16-02-2023, 05:30 PM
(This post was last modified: 17-02-2023, 11:06 AM by মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
☝️☝️☝️
প্রথমাংশ উপরে
পর্ব্বঃ ৪ । দ্বিতীয়াংশ
শেষ হালনাগাদে ইহা লিখিয়াছিলাম যে বিসিএস সম্পর্কিত বিষয়ে অবহিত হইতে আমি চন্দ্রাকে বিদায় দিয়া নিখিলদার বাটি অভিমুখে গিয়াছিলাম। নিখিলদা আমাদের এলাকায় পড়াশুনায় সেরা ছাত্র বলিয়া গণ্য হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট! কীসব পিএইচডি করিতেছিল শুনিয়াছিলাম। এখন সরকারী চাকুরীর চেষ্টা করিতেছে। আমার হইতে বৎসরখানেকের বড় হইবে বয়সে। তবে নিখিলদার আর আমার বিশ্ব সম্পূর্ণ পৃথক তাই মুখচেনা থাকিলেও বা দেখা হইলে পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করিলেও সেইভাবে কোনদিন বসিয়া মনের গপ্পো করা হয় নাই, আরেকটি কারণ ছিল, আমার পিতার সহিত নিখিলদার বিশেষ হৃদ্যতা রহিয়াছে, আমার পিতা নিখিলদাকে ভীষণ স্নেহ করে এমনকি বহুবার আমাকে নিখিলদার সহিত তুলনা করিয়া বাছাবাছা শব্দবাণ শুনাইয়াছে। ফলে নিখিলদার সহিত তেমন সুসম্পর্ক আমার কোনকালেই হয় নাই! এহেন নিখিলদা কিন্তু আমাকে তাহার বাসায় দেখিবা মাত্র সাদরেই অভ্যর্থনা করিয়াছিল। টুকটাক কথাবার্ত্তার পরে আমি ভয়ে ভয়ে নিখিলদার নিকট বিসিএস হইবার রাস্তা শুধাইয়াছিলাম। প্রথমে অবশ্য ইহা বলি নাই যে আমি নিজেই বিসিএস হইতে চাহি, বলিয়াছিলাম যে আমার এক বন্ধু বিসিএস হইতে চাহে কিন্তু সে জানে নাই কীরূপে কী করিতে হয়, যেহেতু তুমি সরকারী চাকুরীর চেষ্টা করিতেছ তাই যদি পথখানি সম্পর্কে আলোকপাত কর তো বড় ভাল হয়। নিখিলদা পাত্তা না দিয়া কহিয়াছিল, এই পথ সম্পর্কে যদি কিছু বলি তবে তোর যা বিদ্যা তাহাতে বুঝিতে পারিবি না তাহার চাইতে তোর বন্ধুকে আমার নিকট আসিতে বল আমি তাহাকে বুঝাইয়া দিব। বহুবার অনুনয় বিনয় করিবার পরও নিখিলদার ওই এক গোঁ! "আমি বলিলেও তুই বুঝিতে পারিবি না!" শেষে যখন কোন অস্ত্রেই নিখিলদাকে পরাস্ত করিতে পারিলাম না তখন সকল আত্মসম্মান বিসর্জ্জন দিয়া কহিলাম, "আমি কোন বন্ধুর নিমিত্ত নহে, নিজের জন্যই জিজ্ঞাসা করিতেছি নিখিলদা, যে হর বিসিএস হইতে চাহে সে এই হরি মাঝেই লুকাইয়া আছে। আমিই সেই হরিহর বিজয়! এইবার নিশ্চয় বলিতে পারিবে?" নিখিলদা বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার পর ঠোঁটের