27-01-2023, 06:33 PM
৫) শিবতোষঃ
এবার বিপাশা নীলের হাতে অত্যন্ত সুদর্শন ও ব্যক্তিত্বময় একজনের ছবি দেখতে পেল। নীল বললো ইনি রাজনারায়ণ বাবুর ছোটো ছেলে। অ্যাকাউন্টেসিতে মাস্টার্স করার পর স্টেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে জামশেদপুরে পোস্টেড। সেখানে অফিস থেকে একটা বিশাল বাংলো পেয়েছেন। সেই বাংলোতে তিনি স্ত্রী মোনালি ও পাঁচ বছরের ছেলে সুকান্তের সঙ্গে থাকেন । তিনিও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আসছেন।
৬) চন্দ্রিমাঃ
রাজনারায়ণ বাবুর বড় মেয়ে চন্দ্রিমা , বাড়ির লোক সংক্ষেপে চনু বলে ডাকে। নারীদের সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা নতুন করে দিতে হবে এঁর সামনে দাঁড়ালে। বিপাশা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে একজন নারীর এতরূপ হতে পারে ? কী সুন্দর শান্ত সমাহিত রূপ। এই রূপ পুরুষকে জ্বালিয়ে ছারখার করে না , বরং স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে পুরুষ হৃদয়কে শান্তি প্রদান করে। নিজের রূপের প্রতি কোনোদিনই তাঁর যত্ন নেই , তা সত্ত্বেও ছত্রিশ অতিক্রান্ত চন্দ্রিমাকে দেখলে মনে শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা দুর্গা প্রতিমা। এখনো হাসলে তাঁর দুগালে টোল পড়ে।
তাঁর বিবাহ হয়েছে কোলকাতার নামজাদা ফ্লোরিষ্ট দীপ্তেন্দুর সঙ্গে। দীপ্তেন্দুর প্রপিতামহ দর্পনারায়ণ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল নার্সারিসহ জমিদারি। দীপ্তেন্দুর খ্যাতি ও তাঁর চাষ করা ফুল ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
তাঁদের একমাত্র ছেলে রীতেশ শুধুমাত্র চন্দ্রিমার জেদের কারণে কার্শিয়াং-এর একটা কনভেন্ট কলেজে পড়ে।
৭) রূপকথাঃ
রাজনারায়ণ বাবুর মেজো মেয়ে রূপকথা। নামটা তাঁর রূপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর দেহে এত রূপ যে তাঁকে পরীদের দেশের রানী বলে মনে হয়। বছর তিরিশের এই নারী চৌধুরী ভিলার খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র। চৌধুরী বাড়িতে কুড়ি পার হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাজনারায়ণ বাবু তাঁর মেজাজী ও বাপের আহ্লাদী মেজো মেয়েকে আজ পর্যন্ত পাত্রস্থ করতে পারেন নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রূপকথা মেয়ে হিসেবে মার্জিত , পরিশীলিত, সংস্কৃতিমনা এবং আশ্চর্যজনকভাবে চৌধুরী ভিলার মতো গোঁড়া পরিবারের সদস্য হলেও ভারত নাট্যমের পাবলিক পারফরম্যান্স করে।
বিপাশা আমার মনে হয় রূপকথার জীবনে কোনো অন্ধকার দিক আছে যার জন্য সে পুরুষ জাতটাকেই বিশ্বাস করে না। তোমাকে তাঁর জীবনের সেই অজানা দিকটা উন্মোচিত করতে হবে।
বিপাশা ভাবে কাজের প্রতি নীলের কি ডেডিকেশন ! প্রতিটি চরিত্র সে সাংঘাতিকভাবে বিশ্লেষণ করে। প্রতিটি ফটো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে স্টাডি করে মানুষটির কাল্পনিক মূর্তি তৈরি করে , তার সঙ্গে কথা বলে , যতক্ষণ না তাঁর সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হচ্ছে।
৮) স্বর্ণালীঃ
