14-01-2023, 09:02 PM
সেদিন কারা যেন নীল ফানুস উড়িয়েছিল, সারারাত বাজি পুড়িয়েছিল, হই-হুল্লোড় করেছিল .. তারপর হঠাৎ করেই সব রোশনাই ভোজবাজীর মতো নিভে গিয়েছিল .. শেষ হয়েছিল উৎসবের রাত। হাওয়ার মতো ছুঁতে চাওয়া বাঁশির শব্দ আর কানে আসে না। জল দেখলেই শরীর ভেজাতে ইচ্ছে করে। মনে হয় জলের ভেতর শরীর ডুবিয়ে মুখ উঁচু করে নিঃশ্বাস নিই সারাক্ষণ। কি জানি, আজকাল কোনোকিছুই ভালো লাগে না। এখন আর আগের মতো আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাই না, স্বপ্ন দেখি না বহুকাল, মাথা যেন প্রায়শই ভার হয়ে আসে। একটানা কোনো শব্দ শুনলেই সেটাকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেবে নিয়ে বুক কাঁপে অবিরত, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলি। ঘড়ির কাঁটা আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই .. দিন যে আর কাটতে চায় না আমার।
একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে মেঘের সারি ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার কাছে। চারদিক অন্ধকার .. এতটাই যে, নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। সেই মুহূর্তে তোমার কথা মনে পড়তেই কেঁদে ফেলেছিলাম .. আমি জানি তো তুমি অন্য কারোর, কিন্তু কি করবো বলো! তবে তুমি চিন্তা করো না, একথা আমি কোনোদিনও কাউকে জানতে দেবো না, আমার মনের মনিকোঠায় রেখে দেবো এই ভালোবাসা .. চিরকাল। ঠিক তখনই মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। জানো তো, আমার আজকাল পোড়া গন্ধ খুব ভালো লাগে। চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার।
না না, আমি তখন একটু আগে ভুল বলেছিলাম। জানো তো .. এখন শুধু ঘোড়ার পায়ের শব্দ নয়, মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেও হাঁপিয়ে উঠি, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলি। যে দিক থেকে শব্দ আসে তার বিপরীত দিকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমি নিজেও জানিনা এর কারণ। আগেরদিন তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার পর তুমি যখন চলে গেলে, তখন যদি একবার ফিরে তাকাতে, তাহলে দেখতে পেতে আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি। তুমি বোধহয় আর আসবেনা .. না আসাটাই তো স্বাভাবিক। ক'টা বাজে? এতটাই অন্ধকার, ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় এখন মাঝরাত .. সকাল হতে অনেক দেরি। কিন্তু সকাল হলেই বা আমি কি করবো .. এখন কোনো কাজ আগের মতো করতে পারি না। বাবা আজকাল খুব ভয় পায় .. আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না, সারাদিন চুপচাপ খাটে বসে থাকা। অপেক্ষা .. শুধুই অপেক্ষা করে থাকি।
হিয়ার কাজল কালো চোখ দু'টো আজও ভীষণ প্রিয় আমার কাছে এবং চিরকাল থাকবে। শুধু অচেনা হয়ে গেছে তার সেই মায়াময় দৃষ্টি। মিষ্টি মধুময় তার কণ্ঠস্বর আজও খুব চেনা আমার কাছে। অচেনা হয়ে গেছে শুধু তার কথাগুলো। গোলাপের পাপড়ির মতো তার ঠোঁটের হাসি আজও আছে, কিন্তু হয়তো আগের মতো নেই তার হাসির উদ্দেশ্য আর কারণ। দখিনা বাতাসে তার মাথার একরাশ ঘন কালো চুল আজও ঢেউ খেলে যায়, তবে আগের মতো তারা আর আমার সাথে কথা বলে না। তার গালের টোল'টা আজও বাড়িয়ে দেয় সেই চেনা সৌন্দর্য, তবে আমি দৃষ্টি দিতেই সে অদৃশ্য হয়ে যায় অচেনা চাঁদের মতো। তার আলতা পায়ে হাঁটার সময় নুপুরের যে ছন্দটা .. তা আজও খুব চেনা, তবে তা আমার উপস্থিতিতে নিঃশ্চুপ হয়ে যায়, যেন আমি কোনো আগন্তুক। কেন এমন হয়, আমি নিজেও বুঝতে পারি না। হয়তো এগুলো কিছুই হয় না .. আমি নিশ্চিত এগুলো কিছুই হয় না .. সবই আমার মনের ভুল।
