24-02-2023, 08:59 PM
পর্ব- তেরো
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার শৈশব কালটা তখনকার সময়ের তুলনায় বেশ ভালই কেটেছে। হয়তো প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব কষতে গেলে অনেক কিছুই অপ্রাপ্তি হয়ে বেড়িয়ে আসবে, তবে ঐ পাওয়া না পাওয়ার অক্ষেপ ছাড়া কার জীবন আছে পৃথিবীতে? এক বেলা ঠিক মত খেতে না পাওয়া মানুষটা থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকার মালিক সবারই কিছু না কিছু অপ্রাপ্তি থেকেই থাকে। আর এই না পাওয়ার আফসোস টা বয়ে বেড়াতে হয় মৃত্যু অব্দি। এরপরই চট করে বন্ধ হয়ে যায় হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি সমস্ত কোলাহল এগিয়ে আসে স্নিগ্ধ শান্ত সুন্দর মৃত্যু, ব্যাস সবকিছুর হিসেব এখনেই শেষ।
না না আমি তো এখানে সেই হিসেবের খাতা খুলে বসিনি আমি বসেছি আমার জবানবন্দি লিখতে, সেটাই বরং শুরু করি।
আমাদের মন আর শরতের আকাশের রঙ কখন যে তার রঙ পাল্টাবে সেটার পূর্বাভাস দেয়া বড়ই কষ্টসাধ্য কাজ। মন কখন কি চায়, কার পিছু নেয়, কাহাতে নিজেকে মজায় কিংবা কিসের লাগি নিজেকে ভাসায় ডুবায় সেটা মনের মালিক নিজেও মাঝে মাঝে উপলব্ধি করতে পারে না। যেমন এখন আমি সেই রকম ঝুলন্ত অবস্থায় ঝুলে আছি, বেখেয়ালি মন কখন যে কি আবদার করে বসে থাকে বুঝা মুশকিল। অতৃপ্ত পিয়াসী মন কখন যে কার জন্য নিজের উঠুন জোড়ে কল্পিত সাজানো বাগানের ভ্রমর হয়ে উঠে সেটা যদি আগে আন্দাজ করা যেত তবে তো এতো জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। কে শুনে কার কথা, যেমনি করে আমার মনও ভীষণ ভাবেই আমার অবাধ্য৷ এক নজর দেখতে না দেখতেই রাশি কে নিয়ে পড়ে রয়েছে সেই কখন থেকে। বয়সটাই ওমন সরাসরি দেখাতেও অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি, আবার এক পলক না দেখতে পেলেও এ কেমন যন্ত্রণা। যতটা পেরেছি যতবার পেরেছি নানা কৌশলে অদ্ভুত সব অজুহাতে রাশির কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছি যেন এক নজর ওকে দেখতে পারি।
ওহ রাশি কে সেটাই বলা হলো না, ঐ যে বাড়িতে আসা নতুন অতিথি। আমার নতুন কাকির কাকাতো বোন, মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি নাম রাশি৷ ততোক্ষণে পরিচিতি পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমার সমবয়সী একই ক্লাসে পড়ে। সেদিনের মত আমাদের বাড়িতে ওর স্থায়িত্ব ছিল সন্ধ্যা অব্দি। কিন্তু আমার মনে.... সেটা হয়তো সময় বলে দিবে। হিসেব মতে আমি বয়সে অপরিণত সেই সাথে আমার মনটাও তাই আগে থেকেই কিছুর ভবিষ্যৎ বানী করা যে বেশ মুশকিল। তবে রাশির ক্ষীণ উপস্থিতিও যে আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে সেটা খানিক হলেও বুঝতে পারছি।
বিকেল অব্দি মন টা বারবার গুনগুণ করে গিয়েছে কত শত ভাবনায় ডুবে গিয়ে আবার ভেসে উঠেছে। নিজের পাগলামো দেখে নিজেই মুচকি হেসে উঠেছে। তবুও কি থেমে থাকা যায়! আজও সেই পাগলামি গুলোর কথা চিন্তা করলে আপন খেয়ালেই হাসির ফোয়ারা ছুটে উঠে ঠোঁটের কোনে। অবুঝ মন সম্পর্কের বেড়াজালে নিজেকে জড়াতে চায় নি যতটুকু করেছে নিজের সাথে নিজের পাগলামি...