মনোতোষ বাবুর স্ত্রী স্বর্ণালী চৌধুরী ভিলার সবচেয়ে ট্রাজিক চরিত্র। তাঁর মতো রূপবতী নারীকে শুধুমাত্র দুঃসহ দারিদ্র্য ও বাবার লোভের কারণেই সব জেনেশুনে এক বোবা পুরুষকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিবাহের দশ বছর পরেও সে মাতৃত্বের স্বাদ পায়নি। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেছে মনোতোষ বাবু এই পৃথিবীতে কোনো দিন কারুর বাবা হতে পারবেন না।
নীল বলে চলে - বাকরুদ্ধ স্বামী ও নিজের বন্ধ্যাত্ব - এই দুটো অভিশাপ মাথায় নেওয়া সত্ত্বেও তিনি শরতের শিউলির মতো অভিমানিনী। বিপাশা অবাক হয়ে শোনে একটা মানুষ চিত্রনাট্যের কোনো চরিত্রের সঙ্গে কতটা একাত্ম হতে পারলে তবেই এই কথাগুলো বলতে পারে। নীল তখনো বলে চলেছে - বিপাশা তোমাকে মনে রাখতে হবে চৌধুরী ভিলার গোপন চাবিকাঠিটি কিন্তু স্বর্নালীর আঁচলে বাঁধা। তোমাকে সেখানে নিশি কুটম্ব হয়ে প্রবেশ করে খুলে ফেলতে হবে চৌধুরী ভিলার রহস্যময় দ্বার। আর তাহলেই দেখবে এই ভিডিও ফ্লিমটি হিট করার মতো রসদ তুমি পেয়ে যাবে। তোমার ক্যামেরা এই চিত্রনাট্যে প্রথম স্বর্নালীর ওপরেই ফোকাস করবে।
৯) পদ্মাবতীঃ
ইনি রাজনারায়ণ বাবুর আদরের বোন। বিপাশা তুমি এঁর দেখা পাবে চৌধুরী ভিলার একতলার একটা ঘরে , মাঝ দুপুরেও ঘরে আধো অন্ধকার, সূর্য এখানে বোধহয় সলাজ এক বধূ।
এই মহিলা বা বৃদ্ধা যাই বলো না কেন তুমি , তিনি কিন্তু দু দুবার চোখের ছানি অপারেশন করেও চোখে ভালো দেখতে পান না। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তাঁর বিবাহ হয়েছিলো উত্তর কোলকাতার এক বনেদী পরিবারে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো বিবাহের পাঁচ মাসের মধ্যে এক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে বিধবা অবস্থায় ভাইয়ের সংসারে ফিরে আসেন এবং ভাইয়ের সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নেন।
নীল বলে বিপাশা এর পিছনেও কোনো রহস্যময় অতীত চাপা পড়ে আছে। তোমাকে সাবধানে খনন করে সেই ইতিহাস বের করে আনতে হবে।
নীল চিত্রনাট্যের সমস্ত চরিত্রকে বিপাশার সামনে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে বলে , বিপাশা এই ভিডিও ফ্লিমের চিত্রনাট্য তোমাকে যত্ন নিয়ে লিখতে হবে। তুমি এতোদিন জর্জ টেলিগ্রাফে যা যা শিখেছো বা বই পড়ে যা জেনেছো তার পরীক্ষা এই চিত্রনাট্যের সংলাপ লেখার মাধ্যমে হয়ে যাবে। এই ভিডিও ফ্লিম হবে তোমার সন্তানের মতো , আমি দূর থেকে দেখবো তুমি তোমার সন্তানকে কতটা যত্ন করে হেলদি করে তুলছো। আমি শুধু তোমাকে দূর থেকে গাইড করে যাব , মূল কাজটা তোমাকেই করতে হবে।
একটি সত্তর অতিক্রান্ত মানুষ এই ভিডিও ফ্লিমের মাধ্যমে তার অতীতকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন। হয়তো এই শেষবারের মতো সকলের সঙ্গে তিনি মিলিত হচ্ছেন। মৃত্যুর আগে আবার সকলকে একত্রে পাবেন কিনা ঠিক নেই। এই ভিডিও ফ্লিমটার মাধ্যমেই তিনি সকলকে বারবার ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। সুতরাং এই ভিডিও ফ্লিমটি শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয় , এটা একটা পরিবারের জীবন্ত দলিল , এর সাথে জড়িয়ে থাকবে চৌধুরী ভিলার ইতিহাস , তার ভাব-ভালোবাসা , আশা-নিরাশা , চেতন-অচেতন -- সব কিছু। তাই এই