গভীর উপত্যকার মতো তার স্তন বিভাজিকা আজও সম্মুখে উন্মুক্ত হলে শিহরণ জাগে, অথচ সেই মুহূর্তে একটা অপরাধবোধ গ্রাস করতে থাকে আমাকে। তার শিঞ্জন আজও সেই চেনা তালেই বেজে যায়, তবে তা আর আগের মতো ঘুম ভাঙায় না আমার। অভিমানের ব্যথায় আজও কাজল ধুয়ে জল আসে। অধিকৃতের মতো আজও রাগের ফলস্বরূপ বকুনি দেয়, তবে সেই বকুনিতে বোধহয় ততটা আপনত্ব আর চোখে পড়ে না আগের মতো। কত কাছের চির চেনা সে আজ হঠাৎ করেই বড্ড অচেনা আমার কাছে। যে সময়গুলো আজও চেনা মনে হয়, দিগন্তের দূরে তা প্রায় বিস্মৃত। চেনা অচেনার এই খেলায় আমি পরাজিত। এই পৃথিবীতে আমার সব থেকে ভালোবাসার মানুষ হিয়ার কাছে অচেনা আমি, ঠিক যেন অতি কষ্টে জাগ্রত। কেন এমন হয়, আমি নিজেও বুঝতে পারি না। হয়তো এগুলো কিছুই হয় না .. আমি নিশ্চিত এগুলো কিছুই হয় না .. সবই আমার মনের ভুল। বেশ বুঝতে পারছি, গভীর থেকে গভীরতর গোলকধাঁধায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করে চলেছি আমি .. জানিনা এর থেকে মুক্তির উপায়।
প্রথম প্রেমের উষ্ণ আঁচে , নরম কাদামাটিতে গভীর ছাপ ফেলেছিল মনে। সবাই কি আর পারে একই মানুষকে বারবার ভালোবাসতে .. নতুন করে জীবনের গল্প লিখতে! অনেকেই অসমাপ্ত গল্প আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার মানে খোঁজে বাকি জীবন ধরে। কারণ হয়তো সে জানে নতুন গল্প লেখার রসদ তার কাছে আর নেই .. সমস্তটাই পুরনো গল্পেই খরচ হয়ে গিয়েছে।
কে জানে কার জীবন নদী কোথায় যায় .. আর কবে কোথায় স্রোত হারায়! বহুদিন হলো মৃত্যুকে আর সে ভয় করেনা, তবে ভয় করে একা একা মরতে। শুধু মৃত্যুর সময় এমন একজনের উপস্থিতি অন্তত থাক, যাকে দেখে মৃত্যুযন্ত্রণাও সুখের হতে পারে। শৈশবের ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারিয়ে সে পেয়েছে শুধুমাত্র অহম আর প্রবঞ্জনা। তাই বর্তমানের ভালোবাসাকে ভবিষ্যৎ করে রাখতে চায় সে। কারো পোষ্য হতে নয় .. সে বাঁচতে এসেছে হাতেহাত রেখে পাশে চলতে আজীবন। ভরাট করতে এসেছে জীবনের থেঁতলে যাওয়া ক্ষতগুলো।
কেউ যেন ভুলবশত বা হয়তো ইচ্ছে করে তার পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছিলো এতদিন, তাই হয়তো কুপমন্ডুকের মতো সে অপেক্ষা করছিলো অন্ধকারে। কিন্তু আর নয়, এভাবে বোধহয় অপেক্ষা করাটা আর ঠিক হচ্ছে না। সে যাই ভাবুক তার সম্বন্ধে, তাকে যত কটূ কথাই বলুক না কেনো, তবুও সে যাবে তার কাছে, থাকবে তার পাশে .. ওর ভালোর জন্য। দুপুরবেলা সাইট থেকে বেরোনোর আগে "আজ কাজের প্রচণ্ড চাপ .. আমি বাইরে খেয়ে নেবো, তুমি অপেক্ষা করো না।" এইটুকু বলে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেলো গোগোল।
"এ কি বাবা অনির্বাণ, অসময় তুমি? সব খবর ঠিক আছে তো?" স্বপন সাধুখাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে টগরদের বাড়ির সামনে তার রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটা স্ট্যান্ড করাতে করাতে গোগোল জানালো - শহরের একজন বিখ্যাত এমডি ইন মেডিসিনের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছে .. বিকেল চারটে নাগাদ ডাক্তারবাবু দেখবেন। তাই কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে টগরকে নিয়ে।
এতদিন তো তার ছোট মেয়ে শিউলিকে নিয়ে অনেক টানাপোড়েন অনেক চড়াই-উৎরাই এসেছে তাদের সংসারে, তাদের জীবনে। ক'দিন একটু মানসিকভাবে ধাতস্থ হতে শুরু করার মাঝেই সম্প্রতি আবার তার বড় মেয়ে টগরের ক্রমশ খারাপ হতে থাকা শারীরিক অবস্থার জন্য চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাই গোগোলের এই কথায় হারিয়ে যাওয়া ভরসা যেন ফিরে পেলেন স্বপনবাবু, "তুমি কি এখন সাইট থেকে সোজা আমাদের বাড়ি এলে বাবা? মানে আমি বলতে চাইছিলাম দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করেছো?"