মনের গহীন কোনে স্মৃতিপটে অনুরণে শৈশব কাল
মধুর ছিলো সে ক্ষন তনু মন শিহরণ স্মরণে অতল,
মায়ের মুখের বোল হামাগুড়ি ডামাডোল কথা বলা শেখা
সময়ের প্রয়োজনে নানাবিধ আয়োজনে জীবনকে দেখা।
বাল্যকালের স্মৃতি আদেশ নিষেধ প্রীতি মধুর লগন
পাঠ ভুলে কলেজে কান মলা ঢের হলে অ-আ ক-খ মন,
খেলায় পাগল প্রাণ মন করে আনচান বন্ধুদের মিছিলে
প্রাইমারী চৌকাঠ নামতা ও ধারা পাঠ মুখে তুলে নিলে।
কৈশোরের আগমন বয়ঃসন্ধি-র শিহরণ উড়িবার ডানা
পরিবর্তনের বেড় সময়ের হেরফের যৌবনের হানা,
ঋতুস্রাব স্বপ্নদোষ নবোদয়ে পরিতোষ অজানা সীমানা
শিশুকাল চলে গেল এই সবে শুরু হলো নতুন ঠিকানা।
বলে বীর বলবান যেই রূপে সম্মান আয়োজনের ছন্দ
কচু পাতার পানি যৌবনের হাতছানি ভালাে নয় মন্দ,
শ্রেষ্ঠ সেই ক্ষণকাল জীবনের হালচাল যেই সুরে গায়
জীবন এ তরণী তার ধীরে নয় দুর্বার সেই দিকে ধায়।
প্রৌঢ়ত্বের সুর ক্ষয়ে যাওয়া সুমধুর গ্রামোফোনের গান
এই বুঝি চলে গেল সময় তো বেশ হলো সাঁঝ বাতি ঘ্রাণ,
সলতের কেরােসিন রং চটা তার্পিন হাতা ভাঙ্গা চেয়ার
বসে না তো আর ঠিক দরবার চৌদিক ক্ষমতার পেয়ার!
ঐটুকু এক চিলতে রোদের মত ওকে দেখার পর আরেকবার ভালো করে দেখার সুযোগ হলো দুপুরের খাবারের সময়। আন্টির ওখান থেকে উদরপূর্তি করে আসার পর কোন ভাবেই আবার ভাতের খিদে পেটে থাকার কথাই না। কিন্তু ঐ যে মনের প্রবল ইচ্ছেতে কিভাবে যেন বেহায়া খিদে টা লেগেই গেল। মা ওটা নিয়ে হালকা বকাবকিও করেছে কিন্তু আমার মন যে তাকে আরেকবার কাছ থেকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তাই বুঝি পেটের খিদে নয় চোখের খিদেটাই বড় হয়ে ধরা দিয়েছে। আঙুল গুলো ভাত মাখিয়ে চলেছে আর নির্লজ্জ চোখ জোড়া বুভুক্ষের মত রাশির দিকে তাকিয়ে আছে। তবে মনে বড় ভয়, চোখে চোখ মিলে যাবার ভয়, ওর চোখে ধরা পড়ে যাবার ভয়, ওর চোখে হারিয়ে যাবার ভয়, আর কত কিসের ভয়...
মন টা খুব করে চাইছিলো রাশির সাথে কথা বলতে কিন্তু কিভাবে কি শুরু করবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সামনে যদি ও না থেকে কথা থাকতো তবে হয়তো এতটাো ইতস্তত বোধ করতাম না কখনো কিন্তু রাশি সে তো আমার পূর্ব পরিচিত কেউ নয়। তাই বুঝি এত উৎকন্ঠা মনের ভেতর হাপিত্যেশ করে চলেছে। হঠাৎ করেই একবার রাশির চোখ গুলো পরশ বুলিয়ে গেল আমার চিন্তায় মগ্ন কুঞ্চিত হয়ে আসা মুখখানার উপর। আমি প্রতিক্রিয়ায় একটু হাসতে চেয়েছিলাম তার আগেই যে ওর দৃষ্টি নেমে গেল নিচের দিকে। মেয়েটা বেশ লাজুক নাকি আমিই একটু ইন্ট্রুভাট, তাই সামনে বসে থাকা আমার মন হরণী কে একবার নাম ধরে সম্বোধন পর্যন্ত করতে পারছি না...
সম্বোধন করবো কি বলে!
আপনি নাকি তুমি? মন চাচ্ছে তুমি'ই বলি!
