24-02-2023, 02:02 PM
লিপিকার বিয়ের রাতের ঘটনার পর এক মাস পার হয়ে গেছে। রবি বারের সকাল। অনিকেত পিয়ালি দের বাড়িতে চলে এসেছিল সকাল থেকেই। আজ একজনের আসার কথা আছে। অনিকেত পিয়ালি আর ওর বাবা মা একসাথে বসে গল্প করছিল। তখনই ওদের বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। আর গাড়ি থেকে নেমে এলেন সৈকত বসু।
-আপনি যে এভাবে আমাদের সাহায্য করবেন আমরা সত্যিই ভাবতে পারিনি সৈকত বাবু। সৈকত বাবুর দিকে চায়ের কাপ টা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন পিয়ালির মা রানু দেবী।
-সত্যি আঙ্কেল আমার এখনও বিশ্বাস হয় না যে আপনি নিজের রেপুটেশন এর কথা না ভেবে এভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। ওই ভিডিও গুলো যে পাঠিয়েছিল আমাকে তাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুজে পাইনি। ভেবেছিলাম ওই ভগবানের দুত কে কোনোদিনও খুজে পাব না। কিন্তু লিপিকার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে যখন আপনি দেখা করলেন তখন আমার জাস্ট পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল। আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারিনি ওটা আপনি হবেন। এর আগে বেশি কথা বলার সময় না সুযোগ হয়নি আপনার সাথে। তাই অনেক প্রশ্ন আছে আঙ্কেল আমাদের সবার মনে। কিভাবে করলেন এসব? রাহুল তো আপনার নিজের ছেলে। তাও কিভাবে পারলেন এভাবে আমাদের সাহায্য করতে?
একটানা বলে গেলো অনিকেত।
-ছেলে? কুলাঙ্গার একটা। যদি পারতাম আমি ওকে নিজে হাতে খুন করে ফেলতাম। কিন্তু যতই হোক নিজের ছেলে তো। নিজের রক্ত। পুরো মারতে পারলাম না। বলে স্মিত হাসলেন সৈকত বাবু।
সবার চোখ একসঙ্গে বড় বড় হয়ে গেলো। বলেন কি সৈকত বাবু। সবার হতবম্ভ মুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলেন সৈকত বাবু। তারপর বললেন।
-আমি জানি অনেক প্রশ্ন আপনাদের মনে। আমি আজ সবই বলব। তবে আমি যা যা বলব সেগুলো হয়তো আপনাদের একসাথে বসে শুনতে অস্বস্তি হতে পারে।
-চিন্তা করবেন না সৈকত বাবু। এই কমাসে আমরা সবাই যা যা দেখেছি আর সহ্য করেছি তারপর আর কোন কিছুই আমাদের বিব্রত করবে না। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। আমরা একসাথে বসেই শুনবো। বললেন পিয়ালির বাবা কমলেশ বাবু।
সৈকত বাবু বলতে শুরু করলেন তার কাহিনি।
-রাহুল হোল আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান। যখন রাহুলের ১৬ বছর বয়স তখন আমার প্রথম স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যায়। রাহুল প্রথম থেকেই খুব জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের। ছোট থেকেই অসৎ সঙ্গে পড়ে নষ্ট হতে শুরু করেছিল। ওর মা মারা যাবার পর সেটা আরও বেড়ে গেলো। আমি বাড়িতে বেশিরভাগ সময় থাকতে পারতাম না। তাই ভাবলাম বাড়িতে একজন অবিভাবক এর দরকার। তাছাড়া আমি নিজেও খুব একাকিত্ত অনুভব করতাম। তাই আমি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করলাম। আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনিতা আমার থেকে প্রায় ১২ বছরের ছোট। রাহুল সুনিতা কে একেবারেই মেনে নিতে পারল না। বিয়ের পর থেকেই ওর সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করতো রাহুল। ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু হলনা। রাহুল যত বড় হতে লাগলো তত সুনিতার সাথে ওর দূরত্ব বাড়তে থাকলো।
মলয় এর সাথে পার্টনারশিপ আমার অনেক বছরের। শুরুর দিকে ওকে ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। যেমন টা ও নিজেকে সমাজের কাছে দেখায় তেমন টা কিন্তু ও একেবারেই নয়। এত দান করা, মানুষ কে সাহায্য করা এসব ওর মুখোস। আসল মানুষ টা কে আমি চিনতে শুরু করি আমার দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে। সুনিতার প্রতি ওর একটা আকর্ষণ শুরু থেকেই ছিল। নানা ভাবে ও আমার কাছে সুনিতার প্রশংসা করতো প্রায়ই। কখনো কখনো সেটা শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। আমি বুঝেও ইগনোর করতাম শুরুর দিকে। তবে এরপর মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। আমার অনুপস্থিতিতে ও আমার বাড়ি চলে যেত। সুনিতা বাড়িতে থাকতো। ওর সাথে নানা আছিলায় খোস গল্প করতো জোর করে, তার সাথে অতিরিক্ত রুপের প্রশংসা, নোংরা জোকস বলা এসব ও চলতো। সুনিতা একদমই সাধারন মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। ও এসব পছন্দ করতো না। ও সবই বুঝত কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারতো না। আমি এসব একদিন জানতে পারি সুনিতার কাছেই। তারপর আমি মলয় এর সাথে সিরিয়াসলি কথা বলি। কড়া ভাবেই ওকে বলি এসব বন্ধ করতে। মলয় ও মেনে নেয়। তারপর থেকে ও আর এসব করতো না। তবে এরপরে কোথাও কোন পার্টি তে দেখা হলে সুনিতার ওপর ওর নজর আমার দৃষ্টি এড়াতো না।
