14-02-2023, 06:34 PM
"তার মানে, আমার সঙ্গে আজ ডিনার করতে তোমার কোনো আপত্তি নেই। আমি খুব খুশি হয়েছি অপর্ণা দি। এরকম একটা অচেনা জায়গায় এসে একা একা কি করে এতটা সময় কাটাবো, এটা ভেবেই ভীষণ বোর লাগছিলো। তারপর মনে পড়লো তোমার তো এখানেই বিয়ে হয়েছে .. তুমি বলেছিলে। তাই তোমাকে কল করলাম। আমার অবশ্য তোমার হাজব্যান্ডকেও ডাকা উচিৎ ছিলো, কিন্তু আমি শুধু তোমার সঙ্গেই দেখা করতে চেয়েছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, ফিরতে রাত হলে তোমার বর আবার রাগ করবে না তো?" জানতে চাইলো শশাঙ্ক।
"আমি আমার বরের সঙ্গে থাকলে তো রাগ করবে!" সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো অপর্না।
- "মানে?"
- "মানে, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। ইনফ্যাক্ট আমিই ওকে মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়েছি। যেহেতু আমার কোনো দাবি-দাওয়া ছিলো না, তাই ওর দিক থেকেও কোনো বাধা আসেনি।"
শশাঙ্ক ভালো করে অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো,, তার মুখে বিন্দুমাত্র কষ্ট বা আক্ষেপের ছাপ নেই। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছে সে। "যদি অবশ্য বলতে আপত্তি না থাকে তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি .. হঠাৎ এরকমটা হলো কেনো? আর তোমাদের ছেলেমেয়ে?" জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
"আমাদের বিয়ের আগে থেকেই ও একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে ইনভলভড ছিলো, আই মিন রিলেশনশিপে ছিলো। আমি জানতাম না। যখন জানতে পারলাম, তখন আর এক মুহূর্তও .. আমারও তো একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। আমাদের কোনো ইস্যু হয়নি .. তাই পরস্পরের প্রতি সেই অর্থে কোনো টান তৈরিই হয়নি আমাদের .." কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা আনমনা হয়ে গেলো অপর্ণা।
শশাঙ্ক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো, তারপর জিজ্ঞাসা করলো "এখন, কেমন আছো? কাকু কাকিমা কেমন আছেন?"
"মাস ছয়েক হলো রূপনগর ইউনিভার্সিটিতে পার্টটাইমারের একটা চাকরি পেয়েছি .. যদিও এটা কন্ট্রাকচুয়াল। ভাড়া থাকি একটা ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে .. ব্যাস, এই আর কি। বাবা-মা তোদের ওখানে আই মিন সুন্দরপুরেই রয়েছে .. ওখানে আমাদের বাড়ি আছে তো! ওয়াশরুমটা ওইদিকে, তাই না? আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো .." কথাগুলো বলে অ্যাটাচ বাথরুমে ঢুকে গেলো অপর্ণা।
ততক্ষণে শশাঙ্ক ফোনে ডিনারের অর্ডার দিয়ে দিলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অপর্ণা জিজ্ঞাসা করলো "বলেছিলিস ভায়োলিনটা সঙ্গে করে এনেছিস! কোথায় .. দেখতে পাচ্ছি না তো?"
কম্বলের তলা থেকে ভায়োলিনটা বের করে মুচকি হেসে শশাঙ্ক বললো "এটার কথা তোমার এখনো মনে আছে?"
"মনে থাকবে না .. তাই কখনো হয়! সেই ইউনিভার্সিটির পিকনিকের দিন .. একটা বিশেষ কারণে খুব মন খারাপ ছিলো আমার। তোর ভায়োলিনের সুরেই তো আমার মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। আর সেই দিন থেকেই তো .." অপর্ণার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলো শশাঙ্ক, "সেই দিন থেকেই তো .. কি?"
- "নাথিং .. লিভ ইট। আচ্ছা তুই আমাকে একটা কথা বল .. একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান হয়ে তোর হঠাৎ চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার দরকার হয়ে পড়লো কেনো?"
- "কিছুই না .. নিজের একটা আইডেন্টিটি সৃষ্টি করার চেষ্টা মাত্র। আমি যদি লাইফে ইন ফিউচার কোনো ডিসিশন নিই এবং সেটা যদি ফেয়ার ডিসিশন হয় .. তাহলে আমার পরিবারের লোকজন যেনো অযথা বা অন্যায়ভাবে সেই সিদ্ধান্তের উপর বাধাপ্রদান না করতে পারে। আচ্ছা, একটু আগে যে বলছিলে তোমার নাকি পিকনিকের দিন খুব মন খারাপ ছিলো। কেনো, জানতে পারি?"
