25-01-2023, 09:32 PM
চুলা জ্বলছে মোট এগারো টা , তিন রাউন্ড রান্না হবে। মজিদ মিয়াঁ বলেছিলো আরও চুলা বানাতে। জায়গার তো অভাব নাই তাঁর, তিবার হাড়ি চরানোর দরকার কি? কিন্তু বাবুর্চি করিম বক্স কিছুতেই রাজি না। করিম বক্সের উস্তাদ বলে দিয়েছে সব সময় ১১ চুলায় রান্না করতে । তাই হাড়ি একটা হলেও করিম বক্স এগারোটা আগুন জ্বালায় আবার ১০০ হাড়ি হলেও ১১ টা চুলা বানায়। মোট ২০ হাড়ি মাংস হবে , দুই হাজার লোকের খাবার , গ্রাম সুদ্ধ সবাই কে দাওয়াত করা হয়েছে। মজিদ মিয়াঁ নিজে হাঁট থেকে গরু কিনে এনেছে । নিজের মেয়ের বিয়েতে অন্য কারো উপরে এই দায়িত্ব দিতে মনে সায় দেয়নি তাঁর । এমন জিনিস এনেছে যে গ্রামের মানুষ এক মাস পর্যন্ত আঙুল চাটবে । এক মাত্র মেয়ের বিয়েতে এমন খাওয়া খাওয়াবে যে গ্রামের মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে। টাকা পয়াসার তো কোন অভাব নেই , খোদার রহমতে সে অনেক আছে মজিদ মিয়ার । গত ১২ বছর যাবত ইউ পি মেম্বার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ।
করিম মানুষ জানি আঙুল চাইট্টা ক্ষয় কইরা ফালায় , বাবুর্চি করিম বক্স কে উদ্দেশ্য করে বলে মদিজ মিয়াঁ , তারপর বাবুরচির সহকারি কে হাড়ির ঢাকনা সরাতে বলে । ঢাকনা সরে জেতেই কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোয়া ওঠে , মশলা আর মাংসের গন্ধে মম , সেই বাস্পে নিঃশ্বাস নেয় মদিজ । দু চোখ বুজে আসে তাঁর ।
আপনে চিন্তা কইরেন না মেম্বার সাব……। স্বল্প ভাষী করিম উত্তর দেয় । বেশীক্ষণ আর দারায় না সেখানে মজিদ মিয়াঁ । সব দিক তাকেই দেখা শুনা করতে হচ্ছে । এমন নয় যে লোক জনের অভাব , কিন্তু কারুকেই ভরসা করতে পারছে না সে , ঘুরে ঘুরে সব যায়গায় তদারকি করছেন । চেয়ারম্যান সাহেব কে নিয়ে ক্ষোদ এম পি সাহেব এর বাড়ি গিয়েছিলো । এম পি সাহেব আশ্বাস দিয়েছেন আসবেন । তাই কোন কিছুতে ত্রুটি হয়ে দেয়ার অবকাশ নেই ।
দাদা টেকা দেন…… উদল গায়ে লুঙ্গি পরা একটা নাদুস নুদুস ছেলে প্রায় দৌরে আসে , হাঁপাচ্ছে ছেলেটি । থলথলে চর্বি ভরা শরীর থেকে তেলের মত ঘাম ঝড়ছে ।
কিয়ের টেকারে নাক্কির পো ……… সামিয়ানার কাজ তদারকিতে ব্যাস্ত মজিদ মিয়াঁ খেঁকিয়ে ওঠে ,
আমি কি জানি…… প্রথমে মাথা চুল্কে এই উত্তর দিলেও পর মুহূর্তে নিজের উত্তর পরিবর্তন করে ছেলেটি , বলে কন্যা সাজানির মাইয়াগো আনতে জামু গাড়ি ভাড়া লাগবো, বলে মজনু ।
আমারে ফকির বানাইয়া ফালাইবো তর দাদি , কন্যা সাজানির লইগা আবার শহর থেইকা মাইয়া আনন লাগবো ক্যান……… রেগে গিয়ে দাত মুখ খিঁচিয়ে বলে মজিদ মিয়াঁ , তবে পাঁচশো টাকার একটা নোট ঠিক ই লুঙ্গির গাঁট থেকে বের করে দেয়।
