22-01-2023, 03:13 PM
(This post was last modified: 22-01-2023, 03:17 PM by ddey333. Edited 4 times in total. Edited 4 times in total.)
প্রতিবিম্ব
রুচিস্মিতা ঘোষ
তমাল-- লম্বা একহারা চেহারা। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল। অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি। কবি তমাল। সে-ই আমার প্রথম প্রেম। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। আমার আর তমালের উচ্ছল সেই দিনগুলো! পাতায় পাতায় অজস্র কবিতা। সবুজ কালি দিয়ে লেখা। আমি বলতাম সবুজ কবিতা। সেই কবিতার খাতা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। পদ্মপাতার মোড়কে জলের গভীরে লুকিয়ে রেখেছি সেই প্রেম। তমাল আমার জীবনে এলো না। বাউন্ডুলে বেপরোয়া তমাল কলেজের পড়াশোনা শেষ না করেই হারিয়ে গেল আমার জীবনে ক্ষত-র উল্কি এঁকে।
রুচিস্মিতা ঘোষ
বিভু রোদের দিকে পিঠ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। ওর হাতে একটা বই। শীতের সজীব সকাল। ওর মুখের একপাশটা দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে। রোদের মিষ্টি আভা ছড়িয়ে পড়ছে ওর নিখুঁত কামানো গালে। এ কদিন ওর অশৌচ চলছিল। গালে না- কামানো দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো। বিভু মাথা কামাতে চায়নি। আমি বাধা দিইনি। আজ চুল আঁচড়েছে পরিপাটি।
শীতের এই শান্ত সকালে ওকে ঠিক দেবদূতের মত লাগছে। কালই চলে যাবে বিভু। বুক ভাঙছে আমার। ওকে তো ছেড়েছি কবেই। ওর সেই আঠারো বছর বয়সে। পড়াশোনা শেষ করে আজ কয়েক বছর ও চাকরি করছে ব্যাঙ্গালোরে। ক' দিনের ছুটি নিয়ে আসে আবার চলেও যায়। অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের চলে যাওয়া এত নিঃস্ব করছে কেন আমাকে? বিভুর বাবা চলে গেল বলে? হয়তো তাই। হঠাৎই চলে গেল বিজন। কোনো আয়োজন ছাড়াই। ঘুমের মধ্যেই হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি তখন স্থবির। বাকরুদ্ধ। অশ্রুহীন। কাকে দোষ দেব? সময়! হ্যাঁ, এখন সময়কেই প্রতারক মনে হচ্ছে। ভেতরের হু-হু কান্না চেপে রেখে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরব বুকের মধ্যে? পারছি না। হয়তো ও বড় হয়ে গেছে বলে।
এ ক'দিন আলো নিভিয়ে শুয়েছিলাম শুধু। দিনের বেলাটা লোকজনের আসা-যাওয়া। অনিবার্য কাজের ভিড়। রাতের বেলায় শুয়ে থাকতাম মন শিথিল করে। গ্রামের শান্ত পুকুরের মত ঠান্ডা হয়ে আসত ভেতরের অস্থিরতা। কাল রাতে সেই শান্তিটুকু পাইনি। স্নায়ুর উপর অদম্য চাপ তার অত্যাচার জারি রেখেছিল।
কাল রাতে বিভু এসে বসেছিল আমার পাশে। আমার হাতে ওর হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেয়েছিলাম। আমার চোখ ছাপিয়ে জল আসছিল। আসতে দিইনি। বিভু বিস্ময়ে দেখছিল তার স্থির শান্ত মা- কে। স্থির-- অবিচল এক নিস্তরঙ্গ দিঘি। সেই দিঘির তল খুঁজতে চেষ্টা করছিল। পারেনি। বিভু আর আমার মধ্যে শান্ত দুপুর বসেছিল ধ্যানমগ্ন ঋষির মত। বিভুর হাতের উষ্ণতাটুকু আমার হাতের আঙুলে সংক্রামিত হচ্ছিল। একসময় ভাঙা গলায় ও বলে উঠল -- ' মা, ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেব এবার। তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।' আমি ওকে বলতে পারিনি, আজ তুমি একা। কাল তোমার বৌ আসবে। তোমাদের দুজনের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব না থাকাই উচিত।
বিভু কি বুঝতে পেরে গিয়েছিল আমার মনের কথা? ওর চোখে, স্পর্শে সেই একই উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়ল মরা বিকেলের মত -- একই অস্তিত্বের দুটো মানুষের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল নিরুচ্চারে।
বিভু তো জানে আমার সবটুকু মিশে রয়েছে ওরই মধ্যে। সে আমার ও বিজনের মাঝখানে এক সেতু ছিল। আমার জীবনের এক টুকরো মরুদ্যান। তা বলে বিজনকে নিয়ে আমি কি কোনোদিন ভাবিনি? বিজনও জানত, সে আমার সবটুকু হতে পারে না।
হঠাৎ বাসন্তীর পায়ের আওয়াজে এলোমেলো হয়ে গেল আমার সমস্ত ভাবনা। এ ক'দিন ধরে ও-ই তো এই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হয়ে উঠেছে। তবুও সে তো কাজের লোকই। পেছন থেকে সে বলে উঠল --' বৌদি, আর কতদিন এমনভাবে চলবে বলুন তো? এবার কাজে মন দিন। আমি কি ছাই এই সংসারের সবকিছু জানি?