গোড়ায় একটি গোল্ডফ্লেক ধরিয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিতে করিতে বলিল, "সহসা এমন মতিভ্রমের কারণ! দিবালোকে জনসমক্ষে মদ্যপান, মাতাল হইয়া গালিগালাজ, মেয়েবাজি ইত্যাদি সকল দুর্ধর্ষ কার্য্যকলাপ যে করিয়া থাকে তাহার এমন সহসা রামের সুমতি হওয়া চিন্তার বিষয়! সুতরাং যদি এই অধম মূর্খ ব্যক্তিকে তোমার বিসিএস জয় করিবার অভিপ্রায়ের পিছনের হেতুটি জ্ঞাত কর তো বাধিত হই!" শেষের কথাটি শ্লেষ ও ব্যঙ্গ সহযোগে কহিল নিখিলদা। অন্য সময় হইলে চটিয়া যাইতাম কিন্তু এক্ষণে রাগ করা মূর্খামি হইবে। অগত্যা ঢোঁক গিলিয়া আলমারী হইতে বাবার ডায়েরী খুঁজিয়া পাওয়া ইস্তক সকল ঘটনা বলিলাম। নিখিলদা চুপ করিয়া সব শুনিল। শুনিতে শুনিতে তাহার মুখমণ্ডলে পরিবর্ত্তন আসিতে লাগিল। চক্ষু দুইখানি সজল হইয়া গেল। আমার বক্তব্য শেষ হইলে পরে সহসা আসিয়া আমাকে বক্ষমাঝে জড়াইয়া বলিল, "আমি বিনয়কাকুকে বলিয়াছিলাম, আমের গাছে আমড়ার ফলন কদাপি হইবে না। তুমি দেখিয়া লও একদিন না একদিন বিজয় ঠিক শুধরাইবে শুধু সময় আর জগদীশে ভরসা রাখ। ভাই, সত্ত্য বলিতে যত দিবস অতিবাহিত হইতেছিল আমার নিজের এই কথাখানি আমার নিজের কাছেই হাস্যকর শুনাইতেছিল। আজ বুঝিলাম ঈশ্বর সত্য সত্যই আছেন আর তিনিই তোকে এই ডায়েরী পাঠ করাইয়াছেন!" আমি বিহ্বল হইয়া কী বলিব বুঝিতে পারিলাম না। একটু পরে নিখিলদা আমাকে ছাড়িয়া কেদারায় পুনরায় উপবেশন করিয়া বলিল, "তোর বাবা বিনয়কাকু আমাদের এলাকার প্রথম ব্যক্তি যিনি মাধ্যমিকে না শুধু ফার্স্ট ডিভিশন বরঞ্চ তাহার সহিত তিনটি বিষয়ে লেটার মার্কস্ পায়। অঙ্কের মাথা খুব ভাল ছিল কিন্তু তোর দাদুর ক্ষমতা ছিল না ছেলেকে সায়েন্স পড়াইবার তাই আর্টস লইয়া উচ্চমাধ্যমিকে ভর্ত্তী হয়, স্কলারশিপ যোগাড় করিয়া সাম্মানিকে প্রথম শ্রেণীতে নিজের স্নাতক সম্পূর্ণ করে। তাহার পর বিসিএসে বসে, প্রথমবারের চেষ্টাতেই প্রাথমিক চরণ পার করিয়া দেয় কিন্তু যখন মূল পরীক্ষা দিবে তাহার প্রাক্কালেই তোর দাদু হঠাৎ করিয়া পরলোকগত হন ফলে পুরা সংসারের জোয়ালখানা তোর বাবার স্কন্ধে আসিয়া পড়ে। দুই দুইটি বিবাহযোগ্যা কন্যা রাখিয়া গিয়াছিলেন তোর পিতামহ, বড় দাদা হিসাবে উহাদের সুপাত্রস্থ করিবার পাশাপাশি সংসারখানি চালাইবার জন্য অর্থ যোগাড় করা এইসব তোর পিতার বিসিএস হইবার ইচ্ছায় জল ঢালিয়া দিয়াছিল। শেষে