07-02-2023, 09:32 AM
বাবার ঘাটকাজ ছিল সেদিন। সকাল ছ'টায় আমরা হাজির হলাম ঘাটে। গঙ্গা খুব দূরে নয়, তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মা, আমার বড়মামা আর কাছা গলায় আমি। আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন টি'শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক।
” কাজ করবেন তো?”
” হ্যাঁ। বাবার ঘাটকাজ।“
” পুরুত ঠিক করা আছে? না থাকলে কোন চিন্তা নেই, আমি আছি।“
” আপনি পুরুতমশাই?”
” আজ্ঞে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি”
” না। আমাদের পুরোহিত মশাই ঠিক করাই আছে। এসে পড়বেন যেকোনো সময়ে।“
” ঠিক আছে স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন। আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব।“
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম আমি। লোকটি বেশ করিতকর্মা। প্রথমে গঙ্গা থেকে এক বালতি জল তুলে নিয়ে এলেন। অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হল তার জন্য, কারন তখন ভাটার টান চলছে। গঙ্গা সরে গিয়েছে অনেকটা দুরে। তারপর নিয়ে এলেন কেজিখানেক গঙ্গামাটি। অত্যন্ত যত্ন করে একটা চৌকো বেদী মত বানালেন, যার উপর কাজ হবে। কোসা-কুসি নিয়ে গিয়েছিলাম আমরাই। আমাদের অনুমতি নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে আনলেন সেগুলো।
ইতিমধ্যে পুরোহিত এসে পড়েছেন। হেসে বললেন, “ বাহহ। খাসা ব্যবস্থা”।
হাসিমুখে নমস্কার করে একপাশে সরে দাঁড়ালেন সেই ভদ্রলোক, “আপনারা কাজ করুন, আমি আছি।“
হাতে কুশের আঙটি পরে নিলাম। কাজ শুরু হল। ঝাপসা ঝাপসা লাগছিল মাঝে মাঝে। চোখের পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়, ডাক্তার দেখাতে হবে।
পূজাপাঠ চলল ঘন্টাখানেক, তারপর বাবাকে স্মরণ করে প্রার্থনা, অতঃপর পিণ্ডগুলো সাজিয়ে দিলাম একটার পর একটা। রোদের তেজ বাড়ছে।
“নিন, এবার কাছা ছেড়ে, স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে নিন।” বললেন পুরোহিত।
এইবার এগিয়ে এলেন সেই লোকটি, আবার।
“ভাটার সময়ে স্নান করতে পারবেন?”
“না পারলে উপায়?” আমার মামা প্রশ্ন করলেন।
ঠিক যে উত্তরটা আশা করেছিলাম, সেটাই এল, “আমি আছি তো।”
“অনুমতি করলে আমি দুই বালতি গঙ্গাজল তুলে এনে দেব, স্নান করবেন তাতেই। ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন। সর্বভুতেষু সংস্থিতা।“
শেষ অংশটা আশা করিনি। যাইহোক। ঠিক হল আমি একটু গভীরে গিয়ে হাল্কা ডুব দিয়ে আসব, আর তারপর ওনার তুলে দেওয়া গঙ্গাজলে স্নান করে নেব ভাল করে।
ডুব দেওয়ার জন্য আমি যেখানে গেলাম, তার থেকে আরও দুশো মিটার গভীরে গিয়ে জল তুলে আনলেন উনি। ক্লেদমুক্ত, পরিস্কার জল।
ডাঙ্গায় উঠে এলাম। আমার পায়ে লেগে থাকা পলিমাটি ধুয়ে দিলেন জল ঢেলে। অতঃপর, দু বালতি গঙ্গাজলে জলে বেশ করে স্নান সারলাম।
ভেজা ন্যাড়া মাথায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। ফেরার সময় হয়েছে। সেই ভদ্রলোকটিকে কাছে ডাকলাম। টাকার ব্যাগ মামার কাছে। দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম, “অনেক উপকার করেছেন, রাখুন এটা।“
” ধন্যবাদ স্যার। আমি এখানেই থাকি। যেকোনো কাজ - পুজা পাব্বনে আমাকে পাবেন।“ নমস্কার করেন আবার।
“ কি নাম আপনার?”
এইবার একটু কুঁকড়ে গেলেন মনে হল, “নাম থাক না বাবু। আমাকে সবাই কাকা বলেই চেনে।“
অবাক হলাম, “ নাম বলতে আপত্তি কিসের ?” মুচকি হেসে বললাম।
এইবার আমার একদম কাছে সরে এলেন উনি। আমার হাতটা ধরলেন। কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, “আমার নাম আসগার। আসগার আলি।“ হাতটা আলগা না করেই বললেন, “কাউকে বলার দরকার নেই বাবু। আপনি জানলেন, ব্যস। চিন্তা করবেন না বাবু, আমি গীতা, কথামৃত সবই পড়েছি। নিরামিষ খাই। জন্ম '. ঘরে হয়েছে, এই যা। আপনার কোনো পাপ লাগেনি বাবু। নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।“
ফেরার সময় হয়েছে। পিণ্ডের দিকে পিছু ফিরে তাকাতে নেই, তবু, চোখ চলেই গেল। কাকেদের ভিড়। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করেছে ড্রাইভার। পিছনে পড়ে রইল এক মুক্তমনা মানুষের বিদেহী আত্মার প্রতীক্ষায় রাখা তেরটি পিণ্ড, পারলৌকিক ক্রিয়ার কিছু অবসম্ভাবি অবশেষ, শান্ত গঙ্গা, পলিমাটির গন্ধ আর আসগার আলি।
বুক ভরে টেনে নিলাম পলিমাটির গন্ধ। আআহহ। এইতো ভারতবর্ষ, আমার ভারতবর্ষ।
।। সংগৃহীত ।।
” কাজ করবেন তো?”