- "আসলে তার আগের দিন আমার উড বি হাজব্যান্ড আমাকে দেখতে এসেছিলো। আমি ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখেছি, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বাড়ির লোকজন এবং আমার মা-বাবার কথায় বাধ্য হয়ে ওদের সামনে আমাকে নাচতে হয়েছিল। এটা আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বলে আমি মনে করি .. এটাও একটা কারণ আমার মন খারাপের। কিন্তু তারপর যেটা হয়েছিলো সেটা আরো খারাপ। পরে আমার মা'কে ওর মা করে জানিয়েছিল .. আমাকে ওনার ছেলের পছন্দ হয়েছে। তবে, উনার ছেলে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের পর আর ধেই ধেই করে নাচা চলবে না। নাচার সময় আমাকে নাকি ভীষণ অড্ লাগছিলো। যে লোকটা নাচের কিছুই বোঝেনা, সে এমন একটা আন-পার্লামেন্টারি কথা বলে দিলো .. এই কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। তাই মন খারাপ ছিলো।"
- "আচ্ছা .. এবার বুঝলাম।"
- "তোর ভায়োলিনের সুর শুনে আমার মনে হয়েছিলো .. এই ছেলেটা যদিও আমার থেকে অনেকটাই ছোট, অন্য ডিপার্টমেন্টের হলেও ও এখনো এই ইউনিভার্সিটি ছাত্র আর আমি শিক্ষিকা। কিন্তু তবুও এই ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাতে আমার বেশ ভালো লাগছে। মনের সব কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, রাগ, ক্ষোভ ভুলে থাকতে পারছি। মনটা ধীরে ধীরে খুশিতে ভরে উঠছিল। আসলে সবই ছিল ওই ভায়োলিনের সুরের প্রভাব। তবে তোর কথাবার্তা এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমার খুব ভালো লেগেছিলো। আর মুখের ওই হাসিটা .. ঠিক যেন তোর ভায়োলিনের সুরের মতোই সুন্দর।"
- "আসলে কি জানো তো অপর্ণা দি .. আমার মনে হয়, তুমি একটা সাপোর্ট খুঁজছিলে। এমন একজনের সঙ্গ চাইছিলে, যার সঙ্গে থাকলে তোমার মনের ভার ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে যাবে। তাই না, বলো?"
- "হ্যাঁ রে, ঠিক তাই। আসলে আমি ওই বিয়েটাও করতে চাইনি। আমাদের বাড়ির অবস্থা তো আর তোদের মত নয়। খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে আমি। তার উপর দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য বাবা খুব তাড়াতাড়ি কার্যক্ষমতা হারিয়ে বাড়িতে বসে যাওয়ার ফলে অবস্থা আরও পড়ে যায়। তাই হয়তো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিল আমার। আমার প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ি অবস্থাপন্ন ঘরের ছিলো। আমার মা-বাবা দেখলো ওদের টাকা আর ওরা দেখলো আমার রূপ। তবু দুটো বছর বিয়েটা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর আর পারলাম না। এখন মনে হয়, ওকে আমি কোনোদিনই ভালবাসতে পারিনি। তখন যদি মা-বাবার কথায় চাকরিটা ছেড়ে না দিতাম, তাহলে বিয়েটা হয়তো এড়াতে পারতাম। তুই একদম ঠিক ডিসিশন নিয়েছিস .. তোর বাবা যতই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হোক না কেনো, চাকরি করাটা জরুরী। স্বনির্ভর হলে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করা যায়। তা না হলে, অন্যের চাপিয়ে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয় .. যেমন আমি হয়েছি।"
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় গলা জড়িয়ে এলো অপর্নার। সেই মুহূর্তে দরজায় টোকা পড়লো। অর্ডার দেওয়া খাবারগুলো চলে এসেছিল। মিক্সড ফ্রাইড রাইস আর ড্রাই চিলি-চিকেন দিয়ে ডিনার শুরু করলো ওরা, ঘড়িতে তখন সাড়ে ন'টা। শশাঙ্কর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, সে ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো। অপর্ণা ধীরে ধীরে খায় .. সে তখনও খাচ্ছিলো। খেতে খেতেই শশাঙ্কর দিকে তাকিয়ে বললো, "সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি .. এবার ভায়োলিনটা বাজা প্লিজ .."
"কোনটা শোনাবো?" বিছানার উপর থেকে ভায়োলিনটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
অপর্ণা তৎক্ষণাৎ বললো "ওই যে .. পিকনিকের দিন একদম শেষে যেটা বাজিয়েছিলি .. বলতো কোনটা! দেখি তো মনে আছে নাকি তোর .."
"মনে আছে .." এইটুকু বলে, বাজনা শুরু করলো শশাঙ্ক - 'লাগ যা গালে ...."
ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল অপর্ণার। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে সোজা বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। ঠিক সেই মুহূর্তে স্কিন টাইট টি-শার্টের বুকের কাছের বোতামটা পটাং করে খুলে খুলে গিয়ে ওর গভীর স্তন বিভাজিকা স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো। অথচ সেই দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই অপর্ণার। বাজনা শেষ হতেই বলে উঠলো "একটা বাউল গানের সুর বাজাবি? ওই যে লালন ফকিরের গান .. মিলন হবে কত দিনে .."
"তুমি বাউল গান পছন্দ করো অপর্ণা দি?" জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
"হ্যাঁ, আমার খুব পছন্দ বাউল সঙ্গীত। তবে একটা কথা না বলে পারছি না .. মানছি আমি তোর থেকে বয়সে বছর চারেকের বড় আর এক সময় তোর ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। তাই বলে আমাকে সবসময় 'দিদি' সম্বোধন করে নিজেকে ছোট প্রমাণ করার তোর এই প্রচেষ্টা মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে আমার .." কপট রাগ দেখিয়ে বললো অপর্ণা।
"তুমি যখন অভয় দিয়েছো, তখন আর দিদি বলবো না, নাম ধরেই ডাকবো .." এইটুকু বলে শশাঙ্ক বাজাতে শুরু করলো অপর্ণার ফরমাইস করা গানের সুর।
"তোর বাজানো ভায়োলিনের সুর শুনলে আমার বুকের ভেতরটা কিরকম যেন করে .." অপর্ণার এই উক্তিতে কিছুটা সাহস করেই শশাঙ্ক বলে উঠলো "তোকে দেখলে বা তুই পাশে থাকলে আমার বাজানোর তাগিদটা হাজারগুন বেড়ে যায়। এখন যেমন আমি বাজাচ্ছি আর তুই আমার পাশে শুয়ে আছিস। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার শরীরে।"
'তুমি' থেকে হঠাৎ 'তুই' সম্মোধন এবং 'দিদি' থেকে নাম ধরে ডাকাতে বিন্দুমাত্র রিঅ্যাকশন না দেখিয়ে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই অপর্ণা জিজ্ঞাসা করলো, "ওই যে পিকনিকের দিন বলেছিলিস, শনি-রবিবার করে বাউলদের আখড়ায় যাস, এখনো সেটা কন্টিনিউ করিস?"
"হ্যাঁ, এতদিন তো বাবার বিজনেসের কাজ দেখাশোনা করতাম বা করছি এখনো। আমাদের অফিস থেকে শনিবার দুপুরে বেরিয়ে সোজা আখড়ায় চলে যাই। গান বাজনার মধ্যে বেশ কাটে দেড়টা দিন। কখনো বা বাউলদের সঙ্গে কাছেপিঠের কোনো গ্রামেও চলে যাই .. আমার বাজনা শুনিয়ে আসি। ওদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে আমার।" উত্তর দিলো শশাঙ্ক।
"হলোই বা তোদের নিজেদের অফিস। তবুও তো কাজের প্রচণ্ড প্রেসার থাকে। সারা সপ্তাহ এত চাপ সামলে, এনার্জি থাকে তোর?" উঠে বসে কথাগুলো বললো অপর্ণা।
"বড় হয়েছি, এমবিএ পাস করেছি, পুরুষ মানুষ, তার ওপর বাবার আদেশ .. তাই দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে। সবকিছুই এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বলতে পারিস। তবে মাঝে মাঝে ভীষণ ক্লান্ত এবং বিষন্ন লাগে আমারও .. যখন দেখতে পাই কর্মচারীরা উচ্চ পদ আর টাকা দেখে মানুষকে বিচার করে। সহকর্মীরা কেউ কোনো সাফল্য পেলে নিজেদের মধ্যেই ঈর্ষা করে, কিন্তু তার প্রতিভা বা গুণের কোনো কদর করে না। এই পরিবেশে সারা সপ্তাহ থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠি। তাইতো ছটফট করি আখড়ায় ফেরার জন্য। ওখানে গিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিই, খোলা আকাশের নিচে ঘুমাই, প্রাণ খুলে আমার ভায়োলিন বাজাই .. সুর আমার বেঁচে থাকার রসদ।" কথাগুলো বলতে বলতে কখনো তৃপ্তিতে মন ভরে যাচ্ছিল শশাঙ্কর আবার কখনো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল তার ভেতর থেকে।
"আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, রাগ করবি না তো? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ে তো দুরস্ত, এখনো কোনো গার্লফ্রেন্ড হয়নি তোর। তুই ভীষণ একা, তাই না?" অপর্ণার এই প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শশাঙ্ক। তারপর জিজ্ঞাসা করলো "কি করে বুঝলি?"
