23-02-2023, 09:31 PM
(This post was last modified: 23-02-2023, 09:45 PM by Bumba_1. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
(২)
সেদিন রাতে তাদের বাড়িতে বিধায়কের কুলাঙ্গার ছেলে মুন্না এবং তার তিন সঙ্গীর আবির্ভাব ঘটেছিলো। চার দুর্বৃত্তের অন্তরে কম্পন সৃষ্টি করে চতুর্দশী বালিয়াড়ি। বিকৃত মস্তিষ্কে খেলা করে কামার্ত ভাবনা। অতঃপর নৈঃশব্দ্যে আনমনা বাতাসে ভেসে বেড়ায় বালিয়াড়ির চাপা কান্না, বুকভরা হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস! সবশেষে অমর্ত্যর চোখের সামনেই প্রথমে নিজের সতীত্ব এবং পরে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিলো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী অদিতিকে।
অমর্ত্যর ভীষণ ইচ্ছে করছিল তার স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যেতে। কিন্তু এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেতে পারেনি সে। তাকে যে প্রতিশোধ নিতে হতো! সে কি করে যেত? 'আমি নিঃশ্চুপ, আমি বাকরুদ্ধ। জানি অন্ধকার আসবে, গিলে খাবে শুদ্ধ বাতাসটুকুও। মাটির গভীরে চাপা থাকবে আমার কান্না। কতটা কঠিন হলে এতো নিষ্ঠুর হয় মন! এতদিন তো চুপ করেই ছিলাম, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারিনি, এবার প্রতিশোধের পালা। এবার শব্দরা দীর্ঘ ছুটিতে যাবে, হাজার বছর পর আমার মনের গভীরের যন্ত্রণার ফসিলস খুঁজে পাবে কোনো এক প্রত্নতাত্ত্বিক। তবে কি এ বসন্তই শেষ? এমনটা তো কথা ছিলনা! চাইলেই আরো পথ হাঁটতে পারতাম।' শপথ নিয়েছিলো অমর্ত্য। তারপর একে একে শেষ করেছিল তার স্ত্রীর হত্যাকারীদের। বিধায়কের ছেলে মুন্নার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আজ তার অবসান ঘটলো। কিন্তু এখনো অনেক অনেক কাজ বাকি। একে একে জঞ্জালমুক্ত করতে হবে এই সমাজ, এই পৃথিবী।
তবে অমর্ত্যর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা বা এর সূত্রপাত বছর পাঁচেক আগে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনার সম্মিলিত ফলস্বরূপ শুরু হয়। অম্বরীশের ফোনটা এসেছিলো দুপুরের দিকে, ''আরে, ভাই দার্জিলিঙে তুইও এসেছিস?'' কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়েছিল অমর্ত্য, ''না তো, আমি তো এখানেই মানে আমার কলেজে রয়েছি। খাতা দেখছিলাম।'' হাসতে হাসতে অম্বরীশ জানিয়েছিল, ''ভাই, এতটা ভুল দেখলাম? আমি আর দিপ্তেশ স্পষ্ট দেখলাম টাইগার হিলে তুই সূর্যোদয়ের ছবি তুলছিস, একটু দূর থেকে ডাকতেই তুই কেমন যেন হনহনিয়ে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলি।''
''হয়তো আমার মতো দেখতে অন্য কেউ হবে .. বিশ্বাস না হয়, তুই খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, আমি কলেজেই রয়েছি।" গলায় অবিশ্বাসের সুর মিশিয়ে জবাব দিয়েছিলো অমর্ত্য। ''কিন্তু একসাথে দুজনেই ভুল দেখলাম?'' অম্বরীশের সন্দেহ একথা সেকথায় চাপা দিয়েছিল সেইদিন।
এই ঘটনার প্রায় দুই বছর পরে তার কলেজের এক ছাত্রী মনোরমা বলেছিলো ''স্যার, পরশুদিন বিকেলে আপনাকে বইমেলাতে দেখলাম ! বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে যান নি?'' ছাত্রীর কথায় রীতিমতো অবাক হয়ে অমর্ত্য জানিয়েছিল যে, সেই বিকেলে সে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। মনোরমার তখন সসেমিরা অবস্থা।
