17-02-2023, 09:09 PM
পর্ব- এগারো
মা ও মা মাআআআআ একটু আসো না এদিকে..
অনেকক্ষণ ধরে ছেলের তারস্বরে ডাকখানা মা শুনতে পেলেও হাতের কাজ ফেলে ছেলের কাছে ছুটে যেতে পারছে। মনটা ছেলের কাছে পড়ে থাকলেও হাত দুটো তার চলমান কাজটা যতটা তড়িৎগতিতে সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করছে। মায়ের মন সন্তানের ডাক উপেক্ষা করার শক্তি ভগবান যে কেন দেয় নি সেটা ভগবান স্বয়ং নিজেও হয়তো বলতে পারবেন না। তার লীলাময় আখ্যানে তিনি নিজেও তো তার মা কে কম জ্বালাতন করেন নি।
কোন মতে হাতের কাজটা আধ সমাপ্ত করেই প্রাণপ্রিয় সন্তানের দিক ছুট দিলো আনচান মনের অস্থিরতায় কাতরাতে থাকা মা। ছেলে তার গাল ফুলিয়ে বসে আছে, অভিমানের ভারে ভারী হয়ে এসেছে তার মুখটা। চোখগুলো ছলছল করছে এই বুঝি অঝোর ধারায় নেমে আসা প্লাবনে আজ সব ভাসাবে। মায়ের স্পর্শের ছেলের অভিমান ধুপে টিকবে না সেটা কি মায়ের অজানা নাকি? তাইতো মা ছোটে গিয়ে ছেলের পাশে বসে পড়লো আর মাথার ঘন চুলে আঙুল ডুবিয়ে আদরে আদরে কপাল গাল ভরিয়ে তুললো।
কি হলোরে বাবু কখন থেকে এমন করে ডাকছিস কেন রে??
এমনি এমনি তো ডাকছি না সেটা তো বলে দিতে হবে না।
কিরে বাবু আজকাল যেন তোর অভিমান গুলো বড্ড বোকাসোকা হয়ে যাচ্ছে হ্যাঁ! মা তো হাতের কাজ সেরে আসবে তো নাকি??
সে আমি জানি না। আমার যে মনে হয় আজকাল তুমি আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না। আগের মত তোমার কাছে টেনে নিয়ে আদর করো না (অভিমানে গলার স্বর ভারী হয়ে আসে, একরাশ অভিযোগ যেন গলার কাছে চেপে বসে আছে) জানো মা আমার না খুব ইচ্ছে করে সেই আগের মত তুমি আমার চুলের মাঝে আঙুল ডুবিয়ে বিলি কেটে দাও। মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দাও, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুম পারিয়ে দাও। জানো মা আজকাল না কেন জানি ঘুম আসে না, মাথা টা খুব ব্যাথা করে কিন্তু যখনি তুমি আমার কপালে চুমু খাও সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যাথা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। ও মা বলো না তুমি আবার আগের মত আদর করবে আমাকে!
ছেলের অভিযোগে মায়ের কন্ঠে কোন উত্তর এগিয়ে না আসলেও ফুঁপিয়ে উঠা কান্নার দলা পাকিয়ে যায়৷ ছলছল করা চোখ জোড়ার বাঁধ ছাপিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে। কেঁপে উঠা গলা ধরে আসে,
বাবু তোর এই মনে হয়! আমি তোকে ভালোবাসি না আদর করি না?
গাল বেয়ে নেমে আসা অঝোর ধারার কয়েক ফোঁটা ছেলের কপালে পড়তেই ছেলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাকে কাঁদতে দেখে সে নিজেও কেঁদে ফেলে। জড়িয়ে ধরে মাকে মায়ের কপালে গালে চুমু খায়,
ও মা আমার ভালো মা তুমি কেঁদো না আমার সোনা মা তুমি কাঁদলে যে আমার কষ্ট হয়৷ তুমি না আমার ভালো মা প্লিজ আর কেঁদো না। তুমি পৃথিবীর বেস্ট মা, তোমার মত আদর তো কেউ করে না৷ আর কেঁদো না প্লিইইইইইজ...
