18-01-2023, 09:46 PM
পর্ব - ২
খবরটা যখন পরেরদিন পেয়েছিলাম.... সত্যি বলছি প্রথমে হা করে সুপ্রিয়া বৌদির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিলো না পল্লবী আর নেই! এই তো কয়েক মাস আগেই কথা হয়েছিল আমার সাথে রাস্তায়। আমার জোজোকে আদর করে গাল টিপে দিয়েছিলো, কোলে নিয়েছিল। অবাঙালি হলেও বেশ ভালোই বাংলা জানে সে। যদিও হিন্দির টান থাকতো কথায়। এমনকি এই পরশু সকালেও যখন ছেলেকে নিয়ে ছাদে গেছিলাম তখন দেখা পেয়েছিলাম ওর। দূর থেকে যতদূর বুঝে ছিলাম ফোনে কারোর সাথে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলো হয়তো। একবার এদিকে তাকিয়ে আমাদের দেখে ছিল। তারপরে আবার ছাদের অন্য প্রান্তে চলে গেছিলো। আজ কিনা সে আর নেই! এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো এক রাতের মধ্যে! অরিন্দম অর্থাৎ আমার স্বামী খবরটা পেয়ে ওদের বাড়ির কাছে গেছিলো সকালে কাজে বেরোনোর সময়। আমরা কয়েকজন আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন। ফিরে এসে ও জানায় খুব কান্নাকাটি চলছে। আমার না যাওয়াই ভালো। এই বলে সে বেরিয়ে যায় কাজে। আমিও আর যাইনি ওদিকে। এইটুকু ছেলেটাকে সাথে নিয়ে ওসব জায়গায় না যাওয়াই ভালো। আর নিজেও একা যেতে কেমন যেন ইচ্ছে করছিলো না। সুপ্রিয়া বৌদি আর তানিয়া বৌদির সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন কথা বলে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। একরাশ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে। আমার তার সাথে সেইভাবে ভাব বা বন্ধুত্ব কিছুই কোনোদিন ছিলোনা, ঠিকমতো চেনাও হয়নি তাকে। কিন্তু যে মানুষটা একবার আমার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করেছিল, আমার সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করেছে...... সে কাল রাতে নিজেকে শেষ করে দিলো ঐভাবে!
কাল রাত!! তাহলে কি আমি......... ওই যে আওয়াজটা পেয়েছিলাম.... ওটা কি কোনোভাবে তাহলে !!
এই দিনের আলোতেও ছ্যাত করে উঠলো আমার গা টা। পল্লবীদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা কাছে না হলেও দূরেও নয়। আমাদের ছাদ থেকে সহজেই ওদের বাড়ির তিনতলা বাড়িটার ছাদ দেখা যায়। অনেকবার ছাদে কাপড় দিতে গিয়ে দেখেছি মেয়েটাকে ওর বোনের সাথে ছাদে। দুই বোনে বয়সের বেশ তফাৎ। ছোটটা আজও বাবা মায়ের সাথে ঘুমায়। পল্লবী মেয়েটা বেশ তো ছিল হাসিখুশি। কি হলো হটাৎ করে? তাহলে কি প্রেম ঘটিত কিছু? আমি কোনোদিন কিছু না দেখলেও পাশের বাড়ির তানিয়া বৌদি নাকি ওকে দেখেছে এক দুবার একটা ছেলের সাথে। তাহলে কি সেই ব্যাপার কেন্দ্র করেই এমন কান্ড ঘটালো? নাকি বাবা মায়ের ওপর কোনো রাগ? আমার কোনোদিনই ওর সাথে খুব একটা মেলামেশা হয়নি। যতবারই দেখা হয়েছে ওই কেমন আছো আর ভালো আছোতো এর ওপর দিয়েই গেছে। কিন্তু ও বাচ্চা খুব পছন্দ করতো সেটা বুঝতাম। কারণ আমাদের ওই অল্প পরিচয়ের মধ্যেই সে একবার আমার জোজোকে এমন ভাবে আদর করেছিল যেন কতদিনের চেনা। আমার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে ওকে আর তারপরে কত কথা তার সাথে। আমিও বাঁধা দিইনি । বুঝতাম মেয়েটা বড্ড বাচ্চা ভালোবাসে। সেই মেয়েটা কিনা শেষপর্যন্ত!
