Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
[Image: Polish-20230116-172756509.jpg]

(১৫)

টগরকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেলো গোগোলের। এর মাঝে হিয়া দু'বার ফোন করেছে, সুজাতা একবার। একজনের ফোনও ধরেনি গোগোল, শুধু হিয়াকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে .. সে একটি বিশেষ কাজে বাইরে গেছে, বাড়িতে ফিরে এসে ফোন করবে। বাইকটা স্ট্যান্ড করে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে গোগোল লক্ষ্য করলো সদর দরজার একটা পাল্লা খুব সরু করে ফাঁক করা রয়েছে, ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা বাইরে এসে পড়েছে।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সে দেখলো হাল ফ্যাশনের আসবাবপত্র দিয়ে তাদের নতুন করে সাজানো বৈঠকখানার ঘরে সুজাতার পাশে বড় সোফাটায় হিয়া আর তার মা কাবেরী দেবী বসে রয়েছে। একসময় তার হবু জামাই সন্দীপের হয়ে সুজাতার কাছে ওকালতি করা এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে বাগ-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ার জন্য তার বান্ধবী সুজাতার কাছে পরে সবিনয় ক্ষমাও চেয়ে নিলেও, তার অতীতের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, হিয়া আর তার সম্পর্কটা তিনি যে এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেননি .. এটা গোগোল ভালো করে জানে। তাই এই সময়ে হঠাৎ করে কাবেরী দেবীকে তাদের বাড়িতে দেখে কিছুটা হলেও অবাক হলো সে।

"কোথায় গেছিলে? ফিরতে এত দেরি হলো .." প্রথম প্রশ্নটা কাবেরী দেবীর তরফ থেকেই এলো।

সে নিজের বাড়িতে ঢুকছে, এমত অবস্থায় এই বাড়ির কর্ত্রী তার মামণি সুজাতার এই প্রশ্ন করার কথা। যেখানে সে নিঃশ্চুপ রয়েছে, সেখানে কাবেরী দেবীর এইরূপ প্রশ্নে যারপরনাই বিব্রত বোধ করে শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় গোগোল বললো "একটু কাজ ছিলো .."

"কি কাজ? কোথায় গেছিলে? সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি .." এবার বেশ উচ্চকন্ঠে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

ডাক্তার বসাকের শেষ কথাগুলো তখনও কানে বাজছিলো গোগোলের, তার সঙ্গে টগরের নিষ্পাপ করুন মুখটা বারবার মনে পড়ছিল তার। কিভাবে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হবে সে, কিভাবে সুস্থ করে তুলবে টগরকে .. এইসব নিয়ে কঠিন মানসিক চাপের মধ্যে ছিলো সে। এমতাবস্থায় কাবেরী দেবীর কর্কশ উচ্চকণ্ঠের কথাগুলোয় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো গোগোলের। কিছুটা পারদ চড়লো তার গলার স্বরেও "এ কি .. আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার মেয়েকে আমি মেসেজ করি জানিয়েছি - একটি বিশেষ কাজে আমাকে বাইরে যেতে হচ্ছে, বাড়িতে ফিরে এসে ফোন করবো। ওর কাছ থেকে জেনে নিন।"

"দ্যাখ .. দেখলি তো? তোর সামনে তোর মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছে .. আর তুই এখনো চুপ করে থাকবি? ওকে কিচ্ছু বলবি না?" প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে হিয়ার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

এর উত্তরে গোগোল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে হিয়া বললো "এটা ঠিক যে, ও তোমার সঙ্গে একটু উঁচু গলায় কথা বলেছে। তবে তার আগে ওর সাথে তোমার কথা বলার ভঙ্গি কিন্তু একদমই ঠিক ছিলো না .. সেটাও কিন্তু আমার চোখ এড়ায়নি মা। তাছাড়া যেখানে গোগোলের মামণি উপস্থিত আছে, সেখানে প্রথমে উনাকে কথা বলতে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত ছিলো।" তারপর গোগোলের উদ্দেশ্যে বললো "হ্যাঁ, তোমার করা মেসেজ আমি দেখেছি। তা এখন তো বাড়িতে ফিরে এসেছো, এবার বলো, কোথায় গিয়েছিলে?"