কোনমতে মিউনিসিপ্যালিটিতে একখানি করণিকের চাকুরী জুটাইয়া নিজের সকল সাধের জলাঞ্জলি দিয়াছিল, তবুও দেখ নিজ কর্ম্ম যোগ্যতায় সচিব পদে উন্নতি ঘটাইয়া কর্ম্ম হইতে অবসর লইল। আমার পিতার মুখ হইতে শুনিয়াছিলাম যখন তুই জন্ম লইলি তোর পিতা প্রচণ্ড খুশী হইয়াছিল, তাহার স্বপ্ন ছিল তুই একদিন তাহার অপূর্ণ অধরা ইচ্ছা পূর্ণ করিবি আর একদিন বিসিএস জয় করিবি তাই তোর নাম রাখিয়াছিল বিজয়! কিন্তু যতদিন যাইতে লাগিল তত তোর বাবা সহ সকলেই বুঝিতে পারিতেছিল তুই সেই গরু নহে যে জমি চাষ করিবার ক্ষমতা রাখে! শেষে তোর বাবা ভাবিল যদি কোনক্রমে বাঁচিয়া থাকিস তাহা হইলেও হইবে। একটাই আক্ষেপ তাহার, বিসিএস না হউক এমন কোন গুণও নাই তোর যাহাতে এই সংসার জীবনখানা ঠেলিতে পারিস। সত্য কহিতে ভাই শুধু তোর পিতা নহে আমরা সকলেই তোর ভবিষ্যৎ লইয়া বড্ড চিন্তিত ভাই! কিন্তু আজ যখন সকলে তোর প্রতি সকল আশার মোহমুক্তি ঘটাইয়া দিয়াছে ঠিক সেই সময় জগদীশ তোকে তোর গন্তব্যে ঠেলিবার নিমিত্তেই বোধকরি তোর পিতার ডায়েরীখানি তোরে দিয়া পাঠ করাইল নইলে জন্মাবধি এত বৎসর যে বাড়িতে আছিস সেইখানে কোনদিন ডায়েরী খুঁজিয়া পাস নাই, সহসা আলমারী ঘাঁটিবার মতিই কেন হইল আর কেনই বা ডায়েরীখানি পাবি!"
একনাগাড়ে নিখিলদা এতগুলি কথা বলিয়া থামিল। আমি নিশ্চুপ হইয়া শুনিতেছিলাম। আমার পিতাকে কী পরিমাণ ঝড়ের সহিত সঙ্ঘাত করিতে হইয়াছিল, আমাকে লইয়া তাহার মনোমধ্যে কত কী বাসনা ছিল এবং আমি কেমন করিয়া এমনধারা ঢেঁড়স হইলাম ইত্যাদি আমার বুকের ভিতরে তোলপাড় করিতেছিল। সত্য আমি বাবা মা কাহাকেও কোনদিন তাহাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিই নাই, তাহাদের আশাপূরণ তো দূর অস্ত! নিখিলদা আর আমি দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসিয়া রইলাম। শেষে আমি বলিলাম, "আমি কী ছিলাম আমি জানি নাই, আমি আদৌ বদলাইয়াছি কি না তাহাও আমার ধারণায় নাই কিন্তু আমি এইটুকু জানি নিখিলদা আমি বিসিএসে বসিব এবং ঐ পরীক্ষায় আমার যতটুকু সামর্থ্য আমি তাহার সবটা দিয়া জয় করিবার চেষ্টা করিব। আদৌ এই পরীক্ষার দরিয়া সাঁতার দিয়া পার করিতে পারিব কি না জানি নাই কিন্তু সাঁতার অবশ্যই দিব। তুমি সাহায্য করিবে কি না বল?" নিখিলদা আমার দিকে একটা গোল্ডফ্লেক বাড়াইয়া দিয়া বলিল, "ভাই আমি আজ অবধি যাহা জানি যতটুকু বিদ্যা অর্জ্জন