দায়িত্ব আমি ভরসা করে তোমার হাতে ছেড়েছি। আশাকরি তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে। তোমাকে এই চিত্রনাট্য লেখার জন্য তোমার দৃষ্টিকে দিগন্ত প্রসারী করতে হবে , তোমার মনের ভাবনা সিরাজের কবুতরের মতো অসীম আকাশে ভেসে বেড়িয়ে তোমার জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর খুঁজে নিয়ে আসবে। তোমার সাফল্যের চাবিকাঠি হবে তোমার মনের সংবেদনশীলতা, তুমি সংবেদনশীল হলে তবেই চৌধুরী ভিলার বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারবে , আর তাহলেই দেখবে তোমার চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গেছে।
জর্জ টেলিগ্রাফে তোমাদের ব্যাচের মধ্যে তুমিই ছিলে অত্যন্ত প্রমিসিং এবং তোমার কাজের প্রতি ছিলো অসীম ভালোবাসা, কাজটা যতক্ষণ না নিখুঁত হচ্ছে ততক্ষণ তুমি লড়ে যেতে । তোমার এই গুণগুলোই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। তাই আমি তোমাকে আমার সহকারিনী হিসেবে নির্বাচিত করেছি। তুমি নিশ্চয়ই তার মর্যাদা রাখবে। এই বলে নীল বিপাশার দুই কাঁধ ধরে কাছে টেনে ওর কপালে একটা চুমু খায়। দুজনের চোখ পরস্পরের সঙ্গে মিলে গিয়ে যেন এক সেতুবন্ধ তৈরি করেছে।
বিপাশা বোঝে নীল কতটা ভরসা করে ওকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। তাই হরিশ মুখার্জি রোডে তাদের বাড়ির দোতলার চিলেকোঠায় বসে আবেগ , মনের মাধুর্য , বাস্তবের কঠোরতা সব কিছুর মিশেলে সে পাতার পর পাতা কাটাকুটি করে সংলাপ লেখে। লেখার পর নিজেই সেটা ট্রায়াল দেয় কতটা ভালো হয়েছে দেখার জন্য, যে অংশ পছন্দ হয় না সেটা কলমের এক খোঁচায় বাতিল করে আবার লেখে। প্রথমে বিদিশার কাছে চিত্রনাট্যের চরিত্রগুলো আবছা আবছা ভাবে ধরা দিচ্ছিল। এতগুলো চরিত্র, তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা ও জীবন দর্শন, নিজস্ব উটাচন ও অন্ধকার, কারুর রিক্ততা তো কারুর উন্নাসিকতা, কেউ জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়েছে তো কেউ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে -- এসব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে সুবিশাল এক ক্যানভাসে সংলাপের মাধ্যমে প্রত্যেকটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা রীতিমতো এক চ্যালেঞ্জিং কাজ। সাত দিন ধরে লড়াই করে শব্দের নিরন্তর কাটাকুটি ও জাগলারির মাধ্যমে বিপাশা চৌধুরী ভিলার চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ করে। তারপর সুখবরটা নীলকে জানায়।
নীল তাকে বিকেলে আপাত নির্জন রবীন্দ্র সরোবরের পাড়ে চিত্রনাট্যের খাতা নিয়ে আসতে বলে। ওখানেই লেমনটি খেতে খেতে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে চিত্রনাট্যটা কাটাছেঁড়া করবে।
কথামতো রবীন্দ্র সরোবরের নির্জন এক কোণায় সিমেন্টের এক বেঞ্চে বসে বিপাশা তার চিত্রনাট্য পাঠ করতে শুরু করে। বিষন্নতার প্রতিমূর্তি স্বর্ণালীকে প্রধান চরিত্র করে বিপাশা যে চিত্রনাট্য তৈরি করেছে তা এক কথায় অনবদ্য। নীল এক ঘোরের মধ্যে হাততালি দিতে দিতে বিপাশাকে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বসে।
বিপাশা গম্ভীর কন্ঠে বলে -- "এটা কি হলো?'