"হুঁ, সাইট থেকে সোজা এখানেই আসছি। বাড়িতে যাইনি, তাই লাঞ্চ হয়নি। আসলে বাড়িতে গিয়ে খেয়েদেয়ে তারপর এলে অনেকটা দেরি হয়ে যেতো। এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে তো .." স্বপন সাধুখাঁর কথার উত্তরে জানালো গোগোল।
"আমি ঠিকই ধরেছি, মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে আমাদের অনির্বানের। তোমরা তো বাইকে করেই যাবে নিশ্চয়ই। এখন তো সবে দেড়টা বাজে, এখান থেকে শহরে যেতে মোটামুটি ঘন্টাখানেক সময় লাগে বলেই জানি। আড়াইটে নাগাদ বেরোলেই তো হবে মনে হয়। তা বলছিলাম বাবাজীবন, যদি আমাদের বাড়ি থেকে দুটো মুখে দিয়ে যেতে .." বিনয় সহকারে বললেন স্বপনবাবু।
"উনি কিছু না জেনে, না শুনে আগেই খেতে বলে দিলেন .. বলি আগে ঘরের লোককে জিজ্ঞাসা করবে তো? ভাত নেই .. সব শেষ .. এখন এই এঁটো বাসনগুলো কলপাড়ে নামাতে যাচ্ছি, বিকেলে মালতি মাসি এসে মাজবে।" ঘর থেকে একগাদা এঁটো বাসন হাতে নিয়ে বেরিয়ে কলপাড়ের দিকে যেতে যেতে তার বাবার উদ্দেশ্যে ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বললো টগর।
"না না .. ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই, আমার অভ্যাস আছে। কাজের চাপের জন্য দুপুরে মাঝেমধ্যেই খাওয়া হয় না আমার। আমরা তো শহরে যাচ্ছি, সেরকম খিদে পেলে রাস্তায় না হয় কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।" টগরের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে জানালো গোগোল।
"এ কি কথা টগর মা? বাড়িতে অতিথি এলে এইরকম ব্যবহার করতে হয় বুঝি? সেই শিক্ষা তো আমি তোমাদের দিইনি। তাছাড়া ও আমাদের অতিথি নয়, ও আমাদের আপনের লোক। আজ ও না থাকলে আমার ছোট মেয়েটাকে আমি বাঁচাতেই পারতাম না আর তুইও কোথায় হারিয়ে যেতিস ভগবান জানে। তুই জানিস ও নিজে শহরের ডাক্তারের সঙ্গে তোকে দেখানোর জন্য যোগাযোগ করেছে? ওখানকার সব থেকে বড় ডাক্তারের কাছে তোকে আজ নিয়ে যাবে। এভাবে কথা বলতে নেই মা .. ভাত ফুরিয়ে গেছে তো কি হয়েছে? তড়ি-তরকারি, মাছের ঝোল সবই তো আছে। একটু ভাত বসিয়ে দে না মা .." প্রথমে মেয়ের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কথাগুলো বললেন স্বপনবাবু।
"জানবো না কেন? আমি ভেতর থেকে সব শুনেছি। কিন্তু আমি তো ওনার সঙ্গে কোথাও যাবো না! একটা সামান্য মাইগ্রেনের প্রবলেম, এর জন্য এত আদিখ্যেতা করার কোনো দরকার নেই। আর দেখো, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পুরুষ মানুষকে অত নাক গলাতে নেই। তোমার অনির্বাণকে আমি ভাত রেঁধে দেবো কিনা, সেটা না হয় আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তুমি এখন দোকানে যাও, কলেজের মিড ডে মিলের মালগুলো রেডি করতে হবে, সে খেয়াল আছে?" পুনরায় ঝাঁঝিয়ে উঠে উত্তর দিলো টগর।
তার মেয়ের কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন স্বপনবাবু, তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে গোগোল বললো "আপনি দোকানে যান মেসোমশাই, আপনার মেয়ে আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। তাছাড়া ও তো ভাত শেষ হয়ে গিয়েছে এটা বলেছে, আমাকে খেতে দেবে না সেটা তো বলেনি! তাছাড়া ও আমার সঙ্গে অবশ্যই যাবে ডাক্তার দেখাতে, এই ব্যাপারে আপনি নির্দ্বিধায় থাকুন।" গোগোলের কথা শুনে নিশ্চিন্ত মনে দোকানের দিকে পা বাড়ালেন স্বপনবাবু।
- "বাব্বা .. নিজের প্রতি এত কনফিডেন্স?"
- "নিজের প্রতি নয়, আমার অগাধ কনফিডেন্স টগররানী ফরফরানির উপর .."
- "এই আমি তোমাকে বলেছি না, আমাকে ওই নামে ডাকবে না .. আমি মোটেই ফরফরানি নই .."
- "একশো বার ফরফরানি .. তুই যেমন সব সময় ফরফর করে চরে বেড়াস, মানে ঘুরে বেড়াস, ঠিক তেমন সব সময় ফরফর করে কথা বলিস .."
"দেখো ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি গোগোল দাদা, বড় হয়ে একটা ছোট মেয়ের হাতে মার খেতে চাও এই বয়সে?"
কপট রাগ দেখিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো টগর, আর তার পেছন পেছন গোগোল। ঘরে ঢুকেই গোগোল দেখলো শিউলি বিছানায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাই মৃদুস্বরে টগরকে বললো "থাক, আর ভাত বসিয়ে কাজ নেই, তুই বরং তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে .."