এমন সময় হই হুল্লোড় শুনতে পাওয়া যায় বাড়ির ফটকের সামনে , ডজন খানেক বাচ্চা ছেলে পেলে পেছন পেছন হৈ চৈ করতে করতে আসছে , আর সামনে আসছে বজলু , বজলুর হাতে বিশাল এক বোয়াল মাছ , মাছের লেজ মাটিতে ছেঁচরে ছেঁচরে আসছে। মজিদ মিয়াঁ দ্রুত সেদিকে এগিয়ে যায় । এম পি সাহেব এর প্রিয় মাছ হচ্ছে বোয়াল মাছ । তাই এক মাস আগে অর্ডার করে রেখেছিলো মজিদ মিয়াঁ । যেন তেন বোয়াল হলে চলবে না একদম বিলের বোয়াল হতে হবে । আর কম করেও ২০ কেজি ওজন হতে হবে ।
ওই পোলাপান যাহ অহন , যোহর নামাজের পরে আহিস , মজিদ মিয়াঁ কে দেখে পেছনে লাগা বাচ্চার দল কে তাড়ানোর চেষ্টা করে বজলু , কিন্তু এমন অলৌকিক জিনিস এই গ্রামের ছেলে পেলে আগে কখনো দেখেনি , তাই এত সহজে এরা যাবে না। যেমন তেমন জিনিস তো নয় , একদম মানুষ সমান বোয়াল মাছ ।
ওই মান্দার পুত রা গেলি এহন , এবার বজলু ক্ষেপে ওঠে , মেম্বার মজিদ মিয়াঁর অনেক দিনের সঙ্গি এই বজলু , তাই তার মাঝেও মেম্বারি দাপট কিছুটা চলে এসেছে । এরি মাঝে মজিদ মিয়াঁ চলে এসেছে , জহুরির মত খুঁটিয়ে মাছ পরীক্ষা করছেন উনি । আর মজনু যতটা সম্ভব উচু করে ধরে রেখেছে । মজনুর মুখে বিজয় এর হাঁসি , ভাব খানা এমন যে মাছটি ও নিজেই ধরে এনেছে এখন।
বরফ ঘরে কয় মাস আসিলো কে জানে…… বেশ অনেক্ষন খুঁটিয়ে পরীক্ষার পর বিরক্ত মুখে বলে মজিদ মিয়াঁ ,
কাইলকা আইসে , মাছের আড়ৎদার এর বলা কথাটি বলে বজলু ,
তুমি দেখসো ?
এবার বজলু দমে যায় , আসলে এমন জিনিস ও নিজেও কোনদিন চোখে দেখেনাই , তাই আড়ৎদার এর কথা পুর বিশ্বাস করেছে ও । মাছ দেখে বজলু এততাই বিমোহিত যে আড়ৎদার মিথ্যা বলতে পারে এটা বজলুর বিশ্বাস হয়নি । কইলো তো…… মিন মিন করে বলে বজলু ।
এমুন কথা সব হারামির বাচ্চায় ই কয়……… যা ভিতরে লইয়া যা ,
মাছ রান্নার দায়িত্ব পরেছে খোদ মেম্বার গিন্নীর উপর , করিম বক্স নামকরা বাবুর্চি কিন্তু এই মাছ রান্না তার কম্ম নয় । এসব জিনিস রান্নায় পারদর্শী হয় গেরস্থ বাড়ির মেয়েরা । যুগে যুগে এসব রান্নার রেসেপি নানি দাদি মা খালার মাধ্যমে এরা পেয়ে থাকে । তাই কমার্শিয়াল বাবুর্চি তা সে জতই বিখ্যাত হোক , গেরস্থ বাড়ির বউ ঝি দের কাছে এসব খান্দানি রান্নায় এরা গো হারা হারবে , অন্তত মজিদ মিয়াঁ এই বিশ্বাস করেন । তাইতো মেয়ে বিদায় এর শোকে কাতর মেম্বার গিন্নীর উপর জোড় করে এই দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিয়েছন ।
