28-02-2023, 09:40 PM
পর্ব:১৯
রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে পুরনো একটা বিল্ডিংয়ের সামনে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া। বাড়ির মেইন গেট তালাবদ্ধ। বাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহুদিন ধরে অযত্নে পড়ে আছে। বাড়িটায় কেউ থাকে না, সেটা দুইজন প্রথম দেখায়ই বুঝে গিয়েছিল। তবুও রুদ্র অনেকটা সময় ধরে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
রুদ্র তার পকেট থেকে কাগজটা বের করে আবার দেখে মিলিয়ে নিলো। হ্যাঁ, এই বাড়িটাই। কাগজে এই যে ঠিকানা লেখা আছে সেটা এই বাড়ির ঠিকানা।
একটা লোক হেঁটে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। রুদ্র তাকে সালাম দিয়ে কাগজটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আসসালামু আলাইকুম আংকেল। এই ঠিকানাটা কি এটাই?"
লোকটা কাগজটা দেখে বলল, "ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, আপনারা ঠিক ঠিকানায় এসেছেন। কিন্তু এখানে তো কেউ থাকে না।"
রুদ্র জানে তারা ঠিক ঠিকানায় এসেছে। বাড়ির গেটের পাশের দেয়ালে যে ঠিকানা ছিল সেটার সাথে কাগজে লেখার ঠিকানা মিলিয়ে দেখেছে। তবুও সে জিজ্ঞেস করলো এটা ভেবে যদি কোনো তথ্য জানা যায়।
"আমাকে তো এই ঠিকানা দিয়ে এখানে আস্তে বলল।" রুদ্র একটু চালাকি করে মিথ্যা বলল।
"আপনাকে তাহলে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। অনেক দিন আগেই এই বাড়িতে যারা ছিল তারা বাড়িটা বিক্রি করে চলে যায়।" বয়স্ক লোকটা বলল।
"কি বলেন?" রুদ্র কৌতুহল হওয়ার ভঙ্গি করলো। সে বাড়িটা দেখেই বুঝেছে অনেক দিন ধরে বাড়িটায় কেউ থাকে না। সে আবার বলল, "ঠিক কতদিন আগে বাড়িটা বিক্রি করে সবাই চলে গেছে?"
"এই ধরুন সাত আট মাস হবে। তারও বেশি হতে পারে। আমার ঠিক মনে নেই।"
"তাহলে তো অনেক দিন আগে।" লোকটার সামনে রুদ্র হতাশ হওয়ার অভিনয় করলো। সে আবার বলল, "তাহলে তরু মেয়েটা আমাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে!" মিথ্যে করে বলে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।
"কি নাম বললেন?"
"তরু! কেনো?"
"এই নামেই একটা মেয়ে এখানে থাকতো।" লোকটা কথাটা বলে আনমনে আবার বলল, "মেয়েটার বাবার নাম যেনো কি?" আস্তে করে বললেও রুদ্র এবং তরু ঠিকই কথাটা শুনতে পেলো।
"তরুর বাবার নাম কি?" রুদ্র এবার লোকটিকে সরাসরি জিগ্যেস করলো।
লোকটি কিছুক্ষণ ভাবলো। ভুলে যাওয়া একটা কথা মনে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটে এলো। সে বলল, "আফজাল হোসেন। হ্যাঁ, এটা আফজাল হোসেনর বাড়ি। লোকটা ভাল মানুষ ছিলো। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। একবার মসজিদে বড় করে মিলাদ দিয়েছিল। উনার মেয়ে অসুস্থ ছিলো, তার সুস্থতা কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলো।" লোকটা এই পর্যন্ত বলে থামলো। সে আবার বলল, "হুট করে লোকটা মসজিদে নামাজ পড়তে আসা বন্ধ করে দিলে, একদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে বাড়িটা বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। লোকটা এভাবে চলে যাওয়াতে খুব খারাপ লেগেছিলো। খুব ভালো মানুষ ছিলো।" লোকটা পরের কথাগুলো আনমনে বললেও রুদ্র এবং রিয়া শুনলো।
"বাড়ি বিক্রি করে কোথায় গেছে আপনি কি জানেন?" রুদ্র আবার জানতে চাইলো।
"কোথায় গেছে তা-তো জানিনা। তবে লোকমুখে শুনেছিলাম মেয়ের চিকিৎসা করানোর জন্যই বাড়িটা বিক্রি করেছে। মেয়েটার চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছে এটাও শুনেছিলাম। আসলে কার কোন কথা সঠিক কেউ জানেনা। লোকমুখে নানা কথা বলা বলি হতো, হঠাৎ এভাবে নিজের বাপদাদার জমি বিক্রি করে চলে যাওয়া পর। কিন্তু একটা সময় পর লোকটাকে সবাই ভুলেই গেলো।"
বয়স্ক লোকটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলছে কিন্তু আজ রুদ্রের সেটা শুনতে ভাল লাগছে। প্রশ্ন করা ছাড়াই লোকটা অনেক তথ্য বলে দিচ্ছে।
"আফজাল হোসেন কোথায় থাকে এখন বলতে পারবেন?"
"সেটা-তো বলতে পারবো না, বাবা।"
"তার পরিচিত কেউ কি এই এলাকায় থাকে?"
"না, তেমন কেউ নেই। আফজাল হোসেনের কোনো ভাই বোন নেই। এছাড়া তেমন কাউকেই চিনিনা আমি।"
"লোকটা কি করতো? কোথায় চাকরি করতো? কিছু কি জানেন?"
বয়স্ক লোকটা হঠাৎ রুদ্রকে ভাল করে লক্ষ করলো। তার মনে সাহসা কিছুটা সন্দেহ জেগেছে। ছেলেটা এতো প্রশ্ন করছে কেনো? সে সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কে? তাকে কেনো খুঁজছেন?"
