19-01-2023, 07:46 AM
পর্ব দশ: Good হইতে…
(ক্রমশ)
১.
১৭৯১ ইঙ্গ সনের বর্ষাসিক্ত মধ্যাহ্ন। গঙ্গার বারিরাশি উৎফুল্ল হইয়া আপনবেগে বহিয়া চলিতেছে। আকাশে বারিভারনত নিকষ মেঘখণ্ডসমূহ পূর্ণবয়স্ক হস্তিনীসম ধীরে চারণ করিতেছে।
এমতাবস্থায় মৃদু পবনে পাল খাটাইয়া যাজক বেরির বোটখানি, ইংরাজদিগের ডিহি কলকেতার কুঠি হইতে, গঙ্গার উচ্চ উজানে, হুগলি নদী তীরস্থ শ্রীরামপুরে, দিনেমারদিগের ফ্রেডরিক কুঠির উদ্দেশে সবান্ধব গমন করিতেছিল।
যাজক উইলিয়াম বেরি কয়েক বৎসর হইল জাহাজযোগে ইংলন্ড দ্বীপভূমি হইতে বঙ্গদেশে পদাপর্ণ করিয়াছেন; নেটিভ, বর্বর ও পরাধীন ভারতীয়গণের হৃদয়ে, খৃষ্টের গুণকীর্তন প্রোথিত করিবার মহৎ উদ্দেশে।
কিন্তু অশিক্ষিত জাতির মধ্যে সহজে প্রভুর মহিমা প্রচারে, তাঁহার প্রধান অন্তরায় হইয়া উঠিয়াছে ভাষার প্রতিবন্ধকতা; এ দেশিয়রা বেশিরভাগই কেহ রাজ-ভাষা ইংরাজি, তিলমাত্রও অনুধাবন করিতে পারে না।
তাই এই ক্ষণে বেরি সাহেবের প্রধান শিরঃপীড়ার কারণ ঘটিয়েছে, বঙ্গালায় যিশুর বাণী তর্জমা করিবার উপায় লইয়া।
কিন্তু তাহাতেও প্রভূত অন্তরায় উপস্থিত হইয়াছে। বঙ্গালিরা মুখে বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহার করিয়া থাকলেও, লিখনের ক্ষেত্রে এখনও প্রাচীন ও দূরুহ সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করিয়া থাকে। যদিচ ', জাতি ব্যতীত, অন্য কোনও মানুষ এ দেশে নূন্যতম শিক্ষা লাভ করিয়া থাকে না।
কিন্তু বেরির একান্ত ইচ্ছা, যিশুর কথা, এই হতভাগ্য দেশে, অতি হীন ও দরিদ্রদিগের মাঝেও ছড়াইয়া দিবার। এই হেতু তিনি বঙ্গালির কথ্য ভাষাতেই বাইবেল অনুবাদের চিন্তাভাবনা শুরু করিয়াছেন।
কিন্তু কথ্য বঙ্গালার কোনও ব্যকরণ, হরফ, অথবা লিখিত নমুনা, এ দেশে নাই। ',গণ বঙ্গালাকে লেখ্য-ভাষার স্বীকৃতি দিতে ঘৃণা বোধ করিয়া থাকেন।
তথাপি এক্ষণে ধর্ম প্রচারের পূর্বে, বাঙ্গালা ভাষার একখানি লেখ্য-রূপ ও তাহার গ্রামারের সটীক প্রাইমার প্রস্তুত করিবার হেতু, বেরি সাহেব উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছেন।
প্রাথমিক কার্য কিয়ৎদূর অগ্রসরও হইয়াছে। এক্ষণে বেরি সাহেব বঙ্গালাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-প্রান্তরে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া, সহজ কথ্য বঙ্গ-ভাষার বিবিধ শব্দ সংগ্রহের কাজে আপনাকে ব্যপৃত রাখিয়াছেন। বেরির একান্ত অভিলাষ, তাঁহার রচিত বঙ্গালা প্রাইমারের প্রথম পুস্তকের পশ্চাদে, সংক্ষিপ্ত বঙ্গালা শব্দের একখানি অভিধিনও সংযুক্ত হইবে।
ডিহি কলিকাতার ইংরাজ কোম্পানির কুঠিতে কোনও আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র নাই।
কলিকাতা কুঠির বৃহৎ ভবন, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা, দুই দশক পূর্বেই মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ আসিয়া, তোপের মুখে গুঁড়া করিয়া দিয়া যাইয়াছিলেন। সেই হইতে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার ভগ্নদশা এখনও সম্পূর্ণ মেরামত হইয়া উঠে নাই।
সেই হেতুই উপায়ান্ত না দেখিয়া, বেরি মনস্থ করিয়াছেন, বঙ্গালা ভাষার প্রথম প্রাইমার বই এবং তৎসঙ্গে বঙ্গালায় অনুদিত প্রথম বাইবেলের কপি, দুই-ই দিনেমারি শ্রীরামপুর কুঠি হইতে প্রকাশিত হইবে। কারণ, ডিহি কলিকাতার সন্নিকটে, কেবল এই ফ্রেডরিকনগর শ্রীরামপুরের কুঠিতেই, একটি মুদ্রণযন্ত্র সংরক্ষিত রহিয়াছে।
তাই এই বর্ষাঘন মধ্যাহ্নে, স্ফীত গঙ্গা-বক্ষ বহিয়া, বেরি সাহেবের তরী, কলিকাতা হইতে শ্রীরামপুরের পথে উজান তুলিয়াছে।
২.