মাছ দেখে মেম্বার সাহেব আবারো ভেতর দিকে হাঁটা দিলেন , উদ্দেশ্য মেয়ের সাথে একবার দেখা করবেন , গত কয়েকদিন কাজে এত ব্যাস্ত ছিলেন যে মেয়েটাকে ঠিক মত দেখেও নি । আর বিয়ের আয়োজন শুরু হওয়ার পর মেয়েটা লজ্জায় সামনে আসে না। আর মজিদ মিয়াও কন্যা বাৎসল্য তেমন কোনদিন দেখান নি। মনে মনে মমতা থাকলেও সারাজীবন কঠিন শাসনে রেখেছেন মেয়েকে । তাই এমিন্তেও একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
মজিদ মিয়াঁ অবশ্য এটাই ভালো মনে করেন । বাপ কে ভয় না পেলে সন্তান ভালো হয় না , এটাই মজিদ মিয়াঁর বিশ্বাস। এমনিতে মজিদ মিয়াঁর মেয়ে একটু চঞ্চল মত। তাই সব সময় মেয়ের মনে ভয় তৈরি করে রাখা দরকার ছিলো ,অবশ্য এই কয়দিনে মজিদ মিয়াঁর মনে একটু অনুশোচনা হচ্ছে । এই যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাই মেয়ের সাথে বিয়ের আগে একটু বেশি সময় কাটানোর কোন উসিলা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই যে এখন দেখা করতে জাবেন সেটার জন্য ও কোন কারন খুঁজে পাচ্ছেন না। মনে মনে মজিদ মিয়াঁ ভাবছেন কি করে মেয়ের সাথে দেখা করা যায়। এমন সময় একজন ডাকল… মেম্বার সাব
বিরক্ত হয়ে পেছন দিকে তাকালেন মজিদ মিয়াঁ , কি চাই … একটা কাম ও কি আমারে ছাড়া হয় না তগো? মজিদ মিয়াঁ ভাব্লেন হয়ত লোকটা বিয়ের কোন কাজের ব্যাপারে এসেছে । তবে সাথে সাথেই লোকটাকে চিনতে পারলো মজিদ মিয়াঁ , না বিয়ের কাজের ব্যাপারে আসেনি , এ হচ্ছে সেদু , ভালো নাম সাইদুর , তবে এই নামে কেউ আর চেনে না সবাই সেদু বলেই ডাকে। সেদু কি কারনে এসেছে সেটা বুঝতে পেরে মজিদ মিয়াঁর মেজেজ খারাপ হয়ে গেলো , ইচ্ছা করছে একটা কষে চড় বসিয়ে দিতে সেদুর গালে । কিন্তু এরকম কিছু করা ঠিক হবে না ভেবে নিজেক কন্ট্রোল করলেন । একটু কাছে এগিয়ে গেলেন , ময়লা ছেড়া লুঙ্গি পরিহিত সেদুর দিকে , দাতে দাত পিষে বললেন ,
দুইটা দিন সহ্য অয় না তগো… আমি কইসি তো বেবস্থা করুম , বিয়া টা শেষ হইতে দে
কিন্তু সেদু কোন উত্তর দেয় না , হাত জোড় করে সুধু চোখের পানি ফেলে , সেটা দেখে মজিদ মিয়াঁ সেদুর পিঠে হাত রাখে । নরম স্বরে বলে , তুই তো জানস আমার কিছুই করন এর নাই , যেইটা নিয়ম সেইটা তো মানতেই হইবো । আর এই কামের লইগা চেয়ারম্যান সাবের চেয়ে ভালা মানুষ আর কে আছে ক? অন্য কারো হাতে দিবি? কার মনে কি আছে কয়ন যায় , যদি নষ্ট কইরা দেয়। আর চেয়ারম্যান সাব আমাগো সবার মুরুগবি আমাগো বাপের লাহান ।
মাম্বার সাব রাগের মাথায় কইয়া হালাইসে , আপনে আমার বাপ , আমি চেয়ারম্যান ফেয়ারমেন চিনি না , আপনে কাউরে কইয়েন না তাইলেই সব ঠিক হইয়া যায় । কথা গুলো বলে সেদু মজিদ মিয়াঁর পায়ের ধরার জন্য নিচু হতে যায় আর সেই সময় মজিদ মিয়াঁ সেদু কে ধরে ফেলে , আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ দেখছে কিনা ।