-কি বলছেন আপনি। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না। ছোট থেকে মলয় আঙ্কেল আমাকে কত স্নেহ করতেন। উনি এরকম মানুষ? পিয়ালি বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো।
সৈকত বাবু হাসলেন স্মিত। তারপর বললেন।
-এখনও তো কিছুই বলিনি। শেষ অব্দি শোন।
-রাহুলের বিয়ের মাস ছয়েক আগে একদিন আমি ব্যাবসার কাজে বাইরে গেছিলাম। সুনিতা বরাবরের মত বাড়িতেই ছিল। তখন রাহুলের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে লিপিকার সাথে। আমি চাইনি ঐ পরিবারে রাহুলের বিয়ে হোক। কিন্তু রাহুলের জেদের কাছে আমি হার মেনেছিলাম। ব্যাবসার কাজ মিটিয়ে দুদিন পর যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম সুনিতা কেমন যেন হয়ে গেছে। চোখ মুখ শুকনো। চোখের তলায় কালি। নিস্তেজ প্রানহীন একটা মানুষ। এরকম তো দেখে যাইনি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। আমাকে কিছুই বলল না। বার বার জিজ্ঞাসা করলেও এদিক ওদিকের কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর ধিরে ধিরে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিয়ের মাস তিনেক আগে আমাকে আবার একদিনের জন্যে বাইরে যেতে হয়। এবার সুনিতা অনুরোধ করেছিল ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। আমি অবাক হয়েছিলাম। এর আগে ও কখনো এরকম বলেনি। এবারে আমাকে একদিনে অনেক জায়গা যেতে হতো, সুনিতা কে নিয়ে গেলে সমস্যা হতো। তাই ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একা রেখেই চলে গেলাম। আজও আপসোস হয় ঐ দিনটার কথা ভেবে। পরের দিন যখন ফিরলাম দেখলাম সুনিতার আবার সেই একই অবস্থা, বরং এবার আরও খারাপ অবস্থা। আমি চেপে ধরলাম ওকে। শুরুতে বলতে না চাইলেও পরে আর নিজেকে আটকাতে পারল না, ভেঙে পড়লো কান্নায়। তারপর আমাকে যা যা বলল তা শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।
-প্রথম বার যেদিন দুনিনের জন্যে বাইরে গেলাম সেদিন রাতে সুনিতা ওর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরদিন সকালে উঠে ও নিজেকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় আবিস্কার করে। এবং বুঝতে পারে ওর সাথে কি হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা টা কাটিয়ে ওঠার আগেই রাহুল আসে ওর ঘরে। রাহুল ওকে একে একে বলে ওর সাথে কি হয়েছে। কিভাবে ও সুনিতার এবং বাড়ির সব চাকর দের খাবারে ড্রাগ মিশিয়েছিল, কিভাবে একজন লোক কে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকিয়েছিল। কিভাবে সেই ব্যাক্তি ওর সাথে নোংরামি করেছে। কিভাবে রাহুল নিজেও……। সব কিছু। ঐ অপর ব্যাক্তি আর কেও না। তোমার মলয় আঙ্কেল। মলয় এর সুনিতার ওপর লোভ ছিল জানতাম। কিন্তু রাহুল নিজেও কিভাবে ওর সৎ মায়ের সাথে ওটা করতে পারলো।
গলা ধরে এলো সৈকত বাবুর। একটু থামলেন তিনি। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল সৈকত বাবুর দিকে তাকিয়ে। কেও কিছু বলতে পারল না। সৈকত বাবু আবার বলতে শুরু করলেন।
-রাহুল সুনিতার নোংরা ভিডিও তুলে রেখেছিল। সেটা দিয়েই ওকে ব্ল্যাকমেল করে ওর মুখ বন্ধ করে। রাহুল এটাও বলেছিল সুনিতা মুখ খুললে মলয় আমার ক্ষতি করে দেবে। সুনিতা ভয়ে মুখ খোলেনি। এরপর থেকে প্রায়ই সুযোগ পেলে সুনিতা কে রাহুল নোংরা ভাবে ছুঁত। সুনিতা অসহায় এর মতো সব সহ্য করতো।
পরের বার যেদিন আমি বাইরে গেলাম সেদিন আর ঘুমের ওষুধের দরকার হয়নি। বাকি চাকর আর দারোয়ান কে ঐ ড্রাগ দিলেও সুনিতা কে দেয়নি। সুনিতা সেদিন স্বজ্ঞানেই ছিল। সেদিন রাতে ওর ওপর মলয় আর রাহুল দুজনে মিলে অত্যাচার করে। সেই রাতেই ওরা সুনিতা কে বলেছিল রাহুল পিয়ালির সাথে কি করেছে এবং রমা আর লিপিকা কিভাবে ওকে সাহায্য করেছে। রমার গ্যাং এর পাওয়ার এর কথাও ওকে ওরা বলে। সুনিতা কে আরও ভয় দেখানোর জন্যেই বলেছিল এসব। মলয় নাকি নিজের সারা বাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। সেটা ওর বাড়িতে কেও জানে না। অজয় এর সাথে রমার গোপন সময় এর ফুটেজ মলয় নাকি নিজের অফিসে বসে দেখে উপভোগ করে। পিয়ালির ফুটেজ টাও মলয় নাকি প্রায়ই দেখে। সেই রাতেও ঐ ফুটেজ টা দেখেই আমার বাড়ি গিয়েছিল মলয়। পিয়ালির ফুটেজ টা পাওয়ার পর মলয় রাহুল কে ব্ল্যাকমেল করে। এতদিনের মনবাসনা পুরন করতে রাহুলকে ব্যাবহার করার প্ল্যান ওর মাথায় আসে। এই সবকিছু রাহুল আর মলয় সে রাতে সুনিতার ওপর অত্যাচার করার পর বলে। মলয় এর এই দিকটা রমা দের কেও জানে না মনে হয়। নাহলে ও রমা দের গ্যাং এর মেম্বার এতদিনেও হয়নি কেন? ওরাও হয়তো মলয় কে বাকি সমাজের মতো ভালো মানুষ বলেই জানে।
-ছিঃ। আমি ভাবতে পারছি না। মলয় আঙ্কেল এতোটা জঘন্য মানুষ ! আমি ছোট থেকে এতদিন যেগুলো কে স্নেহের স্পর্শ ভাবতাম সেগুলো যে নোংরা ছোঁয়া ছিল সেটা আজ অনুভব করতে পারছি। -পিয়ালি রাগে ফেটে পড়লো।