লোকটার কাছ থেকে এরকম একটা প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই রুদ্র আশা করেছিলো। তাই প্রথম থেকেই সে কিছুটা মিথ্যে বলেছে যাতে করে বানিয়ে একটা গল্প বলতে পারে। সে বলল, "তরু নামের মেয়েটার সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয়। সে-ই আমাকে অনেক দিন আগে এই ঠিকানাটা দিয়েছিলো। তারপর হটাৎ মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর নেই। অনেক চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু পারি নি। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো আমাকে সে বাসার ঠিকানা দিয়েছিল। তাই আজ এখানে খুঁজতে এলাম।" রুদ্র দ্রুত একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে বানিয়ে লোকটাকে বলে দিলো।
"ওহ আচ্ছা।" লোকটা বলল।
লোকটা রুদ্রের কথা বিশ্বাস করলো কি-না সে জানেনা। অবশ্য তার বিশ্বাস অবিশ্বাস, সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। রুদ্র আবার বলল, "লোকটার ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন? প্লিজ, যদি কিছু জেনে থাকেন আমাকে বলুন। আমার খুব উপকার হবে।"
বয়স্ক লোকটা পুরোপুরি রুদ্রের কথা বিশ্বাস করলো না, আবার অবিশ্বাসও করলো না। রুদ্রকে দেখে তার খারাপ মনে হয় নি। সে বলল, "আমি তেমন কিছুই জানিনা, বাবা। জানলে অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করতাম।" লোকটা এবার হঠাৎ তুমি করে রিয়া এবং রুদ্রকে উদ্দেশ্যে করে কথাগুলো বলল।
"এমন কেউ কি আছে, যে খোঁজ দিতে পারবে বলে আপনার মনে হয়।" রুদ্র বলল।
"আমার জানামতে তেমন কেউ নেই।" লোকটা ফ্যাকাসে মুখে উত্তর দিলো।
লোকটা বিরক্ত হচ্ছে রুদ্র বুঝতে পারলো। বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। লোকটা অনেক সময় দিয়েছে তাদের। পুরোটা সময়জুড়ে রিয়া একটা কথাও বলে নি। সে শুধু শুনেছে। রুদ্রের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে সে আরো একবার মুগ্ধ হলো। রুদ্র পরিস্থিতি খুব ভালো ভাবে সামলে লোকটার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলে অনেক কিছু জেনে নিয়েছে।
"আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।" রুদ্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
"তোমাদের সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম।" লোকটা বলল। সে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আবার বলল, "আসসালামু আলাইকুম। ভালো থেকো।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। ধন্যবাদ আংকেল।" রুদ্র সালামের উত্তর দিয়ে বলল।
লোকটা চলে গেলে রিয়া বলল, "কি করবে এখন?"
"বুঝছি না। হয়তো আর কিছুই করার নেই। আর কোনো আশা নেই। ভাগ্যের উপর সবটা ছেড়ে দিতে হবে।" রুদ্র হতাশাজনক ভাবে কথাগুলো বলল। তার মুখ মলিন হয়ে গেছে।
রুদ্রকে এভাবে দেখে রিয়ার খারাপ লাগছে। সে কি-ই বা বলবে? সেও জানে, তরুর খোঁজ পাওয়া এখন অসম্ভব। যদি না তরু নিজ থেকে তার খোঁজ দেয়। কিন্তু তরু কি তা করবে? এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কারো কাছেই নেই। আসলেই সবটা এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে।
"চলো যাওয়া যাক। এখানে থেকে আর লাভ নেই। লোকটা যা জানার সবটাই বলেছে। লোকটা বেশ ভালো ছিল।" রুদ্র মনে মনে লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
"হ্যাঁ, এখনো এরকম মানুষ আছে। তবে সেটা সংখ্যায় খুব কম।" রিয়া বলল।
তারা যাওয়ার জন্য রিকসা খুঁজছিলো। ঠিক তখন রিয়া বলল, "আমার না প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। সকালে না খেয়ে বেরিয়ে গেছি। তুমি এতো সকালে ফোন দিবে ভাবতে পারি নি। তোমার ফোন পেয়ে তারাহুরো করে রেডি হয়ে বেরিয়ে এসেছি। এদিকে এখন দুপুর।"
"তুমি সকালে কিছুই খাও নেই?"
"টেবিলে একটা পরটা ছিল সেটার অর্ধেকটা কোনো রকম খেয়ে পানি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি।"
"ওহ, সরি। আমারই ভুল। তোমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। আসলে...!"
রুদ্রকে কথা শেষ করতে দিলো না রিয়া। সে বলল, "সরি কেনো বলছ? কোনো সমস্যা নেই। সকালে এমনিতে বেশিকিছু খাই না আমি।"
"ওহ আচ্ছা। ডায়েট করছো?"
রিয়া হাসলো। সে বলল, "আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?"
রিয়াকে ভাল করে দেখলো রুদ্র। সে বলল, "হ্যাঁ, তাই-ই মনে হচ্ছে। দিনদিন তো সুন্দরই হচ্ছো!"