- "সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, তারপর আমি এইমাত্র বাড়িতে ঢুকলাম হিয়া। বাইরে থেকে কেউ আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে এইভাবে জেরা করা কি ঠিক? একটু সময় দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে সব বলছি। তাছাড়া আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, তোমরা এসময় এখানে? না মানে, আমি কাবেরী আন্টির কথা বলতে চাইছি, উনি হঠাৎ এই সময়ে .."

- "কেন, আমার মায়ের এই বাড়িতে আসবার কোনো সময় বেঁধে দেওয়া আছে নাকি? তাছাড়া এটা তো কোনো অসময় নয়। এখন তো খুব বেশি রাত হয়ে যায়নি, সবে সাড়ে আটটা বেজেছে। তবে তোমার যদি অসুবিধা থাকে তাহলে বলো, মাকে আমি চলে যেতে বলছি, তার সঙ্গে আমিও চলে যাচ্ছি। কিন্তু যাওয়ার আগে ওই উত্তরটা যে আমার জানতে হবে। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এই ছোট্ট একটা কথা বলতে  তোমার এত সময় লাগছে কেন?"

গোগোল, হিয়া আর কাবেরীর পারস্পরিক কথোপকথনে পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এটা বুঝতে পেরে এবার সুজাতা মুখ খুললো "আসলে বাইরে কত রকমের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটা তো ঘরের মানুষ জানে না। তাই কেউ বাইরে থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেলতে নেই, এটা আমিই ওকে ছোটবেলায় শিখিয়েছিলাম। বাড়িতে কিছু ঘটনা ঘটে গেলে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার থাকলে আমি ওকে কোনোদিন বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে কিছু বলিনি। সেটাই অভ্যেস হয়ে গেছে গোগোলের। তাই বলছিলাম .. ও ফ্রেশ হয়ে আসুক, তারপর না হয় .."

"এতক্ষণ ও কোথায় ছিলো .. এটা বলার জন্য ফ্রেশ হয়ে আসতে হবে কেন? ও আচ্ছা বুঝেছি .. পুরো ব্যাপারটা যাতে সাজিয়ে গুছিয়ে বলা যায়, সেইজন্য .. তাই না?" কাবেরী দেবীর এই উক্তিতে যেন আগুনে ঘি পড়লো। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে গোগোল বলে উঠলো "আপনি আমাকে পছন্দ করেন না জানি .. তার মানে এই নয় যে কারণে অকারণে আপনি আমাকে অপমান করবেন! আপনার সাহস হলো কি করে এই ধরনের কথা বলার? কবে, কোথায়, কখন সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলেছি আপনাকে আমি? আমি আপনাকে আবার বলছি কাবেরী আন্টি .. ডোন্ট টক টু মি লাইক দ্যাট .. আমার মানসিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নেই .."

"তুই এখনো চুপ করে থাকবি হিয়া? তোর মায়ের অপমান তুই এইভাবে মুখ বুজে সহ্য করবি?‌ আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম এই ছেলে তোর জন্য ঠিক নয়। কিন্তু কি করা যাবে .. আমার পছন্দ করা ছেলে আমার মুখে চুন কালি দিয়ে চলে গেলো। তাই এখন তো আমার মুখ বন্ধ রাখতেই হবে, আমার তো কিছু বলার উপায় নেই। তার উপর মেয়ে বড় হয়ে গেছে, এখন ওর মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।" অভিযোগের সুরে হিয়ার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

"তুমি একটু চুপ করো মা, এখন এই সমস্ত কথা বলোনা প্লিজ।" এই বলে তার মা'কে বিরত করে, গোগোলের দিকে তাকিয়ে হিয়া শান্তভাবে বললো "ঠিক আছে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর না হয় বলো কোথায় গিয়েছিলে বিশেষ কাজে .."

আর যাই হোক, কাবেরী আন্টি তাদের বাড়ির অতিথি। তাই তিনি যাই বলুন না কেন, নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে গোগোলের এইভাবে মাথা গরম করা উচিৎ হয়নি। গলার স্বর অনেকটা নরম করে হিয়াকে সে বললো "বলছিলাম, তোমরা কখন এসেছো? মামণি কিছু খাইয়েছে, নাকি শুকনো মুখে শুধু গল্পই হচ্ছে? বড় রাস্তার মোড়ের তারকদার দোকান থেকে চিকেন পকোড়া আর ফিসফ্রাই নিয়ে আসি .. খেতে খেতে গল্প করা যাবে, কেমন!"

