26-01-2023, 08:54 PM
(১৬)
ভিখারিনী হোক বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ, পাগলিনী হোক বা উচ্চশিক্ষিতা যুবতী .. দুষ্টু লোকেদের কোনো কিছুতেই অরুচি নেই। বরং যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো বয়সের নারীমাংস দেখলেই তাদের উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। হোক না সে বর্তমানে একজন মধ্যবয়স্কা পাগলী, কিন্তু ওইরকম একটা উত্তেজক শরীর নিয়ে শতচ্ছিন্ন কাপড়ে একা রাস্তায় কাটানো রূপসার পক্ষে ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিলো। অনেকবার দরবার করেও এলাকার বিধায়ক মানিক সামন্তর কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য, বলা ভালো সরকারের কাছ থেকে কোনো রকম সাহায্য না পেয়ে গোগোল এবং তার বন্ধুদের সহযোগিতায় রূপসার ঠাঁই হয়েছিলো রেলপাড়ের ক্লাবঘরের পিছনদিকের ছোট্ট ঘেরা বারান্দায়।
কিন্তু দুষ্টের তো ছলের অভাব হয় না, যারা উদয়স্থ তাকে ভোগ করার স্বপ্ন দেখে চলে। নিঃশ্বাসে কামনার বিশ্বাস মেখে কল্পনায় তার নগ্ন দেহের ছবি আঁকে। রূপসার কাজল কালো চোখের কোণে সোনালী রোদের ঝিলিক দেখে। তারপর কোনো এক সময় সেই স্বপ্ন হয়ে ওঠে বাস্তব। পাগলিনী রূপসার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে রাখে নিজের নোংরা ঠোঁট। তার এলো চুলের ফাঁকে কামনা খোঁজে। তারপর সেই কামনা কামাগ্নিতে পরিণত হলে মুখ গুঁজে দেয় তার কোমরের ভাঁজে। কখনো তাকে শাড়ি দেওয়ার কথা বলে বা ইমিটেশনের গয়না কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, কিংবা হয়তো তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে তাকে ঘরে তুলে নিরাপত্তা দেওয়ার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ভোগ করে চলে তাকে। বুকের মাঝে মুখ গুঁজে লজ্জায় রাঙিয়ে দেয় তার নারীত্বের সত্তাকে। তার গায়ের গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে সেই দুষ্টু লোকেরা। পাগলিনী রূপসা স্নান করে না অনেকদিন। কিন্তু দুষ্টু লোকেরা তাকে বীর্যস্নান করায় ভোরের আলোয়, তার সারা শরীরের নোংরা ঘাম শুষে নেয়, রাতভর তাকে শোষন করে কামনার ফসল ফলায়।
"আজ আমারে ছেড়ে দ্যান বাবু, শরীরে একটুও শক্তি নাই .. গা'টা কিরকম ম্যাজ ম্যাজ করতেছে .." আকুতি করে বলে উঠলো রূপসা। "চুপ শালী .. কাল সন্ধ্যেবেলা যখন লিপস্টিক আর কাঁচের চুড়িগুলো কিনে দিলাম .. তখন তো হাত পেতে নিয়ে নিলি। তারপর রাতের বেলায় চিকেন চাওমিন, মনে আছে? আমি তো তখনই বলেছিলাম আজ সকালে আসবো। চল ওই পেছনের বাথরুমটায়, বেশিক্ষণ লাগবেনা .. পনেরো মিনিটে কাজ শেষ হয়ে যাবে।" এই বলে রূপসাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো একটা মাঝবয়সী টাক মাথাওয়ালা হৃষ্টপুষ্ট লোক।
"কি ব্যাপার বউ দেয় না, নাকি বয়স থাকতে বাপ-মা বিয়ে দেয়নি?" এরকম একটা উক্তি কানে আসতেই মাঝবয়সী টাক মাথাওয়ালা লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল তার সামনে একজন দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ এবং সুদর্শন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। "মানে? কে আপনি? এখানে নাক গলাতে এসেছেন কেনো?" মেজাজ দেখিয়ে বললো মাঝবয়সী লোকটা।
"আমার নাকটা একটু লম্বা তো, তাই সব সময় সুরসুর করে। তবে শুধু নাক নয়, আমি মাঝেমধ্যেই অনেক জায়গায় অনেক কিছু গলিয়ে ফেলি। যার ক্ষেত্রে এই গলিয়ে ফেলার ব্যাপারটা ঘটে, সে কিন্তু আর দু-পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না। শুয়োরের বাচ্চা .. মাঝ রাস্তায় একজন মহিলার হাত ধরে টানাটানি করছিস আর আমাকে প্রশ্ন করছিস আমি নাক গলাতে এসেছি কেনো? শালা এমন মার মারবো .. নো পাসপোর্ট, নো টিকিট .. একেবারে সোজা উপরে পাঠিয়ে দেবো। চল ফোট এখান থেকে .." আগন্তুকের পেশীবহুল চেহারা এবং এইরূপ উক্তিতে রূপসার হাত ছেড়ে ভয়ের চোটে হাঁপাতে হাঁপাতে থপথপ করে পালালো হৃষ্টপুষ্ট মাঝবয়সী লোকটা।