"তোমাকে বলেছে! দিনদিন মোটা হচ্ছি।"
"আমি-তো দেখছি না। ঠিকই আছো।"
"তোমাকে আর দেখতে হবে না। চলো, কিছু খেয়ে নেই।"
"আচ্ছা, চলো।"
রিয়া ভেবেছিলো পরিবেশটা গুমোট থাকবে। রুদ্রের মন প্রচন্ড খারাপ থাকবে। কিন্তু না, রুদ্র অনেকটা প্রাঞ্জল। যতটা খারাপ পরিস্থিতি হবে ভেবেছিল রিয়া ততটা হয়নি।
তারা একটা হোটেলে ঢুকে পড়লো। রিয়াকে জিজ্ঞেস করতেই সে সাদামাটা খাবার অর্ডার দিতে বলল। রুদ্র সাদা ভাত, সবজি, সমুদ্রের মাছ আর ডাল অর্ডার দিলো।
"এতোকিছু অর্ডার দিলে?" রিয়া বলল।
"তুমিই তো বললে।" রুদ্র উত্তর দিলো।
"অল্প কিছু অর্ডার দিতে বলেছিলাম।"
"দুপুরের লান্সে কি কেউ নাস্তা করে?"
"আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমি না পারলে তুমি তো আছোই। আমারটা না হয় তুমি খেলে।"
রুদ্র হাসলো। সে বলল, "আচ্ছা, সমস্যা নেই।"
খাবার দ্রুতই চলে এলো। তারা নিরবে খেলো। খাবারের সময় তাদের মধ্যে তেমন একটা কথা হলো না। রুদ্র যতটা পারে হাসিখুশি থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে চায় না, রিয়া বুঝতে পারুক সে আসলে বেশি ভালো নেই।
পুরো পথে তাদের মধ্যে দুই একটা দরকারি কথা ছাড়া তেমন কোনো কথা হলো না। রিয়াও জোর করে কথা বলেনি। দুইজনে নিরব ছিলো। রিয়া যতটা ভেবেছিল, রুদ্র ঠিক আছে আসলে সে ততটা ঠিক নেই। সে এখন বুঝতে পারছে। রুদ্র শুধু ঠিক থাকার বাহানা করে যাচ্ছে।
আজকে রিয়াই রুদ্রকে নামিয়ে দিলো। রুদ্র একবার বলেছিল, সে রিয়াকে পৌঁছে দিবে। কিন্তু সেই বলার জোর ছিলো না। রিয়াও চাচ্ছিলো না রুদ্র তাকে পৌঁছে দিক। রুদ্রকে নামিয়ে দিয়ে সে সেই রিকসা নিয়েই চলে গেলো।
রুদ্র বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তার দাদী ছাড়া এই মুহুর্তে বাসায় কেউ নেই। জাহানারা কাজে, মিলি কলেজে।
রুদ্রের ঘুম ভাঙলো জাহানারা ডাকে। সে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল বলে সে শুয়ে ছিলো। ঘুম ভেঙেই দেখে তার মা চেয়ার টেনে তার পাশে বসে আছে। এক হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুদ্রের খুব ভালো লাগল। কতদিন তার মা তাকে এভাবে আদর করে না। অবশ্য এতে সে অভিমান করে না। সে সবটাই বুঝে, এই পুরো সংসার তার মা'ই সামলায়।
"তোর কি শরীর খারাপ?" জাহানারা জিজ্ঞেস করল।
রুদ্র তার মায়ের হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গালের নিচে রেখে হাতের তালুর উপরে মুখ রেখে শুয়ে রইল। সে বলল, "ভালো লাগছে না। মাথাটা ব্যথা করছে।"
"তোর কি কিছু হয়েছে? আজকাল তোকে অন্য রকম লাগে। সবসময় মন খারাপ করে থাকিস কেনো?"
"কই মন খারাপ করে থাকি?"
"মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া কি এতো সহজ?"
"সরি মা।" আহ্লাদী কন্ঠে রুদ্র বলল। সে আবার বলল, "অনেক কিছু নিয়ে একটু সমস্যায় আছি। সবকিছু সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
"ধৈর্য রাখ। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।" জাহানারা থাকলো, তারপর সে আবার বলল, "যদি আমাকে বলার মত কথা হয় তাহলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারিস। তোর ভালো লাগবে। মন হালকা হয়ে যাবে।"
"আচ্ছা, মা। রুদ্র কথাটা বলে হাসলো।
"দুপুরে খেয়েছিস?"
"হ্যাঁ, খেয়েছি।"
আচ্ছা তাহলে বিশ্রাম কর। আমি যাই, রাতে রান্না করতে হবে।"
"এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকো না প্লিজ। আমার ভালো লাগছে৷"
"আচ্ছা.." বলেই জাহানারা তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
"আমি-তো কেউ না। ভাইয়ার মত করে আমাকে একটুও ভালোবাসো না।"
রুদ্র এবং জাহানারা কথা শুনে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো মিলি দাঁড়িয়ে আছে।
"এদিয়ে আয়।" জাহানারা ডাকলো।
ছোট্ট চড়ুই পাখির মত মিলি ছুঁটে এসে তার মায়ের কোলের মধ্যে ডুকে গেলো। এভাবেই তারা তিনজন কিছুক্ষণ আধো আলো অন্ধকারের মধ্যে রইলো।
সারা বিকাল ঘুমানোর কারণে রুদ্রের রাতে ঘুম এলো না। সে এলোমেলো নানা কাজ করে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে এটা সেটা গুছিয়ে রাখছে। রিয়ার দেওয়া বইটা একবার পড়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কোনো কিছুতে মন বসছে না। অবশেষে সে টেবিলের ড্রয়ার খুলে তরুর সব চিঠিগুলো একে একে বের করলো। সেই চিঠির ভেতর থেকে তরুর পাঠানো শেষ চিঠিটা খুঁজে বের করে সে সেটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো।
বাইরে জোছনার আলোয় ঝলমল করছে। আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশকিছুটা সময় একা চাঁদটাকে দেখলো। তারপর সে সাহস করে তরুর শেষ চিঠিটা খুললো। সে প্রথম লাইন পড়তেই চিঠিতে ডুবে গেলো।
"রুদ্র, কেমন আছিস? আমি ভালো নেই। সত্যি আমি ভালো নেই। তুই কি জানিস, আমার প্রিয় ঘ্রাণ কি? আমি-না ভুলে গেছি। কিন্তু আজকাল আমার মনে হয় হাসপাতালের ফিনাইলের ঘ্রাণই আমার প্রিয়। আমি পাগল হয়ে গেছি ভাবছিস? কি করবো বল? এখন তো হাসপাতালই আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার পুরো জগৎ। এই জগৎটা খারাপ না৷ কিন্তু এখানে শুধু তুই নেই। তুই নেই মানে, সত্যি কোথাও নেই, তোর ছায়াও নেই, তোর আলোও নেই!