"সে কি .. একটু আগেই তো বললে ফ্রেশ হতে ভিতরে যাবে, এখন আবার আমাদের জন্য খাবার আনতে বাইরে যেতে চাইছো। আমাদের সামনে দু-দন্ড দাঁড়াতেই পারছো না যেনো! তুমি হঠাৎ এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এর আগে তো এতো আতিথেয়তা কখনো দেখিনি! আরে আমি হলাম তোমার মামণির বান্ধবী, আমরা তোমাদের বাড়িতে আসবো আর আমার বান্ধবী আমাকে খাওয়াবে না, তা কি হয়? সুজাতা চা আর মিষ্টি দিয়েছে তো আমাদেরকে। ভালো কথা, তুমি একটু আগে বলছিলে যে তোমার মানসিক পরিস্থিতি ভালো নেই, কেন গো?" এবার
গোগোলের থেকেও গলার স্বর নরম করে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

- "না মানে, সাইটে একটু প্রবলেম হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন সরকারি কাজ তো! সবসময় যে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ঠিকঠাক পেমেন্ট আসে তা তো নয়, তাই লেবারদের নিয়ে একটু অসুবিধায় পড়েছি। এইসব নিয়েই নানারকম মানসিক অশান্তি .. সেটাই বলছিলাম।

- "তাই? আচ্ছা, সেই জন্যই ফিরতে এত দেরি হলো আজ?"

- "হ্যাঁ মানে, না মানে .. ঠিক সেইজন্য নয়। তবে কাজের সূত্রেই আমাকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিলো। তাই আজ ফিরতে একটু .."

- "কোথায় গিয়েছিলে?"

- "কনস্ট্রাকশনের কিছু জিনিস অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। পেমেন্টের জন্য শহরে যেতে হয়েছিলো আমাকে। সেইজন্যই তো দেরি হলো।"

- "আচ্ছা? তাই? একাই গিয়েছিলে নাকি .. শহরে?"

এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা গোগোল আর কাবেরী দেবীর কথোপকথনে তাল কাটলো কাবেরী দেবীর শেষ প্রশ্নে। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে আনতে আমতা করে গোগোল বললো "হ্যাঁ .. মানে অফিসিয়াল কাজ যখন, আমার একা যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক .."

"মিথ্যে কথা, এতক্ষণ ধরে সাজিয়ে গুছিয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলে চলেছো আমাদেরকে তুমি। তুমি মোটেও একা যাওনি, তোমার সঙ্গে আরও একজন ছিলো। হসপিটাল থেকে ফেরার পথে আমি তোমার বাইকের পিছনে টগরকে দেখেছি। আমি দেখলাম তুমি ওকে পেছনে বসিয়ে হাইওয়ের দিকে চলে গেলে, কিন্তু তোমরা কেউই আমাকে দেখতে পাওনি। আমি তোমাকে ঠিকই চিনেছিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমার মেয়েটা তোমার উপরের এই সৎ , ভালোমানুষ, প্রতিবাদী পুরুষের একটা মিথ্যে পর্দার আড়ালে যে একজন অসৎ , মিথ্যাবাদী , চরিত্রহীন পুরুষ লুকিয়ে আছে .. সেটা দেখতে পায়েনি। জানিনা আজ ওর বোধোদয় হবে কিনা .." চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠলেন কাবেরী দেবী।

হিয়া তার মায়ের কাছ থেকে সবকিছুই আগে শুনেছিলো। তবুও সে মনে মনে ভাবছিল তার মায়ের এই কথায় বোধহয় আবার একটা খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যাবে। তার লাটসাহেব তার মায়ের কথার প্রতিবাদ করে বলবে 'না না না এরকম কিচ্ছু হয়নি, কেউ আমার বাইকের পেছনে ছিলো না, আপনি ভুল দেখেছেন ..' এবং সেটাই সে বিশ্বাস করবে, কারণ এই পৃথিবীতে তার লাটসাহেবকে সে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে গোগোল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, অথচ তার মায়ের একটা কথার প্রতিবাদ করলো না।