-মলয় সামন্ত নাহয় নিজের স্ত্রী র ওপর নজর রাখতে, বা উপভোগ করতে যে কারনেই হোক ক্যামেরা লাগিয়েছিল। কিন্তু ঐ বাড়িতেই তো ওর নিজের মেয়েও থাকতো। তাকেও… মানে… কিভাবে… কথা গুলো কি ভাবে বলবেন বুঝতে পারলেন না রানু দেবী।
-লিপিকা মলয় এর মেয়ে হতেই পারে না। মলয় এর বাবা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। বিয়ের পর থেকে বার বার চেষ্টার পরও ওদের কোন সন্তান হয়নি। তাই মলয় লুকিয়ে নিজের টেস্ট করাতে ডাক্তার দেখিয়েছিল। কিন্তু রিপোর্ট টা কাওকে দেখায়নি। অবশ্যই লজ্জায়। আমি একদিন রিপোর্ট টা মলয় এর অনুপস্থিতি তে ওর অফিসে হঠাৎ দেখে ফেলি। লিপিকা নিশ্চয়ই অজয় আর রমার অবৈধ সন্তান।
এটা শুনে সবার মুখ হা হয়ে গেলো। একদিনে এত বিস্ময় কেও আশা করেনি।
-যেদিন সুনিতা আমাকে এসব বলল সেদিন রাহুল বাড়িতে ছিল না। থাকলে হয়তো সেদিন ই ওকে খুন করে ফেলতাম। রাহুল বাড়িতে না থাকলে নিজের রুম লক করে যেত। নকল চাবি বানানোর একজন লোকের সাথে আমার ভালো পরিচয় ছিল। আমি তাকে ডেকে রাহুলের রুমের লক খোলা করাই। সে চলে গেলে আমরা রাহুলের রুমে ঢুকি। সুনিতা বলেছিল ঐ ভিডিও গুলোর কপি রাহুল নিজের ল্যাপটপে রেখেছে। রুমে ঢুকে আমি ওর ল্যাপটপ খুলি। ভাগ্য ভালো যে পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিল না। আমরা সুনিতার সব ভিডিও খুজে পাই। তার সাথে খুজে পাই পিয়ালির সাথে রাহুল যা করেছে সেই ভিডিও। সেদিন আবার রাহুলের ল্যাপটপ আগের মতো রেখে, রুম লক করে বেরিয়ে আসি। আর সেদিন থেকে আমি প্ল্যান বানাতে শুরু করি। সুনিতা কে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওখানেও রাহুল সুনিতা কে ফোন করে ভয় দেখাত। বার বার বাড়ি ফেরার জন্য বলত। কিন্তু তাতে আর কোন লাভ হয়নি। তবে আমি যে সব জেনে গেছি সেটা আমরা রাহুল কে কোন ভাবেই আমরা বুঝতে দিই নি।
-রমা আনটি দের ফুটেজ টা আপনি কিভাবে পেলেন? প্রশ্ন করলো অনিকেত।
-রমা যে কি রকম মহিলা তা আমি জানতাম। অজয় রায়, আর ওদের দলের সবাইকেই আমি চিনি। অজয় এর সাথে যে রমার সম্পর্ক আছে সেটা মলয়ও জানতো। আমাদের পার্টনারশিপ এর শুরুর দিকে যখন মলয় কে ভালো মানুষ ভাবতাম তখন নেশার ঘোরে আমাকে দুঃখ করে সেই কথা বলেওছিল। কিন্তু পরে যে ও এই ব্যাপার টা উপভোগ করতে শুরু করেছিল সেটা এখন বুঝতে পারি। সেই কারনেই হয়তো সারা বাড়িতে ও হিডেন ক্যামেরা লাগিয়েছিল। যাই হোক, এরপর আমি অজয় এর বাড়ির চাকর কে টাকা খাইয়ে হাত করি। মোটা টাকার লোভে ছেলে টা রাজি হয়ে যায়। ওর সাহায্যে একদিনের জন্য অজয় এর বাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগাই। জাস্ট একদিনের ফুটেজই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
এরমধ্যে লোক লাগিয়ে আমি পিয়ালির খবর নিচ্ছিলাম, ওরা পিয়ালির আর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আমি তা হতে দিতাম না। সেই সময়ই আমি অনিকেতের ব্যাপারে জেনেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম অনিকেত একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। আমার হোটেলের ব্যাবসা, অনেক রকমের লোকের সাথে পরিচয়। লিপিকার পেছনেও লোক লাগালাম। ওর ক্রিয়াকলাপের ভিডিও জোগাড় করলাম। তারপর ফুটেজ গুলো একটা অন্য নাম্বার থেকে পাঠিয়ে দিলাম অনিকেত কে। শুরুতে সামনে আসার ভরসা পাইনি। একটু সাবধানে করছিলাম সবকিছু। কারন রমার গ্যাং যথেষ্ট পাওয়ারফুল। তবে আড়াল থেকে অনিকেতের ওপর ঠিক নজর রেখেছিলাম। লিপিকার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আমি অনিকেতের সাথে দেখা করে বিয়ের দিনের প্ল্যান টা ওকে বলি। অনিকেতও একই রকম প্ল্যান ভেবে রেখেছিল।
এর পরের অনেক ঘটনা তো অনিকেত এর থেকেই জেনেছেন আপনারা। তবে আমি আরও কিছু তার সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি। আমি সেদিন সকালে কলকাতা তে বিশেষ কাজের আছিলায় ডেকে নিয়ে যাই মলয় কে। সেদিনই সকালে আমি মলয় দের তিন তলার গ্রিলের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম অনিকেত কে। ওটাই অনিকেত ছেলে দুটোকে দিয়েছিল। নকল চাবি টা আমি আগেই মলয় এর থেকে লুকিয়ে বানিয়ে রেখেছিলাম। বিয়ের দিনও আমি নিজে লোক ঠিক করেছিলাম কন্ট্রোল রুমের জন্য। আসলে মলয় কে আমি বলেছিলাম ওকে রাখার জন্য। আর আমিই লোক দিয়ে কৌশলে পানিয়ের সাথে বিষ মিশিয়ে রহুল কে খাইয়ে দিয়েছিলাম। ওই বিষ রাহুল কে মারবে না। তবে যতদিন বাঁচবে, পঙ্গু হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করবে। রাহুলের এই অবস্থা আমি অনেক আগেই করতে পারতাম। কিন্তু সেটা করলে বিয়ে বন্ধ হয়ে যেত। তাহলে আর সবাইকে এভাবে একসাথে শাস্তি দেওয়া যেত না।
এতোটা একটানা বলে থামলেন সৈকত বাবু। সবাই ওনার করুন কাহিনি একদম চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমলেশ বাবু বললেন।
-এবার আপনি কি করবেন? মলয় সামন্ত, রমা, লিপিকা বা অন্যদের খবর কি? করা কি করছে?
