Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
[Image: Polish-20230116-213556403.jpg]

(১৮)

আগের দিন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্তর সামনে ওই কথাগুলো বলার পর, গোগোলকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি। "দয়া করে ওকে নিয়ে যাবেন না স্যার, ওকে অ্যারেস্ট করবেন না .." অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বারবার সুজাতার অনুরোধেও কোনো লাভ হয়নি। একসময় কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছিল গোগোলের মামণি। হিয়া একবারের জন্যও কোনো কথা বলেনি, একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু তার লাটসাহেবকে নিয়ে যাওয়ার সময় অস্ফুটে বলে উঠেছিলো "আমি একটা কথাও বিশ্বাস করি না .. যে একটা মাছি মারতে পারে না, সে নাকি .."

পুলিশ স্টেশনে ডেকে না পাঠিয়ে ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত সবাইকে বিকেলের পর মিউনিসিপাল হসপিটালের ভিআইপি ওয়ার্ডের তিন নম্বর কেবিনে আসতে বলায় কিছুটা অবাক হয়েছিলো সকলে। বিকেলের দিকে আর চেম্বারে যাননি ডাক্তার দাসগুপ্ত। সুজাতারও আজ মর্নিং-শিফট ছিলো .. দু'জনে একসঙ্গেই হসপিটালে এলেন ভারাক্রান্ত মনে। গোগোলের চার বন্ধুকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিলো। সুবীর, কাঞ্চন, মধু, আর কালু .. একে একে চারজনে উপস্থিত হলো।

সাড়ে চারটে নাগাদ এলো হিয়া এবং তার মা কাবেরী দেবী। আগের দিনের গোগোলের ওই উক্তিতে পৃথিবীটাই পাল্টে গেছে হিয়ার কাছে। যখন অজানা আশঙ্কা মননকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে, তখন মনুষ্যজাতির বুদ্ধিমত্তা গ্রাস করে দুশ্চিন্তা। তার হৃদয় উদয়স্থ মুক্তি পেতে চাইলেও, বন্দী অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়। আবির্ভূত কষ্টগুলো বাতাসে পথের ধুলো উড়িয়ে যত্ন করে সাজানো বাগান এলোমেলো করে দেয়। তখন ছন্নছাড়া গম্ভীরতা, বুঝতে চায়না প্রাণের ব্যথা। জীবনের হিসেব-নিকেশ শেষ না হতেই নতুন পাতায় আবির্ভূত হয়।‌ মৌনযুদ্ধে বিপর্যস্ত, উৎকণ্ঠার অধীনস্থ মন চিন্তামুক্ত থাকতে চায়। তবু সবাই কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অপর ব্যক্তিকেও অসহিষ্ণু করে তোলে। ভাবনা বোঝে ভাবের ভাষা, কিন্তু সেই সময় আপন-পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ। সেই চিন্তাই বিভোর ঘুমে, ভাবনা নিয়ে জেগে কাটায়। আয়োজনের ঝেড়ে ফেলা, এড়িয়ে যেতে অবহেলা। ভাবনাগুলো আবার ভাবায় দুশ্চিন্তার ছলাকলা। শুধু হিয়া নয়, সুজাতা এবং ডাক্তার দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট ধরা পড়ছিলো গোগোলের চার বন্ধুর মুখেও।

প্রত্যেকেই ভিআইপি ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলো। পৌনে পাঁচটার কিছু পরে এলেন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত স্বয়ং আর তার সঙ্গে বছর বাইশের এক যুবতী এবং মধ্যবয়স্ক এক পাঞ্জাবী ব্যক্তি। "সরি, একটা কাজ সেরে আসতে একটু লেট হয়ে গেলো .. আপনারা ভেতরে আসুন .." এই বলে কেবিনের দরজা খুলে ইশারায় সবাইকে ভেতরে ডাকলেন সন্দীপ।

ইন্সপেক্টর সেনগুপ্তর সঙ্গের মেয়েটিকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদুকন্ঠে সুজাতা জিজ্ঞাসা করলো "পর্ণা?"