মায়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বাধ্য ছেলের মত বুকের মাঝে মুখ লুকায়। মা নিজের অংশ কে মিশিয়ে দেয় নিজের বুকের সাথে,
পাগল ছেলে একটা... দিন দিন যেন আরও ছোট হচ্ছে সে।
বিকেলের দিকে বাগানের কাছটায় ক্যানভাসের নিষ্প্রাণ সাদা কাগজে রঙিন তুলির আঁচড়ে জীবন দান করে চলেছে কৌশিক। শুকনো পাতা পায়ের নিচে মাড়িয়ে কেউ একজন পেছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে সেটা চোখে না দেখলেও সর্তক থাকা পঞ্চইন্দ্রীয় এমনিতেই জানান দেয়। তবুও উৎসুক মন মানুষটা কে সেটা জানবার আগ্রহ প্রকাশ করলেও ক্যানভাস থেকে চোখ সরানো টা যে বড্ড কঠিন চিত্রকরের জন্য। পেছন থেকে এগিয়ে আসা মানুষটা ক্রমেই আরও কাছে এসে গিয়েছে, বলতে গেলে হাত ছোঁয়া দূরত্বে। গায়ে মাখা সুগন্ধির সুঘ্রাণ টা কৌশিকের নাসারন্ধ্রে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। মিষ্টি একটা সুবাতাসে আঙিনা টা ভরে উঠেছে, এবার আর কৌশিক চোখের ব্যাকুলতা কে আটকাতে পারে না। পাশ ফিরতেই সেই জন বলে উঠে,
আদাব স্যার....
আলেয়ার মিষ্টি হাসিতে কৌশিকের ঠোঁটের কোনে এমনিতেই হাসি ঠেউ খেলে যায়। হাত বাড়িয়ে আলেয়ার মাথা ছুয়ে যায় কৌশিক
খুব মিষ্টি লাগছে তোমাকে। এখানে আমার মত বেরসিকের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভিতরে যাবে? মা আছে ভিতরে।
বেরসিক মানুষরা বুঝি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে জানে! আপনি মোটেও বেরসিক মানুষ না। যাই আন্টির সাথে দেখা করে আসি।
যাও যাও ( কফির কাপটা আলেয়ার হাত দিয়ে) একটু কষ্ট করে এক কাপ কফি নিয়ে এসো তো। প্রথম দিনেই অর্ডার দিয়ে ফেললাম কিছু মনে করলে না তো?
না না স্যার কি যে বলেন।
আলেয়া কফির কাপটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে যায়। কাউকে চেনে না তাই হয়তো একটু ভীতি কাজ করছে মনে। এমনিতে এইদিকে আগে তেমন একটা আসা হয় নি ওর, কলেজ টিউশন আর বাড়ি এটাই যে ওর দুনিয়া। স্যারের সাথে ওমন ফ্রেন্ডলি কথা বার্তার পর মনে কিছুটা হলেও সাহস আসে।
মাত্রই কাজ শেষ করে পচুইকে কোলে নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে লক্ষ্মী। আজ তাড়াতাড়িই কাজ গুছিয়ে নিয়েছিল বলে বিকেলেই ছুটি পেয়ে গেল। মালিকের বাড়ি থেকে দেয়া চানাচুর এক মুঠোতে রেখে সেখান থেকে একটু একটু করে মুখে পুড়ছে পচুই। এক দুবার মায়ের মুখে দেবার চেষ্টা করেছে কিন্তু লক্ষ্মী মুখ খুলে নি আবার বকাও দেয় নি। খানিক আগে থেকেই লক্ষ্মীর মনটা ভীষন খারাপ হয়ে আছে আর হবেই না কেন! এবারও পচুইয়ের বাবার বাড়ি আসতে দেরি হবে। এমনিতেই মন টা কয়েকদিন ধরে বেশ অস্থির হয়ে আছে, এমন অবস্থায় মনে হয় আগে কোনদিন পড়ে নি। বারবার মন চাইছিলো পচুইয়ের বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুক তাতে যদি মনের অস্থিরতাটা কোন ভাবে কাবু করতে পারে। মাঝে মাঝে কি যে হয় সেটাই বুঝতে পারে না, নিজেকেই নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। মনের ব্যাকুলতাকেও যে পাশ কাটাতে পারছে না যে আজকাল। এমন দুটানার মাঝে মানুষ সবসময় তার কাছের মানুষ প্রিয়জন কে নিজের পাশে চায়। পরিস্থিতি সামল দিতে হিমশিম খেলে সে জন যে ভরসার জিয়ন কাঠি হয়। কিন্তু কিসের কি সে জন যে সংসারটাকে আরেকটু দাঁড় করাতে কাজের ভারে নিজের পিঠ টা আরেকটু ন্যুব্জ করে দিয়েছে৷ তবে আর্থিক দিকটা ভাবতে গিয়ে ভালোবাসার দিকে কোন খামতি পড়ে যাচ্ছে কি না সেটাও তো নজরে রাখতে হয়। মানুষ মন আর শরীরে জটিল সংযোগের যুগলবন্দি তে তৈরি, মন যেটা যায় আর শরীর সেটায় যদি সায় না দেয় তবে ভারসাম্যের তারতম্যে কোপকাত হতেই হয়। সেটাই যে প্রকৃতির নিয়ম তবে কে কতক্ষণ পর্যন্ত সেই পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারে সেটাই দেখার বিষয়।
মানুষ একা বাঁচতে পারে না, জীবনের প্রতিটা মোড়ে একজন সঙ্গীর দরকার হয় কাউকে অবলম্বন হিসেবে ধরে রাখতে চায়। আমাদের মন ভীষন রকমের হেয়ালী কাজে নিজেকে এমন করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে যে চাইলেও সেই জাল ছেড়ে সবাই বেড়িয়ে আসতে পারে না। মাকড়সার জালের মত আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ে জাগতিক মোহের বেড়াজালে। মনের খেয়ালে যেমন বাস্তবতা এড়ানো যায় না তেমনি করে অতিরিক্ত বাস্তববাদী হয়ে উঠাও মানুষের নিজের কিংবা তার পাশের মানুষের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। পচুইয়ের বাবা হয়তো বাস্তবতার নিরিখে নিজের জায়গায় ঠিক, আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে বুঝি ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হয় অনেক সময় প্রিয়জনের সান্নিধ্যে তার স্পর্শে ছোট্ট একটা বাক্যে অনেক জটিল মনব্যাধি নিরাময় হয়ে যায় যেটা জাগতিক পন্থায় আর্থিক পথ্যে উপশম করা সম্ভব নয়।
লক্ষ্মী ভীষন করে চাইছিলো তার এতদিনের সুখ দুঃখের সাথীটা পাশে থাকুক, নিজের বাহুডোরে ওকে জড়িয়ে ধরুক। আজকাল যে বড্ড ভয় হয় ওর এই বুঝি পা ভড়কালো। লক্ষ্মীর একাকিত্বে নিখিল শীতলতার পরশ বুলায় সেটা হয়তো আবেগি মনে দোলা দেয় ঠিকই কিন্তু তার সাথে খানিক যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় নিজগুনে। একরাশ অভিমান জড় হয় নিজের উপর না না নিজের উপর নয় সেই মানুষটির উপর যার এখন তার পাশে থাকার কথা তবে কেন সে নেই। নিখিলের সান্নিধ্যে নিজেকে শান্ত মনে হয় সেই সাথে ভয় হয় স্রোতে ভেসে যাবার ভয়। মনটা খুব করে যখন কাউকে পাশে পেতে চায় তখনি বসন্তের বাতাসের মত করে নিখিল আসে, নতুন প্রাণের সঞ্চারে অনাবিল আনন্দের উদ্ভাসে ভাসিয়ে নেয় লক্ষ্মী কে। যেন