড়লো মাথার মধ্যে চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে এমন সময় "দাদা তুই এখানে?" শুনে ফিরে দেখে তার আদরের বোন দাঁড়িয়ে আছে সাথে অদ্রিজা দুজনের মুখই গম্ভীর, আদিত্য বোনের কাছে যায় শান্ত স্বরে বলে,
"হ্যাঁ ওই সুবিমলবাবুর কাছে এসেছিলাম একটু দরকার ছিল তা তোরা কোথাও গিয়েছিলি?"
"হ্যাঁ, এইসময় খালি থাকায় দুজনে বাইরে গিয়েছিলাম একটু চা খেতে"
"বেশ, তা মুখ গম্ভীর কেন? এখনও চিন্তা করছিস বলেছি তো আমি আছি"
এবারে প্রীতির মুখে একটু শুকনো হাসি দেখা গেল, আদিত্য দেখে অদ্রিজার মুখে তখনও হাসি নেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, "আপনিও চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে আপনি আর সুবিমলবাবু যে নির্দোষ সেটা আমি জানি তাই যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না'
অদ্রিজা আজ এই প্রথম চোখ তুলে তাকালো আদিত্যর দিকে এইটুকু আশ্বাস পেয়েই সে যেন অনেকটা হাল্কা হয়েছে বললো "আপনি বিশ্বাস করেন যে আমরা নির্দোষ?"
"করি, এবং আমার বিশ্বাস আসল অপরাধী খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে তাই চিন্তা করবেন না"
"থ্যাংকস"
"আরেকটা কথা আপনারা ডাক্তার, সাধারণ মানুষের কাছে ভগবানের পরেই আপনাদের স্থান তাই আপনাদের ব্যাক্তিগত জীবনে যাই ঘটুক খেয়াল রাখবেন যেন তার প্রভাব আপনাদের পেশায় না পরে, এটা শুধু আপনাদের পেশা নয় মানবিক কর্তব্য এটা তোকেও বলছি প্রীতি"
"মনে থাকবে দাদা"
"ওইদিকে দেখলাম পেশেন্টের ভিড় বেশী কয়েকজনকে দেখলাম রীতিমতো কষ্ট পাচ্ছেন বোধহয় ওই ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার এখনও আসেননি যদি পারিস তো সেগুলো অ্যাটেণ্ড কর"
"ঠিক আছে দেখছি দাদা"
"গুড আমি চলি আর যদি কোনো সমস্যা হয় সোজা আমাকে ফোন করবি ওকে?"
"ওকে"
"বাই"।
বোনের মাথায় স্নেহ ও সান্ত্বনা মিশ্রিত হাত বুলিয়ে আদিত্য বেরিয়ে আসে বাইরে রাখা নিজের জিপের কাছে এসে জিপে উঠতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পায়,
"মিস্টার আদিত্য যদি কিছু মনে না করেন আমাকে একটু থানায় ড্রপ করে দেবেন?"
আদিত্য ঘুরে দেখে একটু আগে দেখা ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল দাঁড়িয়ে আছেন এবং তিনিই কথাটা বলেছেন।
"আপনি?" আদিত্য বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, একটু হাল্কা হেসে নীলাদ্রি বলে "আমার জিপটা খারাপ হয়ে গেছে, মেকানিক আর নতুন জিপ আসতে কিছুটা সময় লাগবে তাই আপনি যদি একটু লিফট্ দেন"
"আর যদি না দিই?"
"কি আর করবো এখানেই অপেক্ষা করবো"
দুজনে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো আদিত্যর চোখে গাম্ভীর্য অপরদিকে নীলাদ্রির চোখে হাল্কা হাসি, একটু পরে আদিত্যই মুখ খুললো "আসুন"।
"থ্যাংকস"বলে নীলাদ্রি ড্রাইভারের পাশের সিটে আদিত্যর পাশে বসলো, যেতে যেতে দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো এমনকি মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জ পাল্টা চ্যালেঞ্জও হলো একসময় থানার সামনে এসে আদিত্য জিপ দাঁড় করালো। নীলাদ্রি জিপ থেকে নামতে যাবে এমন সময় আদিত্য একটা প্রশ্ন করলো "এবার নিজের পুরো পরিচয়টা দিন"।
নীলাদ্রি নামতে গিয়েও থেমে গেল আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো "পুরো পরিচয়?"।
"শুধুমাত্র থানার ইনচার্জ? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় বরং অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ পুলিশ এণ্ড সন অফ পুলিশ কমিশনার শশাঙ্ক সান্যাল, তাইতো?"
নীলাদ্রি বিষ্ময়ভাবটা দারুণভাবে একটা হাসি দিয়ে ঢেকে বললো "সব খবরই পেয়ে গেছেন দেখছি"।
"তা পেয়েছি"
"কিভাবে জানতে পারি?"
"আপনারও নিশ্চয়ই অনেক ইনফর্মার আছে আপনি তাদের নাম পরিচয় অন্যের কাছে প্রকাশ করেন?"
"বুঝলাম, এবার নিজেরও আসল পরিচয়টা দিন"
নীলাদ্রি লক্ষ্য করলো কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্য একটু যেন চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল তার মুখ এখন আগের থেকে অনেক বেশী গম্ভীর হয়ে গেছে, আদিত্য বললো "মানে?"
"মানে আবার কি আমার আসল পরিচয় আপনি জানেন এবার আপনারটা দিন"
"আদিত্য সিংহ রায়, এটাই আমার পরিচয়"
"এটা তো নাম, আমি পরিচয় জানতে চেয়েছি"
"থানা এসে গেছে"
আদিত্যর কথা শুনে নীলাদ্রি আর কিছু বললো না একটু হেসে জিপ থেকে নেমে গেল তবে থানার ভিতরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বললো "চিন্তা নেই আমাদের আবার দেখা হবে তখন না হয় দেবেন"। আদিত্য আরেকবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো "গুড বাই অফিসার", কথাটা বলে জিপ ঘুরিয়ে চলে যায় পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাদ্রি একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্টরে বললো "আপনি বলুন আর নাই বলুন আমি জানবোই"।
এই ঘটনার পর বেশকিছুদিন কেটে গেছে আদিত্য জানতে পেরেছে যে পুলিশ আর প্রীতি বা সুবিমলবাবুর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি শুধু একদিন একবার নীলাদ্রি একা এসেছিল প্রীতির সাথে দেখা করতে, রাতে প্রীতি বাড়িতে ফিরলে এব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করে আদিত্য উত্তরে প্রীতি তাকে এইবলে আশ্বস্ত করে যে নীলাদ্রি তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি শুধু কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছে আর প্রীতি তার উত্তর দেওয়ায় চলে গেছে। আরেকবার আরেকটা খবর পায় আদিত্য এটা অবশ্য অদ্রিজার থেকে পায় একদিন নিজেদের ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে হাসপাতালের সামনে দিয়ে ফেরার সময় হাসপাতালে ঢুকেছিল উদ্দেশ্য ছিল বোনকে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরবে কিন্তু গিয়ে প্রীতিকে খুঁজে পায়নি, সেখানে অদ্রিজার সাথে দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞেস করায় সে জানায় প্রীতি নীলাদ্রি সান্যালের সাথে গেছে তবে নীলাদ্রি ওকে গ্ৰেপ্তার করেনি দুজনে বোধহয় ঘুরতে গেছে।