তোমাকে দেখেই মুগ্ধ হলাম।
টিনেজার'রা এই অনুভিতিকে বলে ক্রাশ,
তবে আমার ধারণা তোমার রূপ
আর নিষ্পার সরলতায় হচ্ছি গ্রাস।
তোমার প্রতিটা কথাতেই প্রলুব্ধতা মাখনো,
চিকন ফ্রেমের চশমার কাচ ভেদ করে
জ্যোতি ছড়ায় তোমার হরিনী চোখের মণি।
মনোহরা তোমার দেহের গড়ন
কি অপরূপ দুধে-আলতা রঙ
যুগল ঠোট যেন গোলাপ পাপড়ি।
আখিতে রয়েছে কারুকাজ
মাথার ঘনকেশে অপরূপ সাজ
মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত অপ্সরী।
কি বলে সম্বোধন করবো তোমায়
একবার বলে যাও
ও আমার হৃদয় হরণী...
না সেদিনের লীলা সেখানেই হয়েছিল ক্ষান্ত শত চেষ্টার পরেও কথা বলা হয়ে উঠেনি। তার মাঝে যতটুকু মন বিনিময় সবটুকুই তড়িৎ গতিতে ছুটে চলা চোখের পলকে পলকে। কখনো বা ভুবন ভোলানো মিষ্টি হাসিতে বা রাজে রাঙা হয়ে উঠা টুকটুকে গালে। যে কতবার পেরেছি লুকিয়ে দেখেছি ওকে, রাশির দিকে ছুটতে থাকা মনের রাশ টেনে ধরাতে ভীষন রকমের ব্যর্থ আমি। এ কেমন নিদারুণ পরাজয় যেটাতে কষ্ট না পেয়ে উল্টো বিজয়ের হাসি ফুটে উঠে৷
সন্ধ্যায় ওদের প্রস্থানে মন ক্ষণ গগনা শুরু করে কবে আসবে সেই তারিখটা যেদিন আমার যাবার পালা ওদের ওখানে। বিয়ের আনন্দটা বদলে গিয়ে ওকে দেখার জন্য মন খুব করে নিসপিস করছে। এখনকার সময়ে হলে চট করে মোবাইলে একটা ফোন করে নিতাম কিন্তু তখন তো হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। আর বাসার মোবাইল থেকে কল করলেও কি অজুহাত দেখাতাম ওর সাথে কথা বলার জন্য। তাই কষ্ট হলেও অপেক্ষা করাই এখন সবচেয়ে শ্রেয়, আর শুনেছি অপেক্ষার ফল নাকি মিষ্ট হয়। দেখি আমার কপালে কি অপেক্ষা করে আছে, চেখে দেখা ছাড়া তো আর ফলাফল বলা যাবে না।
★★★★★
"হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে। সব মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে ।"
প্রেম আমারও এসেছিলো দুয়ারে, অতি নিরবে । বসন্তের সবটুকু শুভ্রতা আর জানা অজানা ফুলের সুবাস নিয়ে । তপ্ত মরুভমির অসহ্য উত্তাপের তৃষিত হৃদয়ে সে এসেছিল একফোঁটো জল হয়ে। বসন্তের নির্মল হাওয়ায় আমার হৃদয় ভেসেছিলো ভালোবাসার প্লাবনে । একরাশ প্রশান্তির আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেহ মনে ।।
রবীন্দ্রনাথের গানের মতো -
" কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করেছে কোলাকুলি ।"
পাখির কলকাকলীর মতো সেই মধুর দিনগুলো ছিল স্বর্গীয় ভালোবাসায় ভরপুর । সেই প্রথম শুনেছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে আকাঙ্খিত , প্রচন্ড ভালো লাগার শব্দটি। " ভালোবাসি" ।
বলেছিলাম -
আমিও যে ভালোবাসি তোকে ।
-কতটুকু ?
-যতটুকু হলে তোকে আমার করে পাওয়া যায় ।
- তাহলে বলিসনি কেন এতদিন ? কেন রেখেছিলি নিজ অন্তরে লুকিয়ে ?
- যদি তুই প্রত্যাখ্যান করিস আমার নিবেদন সেই ভয়ে ।
- বোকা ছেলে একটা এতদিন একসাথে এতো সময় পাড়ি দিলাম। তুই কি কখনোই বুঝতে পারিস নি আমার মনের কথা !