করিয়াছি তাহার সবটুকু দিয়াই সাহায্য করিব। আমার দরজা তোর জন্য সদাই খোলা থাকিবে কিন্তু যে গরু গু খায় সে যতই শিবমন্দির যাউক তাহার শুদ্ধতা লইয়া ধন্দ থাকিয়াই যায়। তাই আমি বলিতেছি না যে, আমার, তোর এই মুহূর্তে যে আবেগ রহিয়াছে তাহাতে কোন সন্দেহ আছে কিন্তু আমি বহু কিছু দেখিয়াছি, দুইদিন সকলেই প্রাণান্ত দেয় তাহার পর যেমন যেমন সময় যায় উহাদের চেষ্টা কমিতে থাকে এবং একসময় এই পথ হইতে সরিয়া যায়! বিসিএস একটি ম্যারাথন! প্রবল চেষ্টা ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায় সকলকে একসাথে বাঁধিলে তবেই এই পরীক্ষায় সফল হওয়া যায়। প্রতি বৎসর লাখ পাঁচেকেরও বেশি পরীক্ষার্থী এই পরীক্ষায় বসে তাহাদের মধ্যে বড়জোর দুইশত এই পরীক্ষায় কৃতকার্য্য হইতে পারে। রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনে যাইবার পথখানি খুব সরল নহে। তাই তোকে সর্বাগ্রে এইটুকু প্রমাণ করিতে হইবে তোর মধ্যে সেই ধৈর্য্য আর অধ্যাবসায়ের ক্ষমতা আছে।" আমি কহিলাম, "নিজেকে প্রমাণ করিবার জন্য আমাকে কী করিতে হইবে?" নিখিলদা আমার দিকে একমুহূর্ত চাহিয়া বলিল, "দুই মিনিট বসিয়া থাক আমি আসিতেছি।" কহিয়া বাসার অন্দরে গেল। কিছুক্ষণ পর হাতে একখানি মোটা কেতাব লইয়া ঢুকিল। আমার দিকে বইখানি বাড়াইয়া কহিল, "এই বইটি অগ্রবাল সাহেব লিখিয়াছেন নাম কোয়াণ্টিটেটিভ অ্যাপ্টিটিউড। নাম শুনিয়া ঘাবড়াইবার প্রয়োজন নাই ইহা গণিতের বই এবং বাঙ্গালাতেই অনুবাদিত। এই বইয়ে ঊনচল্লিশটি অধ্যায় আছে যাহার চৌত্রিশটিতে আমি দাগ দিয়া দিয়াছি, তোর কার্য্য হইল আগামী একমাস ধরিয়া প্রতিদিন এই চৌত্রিশটি অধ্যায়ের প্রতিটি অধ্যায় হইতে তিনটি করিয়া অঙ্ক কষা। যদি একমাস পর তুই প্রমাণ করিতে পারিস যে তুই প্রতিদিন এই কার্য্য করিয়াছিস তবে এবং তবেই বিসিএস পাস করিতে গেলে কী কী করিতে হইবে আমি তোকে জানাইব নইলে খামোখা নিজের আর তোর সময় নষ্ট করিবার কারণ দেখিতেছি না।" আমি কিছু না বলিয়া ঘাড় হেলাইয়া বইটি লহিয়া বাসায় আসি। আসিবার পথে গজেনের দোকান হইতে মাল তুলিবার সময় এক রিম সাদা খাতা আর গোটা দশেক কলম কিনিয়া বাসায় ফিরি।