যদি এমন একটা পৃথিবী হতো, শুধু তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তাহলে কি এমন ক্ষতি হতো? পরক্ষণেই ভাবি, বড্ড অন্যায় হতো। তোকে একা রেখে সেই আমাকে চলেই যেতে হতো৷ তুই বড্ড খারাপ থাকতি।
আজকাল আমার কেবল মনে হয় জীবনে অনেক ভুল করেছি। এখন তার কোনোটাই শোধরানো সম্ভব না। আর আমি শোধরাতেও চাই না। আচ্ছা, তুই বল, মানুষ হয়ে জন্মেছি সেহেতু জীবনে একটা দুইটা ভুল জেনে বুঝে ইচ্ছে করে না করলে কি হয়? আমার না এতে কোনো আফসোস নেই। বরং এই ভুলগুলো করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ভুল না করলে তোর দেখা পেতাম কি করে? তোর মত একটা ছ্যাবলা ছেলেকে ভালোবাসতাম কি করে?
আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই না রুদ্র? তুই ভুল বুঝিস না, আমি সেই সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবো না। যাকে এতোটা ভালোবাসি তাকে একটু কষ্ট দেওয়াই যায়। কি আমি ভুল বললাম?
রুদ্র, মহাদেব সাহা'র মত করে আজ তোকে বলতে ইচ্ছে করছে, "তোকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার। আর এক কোটি বছর হয় তোকে দেখি না। এক কোটি বছর হয় তোকে দেখি!"
মানুষ মনের মধ্যে, কি ভীষণ অভিমান, কি ভীষণ রাগ, কি ভীষণ ঘৃণা জমিয়ে রাখে। কিন্তু আমি কেনো পারি না? আমার সবটা সময় কেনো চলে যায় শুধু তোকে ভালোবাসায়? কিন্তু এতো ভালোবাসা দিয়ে আমি কি করবো? সবটা-তো সাথে করে নিয়ে চলে যেতে হবে দূরে, বহুদূরে।
এই রুদ্র, আমার আজ কেনো এতো কান্না পাচ্ছে? কী ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে! জোছনার মত করে গলে গলে চোখ বেয়ে পড়ছে দুঃখ'রা। এ যে থামার নাম নেই। তুই এসে একটি ছুঁয়ে দিবি; আমার ভেজা চোখ, ভেজা গাল, ভেজা ঠোঁট?
আমি জানিনা, তোকে আর চিঠি লিখতে পারবো কি-না। আমি-তো এ-ও জানিনা, চিঠিগুলো তোর কাছে পৌঁছাচ্ছে কি-না। আমার আজকাল মনে সংশয় জাগে, তুই আগের ঠিকানা থাকিস তো? যদি আমার পাঠানো চিঠি তোর কাছে না-ও পৌঁছায় তাহলে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি শুধু শেষ সময়ে তোকে আরেকটু কষ্ট দিতে চেয়েছি। তুই কষ্ট পেলে আমার ভালো লাগে, ভীষণ আনন্দ হয়, ভীষণ!
রুদ্র, হাত কাপছে৷ আমি লিখতে পারছি না৷ তবে তোকে শেষ একটা অনুরোধ করতে চাই, রাখবি তো? আসলে একটা না দুইটা অনুরোধ করতে চাই। একটা হলো, আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখিস। পরেরটা হলো, আমাকে খুঁজিস না, কোথাও খুঁজিস না। আমি নেই, কোথাও নেই। প্রথমেই বলেছিলাম, আমার জগতে তুই নেই। তুই নেই মানে, সত্যি কোথাও নেই, তোর ছায়াও নেই, তোর আলোও নেই!
ইতি, তরু "
রুদ্রের চোখ ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। এই চিঠিটা সে যখনই পড়ে ততবারই তার চোখ থেকে অশ্রু বেড়িয়ে আসে। কেনো আসে সে জানেনা। যাকে সে কখনো দেখেনি তার জন্য তার কেনো এতো মায়া হয়? তার জন্য কেনো তার মনে এতো স্নেহ, ভালোবাসা? কে তরু? সে তার কে হয়? রুদ্রের কাছে কোনো উত্তর নেই। তবুও তার মনে তরুকে এবার দেখতে চাওয়ার সে যে কি আকুলতা তা বোঝানো সম্ভব নয়!
রুদ্র চিঠিটা ভাজ করে রাখলো। সে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে অদ্ভুত চাঁদ৷ তরুও কি এই একই চাঁদ দেখছে?
রুদ্র ক্রমশ জোছনায় মিশে যেতে থাকলো। তার সকল কষ্ট, আকুলতা বেরিয়ে এলো চোখ বেয়ে। তারপর সে আনমনে মহাদেব সাহার 'এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না' কবিতাটা পড়তে থাকলো।
"এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর
… কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।"
চলবে....!
রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে পুরনো একটা বিল্ডিংয়ের সামনে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া। বাড়ির মেইন গেট তালাবদ্ধ। বাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহুদিন ধরে অযত্নে পড়ে আছে। বাড়িটায় কেউ থাকে না, সেটা দুইজন প্রথম দেখায়ই বুঝে গিয়েছিল। তবুও রুদ্র অনেকটা সময় ধরে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
রুদ্র তার পকেট থেকে কাগজটা বের করে আবার দেখে মিলিয়ে নিলো। হ্যাঁ, এই বাড়িটাই। কাগজে এই যে ঠিকানা লেখা আছে সেটা এই বাড়ির ঠিকানা।
একটা লোক হেঁটে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। রুদ্র তাকে সালাম দিয়ে কাগজটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "আসসালামু আলাইকুম আংকেল। এই ঠিকানাটা কি এটাই?"
লোকটা কাগজটা দেখে বলল, "ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, আপনারা ঠিক ঠিকানায় এসেছেন। কিন্তু এখানে তো কেউ থাকে না।"
রুদ্র জানে তারা ঠিক ঠিকানায় এসেছে। বাড়ির গেটের পাশের দেয়ালে যে ঠিকানা ছিল সেটার সাথে কাগজে লেখার ঠিকানা মিলিয়ে দেখেছে। তবুও সে জিজ্ঞেস করলো এটা ভেবে যদি কোনো তথ্য জানা যায়।
"আমাকে তো এই ঠিকানা দিয়ে এখানে আস্তে বলল।" রুদ্র একটু চালাকি করে মিথ্যা বলল।
"আপনাকে তাহলে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। অনেক দিন আগেই এই বাড়িতে যারা ছিল তারা বাড়িটা বিক্রি করে চলে যায়।" বয়স্ক লোকটা বলল।
"কি বলেন?" রুদ্র কৌতুহল হওয়ার ভঙ্গি করলো। সে বাড়িটা দেখেই বুঝেছে অনেক দিন ধরে বাড়িটায় কেউ থাকে না। সে আবার বলল, "ঠিক কতদিন আগে বাড়িটা বিক্রি করে সবাই চলে গেছে?"
"এই ধরুন সাত আট মাস হবে। তারও বেশি হতে পারে। আমার ঠিক মনে নেই।"
"তাহলে তো অনেক দিন আগে।" লোকটার সামনে রুদ্র হতাশ হওয়ার অভিনয় করলো। সে আবার বলল, "তাহলে তরু মেয়েটা আমাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে!" মিথ্যে করে বলে রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।
"কি নাম বললেন?"
"তরু! কেনো?"
"এই নামেই একটা মেয়ে এখানে থাকতো।" লোকটা কথাটা বলে আনমনে আবার বলল, "মেয়েটার বাবার নাম যেনো কি?" আস্তে করে বললেও রুদ্র এবং তরু ঠিকই কথাটা শুনতে পেলো।
"তরুর বাবার নাম কি?" রুদ্র এবার লোকটিকে সরাসরি জিগ্যেস করলো।
লোকটি কিছুক্ষণ ভাবলো। ভুলে যাওয়া একটা কথা মনে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটে এলো। সে বলল, "আফজাল হোসেন। হ্যাঁ, এটা আফজাল হোসেনর বাড়ি। লোকটা ভাল মানুষ ছিলো। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। একবার মসজিদে বড় করে মিলাদ দিয়েছিল। উনার মেয়ে অসুস্থ ছিলো, তার সুস্থতা কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলো।" লোকটা এই পর্যন্ত বলে থামলো। সে আবার বলল, "হুট করে লোকটা মসজিদে নামাজ পড়তে আসা বন্ধ করে দিলে, একদিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে বাড়িটা বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। লোকটা এভাবে চলে যাওয়াতে খুব খারাপ লেগেছিলো। খুব ভালো মানুষ ছিলো।" লোকটা পরের কথাগুলো আনমনে বললেও রুদ্র এবং রিয়া শুনলো।
"বাড়ি বিক্রি করে কোথায় গেছে আপনি কি জানেন?" রুদ্র আবার জানতে চাইলো।
"কোথায় গেছে তা-তো জানিনা। তবে লোকমুখে শুনেছিলাম মেয়ের চিকিৎসা করানোর জন্যই বাড়িটা বিক্রি করেছে। মেয়েটার চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছে এটাও শুনেছিলাম। আসলে কার কোন কথা সঠিক কেউ জানেনা। লোকমুখে নানা কথা বলা বলি হতো, হঠাৎ এভাবে নিজের বাপদাদার জমি বিক্রি করে চলে যাওয়া পর। কিন্তু একটা সময় পর লোকটাকে সবাই ভুলেই গেলো।"
বয়স্ক লোকটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলছে কিন্তু আজ রুদ্রের সেটা শুনতে ভাল লাগছে। প্রশ্ন করা ছাড়াই লোকটা অনেক তথ্য বলে দিচ্ছে।
"আফজাল হোসেন কোথায় থাকে এখন বলতে পারবেন?"
"সেটা-তো বলতে পারবো না, বাবা।"
"তার পরিচিত কেউ কি এই এলাকায় থাকে?"
"না, তেমন কেউ নেই। আফজাল হোসেনের কোনো ভাই বোন নেই। এছাড়া তেমন কাউকেই চিনিনা আমি।"
"লোকটা কি করতো? কোথায় চাকরি করতো? কিছু কি জানেন?"
বয়স্ক লোকটা হঠাৎ রুদ্রকে ভাল করে লক্ষ করলো। তার মনে সাহসা কিছুটা সন্দেহ জেগেছে। ছেলেটা এতো প্রশ্ন করছে কেনো? সে সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কে? তাকে কেনো খুঁজছেন?"