"তোমার মানে আপনার বাড়ি কোথায়?" আগন্তুকের এই প্রশ্নে "আমার তো বাড়ি নাই বাবু .. এখানেই থাকি .. ক্লাবের এই বারান্দাটায় .. গোগোল দাদাবাবু সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে .." এটুকু বলে মাথা চুলকাতে লাগলো রূপসা।
"বুঝলাম .. কিন্তু এখানে এইভাবে থাকা তো তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়। আমি তো আর সব সময় আসবো না তোমাকে বাঁচানোর জন্য। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। চলো .. তোমাকে একটা নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া যাক।" আগন্তুক ভদ্রলোকটির এই কথা শুনে তার সঙ্গে কিছুতেই যেতে রাজি হলো না রূপসা। সে জানালো এটাই তার বাড়ি, এটাই তার ঘর। যে তাকে আশ্রয় দিয়েছে এখানে, সেই ব্যক্তিকে না বলে সে কোথাও যাবে না। তাছাড়া সে যে তাকে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে খারাপ কিছু করবে না তারই বা কি প্রমাণ আছে!
রূপসার কথা শুনে আগন্তুক বুঝলো এখনো পুরোপুরি মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি এই মহিলার। এছাড়া তার মুখে বারবার গোগোলের নাম শুনে সে বুঝলো ব্যক্তিটি সজ্জন এবং পরোপকারী।
★★★★
"বলছিলাম স্যার .. আমি এখানে নতুন, আজ সকালেই এসেছি। রাস্তা দিয়ে আসার পথে দেখলাম রেলপাড়ের পশ্চিমপ্রান্তের মাঠের কাছে যে ক্লাবটা আছে সেখানে একজন মহিলার সঙ্গে এক অচেনা ব্যক্তি অসভ্যতামি করছে, তার হাত ধরে টানাটানি করছে .. ইত্যাদি ইত্যাদি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই মহিলা ওখানে অনেকদিন ধরেই আছে। এক সহৃদয় ব্যক্তি নাকি তাকে ওখানে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। তিনি সেই মহিলার দেখাশোনা করেন, কিন্তু সবসময় তো সেই ব্যক্তির পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। আজ যদি আমার চোখে ব্যাপারটা না পড়তো, তাহলে বিশাল অঘটন ঘটে যেতো। সেই মহিলা গৃহহীন, নিরাশ্রয় বলে দিনে দুপুরে তার সঙ্গে এভাবে অন্যায় হচ্ছে আর প্রশাসন এর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না? এ বিষয়টা নিয়ে আমি প্রথমে রেলপাড় থানায় গিয়েছিলাম। ওরা বললো এলাকাটা ওদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই ওরা আমাকে এখানে, মানে বড়বাজার পুলিশ স্টেশনে পাঠিয়ে দিলো। বিষয়টা যদি একটু অনুগ্রহ করে বিবেচনা করেন স্যার, মানে ওই মহিলার থাকার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলছি।" ওই আগন্তুক ভদ্রলোকটি গঙ্গানগর সিটি পুলিশ স্টেশনের মেজবাবু বিকাশ দত্তের সামনে করজোড়ে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন।
"রেলপাড়ের ক্লাব, তারমানে আপনি ওই রূপসা পাগলীটার কথা বলছেন নিশ্চয়ই। এই দাঁড়ান দাঁড়ান মশাই .. ওখান থেকে আসছেন, হাত-পা সব স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করে এসছেন তো? কি মুশকিলে পড়া গেলো বলো তো দেখি। বাইরে থেকে সবকিছু জেনেশুনে না নিয়ে আমার ঘরে পাঠাও কেনো বলো তো এসব পাবলিকদের!" বিরক্ত প্রকাশ করে কথাগুলো বললো মেজবাবু বিকাশ দত্ত।
"কেনো স্যার, কি হয়েছে? আমি কি ভুল কিছু বললাম? জায়গাটা কি আপনাদের এলাকায় পড়ে না? তাছাড়া হাত-পা স্যানিটাইজ করে আসার কথা বলছেন কেনো? এনি প্রবলেম?" অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বললেন আগন্তুক।
