30-01-2023, 09:03 PM
(১৭)
হৃদপিন্ডের কাছে আর্তনাদ করা করুণ সানাই সঙ্কীর্ণ ব্যাসের শৈল্পিক কূপে ডুবে মরা শব্দহীন হয়ে যন্ত্রণার ভায়োলিন মানুষের সহ্য শক্তিকে আরো কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলে। তবুও অপারগতার গ্লানির কালো বলপয়েন্ট দিয়ে সে তার মনের গভীরে এঁকে চলে সোনালী ধানের ক্ষেত। তার কারণ, মানুষ সর্বদা বাঁচে কিছুটা কল্পনায়, কিছুটা আশায়। যে ফুল এখনো ফোটেনি, সে তারও গন্ধ পায়। একান্ত মনের গভীর থেকে চাওয়া সেই কল্পনা এবং আশা কখনো কখনো কিছুটা হলেও বাস্তবের রূপ নেয়। জ্ঞান ফেরার পর সে বিপদমুক্ত নয় বলে তাকে আইসিইউ থেকে সেই সময় সরানো হয়নি। তবে বর্তমানে টগরের জন্য একটি স্পেশাল কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে তার জন্য সর্বদা একজন সিস্টার নিযুক্ত রয়েছে। এই সবকিছুই হয়েছে ডক্টর বসাকের নির্দেশে। সিনিয়র মেট্রন ভারতী দেবী তার সহকর্মীদের বলছিলেন "কম দিন তো দেখছি না ডাক্তার বাবুকে! আদ্যোপান্ত প্রফেশনাল এবং কঠিন হৃদয়ের ডক্টর বসাক, যিনি কোনোদিন কোনো পেশেন্টকে নিজের কাজের বাইরে এক ফোঁটাও গুরুত্ব দেননি, সেই ব্যক্তি এই মেয়েটিকে যে কি চোখে দেখেছে .. ভগবান জানে।"
"ডাক্তারবাবু .. আমি কি একটু টগরের সঙ্গে দেখা করতে পারি?" রাউন্ড দিয়ে ফেরার পথে ডক্টর বসাককে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো হিয়া। "এখন? ঠিক আছে যান, তবে খেয়াল রাখবেন ওর যেন কোনোরকম মানসিক উত্তেজনা না হয়!" জানিয়ে দিলেন ডক্টর বসাক।
"কি রে? কেমন আছিস? আগের থেকে একটু বেটার ফিল করছিস তো? শুনলাম জ্ঞান আসার পর তোর গোগোল দাদাকে দেখতে চেয়েছিস। কই আমাকে একবারও ডাকলি না তো?" কেবিনে ঢুকে বিছানায় শুয়ে থাকা টগরের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো হিয়া।
"ও .. তুমি এসেছো হিয়া দিদি? শুধু গোগোল দাদাকে নয়তো, আমার বোন শিউলিকেও তো দেখতে চেয়েছিলাম। আসলে এখানে যখন আমাকে আনা হয়, তখন তো আমার সেন্স ছিলো না! জ্ঞান আসার পর জানতে পারি গোগোল দাদা আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। সঙ্গে আমার বাবা আর শিউলিও এসেছে। কিন্তু নার্স দিদির কাছ থেকে জানতে পারলাম বাবা বাড়িতে ফিরে গেছে। তাই শুধু গোগোল দাদা আর শিউলিকে দেখতে চেয়েছিলাম। তুমি যে এসেছো, সেটা তো আমি জানতাম না হিয়া দিদি।" অতি কষ্টে নিজের চোখ দুটো খুলে উত্তর দিলো টগর।
"শুধু আমি নয় অনেকেই এসেছে। তোর বাবা থেকে শুরু করে ডাক্তার আঙ্কেল, তোর সুজাতা মাসি থেকে শুরু করে আমার মা .. সবাই এসেছে। দেখা করবি নাকি ওদের সঙ্গে?" জানতে চাইলো হিয়া।
"না, একদম নয়। ডক্টর বসাকের স্ট্রিক্টলি বারণ আছে এই ঘরে বেশি ভিড় বাড়ানো যাবে না। আপনি পারমিশন পেয়েছেন, দেখা করে চলে যান। সবাইকে অ্যালাও করা যাবে না এখন।" তৎক্ষণাৎ কেবিনে অপেক্ষারতা সিস্টার জানিয়ে দিলো।
"আমার সময় হলে আমি ঠিক চলে যাবো। এখন আপনি একটু বাইরে যান না প্লিজ! আমাদের কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে .. প্রয়োজন হলে আপনাকে ডেকে নেবো।" হিয়ার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর সিস্টার টগরের দিকে তাকালো। টগর তাকে চোখের ইশারায় বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললো।
"কি বললি তোর গোগোল দাদাকে?" সিস্টার কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই টগরকে জিজ্ঞাসা করলো হিয়া।
- "তুমি এত ইন্সিকিওর কেনো হিয়া দিদি?"