নীল উত্তর দেয় -- "এটা তোমার পরিশ্রমের পুরস্কার।"
-- " তাহলে এই পুরস্কার তো ভাগ করে নিতে হয় , তোমার সাহায্য ছাড়া এটা সম্পূর্ণ করা আমার সাধ্য ছিল না।"
এই বলে বিপাশাও নীলকে ঠোঁটে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বসে। দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে।
নীল বলে -- " এই ভিডিও ফ্লিমটার নাম কি হবে?"
বিপাশা বলে -- " এই ভিডিও ফ্লিম একটা পরিবারের সদস্যদের গোপন জবানবন্দি নিয়ে। তাই আমার মতে এই ভিডিও ফ্লিমের নাম 'গোপন কথাটি রবে না গোপনে' -- এটাই হওয়া উচিৎ।"
নীল বিপাশার কলাপে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলে -- " এই জন্যই তোমাকে এত পছন্দ। তোমার চিন্তাধারা আমার সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করে। "
এরপর ঠিক হয় অনুষ্ঠানের ঠিক সাত দিন আগে থাকতেই তারা চৌধুরী ভিলায় প্রতিদিন হানা দেবে। প্রথম দিন ভোরবেলায় স্বর্নালীর ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে ভিডিও ফ্লিম তৈরির কাজটা শুরু হবে।
এবার বিপাশা নীলের হাতে অত্যন্ত সুদর্শন ও ব্যক্তিত্বময় একজনের ছবি দেখতে পেল। নীল বললো ইনি রাজনারায়ণ বাবুর ছোটো ছেলে। অ্যাকাউন্টেসিতে মাস্টার্স করার পর স্টেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে জামশেদপুরে পোস্টেড। সেখানে অফিস থেকে একটা বিশাল বাংলো পেয়েছেন। সেই বাংলোতে তিনি স্ত্রী মোনালি ও পাঁচ বছরের ছেলে সুকান্তের সঙ্গে থাকেন । তিনিও এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আসছেন।
৬) চন্দ্রিমাঃ
রাজনারায়ণ বাবুর বড় মেয়ে চন্দ্রিমা , বাড়ির লোক সংক্ষেপে চনু বলে ডাকে। নারীদের সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা নতুন করে দিতে হবে এঁর সামনে দাঁড়ালে। বিপাশা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে একজন নারীর এতরূপ হতে পারে ? কী সুন্দর শান্ত সমাহিত রূপ। এই রূপ পুরুষকে জ্বালিয়ে ছারখার করে না , বরং স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে পুরুষ হৃদয়কে শান্তি প্রদান করে। নিজের রূপের প্রতি কোনোদিনই তাঁর যত্ন নেই , তা সত্ত্বেও ছত্রিশ অতিক্রান্ত চন্দ্রিমাকে দেখলে মনে শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা দুর্গা প্রতিমা। এখনো হাসলে তাঁর দুগালে টোল পড়ে।
তাঁর বিবাহ হয়েছে কোলকাতার নামজাদা ফ্লোরিষ্ট দীপ্তেন্দুর সঙ্গে। দীপ্তেন্দুর প্রপিতামহ দর্পনারায়ণ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল নার্সারিসহ জমিদারি। দীপ্তেন্দুর খ্যাতি ও তাঁর চাষ করা ফুল ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
তাঁদের একমাত্র ছেলে রীতেশ শুধুমাত্র চন্দ্রিমার জেদের কারণে কার্শিয়াং-এর একটা কনভেন্ট কলেজে পড়ে।
৭) রূপকথাঃ