"প্রবলেম মানে .. পুরোটাই প্রবলেম। আপনি কে মশাই? বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আমার ঘরে ঢুকে এসে এসব আল-বাল কথা বলে যাচ্ছেন? জায়গাটা আমাদের এলাকায় পড়ুক অথবা না পড়ুক তাতে আপনার কি? আপনি কি রুলিং পার্টির নেতা যে আপনার সব কথার উত্তর দিতে হবে আমাকে? কে কোথায় কোন পাগলীর সঙ্গে নোংরামি করেছে তার জন্য আপনি চলে এলেন কমপ্লেন করতে? যান তো মশাই, ফুটুন তো এখান থেকে। ওই পাগলীটা একটা বেশ্যাপাড়ার আইটেম ছিলো। নোংরা রোগ হয়েছে বলে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে ওখান থেকে। ওর ত্রিসীমানায় আমরা কেউ যাই না আর ইনি ওই পাগলীর সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে এসে বেমালুম আমার সামনে চলে এলো? বেরিয়ে যান, আপনি এখান থেকে, বেরিয়ে যান এক্ষুনি।" পুনরায় বিরক্তি প্রকাশ করে কথাগুলো বললো বিকাশ দত্ত।
"আচ্ছা বুঝলাম, তারমানে আমি রুলিং পার্টির নেতা হলে আমার সব কথার উত্তর দিতেন এবং মেনে চলতেন আপনি। পুলিশে চাকরি করে যে বেতন পান তাতে বোধহয় আপনার চলে না, তাই না? ওই সব নেতাদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিয়ে শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে হয়, তাই তো? একটা কথা ভুলে যাবেন না, আপনারা কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্ট। আপনাদের মতো কয়েকজন পুলিশকর্মীর জন্যই কিন্তু আজ পুরো ডিপার্টমেন্টের এই বদনাম।" দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললেন আগন্তুক ভদ্রলোক।
"এই যে মশাই তখন থেকে বড্ড চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে যাচ্ছেন আপনি! আর একটাও যদি কথা শুনি তাহলে ওই রূপসা পাগলীর শ্লীলতাহানির কেস দিয়ে আপনাকে জেলে ঢুকিয়ে পিছনে রুলের বাড়ি মেরে চামড়া গুটিয়ে নেবো।" চেয়ার ছেড়ে উঠে উত্তেজিত ভাবে কথাগুলো বললো বিকাশ দত্ত।
মুহূর্তের মধ্যে মেজবাবুর গালে একটা বজ্রমুষ্টি আছড়ে পড়লো, এবং তৎক্ষণাৎ রোগাপাতলা চেহারার অধিকারী বিকাশ দত্ত ছিটকে পড়ে গেলো মাটিতে। সুইং ডোরের তলা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঘটা সমস্ত দৃশ্য বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলো। এই দৃশ্য দেখে এবং শব্দ শুনে বাইরে থেকে এক বন্দুকধারী কনস্টেবল এই ঘরে ঢুকে ওই আগন্তুককে আঘাত করার আগেই তার দু পায়ের মাঝখানে ভারী বুটের একটা লাথি পড়লো। তৎক্ষণাৎ "ওঁক .." শব্দ করে মাটিতে বসে পড়লো সেই কনস্টেবল।
"এ থানা বলছো ও থানা আর ও থানা বলছে এ থানা .. অদ্ভুত ব্যাপার মাইরি! যাইহোক, সন্দীপ সেনগুপ্ত .. স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ। গঙ্গানগরে রমরমিয়ে চলা নিষিদ্ধ ড্রাগ র্যাকেট আর জাল ওষুধের ব্যবসার কিনারা করতে আমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে। হাতে সময় খুব কম .. মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টা। গঙ্গানগর বাস টার্মিনাসে নিষিদ্ধ ড্রাগের ব্রিফকেস সমেত ধরা পড়া লোকটা তো বড়বাজার পুলিশ স্টেশনের লক-আপেই আছে। ওকে আমি ইন্টারোগেট করতে চাই। আশা করি আজকে সন্ধ্যের মধ্যেই এই রহস্যের কুলকিনারা ভেদ করে ফেলতে পারবো। তবে হ্যাঁ, আমাকে সহযোগিতা না করে যদি আমার কাজে কেউ বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে কিন্তু তার কপালে দুঃখ আছে .. বোঝা গেলো?" ফুলস্লিভ শার্টের হাত গোটাতে গোটাতে অত্যন্ত স্বাভাবিক অথচ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললেন আগন্তুক ভদ্রলোকটি।
"আজ্ঞে স্যার .. বোঝা গেলো .." মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা সেলাম ঢুকে মিনমিন করে বললো মেজবাবু বিকাশ দত্ত।
★★★★