সারা জীবন পাপের তলে থাকতে চাস? এবার একটু কড়া স্বরে বলে মজিদ মিয়াঁ , তারপর আবার নরম স্বরে বলে , কব্বরে গিয়া কি জবাব দিবি , এই ছোট একটা কামের লইগা দোজগ এ জাইতে চাস নি , আর তুই নাইলে দজগ এ গেলি , আমি ক্যান এই পাপের ভাগ লইতে যামু । আর যদি চুপ চাপ কামটা হইয়া জাইতে দেস কেউ কিচ্ছু জানত না , আর চেয়ারম্যান সাবেরে তো চিনস একদম পবিত্র থাকব । অহন যা, জোহর পইরা আইয়া পরিস , খাইয়া জাইস আবার চুপ কইরা তরে এক টুকরা বোয়াল মাছের পেটি দিয়া দিমুনে, এহন যা । এই বলে মজিদ মিয়াঁ আর দাড়ায় না । পেছনে তকালে দেখত সেদুর কাতর চোখ দুটোতে কি অসহায় চাহুনি ।
সেদু কে বিদায় করে দিয়ে মজিদ মিয়াঁ মেয়ের সাথে দেখা করার চিন্তা বাদ দেয় । এমন বিরক্ত মন নিয়ে এই সময় মেয়ের কাছে যাওয়ার মানে হয় না । হয়ত কোন খারাপ ব্যাবহার করে ফেলবে । মেজাজ বিগড়ে আছে এমনিতেই , এই মেজাজ নেয়ে বিয়ে সাঁজে বসে থাকা মেয়ের সামনে যাওয়া যাবে না ।
গ্রাম সুদ্ধ লোক এর ঢল নেমেছিলো মজিদ মিয়াঁর আঙিনায় , সবাই পেট পুরে খেয়েছে , ভাত মাংস ডাল আর পায়েস । যদিও মজিদ মিয়াঁ এদিকে তেমন সময় দিতে পারেনি , উনি বিজি ছিলেন ভি আই পি গেস্ট দের নিয়ে । এম পি সাহেব , পাঁচ ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান মেম্বার রা এসেছিলো । কিন্তু মজিদ মিয়াঁর একটা দুঃখ রয়ে গেলো , বোয়াল মাছ কেউ খায়নি । কেউ একজন রটনা রটিয়ে দিয়েছিলো এটা রাক্ষুসে বোয়াল , এই বোয়াল মানুষ খেকো । যদিও এম পি সাহেব এসব মানেন না , তবুও নাকি ওনার কেমন জানি লেগেছে । আর এম পি সাহেব যখন খাবে না বাকিরাও বোয়াল মাছে হাত দেয়ার সাহস করেনি ।
তবে শত ব্যাস্ততার ফাকে মজিদ মিয়াঁ সেদুর ব্যাপারটা চেয়ারম্যান সাহেব এর কানে তুলতে ভুল করেনি । শুনে চেয়ারম্যান সাহেব এর চোখ দুটো চক চক করে উঠেছিলো , এবং যত দ্রুত সম্ভব এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলেছে । এসব ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাহেব কিছুতেই দেরি করতে চায় না ।
<><><>
করিম মানুষ জানি আঙুল চাইট্টা ক্ষয় কইরা ফালায় , বাবুর্চি করিম বক্স কে উদ্দেশ্য করে বলে মদিজ মিয়াঁ , তারপর বাবুরচির সহকারি কে হাড়ির ঢাকনা সরাতে বলে । ঢাকনা সরে জেতেই কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোয়া ওঠে , মশলা আর মাংসের গন্ধে মম , সেই বাস্পে নিঃশ্বাস নেয় মদিজ । দু চোখ বুজে আসে তাঁর ।
