Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
বিপন্ন বার্ধক্য 

 
    অফিস ফেরত মনিকাকে প্রায় রোজ বাপের বাড়ি হয়ে শ্বশুর বাড়ি ফিরে ঘর-সংসার সামলাতে হয় । নিজের বাবা, মা যদিও সুস্থ শরীরে রয়েছেন, কিন্তু মাঝে-মাঝেই বার্ধক্য জনিত সমস্যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে । সেটা মাথায় রেখে মনিকা মনে-মনে ঠিকই করে রেখেছিল, বাবা-মা অসুস্থ হলে বেলেঘাটায় নিজের কাছে নিয়ে আসবে । শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় । 
    এক সময় হলোও তাই । বাবা হঠাৎ বিছানা থেকে পড়ে পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে শয্যাশায়ী হতেই মনিকা আর দেরি করেনি ।
    সন্ধ্যার পর বাপের বাড়ি থেকে ঘরে ফিরেই জয়ন্তকে সব কিছু আগাগোড়া জানিয়ে বলেছিল,
    "আমাকে খুব রূঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে । আমার মায়ের এমনিতে হাটু-কোমরের ব্যাথায় নড়া-চড়া করতে পারে না, তার উপর বাবা হটাৎ শিরদাঁড়া ভেঙ্গে বেড-পেশেন্ট । আমি যেটা বলতে চাই, মা-বাবাকে এ বাড়িতে শিফট করলে আমি অন্তত নিশ্চিন্ত হয়ে যে কটা বছর বাকি আছে, সরকারি অফিসে চাকরিটা বজায় রাখতে পারবো ।"
    "তোমার বাবা, মা-কে আমাদের বাড়ি শিফট করবে ?" জয়ন্ত হতভম্ব হয়ে বলেছিল, "কিন্তু আমার মা এখানে রয়েছে, তার কথা না ভেবে তুমি ---- !"
    জয়ন্তর কথার মাঝে ইন্টারাপ্ট করে মনিকা বলেছিল, "আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই কথাটা বলছি । বলতে নেই, তোমার মায়ের শরীর-স্বাস্থ্য এখনো ভাল । হ্যাঁ, দুবেলা পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া করলে তার কোন চিন্তার কারণ দেখছি না।  কাল-ই আমি খোঁজ-খবর নেব, শুনেছি বেহালায় দু-তিনটে মাঝারি খরচের বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে । দু-এক দিনের মধ্যেই ফাইনাল করে নিতে চাই ।"
    রিটায়ার্ড জয়ন্ত স্ত্রীকে চাপে ফেলতে বলেছিল, "কেনো, তোমার ছোটভাই স্বস্ত্রীক সল্টলেকে তিন কামরার ফ্লাটে রয়েছে । তার-তো উচিৎ নিজের অসুস্থ্য মাকে সঙ্গে রাখা ! আমায় বলার আগে তাকে কথাটা বলেছ ?"
    "হুঁ, তুমি কি ভাবছো আমি বলিনি, কোন লাভ হয়নি ! এক সময় ভাইকে মা আঁচলের তলায় রেখে মানুষ করেছিল, এখন বউয়ের আঁচল চিনেছে ।" নিজের হতাশা কাটিয়ে মনিকা বলেছিল, "মায়ের সব কথা শুনে ভাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যত টাকা লাগবে সে দিতে রাজি, কিন্তু মাকে সঙ্গে রাখা সম্ভব নয় ।"
    "সব মানছি," নিরুপায় হয়ে জয়ন্ত বলেছিল, "তোমার বাবা, মা-কে এখানে এনে রাখলে তুমি যদি শান্তি পাও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই । কিন্তু আমার বৃদ্ধা মাকে ঠেলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে হবে কেন ?"
    "পাঠাতে হবে কেন ?" মনিকা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, "শোনো, আট্যাচড বাথরুমের ঘরটা বাবা, মা-র জন্য ভেবে রেখেছি । বাকি রইলো আমাদের থাকার ঘর । ছেলে আমার ধানবাদ থেকে প্রতি শনিবার রাতে এখানে এসে সোমবার ভোর রাতে ফিরে যায় । তাকে আমি ড্রইং-রুমের মেঝেতে শুতে দেব, ভাবলে কি করে ?"
    জয়ন্ত আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিল, "ঠিক আছে, আস্তে কথা বলো, প্লিজ । মা পাশের ঘরে রয়েছে ।"
    মনিকা স্বামীর প্রাথমিক সম্মতির আঁচ টের পেয়ে আর দেরি করেনি । দু-এক দিন নিজের দায়িত্বে সব কিছু চূড়ান্ত করে পরের দিনই স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল । প্রতিমা দেবী সদ্য সন্ধ্যা আরতি সেরে বিছানায় বসে ছেলেকে দ্বিধাগ্রস্থ হতে দেখে চরম বিস্ময়ে বললেন, "এমন ভাবে চুপ করে রইলি, আমায় কিছু বলবি ?"