শেষ ঘটনাটি এরও মাস ছয়েক পরে। সেদিন বাজারে হঠাৎ জামায় টান পড়তে ফিরে দ্যাখে অবাক চোখে তাকিয়ে পাশের পাড়ার প্রবীরদা। আগে তাদের পাড়ায় থাকলেও কিছুদিন আগে নতুন ফ্ল্যাট কিনে এখন পাশের পাড়ায় চলে গিয়েছেন। সেই প্রবীরদাও জানিয়েছিলো অমর্ত্যকে একটা বড়ো ব্যাগ নিয়ে আসানসোল স্টেশনে কিছুদিন আগে তিনি দেখেছেন। ডাকলেও নাকি সে সাড়া দেয় নি।
কথাটা তার স্ত্রীকেও কোনোদিন জানায়নি অমর্ত্য। পরবর্তীকালে অদিতি চলে যাওয়ার পর এই ঘটনাগুলো একটা অদ্ভুত পরিকল্পনার জন্ম দিয়েছিলো তার মনে। তার মতো দেখতে লোকটি কোনো অপরাধ করলে বা কোনো গর্হিত কাজ করলে তার দায় যেমন তার ওপর চাপলেও চাপতে পারে। তেমন উল্টোটাও তো ঘটতে পারে! সেই থেকে যে মানুষটি তার প্রতিরূপ, যাকে সে চোখেও দেখেনি, তাকেই নিজের অল্টার ইগো ভাবতে শুরু করে অমর্ত্য।
★★★★
পুরনো সব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় মাথা গরম হয়ে ওঠে অমর্ত্যর। এখন এসব ভাবার সময় নয়, তাকে তার পরের শিকার নিয়ে ভাবতে হবে। ওসব ফালতু চিন্তা ফেলে দিতে হবে মাথা থেকে .. বর্জন করতে হবে একদম। অভিনব কোনো উপায় ভাবতে হবে পরের কাজ'টার জন্য। সে ঢুকে পড়ে তার এক চিলতে গবেষণাগারে। মনে মনে হাসে .. 'গবেষণাগার!' পরক্ষণেই ভাবে হ্যাঁ, গবেষণাগারই তো! কত মাথা খাটিয়ে এক একটা নিঁখুত খুন করতে হয়েছে তাকে .. কেউ কি জানে? বোঝে এসব? তবে তার সবচাইতে প্রিয় পদ্ধতি হলো লম্বা সুতীক্ষ্ণ ব্লেড গলার নলীতে বসানো। আঃ, কি আরাম যে হয় ! মাখনে ছুরি চালানোর থেকেও আরামদায়ক মনে হয় যখন তার হাতের জাপানী ব্লেড সাঁই শব্দ তুলে তার শিকারের শ্বাসনালীটা কেটে ফেলে। এত নিখুঁত, এত সূক্ষ্ম ! আহাহাহা সুখ হয়তো একেই বলে! তবে ওই, একটু ক্লোরোফর্ম রাখতে হয়। নইলে মানুষরূপী জানোয়ার গুলোকে কাটবার আগে এমন ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে! ভীষণ বিরক্ত লাগে তখন।
বেসিনে সরু জাপানি ব্লেডটা মনের আনন্দে ধুয়ে তার ব্যাগে রাখার পরেই যেটা দেখলো, তা দেখে তার বুকটা একটু কেঁপে উঠলো। দেখলো তার বাড়ির সদর দরজা অর্ধেকটা খোলা, গ্রীলের গেটখানাতেও তালা দিতে ভুলে গেছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয় ! তার ভীষণভাবে মনে আছে দরজা সে বন্ধ করেছিলো। কেউ কি তার বাড়িতে ঢুকেছে ? সে কে ? বিশাল বাড়ি সে তৈরি করেনি। সব মিলিয়ে মোট তিনটে ঘর, এছাড়া কিচেন আর বাথরুম। সে প্রথমে বাথরুম, তারপর রান্নাঘর, তারপর একটা একটা করে ঘর খুঁজে শেষে যখন দোতলায় অদিতির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন চমকে উঠে দু'পা পিছিয়ে গেলো অমর্ত্য। অদিতির ছবির দিকে যে তাকিয়ে আছে তাকে সে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর চেনে আয়নাতে। মোবাইলে নিজস্বী তোলা হলে যে লোকটার ছবি দেখা যায় .. সে এই লোকটা। কিন্তু এ কি করে সম্ভব ? সেই প্রতিরূপ তো তার কল্পনামাত্র! সে চোখ কচলায় কিন্তু আলোকজ্জ্বল ঘরে অন্য সব কিছুর মতোই আয়না ছাড়াই নিজেই নিজেকে দেখতে পাচ্ছে অমর্ত্য।
"ক..কে ওখানে? কে আপনি?'' কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে অমর্ত্য। ''কেন চিনতে পারছো না?'' ঘুরে দাঁড়ায় তার প্রতিরূপ। ''নাকি চিনতে চাইছো না?'' হঠাৎ করে তার প্রতিরূপের হাতে টিউবলাইটের সুতীব্র আলোয় ঝলসে ওঠে সেই জাপানি ব্লেডখানা; যেটা যত্ন করে ধুয়ে একটু আগে অমর্ত্য ঢুকিয়ে রেখেছিল নিজের ব্যাগে। ''এটা চেনো তো?'' যেন বিদ্রুপের স্বরে জানতে চায় তার প্রতিরূপ। মুখটা কিরকম যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় অমর্ত্যর।, বলে ''ওটা পেলে কোথায়? কে তুমি ? ব্লাডি গুন!''