- "মানে?"
- "মানে, আমি ওকে যাই বলি না কেনো, তাতে তোমার কোনো ভয় নেই। গোগোল দাদা তোমারই থাকবে .. ও তোমাকে অন্তর থেকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে।"
টগরের মুখে কথাগুলো শুনে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো হিয়ার। মাটির দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞাসা করলো "আর তুই? তুই ওকে ভালবাসিস না?"
"ভালোবাসা! সে তো জন্মেছে মনে, বসত করেও মনে। ভালোবাসার অলিখিত কাব্য কথা বলে যায় চরণে। আমার সকাল, বিকেল, এমনকি রাত্রিও সঁপে দিয়েছি তাকে। তবে শুধুই অন্তরে, এর কোনো বাহ্যিক প্রকাশ নেই। সব আলসেমি ফেলে তাকে দেখতে ছুটে যাই রেলপাড়ের পশ্চিমের ধুধু প্রান্তরের সেই উঁচু দিগন্ত থেকে আরো উঁচুতে। একাকী হয়েও একা নই তো আমি .. সে থাকে তো আমার অনুভবে সর্বদা। প্রহর গুনি আবার কবে দেখা হবে তার সঙ্গে এই ভেবে। বৃষ্টি তো আমার কাছে শুধু বৃষ্টি নয়, সে যে ভালোবাসার জলছবি। তাকে ভালোবেসে আমার মতো একজন মূর্খেরও কবিত্ব প্রকাশ পায়। এখানে সেখানে যেখানেই যাই খুঁজি তার ছায়া সারাক্ষণ। না পেয়ে হতাশ হই, কিছুটা দুঃখী, মনে মনে আলপনা আঁকি। তাকে নিয়ে বিলাসী মনে স্বপ্নের জাল বোনা,শত কাজের মাঝেও হঠাৎ করেই হয়ে যাই আনমনা। কখনো আবার অভিমান মেঘের সমান ভালোবাসার রঙে সৃষ্টি হয়, আবার কখনো নিমেষে উধাও হয়ে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। স্মৃতির গভীরে হারাই যদি, হেসে উঠি ক্ষণে ক্ষণে। উচ্ছল আমি চঞ্চল আমি ভালোবাসা আছে তাই। তাকে নিয়েই গল্প বাকিটা জীবন, সে ছাড়া যে আর কিছুই নেই। তুমি এখন যাও হিয়া দিদি .. আমার মাথাটা কিরকম ঝিমঝিম করছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে .. আমি এবার ঘুমাবো।" কথাগুলো বলে চোখ বুঝলো টগর। তার চোখের কোণ দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো, যা হিয়ার চোখ এড়ালো না।
একটা তীক্ষ্ণ বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে মনের সমস্ত দুঃখ চোখের কোণে জল, নির্বাক মুখে! শব্দ আলাদা জুড়ে তৈরী করতে পারেনি তার মানে। তীরের ফলা হয়ে বিঁধলো হিয়ার বুকে নীরব যন্ত্রণায় মলিন শব্দ। মনের কোণে আলপনা আঁকা এক নিমেষেই সুনামির জলে ভেসে সব স্তব্ধ হয়ে গেলো। লাঙ্গল চোষে অক্ষর খুঁড়ে এনে মাটির পরতে পরতে অস্থির শব্দের ব্যাকুলতা। হিয়া দেখলো কখনো টগরের চোখে বসন্তের কোকিলের কুহু সুরের আকুলতা। আবার কখনো যন্ত্রণাগুলো মনের উঠোনে বসবাস করছে নিবিড়ে। স্নিগ্ধমায়া চোখের চাউনি রইলো অধরা চিরজীবনের তরে। ঠিকানা বিহীন সীমানা বহুদূরে আকাশ বাতাস বড়রাস্তার মোড়ে। যেখানে সুমিষ্ট গন্ধ আলতো স্পর্শ শব্দের বুনিয়াদ মনন জড়িয়ে থাকে ছুঁয়ে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো হিয়া।
★★★★
দুপুরের দিকে হসপিটালে ফিরে এলো গোগোল, সঙ্গে ইন্সপেক্টর সন্দীপ। তার লাটসাহেবকে দেখেই মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হিয়ার। দৌড়ে তার কাছে গিয়ে অভিমানের সুরে বললো "তোমার আক্কেল দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। আমি বারবার ফোন করছি, ফোন রিং হয়ে যাচ্ছে, অথচ তুমি ফোন ধরছো না। চিন্তায় চিন্তায়, পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, তারপর শিউলি এসে ফোনটা আমাকে দিলো। তুমি ওর কাছে ফোন রেখে গিয়েছিলে? ঠিক আছে ফোনটা না হয় নিয়ে যাওনি, কিন্তু কারুর একটা ফোন থেকে কল করে তো জানাবে! চিন্তা হয় না আমার?"