নতুন করে যৌবনের আগমন ঘটায় ওর জীবনে। আবার ভয় টাও যে সেখানেই যেখানেই যৌবন সেখানেই তো ঝড়ের পূর্বাভাস, নিজেকে যৌবনের উন্মত্ততায় ভাসিয়ে যদি কালবৈশাখী ঝড়ের মুখে পড়ে তবে কি নিজেকে সামলে নিতে পারবে? মনের দোলাচলে দুলতে দুলতেই বাড়িতে পৌঁছায় লক্ষ্মী। খুব অভিমান জন্মেছে মনে নিজের স্বামীর প্রতি কেন যে বুঝে না, ওর এখন ওকে ভীষন করেই কাছে পেতে মন চাইছে। পরক্ষণেই মনকে বুঝানোর চেষ্টা করে ওদের জন্যই তো পড়ে আছে ঐ দূরদেশে, হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কটা টাকা বেশি রোজগার করছে। ঐতো আজ বললো এবার ওকে একটা টাচ মোবাইল কিনে দিবে ওটাতে নাকি একজন আরেকজনকে দেখে দেখে কথা বলতে পারবে দূরে বসেও। নাহ! মন কে বুঝাতে হবে নিজেকে শক্ত করতে হবে।
বসার ঘরেই ছিল মমতা দেবী, মোবাইলে কারও সাথে কথা বলছিলো। আলেয়া ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসছিলো ওনার দিকেই। বসার ঘরটা অনেক বড় আবার সাজিয়েছেও অনেক সুন্দর করে। না চাইতেই চোখ জোড়া ছুটে যায় দেয়ালের বড় বড় বাঁধানো ফ্রেম গুলোতে। দেখেই বুঝতে পারে ছবিগলো কৌশিকের হাতেই ফুটে উঠেছে আর্ট পেপারে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই চোখাচোখি হয় আলেয়া আর মমতা দেবীর। অচেনা হলেও মিষ্টি হাসিতেই মমতা দেবী স্বাগত জানায় আলেয়া কে, কৌশিক বলেছিল একজন আসতে পারে এ বুঝি সেইজন। আলেয়া কিঞ্চিৎ ইতস্তত বোধ করে,
আদাব আন্টি, ভালো আছেন?
হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকে,
এইতো মা ভালো আছি, তুমি? তোমাকে তো মা ঠিক চিনলাম না।
মমতার দেবীর পাশে দাঁড়িয়ে,
ভালো আছি। আমি আলেয়া, আমাদের কলেজে স্যার পড়ায়।
ওহহ তোমার কথাই তাহলে বলছিলো, বসো মা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?( আলেয়ার হাতে কফির মগটা দেখতে পায়) ওটা তোমার হাতে কেন?
না মানে স্যার বললো নিয়ে আসতে, আরেক কাপ কফি নিয়ে যেতে।
আলেয়ার হাত থেকে কফির কাপটা নিজের হাতে নিয়ে,
দেখো ছেলেটার কান্ড, তোমাকে দেখতে না দেখতেই একটা কাজের অর্ডার দিয়ে দিলো। এটাতো আমাকে বললেই পারতো। তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না মা ও একটু এরকমি।
না না আন্টি কি বলছেন, আমি কিছু মনে করে নি তো। স্যার খুব ভালো মানুষ। আপনিও...
তাই নাকি! এক দেখাতেই বুঝে গেলে, আচ্ছা তুমি বসো আমি ওর কফি টা নিয়ে আসি (চলে যেতে গিয়েও পিছন ফিরে বললো) তুমি কি খাবে চা না কফি?
কিছুই লাগবে না, আমি এখন কিছু খাবো না। স্যার আসতে বলেছিল তাই...
সেটা কি করে হয় প্রথম এলে আমাদের বাড়িতে কিছু খাবে না সেটা আবার হয় নাকি। তুমি বসো আমি কিছু নিয়ে আসি তারপর দুজনে মিলে গল্প করবো।
যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আন্টি আমিও আপনার সাথে আসি একা বসে বসে কি করবো...
