25-01-2023, 10:22 AM
**ফুটন্ত ভাতের গন্ধ!**
"রণেন বসু"
"নুতন বউ, ও নুতন বউ -উ -উ-উ। ও-ও নুতন বউ-উ-উ-উ!" স্নান করে ভিজে শাড়িতে সবে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই নুতন বউ লাবণ্য শুনতে পেল, খুড়ি শাশুড়ির ক্ষীণ কণ্ঠে ডাক। "ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ।"
"যাই খুড়িমা।" হাতের ভিজে কাপড়গুলো বারান্দায় রেখে, লাবণ্য ভ্যারাণ্ডার ভাঙা বেড়া ডিঙিয়ে ছোট তরফের উঠানে ঢোকে। ছোট তরফ মানে, একই বাড়ির খুড়ো শ্বশুরের অংশ। দুই তরফের বাড়িই আজ ভগ্নদশা।
কুড়ি বছর আগে, লাবণ্য যখন বউ হয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিল তখন তরফের অবস্থাই বেশ ভালো ছিলো। এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন। নিজের শাশুড়ি তখন শয্যাশায়ী। ভিন্ন শরিক হলেও সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। সেই থেকে খুড়ি শাশুড়ি তাকে 'নুতন বউ' বলেই ডাকেন! আজ কুড়ি বছর পরেও, সে খুড়ি শাশুড়ির কাছে নতুন বউ-ই রয়ে গেছে! যদিও এই দীর্ঘ সময়ে দুই তরফেই ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন! নিজের শক্তিতে। শ্বশুর- শাশুড়ি দু'জনেই মারা গেছেন আর ওই তরফের খুড়ো শ্বশুরও। মারা গেছেন ওদের একমাত্র ছেলে। দুই তরফেই আজ রিক্ত-নিঃস্ব! দুই অংশই আজ রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপের!
" ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ!"
"এই তো খুড়ি-মা, আমি এসে গেছি। বলুন, কী বলবেন? বলবেন বলুন।" লাবণ্য খুড়ি-শাশুড়ির দীর্ণ-শীর্ণ শয্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে তখনও ভিজে শাড়ি জড়ানো।
"আমার যে একমুঠো গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে নুতন বউ। সঙ্গে সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুনপোড়া! তোমাদের উঠানে সেদিন দেখলাম ক'টা বেগুন হয়েছে। একমুঠো গরম ভাত আর একটু বেগুন পোড়া করে দেবে নুতন বউ?" খুড়ি-শাশুড়ির গলায় অনুনয় শুনেও লাবণ্য কোনো কথা বলতে পারছে না। স্থির চোখে অসুস্থ খুড়ি শাশুড়ির দিকে চেয়ে থাকে। বহুদিন বাদে যেন ওঁকে নতুন করে দেখছে!
সেই কুড়ি বছর আগে, এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন, নতুন বউ হয়েও অপলক চোখে চেয়ছিল ওঁর মুখের দিকে। যদিও অবস্থাপন্ন চাষী তবুও তাদের ঘরে এমন সুন্দরী মহিলা দেখবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি! পরে জেনেছিল, ওঁর সৌন্দর্য ও গুনের খ্যাতি সারা গ্রামে ছড়িয়ে আছে!
"কী হল, নুতন বউ, একমুঠো গরম ভাত রেঁধে দিতে পারবা না! দু'দিন শুধু মুড়ি খেয়ে আছি! আজ আর উঠতে পারছি না। একমুঠো গরম ভাত না খেলে তো আর উঠতে পারব না, নুতন বউ।"
লাবণ্য এতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ছিল কিন্তু আর পারলো না। "কিন্তু খুড়ি-মা, আমাদের ঘরে তো চাল বাড়ন্ত। ক'দিন ধরে আমরা শুধু রুটি খাচ্ছি। করায় দেশটা জ্বলে গাচ্ছে! মাঠে কাজ নেই। আপনাদের ছেলেও কাজ পাচ্ছে না। চাল কেনার ক্ষমতাও নেই। একটু আটা আছে, রুটি খাবেন? গরম গরম রুটি সেঁকে দিচ্ছি, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা ও তেলে মাখা বেগুন পোড়া।" ও উৎসাহ দেখায়।
"না-না, নুতন বউ, আজকে আমার খুব গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।" গলায় মিনতি ও আবদারের সুর!