ইহার পর এই গত একমাস ধরিয়া শুধু খাতার পর খাতা ধরিয়া অঙ্ক কষিয়া গিয়াছি। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হইতে পারে মাত্র তিনখানি অঙ্ক প্রত্যহ কষা কী এমন কঠিন ব্যাপার! কিন্তু নিখিলদা নিশ্চয় আমি বিসিএসে বসার নিমিত্ত তাহার ছাত্র হইবার আদৌ যোগ্য কীনা তাহা বিচার করিবার জন্য দৈনিক তিনটি অঙ্ক বরাদ্দ করিবার মত শিশুসুলভ কার্য্য দিবে না, আঁচাইয়া দেখিলাম নিখিলদা বলিয়াছিল, চৌত্রিশটি অধ্যায়ের প্রতিটি হইতে তিনটি অঙ্ক তাহার অর্থ দৈনিক ৩৪×৩= ১০২টি অঙ্ক বরাদ্দ হইয়াছে। আমি ষোল বৎসর বয়েসে মাধ্যমিক দিবার কালে শেষবার গণিতের মুখদর্শন করিয়াছি, আজ আমি আঠাশ! অর্থাৎ সুদীর্ঘ বারো বৎসর অঙ্ক নামক বিভীষিকার সহিত কোনরূপ সাক্ষাৎ হয় নাই! আর মাধ্যমিকেও অঙ্কে আমি আহামরি কিছু ছিলাম তাহা নহে সুতরাং এই শতখানেক দৈনিক অঙ্কের চাপ আমার পক্ষে কার্য্যতঃ প্রাণঘাতী হইয়াছিল বলিলেও কম বলা হয়। ইদানীং প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গ হইবার ধারা অব্যাহত আছে। দিনকয়েক বড্ড যাতনা হইতেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে দিন পনের যাইতে না যাইতে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। এক্ষণে আর অ্যালার্ম ঘড়িখানির সেইরূপ আবশ্যিকতা পড়ে না, উহা বাজিয়া উঠিবার আগেই ব্রাহ্মমুহূর্তে বিছানা ত্যাগ করি, হাত মুখ ধুইয়া প্রাতঃক্রিয়াদি সারিয়া সূর্য্যবন্দনা করিবার পর পরই চা আর বিস্কুট খাইয়া অঙ্ক কষিতে বসিয়া যাই। কিন্তু খান চল্লিশেক অঙ্ক কষিতেই ঘণ্টা পাঁচেক চলিয়া যায়। নয়টা নাগাদ উঠিয়া স্নান সারিয়া কিঞ্চিৎ জলখাবার খাইয়া বাড়ির কোন কাজ করিতে হইবে কিনা দেখি কাজ থাকিলে এগারোটা নইলে দশটা নাগাদ ফের বসিয়া যাই অঙ্ক কষিতে। উঠি একেবারে দেড়টায়। দুপুরের ভাত খাইয়া ফের বসি শরীরে ক্লান্তি বাসা বাঁধে তাও কোনমতে টানিয়া টুনিয়া বরাদ্দের তিরিশটি অঙ্ক শেষ করিয়া একটু বিছানায় গা এলাইয়া দিই। বৈকাল হইলে একটু ঘুরিতে যাই, মাঠে গিয়া একটু দৌড়ঝাঁপ হইয়া যায় তাহার পর সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ বাসায় ফিরিয়া হাত পা মুখ ধুইয়া চা খাই আর তারপর আবার অঙ্কের খাতা টানিয়া লই। কোনমতে অন্তিমের বত্রিশখানা অঙ্ক কষিতে কষিতেই রাত্তিরের খাবারের ডাক পড়ে। আর মুখে কিছু দিবার বাসনা থাকে না তবুও কোনমতে মুখে কিছু গুঁজিয়া দশটার মধ্যে পরিশ্রান্ত শরীরকে শয্যার স্পর্শ দিই। শুইতে না শুইতেই জাঁকাইয়া ঘুম আসে। স্বপ্নহীন সুনিদ্রা। পরদিবসে আবার ওই একই কার্য্যের সূচনা ঘটে। বহুবার ভাবিয়াছি কী দরকার খামোখা এত কষ্ট করিবার! কিন্তু, পরমুহূর্তেই নিজেকে বুঝাইয়াছি জীবনে অন্ততঃ এই একবার অলসতা করিব না তাই মন হাঁফাইতে চাহিলেও তাহাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া রাখিয়া দিয়াছি।