সৈকত বাবু বললেন-
অজয় আর ওর গ্যাং কেও আর এই শহরে নেই। পাড়ার লোকজন ওদের বাড়িতে পাথর মারার পরের দিনই ওরা বেপাত্তা হয়েছে। উকিল দের বার কাউন্সিল অজয় এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিয়েছে। এতদিন যা যা ক্রাইম কে অজয় আর রথিন মিলে চাপা দিয়েছে সেই কেস গুলো এই সুযোগে আবার ওপেন হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি অজয় এর লাইসেন্স আর রথিনের চাকরি দুটোই যাবে। অনিলও এই শহরে আর কোনদিন ডাক্তারি করতে পারবে না।
রমা আর লিপিকা ওদের বাড়িতেই আছে। শুনছিলাম খুব তাড়াতাড়ি এখানকার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাবে।
-মলয় বাবু কে তো শুনছিলাম খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কোন খবর জানেন না?
-না। একটু গম্ভির ভাবে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন সৈকত বাবু। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
-যাই হোক, শয়তান গুলো শাস্তি পেয়েছে। এটাই এখন আমার শান্তি। এই বলে উঠে পড়লেন সৈকত বাবু।
-আজ আমি উঠি। আমাকে একবার কোর্ট যেতে হবে আজ। মলয় এর সাথে পার্টনারশিপ শেষ করছি। সেই ব্যাপারেই কাজ আছে।
বেরিয়ে যাবার আগে মলয় বাবু কমলেশ বাবুর হাতে একটা কাগজের খাম দিয়ে বললেন।
-এটা পিয়ালির বিয়ের জন্যে আমার আগাম উপহার। দয়া করে গ্রহন করুন। তাহলে আমি সামান্য হলেও মনের শান্তি পাবো।
কমলেশ বাবু কিছু বলতে পারলেন না। সেটা গ্রহন করলেন। এরপর সৈকত বাবু বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কমলেশ বাবু আর রানু দেবীও এগিয়ে গেলেন গেটের কাছে তাঁকে বিদায় জানাতে।
-মলয় সামন্ত যেন ছাড়া না পায়। ওকে খুজে বার করে শাস্তি দেবেন কিন্তু অবশ্যই। গেটের কাছে এসে বললেন রানু দেবী।
সৈকত বাবু রানু দেবীর দিকে একবার তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, কিছু বললেন না। তারপর গাড়িতে উঠে পড়লেন।
সৈকত বাবু চলে গেলে ওখানেই তার দেওয়া খাম খুলে কমলেশ বাবু দেখলেন ভেতরে আছে একটা ব্যাঙ্ক চেক। তার ওপর অর্থের পরিমানের জায়গায় লেখা আছে ২০ লখ্য টাকা।
—
সৈকত বাবু যখন কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরলেন তখন বিকাল হয়ে গেছে। নিজের রুমে এসে দেখলেন সুনিতা দেবী তখনও ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত স্ত্রীর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন সৈকত বাবু। তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। নিজের বাড়িতে বেসমেনটে একটা সিক্রেট চেম্বার বানিয়েছিলেন সৈকত বাবু। সেটা বাড়ির চাকরেরা জানে না। একটা গোপন দরজা দিয়ে সেখানে ধুকতে হয়। গত এক মাস ধরে দিনে একবার খাবার আর জল নিয়ে সেই চেম্বারে যাচ্ছেন সৈকত বাবু। চেম্বারে এসে একটা ছোট হোলের ভেতর দিয়ে তিনি খাবার আর জল ভেতরে ঠেলে দিলেন। আর তখনই ভেতর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেলো।
-প্লিস আমাকে যেতে দে। আমি জেলে যেতে চাই। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। প্লিসস……
-তোকে এর আগেও বলেছি মলয়। তোর মুক্তি নেই। তুই জীবিত অবস্থায় আর কোনদিন এখান থেকে বেরতে পারবি না। এই জানালা বিহীন ছোট ঘরে, টিমটিমে আলোয়, সারাদিনে একবার আধপেটা খেয়ে মৃত্যুর দিন অব্দি বন্দি থাকবি।
আর কথা বাড়ালেন না সৈকত বাবু, এই প্রার্থনা রোজকার ব্যাপার। তিনি বেরিয়ে এলেন চেম্বার থেকে। তারপর বন্ধ করে দিলেন সাউন্ড প্রুফ ঘরের দরজা। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো ভেতর থেকে ভেসে আসা মলয় সামন্তর চিৎকার এর শব্দ। মলয় সামন্ত নিজে ছাড়া ঐ শব্দ বাইরের কোন জনপ্রানী শুনতে পাবে না।
-আপনি যে এভাবে আমাদের সাহায্য করবেন আমরা সত্যিই ভাবতে পারিনি সৈকত বাবু। সৈকত বাবুর দিকে চায়ের কাপ টা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন পিয়ালির মা রানু দেবী।
-সত্যি আঙ্কেল আমার এখনও বিশ্বাস হয় না যে আপনি নিজের রেপুটেশন এর কথা না ভেবে এভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। ওই ভিডিও গুলো যে পাঠিয়েছিল আমাকে তাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুজে পাইনি। ভেবেছিলাম ওই ভগবানের দুত কে কোনোদিনও খুজে পাব না। কিন্তু লিপিকার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে যখন আপনি দেখা করলেন তখন আমার জাস্ট পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল। আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারিনি ওটা আপনি হবেন। এর আগে বেশি কথা বলার সময় না সুযোগ হয়নি আপনার সাথে। তাই অনেক প্রশ্ন আছে আঙ্কেল আমাদের সবার মনে। কিভাবে করলেন এসব? রাহুল তো আপনার নিজের ছেলে। তাও কিভাবে পারলেন এভাবে আমাদের সাহায্য করতে?
