22-01-2023, 03:20 PM
যখন এম এ পড়ছি, তখন আমার দ্বিতীয় প্রেম। প্রবুদ্ধ গুহ। সাহিত্যের অধ্যাপক। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে তাঁর চোখ দুটো এক অদ্ভুত আলো ছড়াত। মুখ গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ। সহজ অনাড়ম্বর তাঁর সাজপোশাক। পরতেন সুতির হাওয়াই শার্ট। ছিপছিপে চেহারা। সেই বয়সে একটুও মেদ জমেনি। চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ দুটো আমাকে বার্তা পাঠাত। মনে হত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমার ভেতরটা যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তাঁর প্রজ্ঞায়। বয়সে আমার থেকে অনেক বড়। বিবাহিত। তবু প্রেমে পড়লাম। যৌবনের স্বপ্নের কাজল আমার চোখ থেকে হয়তো মোছেনি। মোছেনি তমালের স্মৃতি। তবুও।
মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করলাম। কী যেন একটা অনুভব চরার মত বুকে জন্ম নিল। ভাবলাম সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। জীবনের অনিবার্য পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে হয়। বদলে যায় জীবনের মানে। এক অদৃশ্য ঘুণপোকা জীবনকে কাটতে কাটতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাই বিজনকেও মেনে নিলাম। বিয়েতে মত দিলাম। তাকে ভালবাসলাম। বিজনকে ভালবাসার ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোতে তমাল এলো তার এলোমেলো চুল আর একগাল দাড়ি নিয়ে। ভেসে এল সবুজ কবিতা। এলেন প্রবুদ্ধ গুহও তাঁর নিটোল গাম্ভীর্য -- তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। ওদের দুজনের মুখ সরিয়ে দিয়ে আমি বিজনের মুখের দিকে ঝুঁকে পড়তে চাইলাম। বিজনের চোখ, ঠোঁটের উষ্ণতা আদর হয়ে শরীরে নেমে এলেও মনের ভেতর মনে হল ঝাড়লন্ঠন ভেঙে পড়েছে - ছিন্নভিন্ন কাচের টুকরোগুলো ঝরাচ্ছে রক্তপাত।
বিয়ের দু- বছরের মধ্যেই বিভু এলো। বিজন ওর নাম রাখল বিভাস। আদর করে 'বিভু'। বিভু যখন বড় হচ্ছে, যখন ওর চোদ্দ- পনের বছর বয়স, ওর পড়ার টেবিল গোছাতে গিয়ে দেখি একটি খোলা খাতা। তার পাতায় পাতায় কবিতা। চমকে উঠলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম। কোথা থেকে পেল ও এই প্রতিভা? বিজন তো কবিতা লেখে না। এমন কি সাহিত্যে ওর রুচিও নেই। আমি সাহিত্যের ছাত্রী হলেও কবিতা কোনোদিন লিখিনি। চেষ্টা করেছি, তবু পারিনি। তবে? তবে কি মনের গোপন অন্দরে তমালের কবিতারা বয়ে যাচ্ছিল? মিশে গিয়েছিল আমার রক্তস্রোতে? যে রক্ত বিভুর ধমনীতেও বয়ে চলেছে? কেমন করে সম্ভব? বুঝতে পারিনি।
বিভু ভালবাসল একটি মেয়েকে। একদিন বিভু আর মধুশ্রী গল্প করছে বিভুর ঘরে। টেবিলে ছড়ানো বই খাতা। মধুশ্রী প্রশ্ন করছে বিভুকে -" এই তুমি সবুজ কালি দিয়ে কবিতা লেখো কেন?" আমার হাত থেকে কফির মগ মেঝেতে পড়ে ভেঙে খানখান। ওদের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম। ওরা দুজনে ছুটে এসে জড়ো করছে কাচের টুকরো। কান্না গোপন করতে আমি রান্নাঘরে।
তারপর বিভু আরও বড় হল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম বদলে যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি। ওর মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি প্রবুদ্ধকে। সেই তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি। যেন আমার ভিতরটা ও পড়ে নিচ্ছে।
কেন? কেন? কেন? নিজেকে আবার প্রশ্ন। বিজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ওদের দুজনকে ভুলতে পারিনি, তাই?