তার গলার স্বরে বিরক্তির সঙ্গে এক টুকরো মায়াও জড়িয়ে ছিল। আমি জানালা ধরে দাঁড়িয়েই রইলাম। ওর দিকে না ফিরে প্রত্যুত্তরে বললাম -- ' আর কয়েকটা দিন চালিয়ে দাও বাসন্তী। ' সে নির্বোধ নয়। কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালো সংসারের প্রাত্যহিক কাজে।
জানালা দিয়ে উড়ন্ত আঁচলের মত হাওয়া ভেসে আসছে। আমি গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলাম। পাশের বাড়িতে জোরদমে টিভি চলছে। বিজ্ঞাপনের বকবকম। ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ওদের বাড়ি গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিই। বারান্দায় একঝাঁক শালিক আর চড়ুই হুটোপুটি বাঁধিয়েছে। ইচ্ছে করছে না ওদের প্রাপ্য খাবারটুকু ছড়িয়ে দিই। আমার উদাসী মন শরীরটাকেও অবাধ্য করে তুলেছে। সংসার, সমস্যা, বাস্তব, পরিপার্শ্ব কিছুই আমার চেতনা স্পর্শ করছে না। মাথার পিছনদিকটায় একটা চাপ ব্যথা। প্রেসারটা কি একটু বাড়ল? বিস্মৃত অবহেলার ঝোপঝাড় থেকে উড়ে আসছে একঝাঁক স্মৃতি। আমার বিয়ের দিনটা কেন যে বড় কাছ ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে! মনে পড়ছে সব কথা।
বিভুর মনে কি একটুও অস্থিরতা নেই? কী নিবিষ্ট মনে পড়ে চলেছে বইটা। আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে বিভুর দিকে। একেবারে সেই এক চেহারা। বিজনের সেই এক বয়স। বিভুর এখন তিরিশ। বিজনও তিরিশেই বিয়ে করেছিল। মনে পড়ে যাচ্ছে বৃহদারণ্যক আর কৌষিতকির দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপনিষদের সেই লাইনগুলো -- " পিতার মৃত্যুকাল আসন্ন হলে তিনি পুত্রকে ডেকে পাঠান, মাল্য ও নববস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুত্র এসে পিতার উপর শুয়ে পড়ে। ইন্দ্রিয় দ্বারা ইন্দ্রিয় স্পর্শ করে। পিতা বলেন, -- " বাচং মে ত্বয়ি দধানি, চক্ষুর্মে ত্বয়ি দধানি, শ্রোত্রং মে ত্বয়ি দধানি -- ' আমার বচন তোমার মধ্যে দিয়ে গেলাম, আমার দেখার দৃষ্টিও তোমাকে দিয়ে গেলাম, আমার শ্রবণ তাও তোমাকে দিলাম' এমনিভাবে কাম, কর্ম, সুখ, দুঃখ, অন্ন, প্রজ্ঞা পর্যন্ত। আর পুত্র উত্তরে বলে যায় তোমার বাক, চক্ষু, শ্রবণ... প্রজ্ঞা আমি ধারণ করি।" কখন নীরবে আমার অগোচরে ঘটে গেল এত আয়োজন আর আমি জানতেও পারলাম না! বিভুকে এখন যত দেখছি, তত অবাক হচ্ছি। বিজনের সেই চোখ, নাক, কপাল এমন কি চিবুকের ডৌলটিরও কী অদ্ভুত সাদৃশ্য! যেন ঠিক তিরিশ বছরের বিজন।
পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, ছিপছিপে, ঝকঝকে চোখ। কেমিষ্ট্রির রিসার্চ ফেলো। সম্বন্ধটা এনেছিল বাবার বন্ধু অজিতকাকু। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গিয়েছিল বিজনকে। তবু বিয়েতে রাজি হতে পারিনি প্রথমে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা আমার একটা অভ্যাস। আসলে মনের মধ্যে লালন করতাম একজনকে নয়, দুজনকে।