"তোর প্রতিটা কথায় একাকীত্বের কষ্ট ফুটে উঠেছে, তোর ভায়োলিনে তোলা সুরের প্রতিটা তরঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে নিঃসঙ্গতার হাহাকার। কারো ভিতরে বিষাদ আর একাকীত্ব থাকলে তবেই সে এত অসাধারণ বাজাতে পারে।" শশাঙ্কর কাছে এগিয়ে এসে কথাগুলো বললো অপর্ণা।
"আর তুই? তোর মধ্যে একাকীত্ব নেই? নিঃসঙ্গতা অনুভব করিস না তুই?" পাল্টা প্রশ্ন করলো শশাঙ্ক।
অপর্ণা এই মুহূর্তে শশাঙ্কর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। তারপর শশাঙ্কর ঠিক পেছনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো "যারা যারা বেহেকতা হ্যায় .. এটা একটু বাজাবি প্লিজ?"
এক সময় শেষ হলো বাজনা। অপর্ণা এখন শশাঙ্কর বাহুবন্ধনে। ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এক অদ্ভুত ঘোর লাগা স্বরে অপর্ণা বলে উঠলো "নিঃসঙ্গ না হলে এই শীতের রাতে তোর একটা ফোন কলে আমি এখানে, এই হোটেলে আসতাম?" তারপর শশাঙ্কর মুখটা দুই হাত দিয়ে নিজের সামনে তুলে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে খেতে বললো, "বাইরে আজ বরফ পড়লেও আমি আসতাম, কেনো জানিস? তোর ওই ভায়োলিনের সুরের টানে।"
শশাঙ্কর সঙ্গে চুম্বনরত অবস্থাতে নিজের অবশিষ্ট দুর্বলতাটুকু অতিক্রম করলো অপর্ণা। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হলো তারা। অপর্ণা ধীরে ধীরে অনুভব করলো .. অন্তিম দুর্বলতাটুকু জয় করতে পেরেছে বলেই জানতে পারছে শরীরে এত সুধা ছিলো, এত শিহরণ লুকিয়ে ছিলো, শরীরের ক্ষুধা এবং তা যথাযথভাবে প্রশমন করার উপায়।
এই রোমাঞ্চকর শরীরি যাত্রায় গা ভাসাতে পেরেছে বলে শরীরের অব্যবহৃত রত্নসমূহ শশাঙ্কর হাতে সঁপে দিয়ে, অন্ধ অতল জোয়ারে - কখনো পরম যত্নবান হয়ে আবার কখনো করাতের মতো চিরে চিরে শশাঙ্ক যখন খেলছিলো তার তিরিশ বর্ষীয় যুবতী শরীর নিয়ে , অপর্ণা বিস্ময়াবিষ্ট হচ্ছিলো শরীরের অনৈসর্গিক সুখের পূর্ণতায়। শরীরি সঙ্গমে মনে হচ্ছিলো সে যেন একটা স্কেলে বাঁধা 'ভায়োলিন' .. আর ওর শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ যেন এক-একটা 'তার', সেই তারগুলির এদিক ওদিক চাপে ওর শরীরে যেন সঙ্গীতের মূর্ছনা ফুটে উঠছে। শুদ্ধস্বরের মাঝে কখনো কোমল "রে" , কখনো কোমল "গা" , কখনো করি "মা" , আবার কখনো কোমল "ধা" অথবা কোমল "নি" ব্যবহার করে তার শরীরে বিলাবল, খাম্বাজ, কাফী, আশাবরী, ভৈরব হয়ে কল্যাণ, মারওয়া, ভৈরবী, পূর্বী, তোড়ীর .. সম্মিলিত আরোহন অবরোহন হচ্ছে। সুখের আবেশে হারিয়ে যেতে থাকলো অপর্ণা।
তারপর একসময় শশাঙ্কর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে অপর্ণা বলে উঠলো "কালকে ইন্টারভিউ দিয়ে এখান থেকে চলে গেলে আমার কথা আর মনেই পড়বে না তোর। এই রাতটাকে দুর্ঘটনা মনে করে আজকের সবকিছু ভুলে যেতে চাইবি, তাই তো?"
"চুপ .. এইসব কথা একদম নয়। একটু আগে তোকে বলছিলাম না .. আমি যদি লাইফে ইন ফিউচার কোনো ডিসিশন নিই এবং সেটা যদি ফেয়ার ডিসিশন হয় .. তাহলে আমার পরিবারের লোকজন যেনো অযথা বা অন্যায়ভাবে সেই সিদ্ধান্তের উপর বাধাপ্রদান না করতে পারে। এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। আজকের পর আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি তোকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও চলবে না আমার আর আমার সঙ্গীতের। তাই কালকের ইন্টারভিউতে চাকরিটা পাওয়া আমার জন্য ভীষণ জরুরী এবং চাকরিটা আমি পাবোই .. এই ব্যাপারে আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত। আমাদের দু'জনের পরিবার থেকে যদি আমাদের এই সম্পর্কটা মেনে নাও নেয়, তাহলে আমরা দু'জন নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে পারবো না?" শশাঙ্কর মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর তার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো অপর্ণা .. তখন মাঝরাত।
"আমি আমার বরের সঙ্গে থাকলে তো রাগ করবে!" সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো অপর্না।
- "মানে?"