খবরটা শুনে একটু অবাকই হয় আদিত্য কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার বোন সবকথা তাকে বলে সেখানে তার যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ হয়ও তাহলে সেই কথাটা দাদাকেই সবার আগে বলবে এটাই আদিত্য বিশ্বাস করতো কিন্তু এখন সে কথাটা লুকিয়েছে দেখে একটু খারাপ লাগে তার। পরে প্রীতিকে নিজের হাসপাতালে যাওয়ার কথাটা বলে কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করতে প্রীতি আসল কথা লুকিয়ে যাহোক একটা কিছু উত্তর দিয়ে সরে পরে, আদিত্য মনে মনে ভাবে তার বোন হয়তো ভয় পাচ্ছে।
পুরো নর্থবেঙ্গলে হইচই পরে গেছে, এতদিন ধরে এখানে যে হিউম্যান অর্গান স্মাগলিংএর কারবার চলছিল তার তদন্তে পুলিশ সফল হয়েছে এবং এই তদন্তকারী দলের নেতা আর কেউ নয় স্বয়ং নীলাদ্রি সান্যাল। তদন্তে মূল অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ সংগ্ৰহ করেছেন তিনি কিন্তু এই অপরাধ চক্রের মূল হোতাকে এখনও ধরতে না পারলেও পুলিশ তার কয়েকজন অনুচর সহ গ্ৰেপ্তার করেছে আর এই চক্রের মাথা আর কেউ নন প্রতাপ সরকার নামটা শুনে আদিত্য অবশ্য খুব বেশি অবাক হয়নি কারণ শুরু থেকেই তার মনে এই একটা নামই ঘুরছিল তবে অবাক করেছে অন্য একটা বিষয় প্রতাপ সরকারকে সে যতটুকু চিনেছে তাতে সে জানে প্রতাপ সরকার প্রমাণ রেখে কাজ করার লোক নয় এমনকি তার বিরুদ্ধে যদি কেউ সাক্ষী দিতে চায় তাহলে তাকেও আর বাঁচিয়ে রাখে না তাহলে? আদিত্যর মনে হয়েছে যে প্রমাণগুলো পুলিশ আদালতে পেশ করেছে সেই প্রমাণগুলো যেন অতি সহজেই পুলিশের হাতে চলে এসেছে প্রতাপবাবু অবশ্য এখনো পলাতক তবে তার পরিবারকে পুলিশের নজরবন্দিতে রাখা হয়েছে সবকিছু পরিষ্কার তবুও কোথাও যেন একটা খটকা লাগে আদিত্যর তবে যেহেতু তার বোন এবং সুবিমলবাবুরা পুলিশের তরফ থেকে ক্লিনশীট পেয়ে গেছে তাই আর সে নিয়ে মাথা ঘামায় না, তবে ঘামালেই বোধহয় ভালো করতো তাহলে হয়তো আবার তার ব্যাক্তিগত জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতো না।
কিছুদিন পরে একদিন রাতে ডিনারের পরে হটাৎ অতীন্দ্রবাবু আদিত্যর রুমে আসেন আদিত্য তখন একা নিজের রুমে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল ,শুধু বসেছিল বললে অবশ্য ভুল বলা হবে সে তখন নিজের ফেলে আসা জীবনের এক ভয়াবহ স্মৃতির মধ্যে ডুবে ছিল যতই সে এটা ভোলার চেষ্টা করে সে ভুলতে পারে না একাকী কিছুক্ষণ থাকলেই চোখের সামনে সে স্মৃতি ভেসে ওঠে, ঘুম তো প্রায় আসেই না এটাতেই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
অতীন্দ্রবাবুর ডাকে চোখ খুলে দেখে তিনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অতীন্দ্রবাবুকে ভিতরে ডাকে। অতীন্দ্রবাবু ভিতরে এসে বলেন "তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল"
"বলুন" কথাটা বলে আদিত্য বিছানার উপরেই বসার জায়গা ছেড়ে দেয়, অতীন্দ্রবাবু সেখানে বসে আদিত্যকে বসতে বলেন আদিত্য বসলে তিনি একটা প্রশ্ন করেন "আচ্ছা এই পুলিশ অফিসার নীলাদ্রিকে তোমার কেমন ছেলে বলে মনে হয়?"
প্রশ্নটা শুনে আদিত্য বেশ অবাক হয় সে বলে "কেমন ছেলে মানে? মানে হটাৎ এই প্রশ্ন?"
অতীন্দ্রবাবু একটু দোনোমোনো করে বলেন "আসলে প্রীতি আমাকে একটা কথা বলেছে"।
"কি কথা?"
"আসলে ও বলেছে ওর নাকি নীলাদ্রিকে পছন্দ আর নীলাদ্রিও নাকি ওকে পছন্দ করে"
খবরটা আদিত্যর কাছে নতুন না হলেও কথাটা শুনে আরো একবার মনে মনে ধাক্কা খায় আদিত্য বিগত সাত বছর ধরে তার বোন সবকথা বাবা-মায়ের আগে তাকেই জানায়, কিন্তু এখন শুধু যে কথা লুকোচ্ছে তাই নয় তাকে সবকথা বলছেও না তবুও নিজেকে সামলে বলে "হাসপাতালের কেসটা চলার সময়েই খোঁজখবর নিয়েছিলাম ছেলেটা সৎ, নির্ভীক, কর্মঠ, চরিত্র সংক্রান্ত কোনো বদনামের খবর পাইনি"
"এখানে তোমাকে আরেকটা কথা বলি আদিত্য নীলাদ্রির বাবা শশাঙ্ক যিনি বর্তমানে পুলিশ কমিশনার তিনি আমার পূর্ব পরিচিত, সুবিমলের মতো কাছের বন্ধু না হলেও বন্ধই বলতে পারো"।
"বাহঃ তাহলে তো আর কোনো কথাই থাকে না তবে একটা ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকছে"
"দুশ্চিন্তা, কি ব্যাপারে?"
"বললাম না নীলাদ্রি সৎ এবং নির্ভীক"
"তাতে কি?"
"সেটাই তো চিন্তার খবর পেয়েছি কোথাও ক্রাইমের গন্ধ পেলেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা সে যতই বিপদের আশঙ্কা থাকুক আর এই ধরনের সৎ অফিসাররাই বেশি বিপদে পড়ে"।
"সেটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো তবে কি বলোতো একেই দুজনের দুজনকে পছন্দ তার উপর ওর বাবাকেও আমি চিনি কাজেই"
"প্রীতি যদি ওখানে সুখী থাকে তাহলে আমি আপত্তি করবো কেন? আমার আপত্তি নেই"
"তাহলে শশাঙ্ককে হ্যাঁ বলে দিই বলো, আসলে শশাঙ্কই আমাকে ফোন করে প্রস্তাবটা দিয়েছিল আমি তোমার সাথে কথা বলবো বলে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলিনি"।
"বললাম তো প্রীতি যদি সুখী থাকে তো আমার আপত্তি নেই"।
"ঠিক আছে আমি শশাঙ্কর সাথে কথা বলবো, আমাকে কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে হবে তারপর ফিরে এসে নাহয় বিয়ের সব কাজকর্ম শুরু করা যাবে, কি বলো?"