লোকটার কাছ থেকে এরকম একটা প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই রুদ্র আশা করেছিলো। তাই প্রথম থেকেই সে কিছুটা মিথ্যে বলেছে যাতে করে বানিয়ে একটা গল্প বলতে পারে। সে বলল, "তরু নামের মেয়েটার সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয়। সে-ই আমাকে অনেক দিন আগে এই ঠিকানাটা দিয়েছিলো। তারপর হটাৎ মেয়েটার কোনো খোঁজ খবর নেই। অনেক চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু পারি নি। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো আমাকে সে বাসার ঠিকানা দিয়েছিল। তাই আজ এখানে খুঁজতে এলাম।" রুদ্র দ্রুত একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে বানিয়ে লোকটাকে বলে দিলো।
"ওহ আচ্ছা।" লোকটা বলল।
লোকটা রুদ্রের কথা বিশ্বাস করলো কি-না সে জানেনা। অবশ্য তার বিশ্বাস অবিশ্বাস, সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। রুদ্র আবার বলল, "লোকটার ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন? প্লিজ, যদি কিছু জেনে থাকেন আমাকে বলুন। আমার খুব উপকার হবে।"
বয়স্ক লোকটা পুরোপুরি রুদ্রের কথা বিশ্বাস করলো না, আবার অবিশ্বাসও করলো না। রুদ্রকে দেখে তার খারাপ মনে হয় নি। সে বলল, "আমি তেমন কিছুই জানিনা, বাবা। জানলে অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করতাম।" লোকটা এবার হঠাৎ তুমি করে রিয়া এবং রুদ্রকে উদ্দেশ্যে করে কথাগুলো বলল।
"এমন কেউ কি আছে, যে খোঁজ দিতে পারবে বলে আপনার মনে হয়।" রুদ্র বলল।
"আমার জানামতে তেমন কেউ নেই।" লোকটা ফ্যাকাসে মুখে উত্তর দিলো।
লোকটা বিরক্ত হচ্ছে রুদ্র বুঝতে পারলো। বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। লোকটা অনেক সময় দিয়েছে তাদের। পুরোটা সময়জুড়ে রিয়া একটা কথাও বলে নি। সে শুধু শুনেছে। রুদ্রের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে সে আরো একবার মুগ্ধ হলো। রুদ্র পরিস্থিতি খুব ভালো ভাবে সামলে লোকটার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলে অনেক কিছু জেনে নিয়েছে।
"আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।" রুদ্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
"তোমাদের সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম।" লোকটা বলল। সে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আবার বলল, "আসসালামু আলাইকুম। ভালো থেকো।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। ধন্যবাদ আংকেল।" রুদ্র সালামের উত্তর দিয়ে বলল।
লোকটা চলে গেলে রিয়া বলল, "কি করবে এখন?"
"বুঝছি না। হয়তো আর কিছুই করার নেই। আর কোনো আশা নেই। ভাগ্যের উপর সবটা ছেড়ে দিতে হবে।" রুদ্র হতাশাজনক ভাবে কথাগুলো বলল। তার মুখ মলিন হয়ে গেছে।
রুদ্রকে এভাবে দেখে রিয়ার খারাপ লাগছে। সে কি-ই বা বলবে? সেও জানে, তরুর খোঁজ পাওয়া এখন অসম্ভব। যদি না তরু নিজ থেকে তার খোঁজ দেয়। কিন্তু তরু কি তা করবে? এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কারো কাছেই নেই। আসলেই সবটা এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে।
"চলো যাওয়া যাক। এখানে থেকে আর লাভ নেই। লোকটা যা জানার সবটাই বলেছে। লোকটা বেশ ভালো ছিল।" রুদ্র মনে মনে লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
"হ্যাঁ, এখনো এরকম মানুষ আছে। তবে সেটা সংখ্যায় খুব কম।" রিয়া বলল।
তারা যাওয়ার জন্য রিকসা খুঁজছিলো। ঠিক তখন রিয়া বলল, "আমার না প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। সকালে না খেয়ে বেরিয়ে গেছি। তুমি এতো সকালে ফোন দিবে ভাবতে পারি নি। তোমার ফোন পেয়ে তারাহুরো করে রেডি হয়ে বেরিয়ে এসেছি। এদিকে এখন দুপুর।"
"তুমি সকালে কিছুই খাও নেই?"
"টেবিলে একটা পরটা ছিল সেটার অর্ধেকটা কোনো রকম খেয়ে পানি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি।"
"ওহ, সরি। আমারই ভুল। তোমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। আসলে...!"
রুদ্রকে কথা শেষ করতে দিলো না রিয়া। সে বলল, "সরি কেনো বলছ? কোনো সমস্যা নেই। সকালে এমনিতে বেশিকিছু খাই না আমি।"
"ওহ আচ্ছা। ডায়েট করছো?"
রিয়া হাসলো। সে বলল, "আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?"
রিয়াকে ভাল করে দেখলো রুদ্র। সে বলল, "হ্যাঁ, তাই-ই মনে হচ্ছে। দিনদিন তো সুন্দরই হচ্ছো!"