"ভালো আছো, পিসিমণি?" প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে, তারপর সুজাতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো পর্ণা। এমত অবস্থায় তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ডক্টর দাশগুপ্ত ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটিকে সে কি করে চিনলো! "ও আমার আপন পিসতুতো ভাইয়ের মেয়ে। তবে গোগোলের সঙ্গেও ওর কিন্তু একটা সম্পর্ক আছে। অরুন্ধতী দিদির যিনি মামিমা, তিনিই তো আমার পিসিমা .. গোগোল আর পর্ণা মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন। ওকে অনেক ছোটবেলায় দেখেছি। চেহারায় বড়সড়ো হয়ে গেলেও মুখটা একই আছে, একটুও পরিবর্তন হয়নি। তাই এক দেখাতেই চিনতে পারলাম। কিন্তু ওর তো আমাকে চেনার কথা নয়, আমার সঙ্গে ওদের যখন শেষ দেখা হয়, তখন ও খুবই ছোট।"

"তোমার ফটো দেখেছি অনেকবার আমাদের বাড়িতে, তাই একবার দেখেই চিনতে পারলাম। তাছাড়া আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলেও তোমাদের সব খবর আমরা .. মানে আমি রেখেছি। মনে মনে ভাবতাম আমাদের একদিন ঠিক দেখা হবে। গোগোল দাদার সঙ্গেও তো একদিন ওনার, মানে আলম সাহেবের অফিসে আমার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু, আমি .." এটুকু বলেই থেমে গেলো পর্ণা।

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সুজাতা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু কেবিনের ভেতর ঢুকে বিছানার উপর গোগোলকে বসে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো "তুই আগের দিন সব মিথ্যে বলেছিলিস তাই না? কেউ মনে হয় তোকে ভয় দেখিয়ে এসব বলতে বাধ্য করেছে, তাই তো? বল না এগুলো সব মিথ্যে .. চুপ করে আছিস কেনো? প্লিজ, কিছু তো বল!"

নিঃশ্চুপ গোগোল তার মামণির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দেওয়া ছাড়া একটা কথাও বললো না বা হয়তো বলতে পারলো না।

"আমি আন্দাজ করতে পারছি ইন্সপেক্টর স্যার আমাদের এখানে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। উনার হয়তো তোমাকে ইন্টারোগেশন করা হয়ে গিয়েছে। তাই হয়তো উনি আমাদের সবার সামনে তোমার কি পানিশমেন্ট হবে সেটাই জানিয়ে দেওয়ার জন্য ডেকেছেন। এত জেরার পর তুমি সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়েছো, তাই হয়তো তোমাকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। কাজগুলো করার আগে এর পরিণতির কথা তোমার একবার ভাবা উচিৎ ছিল অনির্বাণ। তবে, কথায় বলে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। তুমি যতই নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা করো, শেষে তো প্রমাণ হয়েই গেলো তুমি একজন নৃশংস খুনি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার মেয়ের জীবনটা যে শেষ মুহূর্তে বেঁচে গেলো, এটা ভেবেই আমি সব থেকে খুশি হয়েছি।" নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গোগোলের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

"চুপ করো মা, চুপ করো .. প্লিজ তুমি এইসব কথা আর বলো না। বাড়িতে সারাক্ষণ ধরে বলে চলেছো, আবার এখানে এসেও শুরু করলে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না মা। তুমি কি মনে করেছো, এই সমস্ত কথা বলে তুমি আমার মন ভেঙে দেবে? স্বয়ং ভগবান এসে বললেও আমি লাটসাহেবের বলা একটা কথাও বিশ্বাস করবো না। কি হবে? ওর শাস্তি হবে তো? হোক .. আমি অপেক্ষা করবো ওর ফিরে আসা পর্যন্ত।" চিৎকার করে উঠলো হিয়া।

"প্লিজ আপনারা সবাই একটু শান্ত হয়ে বসুন। না একটু ভুল বললাম, এইটুকু কেবিনে তো সবার বসার জায়গা করে দিতে পারবো না। তাই তোমরা চার যুবক দাঁড়িয়ে থাকো.." তারপর তার সঙ্গে আসা মাঝবয়সী পাঞ্জাবী লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন "ধনঙ্গী ভাই .. আপনিও দাঁড়িয়ে থাকুন, আমিও দাঁড়াচ্ছি আর বাকিরা বসুক। এটা একটা হসপিটাল আর আমার ধারণা আমি আপনাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। তাই আমার কথাগুলো শান্ত হয়ে মন দিয়ে শুনুন। আপনি যে এতক্ষন আপনার আন্দাজের উপর একটা বিশাল ভাষণ দিয়ে গেলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে কয়েকটা কথা বলি কাবেরী দেবী .. অনির্বাণ তো নিজের মুখেই সব স্বীকার করেছে, তাহলে আবার ও নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার চেষ্টা করলো কখন? আর ওস্তাদই বা শেষ রাতে ওকে মেরে গেলো কি করে? নাহ্ , ও একবারের জন্যও অসুস্থ বোধ করেনি। আমি বরং মেডিকেল টিমকে দিয়ে একটা সার্টিফিকেট বের করে ওকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। আর আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি .. কাউকে পানিশমেন্ট বা সাজা পুলিশ দেয় না বা দিতে পারে না। আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়। তবে হ্যাঁ, একটা কথা কবেরী দেবী ঠিক বলেছেন .. ইন্টারোগেশন। যেটা কিছুটা আগে হয়েছে অন্যদের সঙ্গে, বাকিটা হবে এখন, এখানে।" খুব স্বাভাবিকভাবে অথচ দৃঢ়কন্ঠে কথাগুলো বললেন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত।