উফফফফ যতবার ওই শেষ কথাটা মনে পড়ছে, ততবার কেমন কেঁপে উঠছি। এদিকে সারা বাড়িতে এখন আমি একা। শশুর শাশুড়ি গেছেন নিজের ছোট মেয়ের বাড়িতে কদিন হলো। কদিন কাটিয়ে ফিরবে। ওনারা থাকলে তাও একটা আলাদা জাঁকজমক থাকে। এখন সারাদিন আমায় একা থাকতে হচ্ছে আমার জোজোকে নিয়ে। কাল পর্যন্ত এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি কিন্তু রাতের ওই ভয় আর আজকের এই দুসংবাদ মিলে গিয়ে এই আজকের এই শ্রেয়াকে ভাবতে ও দুশ্চিন্তা করতে বাধ্য করছে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও একসময় দিন শেষে সন্ধে নামলো। আমিও এতো কিছুর মধ্যেই আমার প্রতিদিনের কাজ সেরেছি। মুন্নিদি এসে বাসন মেজে,ঘর ঝাড় দিয়ে গেছে। তার সাথেও কিছুক্ষন গল্প করে যেন কিছুটা শান্তি পেয়েছি। মুন্নিদি বহুদিন হলো এ বাড়িতে কাজ করে। তাই তাকে কাজের লোক ভাবাটা কবেই ভুলে গেছি। সে যতক্ষণ থাকে, বাড়িরই একজন হয়ে থাকে। শাশুড়ি মা ও আমরা একসাথে বসে চা খাই, টিভি দেখি তারপরে উনি চলে জান। অনেক সময় শাশুড়ি মায়ের পাড়ার এক বন্ধু সুজাতা কাকিমাও এসে আড্ডা দিয়ে জান আমাদের সাথে। এই কদিন আগে এসেও গল্প করে গেছেন আমাদের সাথে। আজ দুদিন হলো আমি আর মুন্নিদিই একসাথে গল্প করছি। ওনার সাথেও ওই বাড়ির দুর্ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষন কথা বলি। যদিও নিজের সাথে ঘটা রাতের ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছুটি বলিনি। ছেলের বাবাকেও নয়।বাড়ির কাজ সেরে কিছুক্ষন গল্প করে একসময় মুন্নিদিও চলে যায়। আবার আমি একা হয়ে যাই। একাকিত্ব কাটাতে কিছুক্ষন টিভিতে এদিক ওদিক দেখি। ছেলে তখনো ঘুমিয়ে আমাদের বেডরুমে।ওকে জাগাইনি। এইবার জাগাবো ভেবে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাবো ভাবছি হটাৎ রান্না ঘরে কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। যেন কৌটো জাতীয় কিছু পড়লো। আমি উঠে গিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যিই চাপাতার কৌটোটা পড়ে। হয়তো আমারই ভুল। অসাবধানে রেখে দিয়েছিলাম। ওটাকে তুলে যথাস্থানে রেখে দিলাম। তারপরে মনে পড়লো আমার শাড়িটা যে দুপুরে রোদে দিয়েছিলাম ছাদে, তোলা হয়নি। সেটা আনতে গেলাম আমাদের ছাদে। তখনও আলো কিছুটা আছে। যদিও অনেকটা কমে এসেছে। তাই আলো জ্বালার প্রয়োজন হলোনা। শাড়ীটা তুলে নিয়ে ফিরে আসবো.....