23-02-2023, 12:11 PM
#অন্য_রূপকথা
আগামীকাল মহাশিবরাত্রি, তাই আজ আমার 'সংযম' - অর্থাৎ, নিরামিষ খাবার পালা।
সেইমতো দুপুরে অফিসের খাবার না খেয়ে বাড়ি থেকে বানিয়ে নিয়ে যাওয়া খিচুড়ি খেয়েছিলাম লাঞ্চে। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় খুউউব খিদে পেয়ে গেছিল। এতটাই, যে মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছে। তা, মাথার আর দোষ কি, একেই লাঞ্চের পরিমান অল্প ছিল, তারমধ্যে অফিসেই বিকেলে একটু ব্যয়াম করেছিলাম। তাই, খিদে তো পাবেই! আর আমি সেই ছোট্টবেলা থেকেই খিদে একদম সহ্য করতে পারি না। মানে, খিদে পেলে সমানুপাতিক হারে মাথাও গরম হয়ে যায়! আগে তো দিদির সঙ্গে মারপিট করতাম, এখন তো আর সেটা পারি না, তাই ঝটপট খেয়ে নিই।
কিন্তু ডায়েট মেনে চলছি বলে অনেকদিন ধরেই বাইরের খাবার খাচ্ছি না। তাই… কী করি ভাবতে ভাবতেই সমাধান পেলাম। আমাদের নাগেরবাজারের কাছেই একটি চায়ের দোকান আছে, সেখানে মুখ দিয়ে 'আহ্' বেরিয়ে আসবেই, এইরকম ওয়ার্ল্ড ফেমাস চা বানায়। তাই, সেখানেই গেলাম। চিনি ছাড়া চা বানাতে বলে একটু পাশের দিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ পড়ল একজনের দিকে!
সাধারণ চেহারার একজন বৃদ্ধা - শাড়ি আর গায়ে একটা হাল্কা চাদর দেওয়া। ঠিক আমাদের ঠাকুমা - দিদিমাদের মতোই। আর একহাতে চায়ের ভাঁড়। মুখে কুঞ্চন!
একপলক দেখেই বুঝলাম, চায়ের ভাঁড়টি বড্ড গরম - তাই ধরতে অসুবিধা হচ্ছে ওনার। আমিও পারিনা ধরতে। তাই একটু হেসে, বিস্কুট- কেকের বয়ামের পাশের একটুকরো জায়গা দেখিয়ে বলেছিলাম "খুব গরম না? এখানে রাখতে পারেন।"
উনিও একগাল হেসে বললেন "থ্যাংকইউ, দিদিভাই!"
আমার অনেক সমস্যার মধ্যে একটা হলো, আমি এইধরণের সম্বোধন, মানে কেউ আমাকে 'মা' বা 'দিদিভাই' বলে ডাকলে বুকের মাঝে পাগলাঝোরা বয়ে যায় আমার। হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করে মুহূর্তটাকে। আর ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে করে "আবার বলবে? আর একবার?"
আর হয়ত সেজন্যই ওনার সঙ্গে আলাপ জমালাম। আর কী ভাগ্যিস, আলাপটা জমালাম!
বাহাত্তর বছর বয়স ওঁর, বাড়ি নাগেরবাজারের কাছেই সাতগাছি এলাকাতে। 'বয়সের ধর্ম' অনুযায়ী বেশ কিছু রোগ আছে। আর আছে, একাকীত্বের অনুভব! তাই সবমিলিয়ে বয়সের তুলনাতেও বেশি নেতিয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু, ওই 'ছিলেন' এখন অতীত!
"উনি চলে যাবার পর থেকেই দিনগত পাপক্ষয় করছি মনে হতো গো দিদিভাই! ছেলে বাইরে থাকে, তারা যেতে বলে কিন্তু আমারই আর ইচ্ছে করে না! এমনি কাজের লোকজন আছে, কিন্তু বুকটা খাঁ খাঁ করত! অথচ আমার বয়সে কতমানুষ স্ট্রং থাকে কত!
কিন্তু এইবছরের শুরু থেকে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছি গো মা! এতবছর তো ঘরের কোণেই রয়ে গেলাম, কিছুই করলাম না, দেখলাম না! তাই যা যা করিনি আগে, অথচ এখনও করতে পারব, সেসব করা শুরু করেছি। যেমন, এবার পাড়ার ছোট ছেলেদের সরস্বতী পুজোয় ফল কেটেছি। আগে কোনোদিন করিনি। এখন বিকেলে একটু হাঁটতে বেরোই। আগে কোনোদিন একা একা রাস্তার চায়ের দোকান থেকে চা কিনে খাইনি, ওনার সঙ্গে কখনও বেরোলে খেয়েছি। তবে একা একা - না! কিন্তু এই ক'দিন হলো খাচ্ছি। এবার একদিন ফুচকা খাব! রাস্তার খাবার বলে খাইনি কতবছর হয়ে গেল! একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না!"