একটানা বলে গেলো অনিকেত।
-ছেলে? কুলাঙ্গার একটা। যদি পারতাম আমি ওকে নিজে হাতে খুন করে ফেলতাম। কিন্তু যতই হোক নিজের ছেলে তো। নিজের রক্ত। পুরো মারতে পারলাম না। বলে স্মিত হাসলেন সৈকত বাবু।
সবার চোখ একসঙ্গে বড় বড় হয়ে গেলো। বলেন কি সৈকত বাবু। সবার হতবম্ভ মুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলেন সৈকত বাবু। তারপর বললেন।
-আমি জানি অনেক প্রশ্ন আপনাদের মনে। আমি আজ সবই বলব। তবে আমি যা যা বলব সেগুলো হয়তো আপনাদের একসাথে বসে শুনতে অস্বস্তি হতে পারে।
-চিন্তা করবেন না সৈকত বাবু। এই কমাসে আমরা সবাই যা যা দেখেছি আর সহ্য করেছি তারপর আর কোন কিছুই আমাদের বিব্রত করবে না। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। আমরা একসাথে বসেই শুনবো। বললেন পিয়ালির বাবা কমলেশ বাবু।
সৈকত বাবু বলতে শুরু করলেন তার কাহিনি।
-রাহুল হোল আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান। যখন রাহুলের ১৬ বছর বয়স তখন আমার প্রথম স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যায়। রাহুল প্রথম থেকেই খুব জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের। ছোট থেকেই অসৎ সঙ্গে পড়ে নষ্ট হতে শুরু করেছিল। ওর মা মারা যাবার পর সেটা আরও বেড়ে গেলো। আমি বাড়িতে বেশিরভাগ সময় থাকতে পারতাম না। তাই ভাবলাম বাড়িতে একজন অবিভাবক এর দরকার। তাছাড়া আমি নিজেও খুব একাকিত্ত অনুভব করতাম। তাই আমি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করলাম। আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনিতা আমার থেকে প্রায় ১২ বছরের ছোট। রাহুল সুনিতা কে একেবারেই মেনে নিতে পারল না। বিয়ের পর থেকেই ওর সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করতো রাহুল। ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু হলনা। রাহুল যত বড় হতে লাগলো তত সুনিতার সাথে ওর দূরত্ব বাড়তে থাকলো।
মলয় এর সাথে পার্টনারশিপ আমার অনেক বছরের। শুরুর দিকে ওকে ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। যেমন টা ও নিজেকে সমাজের কাছে দেখায় তেমন টা কিন্তু ও একেবারেই নয়। এত দান করা, মানুষ কে সাহায্য করা এসব ওর মুখোস। আসল মানুষ টা কে আমি চিনতে শুরু করি আমার দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে। সুনিতার প্রতি ওর একটা আকর্ষণ শুরু থেকেই ছিল। নানা ভাবে ও আমার কাছে সুনিতার প্রশংসা করতো প্রায়ই। কখনো কখনো সেটা শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। আমি বুঝেও ইগনোর করতাম শুরুর দিকে। তবে এরপর মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। আমার অনুপস্থিতিতে ও আমার বাড়ি চলে যেত। সুনিতা বাড়িতে থাকতো। ওর সাথে নানা আছিলায় খোস গল্প করতো জোর করে, তার সাথে অতিরিক্ত রুপের প্রশংসা, নোংরা জোকস বলা এসব ও চলতো। সুনিতা একদমই সাধারন মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। ও এসব পছন্দ করতো না। ও সবই বুঝত কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারতো না। আমি এসব একদিন জানতে পারি সুনিতার কাছেই। তারপর আমি মলয় এর সাথে সিরিয়াসলি কথা বলি। কড়া ভাবেই ওকে বলি এসব বন্ধ করতে। মলয় ও মেনে নেয়। তারপর থেকে ও আর এসব করতো না। তবে এরপরে কোথাও কোন পার্টি তে দেখা হলে সুনিতার ওপর ওর নজর আমার দৃষ্টি এড়াতো না।
-কি বলছেন আপনি। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না। ছোট থেকে মলয় আঙ্কেল আমাকে কত স্নেহ করতেন। উনি এরকম মানুষ? পিয়ালি বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো।
সৈকত বাবু হাসলেন স্মিত। তারপর বললেন।
-এখনও তো কিছুই বলিনি। শেষ অব্দি শোন।
-রাহুলের বিয়ের মাস ছয়েক আগে একদিন আমি ব্যাবসার কাজে বাইরে গেছিলাম। সুনিতা বরাবরের মত বাড়িতেই ছিল। তখন রাহুলের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে লিপিকার সাথে। আমি চাইনি ঐ পরিবারে রাহুলের বিয়ে হোক। কিন্তু রাহুলের জেদের কাছে আমি হার মেনেছিলাম। ব্যাবসার কাজ মিটিয়ে দুদিন পর যখন বাড়ি ফিরলাম দেখলাম সুনিতা কেমন যেন হয়ে গেছে। চোখ মুখ শুকনো। চোখের তলায় কালি। নিস্তেজ প্রানহীন একটা মানুষ। এরকম তো দেখে যাইনি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। আমাকে কিছুই বলল না। বার বার জিজ্ঞাসা করলেও এদিক ওদিকের কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর ধিরে ধিরে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিয়ের মাস তিনেক আগে আমাকে আবার একদিনের জন্যে বাইরে যেতে হয়। এবার সুনিতা অনুরোধ করেছিল ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। আমি অবাক হয়েছিলাম। এর আগে ও কখনো এরকম বলেনি। এবারে আমাকে একদিনে অনেক জায়গা যেতে হতো, সুনিতা কে নিয়ে গেলে সমস্যা হতো। তাই ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একা রেখেই চলে গেলাম। আজও আপসোস হয় ঐ দিনটার কথা ভেবে। পরের দিন যখন ফিরলাম দেখলাম সুনিতার আবার সেই একই অবস্থা, বরং এবার আরও খারাপ অবস্থা। আমি চেপে ধরলাম ওকে। শুরুতে বলতে না চাইলেও পরে আর নিজেকে আটকাতে পারল না, ভেঙে পড়লো কান্নায়। তারপর আমাকে যা যা বলল তা শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।
-প্রথম বার যেদিন দুনিনের জন্যে বাইরে গেলাম সেদিন রাতে সুনিতা ওর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরদিন সকালে উঠে ও নিজেকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় আবিস্কার করে। এবং বুঝতে পারে ওর সাথে কি হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা টা কাটিয়ে ওঠার আগেই রাহুল আসে ওর ঘরে। রাহুল ওকে একে একে বলে ওর সাথে কি হয়েছে। কিভাবে ও সুনিতার এবং বাড়ির সব চাকর দের খাবারে ড্রাগ মিশিয়েছিল, কিভাবে একজন লোক কে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকিয়েছিল। কিভাবে সেই ব্যাক্তি ওর সাথে নোংরামি করেছে। কিভাবে রাহুল নিজেও……। সব কিছু। ঐ অপর ব্যাক্তি আর কেও না। তোমার মলয় আঙ্কেল। মলয় এর সুনিতার ওপর লোভ ছিল জানতাম। কিন্তু রাহুল নিজেও কিভাবে ওর সৎ মায়ের সাথে ওটা করতে পারলো।
গলা ধরে এলো সৈকত বাবুর। একটু থামলেন তিনি। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল সৈকত বাবুর দিকে তাকিয়ে। কেও কিছু বলতে পারল না। সৈকত বাবু আবার বলতে শুরু করলেন।
-রাহুল সুনিতার নোংরা ভিডিও তুলে রেখেছিল। সেটা দিয়েই ওকে ব্ল্যাকমেল করে ওর মুখ বন্ধ করে। রাহুল এটাও বলেছিল সুনিতা মুখ খুললে মলয় আমার ক্ষতি করে দেবে। সুনিতা ভয়ে মুখ খোলেনি। এরপর থেকে প্রায়ই সুযোগ পেলে সুনিতা কে রাহুল নোংরা ভাবে ছুঁত। সুনিতা অসহায় এর মতো সব সহ্য করতো।
পরের বার যেদিন আমি বাইরে গেলাম সেদিন আর ঘুমের ওষুধের দরকার হয়নি। বাকি চাকর আর দারোয়ান কে ঐ ড্রাগ দিলেও সুনিতা কে দেয়নি। সুনিতা সেদিন স্বজ্ঞানেই ছিল। সেদিন রাতে ওর ওপর মলয় আর রাহুল দুজনে মিলে অত্যাচার করে। সেই রাতেই ওরা সুনিতা কে বলেছিল রাহুল পিয়ালির সাথে কি করেছে এবং রমা আর লিপিকা কিভাবে ওকে সাহায্য করেছে। রমার গ্যাং এর পাওয়ার এর কথাও ওকে ওরা বলে। সুনিতা কে আরও ভয় দেখানোর জন্যেই বলেছিল এসব। মলয় নাকি নিজের সারা বাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। সেটা ওর বাড়িতে কেও জানে না। অজয় এর সাথে রমার গোপন সময় এর ফুটেজ মলয় নাকি নিজের অফিসে বসে দেখে উপভোগ করে। পিয়ালির ফুটেজ টাও মলয় নাকি প্রায়ই দেখে। সেই রাতেও ঐ ফুটেজ টা দেখেই আমার বাড়ি গিয়েছিল মলয়। পিয়ালির ফুটেজ টা পাওয়ার পর মলয় রাহুল কে ব্ল্যাকমেল করে। এতদিনের মনবাসনা পুরন করতে রাহুলকে ব্যাবহার করার প্ল্যান ওর মাথায় আসে। এই সবকিছু রাহুল আর মলয় সে রাতে সুনিতার ওপর অত্যাচার করার পর বলে। মলয় এর এই দিকটা রমা দের কেও জানে না মনে হয়। নাহলে ও রমা দের গ্যাং এর মেম্বার এতদিনেও হয়নি কেন? ওরাও হয়তো মলয় কে বাকি সমাজের মতো ভালো মানুষ বলেই জানে।
-ছিঃ। আমি ভাবতে পারছি না। মলয় আঙ্কেল এতোটা জঘন্য মানুষ ! আমি ছোট থেকে এতদিন যেগুলো কে স্নেহের স্পর্শ ভাবতাম সেগুলো যে নোংরা ছোঁয়া ছিল সেটা আজ অনুভব করতে পারছি। -পিয়ালি রাগে ফেটে পড়লো।
-মলয় সামন্ত নাহয় নিজের স্ত্রী র ওপর নজর রাখতে, বা উপভোগ করতে যে কারনেই হোক ক্যামেরা লাগিয়েছিল। কিন্তু ঐ বাড়িতেই তো ওর নিজের মেয়েও থাকতো। তাকেও… মানে… কিভাবে… কথা গুলো কি ভাবে বলবেন বুঝতে পারলেন না রানু দেবী।
-লিপিকা মলয় এর মেয়ে হতেই পারে না। মলয় এর বাবা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। বিয়ের পর থেকে বার বার চেষ্টার পরও ওদের কোন সন্তান হয়নি। তাই মলয় লুকিয়ে নিজের টেস্ট করাতে ডাক্তার দেখিয়েছিল। কিন্তু রিপোর্ট টা কাওকে দেখায়নি। অবশ্যই লজ্জায়। আমি একদিন রিপোর্ট টা মলয় এর অনুপস্থিতি তে ওর অফিসে হঠাৎ দেখে ফেলি। লিপিকা নিশ্চয়ই অজয় আর রমার অবৈধ সন্তান।