টগর দ্বিতীয় বারের জন্য জ্ঞান হারানোর পর ডাক্তার বসাককে ওদের বাড়ি থেকেই ফোন করেছিলো গোগোল। সবকিছু শোনার পর ডাক্তারবাবু আর রিস্ক নিতে চাননি। টগরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরের সিটি হসপিটালে নিয়ে আসতে বলেন। সেই অবস্থায় ওকে তো বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিলো না। ওদের বাড়ির পাশেই মধুর চায়ের দোকান। ডাক্তারবাবুর ফোন রাখার পর মধুকে ফোন করে মিউনিসিপাল হসপিটাল থেকে একটা এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিতে বলে গোগোল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। কিছুক্ষণ পর মহাজনের সঙ্গে দরকার মিটিয়ে শিউলিকে কলেজ থেকে নিয়ে স্বপনবাবু ফিরলে ওদের দু'জনকে টগরের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা করে দিয়ে গোগোল নিজের বাড়িতে যাচ্ছিলো সবিস্তারে সবকিছু বলতে। তখনই রাস্তার মধ্যে সুজাতা ওকে ফোন করে এবং বাড়িতে যাওয়ার পর রাগের মাথায় যে কথা এর পূর্বে কোনোদিনও সে বলেনি বা বলতে পারে এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি, সেই কথাগুলো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় গোগোলকে বলে ফেলে।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এলো, এখনো জ্ঞান ফেরেনি টগরের। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে তাকে। আইসিইউয়ের দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো গোগোল। ভেতর থেকে বেরিয়ে গোগোলকে দেখতে পেয়ে ডক্টর বসাক বললেন "চিন্তা করো না .. উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট .. আচ্ছা ভদ্রলোকের ক'টি মেয়ে?"
- "দুই মেয়ে .. কেনো বলুন তো?"
- "যেটা ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হয়েছে। টিউমারটা বাস্ট করেছে হঠাৎ করেই .. কন্ডিশন একদমই ভালো নয়। ঠিক আছে তুমি এত ভেঙে পড়ো না। তুই তো একজন ইয়াং ছেলে, তোমাকে তো শক্ত থাকতে হবে বলো! ইউ আর এ ব্রেভ ম্যান। ভগবানের উপর ভরসা রাখো .. সবকিছুই উনার হাতে।"
ডক্টর বসাক চলে যাওয়ার পর সেই দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো গোগোল। স্বপনবাবু তার ছোট মেয়ে শিউলিকে নিয়ে বাইরের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন। ভীষণ অসহায় লাগছিলো তার নিজেকে এই মুহূর্তে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো তার। একা একা এই খেয়া আর কতদিন বইতে হবে তাকে। হঠাৎ করেই হিয়ার মুখটা মনে পড়লো তার। অস্ফুটে বলে উঠলো "এ জন্মে তো আর হলো না, তবে পরের জন্মে তোমাকে ঠিক এইভাবেই পেতে চাই আমি। বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে, শীতলপাটি বিছিয়ে দেবো। সন্ধ্যে হলে মুখোমুখি বসবো দু’জনে। সেইসময় দু-একটা তারা খসে পড়বে আকাশ থেকে। আর আমি চুপটি করে দু'চোখ ভরে চেয়ে থাকবো তোমার দিকে, কেমন! এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেবো, কথা দিলাম। এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেবো। আমি হবো উড়নচন্ডী এবং খানিক উস্কোখুস্কো। তুমি কাঁদলে গভীর সুখে, এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেবো, কেমন! এই জন্মের তোমার গায়ের সেই মন মাতানো গন্ধ যেন পাই পরের জন্মে! এই জন্মের পরস্পরের পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেনো, কেমন! পরের জন্মে স্বভাব-কবি হবো, তোমায় নিয়ে কতশত গান বাঁধবো। তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে, নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে গান বানিয়ে মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো, কেমন!"