★★★★

"লাটসাহেব .. কিছু বলছো না কেনো তুমি? চুপ করে আছো কেনো? দ্যাখো, এই কথাগুলো দুপুরবেলা বাড়িতে ফিরেই মা আমাকে বলেছিলো। কিন্তু মায়ের একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিনি। আমার মা যাই দেখুক না কেনো, আমি শুধু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই সত্যিটা। শুধু আমি কেনো, মামণিও শুনতে চায় তোমার মুখ থেকে সবটা। তুমি আমার ফোন রিসিভ করোনি কেনো? তুমি মেসেজে লিখেছিলে বিশেষ কাজে তোমাকে বাইরে যেতে হয়েছে। সেই বিশেষ কাজটা কি লাটসাহেব? আমাকে বলবে না সত্যিটা? তোমার বাইকের পেছনে কি সত্যিই টগর বসেছিলো?" গোগোলের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে অনুনয় করে কথাগুলো বললো হিয়া।

গোগোলের ইচ্ছা করছিলো এখনই চিৎকার করে সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দেয়। কিন্তু টগরের কাছে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তার শারীরিক অসুস্থতার কথা কাউকে এমনকি টগরের বাবা স্বপন বাবুকেও জানাতে পারবে না সে। এই মুহূর্তে তার ভিতর একটা পরস্পর বিরোধী সত্তা প্রবলভাবে কাজ করছিলো। কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখদুটো বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর হিয়ার দুটো কাঁধ ধরে তাকে মাটি থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাওয়া নিজের অনুভূতিগুলোকে অবদমিত করে , "হ্যাঁ, টগর ছিলো আমার বাইকের পেছনে .." এইটুকুই শুধু বলতে পারলো গোগোল।

মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেলো হিয়ার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি। চোয়াল দুটো শক্ত করে ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করলো "কোথায় গিয়েছিলে ওকে নিয়ে?"

"বললাম তো, কাজ ছিলো .." অত্যন্ত মৃদুস্বরে কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে ফেললো গোগোল।

- "কাজ নয় বিশেষ কাজ .. এই কথাটাই লিখেছিলে তুমি আমাকে। অনেকক্ষণ ধরে কিন্তু আমরা সবাই মিলে তোমাকে একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি। এবার কিন্তু আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে ধীরে ধীরে। কি কাজে সরি কি বিশেষ কাজে গিয়েছিলে তোমরা দু'জন?"

- "হিয়া, তুমিও আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছো? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? তুমি তো জানো, আমি কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজ করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না। আমাকে একটু সময় দাও আমি পরে সবকিছু বলবো তোমাদেরকে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কোনো কথা বলতে পারছি না।"

"হিয়া .. ও কিন্তু তোকে আবারো ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। ওর কোনো কথা আর বিশ্বাস করিস না। দ্যাখ, আমি তো তোর মা। তুই আমাকে যতই ভুল বুঝিস, আমি সবসময় তোর ভালো চাইবো। আমি বলছি এই ছেলেটা তোকে ঠকাচ্ছে। তুই একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখিস, ও একটার পর একটা মিথ্যে কথা বলে চলেছে। ও কিন্তু প্রথমে টগরের কথা স্বীকার করেনি। প্রথমে গোগোল বলেছিলো, ও নাকি অফিসিয়াল কাজে শহরে গেছে। তারপর আমি যখন চেপে ধরলাম তখন স্বীকার করলো। ওর যদি মনে পাপ না থাকবে, তাহলে টগরের কথা চেপে গেলো কেনো? তোকে মেসেজ করেই বা সেই কথা লিখতে পারলো না কেনো? তাছাড়া এখন বলছে পরে সব কথা নাকি ও বলবে। পরেই যদি বলতে পারে, তাহলে এখন এই মুহূর্তে বলতে আপত্তিটা কোথায়?" আগুনে ঘি ঢালার মতো পাশ থেকে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

দুটি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক দুরত্ব হচ্ছে পরস্পরকে ভুল বোঝা। ভুল বোঝাবুঝির ছোট একটা মুহূর্ত অনেক সময় এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে, যা পরস্পরের একসাথে কাটানো অজস্র ভালোবাসার মুহূর্তকেও ভুলিয়ে দেয়। হিয়ার মনে এখন অজস্র অজানা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে, অনেক অচেনা আশঙ্কার আবির্ভাব ঘটছে। গোগোলের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সে বললো "তুমি আমাকে মিথ্যে বললে লাটসাহেব? আমাকে? কিন্তু কেনো? আমরা তো পরস্পরের কাছে কথা দিয়েছিলাম কেউ আমরা একে অপরের কাছ থেকে কোনোদিন কিচ্ছু লুকাবো না। তবে আজ কেনো তুমি এইভাবে চুপ করে রয়েছো। বলোনা প্লিজ .. কিছু তো বলো। আমি এখনো বিশ্বাস করি .. তুমি কোনো অন্যায় করতে পারো না, কোনো অন্যায় তুমি করোনি। হয়তো এমন কোনো কারণ আছে যেটা তুমি এখন বলতে পারছো না। ঠিক আছে, সবার সামনে তুমি না বলতে পারো, আমাকে আলাদা করে বলো!"