আমি যেমন যেমন এই রাস্তায় হাঁটিতেছি তেমন তেমন আমার আশেপাশের মানুষদিগের মধ্যে আচরণের পার্থক্য ঈষৎ চোখে পড়িতেছে। হঠাৎ করিয়া আমার মা ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করিয়া দিয়াছে, বরং মাঝেমাঝেই দেখি ঠাকুর ঘরে গিয়া বারম্বার কোন এক দৈবকে প্রণাম করিতেছে! আমাকে গঞ্জনা শুনানো দূর অতীত রীতিমতো বাবা বাছা বলিয়া আচরণ করিতেছে! সহসা বুড়ির এমন সুমতি কীসের কারণে হইল বুঝিতেছি না। আবার বুড়ি একা নহে যোগ্য সঙ্গত বুড়াও তাহাকে দিতেছে! সেদিন দেখি আমার বাবা, সরকার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার হইতে কলাকাদঁ কিনিয়া আনিয়াছে তাহার পর রাত্তিরে মাকে বলিতেছে, "বিজয়কে দুইটা কলাকাদঁ দাও ও খাইতে ভালবাসে!" অথচ মা মাস দুয়েক আগে একবার যখন বলিয়াছিল, "স্টেশনরোড ধারে যখন যাইতেছ তখন সরকার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার হইতে গোটা দশেক কলাকাদঁ কিনিও বিজয় বড্ড ভালবাসে তখন চিল্লাইয়া কহিয়াছিল, "আর কদ্দিন বাপের পয়সায় কলাকাদঁ খাইবে! এইবার নিজে কিছু করুক! আর সেই পয়সায় যতখুশী কলাকাদঁ কিনিয়া খাউক! ওর বয়েসী সক্কলের বিয়া শাদী হইয়া বাচ্চা অবধি হইয়া গেল আর নবাব সাহেব বাপের পেনশনের পয়সার শ্রাদ্ধ করিয়া কলাকাদঁ খাইবেন! এমন পুত্র হওয়ার চাইতে যদি নিঃসন্তান হইতাম তাও ভাল ছিল!"
বড্ড কষ্ট হইয়াছিল শুনিয়া সেইদিন। বাবা তুমি এমন বলিতে পারিলে! আমার অস্তিত্ব তুমি বাবা হইয়া সহ্য করিতে পারিতেছ না! আমি কী সত্যই এতটা খারাপ! কী কষ্ট পাইয়াছিলাম বলিয়া বুঝানো যাইবে না! জীবনে প্রথমবার মনে হইয়াছিল ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইব কিন্তু কাপুরুষ আমি সে সাহস আর করিতে পারিলাম না। সামান্য রাঁধিবার ক্ষমতা নাই, মামাবাড়ি ছাড়া বাহির সেইভাবে কখনও দেখি নাই বিদেশ বিভুঁইয়ে চরম বিপদে পড়িতে পারি বিবেচনা করিয়া তিনখানা বিড়ি খাইয়া মনের দুঃখ মনে চাপিয়া দিলাম। সেই বাবা কীনা নিজের ইচ্ছায় আমাকে খাওয়াইবার নিমিত্ত কলাকাদঁ কিনিয়া আনিয়াছে! ইহার পরেও বুড়াকে হিপোক্রিট কহিব না!