"বেশ তো"।
অতীন্দ্রবাবু চলে যাবার পরে আদিত্য আবার একা হয়ে যায় তার ঠোঁটের কোণে এক বিষন্ন হাসি দেখা যায় সে বোঝে কোনো অজ্ঞাত কারণে আতর বোন তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে যদিও কারনটা তার অজানা, সে ঘর ছেড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে ছাদে উঠে যায় তারপর অভ্যাসমতো একটা সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে থাকে।
কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কেটে যায় অতীন্দ্রবাবু শহরের বাইরে গেছেন তাই নর্থবেঙ্গলের সিংহ রায়দের ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজের চাপ একা আদিত্যকে সামলাতে হচ্ছে, মাঝে একবার মনোহরবাবু উমাদেবীকে একটা প্রস্তাব করেছিলেন যে কিছু কাজ মলয়ের সাথে ভাগ করে নিতে এতে আদিত্যর উপর চাপ কমবে কিন্তু উমাদেবী কিছু বলার আগেই আদিত্য এই বলে মানা করে দেয় যে "মলয় এখনও তৈরী নয় আর এইকাজ আমার জন্য এমন কিছু চাপের নয় একাই সামলাতে পারবো, মলয়কে যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটাই ওকে ভালোভাবে সামলাতে বলুন"।
এরপর মনোহরবাবু এবং দুজনেই চূপ করে গেলেও দুজনের চোখেই একটা রাগী দৃষ্টি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল যদিও ব্যাপারটা আদিত্যর চোখ এড়ালো না পরক্ষণেই আদিত্যর মনে পড়লো প্রথমদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে প্রীতিকে দেখে দুজনের চোখের লোভী দৃষ্টি, কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে বোঝাতে পারবে না বলে আদিত্যও চুপ করে রইলো।
রাতে আদিত্য নিজের রুমে বিছানায় বসে চিন্তা করছিল কিভাবে এই বাপ-ব্যাটাকে বাড়ি থেকে দূর করা যায় আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে এরা দুইজন ঠিক সুবিধার লোক নয় কেন যে ওরকম মনে হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারে না আদিত্য, অনেক চেষ্টা করেও ওদের এখানে আসার আগের কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি এখানে আসার পরেও এমন কিছু করেনি যাতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় তবুও আদিত্যর মন থেকে সন্দেহটা যায় না।
বিছানায় বসে এইসবই ভাবছিল এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে ফোনটা কানে দিয়ে যা শুনলো তাতে একটা শব্দই বেরোলো ওর মুখ থেকে "হোয়াট?"। আর বিছানায় বসে থাকা হলো না কোনোমতে পোশাক পাল্টিয়ে দ্রুত পায়ে নীচে নেমে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আদিত্যর জিপ যখন এনজেপি স্টেশনের পথে এক এক পাহাড়ি খাদের ধারে গিয়ে থামলো তখন সেখানে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে, স্থানীয় লোকজনের ভিড় সাথে পুলিশের লোক তো আছেই, তাদেরই মধ্যে একজন আদিত্যকে দেখে এগিয়ে এল, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো "মিস্টার সিংহ রায় আপনি এখানে?"।
আদিত্য পাল্টা করমর্দন করে সে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো "কিভাবে হলো?"।
"কুয়াশার জন্য বোধহয় লরিটা দেখতে পায়নি একেবারে পিছন থেকে এসে ধাক্কা মেরেছে"।
"কুয়াশা?" আদিত্যর গলায় বেশ অবাক ভাব, সে নিজেও গাড়ি চালিয়ে এসেছে কুয়াশা কিছুটা আছে ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘন কুয়াশা নয় যে একটা গাড়ির চালকের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হবে, সে আবার জিজ্ঞেস করে "কেউ বেঁচে আছে?"
"পুরো গাড়িটা তাদের সব আরোহী সহ খাদে পড়ে গেছে তারপরে কি কারো বেঁচে থাকার চান্স থাকে?"
কথাটা শুনে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল আদিত্যর সে জিজ্ঞেস করলো "লরিটা?"
"সেটা এখনো ধরা যায়নি তবে খোঁজ চলছে"
"তারপরেও আপনি বলছেন এটা অ্যাক্সিডেন্ট?"
আদিত্যর প্রশ্নের উত্তরে অফিসারটি কিছু বলার আগেই আরো একটি পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে "তাহলে কি মিস্টার আদিত্য সিংহ রায়ের মনে হয় এটা খুন?"
শান্ত অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে কথাগুলো বললো নীলাদ্রি, একটু থেমে আবার বলে "যেদিন এই পুরো স্মাগলিং র্যাকেটটাকে শেষ করতে পারবো সেদিন আমি শান্তি পাবো তার আগে নয়"।
"আমি জানি তুমি পারবে, তোমার উপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে,কিন্তু সাবধানে কারণ এবার ওই র্যাকেটের মাথায় যারা বসে আছে তারা সতর্ক হয়ে যাবে তাই"
"যতই সতর্ক হোক ওদের পরিণতি হবে হয় জেলের ভিতরে আর নাহয় আমার গুলিতে মরবে"
"তোমার থেকে এটাই আশা করেছিলাম, আরো একটা ইনফরমেশন আছে তোমার জন্য"
"কি স্যার?"
"আমাদের নিজস্ব সোর্স খবর দিয়েছে যে এই স্মাগলিং র্যাকেটের মেইন মাথা বর্তমানে এই এলাকাতেই আছে"
"এটা তো জানা কথাই, এই কাজের মাথা প্রতাপ সরকার তো এই এলাকার বহুদিনের বাসিন্দা"
"উঁহু তুমি ভুল করছো নীলাদ্রি"
"মানে?"
"আমার সোর্সের ইনফরমেশন অনুযায়ী এই গ্যাংএর মেইন মাথা অন্য লোক, প্রতাপ সরকার এই এলাকায় ওদের এজেন্ট মাত্র, আসল যে সে নাকি এই এলাকায় এসেছে"
"কে সে?"
"সেটা এখনো জানতে পারিনি তবে আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবো। পুরো উত্তরবঙ্গ ছাড়াও বাংলাদেশ, নেপাল ,ভুটান, সবজায়গাতেই সে তার শুঁড় ছড়িয়েছে"
"ঠিক আছে স্যার সব শুঁড় কেটে দেবো"
"আরেকটা খবর আছে"
"বলুন"
"বিগত কয়েকবছরে এই এলাকায় আরো একটা নাম উঠে এসেছে তবে ক্রিমিনাল নয় বরং উল্টো বলতে পারো প্রতাপ সরকারের শত্রু সে"
"কে?"
"আদিত্য, আদিত্য সিংহ রায়"
নামটা শুনে যেন একটু চমকে উঠলো অফিসার নীলাদ্রি সান্যাল, তারপর নিজেকে সামলে বললো "কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব, আদিত্য তো."
"কিভাবে সম্ভব এখনো জানিনা, কিন্তু সম্ভব যে হয়েছে সেটা তো সত্যি"
"আপনি দেখেছেন?"
"দেখেছি"
"কিছু বুঝতে পেরেছেন?"
"ছেলেটা অসম্ভব ধূর্ত, তাছাড়া নিজের চারিপাশে গাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে রেখেছে কাউকেই সে দেয়াল ভাঙতে দেয়না"
"আর?"
"নিজেদের এলাকায় রবিন হুড বলতে পারো খুব নাম ডাক খাতির আছে ওখানকার লোকেদের মধ্যে, এছাড়া."
"এছাড়া?"
"খবর পেয়েছি কিছুদিন আগে এক সকালে মর্ণিং ওয়াক করার সময় প্রতাপ সরকারের ছেলেকে কয়েকজন গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় যদিও সেইদিনই আবার ছেড়েও দেয় আবার এদিকে সেইদিন ওই সকালেই আদিত্যকে সরকার ভিলাতে দেখা গেছে"
"প্রতাপ সরকার ডায়রী করেছিল?
"না, সেখানেই খটকা দুজনের মধ্যে যে শত্রুতা এটা পুরো নর্থবেঙ্গল জানে অথচ নিজের ছেলের ক্ষেত্রে প্রতাপ সরকার একদম চুপ, অবশ্য এটাও ঠিক সেইদিনের ঠিক আগের রাতে সিংহ রায় প্যালেসে কয়েকজন আততায়ী গভীর রাতে হামলা করে, তাতে আদিত্য আহত হয়"
"আপনার ধারণা সেই হামলার প্রতিশোধ নিতেই প্রতাপ সরকারের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল? এবং সেটা করেছিল আদিত্য"
"ঠিক তাই কিন্তু কথা হলো তাহলে আবার অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দিল কেন?"