" কিন্তু।"
"আমার খাটের নিচে দেখো তো, লক্ষ্মীর ঝাঁপিয়ে হয়তো এখনও একমুঠো চাল আছে। আগে তো রাখতাম।"
"দেখছি।" লাবণ্য নীচু হয়ে খাটের তলায় পুরনো আমলের টিন-কৌটা নাড়তে-নাড়তে ঝাঁপিটা পেয়ে গেল। ভিতরে একমুঠো চালও পেয়ে গেল। নীচ থেকেই বলে, "পেয়েছি, খুড়ি-মা।" তারপর বেরিয়ে এসে চালটুকু দেখায়।
বৃদ্ধার দারিদ্র্য-জীর্ণ মুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝলক! "আজ তা'লে একমুঠো গরম ভাত পাবো! তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুন পোড়ার কথা যেন ভুলো না, নুতুন বউ। তোমার শাশুড়ি খুব ভালো খেতো।"
"ঘরে ভাত ফুটছে!" বুক ভরে ফুটন্ত ভাতের গন্ধের শ্বাস টেনে, খুশী মনে লাবণ্যের স্বামী বংশী মাটির দাওয়ায় এসে বসে বুক ভরে আবার শ্বাস টেনে, "পুরাণো চাল ফোটার গন্ধ! চাল কোথায় পেলি? বউ?"
লাবণ্য উনানে কাঠ-কুটো গুঁজতে-গুঁজতে, "এ আমাদের নয়।"
"ফুটছে আমাদের উনানে আর তুই বলছিস, আমাদের নয়!" বংশীর গলায় রসিকতা!
"খুড়ি-মা ক'দিন ধরেই বিছানায় পড়ে আছেন। উঠবার ক্ষমতা নেই। তাই ওঁর চালটুকু আমি ফুটিয়ে দিচ্ছি।"কথগুলো যেন বংশীর মুখের ওপর এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল!
মুখ চুন করে , "ও।" গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে, বুক ভরে ভাতের গন্ধ টেনে, "ফ্যানটুকু আবার ফেলে দিসনে আবার।"
তারপর কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে, "আজও কোনো কাজ পেলাম না বউ। খরায় সব জ্বলছে! কারোরই কাজ দেবার ক্ষমতা নেই। কাজই নেই! এভাবে তো চলছে না বউ! তার চেয়ে চল, শহরে যাই। ওখানে তাও টুকটাক কাজ পাওয়া যাবে।" ওর কথায় লাবণ্যর সারা না পেয়ে, গামছার দুই প্রান্ত দুই মুঠোয় ধরে তা দিয়ে পিঠ ঘষতে ঘষতে, "আগে তাও একশো দিনের কাজের দু'এক দিন কাজ পেতাম, এখন তাও পঞ্চায়েতের নতুন মেম্বারেরা দিতে চায় না! বলে, "তোর কাকি যখন মেম্বার ছিল, তখন তো তোরাই তো লুটেপুটে খেয়েছিস। এখন অন্যদের খেতে দে। আচ্ছা তুমিই বলো, প্রথম যখন পঞ্চায়েতে মেয়েদের কোটা চালু হলো, চাষীর ঘরে লিখতে-পড়তে জানা মেয়ে খুঁজতে গিয়ে এক কাকিকেই পার্টির বাবুরা খুঁজে পেলো। কাকি তো নামেই মেম্বার ছিল! না ছিল ক্ষমতা, না ছিল গুছিয়ে নেবার ধান্দা! আর সেও তো বহু বছর আগে! আর কাকি যদি গুছিয়েও নিতো, তা হলে তাকে কী আজ পরের বাড়িতে গায়ে খেটে দিন গুজরাণ করতে হতো! এরা সব নতুন এসেছে। এখন এদের কী চোটপাট! বউ-এ্রর সারা না পেয়ে, হাত বাড়িয়ে তেলের শিশিটা নিয়ে হাতের চেটোয় একটু তেল নিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতে পুকুরে গেল। যাবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, "ফ্যানটুকু আবার দিসনে বলে বোউ।" বলে ভাতের হাঁড়ি দিকে শেষ বারের মত তাকায়!