ধুরু পাগলি কি মনে করবো আবার, তুমি সাথে থাকলে গল্প করতে করতে কফি করাটাও হয়ে যাবে। আসো আমার সাথে ( আলেয়ার হাত ধরে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় মমতা দেবী)
রুমা তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকলো কোন মতে, অনির্বাণের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে একটু দেরিই হয়ে গেল। এই বয়সী প্রেমিক প্রেমিকার লুতুপুতু প্রেমে যেমন ধরণের কথা বার্তা হয় সে রকমই আলাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল দুই উঠতি বয়সি কপোত-কপোতী। আজকাল ভালোবাসার হৃদয় বাক্যের চেয়ে শরীরবৃত্তীয় আলাপ হয় বেশি। দুষ্টু মিষ্টি আলাপে তেতে উঠে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বাড়তে থাকে। ঢেউ উঠে উজান গাঙের তীরে, সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে মনের বারান্দায়। চঞ্চল হয়ে উঠে কামভাবে জর্জরিত দেহখানা। বয়সের দোষে মনের সুখে ভাসতে ইচ্ছে করলেও বাস্তবতায় অনেক পাল্টাপাল্টি তত্ত্ব থাকে। সেই সবের ফাঁক গলিয়ে বাস্তবতার ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে উত্তাল হয়ে উঠা শরীরের রক্তেরচাপ সামলে উঠা বেশ কঠিন।
ক্লাসে ঢুকেই জানতে পারলো আজ একটা সারপ্রাইজ টেস্ট আছে৷ এমনিতে হলে রুমার কাছে এটা তেমন কোন বিষয় ছিল না, আগে তো মনের আনন্দে টেস্ট গুলো দিতো আর ভালো নাম্বারের সাথে সাথে শিক্ষকদের বাহবা পেত। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে ধরা দিয়েছে রুমার কাছে, টেস্টের প্রশ্নপত্র পেয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। কেমন অচেনা লাগছে টেস্টের বিষয় গুলো। এমন নয় যে এগুলো সম্পর্কে ওর জানা নেই, কিন্তু ঠিকমত পড়া হয় নি সেটাও একটা বিষয়। আজকাল প্রেমিকের দুষ্টু মিষ্টি গল্পে মজে গিয়ে পড়াশোনা যে কিছুটা লাটে উঠেছে সেটাও ভাববার বিষয়। সদ্যস্নাত ভালোবাসার মিষ্ট সংলাপের উষ্ণ ছোঁয়াতে নিজেকে একটু একটু করে মিলিয়ে দিতে কার না ভালো লাগে? তেমন ভালোলাগার হাওয়াতে রুমাও আজকাল নিজেকে ভাসিয়ে রাখার ছলচাতুরীতে বাদবাকি দিকে যে মনঃসংযোগ হারিয়েছে ক্ষণে ক্ষণে সেটা স্পষ্টত দৃশ্যমান। আজ সারপ্রাইজ টেস্ট দিতে গিয়ে যেভাবে সাইপ্রাইজড হয়ে বসে আছে তাতে কলমের খাপ কামড়ানো ছাড়া আর কি বা করার থাকে। দোষটাও নিজের ঘাড়েই দিতে হচ্ছে আজ, এমন করে বেখেয়ালি হওয়াটা ঠিক হয় নি ওর। সাময়িক ভালোলাগায় ভেসে যেতে গিয়ে যে নিজের অবস্থান থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যাচ্ছে সে সেটা তো কোন ভাবেই কাম্য নয়। দু পাটি দাঁতের মাঝে কোমল ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে শাসিয়ে নেয় রুমা। যে করেই হোক সংযতচিত্ত করতে হবে নিজেকে, আজকের মত পরিস্থিতি যেন আর কখনো না আসে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
মাত্রই ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে এলো কৌশিক, ধীর গতিতেই বারান্দা ধরে হাঁটছে। মনে হয় কারো জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ বুঝি আসবে এখানে ওর সাথে দেখা করতে। ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটার মাঝেই বিপরীত দিক থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সম্ভাষণের উত্তর দিতে দিতে আপন মনে ভাবতে থাকে, আজ ক্লাসে যতবার মাধুরীর দিকে তাকিয়ে ততোবারই চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছিলো মেয়েটা। আবার আড় চোখে কৌশিক কে দেখার চেষ্টাও করে গিয়েছে সমানতালে। মাঝে মাঝে কৌশিক ভাবে ওর সাথে সামনাসামনি কথা বলবে তবে কলেজর সবার সামনে কি নিয়ে কথা বলবে সেটাই ভেবে পায় না। এর মাঝে কেমন করে রিয়্যাক্ট করবে সেটাও তো জানা নেই যদি বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করে তবে কলেজে বাকিদের সামনে আর মান সম্মান কিছুই থাকবে না। ঐদিন সামনের বাড়িটায় মাকে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারে ওটা মাধুরীদের বাড়ি। ভবিতব্য নাকি কাকতালীয় ব্যাপার সেটাই বুঝে পায় না কৌশিক। বসার ঘরে একটা ফ্যামিলি ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল মাধুরীর মুখটা মনে গেথে গিয়েছিল বাড়ি ফিরেই চট করে আর্টের খাতাটা খুলে বসেছিল আর চোখে দেখা মুখটা কাগজে ফুটিয়ে তুলেছিল। বারবার ভাবে কোন একবার মাধুরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে কিন্তু আবার ভাবে প্রথমদিন যেভাবে চোট পাট করেছিল তাতে বেশ বুঝা যায় মেয়েটা বেশ চঞ্চলমতির।
স্যার আমি এসে গিয়েছি...