কেমন জ্বলজ্বলে মুখে বলে গেলেন উনি।
অদ্ভুত একটা আনন্দ - একটা তেজ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল যেন ওনার অবয়ব থেকে!
কত সাধারণ মানুষ, সাধারণ ইচ্ছে - চা খাওয়া, ফুচকা খাওয়া - কিন্তু এই ছোট্ট ছোট্ট কিছুর মাঝে যে আনন্দধারা আছে, বুঝতে পারছিলাম।
আমি নিজে আনন্দের পথযাত্রী। একটু একমুখীও। একা একা ঘুরতে, সিনেমা দেখতে, রেস্তোরাঁয় খেতে ভালবাসি। ইনবক্সে উপচে পড়া "আপনি কি সিঙ্গল" এর উত্তরে অনায়াসে বলতে পারি "আই অ্যাম আ লোনার, আমার নিজের সাহচর্য বেশি পছন্দ"। কিন্তু আমি বহুবছর ধরেই এরকম। আর ইনি! কথাবার্তা শুনেই মনে হচ্ছিল, বহুবছর ওঁর স্বামী-সংসারের মাঝেই নিজস্ব অস্তিত্বটুকু গচ্ছিত ছিল। আর তারপরে গ্রাস করেছিল প্রবল একাকীত্ব। কিন্তু এখন, নিজের চেষ্টায়, নিজের জন্য বাঁচছেন উনি। ছোট্ট ছোট্ট 'বাকেট লিস্ট আইটেম' এ 'টিক' দিয়ে বোঝাচ্ছেন - বেঁচে আছেন শুধু না, প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে ওঠেন - হয়ত, জীবনে প্রথমবার! আর তাই, ওঁর কথায় এত তেজ! সেই কথাগুলি বলার সময় এত দীপ্তি!
এমনিভাবে, জীবনের প্রান্তিক-পর্বে পৌঁছে বেঁচে ওঠা - এ যদি রূপকথা না হয়, তবে 'রূপকথা' আসলে কি…!
আগামীকাল মহাশিবরাত্রি, তাই আজ আমার 'সংযম' - অর্থাৎ, নিরামিষ খাবার পালা।
সেইমতো দুপুরে অফিসের খাবার না খেয়ে বাড়ি থেকে বানিয়ে নিয়ে যাওয়া খিচুড়ি খেয়েছিলাম লাঞ্চে। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় খুউউব খিদে পেয়ে গেছিল। এতটাই, যে মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরছে। তা, মাথার আর দোষ কি, একেই লাঞ্চের পরিমান অল্প ছিল, তারমধ্যে অফিসেই বিকেলে একটু ব্যয়াম করেছিলাম। তাই, খিদে তো পাবেই! আর আমি সেই ছোট্টবেলা থেকেই খিদে একদম সহ্য করতে পারি না। মানে, খিদে পেলে সমানুপাতিক হারে মাথাও গরম হয়ে যায়! আগে তো দিদির সঙ্গে মারপিট করতাম, এখন তো আর সেটা পারি না, তাই ঝটপট খেয়ে নিই।
কিন্তু ডায়েট মেনে চলছি বলে অনেকদিন ধরেই বাইরের খাবার খাচ্ছি না। তাই… কী করি ভাবতে ভাবতেই সমাধান পেলাম। আমাদের নাগেরবাজারের কাছেই একটি চায়ের দোকান আছে, সেখানে মুখ দিয়ে 'আহ্' বেরিয়ে আসবেই, এইরকম ওয়ার্ল্ড ফেমাস চা বানায়। তাই, সেখানেই গেলাম। চিনি ছাড়া চা বানাতে বলে একটু পাশের দিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ পড়ল একজনের দিকে!
সাধারণ চেহারার একজন বৃদ্ধা - শাড়ি আর গায়ে একটা হাল্কা চাদর দেওয়া। ঠিক আমাদের ঠাকুমা - দিদিমাদের মতোই। আর একহাতে চায়ের ভাঁড়। মুখে কুঞ্চন!
একপলক দেখেই বুঝলাম, চায়ের ভাঁড়টি বড্ড গরম - তাই ধরতে অসুবিধা হচ্ছে ওনার। আমিও পারিনা ধরতে। তাই একটু হেসে, বিস্কুট- কেকের বয়ামের পাশের একটুকরো জায়গা দেখিয়ে বলেছিলাম "খুব গরম না? এখানে রাখতে পারেন।"
উনিও একগাল হেসে বললেন "থ্যাংকইউ, দিদিভাই!"