লাবণ্য ধীরে-সুস্থে বেগুনের আনলা পুড়িয়ে তেল-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে, থালায় সাজিয়ে , ভ্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে, খুড়ি-শাশুড়ির ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
"খুড়ি মা, উঠুন ভাত এনেছি।" কিন্তু কোন সারা পেল না! নীচের মেঝেতে থালা রেখে, খুড়ি-শাশুড়ীকে একটু ঠেলা দিতেই তেলচিতে বালিশ থেকে মাথাটা গড়িয়ে পড়ল!
মুহূর্তের মধ্যেই একটা অনুভুতি , লাবণ্যের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো! ও বুঝতে পারে উনি আর নেই! ও ছুটে যায় বংশীকে ডাকার জন্য। পুকুর ঘাটেই পেয়ে গেল। ঘাটে ও একাই ছিল।শুনেই ছুটে আসে। এসেই বূঝতে পারে, মারাই গেছেন। সেও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!
হঠাৎ তার নাকে আসে পুরাণো চালের গরম ভাতের গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে! মেঝেতে রাখা আছে ভাতের থালা। গরম ভাত থেকে তখনও উঠছে ধোঁয়া। বংশী বুক ভরে শ্বাস টেনে গরম ভাতের গন্ধে বুক ভরিয়ে নেয়। তার চোখ একবার মৃতা খুড়ি-মা, একবার লাবণ্যের দিকে তো একবার ভাতের থালার দিকে চলাফেরা করতে থাকে!
আজ কতদিন সে ভাতের স্বাদ পায়নি! তার মনে নেই! এবার সে লাবণ্যের তাকায়। লাবণ্য জীর্ণ দরজার পাল্লায় মাথা চেপে সজল চোখে মৃতার দিকে চেয়ে আছে। তার মনের স্মৃতিতে দীর্ঘ কুড়ি বছরের টুকরো টুকরো ঘটনা একের পর এক ভেসে চলেছে!অন্য দিকে তার খেয়াল নেই।
বংশী একবার মৃতা খুড়ি মা একবার লাবণ্যের দিকে চোখ ফেরায়, পরমুহূর্তে ভাতের থালার দিকে। তার বুক ভরে ওঠে গরম ভাতের গন্ধে।
ও সামান্য ঝুঁকে নিঃশব্দে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে, চোরের মত ভ্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে নিজেদের ঘরের দাওয়ায় এসে বসে।
একমুঠো ভাত কেটে বেগুনপোড়া দিয়ে মেখে একগ্রাস ভাত হবে মূখে তুলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে খুড়িমার ক্ষুধার্ত, মৃত মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গ্রাস সমেত হাতটা থালায় নেমে আসে। মুখ নীচু করে আঙুলের ডগা দিয়ে ভাত ক'টা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎই ভাতের থালা হাতে উঠানে মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিক তাকিয়ে মুঠো মুঠো ভাত ছড়িয়ে দিতে থাকে! ছড়িয়ে পড়া ভাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝাঁক কাক!
বাবা মারা যাবার পর, খুড়িমাই বলেছিলেন, "মৃত্যুর পর আত্মারা কাকের রূপ নিয়ে আসেন, সন্তানের হাতে হবিষ্যির অন্ন পাওয়ার জন্য।" ওদের দিকে তাকিয়ে ও খুঁজতে থাকে, কোন কাকের মধ্যে লুকিয়ে আছে খুড়িমার আত্মা, ওর হাতের অন্ন পাওয়ার জন্য!