- "তুমি চুপটি করে বোনের পাশে খাটের উপর বসো তো! খিদেতে মুখ-চোখ শুকিয়ে গেছে আর মুখে বলছে খাবো না! তাছাড়া তুমি ভাবলে কি করে, তোমাকে আমি না খাইয়ে যেতে দেবো? আর শোনো, তুমি যে আমাকে তোমার সঙ্গে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে বলছো! আমার সেদিনকার দেওয়া শর্ত মনে আছে তো? বাড়িতে জানিয়েছো এই কথা? আচ্ছা বাড়ির কথা নয় ছেড়ে দিলাম হিয়া'দি কে জানিয়েছো? যদি না জানিয়ে থাকো তাহলে কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি না।"
- "হিয়া তোকে বোনের মতো স্নেহ করে, ও যদি শোনে তাহলে খুব খুশি হবে। আর মামণিও তো তোকে একদম এইটুকু বয়স থেকে দেখে আসছে, খুব ভালোবাসে তোকে। তাই মামণি জানলেও ভীষণ খুশি হবে।"
গোগোলের কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো টগর। তারপর ভাত চাপিয়ে ফিরে এসে বললো "তারমানে তুমি কাউকেই বলো নি, তাই তো?"
- "দ্যাখ টগর, রাগ করিস না .. খুব ভালো করে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। তোর যে এতটা শরীর খারাপ সে কথা তো কেউ জানে না। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টটা আজ সকালেই ফাইনাল হয়েছে .. আমি তখন সাইটে। ফোন করে সেই সময় ওদের এই কথাগুলো কি জানাবো বল? তার থেকে বরং আমরা আজ ফিরে এসে না হয় সবকিছু জানাবো! কেমন? তাছাড়া স্বপন কাকু কিন্তু ভীষণ আশা করে বসে আছে যে আমি তোকে নিয়ে যাবো। এবার যদি তুই না যাস, তাহলে কিন্তু উনি ভীষণ কষ্ট পাবেন। এভাবে নিজের বুড়ো বাবাটাকে কষ্ট দিবি? এরপরও তুই যদি না যাস, তাহলে কিন্তু আমি আজ না খেয়ে তোদের বাড়ি থেকে চলে যাবো। এবার বল, কি বলবি?"
- "আমি আর কি বলবো? শুধু ভাবছি মানুষকে কিভাবে ব্ল্যাকমেইল করা যায়, সেটা তোমার কাছ থেকে শেখা উচিৎ সবার। সেই আমাকে রাজি করিয়েই ছাড়লে! দুপুরে তো বাড়ি যাওনি বললে, আমাকে নিয়ে শহরে গেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি বাড়িতে কি বলে এখানে এসেছো?"
- ''সত্যি কথা বললে তুই তো আবার রাগ করবি .. রাগ করবি না বল, তাহলে বলছি .."
- "ঠিক আছে রাগ করবো না, এবার বলো .."
- "কাজের দোহাই দিয়ে এসেছি, সাইটে প্রচন্ড কাজের চাপ যাচ্ছে .. এটা বলেছি।"
- "ছিঃ গোগোল দাদা, তুমি আজকাল মিথ্যে বলতেও শিখে গেছো! কই আগে তো এত সহজে এরকম মিথ্যা কথা বলতে পারতে না? তুমি কেন এরকম করছো বলো তো? তুমি আমাকে নিয়ে শহরে গেছো .. এই কথাটা পরে যখন সবাই জানতে পারবে তখন কি অশান্তি হবে একবার ভেবে দেখেছো?"
- "হোক .. আমি পরোয়া করি না .. আমার পেটে কিন্তু এবার ছুঁচো ডন মারছে, তোর ভাত এখনো হয়নি? তাড়াতাড়ি খেতে দে, এরপর আমাদের বেরোতে দেরি হয়ে যাবে কিন্তু .."
অতঃপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর আড়াইটে নাগাদ রেডি হয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো টগর। কালোর উপর সোনালী জরির কাজ করা একটি সুতির সালোয়ার কামিজ পড়েছিলো সে। তার দিকে তাকিয়ে গোগোল গুনগুন করে গেয়ে উঠলো "এক যে আছে কন্যা তার দুধে আলতা বরণ, দেখতে সে নয় মন্দ, আহা পুতুল পুতুল গড়ন। মেয়ে শান্ত নয়কো মোটে, কিছু বলতে গেলেই ফোঁস করে সে ওঠে। হায়, বলবো কি আর, উল্টো যে তার অনুরাগের ধরণ।" ছোটখাটো চেহারার গোলাকার মুখমন্ডলের ফর্সা ধবধবে টগরকে ছোট্ট টিপ, হাল্কা লিপস্টিক আর এই পোশাকে অপরূপ সুন্দর লাগছিলো। শিউলি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল, গোগোলের গান শুনে তার দিকে তাকিয়ে জিভ উল্টিয়ে ভেংচি কেটে তার বোন শিউলিকে আদর করে টগর বেরিয়ে পড়লো গোগোলের সাথে। রয়্যাল এনফিল্ড বাইকে গোগোলের পিছনে তার মেয়ে বসে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই দিকে তাকিয়ে স্বপন সাধুখাঁ নিজের দুই হাত জড়ো করে মাথার উপর উঠিয়ে বলে উঠলেন "দুগ্গা দুগ্গা .."