- "মানে, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। ইনফ্যাক্ট আমিই ওকে মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়েছি। যেহেতু আমার কোনো দাবি-দাওয়া ছিলো না, তাই ওর দিক থেকেও কোনো বাধা আসেনি।"
শশাঙ্ক ভালো করে অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো,, তার মুখে বিন্দুমাত্র কষ্ট বা আক্ষেপের ছাপ নেই। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছে সে। "যদি অবশ্য বলতে আপত্তি না থাকে তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি .. হঠাৎ এরকমটা হলো কেনো? আর তোমাদের ছেলেমেয়ে?" জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
"আমাদের বিয়ের আগে থেকেই ও একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে ইনভলভড ছিলো, আই মিন রিলেশনশিপে ছিলো। আমি জানতাম না। যখন জানতে পারলাম, তখন আর এক মুহূর্তও .. আমারও তো একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। আমাদের কোনো ইস্যু হয়নি .. তাই পরস্পরের প্রতি সেই অর্থে কোনো টান তৈরিই হয়নি আমাদের .." কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা আনমনা হয়ে গেলো অপর্ণা।
শশাঙ্ক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো, তারপর জিজ্ঞাসা করলো "এখন, কেমন আছো? কাকু কাকিমা কেমন আছেন?"
"মাস ছয়েক হলো রূপনগর ইউনিভার্সিটিতে পার্টটাইমারের একটা চাকরি পেয়েছি .. যদিও এটা কন্ট্রাকচুয়াল। ভাড়া থাকি একটা ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে .. ব্যাস, এই আর কি। বাবা-মা তোদের ওখানে আই মিন সুন্দরপুরেই রয়েছে .. ওখানে আমাদের বাড়ি আছে তো! ওয়াশরুমটা ওইদিকে, তাই না? আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো .." কথাগুলো বলে অ্যাটাচ বাথরুমে ঢুকে গেলো অপর্ণা।
ততক্ষণে শশাঙ্ক ফোনে ডিনারের অর্ডার দিয়ে দিলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অপর্ণা জিজ্ঞাসা করলো "বলেছিলিস ভায়োলিনটা সঙ্গে করে এনেছিস! কোথায় .. দেখতে পাচ্ছি না তো?"
কম্বলের তলা থেকে ভায়োলিনটা বের করে মুচকি হেসে শশাঙ্ক বললো "এটার কথা তোমার এখনো মনে আছে?"
"মনে থাকবে না .. তাই কখনো হয়! সেই ইউনিভার্সিটির পিকনিকের দিন .. একটা বিশেষ কারণে খুব মন খারাপ ছিলো আমার। তোর ভায়োলিনের সুরেই তো আমার মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। আর সেই দিন থেকেই তো .." অপর্ণার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলো শশাঙ্ক, "সেই দিন থেকেই তো .. কি?"
- "নাথিং .. লিভ ইট। আচ্ছা তুই আমাকে একটা কথা বল .. একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান হয়ে তোর হঠাৎ চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার দরকার হয়ে পড়লো কেনো?"
- "কিছুই না .. নিজের একটা আইডেন্টিটি সৃষ্টি করার চেষ্টা মাত্র। আমি যদি লাইফে ইন ফিউচার কোনো ডিসিশন নিই এবং সেটা যদি ফেয়ার ডিসিশন হয় .. তাহলে আমার পরিবারের লোকজন যেনো অযথা বা অন্যায়ভাবে সেই সিদ্ধান্তের উপর বাধাপ্রদান না করতে পারে। আচ্ছা, একটু আগে যে বলছিলে তোমার নাকি পিকনিকের দিন খুব মন খারাপ ছিলো। কেনো, জানতে পারি?"
