Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
সোয়েট-শার্ট

 
রবিবারের সকাল। একটু একটু করে হিমেল হচ্ছে সকালগুলো। কমলালেবু রঙের রোদ্দুর উঠেছে… পাশের বাড়ির দিদুর পুজো হয়ে এই সকালেই, শাঁখ বাজাচ্ছেন। এক্ষুণি মা এসে যাবেন এই ঘরে, আর ঢুকেই বলবেন "এই রিমি, উঠে পড়! সাড়ে আটটা বেজে গেল। কফি খাবি?"
প্রায় এক রুটিন প্রতি রবিবারের। সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। কফি খাওয়া। খবরের কাগজ পড়া, পড়তে পড়তেই মা লুচি বা পরোটা কিছু একটা বানিয়ে দেন। সেই জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়া। বাড়ির কাছেই একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে, 'বিকেলে ভোরের ফুল' নামের। সেখানে প্রতি রবিবার যায় রিমি। ওখানের দাদু দিদাদের সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে আসে। গল্প করে, ছবি তোলে, আড্ডা মারে। আসলে, মানুষগুলো খুব একা। বেশিরভাগ দাদু বা দিদারই নিজেদের পার্টনারেরা আকাশের তারা হয়ে গেছেন। ছেলে বা মেয়ে প্রবাস বা বিদেশে থাকেন। তাই তাঁরা বড্ড একা! আর কোভিডের ওই বিচ্ছিরি দিনগুলোর পরে রিমি বুঝেছে একা থাকার মতো অসহায়তা আর কিছুতেই নেই! তাই গতবছর থেকেই প্রতি রবিবার এই বৃদ্ধাশ্রমে আসে ও। একটু সঙ্গ দেওয়া… এইটুকুই আর কি! নইলে তো, রবিবার গুলো কোনো কিছু না করেই কেটে যেত এতগুলো বছর। সেই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, জলখাবার খাওয়া, স্নান, দুপুরের খাওয়া, ঘুম… এক বাঁধা গত! আর রবিবারের বিকেল হলেই মনে হতো আবার একটা সোমবার আসছে! ভাল্লাগেনা একটুও! ধ্যাত!
কিন্তু এখন... সোমবার গুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে রিমি। রবিবারেই গুছিয়ে রাখে সোমবারের জামা- কানের দুল- ব্যাগ...
আর এসব শুধুই সাহিলের জন্য! সাহিল ওর টিম হেড। দেখতে আহামরি কিচ্ছু না, কিন্তু ভীষণ গভীর চোখ আর অগাধ পড়াশোনা মানুষটার! বোরোলিনের লোগোতে হাতি কেন থাকে থেকে শুরু করে স্যামসাং - আই ফোনের ব্র‍্যান্ড পজিশনিং এর লড়াই - সবটাই যেন নখদর্পনে সাহিল স্যারের! যদিও, প্রথমদিনেই বলে দিয়েছিলেন "স্যার ট্যার না, উই আর টিম মেটস! আর সবাই জানো তো, টিম মানে কি? টুগেদার উই অ্যাচিভ মোর! এসো, একসাথে মিলে এমন কাজ করি যে গোটা অফিস আমাদের দেখে নিজেদের পারফরম্যান্স বাড়ানোর অনুপ্রেরণা পাক।" সত্যি বলতে কি, এর আগে দুটো কোম্পানিতে কাজ করেছে রিমি। কিন্তু এখানে এসে এতকিছু শিখতে পারছে, সাহিলের কাছ থেকে মার্কেটিং, ব্র‍্যান্ডিং এর খুঁটিনাটি… প্রতিটা দিন কাজে যেতে ভাল লাগে ওর। জানে, প্রচুর কাজ থাকবে। ডেডলাইনের আগে কাজ শেষ করার মরিয়া চেষ্টা থাকবে। আর, তারপরেই সাহিল সেনগুপ্তের কাছ থেকে "ওয়েল ডান" বা "গুড জব" মেসেজ আসবে। আর ওইটুকুর জন্যই গাধার খাটুনিতেও রাজি এখন রিমি।
এই মাস ছয়েক স্বপ্নের মতোই কাটছিল ওর। প্রতিদিনের স্প্রিন্ট মিটিং এ ঠিক হয় সেদিনের কাজের লিস্ট। সেই অনুযায়ী কাজ করতে হয়। তাই সকালগুলো বড্ড ভাল কাটে রিমির। আর, স্প্রিন্ট মিটিং শুধুই কাজের কচকচি না, প্রতি শুক্রবার একটা মিনি আড্ডা মিটিং ও হয়। যেদিন ওদের টিমের সবাই নিজেদের উইকেন্ড প্ল্যান, কি সিনেমা দেখবে, কোথায় শপিং এ যাবে - এইসব নিয়ে আলোচনা করে। সাহিলই এটার শুরু করেছে। কারণ, শুধুই কাজ করলে ওরা নাকি রোবট হয়ে যাবে। তাই। আর, সেজন্যই, শুক্রবার গুলো বড্ড প্রিয় রিমির।
মানে, এই শুক্রবারের আগেও ছিল। শুক্রবারের পর থেকেই একেবারে নিমপাতার মতো হয়ে গেছে সবটা।
হয়েছে কি, ওদের টিমের কাঁকন বলেছিল "এই শোনো না, চলো আমরা সবাই রবিবার মিট করি? ইকো পার্কের ওখানে হস্তশিল্প মেলা হচ্ছে। যাবে সবাই? একটু তাড়াতাড়ি মিট করে লাঞ্চ টাঞ্চ করে যাই? বেশ ভাল কাটবে?"