এটা শুনে সবার মুখ হা হয়ে গেলো। একদিনে এত বিস্ময় কেও আশা করেনি।
-যেদিন সুনিতা আমাকে এসব বলল সেদিন রাহুল বাড়িতে ছিল না। থাকলে হয়তো সেদিন ই ওকে খুন করে ফেলতাম। রাহুল বাড়িতে না থাকলে নিজের রুম লক করে যেত। নকল চাবি বানানোর একজন লোকের সাথে আমার ভালো পরিচয় ছিল। আমি তাকে ডেকে রাহুলের রুমের লক খোলা করাই। সে চলে গেলে আমরা রাহুলের রুমে ঢুকি। সুনিতা বলেছিল ঐ ভিডিও গুলোর কপি রাহুল নিজের ল্যাপটপে রেখেছে। রুমে ঢুকে আমি ওর ল্যাপটপ খুলি। ভাগ্য ভালো যে পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিল না। আমরা সুনিতার সব ভিডিও খুজে পাই। তার সাথে খুজে পাই পিয়ালির সাথে রাহুল যা করেছে সেই ভিডিও। সেদিন আবার রাহুলের ল্যাপটপ আগের মতো রেখে, রুম লক করে বেরিয়ে আসি। আর সেদিন থেকে আমি প্ল্যান বানাতে শুরু করি। সুনিতা কে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওখানেও রাহুল সুনিতা কে ফোন করে ভয় দেখাত। বার বার বাড়ি ফেরার জন্য বলত। কিন্তু তাতে আর কোন লাভ হয়নি। তবে আমি যে সব জেনে গেছি সেটা আমরা রাহুল কে কোন ভাবেই আমরা বুঝতে দিই নি।
-রমা আনটি দের ফুটেজ টা আপনি কিভাবে পেলেন? প্রশ্ন করলো অনিকেত।
-রমা যে কি রকম মহিলা তা আমি জানতাম। অজয় রায়, আর ওদের দলের সবাইকেই আমি চিনি। অজয় এর সাথে যে রমার সম্পর্ক আছে সেটা মলয়ও জানতো। আমাদের পার্টনারশিপ এর শুরুর দিকে যখন মলয় কে ভালো মানুষ ভাবতাম তখন নেশার ঘোরে আমাকে দুঃখ করে সেই কথা বলেওছিল। কিন্তু পরে যে ও এই ব্যাপার টা উপভোগ করতে শুরু করেছিল সেটা এখন বুঝতে পারি। সেই কারনেই হয়তো সারা বাড়িতে ও হিডেন ক্যামেরা লাগিয়েছিল। যাই হোক, এরপর আমি অজয় এর বাড়ির চাকর কে টাকা খাইয়ে হাত করি। মোটা টাকার লোভে ছেলে টা রাজি হয়ে যায়। ওর সাহায্যে একদিনের জন্য অজয় এর বাড়িতে হিডেন ক্যামেরা লাগাই। জাস্ট একদিনের ফুটেজই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
এরমধ্যে লোক লাগিয়ে আমি পিয়ালির খবর নিচ্ছিলাম, ওরা পিয়ালির আর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আমি তা হতে দিতাম না। সেই সময়ই আমি অনিকেতের ব্যাপারে জেনেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম অনিকেত একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। আমার হোটেলের ব্যাবসা, অনেক রকমের লোকের সাথে পরিচয়। লিপিকার পেছনেও লোক লাগালাম। ওর ক্রিয়াকলাপের ভিডিও জোগাড় করলাম। তারপর ফুটেজ গুলো একটা অন্য নাম্বার থেকে পাঠিয়ে দিলাম অনিকেত কে। শুরুতে সামনে আসার ভরসা পাইনি। একটু সাবধানে করছিলাম সবকিছু। কারন রমার গ্যাং যথেষ্ট পাওয়ারফুল। তবে আড়াল থেকে অনিকেতের ওপর ঠিক নজর রেখেছিলাম। লিপিকার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আমি অনিকেতের সাথে দেখা করে বিয়ের দিনের প্ল্যান টা ওকে বলি। অনিকেতও একই রকম প্ল্যান ভেবে রেখেছিল।
এর পরের অনেক ঘটনা তো অনিকেত এর থেকেই জেনেছেন আপনারা। তবে আমি আরও কিছু তার সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি। আমি সেদিন সকালে কলকাতা তে বিশেষ কাজের আছিলায় ডেকে নিয়ে যাই মলয় কে। সেদিনই সকালে আমি মলয় দের তিন তলার গ্রিলের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম অনিকেত কে। ওটাই অনিকেত ছেলে দুটোকে দিয়েছিল। নকল চাবি টা আমি আগেই মলয় এর থেকে লুকিয়ে বানিয়ে রেখেছিলাম। বিয়ের দিনও আমি নিজে লোক ঠিক করেছিলাম কন্ট্রোল রুমের জন্য। আসলে মলয় কে আমি বলেছিলাম ওকে রাখার জন্য। আর আমিই লোক দিয়ে কৌশলে পানিয়ের সাথে বিষ মিশিয়ে রহুল কে খাইয়ে দিয়েছিলাম। ওই বিষ রাহুল কে মারবে না। তবে যতদিন বাঁচবে, পঙ্গু হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করবে। রাহুলের এই অবস্থা আমি অনেক আগেই করতে পারতাম। কিন্তু সেটা করলে বিয়ে বন্ধ হয়ে যেত। তাহলে আর সবাইকে এভাবে একসাথে শাস্তি দেওয়া যেত না।
এতোটা একটানা বলে থামলেন সৈকত বাবু। সবাই ওনার করুন কাহিনি একদম চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমলেশ বাবু বললেন।
-এবার আপনি কি করবেন? মলয় সামন্ত, রমা, লিপিকা বা অন্যদের খবর কি? করা কি করছে?