- "আসলে তার আগের দিন আমার উড বি হাজব্যান্ড আমাকে দেখতে এসেছিলো। আমি ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখেছি, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বাড়ির লোকজন এবং আমার মা-বাবার কথায় বাধ্য হয়ে ওদের সামনে আমাকে নাচতে হয়েছিল। এটা আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বলে আমি মনে করি .. এটাও একটা কারণ আমার মন খারাপের। কিন্তু তারপর যেটা হয়েছিলো সেটা আরো খারাপ। পরে আমার মা'কে ওর মা করে জানিয়েছিল .. আমাকে ওনার ছেলের পছন্দ হয়েছে। তবে, উনার ছেলে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের পর আর ধেই ধেই করে নাচা চলবে না। নাচার সময় আমাকে নাকি ভীষণ অড্ লাগছিলো। যে লোকটা নাচের কিছুই বোঝেনা, সে এমন একটা আন-পার্লামেন্টারি কথা বলে দিলো .. এই কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। তাই মন খারাপ ছিলো।"
- "আচ্ছা .. এবার বুঝলাম।"
- "তোর ভায়োলিনের সুর শুনে আমার মনে হয়েছিলো .. এই ছেলেটা যদিও আমার থেকে অনেকটাই ছোট, অন্য ডিপার্টমেন্টের হলেও ও এখনো এই ইউনিভার্সিটি ছাত্র আর আমি শিক্ষিকা। কিন্তু তবুও এই ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাতে আমার বেশ ভালো লাগছে। মনের সব কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, রাগ, ক্ষোভ ভুলে থাকতে পারছি। মনটা ধীরে ধীরে খুশিতে ভরে উঠছিল। আসলে সবই ছিল ওই ভায়োলিনের সুরের প্রভাব। তবে তোর কথাবার্তা এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমার খুব ভালো লেগেছিলো। আর মুখের ওই হাসিটা .. ঠিক যেন তোর ভায়োলিনের সুরের মতোই সুন্দর।"
- "আসলে কি জানো তো অপর্ণা দি .. আমার মনে হয়, তুমি একটা সাপোর্ট খুঁজছিলে। এমন একজনের সঙ্গ চাইছিলে, যার সঙ্গে থাকলে তোমার মনের ভার ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে যাবে। তাই না, বলো?"
- "হ্যাঁ রে, ঠিক তাই। আসলে আমি ওই বিয়েটাও করতে চাইনি। আমাদের বাড়ির অবস্থা তো আর তোদের মত নয়। খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে আমি। তার উপর দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য বাবা খুব তাড়াতাড়ি কার্যক্ষমতা হারিয়ে বাড়িতে বসে যাওয়ার ফলে অবস্থা আরও পড়ে যায়। তাই হয়তো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিল আমার। আমার প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ি অবস্থাপন্ন ঘরের ছিলো। আমার মা-বাবা দেখলো ওদের টাকা আর ওরা দেখলো আমার রূপ। তবু দুটো বছর বিয়েটা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর আর পারলাম না। এখন মনে হয়, ওকে আমি কোনোদিনই ভালবাসতে পারিনি। তখন যদি মা-বাবার কথায় চাকরিটা ছেড়ে না দিতাম, তাহলে বিয়েটা হয়তো এড়াতে পারতাম। তুই একদম ঠিক ডিসিশন নিয়েছিস .. তোর বাবা যতই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হোক না কেনো, চাকরি করাটা জরুরী। স্বনির্ভর হলে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করা যায়। তা না হলে, অন্যের চাপিয়ে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয় .. যেমন আমি হয়েছি।"
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় গলা জড়িয়ে এলো অপর্নার। সেই মুহূর্তে দরজায় টোকা পড়লো। অর্ডার দেওয়া খাবারগুলো চলে এসেছিল। মিক্সড ফ্রাইড রাইস আর ড্রাই চিলি-চিকেন দিয়ে ডিনার শুরু করলো ওরা, ঘড়িতে তখন সাড়ে ন'টা। শশাঙ্কর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, সে ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলো। অপর্ণা ধীরে ধীরে খায় .. সে তখনও খাচ্ছিলো। খেতে খেতেই শশাঙ্কর দিকে তাকিয়ে বললো, "সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি .. এবার ভায়োলিনটা বাজা প্লিজ .."
"কোনটা শোনাবো?" বিছানার উপর থেকে ভায়োলিনটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
অপর্ণা তৎক্ষণাৎ বললো "ওই যে .. পিকনিকের দিন একদম শেষে যেটা বাজিয়েছিলি .. বলতো কোনটা! দেখি তো মনে আছে নাকি তোর .."
"মনে আছে .." এইটুকু বলে, বাজনা শুরু করলো শশাঙ্ক - 'লাগ যা গালে ...."
ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল অপর্ণার। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে সোজা বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। ঠিক সেই মুহূর্তে স্কিন টাইট টি-শার্টের বুকের কাছের বোতামটা পটাং করে খুলে খুলে গিয়ে ওর গভীর স্তন বিভাজিকা স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো। অথচ সেই দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই অপর্ণার। বাজনা শেষ হতেই বলে উঠলো "একটা বাউল গানের সুর বাজাবি? ওই যে লালন ফকিরের গান .. মিলন হবে কত দিনে .."