আমার অনেক সমস্যার মধ্যে একটা হলো, আমি এইধরণের সম্বোধন, মানে কেউ আমাকে 'মা' বা 'দিদিভাই' বলে ডাকলে বুকের মাঝে পাগলাঝোরা বয়ে যায় আমার। হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করে মুহূর্তটাকে। আর ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে করে "আবার বলবে? আর একবার?"
আর হয়ত সেজন্যই ওনার সঙ্গে আলাপ জমালাম। আর কী ভাগ্যিস, আলাপটা জমালাম!
বাহাত্তর বছর বয়স ওঁর, বাড়ি নাগেরবাজারের কাছেই সাতগাছি এলাকাতে। 'বয়সের ধর্ম' অনুযায়ী বেশ কিছু রোগ আছে। আর আছে, একাকীত্বের অনুভব! তাই সবমিলিয়ে বয়সের তুলনাতেও বেশি নেতিয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু, ওই 'ছিলেন' এখন অতীত!
"উনি চলে যাবার পর থেকেই দিনগত পাপক্ষয় করছি মনে হতো গো দিদিভাই! ছেলে বাইরে থাকে, তারা যেতে বলে কিন্তু আমারই আর ইচ্ছে করে না! এমনি কাজের লোকজন আছে, কিন্তু বুকটা খাঁ খাঁ করত! অথচ আমার বয়সে কতমানুষ স্ট্রং থাকে কত!
কিন্তু এইবছরের শুরু থেকে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছি গো মা! এতবছর তো ঘরের কোণেই রয়ে গেলাম, কিছুই করলাম না, দেখলাম না! তাই যা যা করিনি আগে, অথচ এখনও করতে পারব, সেসব করা শুরু করেছি। যেমন, এবার পাড়ার ছোট ছেলেদের সরস্বতী পুজোয় ফল কেটেছি। আগে কোনোদিন করিনি। এখন বিকেলে একটু হাঁটতে বেরোই। আগে কোনোদিন একা একা রাস্তার চায়ের দোকান থেকে চা কিনে খাইনি, ওনার সঙ্গে কখনও বেরোলে খেয়েছি। তবে একা একা - না! কিন্তু এই ক'দিন হলো খাচ্ছি। এবার একদিন ফুচকা খাব! রাস্তার খাবার বলে খাইনি কতবছর হয়ে গেল! একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না!"
কেমন জ্বলজ্বলে মুখে বলে গেলেন উনি।
অদ্ভুত একটা আনন্দ - একটা তেজ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল যেন ওনার অবয়ব থেকে!
কত সাধারণ মানুষ, সাধারণ ইচ্ছে - চা খাওয়া, ফুচকা খাওয়া - কিন্তু এই ছোট্ট ছোট্ট কিছুর মাঝে যে আনন্দধারা আছে, বুঝতে পারছিলাম।
আমি নিজে আনন্দের পথযাত্রী। একটু একমুখীও। একা একা ঘুরতে, সিনেমা দেখতে, রেস্তোরাঁয় খেতে ভালবাসি। ইনবক্সে উপচে পড়া "আপনি কি সিঙ্গল" এর উত্তরে অনায়াসে বলতে পারি "আই অ্যাম আ লোনার, আমার নিজের সাহচর্য বেশি পছন্দ"। কিন্তু আমি বহুবছর ধরেই এরকম। আর ইনি! কথাবার্তা শুনেই মনে হচ্ছিল, বহুবছর ওঁর স্বামী-সংসারের মাঝেই নিজস্ব অস্তিত্বটুকু গচ্ছিত ছিল। আর তারপরে গ্রাস করেছিল প্রবল একাকীত্ব। কিন্তু এখন, নিজের চেষ্টায়, নিজের জন্য বাঁচছেন উনি। ছোট্ট ছোট্ট 'বাকেট লিস্ট আইটেম' এ 'টিক' দিয়ে বোঝাচ্ছেন - বেঁচে আছেন শুধু না, প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে ওঠেন - হয়ত, জীবনে প্রথমবার! আর তাই, ওঁর কথায় এত তেজ! সেই কথাগুলি বলার সময় এত দীপ্তি!
এমনিভাবে, জীবনের প্রান্তিক-পর্বে পৌঁছে বেঁচে ওঠা - এ যদি রূপকথা না হয়, তবে 'রূপকথা' আসলে কি…!