"রণেন বসু"
"নুতন বউ, ও নুতন বউ -উ -উ-উ। ও-ও নুতন বউ-উ-উ-উ!" স্নান করে ভিজে শাড়িতে সবে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই নুতন বউ লাবণ্য শুনতে পেল, খুড়ি শাশুড়ির ক্ষীণ কণ্ঠে ডাক। "ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ।"
"যাই খুড়িমা।" হাতের ভিজে কাপড়গুলো বারান্দায় রেখে, লাবণ্য ভ্যারাণ্ডার ভাঙা বেড়া ডিঙিয়ে ছোট তরফের উঠানে ঢোকে। ছোট তরফ মানে, একই বাড়ির খুড়ো শ্বশুরের অংশ। দুই তরফের বাড়িই আজ ভগ্নদশা।
কুড়ি বছর আগে, লাবণ্য যখন বউ হয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিল তখন তরফের অবস্থাই বেশ ভালো ছিলো। এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন। নিজের শাশুড়ি তখন শয্যাশায়ী। ভিন্ন শরিক হলেও সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। সেই থেকে খুড়ি শাশুড়ি তাকে 'নুতন বউ' বলেই ডাকেন! আজ কুড়ি বছর পরেও, সে খুড়ি শাশুড়ির কাছে নতুন বউ-ই রয়ে গেছে! যদিও এই দীর্ঘ সময়ে দুই তরফেই ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন! নিজের শক্তিতে। শ্বশুর- শাশুড়ি দু'জনেই মারা গেছেন আর ওই তরফের খুড়ো শ্বশুরও। মারা গেছেন ওদের একমাত্র ছেলে। দুই তরফেই আজ রিক্ত-নিঃস্ব! দুই অংশই আজ রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপের!
" ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ!"
"এই তো খুড়ি-মা, আমি এসে গেছি। বলুন, কী বলবেন? বলবেন বলুন।" লাবণ্য খুড়ি-শাশুড়ির দীর্ণ-শীর্ণ শয্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে তখনও ভিজে শাড়ি জড়ানো।
"আমার যে একমুঠো গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে নুতন বউ। সঙ্গে সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুনপোড়া! তোমাদের উঠানে সেদিন দেখলাম ক'টা বেগুন হয়েছে। একমুঠো গরম ভাত আর একটু বেগুন পোড়া করে দেবে নুতন বউ?" খুড়ি-শাশুড়ির গলায় অনুনয় শুনেও লাবণ্য কোনো কথা বলতে পারছে না। স্থির চোখে অসুস্থ খুড়ি শাশুড়ির দিকে চেয়ে থাকে। বহুদিন বাদে যেন ওঁকে নতুন করে দেখছে!
সেই কুড়ি বছর আগে, এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন, নতুন বউ হয়েও অপলক চোখে চেয়ছিল ওঁর মুখের দিকে। যদিও অবস্থাপন্ন চাষী তবুও তাদের ঘরে এমন সুন্দরী মহিলা দেখবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি! পরে জেনেছিল, ওঁর সৌন্দর্য ও গুনের খ্যাতি সারা গ্রামে ছড়িয়ে আছে!
"কী হল, নুতন বউ, একমুঠো গরম ভাত রেঁধে দিতে পারবা না! দু'দিন শুধু মুড়ি খেয়ে আছি! আজ আর উঠতে পারছি না। একমুঠো গরম ভাত না খেলে তো আর উঠতে পারব না, নুতন বউ।"
লাবণ্য এতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ছিল কিন্তু আর পারলো না। "কিন্তু খুড়ি-মা, আমাদের ঘরে তো চাল বাড়ন্ত। ক'দিন ধরে আমরা শুধু রুটি খাচ্ছি। করায় দেশটা জ্বলে গাচ্ছে! মাঠে কাজ নেই। আপনাদের ছেলেও কাজ পাচ্ছে না। চাল কেনার ক্ষমতাও নেই। একটু আটা আছে, রুটি খাবেন? গরম গরম রুটি সেঁকে দিচ্ছি, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা ও তেলে মাখা বেগুন পোড়া।" ও উৎসাহ দেখায়।
"না-না, নুতন বউ, আজকে আমার খুব গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।" গলায় মিনতি ও আবদারের সুর!