"বোধহয় এই আদিত্য নিজের ক্ষমতা দেখাতে গিয়েছিল তাই, থ্রেট করে এসেছে বা অন্য কোনো ডিল হয়েছে ওদের মধ্যে"
"হয়তো"
"ঠিক আছে আমি দেখবো ব্যাপারটা"
"এই কাজটা হয়তো তোমাকে অফ ডিউটিও করতে হতে পারে"
"তাতে কোনো প্রবলেম নেই স্যার"
"ভেরি গুড তাহলে কাজে লেগে পড়ো, এই নাও আদিত্যর ছবি ক্লোজ স্ন্যাপ নয় কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে"
"ওকে স্যার"
কমিশনারের অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ জিপে উঠে বসেন নীলাদ্রি সান্যাল, তারপর ছবিটা বার করেন, ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্বগোতোক্তি করেন অফিসার নীলাদ্রি সান্যাল,
"খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে মিস্টার আদিত্য সিংহ রায়"।
রাতের ডিনারের আগে সিংহ রায় প্যালেসের ড্রয়িংরুমে রীতিমতো গল্পের আসর বসেছে মনোহরবাবু আর মলয়ই মূলত তাদের এতদিনে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছে আর উমাদেবী এবং অতীন্দ্র বাবু শুনছেন, মনোহরবাবু মাঝে মাঝে এমন সব হাসির কথা বলছেন যে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠছেন শুধুমাত্র আদিত্য একটা সোফায় পা গুটিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে বসে গম্ভীরমুখে ওদের দুজনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। হটাৎ বাইরে গাড়ির আওয়াজ আর একটু পরেই প্রীতি ঘরে ঢোকে সঙ্গে সঙ্গেই আদিত্যর চোখে পরে দুই বাপ-ব্যাটায় চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা হয় আর দুজনের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি এসেই মিলিয়ে যায়।
"কি রে প্রীতি তোর মুখ গম্ভীর কেন কিছু হয়েছে?"
প্রীতির মুখে প্রায় সবসময়ই হাসি থাকে কিন্তু আজ মেয়ের মুখে হাসির বদলে গাম্ভীর্য দেখে উমাদেবী প্রশ্ন করেন কিন্তু প্রীতি সে কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ উপরে নিজের রুমে চলে যায় দেখে উমাদেবী প্রথমে স্বামীর দিকে তাকান অতীন্দ্র বাবু সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন "আহ্ উমা মেয়েটা সবে এসেছে আগে ওকে একটু ফ্রেশ হতে দাও তারপর তোমার জেরা শুরু করো, কেমন?"
"কিন্তু ওর মুখ এত গম্ভীর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে"
"ওহ ডাক্তার, কোনো কঠিন কেস দেখে এসেছে বোধহয়, বললাম তো ও ফ্রেশ হয়ে আসুক তারপর জিজ্ঞেস করো"
"দাদা ঠিকই বলেছে বৌদি, ওকে একটু ফ্রেশ হতে দাও তারপর তোমার প্রশ্ন করবেন"
মনোহরবাবু ও অতীন্দ্র বাবুর কথার সমর্থন করেন, উমাদেবী স্বামীকে আর কিছু না বলে ছেলের দিকে তাকান, আদিত্য বোঝে মা কি বলতে চায় সে সোফা ছেড়ে উঠে পরে, মায়ের কাছে এসে তার সামনে বসে মায়ের দুগালে হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে "ঠিক আছে আমি দেখছি" বলে উপরে চলে যায়।
নিজের রুমে এসে প্রীতি আগে ওয়াশরুমে ঢোকে সেখানে চোখে মুখে য়জল দিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিজের বিছানায় হাঁটু মুড়ে তার মাঝে মাথা গুঁজে বসে থাকে হটাৎ দরজায় টোকা পরে, প্রীতি মাথা তুলে দেখে দাদা দাঁড়িয়ে আছে,
"দাদা তুই?"
"কেন আসা বারণ আছে?"
"না, ভিতরে আয়"
আদিত্য ভিতরে এসে বোনের বিছানার কাছে আসে প্রীতি দাদাকে বসার জায়গা দিয়ে একটু সরে বসে আদিত্য প্রীতির করে দেওয়া জায়গায় বসে নরম স্বরে বোনকে বলে, "মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে চলে এলি, কিছু হয়েছে?"
"না রে দাদা এমনি আজ কঠিন কেস দেখলাম তো তাই একটু"
আদিত্য বোঝে প্রীতি কিছু একটা লুকোচ্ছে তাই আবার বলে,
"মায়ের মনে হয়েছে তোর কিছু একটা হয়েছে আর মায়ের যখন মনে হয়েছে তখন সেটা ভুল হতে পারে না তুই বল যা হয়েছে সেটাই বল, তোর দাদা যতদিন বেঁচে আছে তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না"
"দাদা..আসলে.."
"ভয় পাসনা কি হয়েছে?"
"আজ হাসপাতালে পুলিশ এসেছিল"
"পুলিশ কেন?"
"কোনোভাবে তারা খবর পেয়েছে যে আমাদের হাসপাতালে হিউম্যান অর্গ্যান স্মাগলিং চালু হয়েছে অপারেশনের নামে পেশেন্টের বডি থেকে কিডনি নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া বা কেউ মারা গেলে তার বডি পার্টস নিয়ে নেওয়া"
"তাতে তোর কি? পুলিশ তোর কাছে এসেছিল কেন?"
"পুলিশের সন্দেহের তালিকায় আমার নাম আছে, এর আগেও কয়েকবার এসেছে আজ এসে রীতিমতো জেরার নামে থ্রেট করে গেছে কিন্তু বিশ্বাস কর দাদা আমি এসব কিছু জানিনা আমি এসব কিছু করিনি"
বলতে বলতে প্রীতি দাদার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলে "আমার নামে যদি একবার এই মিথ্যা বদনাম রটে যায় তাহলে তো বাবা-মার.."
প্রীতি কথা শেষ করতে পারে না কাঁদতে থাকে আদিত্য বোনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে "তোদের সিনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিলি?"
"আমার সিনিয়র তো সুবিমল আঙ্কেল, পুলিশ ওনাকেও সন্দেহ করছে উনিও খুব টেনসড্"
"আর এই কথাটা তুই এতদিন আমাকে বলিসনি? আমি কি তোর কেউ হই না?"
"আসলে দাদা আমি তোদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি আর ভয়ও পাচ্ছিলাম"
"ভুলটা আমারই তোর দিকে আরেকটু নজর দেওয়া উচিত ছিল আমার"
"দাদা.."
"ঘাবড়াস না আমি আছি তো কিছু হবে না, কিন্তু তুই আমার থেকে কথা লুকোচ্ছিস বোন?"
"সরি দাদা"
আদিত্য বোনের মুখটা তুলে ধরে চোখ মুছিয়ে বলে "বলেছি না তোর চোখে আমি জল সহ্য করতে পারি না, তুই শুধু হাসবি"।
প্রীতি দাদার বুকে মাথা রাখে, আদিত্য বোনের মাথায় হাত বুলোতে থাকে কিন্তু মুখটা তার কঠিন হয়ে গেছে একটু পর প্রশ্ন করে "আচ্ছা পুলিশের এই সন্দেহ হলো কেন কোনো আইডিয়া আছে তোর?"
"কেউ একজন কমপ্লেন করেছে কে তার পরিচয় পুলিশ গোপন রেখেছে"।
"হাসপাতালে তোর কাউকে সন্দেহ হয় যে এই কাজ করতে পারে কোনো ডাক্তার নার্স বা কোনো স্টাফ?"
"দাদা আমি এখানে নতুন কাকে সন্দেহ করি বলতো?"
"ঠিক আছে বাদ দে আমি দেখে নেবো ও নিয়ে আর ভাবিস না, এবার একটা হাসি দে তো দেখি এখনো, কিন্তু হাসি দেখলাম না তোর মুখে নাকি আমার উপর বিশ্বাস নেই?"