★★★★

কিছুক্ষণ মৌন থেকে সবাইকে পাশ কাটিয়ে গোগোলের বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত পুনরায় বলতে শুরু করলেন "মিস্টার আলমের জ্ঞান ফেরার পর তার সাক্ষ্য আমার নেওয়া হয়ে গিয়েছে। যেখানে কামরাজ আর মানিক সামন্ত খুন হয়, অর্থাৎ আলম সাহেবের বাড়িতে উনার সঙ্গে সে রাতে যে উপস্থিত ছিলো, সেই পর্ণা বর্তমানে আমাদের সঙ্গে এই ঘরে রয়েছে। মেয়েটি কেন আলম সাহেবের সঙ্গে অত রাতে উনার বাড়িতে ছিলো, কি করছিলো .. এইসব প্রশ্নবাণে দয়া করে এই মুহূর্তে আপনারা কেউ ওকে বিব্রত করবেন না। যা কথা বলার, যা জিজ্ঞাসা করার পরে করবেন। এবার আমি অনির্বাণ বাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো।"

"আমি তো যা বলার বলে দিয়েছি আগেই। নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই, নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছাও নেই।" গম্ভীরভাবে জানিয়ে দিলো গোগোল।

- "আপনার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর এখন আর কিছু নির্ভর করছে না অনির্বাণ। পুলিশ আপনাকে যতবার ইন্টারোগেট করতে চাইবে, আপনাকে ততবার সহযোগিতা করতে হবে তাদের সঙ্গে। তাছাড়া এখানে ডিফেন্ড করার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? আপনার প্রত্যেকটি কথা জবানবন্দী হিসেবে রেকর্ড হবে বা হচ্ছে। এটাই তো আমরা কোর্টে প্রডিউস করবো আপনার বিরুদ্ধে।

- "ঠিক আছে, বলুন .."

- "তা আপনি কবে, কখন এবং কিভাবে গুরুকুল বিদ্যামন্দিরের হেডমাস্টারকে প্রাক্তন বানিয়েছিলেন, আই মিন তাকে হত্যা করেছিলেন .. মনে আছে?"

ইন্সপেক্টর সেনগুপ্তর প্রশ্ন শুনেই চোখ দুটো জ্বলে উঠলো গোগোলের। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলতে শুরু করলো "হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেনো? স্পষ্ট মনে আছে।  আমাদের কলেজে মানে ওই গুরুকুল বিদ্যামন্দিরে বরাবর চব্বিশে এপ্রিল থেকে গরমের ছুটি পড়ে। দিনটা ছিলো তার আগের দিন, অর্থাৎ তেইশে এপ্রিল। আমি লুকিয়ে ছিলাম কলেজ বিল্ডিংয়ের পেছনের জঙ্গলটায়। অপেক্ষা করছিলাম কলেজ ছুটি হওয়ার মুহূর্তের জন্য। একসময় কলেজ ছুটি হওয়ার ঘন্টা বাজলো .. তারপর .."