আপনে চিন্তা কইরেন না মেম্বার সাব……। স্বল্প ভাষী করিম উত্তর দেয় । বেশীক্ষণ আর দারায় না সেখানে মজিদ মিয়াঁ । সব দিক তাকেই দেখা শুনা করতে হচ্ছে । এমন নয় যে লোক জনের অভাব , কিন্তু কারুকেই ভরসা করতে পারছে না সে , ঘুরে ঘুরে সব যায়গায় তদারকি করছেন । চেয়ারম্যান সাহেব কে নিয়ে ক্ষোদ এম পি সাহেব এর বাড়ি গিয়েছিলো । এম পি সাহেব আশ্বাস দিয়েছেন আসবেন । তাই কোন কিছুতে ত্রুটি হয়ে দেয়ার অবকাশ নেই ।
দাদা টেকা দেন…… উদল গায়ে লুঙ্গি পরা একটা নাদুস নুদুস ছেলে প্রায় দৌরে আসে , হাঁপাচ্ছে ছেলেটি । থলথলে চর্বি ভরা শরীর থেকে তেলের মত ঘাম ঝড়ছে ।
কিয়ের টেকারে নাক্কির পো ……… সামিয়ানার কাজ তদারকিতে ব্যাস্ত মজিদ মিয়াঁ খেঁকিয়ে ওঠে ,
আমি কি জানি…… প্রথমে মাথা চুল্কে এই উত্তর দিলেও পর মুহূর্তে নিজের উত্তর পরিবর্তন করে ছেলেটি , বলে কন্যা সাজানির মাইয়াগো আনতে জামু গাড়ি ভাড়া লাগবো, বলে মজনু ।
আমারে ফকির বানাইয়া ফালাইবো তর দাদি , কন্যা সাজানির লইগা আবার শহর থেইকা মাইয়া আনন লাগবো ক্যান……… রেগে গিয়ে দাত মুখ খিঁচিয়ে বলে মজিদ মিয়াঁ , তবে পাঁচশো টাকার একটা নোট ঠিক ই লুঙ্গির গাঁট থেকে বের করে দেয়।
এমন সময় হই হুল্লোড় শুনতে পাওয়া যায় বাড়ির ফটকের সামনে , ডজন খানেক বাচ্চা ছেলে পেলে পেছন পেছন হৈ চৈ করতে করতে আসছে , আর সামনে আসছে বজলু , বজলুর হাতে বিশাল এক বোয়াল মাছ , মাছের লেজ মাটিতে ছেঁচরে ছেঁচরে আসছে। মজিদ মিয়াঁ দ্রুত সেদিকে এগিয়ে যায় । এম পি সাহেব এর প্রিয় মাছ হচ্ছে বোয়াল মাছ । তাই এক মাস আগে অর্ডার করে রেখেছিলো মজিদ মিয়াঁ । যেন তেন বোয়াল হলে চলবে না একদম বিলের বোয়াল হতে হবে । আর কম করেও ২০ কেজি ওজন হতে হবে ।
ওই পোলাপান যাহ অহন , যোহর নামাজের পরে আহিস , মজিদ মিয়াঁ কে দেখে পেছনে লাগা বাচ্চার দল কে তাড়ানোর চেষ্টা করে বজলু , কিন্তু এমন অলৌকিক জিনিস এই গ্রামের ছেলে পেলে আগে কখনো দেখেনি , তাই এত সহজে এরা যাবে না। যেমন তেমন জিনিস তো নয় , একদম মানুষ সমান বোয়াল মাছ ।
ওই মান্দার পুত রা গেলি এহন , এবার বজলু ক্ষেপে ওঠে , মেম্বার মজিদ মিয়াঁর অনেক দিনের সঙ্গি এই বজলু , তাই তার মাঝেও মেম্বারি দাপট কিছুটা চলে এসেছে । এরি মাঝে মজিদ মিয়াঁ চলে এসেছে , জহুরির মত খুঁটিয়ে মাছ পরীক্ষা করছেন উনি । আর মজনু যতটা সম্ভব উচু করে ধরে রেখেছে । মজনুর মুখে বিজয় এর হাঁসি , ভাব খানা এমন যে মাছটি ও নিজেই ধরে এনেছে এখন।
বরফ ঘরে কয় মাস আসিলো কে জানে…… বেশ অনেক্ষন খুঁটিয়ে পরীক্ষার পর বিরক্ত মুখে বলে মজিদ মিয়াঁ ,
কাইলকা আইসে , মাছের আড়ৎদার এর বলা কথাটি বলে বজলু ,
তুমি দেখসো ?