সবুজ আর আরিফ রাজি ছিল। হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ছিল। কিন্তু সাহিল বলে উঠল "তোমরা যেতেই পারো। আমার হবে না গো। রবিবার আমার অনেক কাজ থাকে।"
"একদিন ম্যানেজ করতে পারবে না?" বলেছিল আরিফ।
"না, আরিফ। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে গো। আর শুধু আমি না, আরেকজন তাতে ইনভলভড! তাই আমার হবে না গো। কিন্তু তোমরা প্লিজ যাও, মজা করো।"
"ও হো! আরেকজন! গার্লফ্রেন্ড নাকি?" কাঁকন জিজ্ঞেস করেছিল।
উত্তর দেয়নি সাহিল। একটু হেসেছিল শুধু।
কলকল করে উঠেছিল সবাই। সাহিল সেনগুপ্তের গার্লফ্রেন্ড আছে, বলেনি তো!
একটা কাঠপিঁপড়ে কামড়েছিল রিমিকে। তাও কিছু না বললে খারাপ দেখাবে বলে, বলে উঠেছিল "না না, শুধু শুধু আরেকজনের মনখারাপ করিয়ো না।"
"তার মনখারাপ করানোর কথা আমি ভাবতেও পারি না। এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের মনখারাপ হলে তো কলকাতায় নিম্নচাপ আসবে…"।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে… যতবার মনে পড়ছে কথাগুলো, রিমির মনেই নিম্নচাপ নামছে। সেই কলেজ জীবনের পরে কাউকে ভাললেগেছিল - আজকাল বেশিরভাগ ছেলেগুলোই কেমন বোকা বোকা! কোনো গভীরতা নেই বলে মনে হয়। পাঁচমিনিটও কথা বলা যায় না! তাই, এতদিন সেভাবে কাউকে পছন্দ হয়নি রিমির। সেলিব্রিটি ক্রাশ আছে অবশ্য ওর কয়েকজন। কিন্তু রিয়্যাল লাইফে এইপ্রথম এতটা উতলা হয়েছিল ও…
যাই হোক, কিছু কিছু জিনিস… হবার নয়! ডেস্টিনি!
আর, সাহিল আসবে না তো কি হয়েছে, ওরা তো যেতেই পারে মেলায়! আর অন্যকেউ না গেলে ও একাই যাবে। লাঞ্চের পরেই নাহয় যাবে! তাই ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কাঁকন, আরিফ আর সবুজকে ট্যাগ করে মেসেজ করল "তোরা চাইলে আজ হস্তশিল্প মেলায় আসতে পারিস। আমি যাচ্ছি, চারটে নাগাত। সাতটা পর্যন্ত থাকব।" প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাঁকন লিখে দিল "আমি রাজি। চারটে পারব না, পাঁচটা করবি?"
"ওকে।" লিখেছিল রিমি। তারপর বেরিয়ে গেছিল ওর কাজে।
সেন দাদু এই বিকেলে ভোরের ফুল বৃদ্ধাবাসের সেক্রেটারি। গিয়ে দেখে উনি বেজার মুখে বসে আছেন।
"কি হয়েছে দাদু, মুখ গোমড়া কেন আজ?" হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিল রিমি।
"আর বলো কেন রিমলি মা! একতলার বাথরুমের পাইপ গুলো থেকে জল পাস হচ্ছে না। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। "
"আহা, মাথাখারাপ করো না, আমি দেখছি।" বলে গুগল থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে কল করল প্লাম্বারকে। উনি এলেন, কাজে লাগলেন, কাজ শেষ হলো, তারপর রিমি বাড়ি ফিরল। আর স্নান খাওয়া সারতে সারতেই এত বেলা হয়ে গেল… আর বেরোতেই ইচ্ছে করছে না!