সৈকত বাবু বললেন-
অজয় আর ওর গ্যাং কেও আর এই শহরে নেই। পাড়ার লোকজন ওদের বাড়িতে পাথর মারার পরের দিনই ওরা বেপাত্তা হয়েছে। উকিল দের বার কাউন্সিল অজয় এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিয়েছে। এতদিন যা যা ক্রাইম কে অজয় আর রথিন মিলে চাপা দিয়েছে সেই কেস গুলো এই সুযোগে আবার ওপেন হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি অজয় এর লাইসেন্স আর রথিনের চাকরি দুটোই যাবে। অনিলও এই শহরে আর কোনদিন ডাক্তারি করতে পারবে না।
রমা আর লিপিকা ওদের বাড়িতেই আছে। শুনছিলাম খুব তাড়াতাড়ি এখানকার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাবে।
-মলয় বাবু কে তো শুনছিলাম খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কোন খবর জানেন না?
-না। একটু গম্ভির ভাবে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন সৈকত বাবু। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
-যাই হোক, শয়তান গুলো শাস্তি পেয়েছে। এটাই এখন আমার শান্তি। এই বলে উঠে পড়লেন সৈকত বাবু।
-আজ আমি উঠি। আমাকে একবার কোর্ট যেতে হবে আজ। মলয় এর সাথে পার্টনারশিপ শেষ করছি। সেই ব্যাপারেই কাজ আছে।
বেরিয়ে যাবার আগে মলয় বাবু কমলেশ বাবুর হাতে একটা কাগজের খাম দিয়ে বললেন।
-এটা পিয়ালির বিয়ের জন্যে আমার আগাম উপহার। দয়া করে গ্রহন করুন। তাহলে আমি সামান্য হলেও মনের শান্তি পাবো।
কমলেশ বাবু কিছু বলতে পারলেন না। সেটা গ্রহন করলেন। এরপর সৈকত বাবু বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কমলেশ বাবু আর রানু দেবীও এগিয়ে গেলেন গেটের কাছে তাঁকে বিদায় জানাতে।
-মলয় সামন্ত যেন ছাড়া না পায়। ওকে খুজে বার করে শাস্তি দেবেন কিন্তু অবশ্যই। গেটের কাছে এসে বললেন রানু দেবী।
সৈকত বাবু রানু দেবীর দিকে একবার তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, কিছু বললেন না। তারপর গাড়িতে উঠে পড়লেন।
সৈকত বাবু চলে গেলে ওখানেই তার দেওয়া খাম খুলে কমলেশ বাবু দেখলেন ভেতরে আছে একটা ব্যাঙ্ক চেক। তার ওপর অর্থের পরিমানের জায়গায় লেখা আছে ২০ লখ্য টাকা।
—
সৈকত বাবু যখন কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরলেন তখন বিকাল হয়ে গেছে। নিজের রুমে এসে দেখলেন সুনিতা দেবী তখনও ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত স্ত্রীর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন সৈকত বাবু। তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। নিজের বাড়িতে বেসমেনটে একটা সিক্রেট চেম্বার বানিয়েছিলেন সৈকত বাবু। সেটা বাড়ির চাকরেরা জানে না। একটা গোপন দরজা দিয়ে সেখানে ধুকতে হয়। গত এক মাস ধরে দিনে একবার খাবার আর জল নিয়ে সেই চেম্বারে যাচ্ছেন সৈকত বাবু। চেম্বারে এসে একটা ছোট হোলের ভেতর দিয়ে তিনি খাবার আর জল ভেতরে ঠেলে দিলেন। আর তখনই ভেতর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেলো।
-প্লিস আমাকে যেতে দে। আমি জেলে যেতে চাই। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। প্লিসস……
-তোকে এর আগেও বলেছি মলয়। তোর মুক্তি নেই। তুই জীবিত অবস্থায় আর কোনদিন এখান থেকে বেরতে পারবি না। এই জানালা বিহীন ছোট ঘরে, টিমটিমে আলোয়, সারাদিনে একবার আধপেটা খেয়ে মৃত্যুর দিন অব্দি বন্দি থাকবি।
আর কথা বাড়ালেন না সৈকত বাবু, এই প্রার্থনা রোজকার ব্যাপার। তিনি বেরিয়ে এলেন চেম্বার থেকে। তারপর বন্ধ করে দিলেন সাউন্ড প্রুফ ঘরের দরজা। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো ভেতর থেকে ভেসে আসা মলয় সামন্তর চিৎকার এর শব্দ। মলয় সামন্ত নিজে ছাড়া ঐ শব্দ বাইরের কোন জনপ্রানী শুনতে পাবে না।
|| সমাপ্ত ||