" কিন্তু।"
"আমার খাটের নিচে দেখো তো, লক্ষ্মীর ঝাঁপিয়ে হয়তো এখনও একমুঠো চাল আছে। আগে তো রাখতাম।"
"দেখছি।" লাবণ্য নীচু হয়ে খাটের তলায় পুরনো আমলের টিন-কৌটা নাড়তে-নাড়তে ঝাঁপিটা পেয়ে গেল। ভিতরে একমুঠো চালও পেয়ে গেল। নীচ থেকেই বলে, "পেয়েছি, খুড়ি-মা।" তারপর বেরিয়ে এসে চালটুকু দেখায়।
বৃদ্ধার দারিদ্র্য-জীর্ণ মুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝলক! "আজ তা'লে একমুঠো গরম ভাত পাবো! তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুন পোড়ার কথা যেন ভুলো না, নুতুন বউ। তোমার শাশুড়ি খুব ভালো খেতো।"
"ঘরে ভাত ফুটছে!" বুক ভরে ফুটন্ত ভাতের গন্ধের শ্বাস টেনে, খুশী মনে লাবণ্যের স্বামী বংশী মাটির দাওয়ায় এসে বসে বুক ভরে আবার শ্বাস টেনে, "পুরাণো চাল ফোটার গন্ধ! চাল কোথায় পেলি? বউ?"
লাবণ্য উনানে কাঠ-কুটো গুঁজতে-গুঁজতে, "এ আমাদের নয়।"
"ফুটছে আমাদের উনানে আর তুই বলছিস, আমাদের নয়!" বংশীর গলায় রসিকতা!
"খুড়ি-মা ক'দিন ধরেই বিছানায় পড়ে আছেন। উঠবার ক্ষমতা নেই। তাই ওঁর চালটুকু আমি ফুটিয়ে দিচ্ছি।"কথগুলো যেন বংশীর মুখের ওপর এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল!
মুখ চুন করে , "ও।" গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে, বুক ভরে ভাতের গন্ধ টেনে, "ফ্যানটুকু আবার ফেলে দিসনে আবার।"
তারপর কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে, "আজও কোনো কাজ পেলাম না বউ। খরায় সব জ্বলছে! কারোরই কাজ দেবার ক্ষমতা নেই। কাজই নেই! এভাবে তো চলছে না বউ! তার চেয়ে চল, শহরে যাই। ওখানে তাও টুকটাক কাজ পাওয়া যাবে।" ওর কথায় লাবণ্যর সারা না পেয়ে, গামছার দুই প্রান্ত দুই মুঠোয় ধরে তা দিয়ে পিঠ ঘষতে ঘষতে, "আগে তাও একশো দিনের কাজের দু'এক দিন কাজ পেতাম, এখন তাও পঞ্চায়েতের নতুন মেম্বারেরা দিতে চায় না! বলে, "তোর কাকি যখন মেম্বার ছিল, তখন তো তোরাই তো লুটেপুটে খেয়েছিস। এখন অন্যদের খেতে দে। আচ্ছা তুমিই বলো, প্রথম যখন পঞ্চায়েতে মেয়েদের কোটা চালু হলো, চাষীর ঘরে লিখতে-পড়তে জানা মেয়ে খুঁজতে গিয়ে এক কাকিকেই পার্টির বাবুরা খুঁজে পেলো। কাকি তো নামেই মেম্বার ছিল! না ছিল ক্ষমতা, না ছিল গুছিয়ে নেবার ধান্দা! আর সেও তো বহু বছর আগে! আর কাকি যদি গুছিয়েও নিতো, তা হলে তাকে কী আজ পরের বাড়িতে গায়ে খেটে দিন গুজরাণ করতে হতো! এরা সব নতুন এসেছে। এখন এদের কী চোটপাট! বউ-এ্রর সারা না পেয়ে, হাত বাড়িয়ে তেলের শিশিটা নিয়ে হাতের চেটোয় একটু তেল নিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতে পুকুরে গেল। যাবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, "ফ্যানটুকু আবার দিসনে বলে বোউ।" বলে ভাতের হাঁড়ি দিকে শেষ বারের মত তাকায়!