প্রীতি কোনো কথা না বলে দুহাতে দাদাকে জড়িয়ে ধরলো, আদিত্য পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা নাম্বার ডায়াল করলো কিন্তু ওপাশের ফোন বন্ধ দেখে বিরক্ত মুখে আবার পকেটে রেখে দিল।
আজ একটু বেলা করেই হাসপাতালে গেলেন সুবিমল বাবু এমনিতে তিনি প্রতিদিনই সকাল সকালই যান হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের একজন তিনি কত কাজ তার প্রতিদিন এসে আগে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ওখানে ভর্তি থাকা পেশেন্টদের দেখেন তাদের সাথে কথা বলেন, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরেই পুলিশ এসে জেরা করছে কাল তো রীতিমতো থ্রেট করে গেছে পারলে এখনই তাকে ফাঁসিতে ঝোলায়, মনটা তার খারাপ গতকাল বাড়ি ফিরেও চুপচাপ ছিলেন, একজন সৎ মানুষের উপরে যদি এ রকম ক্রাইমের অভিযোগ আনা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার মনটা ভেঙে যায়, সাথে পুলিশ তার মেয়েকেও সন্দেহ করছে।
হাসপাতালে এসে নিজের আলাদা কেবিনে ঢুকেই দেখলেন সেখানে এক অপরিচিত গৌরবর্ণ সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক বসে আছে, তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো বললো "আসুন ডক্টর চক্রবর্তী, সেই কখন থেকে আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম"।
"আপনি?"
সুবিমল বাবু যে এনাকে দেখে অবাক হয়েছেন সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার কথার উত্তরে আগন্তুক যুবকটি একটু হেসে উত্তর দেয় "আমি ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল, এই এলাকার থানার ইনচার্জ"
"তো হটাৎ আমার কেবিনে?"
"কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল"
"কি ব্যাপারে?"
"সেকি সেটা তো আপনার জানা উচিত, কালও তো থানা থেকে লোক এসেছিল"
"যা বলার তা তো বলেছি ওদের"
"তবুও আমি নতুন করে শুনতে চাই"
"আমার নতুন করে কিছুই বলার নেই"
"তাহলে পুরনোগুলোই আরেকবার বলুন"
"কি জানতে চাইছেন আপনি যে আমি এই র ্যাকেটের সঙ্গে জড়িত কি না?তাহলে আমি বারবার একই কথি বলবো আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না"
"আপনার কথা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না আপনি এই হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তারদের একজন আর এখানে এত বড়ো ক্রাইম চলছে অথচ আপনি কিছুই জানতে পারেননি বা বুঝতে পারেননি এটা ঠিক বিশ্বাস হয় না"
"বিশ্বাস করা না করা আপনার হাতে"
"বা এটাও হতে পারে আপনি নিজেই এই ক্রিমিনালদের একজন"
নীলাদ্রির এই শ্লেষ মাখা কথাটার উত্তরে সুবিমল বাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলেন,
"যাকে ক্রিমিনাল বলছেন তার বিরুদ্ধে আপনার কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আছে তো অফিসার?"
আওয়াজটা শুনে সুবিমলবাবু দরজার দিকে তাকালেন, নীলাদ্রি সান্যালও একটু চমকে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকালো, সুবিমলবাবুর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি আগন্তুককে এইসময় এখানে আশা করেননি কিন্তু তাকে দেখতে পেয়ে তিনি সবথেকে বেশী আশ্বস্ত এবং খুশী হয়েছেন, তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে আগন্তুককে বললেন, "আরে আদিত্য যে এসো এসো, এইসময় এখানে?"
"আপনার সাথে একটু দরকার ছিল, কাল রাতে ফোন করেছিলাম কিন্তু আপনার ফোন সুইচড অফ ছিল তাই এখানে চলে এলাম"
আদিত্য সুবিমলবাবুর কথার উত্তর দিয়ে নীলাদ্রির দিকে তাকালো, নীলাদ্রি তখনও চেয়ারে বসে সোজা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে। আদিত্য এবার নীলাদ্রির পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় তার মুখোমুখি বসে একটা পা অপর পায়ের উপরে তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসলো তারপর আবার নীলাদ্রিকে প্রশ্ন করলো,
"কি হলো উত্তর দিলেন না আপনার কাছে প্রমাণ আছে?"
নীলাদ্রি তখনও একদৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে কিছুক্ষণ সেইভাবে তাকিয়ে বললো "আপনি?"
নীলাদ্রির প্রশ্নের উত্তর সুবিমলবাবু দিলেন "পরিচয় করিয়ে দিই ও আদিত্য, আদিত্য সিংহ রায় আর আদিত্য উনি হলেন ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল আমাদের এখানকার থানার ইনচার্জ"
"ওহ তাহলে আপনিই সেই ফেমাস আদিত্য সিংহ রায়? আপনার কথা তো অনেক শুনেছি এই এলাকায় তো আপনার অনেক ক্ষমতা"
"ফেমাস কি না জানিনা তবে হ্যাঁ আমার নাম আদিত্য আর ক্ষমতা বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না তবে এখানকার লোকজন আমাকে ভালোবাসেআমার কথা শোনে, আমাকে ভরসা করে এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? ওনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে?"
"এখনো না, থাকলে ওনাকে আমি.."
"প্রমাণ না থাকলে কাউকে ক্রিমিনাল বলা যায় না এটা আপনাকে কেউ শেখায়নি?"
নীলাদ্রিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আদিত্য কথাটা বললো তার দৃষ্টি এখনও সোজা নীলাদ্রির দিকে, নীলাদ্রিও কম যায়না সেও সোজা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো, "আপাতত সন্দেহ আছে তাই.."
"তাই আপাতত সুবিমলবাবু অভিযুক্ত অপরাধী নয়, দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা নিশ্চয়ই জানা আছে?"
এবারেও নীলাদ্রিকে কথা শেষ করতে দিল না আদিত্য, সবথেকে বড়ো কথা আদিত্যর কথাগুলো যথেষ্ট শ্লেষ মাখা নীলাদ্রির মুখ ধীরে ধীরে রাগে লাল হয়ে উঠছে কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো তারপর সুবিমলবাবুর উদ্দেশ্যে বললো "তদন্ত কিন্তু সবে শুরু হয়েছে আমি কিন্তু আবার আসবো ডক্টর চক্রবর্তী"।
"নিশ্চয়ই আসবেন কিন্তু তদন্তের নামে নিরপরাধদের বিরক্ত করবেন না, নিজের টীমের অন্য অফিসারদেরও বারণ করে দেবেন"।
এবারেও সুবিমলবাবু কিছু বলার আগে আদিত্য কথাটা বলে, নীলাদ্রি অগ্নিদৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলে "কেন কি করবেন? তদন্তের জন্য যা করা দরকার সেটা আমি আর আমার টীম করবো"।
"তাহলে তার ফল ভোগ করতেও তৈরী থাকবেন আপনি ক্ষমতার কথা বললেন না আমি অযথা ক্ষমতা দেখাতে বা তার অপপ্রয়োগ করতে পছন্দ করি না করিও না কিন্তু যদি দরকার পরে তাহলে করতে পিছপাও হই না"
"আপনি একজন অনডিউটি পুলিশ অফিসারকে থ্রেট করছেন এই অপরাধে আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারি"
"আপনার অফিসার আমার বোনকে বিরক্ত করেছে কাজটা ঠিক করেনি প্রথম ভুল ভেবে ছেড়ে দিলাম নেক্সট টাইম ছাড়বো না"
"আপনি.."