কি মনে হতে একবার পশ্চিমের দিকে তাকালাম। ওদিকেই ওদের বাড়িটা। ঐযে দেখা যাচ্ছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িটায় কালকে রাতে। অন্ধকার আর শান্ত বাড়িটা দেখে আবার কেমন করে উঠলো আমার ভেতরটা। চোখ সরিয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি শাড়ীটা নিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলাম। এসে দেখি জোজো উঠে পড়েছে। চোখ ডলছে। ওকে কমপ্লান করে দিলাম। একটু পরেই জোজোর বাবা ফিরে এলো। আমারও একাকিত্ব সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে গেলো। বুঝলাম এটা সাময়িক একটা সমস্যা। আসলে এমন একটা খবর প্লাস রাতের ওই ভুলভাল ভয় মিলেমিশেই এই একটা অনুভূতির জাগরণ। এটা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। এই প্রথম কি আমি সারাদিন একা থেকেছি নাকি? জোজো যখন হয়নি তখনও তো একবার শশুর শাশুড়ি মেয়ের বাড়ি গেছিলো। সারা বাড়িতে একা কাটিয়েছিলাম এমনই। পাঁচ দিন। এক বিন্দুও ভয় লাগেনি।
-------------------------------------
রান্না ঘরে রান্না করছিলাম আর আমার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। মায়ের শরীরটা কদিন একটু খারাপ যাচ্ছে। ঠান্ডা গরমের ফল আরকি। আমি আর ওর জামাই অরিন্দম অনেকবার বাবা মাকে বলেছি কটা দিন আমাদের এখানে এসে থেকে যেতে। শাশুড়ি মাও কতবার এসে থেকে যেতে বলেছেন। কিন্তু আসবো আসবো করেও ওদের আসা হলোনা। কিন্তু এবার ভাবলাম মাকে কদিন আমার কাছে এনে রাখবো। সেই নিয়েই কথা বলছিলাম মায়ের সাথে ভিডিও কলে। আমিই মাকে শিখিয়েছিলাম এসব চালানো। কি প্যাড চালাতে অভ্যস্ত মায়ের একটু সময় লাগলেও বেশ তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেছিলো স্মার্টফোন চালানো। ওনার জামাই ভালোবেসে কিনে দিয়েছিলো মাকে একটা স্মার্ট ফোন। মাকেও জানালাম আজ যা ঘটেছে। সেও দুঃখ প্রকাশ করলো। সাথে যুব সমাজের এই ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকেই দু কথা শুনিয়ে দিলো। আমরা নাকি সত্যিই ভয়ানক চঞ্চল আর অদ্ভুত।কথা বলার মাঝেই মা মা হটাৎ বলে উঠলো -
- এই তিন্নি? তোর পেছনে কে রে? অরিন্দম?
তিন্নি আমার ডাক নাম। বাড়িতে আমায় বাবা মা এমনকি আমার বরটাও ওই নামেই ডাকে। মায়ের প্রশ্ন শুনে আমি তখনি পেছনে ফিরে তাকালাম। কই? কোথায় কে? পুরো গলিটা ফাঁকা। দূরের ডাইনিং রুমটা অন্ধকার। আর পাশের বেডরুমে আলো জ্বলছে। আমি আবার ফোনে মাকে বললাম - কই? কে মা? কেউ নেই তো?
- কিন্তু....... মনে হলো যে......
- কি?
- কেউ ছিল না তোর পেছনে?
- কোথায়? তুমিই দেখো? কোথায় কে?