"তুমি বাউল গান পছন্দ করো অপর্ণা দি?" জিজ্ঞাসা করলো শশাঙ্ক।
"হ্যাঁ, আমার খুব পছন্দ বাউল সঙ্গীত। তবে একটা কথা না বলে পারছি না .. মানছি আমি তোর থেকে বয়সে বছর চারেকের বড় আর এক সময় তোর ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। তাই বলে আমাকে সবসময় 'দিদি' সম্বোধন করে নিজেকে ছোট প্রমাণ করার তোর এই প্রচেষ্টা মাঝেমাঝে অসহ্য লাগে আমার .." কপট রাগ দেখিয়ে বললো অপর্ণা।
"তুমি যখন অভয় দিয়েছো, তখন আর দিদি বলবো না, নাম ধরেই ডাকবো .." এইটুকু বলে শশাঙ্ক বাজাতে শুরু করলো অপর্ণার ফরমাইস করা গানের সুর।
"তোর বাজানো ভায়োলিনের সুর শুনলে আমার বুকের ভেতরটা কিরকম যেন করে .." অপর্ণার এই উক্তিতে কিছুটা সাহস করেই শশাঙ্ক বলে উঠলো "তোকে দেখলে বা তুই পাশে থাকলে আমার বাজানোর তাগিদটা হাজারগুন বেড়ে যায়। এখন যেমন আমি বাজাচ্ছি আর তুই আমার পাশে শুয়ে আছিস। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার শরীরে।"
'তুমি' থেকে হঠাৎ 'তুই' সম্মোধন এবং 'দিদি' থেকে নাম ধরে ডাকাতে বিন্দুমাত্র রিঅ্যাকশন না দেখিয়ে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই অপর্ণা জিজ্ঞাসা করলো, "ওই যে পিকনিকের দিন বলেছিলিস, শনি-রবিবার করে বাউলদের আখড়ায় যাস, এখনো সেটা কন্টিনিউ করিস?"
"হ্যাঁ, এতদিন তো বাবার বিজনেসের কাজ দেখাশোনা করতাম বা করছি এখনো। আমাদের অফিস থেকে শনিবার দুপুরে বেরিয়ে সোজা আখড়ায় চলে যাই। গান বাজনার মধ্যে বেশ কাটে দেড়টা দিন। কখনো বা বাউলদের সঙ্গে কাছেপিঠের কোনো গ্রামেও চলে যাই .. আমার বাজনা শুনিয়ে আসি। ওদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে আমার।" উত্তর দিলো শশাঙ্ক।
"হলোই বা তোদের নিজেদের অফিস। তবুও তো কাজের প্রচণ্ড প্রেসার থাকে। সারা সপ্তাহ এত চাপ সামলে, এনার্জি থাকে তোর?" উঠে বসে কথাগুলো বললো অপর্ণা।
"বড় হয়েছি, এমবিএ পাস করেছি, পুরুষ মানুষ, তার ওপর বাবার আদেশ .. তাই দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে। সবকিছুই এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বলতে পারিস। তবে মাঝে মাঝে ভীষণ ক্লান্ত এবং বিষন্ন লাগে আমারও .. যখন দেখতে পাই কর্মচারীরা উচ্চ পদ আর টাকা দেখে মানুষকে বিচার করে। সহকর্মীরা কেউ কোনো সাফল্য পেলে নিজেদের মধ্যেই ঈর্ষা করে, কিন্তু তার প্রতিভা বা গুণের কোনো কদর করে না। এই পরিবেশে সারা সপ্তাহ থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠি। তাইতো ছটফট করি আখড়ায় ফেরার জন্য। ওখানে গিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিই, খোলা আকাশের নিচে ঘুমাই, প্রাণ খুলে আমার ভায়োলিন বাজাই .. সুর আমার বেঁচে থাকার রসদ।" কথাগুলো বলতে বলতে কখনো তৃপ্তিতে মন ভরে যাচ্ছিল শশাঙ্কর আবার কখনো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল তার ভেতর থেকে।
"আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, রাগ করবি না তো? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ে তো দুরস্ত, এখনো কোনো গার্লফ্রেন্ড হয়নি তোর। তুই ভীষণ একা, তাই না?" অপর্ণার এই প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শশাঙ্ক। তারপর জিজ্ঞাসা করলো "কি করে বুঝলি?"
"তোর প্রতিটা কথায় একাকীত্বের কষ্ট ফুটে উঠেছে, তোর ভায়োলিনে তোলা সুরের প্রতিটা তরঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে নিঃসঙ্গতার হাহাকার। কারো ভিতরে বিষাদ আর একাকীত্ব থাকলে তবেই সে এত অসাধারণ বাজাতে পারে।" শশাঙ্কর কাছে এগিয়ে এসে কথাগুলো বললো অপর্ণা।
"আর তুই? তোর মধ্যে একাকীত্ব নেই? নিঃসঙ্গতা অনুভব করিস না তুই?" পাল্টা প্রশ্ন করলো শশাঙ্ক।
অপর্ণা এই মুহূর্তে শশাঙ্কর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। তারপর শশাঙ্কর ঠিক পেছনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো "যারা যারা বেহেকতা হ্যায় .. এটা একটু বাজাবি প্লিজ?"