"তোমাকে বলেছে! দিনদিন মোটা হচ্ছি।"
"আমি-তো দেখছি না। ঠিকই আছো।"
"তোমাকে আর দেখতে হবে না। চলো, কিছু খেয়ে নেই।"
"আচ্ছা, চলো।"
রিয়া ভেবেছিলো পরিবেশটা গুমোট থাকবে। রুদ্রের মন প্রচন্ড খারাপ থাকবে। কিন্তু না, রুদ্র অনেকটা প্রাঞ্জল। যতটা খারাপ পরিস্থিতি হবে ভেবেছিল রিয়া ততটা হয়নি।
তারা একটা হোটেলে ঢুকে পড়লো। রিয়াকে জিজ্ঞেস করতেই সে সাদামাটা খাবার অর্ডার দিতে বলল। রুদ্র সাদা ভাত, সবজি, সমুদ্রের মাছ আর ডাল অর্ডার দিলো।
"এতোকিছু অর্ডার দিলে?" রিয়া বলল।
"তুমিই তো বললে।" রুদ্র উত্তর দিলো।
"অল্প কিছু অর্ডার দিতে বলেছিলাম।"
"দুপুরের লান্সে কি কেউ নাস্তা করে?"
"আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমি না পারলে তুমি তো আছোই। আমারটা না হয় তুমি খেলে।"
রুদ্র হাসলো। সে বলল, "আচ্ছা, সমস্যা নেই।"
খাবার দ্রুতই চলে এলো। তারা নিরবে খেলো। খাবারের সময় তাদের মধ্যে তেমন একটা কথা হলো না। রুদ্র যতটা পারে হাসিখুশি থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে চায় না, রিয়া বুঝতে পারুক সে আসলে বেশি ভালো নেই।
পুরো পথে তাদের মধ্যে দুই একটা দরকারি কথা ছাড়া তেমন কোনো কথা হলো না। রিয়াও জোর করে কথা বলেনি। দুইজনে নিরব ছিলো। রিয়া যতটা ভেবেছিল, রুদ্র ঠিক আছে আসলে সে ততটা ঠিক নেই। সে এখন বুঝতে পারছে। রুদ্র শুধু ঠিক থাকার বাহানা করে যাচ্ছে।
আজকে রিয়াই রুদ্রকে নামিয়ে দিলো। রুদ্র একবার বলেছিল, সে রিয়াকে পৌঁছে দিবে। কিন্তু সেই বলার জোর ছিলো না। রিয়াও চাচ্ছিলো না রুদ্র তাকে পৌঁছে দিক। রুদ্রকে নামিয়ে দিয়ে সে সেই রিকসা নিয়েই চলে গেলো।
রুদ্র বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তার দাদী ছাড়া এই মুহুর্তে বাসায় কেউ নেই। জাহানারা কাজে, মিলি কলেজে।
রুদ্রের ঘুম ভাঙলো জাহানারা ডাকে। সে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল বলে সে শুয়ে ছিলো। ঘুম ভেঙেই দেখে তার মা চেয়ার টেনে তার পাশে বসে আছে। এক হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুদ্রের খুব ভালো লাগল। কতদিন তার মা তাকে এভাবে আদর করে না। অবশ্য এতে সে অভিমান করে না। সে সবটাই বুঝে, এই পুরো সংসার তার মা'ই সামলায়।
"তোর কি শরীর খারাপ?" জাহানারা জিজ্ঞেস করল।
রুদ্র তার মায়ের হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গালের নিচে রেখে হাতের তালুর উপরে মুখ রেখে শুয়ে রইল। সে বলল, "ভালো লাগছে না। মাথাটা ব্যথা করছে।"
"তোর কি কিছু হয়েছে? আজকাল তোকে অন্য রকম লাগে। সবসময় মন খারাপ করে থাকিস কেনো?"
"কই মন খারাপ করে থাকি?"
"মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া কি এতো সহজ?"
"সরি মা।" আহ্লাদী কন্ঠে রুদ্র বলল। সে আবার বলল, "অনেক কিছু নিয়ে একটু সমস্যায় আছি। সবকিছু সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
"ধৈর্য রাখ। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।" জাহানারা থাকলো, তারপর সে আবার বলল, "যদি আমাকে বলার মত কথা হয় তাহলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারিস। তোর ভালো লাগবে। মন হালকা হয়ে যাবে।"
"আচ্ছা, মা। রুদ্র কথাটা বলে হাসলো।
"দুপুরে খেয়েছিস?"
"হ্যাঁ, খেয়েছি।"
আচ্ছা তাহলে বিশ্রাম কর। আমি যাই, রাতে রান্না করতে হবে।"
"এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকো না প্লিজ। আমার ভালো লাগছে৷"
"আচ্ছা.." বলেই জাহানারা তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
"আমি-তো কেউ না। ভাইয়ার মত করে আমাকে একটুও ভালোবাসো না।"
রুদ্র এবং জাহানারা কথা শুনে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো মিলি দাঁড়িয়ে আছে।
"এদিয়ে আয়।" জাহানারা ডাকলো।
ছোট্ট চড়ুই পাখির মত মিলি ছুঁটে এসে তার মায়ের কোলের মধ্যে ডুকে গেলো। এভাবেই তারা তিনজন কিছুক্ষণ আধো আলো অন্ধকারের মধ্যে রইলো।
সারা বিকাল ঘুমানোর কারণে রুদ্রের রাতে ঘুম এলো না। সে এলোমেলো নানা কাজ করে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে এটা সেটা গুছিয়ে রাখছে। রিয়ার দেওয়া বইটা একবার পড়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কোনো কিছুতে মন বসছে না। অবশেষে সে টেবিলের ড্রয়ার খুলে তরুর সব চিঠিগুলো একে একে বের করলো। সেই চিঠির ভেতর থেকে তরুর পাঠানো শেষ চিঠিটা খুঁজে বের করে সে সেটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো।
বাইরে জোছনার আলোয় ঝলমল করছে। আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশকিছুটা সময় একা চাঁদটাকে দেখলো। তারপর সে সাহস করে তরুর শেষ চিঠিটা খুললো। সে প্রথম লাইন পড়তেই চিঠিতে ডুবে গেলো।
"রুদ্র, কেমন আছিস? আমি ভালো নেই। সত্যি আমি ভালো নেই। তুই কি জানিস, আমার প্রিয় ঘ্রাণ কি? আমি-না ভুলে গেছি। কিন্তু আজকাল আমার মনে হয় হাসপাতালের ফিনাইলের ঘ্রাণই আমার প্রিয়। আমি পাগল হয়ে গেছি ভাবছিস? কি করবো বল? এখন তো হাসপাতালই আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার পুরো জগৎ। এই জগৎটা খারাপ না৷ কিন্তু এখানে শুধু তুই নেই। তুই নেই মানে, সত্যি কোথাও নেই, তোর ছায়াও নেই, তোর আলোও নেই!