- ওমা! তাইতো! ভুলভাল দেখছি নাকি? তিন্নি তোর বাবার মতো আমার চোখটাও গেলো মনেহয় বুঝলি..... পুরো মনে হলো তোর পেছনেই কেউ ছিল। তুই ওই কি একটা নিতে হাত বারালি না..... তখন তুই তো ফোনের ক্যামেরার বাইরে বেরিয়ে গেছিলি..... মনে হলো কেউ একজন তোর সঙ্গে সঙ্গেই তোর পেছনে সেও ক্যামেরার বাইরে চলে গেলো.....মানে সরে গেলো যেন।
মায়ের কথাটা শুনে কি ভেবে আবারো তাকালাম পেছনে। ছোট্ট রান্নাঘর। আর তার বাইরে ফাঁকা লম্বা গলি। আর রান্না ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওই কলঘরের দরজা। সেটা এখন খোলা! আর আমি সেই দরজার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে গপ্পো করছি। এতক্ষন এটা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু এখন সেটা ভাবতেই আবারো কেমন করে উঠলো আমার ভেতরটা যেন । একবার রান্নাঘরের থেকে সরে এসে ওই খোলা দরজার বাইরে তাকালাম। বাল্বটা আজ আগের মতোই জ্বলছে। তাতে ভালো করে দেখে নিলাম পুরো জায়গাটা। ফাঁকা উঠোনের মতো খোলা জায়গাটা আর একধারে কলঘর। সেখানে কোনো আলো জ্বলছেনা তাই অন্ধকার। কিন্তু টয়লেটের দরজার নিচের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ভেতরের দিকে চোখ পড়তে মনে হলো যেন কিছু নড়ে উঠলো। হালকা আলোছায়ার মাঝে স্পষ্ট মনে হলো একটা কিছু যেন টয়লেটে রয়েছে! কি ওটা? সত্যিই কি কিছু আছে নাকি চোখের ভুল? আমি ভ্রূকুটি নিয়ে হালকা ঝুঁকে নিচে আবার তাকালাম। না আর কিছু দেখলাম না। শুধুই অন্ধকার।
- কিরে? কি হলো? কোথায় গেলি?
কানে লাগানো ইয়ারফোনে মায়ের গলা পেয়ে ফোনটা আবার সামনে এনে ধরলাম। মা কি হয়েছে জিজ্ঞাস করায় বললাম কিছুই নয়। তারপরে আবার মায়ের সাথে অন্য বিষয় গল্প করতে লাগলাম। এর মধ্যেই জোজোর বাবাও এসে একবার কলঘরে গেছিলো। আমি মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে সেইদিকেই চেয়ে ছিলাম তখন। যেন একবার মনে হচ্ছিলো ও ঠিক আছে তো ওখানে? কেন এমন একটা খেয়াল এসেছিলো নিজেই জানিনা আমি। নিজের বাড়ির বাথরুমে গেছে মানুষটা, তাতে দুশ্চিন্তার কি আছে? হয়তো ওই একটু আগের ব্যাপারটার জন্য অমন মনে হচ্ছিলো। আমার সামনেই জোজোর বাবা বাথরুম করে বেরিয়ে এসে আবারো ঘরে চলে গেলো। যেন কিছুই হয়নি। আর সত্যিই তো! কি হবার কথা? কেন আমি একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এতো ভেবে ফেলছি?
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আমি ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছি আর ওর বাবা নিজের বাবা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। শুনলাম ও পল্লবীর সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে ওদের সাথে। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আমিও উঠে লাইটটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে বারান্দায় অরিন্দমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে বারান্দায় বসে সে চেয়ারে বসে কথা বলছে। বাইরের চাঁদের আলোয় জায়গাটাতে বেশ আলো আছে বলেই হয়তো আর আলো জ্বালায়নি ও। ওর কথা হলে গেলে আমিও শাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বললাম কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে। ওরা জানালো দুদিন পরেই ফিরে আসছে। বুঝলাম দাদুভাইকে ছাড়া আর বয়স্ক দুজন থাকতে পারেনা। জোজোই এখন ওদের প্রাণ। মেয়ের কন্যাও ততোধিক প্রিয় কিন্তু সে তো অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। কিছুক্ষন কথা বলে ওই দুর্ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে শেষে শুভরাত্রি বলে কলটা কেটে দিলাম। ফোনটা ওকে দিয়ে শুতে আসার জন্য বলে আমি আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় ও বলে উঠলো -
- অমন উঁকি দিয়ে দেখছিলে কেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম - মানে? কিসের উঁকি?