ওদের গ্রুপে সবুজ আর আরিফ মেসেজের কোনো উত্তর দেয় নি। তারমানে ওরা যাবে না। তাই কাঁকনকে ফোন করে রিমি। ওর বলতে খারাপ লাগছিল, কিন্তু বুঝিয়ে বলার পর কাঁকন বলে উঠল "আরে ইটস ওকে, চিল! আমিও ঘুমিয়ে নিই তাহলে একটু। কাল অফিসে দেখা হচ্ছে।"
রিমির ঘুম আসছে না… জানলা দিয়ে দেখছে মিঠেল দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল মুছে নেমে আসছে সন্ধ্যে। শীতল। একাকী।
ঠিক রিমির মতোই।
আসলে, বাবা মা, বন্ধুবান্ধব থাকলেও মাঝেমাঝে খুব একা লাগে রিমির। মনে হয় কারো আঙুল যদি ছুঁয়ে থাকা যেত! কাঁধে মাথা রাখা যেত! মনখারাপের দিনে ভিজিয়ে দেওয়া যেত কারো সোয়েট শার্টের বুক!
"আমাকে খুঁজে দে জলফড়িং!"... ওর রিংটোন শুনে চমক ভাঙল রিমির।
সাহিলের ফোন!
"হ্যালো?" অবাক হয়ে ফোন তোলে ও।
"রিমলি, তুমি কোথায়?" অনেক আওয়াজ ফোনের ওইদিকে।
"আমি? বাড়িতে।" আরও অবাক হয়ে বলে রিমি।
"বাড়িতে, মানে? তুমি হস্তশিল্প মেলায় আসোনি?"
"না গো, আমার আজ… একটু প্রবলেম ছিল। কেন?"
"শিট! এদিকে আমি এসে দাঁড়িয়ে আছি।"
"এমা, কেন? শুধু কাঁকন লিখেছিল ও আসবে, আমি তাই ওকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম।"
"অদ্ভুত মেয়ে তো! গ্রুপে লেখোনি কেন?"
"স্যরি গো…" বলতে বলতেই ভাবল রিমি, খামোকা স্যরি কেন বলবে? সাহিল তো আসবে না বলেছিল! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের মনখারাপ হলে নাকি কলকাতায় নিম্নচাপ হবে!
"কেন? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের কি হলো? কলকাতায় আর নিম্নচাপ এনো না বাবা…" বলে ওঠে রিমি। কাঠপিঁপড়েটা জোরে জোরে কামড়াচ্ছে!
"আহ! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে…"
"হ্যাঁ…সেখানেই যাও। ইকো পার্কে কেন?" রাগ রাগ গলায় বলে রিমি।
কাঁহাতক আর পিঁপড়ের কামড় সহ্য করা যায়?
"যে শুধু চূড়ান্ত এফিসিয়েন্ট তাই না, যে শুধু নিজের না, চারপাশের আর পাঁচজনের কথাও ভাবে… সেই মেয়েটা তো? যে আমি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে আড়চোখে নজর রাখে, আবার চোখে পড়লে অন্যদিকে তাকায়… আমার সব মেইল যে ফোল্ডার করে সেভ রাখে আর প্রতিদিন নিজেকে ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করে… হ্যাঁ, সেই মেয়েটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, আমার কাছে…"।
"মানে…" কানটা গরম হয়ে যাচ্ছে রিমির… হাত কাঁপছে…
"রিমলি বসুমল্লিক, যেদিন শুনেছিলাম, রবিবারে আমার মতো ল্যাদ খেয়ে, ওয়েব সিরিজ দেখে না কাটিয়ে তুমি একটি বৃদ্ধাশ্রমে যাও… কিছু ভাল মুহূর্ত তাঁদের উপহার দিতে, সেদিন থেকেই আমি দিওয়ানা হয়ে গেছি তোমার জন্য।"
"সাহিল…"
"আর হ্যাঁ, কখনও তোমার চোখে জল দেখলে বাণভাসি হব আমিও…"
ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে এবার রিমি।
ভেজানোর মতো সোয়েট শার্ট পেয়ে গেছে যে…

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 20-01-2023, 03:40 PM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)