” হ্যাঁ। বাবার ঘাটকাজ।“
” পুরুত ঠিক করা আছে? না থাকলে কোন চিন্তা নেই, আমি আছি।“
” আপনি পুরুতমশাই?”
” আজ্ঞে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি”
” না। আমাদের পুরোহিত মশাই ঠিক করাই আছে। এসে পড়বেন যেকোনো সময়ে।“
” ঠিক আছে স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন। আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব।“
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম আমি। লোকটি বেশ করিতকর্মা। প্রথমে গঙ্গা থেকে এক বালতি জল তুলে নিয়ে এলেন। অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হল তার জন্য, কারন তখন ভাটার টান চলছে। গঙ্গা সরে গিয়েছে অনেকটা দুরে। তারপর নিয়ে এলেন কেজিখানেক গঙ্গামাটি। অত্যন্ত যত্ন করে একটা চৌকো বেদী মত বানালেন, যার উপর কাজ হবে। কোসা-কুসি নিয়ে গিয়েছিলাম আমরাই। আমাদের অনুমতি নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে আনলেন সেগুলো।
ইতিমধ্যে পুরোহিত এসে পড়েছেন। হেসে বললেন, “ বাহহ। খাসা ব্যবস্থা”।
হাসিমুখে নমস্কার করে একপাশে সরে দাঁড়ালেন সেই ভদ্রলোক, “আপনারা কাজ করুন, আমি আছি।“
হাতে কুশের আঙটি পরে নিলাম। কাজ শুরু হল। ঝাপসা ঝাপসা লাগছিল মাঝে মাঝে। চোখের পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়, ডাক্তার দেখাতে হবে।
পূজাপাঠ চলল ঘন্টাখানেক, তারপর বাবাকে স্মরণ করে প্রার্থনা, অতঃপর পিণ্ডগুলো সাজিয়ে দিলাম একটার পর একটা। রোদের তেজ বাড়ছে।
“নিন, এবার কাছা ছেড়ে, স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে নিন।” বললেন পুরোহিত।
এইবার এগিয়ে এলেন সেই লোকটি, আবার।
“ভাটার সময়ে স্নান করতে পারবেন?”
“না পারলে উপায়?” আমার মামা প্রশ্ন করলেন।
ঠিক যে উত্তরটা আশা করেছিলাম, সেটাই এল, “আমি আছি তো।”
“অনুমতি করলে আমি দুই বালতি গঙ্গাজল তুলে এনে দেব, স্নান করবেন তাতেই। ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন। সর্বভুতেষু সংস্থিতা।“
শেষ অংশটা আশা করিনি। যাইহোক। ঠিক হল আমি একটু গভীরে গিয়ে হাল্কা ডুব দিয়ে আসব, আর তারপর ওনার তুলে দেওয়া গঙ্গাজলে স্নান করে নেব ভাল করে।
ডুব দেওয়ার জন্য আমি যেখানে গেলাম, তার থেকে আরও দুশো মিটার গভীরে গিয়ে জল তুলে আনলেন উনি। ক্লেদমুক্ত, পরিস্কার জল।
ডাঙ্গায় উঠে এলাম। আমার পায়ে লেগে থাকা পলিমাটি ধুয়ে দিলেন জল ঢেলে। অতঃপর, দু বালতি গঙ্গাজলে জলে বেশ করে স্নান সারলাম।
ভেজা ন্যাড়া মাথায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। ফেরার সময় হয়েছে। সেই ভদ্রলোকটিকে কাছে ডাকলাম। টাকার ব্যাগ মামার কাছে। দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম, “অনেক উপকার করেছেন, রাখুন এটা।“
” ধন্যবাদ স্যার। আমি এখানেই থাকি। যেকোনো কাজ - পুজা পাব্বনে আমাকে পাবেন।“ নমস্কার করেন আবার।
“ কি নাম আপনার?”
এইবার একটু কুঁকড়ে গেলেন মনে হল, “নাম থাক না বাবু। আমাকে সবাই কাকা বলেই চেনে।“
অবাক হলাম, “ নাম বলতে আপত্তি কিসের ?” মুচকি হেসে বললাম।
এইবার আমার একদম কাছে সরে এলেন উনি। আমার হাতটা ধরলেন। কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, “আমার নাম আসগার। আসগার আলি।“ হাতটা আলগা না করেই বললেন, “কাউকে বলার দরকার নেই বাবু। আপনি জানলেন, ব্যস। চিন্তা করবেন না বাবু, আমি গীতা, কথামৃত সবই পড়েছি। নিরামিষ খাই। জন্ম '. ঘরে হয়েছে, এই যা। আপনার কোনো পাপ লাগেনি বাবু। নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।“
ফেরার সময় হয়েছে। পিণ্ডের দিকে পিছু ফিরে তাকাতে নেই, তবু, চোখ চলেই গেল। কাকেদের ভিড়। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করেছে ড্রাইভার। পিছনে পড়ে রইল এক মুক্তমনা মানুষের বিদেহী আত্মার প্রতীক্ষায় রাখা তেরটি পিণ্ড, পারলৌকিক ক্রিয়ার কিছু অবসম্ভাবি অবশেষ, শান্ত গঙ্গা, পলিমাটির গন্ধ আর আসগার আলি।
বুক ভরে টেনে নিলাম পলিমাটির গন্ধ। আআহহ। এইতো ভারতবর্ষ, আমার ভারতবর্ষ।
।। সংগৃহীত ।।