ডাক্তারবাবু চারটের আগেই ডাকলেন ওদেরকে। টগরের মুখ থেকে ওর মেডিকেল কেস হিস্ট্রি এবং সিম্পটম গুলো শুনে গোগোলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "মেয়েটি আপনার কে হয় মিস্টার মুখার্জি .. বোন?"
কথাটা শোনার পর টগর কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গেলে, তাকে থামিয়ে দিয়ে গোগোল বললো "নাহ্ , আমার বিশেষ বন্ধু .." গোগোলের কথা শুনে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো টগর।
"আই সি .. দেখুন উনার কথা শুনে এবং উনাকে পরীক্ষা করে আমি যেটুকু বুঝলাম তার ওপর এখনই কিছু বলা সম্ভবপর নয়। তাই আমি উনার একটা এম.আর.আই করাবো এখনই। এমনিতে অফিসিয়াল রিপোর্ট পেতে আপনাদের চব্বিশ ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু কেসটা যেহেতু ক্রিটিকাল বলে আমি মনে করছি, তাই আমি চাইবো আপনারা ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে যান .. তার মধ্যে আশা করি আমি আপনাকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিতে পারবো আসলে উনার কি হয়েছে।" জানালেন ডাক্তার বসাক।
কথাগুলো শুনে উসখুস করতে থাকা টগর ফিসফিস করে গোগোলকে বললো "এখনই সাড়ে চারটে বেজে গেছে, এরপর টেস্ট হবে। তারপর আরো দুই ঘন্টা অপেক্ষা করলে বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে গোগোল দাদা। তাছাড়া উনি যে টেস্টের কথা বললেন, সেটা করতে তো অনেক টাকা লাগে .. আমি বলছি তো আমার সেরকম কিছু হয়নি আর এখন আমি ভালো আছি। এসব টেস্ট করার দরকার নেই, চলো আমরা এখন বেরিয়ে পরি।"
"একদম না .. ডাক্তারবাবু যা বলছেন, সব কথা শুনতে হবে। তোর টেস্ট হবে এবং তারপর আমরা অপেক্ষাও করবো। আর টাকাপয়সা নিয়ে তোকে পাকামি করতে হবে না, আমি আছি তো! তুই চিন্তা করিস না আমি স্বপন কাকুকে ফোন করে সব জানিয়ে দিচ্ছি।" গম্ভীর গলায় জানালো গোগোল।
"আমি বাবার কথা বলছি না .. বাবা তো জানেই তোমার সঙ্গে আমি এসেছি এবং যত রাতেই ফিরি আমাদের বাড়িতে কোনো অসুবিধা হবে না .. আমি বলছি .." টগরের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিস্টার এসে ওকে ভেতরে নিয়ে চলে গেলো।
প্রায় জনশূন্য ওয়েটিংরুমে বসে এই দু-ঘন্টা যে কোথা দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেলো, টের পেলো না ওরা দু'জন। মাঝের সময়টা কোলাহলে কিংবা নির্জনে, নৈঃশব্দে কিংবা গর্জনে, স্বপ্নে কিংবা জাগরণে, প্রলয়ে কিংবা সৃজনে, পরস্পরকে নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করলো দু'জন .. একান্তে, নিভৃতে। কেবিনের ভেতর থেকে যখন ডাক এলো, তখন চমক ভাঙলো পরস্পরের। "আপনি একটু বাইরে বসুন, ওনাকে ডাক্তারবাবু একা ডেকেছেন .." এই বলে টগরকে বাইরে বসিয়ে রেখে গোগোলকে কেবিনের ভেতর নিয়ে গেলো সিস্টার।
"বসুন মিস্টার মুখার্জি .. এই হসপিটালে আমি অত্যন্ত কটুভাষী এবং কঠিন হৃদয়ের মানুষ বলে পরিচিত। তাই সাইড টক না করে আসল প্রসঙ্গে আসি। দেখুন আপনার বিশেষ বন্ধুকে বাইরে বসতে বলে আপনাকে একা যখন ভিতরে ডেকেছি, তখন কোনো সুখবর যে দেবো না, সেটা নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছেন। সি ইজ সাফারিং ফ্রম লাস্ট স্টেজ অফ ব্রেইন টিউমার। এই সিচুয়েশনে অপারেশন করা সম্ভব নয়, সবকিছুই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। আমি মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি .. এরপর পুরোটাই ভগবানের উপর। আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কি বলতে চাইছি? আদ্যোপান্ত প্রফেশনাল এবং কঠিন হৃদয়ের মানুষ হলেও আজ ওই মেয়েটিকে দেখে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছে মিস্টার মুখার্জি। এইরকম একটা অল্পবয়সী ফুটফুটে মেয়ের এই অসুখ কি করে হতে পারে, আমি ভেবে পাই না। যাই হোক, একজন ডক্টর হিসেবে আমার কথাগুলো অত্যন্ত নাটকীয় শোনাচ্ছে বোধহয়। ওষুধ যেগুলো দিয়েছি সেগুলো চলবে। পনেরো দিন পর একবার নিয়ে আসবেন আপনার বন্ধুটিকে। এখন আপনি আসতে পারেন .. খুব যত্নে রাখবেন, খুব ভালো রাখবেন আপনার বন্ধুকে .. কোনোরকম মানসিক দুশ্চিন্তা এবং আঘাত কিন্তু ওর জন্য এই মুহূর্তে ঠিক নয়।" ধীরস্থির অথচ গম্ভীর গলায় গোগোলকে কথাগুলো জানালেন ডক্টর বসাক।
"হে ঈশ্বর .. তোমার দেওয়া প্রতিটা আঘাত আমি সযত্নে গ্রহণ করেছি, এখনো গ্রহণ করে চলেছি।