এর উত্তরে গোগোল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে কাবেরী দেবী বলে উঠলেন "পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে গেলে সঙ্গে করে ফোন নিয়ে যেতে দেয় নাকি .. এটাও জানিস না? তাছাড়া এখনই এত কথা বলার দরকার নেই। আগে শুনি ওখানে কি হলো, গোগোল কোথায় ছিলো কাল সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত .. তারপর যা বলার বলবো।"
"এ যে দেখছি পুরো 'ফুটো ঝিনুক' কেস .." হঠাৎ করেই এইরূপ উক্তি করলেন ইন্সপেক্টর সন্দীপ।
"মানে?" জানতে চাইলেন কাবেরী দেবী।
"আসলে আমাদের গ্রামে একজন দাই'মা ছিলেন। দাই'মা বোঝেন তো? উনার বয়সের কোনো হিসেব ছিলো না, তবে ছোট থেকে বড় আমরা সবাই উনাকে সুরভী দি বলে ডাকতাম। কেউ যদি কারণে অকারণে কর্কশ ভাবে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সিচুয়েশনটাকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো, তাহলে সুরভী দি সেখানে উপস্থিত থাকলে বলতেন 'জন্মানোর সময় মা যখন মুখে ঝিনুক করে মধু ঢালছিলো, তখন মনে হয় ঝিনুকটা ফুটো ছিল, মুখে মধু পড়েনি। তাই মুখ খুললেই শুধু বিষ ঝরে।' আর আমরা সবাই হাসতাম, হাহাহাহা .." কথাগুলো বলেই উচ্চহাসিতে ফেটে পড়লো সন্দীপ।
"কথাগুলো কি আপনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন?" মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কাবেরী দেবী।
"না না, তা কেনো .. আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। আমি কারোর উদ্দেশ্যেই কিছু বলিনি। তবে কি জানেন তো .. পড়লো কথা হাটের মাঝে, যার কথা তার কানে বাজে। যাইহোক, ফর ইউর ইনফরমেশন পুলিশ অনির্বাণ বাবুকে থানায় ধরে নিয়ে যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিল মাত্র। জিজ্ঞাসাবাদ আর গ্রেফতার এই দুটো এক নয় .. এইটুকু জ্ঞান বোধহয় আপনাদের সকলেরই আছে। এটা তো গেলো অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট .. অর্থাৎ, আমি তখন সবার সামনে যেটা বলেছিলাম, এখন সেটা ক্লারিফাই করলাম। কিন্তু আমি তো গোগোল ওরফে অনির্বাণ বাবুকে থানায় নিয়ে যাইনি। আমরা তো গেছিলাম ও যেখানে গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ছিলো .. সেখানে। তারপর সেখানকার কাজ মিটে গেলে, রেস্টুরেন্টে গেছিলাম মধ্যাহ্নভোজ সারতে। অল্পবয়সী ছেলে .. কাল থেকে কিচ্ছু পেটে পড়েনি। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছিলো। সিচুয়েশন ভালো-খারাপ .. এগুলো তো আসবে যাবে। কিন্তু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলে লড়াই করার ক্ষমতাটাই তো চলে যাবে! ও মোটেই যেতে চাইছিল না, কিন্তু ওকে জোর করে খেতে নিয়ে গেলাম।" খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন সন্দীপ।
"ও যেখানে গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ছিলো .. মানে? ও কোথায় গিয়েছিলো কাল .. সেটা যদি অনুগ্রহ করে একটু বলেন .." এগিয়ে এসে বিনয়ের সঙ্গে বললেন ডক্টর দাশগুপ্ত।
"তাই না তাই .. নিয়ে গেলো এক কথা বলে, এখন আবার ফিরে এসে আর এক কথা বলছে! আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচি না .." কাবেরী দেবীর এই কথায় "উফ্ মা .. তুমি একটু থামবে!!" বলে তার মা'কে চুপ করতে বললো হিয়া।