-হয়তো আমি বোকা, কিন্তু তুইও তো আমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পারিস নি। শুধু তোর ঐ নির্মল হাসিমুখটা দেখব বলে, শুধু তোর সেই নিষ্পাপ চাহনি দেখার জন্য বারবার ছুটে আসি তা কি কখনো তুই বুঝিস নি?
-বুঝিরে অনেক সময় বুঝলেও সব কিছু যে মুখে বলা যায় না, মেয়ে হয়ে জন্মেছি তো তাই অনেক বাঁধা। জানিস শুধু আজকের দিনটির জন্য কতদিন অপেক্ষায় রয়েছিলাম। বারবার যে আমি শুধু তোকেই চেয়েছি, আমার নিজের করে চেয়েছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম তোর মুখ থেকে একবার শুনবো বলে...
চুপ করে ছিলাম, অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু আমি শুধু শুনছিলাম। গভীর ভালো লাগা আর ভালোবাসায় হয়ে ছিলাম আচ্ছন্ন, সে আমার চোখে চোখ রাখল । এ এক অন্য রকম চাহনী, যে চাহনীতে সবকিছুই বদলে যায়। আমিও ওর কাজল কালো মায়াবী আঁখিতে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কত কথাই যেন সে চোখে জমে রয়েছে, আমার বলার জন্য উচ্ছলিত হয়ে পড়েছে। কত কিছুই না ও দুটি চোখ বলতে চায়, আমার অনুভূতি জুড়ে নিজেদের ছাপ রেখে যেতে চায়। মনে হচ্ছিল আমি অনন্ত কাল ধরে সেই মায়া ভরা চোখের দিকে চেয়ে থেকেই কাটিয়ে দিতে পারব। সেই থেকেই ভেসেছিলাম ভালোবাসার স্বপ্ন সুখের ভেলায়, হৃদয়ের কত আকুলতা , না বলা কথা , কিছু জমানো ব্যথা বিনিময় আর ভালোবাসার রঙ্গীন সব জাল বোনা। সেই ভালোবাসার জাল অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছিলো মনের অজান্তেই। নিশ্চুপ আমি একা একাই বলে গিয়েছিলাম...
"তোমাকেই যেন ভালোবেসেছি শত রূপে শতবার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।"
মুখে না বললেও ওর চোখের উচ্ছাসে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম ও আমার মনের গোপন বাক্যটাও পড়ে নিয়েছে। খুব করে চাইছিলাম কথা একবার মুখ ফুটে বলুক,
"ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি....
আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি।"
প্রচন্ড শব্দে বাজতে থাকা ফোনের শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো সেই সাথে সুন্দর স্বপ্ন টাও। না না সেটা তো স্বপ্ন নয়, এ তো পুরোটাই বাস্তব। তবে বলতে পারি ঘুমের ঘোরে আমার অতীতের সাথে পুনর্মিলনীতে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বে রসিক মোবাইলটা আর সময় পেল না বেজে উঠার, ইসস! আরেকটু হলেই তো কথার মুখ থেকে আকাঙ্ক্ষিত বাক্যটা শুনে নিতে পারতাম। মোবাইলের ব্যাপারটা ভাবতেই মনে পড়লো যে রিংটোনের আওয়াজ টা শুনলাম সেটা তো আমার মোবাইলের না। তবে কার মোবাইলের আওয়াজ সেটা, আর আমার ঘরেই বা কে এসেছে কেমন করে এসেছে। ভাবতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে, আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম। না আমি তো আমার ঘরেই আছি তবে! হঠাৎ করেই আমার মুখের সামনে ধপাস করে বসে পড়ে কাব্য। ওকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আমি তো পুরোই অবাক, ও কেমন করে ঢুকলো আমার রুমে। রুম তো রাতে লক করেই ঘুমিয়েছি আমি, তবে কাব্য আমার সামনে কেমন করে? আমি কি আবার স্বপ্ন দেখছি নাকি? কাব্যের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে দু হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে ও পাশ ফিরতেই দেখি মহারানী বসে আছে কিছুটা দূরে চায়ের কাপ হাতে। আমার চক্ষু কি চড়কগাছ! সকাল সকাল কি সব হচ্ছে আমার সাথে! আমি কি নেশা টেশা করে ফেলেছি নাকি? না হলে কিসব ভুলভাল দেখছি...