"তারপর কি অনির্বাণ? বলুন .." ফিসফিস করে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত।

"তারপর .. তারপর .. আমি কিছু মনে করতে পারছি না কেনো .. সবটা কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে .. যাইহোক আমি কি করে খুন করেছি, কিভাবে খুন করেছি .. সেটা তো বড় কথা নয়। আমি যখন স্বীকার করছি যে আমি নিশীথ বটব্যালকে হত্যা করেছি, সেটাই আসল কথা এবং এর জন্য আমার কোনোরকম অনুতাপ নেই। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?" কথাগুলো বলার সময় কিরকম যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো গোগোল। জোর করে কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছিলো, অথচ বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো সে।

"সে কি .. লাটসাহেব অফ প্রিন্সেস হিয়া? মাত্র বছর দুই আগের, তাও আবার আপনার জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা আপনি ভুলে গেলেন? মুখে বলছেন আপনি খুন করেছেন, অথচ সেদিনকার ঘটনার কিছুই মনে করতে পারছেন না .. সেটা কি করে সম্ভব? যাইহোক ওসব কথা বাদ দিন, আমরা এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি। আপনার বন্ধু কাঞ্চন বলছিলো আপনি নাকি ক্লাস এইটে অঙ্কে একশোয় নিরানব্বই পেয়েছিলেন?" গলার স্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক করে, মুখে কিছুটা হাসি এনে জিজ্ঞাসা করলেন ইন্সপেক্টর সন্দীপ।

"ধুর, কাঞ্চন একটা ইডিয়েট .. সব ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে আপনাকে। ওটা মোটেও ক্লাস এইট নয়, ক্লাস সেভেন .. আর আমি অঙ্কে ৯৯ নয়, পুরোপুরি ১০০ পেয়েছিলাম .." অবজ্ঞার সুরে বললো গোগোল।

"ব্রাভো ব্রাভো .. আপনি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। আমি তো মশাই কোনোদিন অঙ্কে ষাটের উপরেই তুলতে পারলাম না। তবে, এখন মনে পড়লো, আপনি যা বললেন আপনার বন্ধুটিও সেই কথাই বলেছিলো। ওই তো এখানে দাঁড়িয়ে আছে, জিজ্ঞাসা করে নিন। আমিই বলার সময় ঘুরিয়ে না মানে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। যাইহোক, শুনে ভালো লাগলো অত বছর আগের কথা আপনার মনে আছে অথচ এই দু'বছরের কথা আপনি ভুলে গেলেন!" গোগোলের কাঁধে হাত রেখে গলার স্বর আরোও কিছুটা নামিয়ে উক্তি করলেন ইন্সপেক্টর সন্দীপ।

"কিন্তু .. কিন্তু আমি দেখেছি .. ওই যে আয়নাতে দেখলাম ওই জানোয়ারটার মুখ .. তারপরই তো .." এইটুকু বলে দু'হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো গোগোল।

- "দেখেছেন? কি দেখেছেন? কার মুখ দেখেছেন আয়নাতে? কবে নাগাদ দেখেছেন একটু মনে করে বলতে পারবেন আমাকে? প্লিজ একটু মনে করার চেষ্টা করুন অনির্বাণ।"

- "ওই যে ওই যে .. মামণির বোধহয় সেদিন নাইট শিফট ছিলো .. আমি তো ঘুমিয়েছিলাম .. আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো .. তারপর .. তারপর আর কিছু মনে নেই। হ্যাঁ, মনে পড়েছে .. আমাদের ঘরের ওই বড় আয়নাতেই তো আমি দেখলাম নিশীথ বটব্যালের ওই ভয়ঙ্কর মুখটা। তখনই তো সব জলের মতো মনে পড়ে গেল আমার। তারিখটা .. তারিখটা .. হ্যাঁ মনে পড়েছে .. ২রা সেপ্টেম্বর। এইবার বিশ্বাস করলেন তো যে খুনটা আমিই করেছি?"

"সুজাতা দেবী .. আপনি কিছু মনে করতে পারছেন? হসপিটালের রেজিস্টার খাতাটা একবার দেখলে অবশ্য এখনই বোঝা যাবে অনির্বাণ ঠিক কথা বলছে কিনা। যদিও অতদিন আগেকার কথা আপনার মনে থাকার কথা নয়, তবুও জিজ্ঞাসা করছি .. আপনার কি সত্যিই ওই দিন নাইট শিফট ছিলো আর আপনি পরের দিন যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন কি অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?" সুজাতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ইনস্পেক্টর সেনগুপ্ত।