নীলাদ্রি চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু এবারেও কথা শেষ করতে পারে না কারণ আদিত্য তাকে থামিয়ে নিজে কথা বলতে শুরু করেছে, "আপনি আমার সাথে যা খুশি করতে পারেন কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমার বোনকে যদি কেউ কষ্ট দেয় তাহলে তার জন্য অশেষ দুর্গতি আছে, আমার বোনের খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি"।
"আপনার বোনের উপরেও আমাদের সন্দেহ আছে"
"ও নির্দোষ"
"সেটা আপনার কথা"
"এটাই সত্যি"
"সত্যিটা আমি খুঁজে বার করবো
"আমিও সেটাই চাই কিন্তু তার জন্য আমার বোনকে যদি কষ্ট পেতে হয় তাহলে আমি আপনাকেও ছেড়ে কথা বলবো না"
"আর যদি আমিও ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ পাই তাহলে আমিও ছেড়ে দেবো না"
"গুড লাক"
"লাক আপনাদের দরকার, গুড বাই" বলে আর অপেক্ষা না করে নীলাদ্রি বেরিয়ে গেল।
সুবিমলবাবু একটুক্ষণ চুপ করে নীলাদ্রির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন "লোকটা সুবিধার নয় মনে হচ্ছে ,যাকগে আমার সাথে কি দরকার বলো"।
"প্রীতি আমাকে সব বলেছে সেই বিষয়েই কথা বলতে এসেছিলাম"।
"কিন্তু আমি কি বলবো তোমাকে আমার তো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই হাসপাতালে এরকম একটা জঘন্য কারবার চলছিল"
"চলছিল নয় চলছে আর আপনি বিশ্বাস না করলেই সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না"
"সেটা ঠিকই বলেছো তুমি, পুলিশ তো আমাকে এমনকি অদ্রিকে পর্যন্ত সন্দেহ করছে"
"আপনি তো অনেকদিন ধরেই এই হাসপাতালে আছেন"
"হ্যাঁ তা আছি"
"এখানে কে এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?"
সুবিমলবাবু প্রশ্নটা শুনে বেশকিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তারপর বললেন "দেখো প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলাটা হয়তো ঠিক হবে না তবে কয়েকজন ডাক্তার যে জড়িয়ে আছেন এটা তো নিশ্চিত সাথে নার্স আর স্টাফরাও থাকতে পারে"
"থাকতে পারে নয় আছে কিন্তু কোন ডাক্তারদের আপনি সন্দেহ করেন"
"মূলত দুজনকে ডক্টর অধিকারী আর ডক্টর মিত্র।"
"এদের দুজনকে সন্দেহ করার কারণ?"
"এদের হাবভাব, চালচলন কথাবার্তা সবকিছুই অদ্ভুত ধরনের বিশেষ করে ডক্টর মিত্র উনি এখানে আমার থেকে জুনিয়র কিন্তু হাবভাব যেন উনি আমার বস, অবশ্য পিছনে পলিটিক্যাল সাপোর্ট থাকলে সবারই ওরকম হয়"
"পলিটিক্যাল সাপোর্ট?"
"হ্যাঁ, পলিটিক্যাল কানেকশনের জন্যই এখানে জয়েন করতে পেরেছেন এর আগে যেখানে করতেন সেখানে যেন কি একটা ঝামেলা হয় ফলে ওখানের চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হন তারপর এখানে"
"আগে কোথায় করতেন?'
"নট শিওর বাট শুনেছি পুরুলিয়ার কোনো এক গ্ৰামে"
"গ্রামের নামটা জানেন?"
"না, সরি"
"
ইটস্ ওকে আর ডক্টর অধিকারী?"
"উনিও একই ধরনের আমার তো সন্দেহ হয় ওনার আদৌ ডাক্তারি পড়া আছে কিনা'
"সে কি কথা?'
"হ্যাঁ, ওনার কোনো এক রিলেটিভ রুলিং পার্টিতে আছেন তাই"
"কিন্তু শুধু এইজন্যই কি ওনাদের উপর সন্দেহ?
"না, একবার ওনাদের কিছু কথাবার্তা আমি শুনে ফেলেছিলাম যেখানে ওনারা প্রচুর টাকা ইনকামের বিষয়ে আলোচনা করছিলেন"
"তাতে কি?"
"জানিনা আদিত্য হয়তো আমার সন্দেহ ভুল তবে তুমি জিজ্ঞেস করলে তাই বললাম আর আমি তো আগেই বলেছি প্রমাণ ছাড়া বলাটা ঠিক হবে না"
দুজনের কথোপকথন হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলতো কিন্তু একজন নার্স এসে সুবিমলবাবুকে একটা এমার্জেন্সির বিষয়ে বলায় উনি আদিত্যর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আদিত্যও উঠে পড়লো মাথার মধ্যে চিন্তাভাবনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে এমন সময় "দাদা তুই এখানে?" শুনে ফিরে দেখে তার আদরের বোন দাঁড়িয়ে আছে সাথে অদ্রিজা দুজনের মুখই গম্ভীর, আদিত্য বোনের কাছে যায় শান্ত স্বরে বলে,
"হ্যাঁ ওই সুবিমলবাবুর কাছে এসেছিলাম একটু দরকার ছিল তা তোরা কোথাও গিয়েছিলি?"
"হ্যাঁ, এইসময় খালি থাকায় দুজনে বাইরে গিয়েছিলাম একটু চা খেতে"
"বেশ, তা মুখ গম্ভীর কেন? এখনও চিন্তা করছিস বলেছি তো আমি আছি"
এবারে প্রীতির মুখে একটু শুকনো হাসি দেখা গেল, আদিত্য দেখে অদ্রিজার মুখে তখনও হাসি নেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, "আপনিও চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে আপনি আর সুবিমলবাবু যে নির্দোষ সেটা আমি জানি তাই যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না'
অদ্রিজা আজ এই প্রথম চোখ তুলে তাকালো আদিত্যর দিকে এইটুকু আশ্বাস পেয়েই সে যেন অনেকটা হাল্কা হয়েছে বললো "আপনি বিশ্বাস করেন যে আমরা নির্দোষ?"
"করি, এবং আমার বিশ্বাস আসল অপরাধী খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে তাই চিন্তা করবেন না"
"থ্যাংকস"
"আরেকটা কথা আপনারা ডাক্তার, সাধারণ মানুষের কাছে ভগবানের পরেই আপনাদের স্থান তাই আপনাদের ব্যাক্তিগত জীবনে যাই ঘটুক খেয়াল রাখবেন যেন তার প্রভাব আপনাদের পেশায় না পরে, এটা শুধু আপনাদের পেশা নয় মানবিক কর্তব্য এটা তোকেও বলছি প্রীতি"
"মনে থাকবে দাদা"
"ওইদিকে দেখলাম পেশেন্টের ভিড় বেশী কয়েকজনকে দেখলাম রীতিমতো কষ্ট পাচ্ছেন বোধহয় ওই ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার এখনও আসেননি যদি পারিস তো সেগুলো অ্যাটেণ্ড কর"
"ঠিক আছে দেখছি দাদা"
"গুড আমি চলি আর যদি কোনো সমস্যা হয় সোজা আমাকে ফোন করবি ওকে?"
"ওকে"
"বাই"।
বোনের মাথায় স্নেহ ও সান্ত্বনা মিশ্রিত হাত বুলিয়ে আদিত্য বেরিয়ে আসে বাইরে রাখা নিজের জিপের কাছে এসে জিপে উঠতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পায়,
"মিস্টার আদিত্য যদি কিছু মনে না করেন আমাকে একটু থানায় ড্রপ করে দেবেন?"
আদিত্য ঘুরে দেখে একটু আগে দেখা ইন্সপেক্টর নীলাদ্রি সান্যাল দাঁড়িয়ে আছেন এবং তিনিই কথাটা বলেছেন।
"আপনি?" আদিত্য বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, একটু হাল্কা হেসে নীলাদ্রি বলে "আমার জিপটা খারাপ হয়ে গেছে, মেকানিক আর নতুন জিপ আসতে কিছুটা সময় লাগবে তাই আপনি যদি একটু লিফট্ দেন"
"আর যদি না দিই?"