    স্ত্রীর কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে জয়ন্ত মায়ের পায়ের পাশে বসে কথাটা ছেঁড়া-ছেঁড়া বলতেই অভিমানের আদ্র-ছোঁয়ায় প্রতিমা দেবীর চোখের কানায় টল-টল করে উঠলো অশ্রু-বিন্দু, এই বুঝি দু-গাল বেয়ে ঝরে পড়বে ! নিজেকে সামলে নিয়ে হতাশ নয়নে বললেন, 
    "এরজন্য কেন এতো চিন্তা করছিস বাবা ? আমি কয়দিন ধরে কানাঘুষো শুনছি । জানি আমায় যেতে হবে, শুধু আমার একটা কথা রাখবি ? আমার রাহুল-সোনাকে শেষ বারের মতো চোখের দেখা দেখে এই বাড়ি ছাড়বো ।"
    জয়ন্ত মায়ের হাতদুটো ধরে অপরাধী কন্ঠে বলেছিল, "তাই হবে মা, নাতিকে দেখার পরই তোমায় পাঠাবো ।"
    মনিকা শনিবার সকাল থেকেই শাশুড়ির ব্যবহৃত সব কিছু গুছিয়ে রাখছে । প্রতিমা দেবীর কোন ভাবান্তর নেই । বিকেল গড়াতেই ধীর-স্থির হয়ে বসে রয়েছেন শেষ বারের মতো নয়নের মণি নাতিকে চাক্ষুস দেখবে ।
    রাত নটা নাগাদ রাহুল বাড়ি ফিরতেই মনিকা তাকে পাশের ঘরে টেনে নিয়ে গেল, তার মন বুঝতে । তারপর, ছেলেকে নিয়ে শাশুড়ির ঘরে ঢুকেই মনিকা বেশ নিশ্চিন্ত মনে বললে, "মা আপনার কথা আমরা রেখেছি । নাতিকে এবার দু-চোখ ভরে দেখুন ।  আপনাকে কাল বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে বলে আমাদের অপরাধ নেবেন না ।"
    রাহুল প্রণাম করে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললে, "ঠাম্মা, তুমি শান্ত মনে আমায় দেখার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছো । তোমাকে কাল এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে, সত্যি করে বলতো, তোমার মন খারাপ হচ্ছে না ?"
    প্রতিমা দেবী নাতির মুখে স্নেহের চুম্বন এঁকে নিরাশ হয়ে বললেন, "তোর সাথে দেখা হলো, আমি নিজের জন্য আর কিছু চাইনা ।"
    "তোমার কিছুই চাইনা ?  কিন্তু আমার অনেক চাওয়ার আছে ।" রাহুল এবার সপ্রতিভ হয়ে মা-কে বললে, "ঠাম্মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ঠিকই । কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে নয়, আমার কাছে । আমি নতুন ফ্লাট নিয়েছি । তোমাদের কোন আপত্তি আছে ?"
    "তার মানে !" মনিকা অবিশ্বাস্য কন্ঠে অভিমান করে বললে, "তোকে আমরা কতো কষ্ট সয়ে মানুষ করে তার এই প্রতিদান দিচ্ছিস !"
    "মা তুমি আমায় জন্ম দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু এই বাড়িতে বড় হওয়ার সাথে-সাথে দেখেছি, তোমরা দুজনে দিনের আলোয় অফিস, সন্ধ্যার পর পার্টি, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব করে কাটিয়েছো । এই ঠাম্মা আমায় মায়ের স্নেহ, বন্ধুর সহচার্য্য দিয়ে বুকে আগলে রেখেছিলেন, আর বলেছিলেন মানুষের মতো মানুষ হতে । আমি স্রেফ সেই কাজটাই করছি মা !"
    "মানবতার কথা বলছিস ? কিন্তু ভেবে দেখেছিস, এই বৃদ্ধাশ্রম বুক করতে বাবাকে কতো টাকা জমা দিতে হয়েছে ?"
    রাহুল ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে মার পানে তাকিয়ে বললে, "বাবা যে টাকাগুলো ওখানে জমা দিয়েছে, থাকতে দাও মা । অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তোমাদের ওই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হতে পারে, তখন নয়তো ওই টাকাটা কাজে আসবে !                               

বরেন দাস

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 01-03-2023, 07:16 AM



Users browsing this thread: 16 Guest(s)