রাজনারায়ণ বাবুর মেজো মেয়ে রূপকথা। নামটা তাঁর রূপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর দেহে এত রূপ যে তাঁকে পরীদের দেশের রানী বলে মনে হয়। বছর তিরিশের এই নারী চৌধুরী ভিলার খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র। চৌধুরী বাড়িতে কুড়ি পার হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাজনারায়ণ বাবু তাঁর মেজাজী ও বাপের আহ্লাদী মেজো মেয়েকে আজ পর্যন্ত পাত্রস্থ করতে পারেন নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রূপকথা মেয়ে হিসেবে মার্জিত , পরিশীলিত, সংস্কৃতিমনা এবং আশ্চর্যজনকভাবে চৌধুরী ভিলার মতো গোঁড়া পরিবারের সদস্য হলেও ভারত নাট্যমের পাবলিক পারফরম্যান্স করে।
বিপাশা আমার মনে হয় রূপকথার জীবনে কোনো অন্ধকার দিক আছে যার জন্য সে পুরুষ জাতটাকেই বিশ্বাস করে না। তোমাকে তাঁর জীবনের সেই অজানা দিকটা উন্মোচিত করতে হবে।
বিপাশা ভাবে কাজের প্রতি নীলের কি ডেডিকেশন ! প্রতিটি চরিত্র সে সাংঘাতিকভাবে বিশ্লেষণ করে। প্রতিটি ফটো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে স্টাডি করে মানুষটির কাল্পনিক মূর্তি তৈরি করে , তার সঙ্গে কথা বলে , যতক্ষণ না তাঁর সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হচ্ছে।
৮) স্বর্ণালীঃ
মনোতোষ বাবুর স্ত্রী স্বর্ণালী চৌধুরী ভিলার সবচেয়ে ট্রাজিক চরিত্র। তাঁর মতো রূপবতী নারীকে শুধুমাত্র দুঃসহ দারিদ্র্য ও বাবার লোভের কারণেই সব জেনেশুনে এক বোবা পুরুষকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিবাহের দশ বছর পরেও সে মাতৃত্বের স্বাদ পায়নি। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেছে মনোতোষ বাবু এই পৃথিবীতে কোনো দিন কারুর বাবা হতে পারবেন না।
নীল বলে চলে - বাকরুদ্ধ স্বামী ও নিজের বন্ধ্যাত্ব - এই দুটো অভিশাপ মাথায় নেওয়া সত্ত্বেও তিনি শরতের শিউলির মতো অভিমানিনী। বিপাশা অবাক হয়ে শোনে একটা মানুষ চিত্রনাট্যের কোনো চরিত্রের সঙ্গে কতটা একাত্ম হতে পারলে তবেই এই কথাগুলো বলতে পারে। নীল তখনো বলে চলেছে - বিপাশা তোমাকে মনে রাখতে হবে চৌধুরী ভিলার গোপন চাবিকাঠিটি কিন্তু স্বর্নালীর আঁচলে বাঁধা। তোমাকে সেখানে নিশি কুটম্ব হয়ে প্রবেশ করে খুলে ফেলতে হবে চৌধুরী ভিলার রহস্যময় দ্বার। আর তাহলেই দেখবে এই ভিডিও ফ্লিমটি হিট করার মতো রসদ তুমি পেয়ে যাবে। তোমার ক্যামেরা এই চিত্রনাট্যে প্রথম স্বর্নালীর ওপরেই ফোকাস করবে।
৯) পদ্মাবতীঃ
ইনি রাজনারায়ণ বাবুর আদরের বোন। বিপাশা তুমি এঁর দেখা পাবে চৌধুরী ভিলার একতলার একটা ঘরে , মাঝ দুপুরেও ঘরে আধো অন্ধকার, সূর্য এখানে বোধহয় সলাজ এক বধূ।
এই মহিলা বা বৃদ্ধা যাই বলো না কেন তুমি , তিনি কিন্তু দু দুবার চোখের ছানি অপারেশন করেও চোখে ভালো দেখতে পান না। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তাঁর বিবাহ হয়েছিলো উত্তর কোলকাতার এক বনেদী পরিবারে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো বিবাহের পাঁচ মাসের মধ্যে এক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে বিধবা অবস্থায় ভাইয়ের সংসারে ফিরে আসেন এবং ভাইয়ের সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নেন।