"কি আর করবো এখানেই অপেক্ষা করবো"
দুজনে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো আদিত্যর চোখে গাম্ভীর্য অপরদিকে নীলাদ্রির চোখে হাল্কা হাসি, একটু পরে আদিত্যই মুখ খুললো "আসুন"।
"থ্যাংকস"বলে নীলাদ্রি ড্রাইভারের পাশের সিটে আদিত্যর পাশে বসলো, যেতে যেতে দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো এমনকি মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জ পাল্টা চ্যালেঞ্জও হলো একসময় থানার সামনে এসে আদিত্য জিপ দাঁড় করালো। নীলাদ্রি জিপ থেকে নামতে যাবে এমন সময় আদিত্য একটা প্রশ্ন করলো "এবার নিজের পুরো পরিচয়টা দিন"।
নীলাদ্রি নামতে গিয়েও থেমে গেল আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো "পুরো পরিচয়?"।
"শুধুমাত্র থানার ইনচার্জ? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় বরং অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ পুলিশ এণ্ড সন অফ পুলিশ কমিশনার শশাঙ্ক সান্যাল, তাইতো?"
নীলাদ্রি বিষ্ময়ভাবটা দারুণভাবে একটা হাসি দিয়ে ঢেকে বললো "সব খবরই পেয়ে গেছেন দেখছি"।
"তা পেয়েছি"
"কিভাবে জানতে পারি?"
"আপনারও নিশ্চয়ই অনেক ইনফর্মার আছে আপনি তাদের নাম পরিচয় অন্যের কাছে প্রকাশ করেন?"
"বুঝলাম, এবার নিজেরও আসল পরিচয়টা দিন"
নীলাদ্রি লক্ষ্য করলো কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্য একটু যেন চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল তার মুখ এখন আগের থেকে অনেক বেশী গম্ভীর হয়ে গেছে, আদিত্য বললো "মানে?"
"মানে আবার কি আমার আসল পরিচয় আপনি জানেন এবার আপনারটা দিন"
"আদিত্য সিংহ রায়, এটাই আমার পরিচয়"
"এটা তো নাম, আমি পরিচয় জানতে চেয়েছি"
"থানা এসে গেছে"
আদিত্যর কথা শুনে নীলাদ্রি আর কিছু বললো না একটু হেসে জিপ থেকে নেমে গেল তবে থানার ভিতরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বললো "চিন্তা নেই আমাদের আবার দেখা হবে তখন না হয় দেবেন"। আদিত্য আরেকবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো "গুড বাই অফিসার", কথাটা বলে জিপ ঘুরিয়ে চলে যায় পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাদ্রি একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্টরে বললো "আপনি বলুন আর নাই বলুন আমি জানবোই"।
এই ঘটনার পর বেশকিছুদিন কেটে গেছে আদিত্য জানতে পেরেছে যে পুলিশ আর প্রীতি বা সুবিমলবাবুর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি শুধু একদিন একবার নীলাদ্রি একা এসেছিল প্রীতির সাথে দেখা করতে, রাতে প্রীতি বাড়িতে ফিরলে এব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করে আদিত্য উত্তরে প্রীতি তাকে এইবলে আশ্বস্ত করে যে নীলাদ্রি তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি শুধু কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছে আর প্রীতি তার উত্তর দেওয়ায় চলে গেছে। আরেকবার আরেকটা খবর পায় আদিত্য এটা অবশ্য অদ্রিজার থেকে পায় একদিন নিজেদের ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে হাসপাতালের সামনে দিয়ে ফেরার সময় হাসপাতালে ঢুকেছিল উদ্দেশ্য ছিল বোনকে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরবে কিন্তু গিয়ে প্রীতিকে খুঁজে পায়নি, সেখানে অদ্রিজার সাথে দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞেস করায় সে জানায় প্রীতি নীলাদ্রি সান্যালের সাথে গেছে তবে নীলাদ্রি ওকে গ্ৰেপ্তার করেনি দুজনে বোধহয় ঘুরতে গেছে।
খবরটা শুনে একটু অবাকই হয় আদিত্য কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার বোন সবকথা তাকে বলে সেখানে তার যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ হয়ও তাহলে সেই কথাটা দাদাকেই সবার আগে বলবে এটাই আদিত্য বিশ্বাস করতো কিন্তু এখন সে কথাটা লুকিয়েছে দেখে একটু খারাপ লাগে তার। পরে প্রীতিকে নিজের হাসপাতালে যাওয়ার কথাটা বলে কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করতে প্রীতি আসল কথা লুকিয়ে যাহোক একটা কিছু উত্তর দিয়ে সরে পরে, আদিত্য মনে মনে ভাবে তার বোন হয়তো ভয় পাচ্ছে।
পুরো নর্থবেঙ্গলে হইচই পরে গেছে, এতদিন ধরে এখানে যে হিউম্যান অর্গান স্মাগলিংএর কারবার চলছিল তার তদন্তে পুলিশ সফল হয়েছে এবং এই তদন্তকারী দলের নেতা আর কেউ নয় স্বয়ং নীলাদ্রি সান্যাল। তদন্তে মূল অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ সংগ্ৰহ করেছেন তিনি কিন্তু এই অপরাধ চক্রের মূল হোতাকে এখনও ধরতে না পারলেও পুলিশ তার কয়েকজন অনুচর সহ গ্ৰেপ্তার করেছে আর এই চক্রের মাথা আর কেউ নন প্রতাপ সরকার নামটা শুনে আদিত্য অবশ্য খুব বেশি অবাক হয়নি কারণ শুরু থেকেই তার মনে এই একটা নামই ঘুরছিল তবে অবাক করেছে অন্য একটা বিষয় প্রতাপ সরকারকে সে যতটুকু চিনেছে তাতে সে জানে প্রতাপ সরকার প্রমাণ রেখে কাজ করার লোক নয় এমনকি তার বিরুদ্ধে যদি কেউ সাক্ষী দিতে চায় তাহলে তাকেও আর বাঁচিয়ে রাখে না তাহলে? আদিত্যর মনে হয়েছে যে প্রমাণগুলো পুলিশ আদালতে পেশ করেছে সেই প্রমাণগুলো যেন অতি সহজেই পুলিশের হাতে চলে এসেছে প্রতাপবাবু অবশ্য এখনো পলাতক তবে তার পরিবারকে পুলিশের নজরবন্দিতে রাখা হয়েছে সবকিছু পরিষ্কার তবুও কোথাও যেন একটা খটকা লাগে আদিত্যর তবে যেহেতু তার বোন এবং সুবিমলবাবুরা পুলিশের তরফ থেকে ক্লিনশীট পেয়ে গেছে তাই আর সে নিয়ে মাথা ঘামায় না, তবে ঘামালেই বোধহয় ভালো করতো তাহলে হয়তো আবার তার ব্যাক্তিগত জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতো না।
কিছুদিন পরে একদিন রাতে ডিনারের পরে হটাৎ অতীন্দ্রবাবু আদিত্যর রুমে আসেন আদিত্য তখন একা নিজের রুমে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল ,শুধু বসেছিল বললে অবশ্য ভুল বলা হবে সে তখন নিজের ফেলে আসা জীবনের এক ভয়াবহ স্মৃতির মধ্যে ডুবে ছিল যতই সে এটা ভোলার চেষ্টা করে সে ভুলতে পারে না একাকী কিছুক্ষণ থাকলেই চোখের সামনে সে স্মৃতি ভেসে ওঠে, ঘুম তো প্রায় আসেই না এটাতেই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
অতীন্দ্রবাবুর ডাকে চোখ খুলে দেখে তিনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অতীন্দ্রবাবুকে ভিতরে ডাকে। অতীন্দ্রবাবু ভিতরে এসে বলেন "তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল"
"বলুন" কথাটা বলে আদিত্য বিছানার উপরেই বসার জায়গা ছেড়ে দেয়, অতীন্দ্রবাবু সেখানে বসে আদিত্যকে বসতে বলেন আদিত্য বসলে তিনি একটা প্রশ্ন করেন "আচ্ছা এই পুলিশ অফিসার নীলাদ্রিকে তোমার কেমন ছেলে বলে মনে হয়?"