নাহ্ , সেই আঘাত তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নয়। আসলে আমি তো তোমার মতো আজও পাষাণ হতে পারি নি। কেন জানো? কারণ তোমার দেওয়া এই নীল আঘাতগুলোই আমার এগিয়ে চলার পথের পাথেয় হয়ে থেকেছে চিরকাল, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি তোমার প্রচেষ্টা সফল হতে দেবো না .. আর কাউকে হারাবো না। আমি জিতবই .." ডক্টর বসাকের কেবিন থেকে বেরিয়ে স্বগতক্তি করে উঠলো গোগোল।
"কি হয়েছে গোগোল দাদা, তোমাকে এরকম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেনো? ডাক্তারবাবু কি বললেন? আমার খুব কঠিন অসুখ হয়েছে, আমি আর বাঁচবো না .. তাই তো?" গোগোলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার দুটো হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলো টগর।
নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে টগরের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে গোগোল বললো "নাহ্ .. একদমই না, কে বলেছে এ কথা? কিচ্ছু হয়নি তোর, আমি কিছু হতে দেবো না .. আমি আছি তো! আমি সব ঠিক করে দেবো, দেখে নিস .. সব ঠিক করে দেবো .." কথা শেষ হওয়ার পর টগর দেখলো গোগোলের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।
"আমি জানিনা আমার কি হয়েছে, জানতেও চাই না। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার কিচ্ছু হতে দেবে না, সব ঠিক করে দেবে তুমি .. তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। শুধু একটাই অনুরোধ .. আমার এই অসুখের কথা তুমি কাউকে বলতে পারবে না। এমনকি আমার বাবাকেও না। অন্যের করুনা নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না .. আমার মাথার দিব্যি রইলো। আর একটা অনুরোধ .. যদি একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে যাই দূরে .. বহুদূরে, নীল আকাশে ওই মেঘেদের দলে। বলো, খুঁজবে কি আমায়? সাদা-কালো মেঘমালায় চাতক চোখে, আকাশ দেখার ছলে?" কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে এলো টগরের।
একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে মেঘের সারি ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার কাছে। চারদিক অন্ধকার .. এতটাই যে, নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। সেই মুহূর্তে তোমার কথা মনে পড়তেই কেঁদে ফেলেছিলাম .. আমি জানি তো তুমি অন্য কারোর, কিন্তু কি করবো বলো! তবে তুমি চিন্তা করো না, একথা আমি কোনোদিনও কাউকে জানতে দেবো না, আমার মনের মনিকোঠায় রেখে দেবো এই ভালোবাসা .. চিরকাল। ঠিক তখনই মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। জানো তো, আমার আজকাল পোড়া গন্ধ খুব ভালো লাগে। চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার।
না না, আমি তখন একটু আগে ভুল বলেছিলাম। জানো তো .. এখন শুধু ঘোড়ার পায়ের শব্দ নয়, মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেও হাঁপিয়ে উঠি, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলি। যে দিক থেকে শব্দ আসে তার বিপরীত দিকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমি নিজেও জানিনা এর কারণ। আগেরদিন তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার পর তুমি যখন চলে গেলে, তখন যদি একবার ফিরে তাকাতে, তাহলে দেখতে পেতে আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি। তুমি বোধহয় আর আসবেনা .. না আসাটাই তো স্বাভাবিক। ক'টা বাজে? এতটাই অন্ধকার, ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় এখন মাঝরাত .. সকাল হতে অনেক দেরি। কিন্তু সকাল হলেই বা আমি কি করবো .. এখন কোনো কাজ আগের মতো করতে পারি না। বাবা আজকাল খুব ভয় পায় .. আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না, সারাদিন চুপচাপ খাটে বসে থাকা। অপেক্ষা .. শুধুই অপেক্ষা করে থাকি।
★★★★