লাবণ্য ধীরে-সুস্থে বেগুনের আনলা পুড়িয়ে তেল-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে, থালায় সাজিয়ে , ভ্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে, খুড়ি-শাশুড়ির ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
"খুড়ি মা, উঠুন ভাত এনেছি।" কিন্তু কোন সারা পেল না! নীচের মেঝেতে থালা রেখে, খুড়ি-শাশুড়ীকে একটু ঠেলা দিতেই তেলচিতে বালিশ থেকে মাথাটা গড়িয়ে পড়ল!
মুহূর্তের মধ্যেই একটা অনুভুতি , লাবণ্যের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো! ও বুঝতে পারে উনি আর নেই! ও ছুটে যায় বংশীকে ডাকার জন্য। পুকুর ঘাটেই পেয়ে গেল। ঘাটে ও একাই ছিল।শুনেই ছুটে আসে। এসেই বূঝতে পারে, মারাই গেছেন। সেও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!
হঠাৎ তার নাকে আসে পুরাণো চালের গরম ভাতের গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে! মেঝেতে রাখা আছে ভাতের থালা। গরম ভাত থেকে তখনও উঠছে ধোঁয়া। বংশী বুক ভরে শ্বাস টেনে গরম ভাতের গন্ধে বুক ভরিয়ে নেয়। তার চোখ একবার মৃতা খুড়ি-মা, একবার লাবণ্যের দিকে তো একবার ভাতের থালার দিকে চলাফেরা করতে থাকে!
আজ কতদিন সে ভাতের স্বাদ পায়নি! তার মনে নেই! এবার সে লাবণ্যের তাকায়। লাবণ্য জীর্ণ দরজার পাল্লায় মাথা চেপে সজল চোখে মৃতার দিকে চেয়ে আছে। তার মনের স্মৃতিতে দীর্ঘ কুড়ি বছরের টুকরো টুকরো ঘটনা একের পর এক ভেসে চলেছে!অন্য দিকে তার খেয়াল নেই।
বংশী একবার মৃতা খুড়ি মা একবার লাবণ্যের দিকে চোখ ফেরায়, পরমুহূর্তে ভাতের থালার দিকে। তার বুক ভরে ওঠে গরম ভাতের গন্ধে।
ও সামান্য ঝুঁকে নিঃশব্দে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে, চোরের মত ভ্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে নিজেদের ঘরের দাওয়ায় এসে বসে।
একমুঠো ভাত কেটে বেগুনপোড়া দিয়ে মেখে একগ্রাস ভাত হবে মূখে তুলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে খুড়িমার ক্ষুধার্ত, মৃত মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গ্রাস সমেত হাতটা থালায় নেমে আসে। মুখ নীচু করে আঙুলের ডগা দিয়ে ভাত ক'টা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎই ভাতের থালা হাতে উঠানে মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিক তাকিয়ে মুঠো মুঠো ভাত ছড়িয়ে দিতে থাকে! ছড়িয়ে পড়া ভাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝাঁক কাক!
বাবা মারা যাবার পর, খুড়িমাই বলেছিলেন, "মৃত্যুর পর আত্মারা কাকের রূপ নিয়ে আসেন, সন্তানের হাতে হবিষ্যির অন্ন পাওয়ার জন্য।" ওদের দিকে তাকিয়ে ও খুঁজতে থাকে, কোন কাকের মধ্যে লুকিয়ে আছে খুড়িমার আত্মা, ওর হাতের অন্ন পাওয়ার জন্য!