''আচ্ছা, তাই? তুমি একের পর এক অপরাধ করে আমাকে দোষী করে গেছো চিরকাল, আর নিজে সব ময়লা আমার ওপর দিয়ে সকলের কাছে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে থেকেছো। আজ তোর শেষদিন।'' কথাগুলো বলেই অতিমাত্রায় হিংস্র হয়ে ওঠে তার প্রতিরূপ।
'কি সব বলছো? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার বাড়ি থেকে বেরোও এক্ষুণি..'' অমর্ত্যর এই কথায় 'বুঝবে, বুঝবে .. এই ব্লেড দিয়ে তোমার গলার নলীটা মসৃণভাবে কেটে দিলেই সবটা বুঝে ফেলতে পারবে। তোমার প্রতিশোধ নেওয়ার মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর তো তোমাকে আমি কোনো অন্যায় করতে দেবো না। এবার তোমার যাওয়ার পালা .. তৈরি হও .." হিসহিসিয়ে এই কথাগুলো বলেই একটা লাফ দিয়ে অমর্ত্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার প্রতিরূপ। একটুর জন্য নিশানা ফস্কে যেতেই অমর্ত্য দৌড় দেয় সিঁড়ির দিকে। পিছনে তখন তার প্রতিরূপ উদ্যত ব্লেড হাতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে কোনোমতে শেষ সিঁড়ির ধাপের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই তার প্রতিরূপ যেন নিঃশ্বাস ফেলে অমর্ত্যর ঘাড়ে। প্রাণ বাঁচাতে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় বাড়িতে ঢোকার প্রধান দরজার দিকে। অমর্ত্য বাইরে বেরোতেই তার প্রতিরূপ তাকে অবাক করে দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দেয়।
এরপর প্রায় দুঘণ্টা কেটে গিয়েছে। অমর্ত্য তার বাড়ির দরজার বাইরে বসে আছে। এমত অবস্থায় তার কি করা উচিৎ, তা অনেক ভেবেও বের করতে পারছে না সে। বাড়ির ভিতরে তার সর্বস্ব রয়ে গেছে। না পারছে কাউকে ফোন করতে, না পারছে কারোর কাছে কোনোরকম সাহায্য চাইতে যেতে। প্রতিবেশী কাউকে জাগাতেও কেমন যেন লাগছে .. এখন যে মাঝরাত। তার নিজের বাড়িতে নিজের ঘরের আলোটাও একটু আগে নিভে গেলো। কে আলো নেভাল? সেই ব্যক্তি? তার প্রতিরূপ? এই গভীর রাতে কাউকে ঘুম থেকে টেনে তুলে কি বলবে সে ? কিভাবে বলবে? এসব এলোমেলো ভাবনাতেই ধীরে ধীরে রাত কেটে যায়, পূর্বদিকে আকাশে আলোর প্রকাশ হতে থাকে। একসময় সকাল হয়, বেলা গড়ায়, বিকেল হয়, দিন শেষ হয়ে যায়, আবার রাত নামে। আবার দিন হয়, ফের রাত নামে। কিন্তু অমর্ত্যর কি হলো ?
অনাহারক্লিষ্ট, বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায়, সম্পূর্ণরূপে মানসিক ভারসাম্যহীন অমর্ত্যকে সেই রাতের দু'দিন পর পুলিশ তার বাড়ি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরের এক রেলস্টেশন থেকে উদ্ধার করে। সে তখন বিড়বিড় করে একটা কথাই বলছিল ''আমার স্ত্রীকে খুঁজছি। দেখেছো কেউ?''