"অফিসিয়াল প্রমাণের জন্য আপনারা নিশ্চয়ই রেজিস্টার খাতা সংগ্রহ করবেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বলবো আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনকার কথা।  ডক্টর দাশগুপ্ত মানে আমার হাজব্যান্ড তখন এই হসপিটালেই পোষ্টেড ছিলেন। ওনারও হয়তো মনে থাকবে .. একটা ক্রিটিক্যাল কেস এসে যাওয়াতে অনেকদিন পর হঠাৎ নাইট ডিউটি পড়েছিলো আমার। আমি অনেক সকালে ফিরতাম, তখন কলিংবেল টিপলে গোগোলের ডিস্টার্ব হবে, তাই নাইট ডিউটি থাকলে চিরকালই আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যেতাম। ভোরবেলা ফিরে এসে দেখি ওর ঘরের অ্যাটাচ বাথরুমের দরজার সামনে ঠিক বড় আয়নাটার পাশে মাটিতে শুয়ে আছে গোগোল। প্রথমে তো এই দৃশ্যটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। তারপর ভাবলাম আবার নিশ্চয়ই ও দুঃস্বপ্ন দেখেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ডেকে উঠে বললাম .. তুই মাটিতে শুয়ে আছিস কেন? সারারাত কি এখানে এইভাবে শুয়েছিলিস? হায় ভগবান, এত বড় হয়েছে, অথচ এই ছেলেকে নিয়ে আমি কি করবো! এতদিন পর নাইট শিফটে গেলাম আর ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখতে হলো আমাকে? একটা দিনের জন্যেও কি তুই আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না? ওঠ বলছি ওখান থেকে। যা, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পর। আমার চিৎকারে ঘুম ভেঙেছিলো সেদিন গোগোলের।" হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বললো সুজাতা।

"আবার নিশ্চয়ই ও দুঃস্বপ্ন দেখেছে .. এই কথার মানে ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম। মানে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে ওই ঘটনার আগেও কি অনির্বাণ অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলো? বিষয়টা যদি একটু খুলে বলেন!" সুজাতার উদ্দেশ্যে জানতে চাইলেন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত।

- "ওই ঘটনার আগে অনেকবার দুঃস্বপ্ন দেখেছে আমার গোগোল, হ্যাঁ ওই ঘটনার পরেও দেখেছে .. তবে মাত্র একবার। আমি বুঝতে পারতাম দুঃস্বপ্নের রাতগুলো ওর কাছে সাংঘাতিক বিভীষিকাময় হয়ে উঠতো। আমাকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইতো না ও সেই সময়। কত যে নাইট শিফট ক্যান্সেল করেছি ওর জন্য তা গুনে শেষ করা যাবেনা। আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতো। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে ও বড় হলো, তখন লজ্জায় আমাকে কিছু বলতো না। আমাকে বাড়িতে থেকে যাওয়ার কথাও বলতে পারতো না। কিন্তু আমি বুঝতাম ওর ভেতরে সাংঘাতিক একটা অস্বস্তি হচ্ছে, একটা অজানা ভয় গ্রাস করছে ওকে। আজ আপনার সামনে ইনফ্যাক্ট আপনাদের সকলের সামনে আমাকে একটা কথা বলতেই হবে। জীবনে ভাবিনি জনসমক্ষে এই কথা বলার প্রয়োজন কোনোদিন হবে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, এই কথাগুলো না বললে বোধহয় অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।  ও আগের দিন যে তিনটি হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছে। তার মধ্যে বোধহয় আমি একটা জানি। বোধহয় কেনো বলছি .. আমি অবশ্যই একটা ঘটনা জানি। আমার নিজের পিসিমা যে কিনা আবার অরুন্ধতী দিদির মামী, তিনি ওদের বাড়িতেই ছিলেন তার শেষ জীবনটা। অনেক ক্ষতি করেছেন ওদের পরিবারের, বলা ভালো যারা ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলো ওদের পরিবারটাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, তাদের মধ্যে আমার পিসিমা লতিকা দেবী একজন ছিলেন। উনার মৃত্যুর জন্য যে গোগোল দায়ী এবং এটা সে স্বপ্নের মাধ্যমে অনেকবার দেখেছে .. একথা আমাকে আগেই ও জানিয়েছিলো। কিন্তু অপরিণত মস্তিষ্কের এবং অল্প বয়সের খেয়াল .. এই ভেবে আমি কোনোদিন ওর কথার গুরুত্ব দিইনি, বরং বিষয়টাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি চিরকাল। তারপর ও ধীরে ধীরে বড় হলে, এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে আর কোনোদিন কোনো কথা হয়নি। তাছাড়া ঘটনাটা যেদিন ঘটেছিল, অর্থাৎ আমার পিসিমা যেদিন ওদের কোয়ার্টারের পাশের সিমেন্টের ওই উঁচু টাওয়ারটা থেকে পড়ে মারা যান .. সেদিন আমি স্বয়ং ওখানে উপস্থিত ছিলাম। আগের দিন রাতে ওর মা এবং পরের দিন ভোরবেলা ওর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে বৈঠকখানার ঘরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসেছিলাম আমি। তখনই প্রচন্ড জোরে একটা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ কানে আসে আমার এবং তার সঙ্গে একটা আর্তনাদ।"