"আমি তো বলতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনারা আমাকে বলার সুযোগটা দিচ্ছেন কোথায়? গতকাল ওকে রেলপাড়ের কলেজের হেডস্যার পঙ্কজ বাবু ফোন করে জানায়, কে বা কারা কলেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বাকিটা অনির্বাণের মুখ থেকে শুনেছি .. ফোনটা পেয়ে এইরকম একটা সিচুয়েশন ছেড়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায় ও। যাওয়ার আগে অবশ্য ওর যে ফ্রেন্ড-সার্কেল আছে .. সুবীর, কাঞ্চন, মধু, কালু, রনি ইত্যাদি ইত্যাদি .. তাদের সবাইকে খবর দিয়ে একজোট হয়ে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করতে বলে। ও যখন গিয়ে পৌঁছায়, তখন আগুন নিভলেও অনেকটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছিলো। বিশেষত কলেজের দোতালা, যেখানে আগুন ধরানো হয়েছিল .. সেই জায়গা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার বাকিটা আমি বলছি .. বাকিরা পালিয়ে গেলেও কলেজের পেছনের জঙ্গলটায় লুকিয়ে থাকা দুই দুষ্কৃতি ধরা পড়ে অনির্বাণের বন্ধুদের হাতে। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর তাদের জেরা করে জানা গিয়েছে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে কামরাজ। অনির্বাণের উপর রাগ থেকেই তার বানানো কনস্ট্রাকশন ধ্বংস করতেই এই নির্দেশ কামরাজ দিয়েছিলো, এ'কথা স্বীকার করেছে ওই দুই দুষ্কৃতি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি অনির্বাণকে কেনো নিয়ে গেলাম এবং নিয়ে যাওয়ার সময় ওই কথাগুলো কেনো বললাম! আগুন লাগার ব্যাপারটা এবং কে এই ঘটনাটার পেছনে রয়েছে সেটা জানলেও। অনির্বাণ যে ওখানে গিয়েছিল সেটা আমার কাছে তখনও পরিষ্কার হয়নি। সর্বোপরি কাল রাতেই যখন ওই দুই স্বনামধন্য মহাপুরুষ খুন হলেন, তখন আমার মনেও কিঞ্চিৎ সন্দেহ জেগেছিলো। না না, ওদের মৃত্যুর পেছনে অনির্বাণের হাত আছে .. এই সন্দেহ বা ধারণা কোনোটাই তৈরি হয়নি আমার। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম ও কোন সময় থেকে কোন সময় কলেজে ছিলো এবং কখন ওখান থেকে বেরিয়েছে এবং কোন সময় হসপিটালে এসে পৌঁছেছে .. এই ডিউরেশনটা। বুঝতেই পারছেন .. পুলিশ তো প্রমাণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না। আজ সকালে অনির্বাণকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার পর হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলে, ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে, বলা ভালো পুলিশের কাছে। ও ওখানে কতক্ষণ ছিলো এবং ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা হসপিটালে চলে এসেছে এর প্রচুর সাক্ষী রয়েছে। আর বাকিটা প্রমাণ করেছে হসপিটালের সিসিটিভির টাইমিং।" নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন ইন্সপেক্টর সন্দীপ।
"আমি জানি তো আমার সোনা মানিক, আমার গোগোল কোনো অন্যায় করতেই পারে না। তবে আজ আমি একটা কথা বলবো ইন্সপেক্টর সাহেব। এই যে দুই অমানুষের নাম আপনি করলেন .. কামরাজ আর বিধায়ক মানিক সামন্ত। এদের মৃত্যুতে গোগোলের মনে কি প্রভাব পড়েছে তা আমি জানিনা, তবে আমার মতো খুশি বোধহয় আর কেউ হয়নি, আমার মতো শান্তি বোধহয় আর কেউ পায়নি। এই দুই নরপিশাচকে আমি বহুদিন ধরে চিনি .. আমার গঙ্গানগরে আসার প্রথম দিন থেকেই। এখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমি আজ গঙ্গাস্নান করবো।" সুজাতার প্রত্যেকটি কথায় একটা তৃপ্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো।
"শুধু আপনি নন সুজাতা দেবী, আমিও গঙ্গাস্নান করবো .." মুচকি হেসে বললো সন্দীপ।
- "কেনো স্যার? আপনি হঠাৎ .. মানে আপনি কেনো গঙ্গাস্নান .."