অদ্য মধ্যাহ্নের যাত্রাকালে, বেরি সাহেবের সহিত কলিকাতার এক নব্য ইঙ্গ যুবকও সংযুক্ত হইয়াছেন। ইঁহার নাম, ডিকন ইরেকশন, আথবা সংক্ষিপ্ত করিয়া, 'ডিক'।
ডিকের পিতা, পেনিসসন, অদ্য হইতে ত্রিশ বৎসর পূর্বে, উচ্চ স্কটল্যান্ড প্রদেশের এডিনবরা নগরী হইতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরর চাকুরিবৃত্তি লইয়া, ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশে এ দেশে আসিয়া পড়িয়াছিল।
কলিকাতায় পদার্পণ করিয়া, ভুখা জননেন্দ্রিয়ের তাড়নায়, ডিকের পিতা আপন ঔরস-তেজে এক নেটিভ রমণীর দ্রুত উদরস্ফীতি ঘটাইয়া ফেলেন। তাহার গর্ভেই ডিকের জন্ম হইয়াছিল।
কিন্তু প্রসবকালেই সেই নেটিভ মাতা মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছিল। এবং ডিকের পিতাও অতঃপর আর বেশিকাল জীবিত ছিলেন না।
তিনি এমনিতেই প্রবল রমণ-দোষে দুষ্ট ছিলেন; প্রতি রাতেই এক-একটি যুবতী নেটিভিনীর গর্ভনাশ ও সর্বনাশ করা, তাহার প্রিয় ক্রীড়া হইয়া উঠিয়াছিল।
কিন্তু এক অশ্রুসিক্ত শ্রাবণ রাত্রে, ডিহি কলিকাতার ডোবা ও ঘন উদ্ভিজ্জপূর্ণ বির্জিতালাও অঞ্চলে, ঘন অন্ধকারে ঘাপটি মারিয়া থাকা একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের করাল দংশনে, সহসা তিনিও নেশার্দ্র অবস্থায় আত্মরক্ষারহিত হইয়া, অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করিয়া বসেন।
সেই হেতু ডিক অনাথ হইয়া পড়ে এবং সে বাল্যকাল হইতেই ব্যান্ডেল উপাসনালয়ের পর্তুগিজ যাজক, ফাদার রডরিগেজের নিকট, পোষ্যতা লাভ করিয়া, অনাথাবস্থাতেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছিল।
বাল্যকাল হইতেই ডিক ভারি বুদ্ধিমান ও মেধাবী বালক রহিয়াছিল। তাহার মুখশ্রী সুন্দর, তনু রং ফর্সা এবং আঁখি নীল বর্ণ রহিয়াছিল।
কিন্তু বর্তমানে যুবাবস্থা প্রাপ্ত হইবার পর হইতেই, সে আপনার পিতার ন্যায় কামুক ও মদ্যপ হইয়া উঠিয়াছে।
সেই হেতু ফাদার রডরিগেজ তাহাকে ত্যাগ করিয়াছেন। সে এখন ঘাটে-আঘাটে নেটিভিনীদের দোরে-দোরে, মদ্যপাবস্থায় রাত কাটাইয়া ফেরে।
বেরি সাহেব বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। তাই তিনি সতীর্থদের উপহাস ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও, এই ট্যাঁশ-ফিরিঙ্গিটিকে তাঁহার সঙ্গে রাখিয়াছেন। ইহার একটা প্রধান কারণ হইল, ডিক মদ্যপ ও কামুক হইলেও, নেটিভদিগের সংস্পরশে দীর্ঘক্ষণ কাটাইবার হেতু, সে বঙ্গালা ভাষাটিকে বেশ ভালো বোঝে এবং বিভিন্ন বঙ্গালা শব্দ সম্পর্কে তাহার বিশেষ জ্ঞান ও জানকারি রহিয়াছে।
বেরি বলিয়াছেন, ডিক যদি তাঁহাকে মন মতো বিভিন্ন বঙ্গালা শব্দ, ব্যূৎপত্তি সহ নিয়মিত সরবরাহ করিতে পারে, তা হইলে তিনি প্রতি সপ্তাহান্তে, ডিকের হস্তে একটি করিয়া ইংল্যান্ডের রাণির নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা অর্পণ করিবেন।
এই লোভেই ডিকন পেনিসসন ইরেকশন, বেরি সাহেবের পুচ্ছ ধরিয়া, এই বোটে পদার্পণ করিয়াছিল।(ক্রমশ)