এবার বজলু দমে যায় , আসলে এমন জিনিস ও নিজেও কোনদিন চোখে দেখেনাই , তাই আড়ৎদার এর কথা পুর বিশ্বাস করেছে ও । মাছ দেখে বজলু এততাই বিমোহিত যে আড়ৎদার মিথ্যা বলতে পারে এটা বজলুর বিশ্বাস হয়নি । কইলো তো…… মিন মিন করে বলে বজলু ।
এমুন কথা সব হারামির বাচ্চায় ই কয়……… যা ভিতরে লইয়া যা ,
মাছ রান্নার দায়িত্ব পরেছে খোদ মেম্বার গিন্নীর উপর , করিম বক্স নামকরা বাবুর্চি কিন্তু এই মাছ রান্না তার কম্ম নয় । এসব জিনিস রান্নায় পারদর্শী হয় গেরস্থ বাড়ির মেয়েরা । যুগে যুগে এসব রান্নার রেসেপি নানি দাদি মা খালার মাধ্যমে এরা পেয়ে থাকে । তাই কমার্শিয়াল বাবুর্চি তা সে জতই বিখ্যাত হোক , গেরস্থ বাড়ির বউ ঝি দের কাছে এসব খান্দানি রান্নায় এরা গো হারা হারবে , অন্তত মজিদ মিয়াঁ এই বিশ্বাস করেন । তাইতো মেয়ে বিদায় এর শোকে কাতর মেম্বার গিন্নীর উপর জোড় করে এই দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিয়েছন ।
মাছ দেখে মেম্বার সাহেব আবারো ভেতর দিকে হাঁটা দিলেন , উদ্দেশ্য মেয়ের সাথে একবার দেখা করবেন , গত কয়েকদিন কাজে এত ব্যাস্ত ছিলেন যে মেয়েটাকে ঠিক মত দেখেও নি । আর বিয়ের আয়োজন শুরু হওয়ার পর মেয়েটা লজ্জায় সামনে আসে না। আর মজিদ মিয়াও কন্যা বাৎসল্য তেমন কোনদিন দেখান নি। মনে মনে মমতা থাকলেও সারাজীবন কঠিন শাসনে রেখেছেন মেয়েকে । তাই এমিন্তেও একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
মজিদ মিয়াঁ অবশ্য এটাই ভালো মনে করেন । বাপ কে ভয় না পেলে সন্তান ভালো হয় না , এটাই মজিদ মিয়াঁর বিশ্বাস। এমনিতে মজিদ মিয়াঁর মেয়ে একটু চঞ্চল মত। তাই সব সময় মেয়ের মনে ভয় তৈরি করে রাখা দরকার ছিলো ,অবশ্য এই কয়দিনে মজিদ মিয়াঁর মনে একটু অনুশোচনা হচ্ছে । এই যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাই মেয়ের সাথে বিয়ের আগে একটু বেশি সময় কাটানোর কোন উসিলা খুঁজে পাচ্ছেন না। এই যে এখন দেখা করতে জাবেন সেটার জন্য ও কোন কারন খুঁজে পাচ্ছেন না। মনে মনে মজিদ মিয়াঁ ভাবছেন কি করে মেয়ের সাথে দেখা করা যায়। এমন সময় একজন ডাকল… মেম্বার সাব
বিরক্ত হয়ে পেছন দিকে তাকালেন মজিদ মিয়াঁ , কি চাই … একটা কাম ও কি আমারে ছাড়া হয় না তগো? মজিদ মিয়াঁ ভাব্লেন হয়ত লোকটা বিয়ের কোন কাজের ব্যাপারে এসেছে । তবে সাথে সাথেই লোকটাকে চিনতে পারলো মজিদ মিয়াঁ , না বিয়ের কাজের ব্যাপারে আসেনি , এ হচ্ছে সেদু , ভালো নাম সাইদুর , তবে এই নামে কেউ আর চেনে না সবাই সেদু বলেই ডাকে। সেদু কি কারনে এসেছে সেটা বুঝতে পেরে মজিদ মিয়াঁর মেজেজ খারাপ হয়ে গেলো , ইচ্ছা করছে একটা কষে চড় বসিয়ে দিতে সেদুর গালে । কিন্তু এরকম কিছু করা ঠিক হবে না ভেবে নিজেক কন্ট্রোল করলেন । একটু কাছে এগিয়ে গেলেন , ময়লা ছেড়া লুঙ্গি পরিহিত সেদুর দিকে , দাতে দাত পিষে বললেন ,
দুইটা দিন সহ্য অয় না তগো… আমি কইসি তো বেবস্থা করুম , বিয়া টা শেষ হইতে দে