হঠাৎ করেই কাঙ্ক্ষিত মেয়েলী গলার স্বরটা শোনে পেছন ফিরে তাকায়,
এসো গেছো তুমি, তা তুমি তো দেখি একদিনেই মাকে পটিয়ে ফেলেছো। বারবার শুধু তোমার কথাই বলতে থাকে।(ছোট্ট করে হাসি দেয় কৌশিক)
কি যে বলেন স্যার, আন্টি খুব ভালো মানুষ আর খুব মিশুকে তাই হয়তো। (আলেয়া নিজেও হাসতে থাকে)
হুম দেখতে হবে না মা টা কার। এবার চলো দেখি...
নিজেদের মাঝে টুকটাক কথার মাঝেই বারবার হেসে উঠছে দুজনেই আর হাঁটতে হাঁটতে স্টাফ রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আলেয়া যেহেতু নিচের ক্লাসের বাচ্চাদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে তাই ওর সাথে বসে একটা স্ট্রাকচার তৈরী করার জন্যই আজ ক্লাসের ফাঁকে দেখা করতে বলেছিল কৌশিক। চলার পথে আগের দিনের ঘটনা গুলো নিয়ে নিজেদের মাঝে হাস্যরসে সৃষ্টি হয়েছে দুজনের মাঝে।
সুমনের ক্লাস ছিলো না তাই তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো সে। হঠাৎ করেই ওর দৃষ্টি আটকে যায় বিপরীত ভবনের দিকে। প্রথম দিকে ভেবেছিল ভুল দেখেছে হয়তো তাই বন্ধুদের থেকে খানিকটা সরে এসে আরেকবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। না এবার আর কোন ভুল হয়নি সুমনের ঐতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলেয়া কারও সাথে খুব হাসাহাসি করছে আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলছে। পাশের লোকটা কে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে লোকটা বেশ লম্বা চওড়া আর দেখতেও হ্যান্ডসাম, পাশের লোকটাও হাসতে হাসতে আলেয়ার কথার সাথে সঙ্গ দিচ্ছে। সুমনের চোয়াল জোড়া কঠিন হয়ে আসে, দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। হাতের মুঠো গুলো শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরে বারান্দার রেলিং। নিঃশ্বাসের গতিবেগ বলে দেয় সে মোটেও খুশি হতে পারে না আলেয়া কে ঐ অপরিচিত লোকটা পাশে ওমন হাস্যোজ্জ্বল ভাবে হাঁটতে দেখে। ইচ্ছে করছিলো এখনি ছুটে গিয়ে আলেয়ার পাশের লোকটার মুখে সজোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিতে। তবে সেটা কতটুকু সম্ভব সেটা নিয়েও সে বেশ সন্দিহান কারণ বিপরীতের মানুষটা ওর চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা হবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে। তবুও হয়তো সেই চেষ্টাটাও করতো কিন্তু কলেজে এতো মানুষের মাঝে এমন কাজটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না সেটা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারে সুমন৷ অন্য কোন সঠিক সময়ে বিষয়টা নিয়ে আলেয়ার সাথে যে উতপ্ত বাক্য বিনিময়ে সম্ভাবনা আছে সেটা বলার অবকাশ রাখে না। আপাতত নিজেকে কোন ভাবে সামলে নেয় সুমন আর ততোক্ষণে আলেয়া আর ঐ ব্যাক্তিটাও ওর দৃষ্টি সীমা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে।