নীল বলে বিপাশা এর পিছনেও কোনো রহস্যময় অতীত চাপা পড়ে আছে। তোমাকে সাবধানে খনন করে সেই ইতিহাস বের করে আনতে হবে।
নীল চিত্রনাট্যের সমস্ত চরিত্রকে বিপাশার সামনে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে বলে , বিপাশা এই ভিডিও ফ্লিমের চিত্রনাট্য তোমাকে যত্ন নিয়ে লিখতে হবে। তুমি এতোদিন জর্জ টেলিগ্রাফে যা যা শিখেছো বা বই পড়ে যা জেনেছো তার পরীক্ষা এই চিত্রনাট্যের সংলাপ লেখার মাধ্যমে হয়ে যাবে। এই ভিডিও ফ্লিম হবে তোমার সন্তানের মতো , আমি দূর থেকে দেখবো তুমি তোমার সন্তানকে কতটা যত্ন করে হেলদি করে তুলছো। আমি শুধু তোমাকে দূর থেকে গাইড করে যাব , মূল কাজটা তোমাকেই করতে হবে।
একটি সত্তর অতিক্রান্ত মানুষ এই ভিডিও ফ্লিমের মাধ্যমে তার অতীতকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন। হয়তো এই শেষবারের মতো সকলের সঙ্গে তিনি মিলিত হচ্ছেন। মৃত্যুর আগে আবার সকলকে একত্রে পাবেন কিনা ঠিক নেই। এই ভিডিও ফ্লিমটার মাধ্যমেই তিনি সকলকে বারবার ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। সুতরাং এই ভিডিও ফ্লিমটি শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয় , এটা একটা পরিবারের জীবন্ত দলিল , এর সাথে জড়িয়ে থাকবে চৌধুরী ভিলার ইতিহাস , তার ভাব-ভালোবাসা , আশা-নিরাশা , চেতন-অচেতন -- সব কিছু। তাই এই দায়িত্ব আমি ভরসা করে তোমার হাতে ছেড়েছি। আশাকরি তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে। তোমাকে এই চিত্রনাট্য লেখার জন্য তোমার দৃষ্টিকে দিগন্ত প্রসারী করতে হবে , তোমার মনের ভাবনা সিরাজের কবুতরের মতো অসীম আকাশে ভেসে বেড়িয়ে তোমার জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর খুঁজে নিয়ে আসবে। তোমার সাফল্যের চাবিকাঠি হবে তোমার মনের সংবেদনশীলতা, তুমি সংবেদনশীল হলে তবেই চৌধুরী ভিলার বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারবে , আর তাহলেই দেখবে তোমার চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গেছে।
জর্জ টেলিগ্রাফে তোমাদের ব্যাচের মধ্যে তুমিই ছিলে অত্যন্ত প্রমিসিং এবং তোমার কাজের প্রতি ছিলো অসীম ভালোবাসা, কাজটা যতক্ষণ না নিখুঁত হচ্ছে ততক্ষণ তুমি লড়ে যেতে । তোমার এই গুণগুলোই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। তাই আমি তোমাকে আমার সহকারিনী হিসেবে নির্বাচিত করেছি। তুমি নিশ্চয়ই তার মর্যাদা রাখবে। এই বলে নীল বিপাশার দুই কাঁধ ধরে কাছে টেনে ওর কপালে একটা চুমু খায়। দুজনের চোখ পরস্পরের সঙ্গে মিলে গিয়ে যেন এক সেতুবন্ধ তৈরি করেছে।