কিন্তু সেদু কোন উত্তর দেয় না , হাত জোড় করে সুধু চোখের পানি ফেলে , সেটা দেখে মজিদ মিয়াঁ সেদুর পিঠে হাত রাখে । নরম স্বরে বলে , তুই তো জানস আমার কিছুই করন এর নাই , যেইটা নিয়ম সেইটা তো মানতেই হইবো । আর এই কামের লইগা চেয়ারম্যান সাবের চেয়ে ভালা মানুষ আর কে আছে ক? অন্য কারো হাতে দিবি? কার মনে কি আছে কয়ন যায় , যদি নষ্ট কইরা দেয়। আর চেয়ারম্যান সাব আমাগো সবার মুরুগবি আমাগো বাপের লাহান ।
মাম্বার সাব রাগের মাথায় কইয়া হালাইসে , আপনে আমার বাপ , আমি চেয়ারম্যান ফেয়ারমেন চিনি না , আপনে কাউরে কইয়েন না তাইলেই সব ঠিক হইয়া যায় । কথা গুলো বলে সেদু মজিদ মিয়াঁর পায়ের ধরার জন্য নিচু হতে যায় আর সেই সময় মজিদ মিয়াঁ সেদু কে ধরে ফেলে , আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ দেখছে কিনা ।
সারা জীবন পাপের তলে থাকতে চাস? এবার একটু কড়া স্বরে বলে মজিদ মিয়াঁ , তারপর আবার নরম স্বরে বলে , কব্বরে গিয়া কি জবাব দিবি , এই ছোট একটা কামের লইগা দোজগ এ জাইতে চাস নি , আর তুই নাইলে দজগ এ গেলি , আমি ক্যান এই পাপের ভাগ লইতে যামু । আর যদি চুপ চাপ কামটা হইয়া জাইতে দেস কেউ কিচ্ছু জানত না , আর চেয়ারম্যান সাবেরে তো চিনস একদম পবিত্র থাকব । অহন যা, জোহর পইরা আইয়া পরিস , খাইয়া জাইস আবার চুপ কইরা তরে এক টুকরা বোয়াল মাছের পেটি দিয়া দিমুনে, এহন যা । এই বলে মজিদ মিয়াঁ আর দাড়ায় না । পেছনে তকালে দেখত সেদুর কাতর চোখ দুটোতে কি অসহায় চাহুনি ।
সেদু কে বিদায় করে দিয়ে মজিদ মিয়াঁ মেয়ের সাথে দেখা করার চিন্তা বাদ দেয় । এমন বিরক্ত মন নিয়ে এই সময় মেয়ের কাছে যাওয়ার মানে হয় না । হয়ত কোন খারাপ ব্যাবহার করে ফেলবে । মেজাজ বিগড়ে আছে এমনিতেই , এই মেজাজ নেয়ে বিয়ে সাঁজে বসে থাকা মেয়ের সামনে যাওয়া যাবে না ।
গ্রাম সুদ্ধ লোক এর ঢল নেমেছিলো মজিদ মিয়াঁর আঙিনায় , সবাই পেট পুরে খেয়েছে , ভাত মাংস ডাল আর পায়েস । যদিও মজিদ মিয়াঁ এদিকে তেমন সময় দিতে পারেনি , উনি বিজি ছিলেন ভি আই পি গেস্ট দের নিয়ে । এম পি সাহেব , পাঁচ ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান মেম্বার রা এসেছিলো । কিন্তু মজিদ মিয়াঁর একটা দুঃখ রয়ে গেলো , বোয়াল মাছ কেউ খায়নি । কেউ একজন রটনা রটিয়ে দিয়েছিলো এটা রাক্ষুসে বোয়াল , এই বোয়াল মানুষ খেকো । যদিও এম পি সাহেব এসব মানেন না , তবুও নাকি ওনার কেমন জানি লেগেছে । আর এম পি সাহেব যখন খাবে না বাকিরাও বোয়াল মাছে হাত দেয়ার সাহস করেনি ।
তবে শত ব্যাস্ততার ফাকে মজিদ মিয়াঁ সেদুর ব্যাপারটা চেয়ারম্যান সাহেব এর কানে তুলতে ভুল করেনি । শুনে চেয়ারম্যান সাহেব এর চোখ দুটো চক চক করে উঠেছিলো , এবং যত দ্রুত সম্ভব এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলেছে । এসব ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাহেব কিছুতেই দেরি করতে চায় না ।
<><><>