প্রশ্নটা শুনে আদিত্য বেশ অবাক হয় সে বলে "কেমন ছেলে মানে? মানে হটাৎ এই প্রশ্ন?"
অতীন্দ্রবাবু একটু দোনোমোনো করে বলেন "আসলে প্রীতি আমাকে একটা কথা বলেছে"।
"কি কথা?"
"আসলে ও বলেছে ওর নাকি নীলাদ্রিকে পছন্দ আর নীলাদ্রিও নাকি ওকে পছন্দ করে"
খবরটা আদিত্যর কাছে নতুন না হলেও কথাটা শুনে আরো একবার মনে মনে ধাক্কা খায় আদিত্য বিগত সাত বছর ধরে তার বোন সবকথা বাবা-মায়ের আগে তাকেই জানায়, কিন্তু এখন শুধু যে কথা লুকোচ্ছে তাই নয় তাকে সবকথা বলছেও না তবুও নিজেকে সামলে বলে "হাসপাতালের কেসটা চলার সময়েই খোঁজখবর নিয়েছিলাম ছেলেটা সৎ, নির্ভীক, কর্মঠ, চরিত্র সংক্রান্ত কোনো বদনামের খবর পাইনি"
"এখানে তোমাকে আরেকটা কথা বলি আদিত্য নীলাদ্রির বাবা শশাঙ্ক যিনি বর্তমানে পুলিশ কমিশনার তিনি আমার পূর্ব পরিচিত, সুবিমলের মতো কাছের বন্ধু না হলেও বন্ধই বলতে পারো"।
"বাহঃ তাহলে তো আর কোনো কথাই থাকে না তবে একটা ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকছে"
"দুশ্চিন্তা, কি ব্যাপারে?"
"বললাম না নীলাদ্রি সৎ এবং নির্ভীক"
"তাতে কি?"
"সেটাই তো চিন্তার খবর পেয়েছি কোথাও ক্রাইমের গন্ধ পেলেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা সে যতই বিপদের আশঙ্কা থাকুক আর এই ধরনের সৎ অফিসাররাই বেশি বিপদে পড়ে"।
"সেটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো তবে কি বলোতো একেই দুজনের দুজনকে পছন্দ তার উপর ওর বাবাকেও আমি চিনি কাজেই"
"প্রীতি যদি ওখানে সুখী থাকে তাহলে আমি আপত্তি করবো কেন? আমার আপত্তি নেই"
"তাহলে শশাঙ্ককে হ্যাঁ বলে দিই বলো, আসলে শশাঙ্কই আমাকে ফোন করে প্রস্তাবটা দিয়েছিল আমি তোমার সাথে কথা বলবো বলে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলিনি"।
"বললাম তো প্রীতি যদি সুখী থাকে তো আমার আপত্তি নেই"।
"ঠিক আছে আমি শশাঙ্কর সাথে কথা বলবো, আমাকে কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে হবে তারপর ফিরে এসে নাহয় বিয়ের সব কাজকর্ম শুরু করা যাবে, কি বলো?"
"বেশ তো"।
অতীন্দ্রবাবু চলে যাবার পরে আদিত্য আবার একা হয়ে যায় তার ঠোঁটের কোণে এক বিষন্ন হাসি দেখা যায় সে বোঝে কোনো অজ্ঞাত কারণে আতর বোন তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে যদিও কারনটা তার অজানা, সে ঘর ছেড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে ছাদে উঠে যায় তারপর অভ্যাসমতো একটা সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে থাকে।
কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবে কেটে যায় অতীন্দ্রবাবু শহরের বাইরে গেছেন তাই নর্থবেঙ্গলের সিংহ রায়দের ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজের চাপ একা আদিত্যকে সামলাতে হচ্ছে, মাঝে একবার মনোহরবাবু উমাদেবীকে একটা প্রস্তাব করেছিলেন যে কিছু কাজ মলয়ের সাথে ভাগ করে নিতে এতে আদিত্যর উপর চাপ কমবে কিন্তু উমাদেবী কিছু বলার আগেই আদিত্য এই বলে মানা করে দেয় যে "মলয় এখনও তৈরী নয় আর এইকাজ আমার জন্য এমন কিছু চাপের নয় একাই সামলাতে পারবো, মলয়কে যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটাই ওকে ভালোভাবে সামলাতে বলুন"।
এরপর মনোহরবাবু এবং দুজনেই চূপ করে গেলেও দুজনের চোখেই একটা রাগী দৃষ্টি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল যদিও ব্যাপারটা আদিত্যর চোখ এড়ালো না পরক্ষণেই আদিত্যর মনে পড়লো প্রথমদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে প্রীতিকে দেখে দুজনের চোখের লোভী দৃষ্টি, কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে বোঝাতে পারবে না বলে আদিত্যও চুপ করে রইলো।
রাতে আদিত্য নিজের রুমে বিছানায় বসে চিন্তা করছিল কিভাবে এই বাপ-ব্যাটাকে বাড়ি থেকে দূর করা যায় আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে এরা দুইজন ঠিক সুবিধার লোক নয় কেন যে ওরকম মনে হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারে না আদিত্য, অনেক চেষ্টা করেও ওদের এখানে আসার আগের কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি এখানে আসার পরেও এমন কিছু করেনি যাতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় তবুও আদিত্যর মন থেকে সন্দেহটা যায় না।
বিছানায় বসে এইসবই ভাবছিল এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে ফোনটা কানে দিয়ে যা শুনলো তাতে একটা শব্দই বেরোলো ওর মুখ থেকে "হোয়াট?"। আর বিছানায় বসে থাকা হলো না কোনোমতে পোশাক পাল্টিয়ে দ্রুত পায়ে নীচে নেমে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আদিত্যর জিপ যখন এনজেপি স্টেশনের পথে এক এক পাহাড়ি খাদের ধারে গিয়ে থামলো তখন সেখানে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে, স্থানীয় লোকজনের ভিড় সাথে পুলিশের লোক তো আছেই, তাদেরই মধ্যে একজন আদিত্যকে দেখে এগিয়ে এল, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো "মিস্টার সিংহ রায় আপনি এখানে?"।
আদিত্য পাল্টা করমর্দন করে সে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো "কিভাবে হলো?"।
"কুয়াশার জন্য বোধহয় লরিটা দেখতে পায়নি একেবারে পিছন থেকে এসে ধাক্কা মেরেছে"।
"কুয়াশা?" আদিত্যর গলায় বেশ অবাক ভাব, সে নিজেও গাড়ি চালিয়ে এসেছে কুয়াশা কিছুটা আছে ঠিকই কিন্তু এতটাও ঘন কুয়াশা নয় যে একটা গাড়ির চালকের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হবে, সে আবার জিজ্ঞেস করে "কেউ বেঁচে আছে?"
"পুরো গাড়িটা তাদের সব আরোহী সহ খাদে পড়ে গেছে তারপরে কি কারো বেঁচে থাকার চান্স থাকে?"
কথাটা শুনে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল আদিত্যর সে জিজ্ঞেস করলো "লরিটা?"
"সেটা এখনো ধরা যায়নি তবে খোঁজ চলছে"
"তারপরেও আপনি বলছেন এটা অ্যাক্সিডেন্ট?"
আদিত্যর প্রশ্নের উত্তরে অফিসারটি কিছু বলার আগেই আরো একটি পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে "তাহলে কি মিস্টার আদিত্য সিংহ রায়ের মনে হয় এটা খুন?"
I'm the King of Dark
&
I rule over all Devils
D:) D:)