অরিন্দম উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল মটাকাতে মটকাতে বললো - এই যে একটু আগে কথা বলার সময়। অমন লুকিয়ে তখন মুখ বাড়িয়ে দেখছিলে কেন? কি ভাবছিলে? আমি কি অন্য করো সাথে কথা বলছিলাম নাকি হুম? হেহে হেহে
মানুষটা বলে কি? আমি আবার কখন উঁকি মেরে ওকে দেখলাম। আর অমন করে দেখবোই বা কেন ? সেটা জানাতেই সে দৃঢ় কণ্ঠে বললো সে যখন সবে শশুর মশাইয়ের সাথে ওনার ওষুধ নিয়ে কথা বলছিলো তখন নাকি একবার। চোখ যায় ডান পাশে দূরের দরজার দিকে। হালকা আলোয় নাকি সে স্পষ্ট দেখেছে আমি উঁকি দিয়ে দেখছি ওকে। সে হাত নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞেসও করে কি ব্যাপার? আমি নাকি কোনো জবাব না দিয়ে ওই একি ভাবে মাথাটা বাড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে। ছিলাম। কিন্তু ওই সময় তো আমি....... আমি নিজের ঘরে জোজোকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। হ্যা আমিও ওর কথা সব শুনতে পাচ্ছিলাম যে ও বাবাকে ঠিক সময় ওষুধ খেতে বলছে, তারপরে নিজের মাকে জানালো ওই পল্লবীর ব্যাপারটা কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তো আমি ছেলের সাথেই ছিলাম।
আমার কথা শুনে ও অবাক হয়ে বললো - আমি যে দেখলাম তোমাকে? যাচ্চোলে! এতো বড়ো ভুল হলো আমার? তুমি ছিলেনা?
হটাৎ করেই আমার ভেতরটা আবার কেমন করে উঠলো। আমি ঘুরে তাকালাম আমার পেছনে। আমার ঘর পেরিয়ে ড্রইং রুম আর তার দক্ষিণ দিকে এই বারান্দা। এখন আমি ঠিক বারান্দা আর বসার ঘরের মাঝে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। পেছনে পুরোটাই অন্ধকার। কারণ আমি নিজে একটু আগেই ঘরের আলো নিভিয়ে এসেছি। আর ঘরে আমার ছেলে ঘুমিয়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে অরিন্দম চলে গেলো ঘরের দিকে। আমিও ঘরে ঢুকে দরজা বারান্দার দরজা বন্ধ করতে গেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ গেলো সামনের দিকে। এদিকটায় বেশ অনেকগুলো সুপারি গাছ আছে আর একটা পাঁচিল আছে। আমাদের বাড়িরই উঁচু পাঁচিল। অন্ধকারে যেন একবার মনে হলো! .......... নানা.......ওসব চোখের ভুল। কি যে হচ্ছে আমার সাথে ধুর! আমি দরজা লাগিয়ে ফিরে এলাম। অরিন্দম কলঘর থেকে ঘুরে আসতে আমিও শেষবারের মতো কাজ সেরে সব আলো নিভিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। না..... একটুও কোনো ভয় পেলাম না এবারে। আশ্চর্য! তাহলে ওই মায়ের সাথে কথা বলার সময় কেন অমন হলো?
আমি শুয়ে পড়েছিলাম। অরিন্দম একটু কিছুক্ষন ফোনে খবর বা ইউটিউবে অ্যাকশন ফিল্মের ভিডিও দেখার নেশা ধরিয়েছে। আগে ওসব কিছুক্ষন দেখে সময় নস্ট করবে তারপরে ঘুমোবে। আজকেও তাই হলো। আমি ওকে তাড়াতাড়ি ওসব রেখে শুয়ে পড়তে বলে জোজোকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কখন যেন হালকা তন্দ্রায় ডুবেও গেছিলাম। হটাৎ বিছানাটা হালকা নড়ে ওঠার কম্পনে সেটা যেন কেটে গেলো। চোখ খুলে মাথাটা তুলে দেখি জোজোর বাবা কান থেকে হেডফোন খুলে স্থির হয়ে বসে। তারপরেই ও হটাৎ টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে ভুরু কুঁচকে ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ঘুমের ঘোরেই জড়ানো গলায় বললাম - কি হয়েছে? আবার আলো জ্বালালে কেন? ছেলেটা জেগে যাবে তো। নেভাও।
- একটা আওয়াজ পাচ্ছ?