আরেকবার চোখ বন্ধ করে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছি কিন্তু এর মাঝেই কাব্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে চোখের পাতি টেনে চোখ খোলার জন্য। না এবার বেশ বুঝতে পারছি আমি স্বপ্নে নয় বাস্তবেই আছি আর কাব্য কথা দুজনেই সশরীরে আমার রুমে আছে। হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে কাল রাতে বাগান থেকে যখন রুমে ফিরে আসি তখন কথা আমার কাছ থেকে রুমের চাবিটা চেয়ে নিয়েছিল আর বলেছিল ছিটকিনি না দিতে। তাই তো সকাল সকাল মা ছেলে হানা দিয়েছে আমার রুমে। কাব্য ততোক্ষণে আমার বুকের উপর চড়ে বসেছে আর কাতুকুতু দেবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই কথা বলে উঠলো,
কাব্য এখন দুষ্টুমি করো না, সড়ে এসো তুমি আঙ্কেল ফ্রেশ হবে এখন। (আমার দিকে তাকিয়ে) আর এই যে বাংলার শেষ জমিদার দয়া করে একটু জলদি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিন। নইলে যে বাকিদের সঙ্গে বের হওয়া হবে না।
আমি কাব্যকে জাপ্টে ধরে তড়াক করে উঠে বসলাম। কথার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে উঠলাম,
আজ্ঞে মহারানী আপনার আদেশ শিরোধার্য...
কাব্য কি ভেবে খিলখিল করে হেসে উঠলো, তাতেই যেন কথা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে
খুব ভাব হয়েছে না! তোদের দুটোকেই যখন একসাথে পেটাবো তখন বুঝবি মজা।
কথার মিষ্টি শাসানো তেই কাব্য বাবু শান্ত শিষ্ট ছেলে হয়ে গিয়েছে। আমিও আর দেরি না করে মুচকি হাসি হেসে চলে গেলাম বাথরুমের দিকে সকালের কার্য সম্পাদন করতে।
সকালের নাস্তা সেরেই আমরা বেড়িয়ে পড়েছিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আজ যেখানে যাচ্ছি সেই ভোলাগঞ্জ এলাকাটা সাদা পাথর আর স্বচ্ছ পানির লেকের জন্য বিখ্যাত। আমি ছোট থেকেই একটু ভ্রমণ পিপাসু কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য এটাই যে আমি দেশের ৬৪ জেলার মাঝে এই পর্যন্ত মাত্র গোটা দশেক এর বেশি জেলাতেই ঘুরতে যেতে পারে নি। যেই বয়সটাতে ঘুরতে যাবার সময় ছিল সেই বয়সটাতে না চাইতেই আমার কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব এসো গিয়েছিল। তাই ইচ্ছে থাকলেও যখন দেখতাম আমার সমবয়সীরা কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে, আমি তখন মিষ্টি হেসে ওদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতাম। কেন জানি মনে হতো ঐ রকম পরিস্থিতিতে ঘুরতে যাওয়াটাও আমার জন্য বিলাসিতা। বাকিরা ঘুরতে যেত আর আমি গুগলের কাছে যতটুকু পারতাম সেই জায়গা সম্পর্কে ধারণা নিতাম। পরবর্তীতে বাকিদের সামনে এমন ভাবে উপস্থাপন করতাম যেন আমি নিজেই ঘুরে এসেছি সেই জায়গা থেকে। এই ভোলাগঞ্জ টা আমার আবাস জেলা থেকে একদিনের দূরত্বে চাইলেই আসা যায় কিন্তু এটাও হয়তো আসা হতো না যদি না কথা জোর করে ওর সাথে নিয়ে আসতো।
আমার ঘুরাঘুরি করার সখটার ব্যাপারে কথার জানা আছে। একটা সময় কথা আমাকে বলেছিল, যখন ও চাকরি করবে তখন আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। কিন্তু বিধাতা হয়তো অন্য ভাবেই সবটা লিখে রেখেছিল। আমি ওকে পেলাম না আর ও চাকরিটাও করলো না। তবে এখন হয়তো সুযোগ পেয়েছে তাই আমাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। ও না থাকলে আমার কি যে হতো সেটা ভাবলে গা শিউরে ওঠে, কিন্তু ওকে কি আমি পেয়েছি?
হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া গাড়িটা স্পটে পৌঁছাতেই কথা গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে যেতে লাগলো লেকের দিকে। আমি পেছন থেকে বারবার সাবধান করছি কিন্তু কে শুনে কার কথা? চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাথর এর মাঝ দিয়েই কথা দৌড়ে যাচ্ছে। তুত রঙের সালোয়ার কামিজে লম্বা বিনুনি করা কথাকে দেখে সেই কলেজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এমন দুরন্ত স্বভাবের ছিল ও, চঞ্চলতায় ভরপুর। আবার সময়ে সময়ে ভীষন রকমের ঠান্ডা শান্ত সুস্থির। বয়সটা যত বেড়েছে তার সাথেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ওর গুনের সংখ্যা, যাকে বলে একদম গুনবতী মেয়ে। অনেকদিন পর সেই উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়েটাকে খুঁজে পেয়ে দু চোখ ভরে দেখে নেবার স্বাধ জেগেছে মনে। আমি কাব্য কে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আর চোখের নজর কথার উপর। কাব্য বারবার কিছু একটা দেখাতে চাইছিলো, বাধ্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময় কি যে দেখাতে চাইছে সেটাই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করেই কথার দিকে চোখ ঘুরাতেই দেখি ও নিঁচু হয়ে বসে আছে আর পায়ের কাছে কিছু একটা করছে। দেখে মনে হচ্ছে দৌড়াতে গিয়ে নিশ্চিত হোঁচট খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই আমিও ছুট দিলাম ওর কাছে
হলো তো, বারবার বারণ করেছিলাম কিন্তু কে শুনে কার কথা। এখন কেমন লাগছে পায়ে যে ব্যাথা পেলি...
(কথাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে কাব্য কে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম কথার পাশেই) দেখি হাত সরা, কোথায় লেগেছে দেখতে দে আমাকে।
আরে লাগে নি তো, জুতার বেল্টটা খুলে গিয়েছে জাস্ট। শুধুশুধু টেনসন করছিস...
মিথ্যে বলিস না, আমি ওখান থেকে দেখেছি তুই পায়ে হাত দিয়ে বসে আছিস। কিছু না লাগলে হাত টা সরা, আমি দেখি...
আচ্ছা বিশ্বাস না হলে দেখাচ্ছি, কিন্তু তাই বলে তুই আমার পায়ে হাত দিতে যাস না..
কেন পায়ে হাত দিলে আবার কি হবে?
ওর হাতটা সরাতেই দেখি সত্যিই ওর জুতোর বেল্টটা খুলে আছে। তারপরও মন কে বুঝ দেবার জন্য একবার উল্টেপাল্টে দেখে নিলাম। ওর চোখের দিকে তাকাতেই দেখি ও মিটি মিটি হাসছে।
হলো তো শান্তি! বলছি কিছু হয়নি কিন্তু সে মানলে তো। ধ্যাত! মাঝ থেকে শুধু শুধু আমার পায়ে হাত দিলি...
কেনো তোর পায়ে হাত দিয়েছি বলে কি হয়েছে?
কিছু হয় নি (লাজুক ভাব করে) তুই জানিস না মেয়েদের পায়ে হাত দিতে নেই।
এটা আবার কেমন নিয়ম? কেনো হাত দিলে কি হবে, আমি যে দিলাম তাতে কি কিছু হয়েছে?
এতো কিছু আমি জানি না, তোর সাথে কথা বলে পারবো না। প্যাঁচ ধরার ওস্তাদ, চল না ওখানে গিয়ে বসি...
জানি জানি কিসের এতো তাড়াহুড়ো, লেকের জলে পা ভিজাবি তাই তো!
হঠাৎ দুহাতে আমার গাল টেনে দিয়ে,
এই জন্যই তো তোকে এতো ভালোবাসি। আমি বলার আগেই তুই সব বুঝে যাস। এতো ভাবিস কেন রে আমাকে নিয়ে তুই? যে পর্যন্ত লেকের জলে পা না ভিজাবো ততোক্ষণ পর্যন্ত আমার মনের ছটফটানি কমবে নারে। চল চল তাড়াতাড়ি চল...
কাব্যের এক হাত ধরে কথা এগিয়ে চলেছে আর আমি পেছন থেকে পল্লবিত আঁখি তে ওর দিকেই তাকিয়ে আছি। ওর বলা কথা গুলো এখনো কানে বাজছে, ও কি বলে গেল! ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, সত্যিই ভালোবাসে...
কোন সন্দেহ!! অবকাশই নেই।