- "গঙ্গানগরে রমরমিয়ে চলা নিষিদ্ধ ড্রাগ র্যাকেট আর জাল ওষুধের ব্যবসার হাই কম্যান্ডকে ধরতে আটচল্লিশ ঘণ্টার সময় দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিলো এখানে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই তো কেস সলভ করে দিলাম। তবে পুলিশ ওই দুই মহাপুরুষকে ধরলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম ওরা নিজেদের পাওয়ার খাটিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসতো। সে ক্ষেত্রে লাভের উপর লাভ .. ওদের গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়ে গেলো। তাহলে ভেবে দেখুন, ইনভেস্টিগেশন অফিসার হিসেবে আমার গঙ্গাস্নান না করলে হয়? তবে লালু আলম আর মিস পর্ণার বয়ান নেওয়ার পর আমি স্নানটা সেরে ফেলবো, তার আগে নয়। কি বলেন অনির্বাণ বাবু?"
★★★★
"ডাক্তার কাকু তুমি এসেছো? ক'টা বাজে গো? সন্ধ্যে হয়ে গেছে নাকি? চারিদিকে এত অন্ধকার কেনো? নার্স দিদিকে আলোটা জ্বালাতে বলো না!" ডক্টর বসাকের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে খুব মৃদুস্বরে কথাগুলো বললো টগর।
"না মা .. এখনতো দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল হলো। ঘরে আলো জ্বলছে তো .. তুই বুঝতে পারছিস না কিছু?" টগরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন ডক্টর বসাক।
- "তাহলে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেনো? না মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি .. আবার পরক্ষণেই সবকিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে .. মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে .. ওই বুঝি ডাক এলো আমার .. তাই না গো ডাক্তার কাকু?"
- "ছিঃ মা .. এসব কথা বলতে নেই। একজন বাবার সামনে তার কন্যাসম কেউ যদি এই কথা বলে, তাহলে তার বাবার কাছে তা কতটা বেদনাদায়ক, কতটা কষ্টকর সেটা আমি কি করে বোঝাবো তোকে! নিজেকে মাঝে মাঝে ভীষণ অসহায় মনে হয় আমার .. জানিস! পাঁচ বছর আগে নিজের মেয়েটাকেও তো আমি .. কিসের বড় ডাক্তার? কিসের এত নামডাক? সব মিথ্যে .. সব সব মিথ্যে।"
"মাথার এখানটায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে ডাক্তার কাকু .. ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আমার .. গোগোল দাদা গো .. সেই যে সকালে আমার সঙ্গে দেখা করে কোথায় চলে গেলে .. আর তো এলেনা তুমি .. একবার কেউ ডাকো না ওকে .. একবার চোখের দেখা দেখবো শুধু .." চিৎকার করে উঠলো টগর। তারপরেই আবার জ্ঞান হারালো সে।
কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই নিয়ে পরপর দু'বার জ্ঞান হারালো টগর। অবস্থা ভীষণ আশঙ্কাজনক। একে একে দেখা করে গিয়েছে সবাই। স্বপনবাবু আর শিউলি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো যদি একবার টগর চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু তাদের সেই মনের আশা পূর্ণ হয়নি। অসহায়ের মতো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো স্বপনবাবু তার ছোট মেয়েকে নিয়ে। বর্তমানে শুধুমাত্র গোগোল রয়েছে টগরের সঙ্গে। সে টগরের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও যাবে না .. এ কথা জানিয়ে দিয়েছে।