কেন? কি কারণে? কি জন্যে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর হয়তো কখনো জানা যাবে না তবে মাধুরী এটা জানে ঐ মানুষটার চোখের দিকে তাকালে ওর ভীষণ রকমের ভালো লাগা কাজ করে মনে। ইচ্ছে করে সবসময় যেন ঐ চোখের তারায় নিজেকে খুঁজে পেত তবে ও হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তবে কেন ওর চোখে ঐ মানুষটার চোখ পড়তেই চোরের মত ধরা পড়ে যাবার ভয়ে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। নিজেকে কেন জানি তখন আর সামলে রাখতে পারে না অদ্ভুত এক অনুভূতির ছোঁয়া দিয়ে যায় সারা শরীর আর মন জুড়ে, এক রাশ লজ্জা ঘিরে ধরে ওকে। বড্ড কষ্ট হয় দৃষ্টি সরিয়ে নিতে তবুও কেন যে চোখ জোড়া নিজেদের লুকিয়ে নেয় সেই শান্ত শীতল মায়াধরা চাহনি থেকে কে জানে। আজ বড্ড ইচ্ছে করছিলো একটু কথা বলতে কোন একটা ছুতো ধরে। শেষমেশ ভেবেছিল ওর এঁকে দেয়া ছবিটার জন্য একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারে মানুষটা, সেই অজুহাতে যদি দুটো লাইন বেশি বাক্য বিনিময় করতে পারে নিজেদের মাঝে তবে বুঝি অশান্ত হৃদয় টা খানিক প্রশান্তির পরশ পায়। যদিও এখনো শিউর না ঐ মানুষটাই কি এই জন কি কে জানে, তবে কথা বলার একটা অবকাশ তো পাবে। সেটাই নেহাত কম কিছু নয় এই পরিস্থিতিতে।
ক্লাস শেষ হতেই ছুটে গিয়েছিল মানুষটার পেছন পেছন তবে কেন জানি কাছাকাছি যেতে পারছিলো না। ভয় করছিলো নাকি অন্যকিছুর বাঁধা সেটা জানা নেই। শুধু ঐ মানুষটাকে কাছে পেয়েও কেমন জানি দূরে দূরে মনে হচ্ছিলো। যতক্ষণে খানিক সাহস সঞ্চারে এগিয়ে যাবে মনস্থির করলো তখনি কেউ একজন উড়ে এসে জুড়ে বসলো ওদের মাঝখানে। মূহুর্তেই ওদের মাঝের দূরত্ব টা যেন কয়েক ক্রোশ বেড়ে গেল, চাইলেও যেন আর হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া হবে না। পাশে চলতে থাকা মেয়েটাকে চেনা লাগছে তবে এখন কেন জানি ঐ মানুষটার পাশে সহ্য করতে পারছে না। ওদের হাসি গুলো শেল হয়ে বিঁধতে থাকে মাধুরীর বুকে, হঠাৎ মনে হলো ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠছে কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়ে। যা কখনো তার ছিলই না সেটা হারানোর চিন্তায় এতো কষ্ট আগে কখনো তো পায় নি। মাধুরী থমকে দাঁড়ায় পাথরের মতো, আর ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে মানুষটার প্রস্থানের দিকে। কতো কথা বলবে বলে ভেবে এসেছিল, কিছুই তো বলা হলো না। তার আগেই সব দলা পাকিয়ে গেল হৃদয় প্রকোষ্ঠে। খুব রাগ হচ্ছে মানুষটার প্রতি, একবার ফিরে তাকতে পারলো না? ও তো এখানেই ছিল খুব কাছে তবে কেন একবার ওমন মায়া ধরা চাহনিতে ফিরে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো না। খুব অভিমান হয় মানুষটার প্রতি কাছে পেলে হয়তো হাত পা ছোড়ে নিজের অভিমান প্রকাশ করতো, রাগ মেটানোর পথ খুঁজতো। ধ্যাত একটুও ভালো লাগছে না, ঐ মানুষটা খুজ বাজে পঁচা একদম অসহ্য....