এতক্ষণ ধরে কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেছিলো সুজাতার। একটু দম নিয়ে, পাশে রাখা জলের জগ থেকে কিছুটা জলপান করে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল সে "ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। গোগোলকে ডাকতে যাবো এমন সময় বাইরে থেকে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে ভয়ার্ত কণ্ঠে হাঁপাতে হাঁপাতে গোগোল বলে উঠলো .. আন্টি জানো তো, আমাদের বাড়ির পাশে যে সিমেন্টের টাওয়ারটা আছে, ওখান থেকে দিদা পড়ে গেছে। কিন্তু ওখানে দিদা কেন উঠলো বলো তো? ওখানে তো কিছুই নেই। আমি বিকেলবেলা খেলতে খেলতে ওদিকটা গেলে মা ভীষণ রাগ করতো, আমি কখনো ওখানে যাই না, দরজা হাট করে খোলা ছিলো, তাই আমি বেরিয়ে একটু সামনেটা দাঁড়িয়েছিলাম বাবা কখন ফিরবে সেটা দেখার জন্য। তখন দেখলাম দিদা উপর থেকে ঝপ করে পড়ে গেলো। না না আমি দেখিনি, মানে পড়ে যাওয়ার পর আওয়াজ শুনে ওদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম ওটা দিদা, তুমি শিগগিরি চলো .. এই কথাগুলো শোনার পর এবার আপনি বলুন স্যার ওইটুকু সময়ের মধ্যে কতটুকু একটা ছেলে কি করে অত বড় একটা মানুষকে উপর থেকে ফেলে দিয়ে আবার অত দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলতে পারে? আপনিই এর বিচার করুন।"

ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সুবীর উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললো  "এখানে অনেক সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে, খুনের ঘটনা নিয়ে কাটাছেঁড়া হচ্ছে। আমাকে মার্জনা করবেন, কিন্তু আমি না হেসে পারলাম না। দু'বছর আগে? ২৩শে এপ্রিল? আর ইউ ক্রেজি গোগোল? এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি সবকিছু? কলেজে আমাদের ফাইনাল ইয়ার, কলেজের পক্ষ থেকে আমাদের সকলকে দু'দিনের জন্য সুন্দরবন নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। ২২শে এপ্রিল সকালে আমরা রওনা হয়েছিলাম এবং ২৩শে এপ্রিল সন্ধ্যেবেলা ফিরে আসি। সরি, এখানে কাবেরী আন্টি আছেন তবুও বলছি .. দু'দিন তোকে দেখতে না পেয়ে হিয়া কিন্তু ভীষণ অভিমান করেছিলো তোর উপর। মনে আছে .. হলিডে হোমের বারান্দায় ফোনে তুই ওর অভিমান ভাঙাচ্ছিলিস আর আমরা আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনছিলাম? তারপর আমাদের পিকেবি স্যার মজা করে বলেছিলেন - এখন থেকেই 'জরু কা গুলাম' হয়ে গেলে ভায়া? মনে পড়েছে কথাগুলো? কলেজের রেকর্ডবুক চেক করলেই আপনি সব তথ্য প্রমাণ পেয়ে যাবেন ইন্সপেক্টর সাহেব। এরপর ২৩ তারিখ সন্ধ্যেবেলা ফিরে এসে তুই কোন চুলোয় গেছিলিস, সেটা অবশ্য আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমাদের তো ফিরতে ফিরতে অনেকটা সন্দেহ হয়ে গিয়েছিলো, তখন তো কলেজ ছুটি হয়ে যাওয়ার কথা.."

"নিজের বাড়ি যাওয়ার আগে সন্ধ্যেবেলা ও প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছিলো .. আমাকে একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। সেদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো। পুরোটা মনে আছে আমার।" সুবীরের কথাগুলো শেষ হতেই বলে উঠলো হিয়া।
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 06-02-2023, 09:01 PM



Users browsing this thread: 46 Guest(s)