হিয়ার কাজল কালো চোখ দু'টো আজও ভীষণ প্রিয় আমার কাছে এবং চিরকাল থাকবে। শুধু অচেনা হয়ে গেছে তার সেই মায়াময় দৃষ্টি। মিষ্টি মধুময় তার কণ্ঠস্বর আজও খুব চেনা আমার কাছে। অচেনা হয়ে গেছে শুধু তার কথাগুলো। গোলাপের পাপড়ির মতো তার ঠোঁটের হাসি আজও আছে, কিন্তু হয়তো আগের মতো নেই তার হাসির উদ্দেশ্য আর কারণ। দখিনা বাতাসে তার মাথার একরাশ ঘন কালো চুল আজও ঢেউ খেলে যায়, তবে আগের মতো তারা আর আমার সাথে কথা বলে না। তার গালের টোল'টা আজও বাড়িয়ে দেয় সেই চেনা সৌন্দর্য, তবে আমি দৃষ্টি দিতেই সে অদৃশ্য হয়ে যায় অচেনা চাঁদের মতো। তার আলতা পায়ে হাঁটার সময় নুপুরের যে ছন্দটা .. তা আজও খুব চেনা, তবে তা আমার উপস্থিতিতে নিঃশ্চুপ হয়ে যায়, যেন আমি কোনো আগন্তুক। কেন এমন হয়, আমি নিজেও বুঝতে পারি না। হয়তো এগুলো কিছুই হয় না .. আমি নিশ্চিত এগুলো কিছুই হয় না .. সবই আমার মনের ভুল।
গভীর উপত্যকার মতো তার স্তন বিভাজিকা আজও সম্মুখে উন্মুক্ত হলে শিহরণ জাগে, অথচ সেই মুহূর্তে একটা অপরাধবোধ গ্রাস করতে থাকে আমাকে। তার শিঞ্জন আজও সেই চেনা তালেই বেজে যায়, তবে তা আর আগের মতো ঘুম ভাঙায় না আমার। অভিমানের ব্যথায় আজও কাজল ধুয়ে জল আসে। অধিকৃতের মতো আজও রাগের ফলস্বরূপ বকুনি দেয়, তবে সেই বকুনিতে বোধহয় ততটা আপনত্ব আর চোখে পড়ে না আগের মতো। কত কাছের চির চেনা সে আজ হঠাৎ করেই বড্ড অচেনা আমার কাছে। যে সময়গুলো আজও চেনা মনে হয়, দিগন্তের দূরে তা প্রায় বিস্মৃত। চেনা অচেনার এই খেলায় আমি পরাজিত। এই পৃথিবীতে আমার সব থেকে ভালোবাসার মানুষ হিয়ার কাছে অচেনা আমি, ঠিক যেন অতি কষ্টে জাগ্রত। কেন এমন হয়, আমি নিজেও বুঝতে পারি না। হয়তো এগুলো কিছুই হয় না .. আমি নিশ্চিত এগুলো কিছুই হয় না .. সবই আমার মনের ভুল। বেশ বুঝতে পারছি, গভীর থেকে গভীরতর গোলকধাঁধায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করে চলেছি আমি .. জানিনা এর থেকে মুক্তির উপায়।
প্রথম প্রেমের উষ্ণ আঁচে , নরম কাদামাটিতে গভীর ছাপ ফেলেছিল মনে। সবাই কি আর পারে একই মানুষকে বারবার ভালোবাসতে .. নতুন করে জীবনের গল্প লিখতে! অনেকেই অসমাপ্ত গল্প আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার মানে খোঁজে বাকি জীবন ধরে। কারণ হয়তো সে জানে নতুন গল্প লেখার রসদ তার কাছে আর নেই .. সমস্তটাই পুরনো গল্পেই খরচ হয়ে গিয়েছে।
কে জানে কার জীবন নদী কোথায় যায় .. আর কবে কোথায় স্রোত হারায়! বহুদিন হলো মৃত্যুকে আর সে ভয় করেনা, তবে ভয় করে একা একা মরতে। শুধু মৃত্যুর সময় এমন একজনের উপস্থিতি অন্তত থাক, যাকে দেখে মৃত্যুযন্ত্রণাও সুখের হতে পারে। শৈশবের ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারিয়ে সে পেয়েছে শুধুমাত্র অহম আর প্রবঞ্জনা। তাই বর্তমানের ভালোবাসাকে ভবিষ্যৎ করে রাখতে চায় সে। কারো পোষ্য হতে নয় .. সে বাঁচতে এসেছে হাতেহাত রেখে পাশে চলতে আজীবন। ভরাট করতে এসেছে জীবনের থেঁতলে যাওয়া ক্ষতগুলো।
কেউ যেন ভুলবশত বা হয়তো ইচ্ছে করে তার পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছিলো এতদিন, তাই হয়তো কুপমন্ডুকের মতো সে অপেক্ষা করছিলো অন্ধকারে। কিন্তু আর নয়, এভাবে বোধহয় অপেক্ষা করাটা আর ঠিক হচ্ছে না। সে যাই ভাবুক তার সম্বন্ধে, তাকে যত কটূ কথাই বলুক না কেনো, তবুও সে যাবে তার কাছে, থাকবে তার পাশে .. ওর ভালোর জন্য। দুপুরবেলা সাইট থেকে বেরোনোর আগে "আজ কাজের প্রচণ্ড চাপ .. আমি বাইরে খেয়ে নেবো, তুমি অপেক্ষা করো না।" এইটুকু বলে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেলো গোগোল।
★★★★
"এ কি বাবা অনির্বাণ, অসময় তুমি? সব খবর ঠিক আছে তো?" স্বপন সাধুখাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে টগরদের বাড়ির সামনে তার রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটা স্ট্যান্ড করাতে করাতে গোগোল জানালো - শহরের একজন বিখ্যাত এমডি ইন মেডিসিনের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছে .. বিকেল চারটে নাগাদ ডাক্তারবাবু দেখবেন। তাই কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে টগরকে নিয়ে।
এতদিন তো তার ছোট মেয়ে শিউলিকে নিয়ে অনেক টানাপোড়েন অনেক চড়াই-উৎরাই এসেছে তাদের সংসারে, তাদের জীবনে। ক'দিন একটু মানসিকভাবে ধাতস্থ হতে শুরু করার মাঝেই সম্প্রতি আবার তার বড় মেয়ে টগরের ক্রমশ খারাপ হতে থাকা শারীরিক অবস্থার জন্য চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাই গোগোলের এই কথায় হারিয়ে যাওয়া ভরসা যেন ফিরে পেলেন স্বপনবাবু, "তুমি কি এখন সাইট থেকে সোজা আমাদের বাড়ি এলে বাবা? মানে আমি বলতে চাইছিলাম দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করেছো?"