এক সময় শেষ হলো বাজনা। অপর্ণা এখন শশাঙ্কর বাহুবন্ধনে। ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এক অদ্ভুত ঘোর লাগা স্বরে অপর্ণা বলে উঠলো "নিঃসঙ্গ না হলে এই শীতের রাতে তোর একটা ফোন কলে আমি এখানে, এই হোটেলে আসতাম?" তারপর শশাঙ্কর মুখটা দুই হাত দিয়ে নিজের সামনে তুলে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে খেতে বললো, "বাইরে আজ বরফ পড়লেও আমি আসতাম, কেনো জানিস? তোর ওই ভায়োলিনের সুরের টানে।"
শশাঙ্কর সঙ্গে চুম্বনরত অবস্থাতে নিজের অবশিষ্ট দুর্বলতাটুকু অতিক্রম করলো অপর্ণা। ক্রমে ঘনিষ্ঠ হলো তারা। অপর্ণা ধীরে ধীরে অনুভব করলো .. অন্তিম দুর্বলতাটুকু জয় করতে পেরেছে বলেই জানতে পারছে শরীরে এত সুধা ছিলো, এত শিহরণ লুকিয়ে ছিলো, শরীরের ক্ষুধা এবং তা যথাযথভাবে প্রশমন করার উপায়।
এই রোমাঞ্চকর শরীরি যাত্রায় গা ভাসাতে পেরেছে বলে শরীরের অব্যবহৃত রত্নসমূহ শশাঙ্কর হাতে সঁপে দিয়ে, অন্ধ অতল জোয়ারে - কখনো পরম যত্নবান হয়ে আবার কখনো করাতের মতো চিরে চিরে শশাঙ্ক যখন খেলছিলো তার তিরিশ বর্ষীয় যুবতী শরীর নিয়ে , অপর্ণা বিস্ময়াবিষ্ট হচ্ছিলো শরীরের অনৈসর্গিক সুখের পূর্ণতায়। শরীরি সঙ্গমে মনে হচ্ছিলো সে যেন একটা স্কেলে বাঁধা 'ভায়োলিন' .. আর ওর শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ যেন এক-একটা 'তার', সেই তারগুলির এদিক ওদিক চাপে ওর শরীরে যেন সঙ্গীতের মূর্ছনা ফুটে উঠছে। শুদ্ধস্বরের মাঝে কখনো কোমল "রে" , কখনো কোমল "গা" , কখনো করি "মা" , আবার কখনো কোমল "ধা" অথবা কোমল "নি" ব্যবহার করে তার শরীরে বিলাবল, খাম্বাজ, কাফী, আশাবরী, ভৈরব হয়ে কল্যাণ, মারওয়া, ভৈরবী, পূর্বী, তোড়ীর .. সম্মিলিত আরোহন অবরোহন হচ্ছে। সুখের আবেশে হারিয়ে যেতে থাকলো অপর্ণা।
তারপর একসময় শশাঙ্কর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে অপর্ণা বলে উঠলো "কালকে ইন্টারভিউ দিয়ে এখান থেকে চলে গেলে আমার কথা আর মনেই পড়বে না তোর। এই রাতটাকে দুর্ঘটনা মনে করে আজকের সবকিছু ভুলে যেতে চাইবি, তাই তো?"
"চুপ .. এইসব কথা একদম নয়। একটু আগে তোকে বলছিলাম না .. আমি যদি লাইফে ইন ফিউচার কোনো ডিসিশন নিই এবং সেটা যদি ফেয়ার ডিসিশন হয় .. তাহলে আমার পরিবারের লোকজন যেনো অযথা বা অন্যায়ভাবে সেই সিদ্ধান্তের উপর বাধাপ্রদান না করতে পারে। এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। আজকের পর আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি তোকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও চলবে না আমার আর আমার সঙ্গীতের। তাই কালকের ইন্টারভিউতে চাকরিটা পাওয়া আমার জন্য ভীষণ জরুরী এবং চাকরিটা আমি পাবোই .. এই ব্যাপারে আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত। আমাদের দু'জনের পরিবার থেকে যদি আমাদের এই সম্পর্কটা মেনে নাও নেয়, তাহলে আমরা দু'জন নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে পারবো না?" শশাঙ্কর মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর তার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো অপর্ণা .. তখন মাঝরাত।