ওর প্রশ্নে সামান্য অবাক হয়ে হয়তো উল্টে ওকে জিজ্ঞেস করতেই যাবো কিসের আওয়াজ তার আগেই কান পর্যন্ত পৌঁছে গেলো সেই ধ্বনি। হ্যা প্রাথমিক তন্দ্রার কারণে আমি নজর না দিলেও এবার সত্যিই শুনতে পাচ্ছি আওয়াজটা।
- কেউ কাঁদছেনা? অমনই না আওয়াজটা?
আমি ওর প্রশ্নে আমিও ভালো করে কিছুক্ষন শুনে ওর দিকে তাকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। কেউ যেন সত্যিই কাঁদছে। আর সে কান্নাটা যেন বড়ো বেদনাময়। আর সেটাই এতো রাতে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ঠিক এর সাথেই সামান্য পরেই শুরু হলো কুকুরদের আউউউউউ জাতীয় আওয়াজটা। ও গুলো ঘেউ ঘেউ করছে না। বরং যেন ওদের ওই আওয়াজেও কিছু মিশে। আর এই দুই মিলে কি যে সাংঘাতিক এক মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলেছে সেটা ভালোই টের পাচ্ছি। আমাদের যে ঘরে আমরা শুই অর্থাৎ সেই বেডরুমের বাইরের দিকেই ওই সুপারি গাছ গুলো আছে। জানলা খুললেই ওগুলো দেখা যায়। আর তার পাশে একটা জামরুল গাছ। সেটা আমার শশুর মশাই নিজের যুবা বয়সে রোপন করেছিলেন। আর তার থেকে কয়েক পা এগোলেই অক্ষয় জেঠুর দোতলা বাড়ি। বাড়িতে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা এই দুজনেই থাকে। আর এক তলায় থাকে ওদের এক কাজের মেয়ে। ওনাদের মেয়ের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। আমার মনে হলো আওয়াজটা যেন ঠিক ওদিক থেকেই আসছে।
এরই মধ্যেই একটা কুকুর শুনলাম ঠিক আমাদের এই শোবার ঘরের বাইরে পাঁচিলের ওপাশের জায়গাটা দিয়েই অমন করুন সুরে আউউউউউ করতে করতে জায়গাটা ক্রস করলো। মিথ্যে বলবোনা এমন একটা পরিবেশে গা টা ছম ছম করে উঠলো একবার। ওদিকে কান্নার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি দুজনেই। এতক্ষন একটানা কাঁদছিলো, এবার ফুপিয়ে কাঁদছে। আর ওটা যে কোনো মেয়ের গলা আর তাও কম বয়সী কেউ সেটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা।
- কে রে ভাই? এতো রাতে কাঁদে? আজব তো?
অরিন্দমের প্রশ্নে কোনো জবাব আমি দিলাম না। শুধু ইশারায় বললাম শুয়ে পড়তে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ও কি বুঝলো জানিনা কিন্তু আর কিচ্ছু না বলে ফোনটা পাশের টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লো আলোটা নিভিয়ে। প্রায় অন্ধকার ঘর, বাইরেও রাতের অন্ধকার, সারা পাড়া নিঝুম। আর শান্ত পরিবেশ কে চঞ্চল করে তোলা ওই মিশ্রিত নারী পশুর কান্না। এ যে না শুনেছে সে বোধহয় অনুধাবন করতে পারবেনা কতটা অদ্ভুতুরে! চুপচাপ দুজন শুয়ে শুনে চলেছি ওই কান্না। হটাৎ করেই এর মাঝে আরও কিছু গলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা দুজন। খুব ক্ষীণ হলেও বুঝতে পারলাম কোনো বাড়ির থেকে কেউ বা কারা যেন কিছু বলাবলি করছে। মাঝে একবার 'কে রে?' বলে কেউ চিল্লিয়ে উঠলো, তারপরে 'এই হ্যাট হ্যাট ' জাতীয় কিছু শুনলাম। তখনো কিন্তু কান্না থামেনি বরং আর আরও বড়ো ব্যাপার হলো এবার সেই কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থাৎ..... এবার সেই আওয়াজ এগিয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে!
চলবে.....