বিপাশা বোঝে নীল কতটা ভরসা করে ওকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। তাই হরিশ মুখার্জি রোডে তাদের বাড়ির দোতলার চিলেকোঠায় বসে আবেগ , মনের মাধুর্য , বাস্তবের কঠোরতা সব কিছুর মিশেলে সে পাতার পর পাতা কাটাকুটি করে সংলাপ লেখে। লেখার পর নিজেই সেটা ট্রায়াল দেয় কতটা ভালো হয়েছে দেখার জন্য, যে অংশ পছন্দ হয় না সেটা কলমের এক খোঁচায় বাতিল করে আবার লেখে। প্রথমে বিদিশার কাছে চিত্রনাট্যের চরিত্রগুলো আবছা আবছা ভাবে ধরা দিচ্ছিল। এতগুলো চরিত্র, তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা ও জীবন দর্শন, নিজস্ব উটাচন ও অন্ধকার, কারুর রিক্ততা তো কারুর উন্নাসিকতা, কেউ জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়েছে তো কেউ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে -- এসব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে সুবিশাল এক ক্যানভাসে সংলাপের মাধ্যমে প্রত্যেকটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা রীতিমতো এক চ্যালেঞ্জিং কাজ। সাত দিন ধরে লড়াই করে শব্দের নিরন্তর কাটাকুটি ও জাগলারির মাধ্যমে বিপাশা চৌধুরী ভিলার চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ করে। তারপর সুখবরটা নীলকে জানায়।
নীল তাকে বিকেলে আপাত নির্জন রবীন্দ্র সরোবরের পাড়ে চিত্রনাট্যের খাতা নিয়ে আসতে বলে। ওখানেই লেমনটি খেতে খেতে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে চিত্রনাট্যটা কাটাছেঁড়া করবে।
কথামতো রবীন্দ্র সরোবরের নির্জন এক কোণায় সিমেন্টের এক বেঞ্চে বসে বিপাশা তার চিত্রনাট্য পাঠ করতে শুরু করে। বিষন্নতার প্রতিমূর্তি স্বর্ণালীকে প্রধান চরিত্র করে বিপাশা যে চিত্রনাট্য তৈরি করেছে তা এক কথায় অনবদ্য। নীল এক ঘোরের মধ্যে হাততালি দিতে দিতে বিপাশাকে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বসে।
বিপাশা গম্ভীর কন্ঠে বলে -- "এটা কি হলো?'
নীল উত্তর দেয় -- "এটা তোমার পরিশ্রমের পুরস্কার।"
-- " তাহলে এই পুরস্কার তো ভাগ করে নিতে হয় , তোমার সাহায্য ছাড়া এটা সম্পূর্ণ করা আমার সাধ্য ছিল না।"
এই বলে বিপাশাও নীলকে ঠোঁটে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বসে। দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে।
নীল বলে -- " এই ভিডিও ফ্লিমটার নাম কি হবে?"
বিপাশা বলে -- " এই ভিডিও ফ্লিম একটা পরিবারের সদস্যদের গোপন জবানবন্দি নিয়ে। তাই আমার মতে এই ভিডিও ফ্লিমের নাম 'গোপন কথাটি রবে না গোপনে' -- এটাই হওয়া উচিৎ।"
নীল বিপাশার কলাপে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলে -- " এই জন্যই তোমাকে এত পছন্দ। তোমার চিন্তাধারা আমার সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করে। "
এরপর ঠিক হয় অনুষ্ঠানের ঠিক সাত দিন আগে থাকতেই তারা চৌধুরী ভিলায় প্রতিদিন হানা দেবে। প্রথম দিন ভোরবেলায় স্বর্নালীর ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে ভিডিও ফ্লিম তৈরির কাজটা শুরু হবে।