চন্দ্রা মাঝখানে একদিন আসিয়াছিল, ব্যস্ত আছি কহিয়া আর দেখা সাক্ষাৎ করি নাই। বুঁচির কোন কাজকম্মো নাই আমাকে জ্বালানো ব্যতিরেকে। বাসায় আসে মায়ের সাথে কীসব গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে দেবা ন জানন্তি! সেদিন আবার মা কহিতেছিল, "চন্দ্রার মত মেয়ে দুইটি নাই। আমার বড় ইচ্ছা তোর একটা কিছু গতি হইলে চন্দ্রাকে আমাদের বাসার বউ করিয়া আনিব! ওর হাতে তোর ভার সঁপিয়া আমরা বুড়া বুড়ি নিশ্চিন্তে থাকিব!" চিন্তা কর! বুড়ির ভীমরতি দেখিয়া আমি হাসিব না কাঁদিব বুঝিতে পারিলাম না! গম্ভীর কণ্ঠে বলিলাম, "তিনটি কারণে উহা সম্ভব নহে প্রথমতঃ টেকোচাঁদ দরকার হইলে নিজ কন্যাকে আমৃত্যু অবিবাহিতা রাখিবে তবু আমার হস্তে দিবে না! দ্বিতীয়তঃ বুঁচি যেরকম ধরণের মেয়ে তাহাতে আমাদের বাসায় সে ভাল থাকিবে না আর তৃতীয়তঃ বুঁচিকে আমার সহিত মানাইবে না!" মা খচিয়া গিয়া বলিল, "হ্যাঁ তোমার সাথে তো কেবল ঐশ্বর্য্য রাই ছাড়া আর এই জগতে কাহাকেও মানাইবে না!" আমি প্রত্যুত্তর করিলাম, "ঐশ্বর্য্য রাইয়ের বিবাহ হইয়া গিয়াছে বহুদিন আগে! আর প্রশ্ন ইহা নহে যে বুঁচিকে আমার সহিত মানাইবে কি না! প্রশ্ন হইল বুঁচি যে ধরণের মেয়ে তাহাতে আমি কোনভাবেই তাহার যোগ্য নহি, আমার হইতে ঢেরগুণে ভাল পাত্র তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। খামোখা বামন হইয়া চাঁদ ধরিবার স্বপ্ন নাহয় নাইবা দেখিলে।" শেষের কথাখানি বলিবার পর মা কেন জানি চুপ করিয়া গিয়াছিল আর কিছু বলে নাই।
এতসকল একনাগাড়ে লিখিয়া যাওয়া চাট্টিখানি বিষয় নহে তবুও আপাততঃ বিগত একমাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সকল এইসবই ছিল। আজ নিখিলদার বরাদ্দ একমাস শেষ হইল। আমার সম্মুখে বিস্তর খাতা স্তূপীকৃত হইয়া থরে থরে সাজানো আছে গত একমাসের আমার সকল সাধনার প্রমাণ স্বরূপ। প্রত্যেকদিনের তারিখ সহ ১০২টি করিয়া অঙ্ক চৌত্রিশটি অধ্যায় ধরিয়া ধরিয়া উহাতে কষা আছে। এক রিম অর্থাৎ বিশ দিস্তা খাতা কিনিয়াছিলাম তাহার সতের দিস্তা খাতা আর সাতটি কলম শেষ হইয়াছে। ইহার সাথে সাথে শেষ হইয়াছে অগ্রবাল সাহেবের বইয়ের তিনহাজারেরও বেশী অঙ্ক সমেত চৌত্রিশটি অধ্যায়ই! ইহাই আমার অ্যাকম্প্লীশমেণ্ট! আমার বিগত একমাসের প্রতিটি দিবসে চৌদ্দ ঘণ্টা ধরিয়া খাটিয়া যাইবার প্রমাণ! আমি জানি নাই আমি বিসিএস জয় করিতে পারিব কি না! কিন্তু আমি ইহা জানি, এই পরীক্ষায় বসিবার জন্য নিখিলদার সহায়তা পাইবার যে যোগ্যতামান নির্ধারিত ছিল আমি তাহা পূর্ণ করিয়াছি। শেষ রায় অবশ্যই নিখিলদা দিবে তাই আগামীকালের অপেক্ষায় রইলাম।
আজ আর লিখিতে পারিতেছি না, ঘড়ির কাঁটা সবে রাত্রি আটটার ঘরে, কিন্তু এই শ্রান্ত শরীর জুড়িয়া ঘুম নামিয়া আসিতেছে। একটু শুইয়া লই। চন্দ্রাদের বাসা হইতে গানের কলি ভাসিয়া আসিতেছে, কে গান গাহিতেছে? বড্ড সুরেলা গলা তো? চন্দ্রা বুঝি? কী গাইছে সে,
এবার আমায় ডাকলে দূরে সাগর-পারের গোপন পুরে ॥
বোঝা আমার নামিয়েছি যে,
সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে তৃষ্ণাতুরে ॥
আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
তারার আলোর প্রদীপখানি,
প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
আমার যত কথা ছিল ভেসে যাবে তোমার সুরে॥
(ক্রমশঃ)
★★★