"বাহ্ , তুমি তো ভীষণ স্বার্থপর! শুধু নিজের কথাটাই বলছো, আর আমি? তবে আমি কিন্তু পরজন্মে বিশ্বাসী নই .. আমার সব এই জন্মেই চাই। আমি এই জন্মেই তিতাস হবো, দোল মঞ্চের আবীর হবো, শিউলি তলার দুর্বো হবো। শরৎকালের আকাশ দেখার অনন্তনীল সকাল হবো। এসব কিছু হই বা না হই, তোমার মনের মানুষ হবো, বুঝেছো? এত সহজে আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না তুমি লাটসাহেব।" তার অনেক দিনের চেনা, তার একান্ত আপন সেই নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনে চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে গোগোল দেখলো তার সামনে হিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
"তুমি এখানে .. এখন .. হঠাৎ .. কিভাবে .. এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব?" অবাক হয়ে জানতে চাইলো গোগোল।
সেই মুহূর্তে হিয়া গোগোলের হাতে খুব জোরে একটা চিমটি কাটলো। "আহ্ .. লাগে তো .." কি যে করো না তুমি .." মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো সে।
"জানতে চাইছিলে না .. এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব, তাই চিমটি কেটে প্রমাণ করে দিলাম এটা ঘোরতর বাস্তব। তুমি কি ভেবেছিলে যাবতীয় ঝড়ঝাপটা একা সহ্য করে, সব দুঃখ-কষ্ট একা নিজের বুকে নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে আসবে, আর কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না? বাকিদের কথা ছেড়ে দিলাম, তুমি আমার অস্তিত্বকে ভুলে গেলে কি করে? তুমি কি করে ভাবলে তোমাকে কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতে ছেড়ে না যাওয়ার যে অঙ্গীকার আমি করেছিলাম, তা আমি আমার মায়ের কিছু মনগড়া কথায় ভুলে যাবো? আমার মা ফোন করে মামণিকে যে কথাগুলো বলেছিলো তোমার সম্পর্কে, তার দায় আমি নেবো না, কারণ সেটা মায়ের নিজস্ব ধারনা। কিন্তু মা যখন মামণিকে ফোন করে বললো যে উনি আমার সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের এখানেই ইতি .. সেই কথা আমার কানে আসতেই আমি আমার মায়ের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে, নিজের বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসি সেই মুহূর্তে। তোমাকে একনাগাড়ে ফোন করতে থাকি, কিন্তু তোমার ফোন 'নট রিচেবল' বলছিলো। কোথায় যাবো, কি করবো বুঝতে না পেরে সোজা তোমাদের বাড়ি চলে আসি। সেখানে এসে মামণির সঙ্গে তোমার কথোপকথন, মানে মামণি তোমাকে যা যা বলেছে তার সবকিছু জানতে পারি। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই সেই মুহূর্তে, কারণ আমি তো জানি তুমি কতটা অভিমানী। ঠিক তখনই মধু দাদা এসে ডাক্তার আঙ্কেলকে মিউনিসিপাল হসপিটাল থেকে তোমার অ্যাম্বুলেন্স বুক করতে বলা থেকে শুরু করে সবকিছু জানায়। সবকিছু জানার পর, সবকিছু শোনার পর আমি ওখানে এক মুহূর্ত দাঁড়াইনি, সোজা এইখানে চলে এসেছি তোমার কাছে। মামণি আর ডাক্তার আঙ্কেল কাল সকালে আসবে .. তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে মামণির। আমি জানি এই পরিস্থিতিতে তোমার এ সমস্ত কথা শুনতে ভালো লাগছে না, কিন্তু আমার আর তোমার মধ্যে এই বোঝাপড়াটা হওয়ার খুব দরকার ছিলো লাটসাহেব। এবার বলো তো তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে?" গঝগোলের একদম কাছে গিয়ে তার দুটো হাত ধরে কথাগুলো বললো হিয়া।
গোগোল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে ও প্রান্ত থেকে কিছু শোনার পর হিয়া লক্ষ্য করলো গোগোলের চোখ-মুখের অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। চোয়ালদুটো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে আর চোখ দুটো টকটকে লালবর্ণ ধারণ করেছে। "ঠিক আছে .." এইটুকু বলার পর ঝড়ের গতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার আগে শুধু হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে গেলো "এখানে থেকো, আমি ফিরে আসবো .."
গোগোলের চলে যাওয়ার পথে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো হিয়া, তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলো না। বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধ্যে।