উত্তুরে হাওয়ায় শুকনো পাতারা ঝরে পড়ছে চারদিকে। বিন্দু বিন্দু রিক্ততা এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি করছে। আমি প্রবল আবেগে কাউকে জড়িয়ে ধরতে চাইছি। বিভু চেয়ার টেনে যেখানে বসেছিল, সেখানটায় রোদ সরে গেছে। ওর বোধহয় শীত করছে। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক মনে হল যেন বিজন উঠে দাঁড়াল। সেই এক ভঙ্গি। আমিও জানালা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। ঘরের চারদিকে চোখ চলে গেল। কেমন যেন একটা শীতলতা ছেয়ে যাচ্ছে আমার শরীরে। ডাক্তার যখন বিজনকে দেখে বলল, 'হি ইজ নো মোর' চারপাশটা ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হল আমার পৃথিবীটা আচমকা আলো- বাতাসহীন। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। আমার বিভুর কথা মনে হল। ওকে একটা খবর দিতে হবে। মধুশ্রীর কথাও মনে হল। সে এই শহরেই থাকে। ডাক্তারকে সেসময় কী বলেছিলাম খেয়াল নেই। শুধু মনে পড়ছে মাথার উপর তীব্র আলোটা নেভানো হয়নি। আলোটা ঘিরে একটা মথ ঘুরছে। মুহূর্তের মধ্যে একটা টিকটিকি দেয়াল বেয়ে মথটাকে গিলে নিল। আমার শ্রবণ তখন বধির। ডাক্তার যে কী বলছে, কাকে ফোন করছে, কোনো কথা কানে ঢুকছে না।
নির্বাক বসেছিলাম। সকালের ফ্লাইটে বিভু এলো। মধুশ্রী এসেছিল তারও আগে। আমার হাত ধরে বসেছিল অনেকক্ষণ।
আমি ঘরের সমস্ত আসবাবে হাত বোলালাম। বিজনের চেয়ারে টেবিলে -- যেখানে বসে ও পড়াশোনা করত। সেই গন্ধ -- সেই উষ্ণতা। বিজন তার সমস্ত চিহ্ন মুছে চলে গেছে দীর্ঘ প্রবাসে। অথচ ঘরের আসবাবপত্র বলছে, আছে, সে আছে। মনে হল চেয়ারটায় বিজন বসে আছে। আমি চেয়ার ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
বিভু এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। বুঝতে পারল, এই ঘর এখন মা-র খেলাঘর। বাবার স্মৃতি নিয়ে খেলা। মধুশ্রী বলেছিল, ' বিভু, আন্টিকে নিয়ে এখন ভীষণ ওয়ারিড আমি। একা একা কিভাবে দিন কাটাবে?' আমার কানে গিয়েছিল কথাটা। বিভু বলল,'মা-কে আমার কাছে নিয়ে যাব।' মধুশ্রী বলল, 'তাই কর। আগে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নাও। তারপর আন্টিকে নিয়ে যাও। এক বছর কেটে গেলে আমরা বিয়ে করব। এক বছর তো আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।'
ওদের কথোপকথনে আমারও চিন্তা হচ্ছে। আমি কি ওদের সঙ্গে থাকতে পারব? মাতৃত্বের অধিকারবোধ হয়তো বিঘ্ন ঘটাবে ওদের একান্ত জীবনে। আমি ওদের কিছু বলিনি।
বিভু দরজা ছেড়ে ঘরে ঢুকে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। বলল, 'বাসন্তীমাসি রান্নাবান্না সেরে কখন চলে গেছে। চল মা, কিছু খেয়ে নেবে। আমারও খুব খিদে পেয়েছে। '
নিঃশব্দে আমি আর বিভু অনেক না- বলা কথা চেপে রেখে খেয়ে নিলাম। আমাদের মাঝখানে নীরবতা নিয়ে নিঃস্তব্ধ দুপুর সঙ্গী হয়ে রইল।
শূন্য বিছানা আমাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু ঘুম যে আসে না। শুধুই ঘুমের আয়োজন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দেবার আগে পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ চলে গেল। এ কী চেহারা হয়েছে আমার! এ ক' দিনেই বয়স যেন বেড়ে গেছে। গলার চামড়া কি কুঁচকে গেল? বলিরেখা? এখন এ কথা ভেবে কী হবে? আয়নার কাছ থেকে সরে এলাম।
বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজতেই কেমন যেন একটা তন্দ্রার ঘোর। মনে পড়ল কাল রাত্রিতে একটুও ঘুমোইনি। একটা দীর্ঘঘুমের আশায় পাশবালিশটাকে চেপে ধরলাম বুকে।
হালকা তন্দ্রায় মনে হল যেন পাশে কেউ শুয়ে আছে। আমার হাত স্পর্শ করল তাকে। চমকে উঠলাম। বিজন! চোখ কচলে উঠে বসলাম। দেখি, বিজনের শূন্য জায়গায় বিভু শুয়ে আছে। অবিকল সেই একই ভঙ্গি। ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর নরম গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
বিজন চলে গেছে শরীর ছেড়ে। রেখে গেছে একটি গভীর সম্পর্ক। বিভুর মধ্যে এখন তমাল নয় -- প্রবুদ্ধ নয় -- বিজনকেই দেখতে পেলাম আমি।