"না না, সবার সামনে বলতে না পারার কি আছে! তোমরা আমাকে ভুল বুঝবে, তাই বলতে চাইনি কথাটা। এখন তো ভুলই ভাবছো আমাকে। এটা সেরকম কোনো ব্যাপারই নয়। আসলে .. আসলে কি জানো তো, আমি শহরেই যাচ্ছিলাম। রাস্তায় হঠাৎ করে টগরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো, ও বললো ওর একটা কাজ আছে স্টেশনের দিকে, আমি যদি ওকে একটু পৌঁছে দিই। আমি হাইওয়ের দিকে যাচ্ছিলাম, স্টেশনের তলা দিয়েই তো হাইওয়ের দিকে যেতে হয়। তাই ওকে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। দ্যাট'স অল আর কিছুই নয়। তোমরা এতক্ষণ শুধু শুধু আমাকে .." গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে মুখে অনিচ্ছাকৃত একটা হাসি আনার চেষ্টা করে খুব কষ্ট করে কথাগুলো বললো গোগোল।

"আমি একটা কথাও বিশ্বাস করছি না ওর। এই কথাগুলো তো ও শুরুতেই বলে দিতে পারতো। তাহলে এত বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হতো না। এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, এরমধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে।" আবার পাশ থেকে ফোড়ন কেটে কথাগুলো বললেন কাবেরী দেবী।

"আপনার যা খুশি আপনি ভেবে নিতে পারেন, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা। আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আর এই নিয়ে একটা কথাও আমি বলবো না .." গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিলো গোগোল।

"ঠিক আছে ঠিক আছে এখন সবাই চুপ করো, আমি কথা বলছি তো! টগরকে নিয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে, কেনো গিয়েছিলে .. সেই সম্পর্কে আমি আর নতুন করে কিছু শুনতেও চাই না, জানতেও চাই না। তুমি যেটা বললে, সেটাই আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলাম .. কারণ আমি মনে করি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাসটাই আসল। কিন্তু .. কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। এরপর থেকে, তুমি একা কোনোদিন টগরদের বাড়ি যেতে পারবে না। যদি যেতেই হয় আমার সঙ্গে যাবে, না হলে নয়। আমি যদি কোনোদিন শুনতে পাই তুমি এই কথার অবাধ্য হয়েছো, তাহলে সেই দিনেই আমাদের সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। বলো রাজি?" গোগোলের চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত শান্তভাবে অথচ দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো হিয়া।

সুন্দরী, মিষ্টিভাষী বছরে একুশের হিয়ার এইরকম ব্যক্তিত্বময়ী রূপ আগে কখনো দেখেনি গোগোল। হিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই সুজাতা বলে উঠলো "হ্যাঁ, আমিও হিয়ার সঙ্গে একমত। এই মেয়েটা যখন তার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে, তোর কথাগুলোই বিশ্বাস করেছে বা করতে চাইছে। তখন তোরও সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখা উচিৎ। আমিও চাই তুই আর টগরদের বাড়িতে কোনোদিন যাবি না। তাহলেই তো আমরা বুঝতে পারবো আজকে তোর বলা প্রত্যেকটি কথা সত্যি। আমাকে কথা দে গোগোল, তুই আর কোনোদিন ওদের বাড়ি যাবি না।"

যে তার মনের কথা সব থেকে বেশি বোঝে, তার না বলা কথাগুলোর মানে অনায়াসে বুঝতে পেরে যায় .. তার শেষ ভরসা মামণিও তাকে আজ বুঝতেই পারলো না কিংবা হয়তো বুঝতে চাইলো না। গলার কাছটা কিরকম ভারী হয়ে এলো তার। একবার হিয়া আরেকবার সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললো "ঠিক আছে .."
[+] 10 users Like Bumba_1's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 21-01-2023, 08:51 PM



Users browsing this thread: 57 Guest(s)