যদি এমন একটা পৃথিবী হতো, শুধু তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তাহলে কি এমন ক্ষতি হতো? পরক্ষণেই ভাবি, বড্ড অন্যায় হতো। তোকে একা রেখে সেই আমাকে চলেই যেতে হতো৷ তুই বড্ড খারাপ থাকতি।
আজকাল আমার কেবল মনে হয় জীবনে অনেক ভুল করেছি। এখন তার কোনোটাই শোধরানো সম্ভব না। আর আমি শোধরাতেও চাই না। আচ্ছা, তুই বল, মানুষ হয়ে জন্মেছি সেহেতু জীবনে একটা দুইটা ভুল জেনে বুঝে ইচ্ছে করে না করলে কি হয়? আমার না এতে কোনো আফসোস নেই। বরং এই ভুলগুলো করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ভুল না করলে তোর দেখা পেতাম কি করে? তোর মত একটা ছ্যাবলা ছেলেকে ভালোবাসতাম কি করে?
আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই না রুদ্র? তুই ভুল বুঝিস না, আমি সেই সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবো না। যাকে এতোটা ভালোবাসি তাকে একটু কষ্ট দেওয়াই যায়। কি আমি ভুল বললাম?
রুদ্র, মহাদেব সাহা'র মত করে আজ তোকে বলতে ইচ্ছে করছে, "তোকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার। আর এক কোটি বছর হয় তোকে দেখি না। এক কোটি বছর হয় তোকে দেখি!"
মানুষ মনের মধ্যে, কি ভীষণ অভিমান, কি ভীষণ রাগ, কি ভীষণ ঘৃণা জমিয়ে রাখে। কিন্তু আমি কেনো পারি না? আমার সবটা সময় কেনো চলে যায় শুধু তোকে ভালোবাসায়? কিন্তু এতো ভালোবাসা দিয়ে আমি কি করবো? সবটা-তো সাথে করে নিয়ে চলে যেতে হবে দূরে, বহুদূরে।
এই রুদ্র, আমার আজ কেনো এতো কান্না পাচ্ছে? কী ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে! জোছনার মত করে গলে গলে চোখ বেয়ে পড়ছে দুঃখ'রা। এ যে থামার নাম নেই। তুই এসে একটি ছুঁয়ে দিবি; আমার ভেজা চোখ, ভেজা গাল, ভেজা ঠোঁট?
আমি জানিনা, তোকে আর চিঠি লিখতে পারবো কি-না। আমি-তো এ-ও জানিনা, চিঠিগুলো তোর কাছে পৌঁছাচ্ছে কি-না। আমার আজকাল মনে সংশয় জাগে, তুই আগের ঠিকানা থাকিস তো? যদি আমার পাঠানো চিঠি তোর কাছে না-ও পৌঁছায় তাহলে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি শুধু শেষ সময়ে তোকে আরেকটু কষ্ট দিতে চেয়েছি। তুই কষ্ট পেলে আমার ভালো লাগে, ভীষণ আনন্দ হয়, ভীষণ!
রুদ্র, হাত কাপছে৷ আমি লিখতে পারছি না৷ তবে তোকে শেষ একটা অনুরোধ করতে চাই, রাখবি তো? আসলে একটা না দুইটা অনুরোধ করতে চাই। একটা হলো, আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখিস। পরেরটা হলো, আমাকে খুঁজিস না, কোথাও খুঁজিস না। আমি নেই, কোথাও নেই। প্রথমেই বলেছিলাম, আমার জগতে তুই নেই। তুই নেই মানে, সত্যি কোথাও নেই, তোর ছায়াও নেই, তোর আলোও নেই!
ইতি, তরু "
রুদ্রের চোখ ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। এই চিঠিটা সে যখনই পড়ে ততবারই তার চোখ থেকে অশ্রু বেড়িয়ে আসে। কেনো আসে সে জানেনা। যাকে সে কখনো দেখেনি তার জন্য তার কেনো এতো মায়া হয়? তার জন্য কেনো তার মনে এতো স্নেহ, ভালোবাসা? কে তরু? সে তার কে হয়? রুদ্রের কাছে কোনো উত্তর নেই। তবুও তার মনে তরুকে এবার দেখতে চাওয়ার সে যে কি আকুলতা তা বোঝানো সম্ভব নয়!
রুদ্র চিঠিটা ভাজ করে রাখলো। সে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে অদ্ভুত চাঁদ৷ তরুও কি এই একই চাঁদ দেখছে?
রুদ্র ক্রমশ জোছনায় মিশে যেতে থাকলো। তার সকল কষ্ট, আকুলতা বেরিয়ে এলো চোখ বেয়ে। তারপর সে আনমনে মহাদেব সাহার 'এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না' কবিতাটা পড়তে থাকলো।
"এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর
… কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।"
চলবে....!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)