"হুঁ, সাইট থেকে সোজা এখানেই আসছি। বাড়িতে যাইনি, তাই লাঞ্চ হয়নি। আসলে বাড়িতে গিয়ে খেয়েদেয়ে তারপর এলে অনেকটা দেরি হয়ে যেতো। এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে তো .." স্বপন সাধুখাঁর কথার উত্তরে জানালো গোগোল।
"আমি ঠিকই ধরেছি, মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে আমাদের অনির্বানের। তোমরা তো বাইকে করেই যাবে নিশ্চয়ই। এখন তো সবে দেড়টা বাজে, এখান থেকে শহরে যেতে মোটামুটি ঘন্টাখানেক সময় লাগে বলেই জানি। আড়াইটে নাগাদ বেরোলেই তো হবে মনে হয়। তা বলছিলাম বাবাজীবন, যদি আমাদের বাড়ি থেকে দুটো মুখে দিয়ে যেতে .." বিনয় সহকারে বললেন স্বপনবাবু।
"উনি কিছু না জেনে, না শুনে আগেই খেতে বলে দিলেন .. বলি আগে ঘরের লোককে জিজ্ঞাসা করবে তো? ভাত নেই .. সব শেষ .. এখন এই এঁটো বাসনগুলো কলপাড়ে নামাতে যাচ্ছি, বিকেলে মালতি মাসি এসে মাজবে।" ঘর থেকে একগাদা এঁটো বাসন হাতে নিয়ে বেরিয়ে কলপাড়ের দিকে যেতে যেতে তার বাবার উদ্দেশ্যে ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বললো টগর।
"না না .. ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই, আমার অভ্যাস আছে। কাজের চাপের জন্য দুপুরে মাঝেমধ্যেই খাওয়া হয় না আমার। আমরা তো শহরে যাচ্ছি, সেরকম খিদে পেলে রাস্তায় না হয় কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।" টগরের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে জানালো গোগোল।
"এ কি কথা টগর মা? বাড়িতে অতিথি এলে এইরকম ব্যবহার করতে হয় বুঝি? সেই শিক্ষা তো আমি তোমাদের দিইনি। তাছাড়া ও আমাদের অতিথি নয়, ও আমাদের আপনের লোক। আজ ও না থাকলে আমার ছোট মেয়েটাকে আমি বাঁচাতেই পারতাম না আর তুইও কোথায় হারিয়ে যেতিস ভগবান জানে। তুই জানিস ও নিজে শহরের ডাক্তারের সঙ্গে তোকে দেখানোর জন্য যোগাযোগ করেছে? ওখানকার সব থেকে বড় ডাক্তারের কাছে তোকে আজ নিয়ে যাবে। এভাবে কথা বলতে নেই মা .. ভাত ফুরিয়ে গেছে তো কি হয়েছে? তড়ি-তরকারি, মাছের ঝোল সবই তো আছে। একটু ভাত বসিয়ে দে না মা .." প্রথমে মেয়ের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কথাগুলো বললেন স্বপনবাবু।
"জানবো না কেন? আমি ভেতর থেকে সব শুনেছি। কিন্তু আমি তো ওনার সঙ্গে কোথাও যাবো না! একটা সামান্য মাইগ্রেনের প্রবলেম, এর জন্য এত আদিখ্যেতা করার কোনো দরকার নেই। আর দেখো, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পুরুষ মানুষকে অত নাক গলাতে নেই। তোমার অনির্বাণকে আমি ভাত রেঁধে দেবো কিনা, সেটা না হয় আমার উপরেই ছেড়ে দাও। তুমি এখন দোকানে যাও, কলেজের মিড ডে মিলের মালগুলো রেডি করতে হবে, সে খেয়াল আছে?" পুনরায় ঝাঁঝিয়ে উঠে উত্তর দিলো টগর।
তার মেয়ের কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন স্বপনবাবু, তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে গোগোল বললো "আপনি দোকানে যান মেসোমশাই, আপনার মেয়ে আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। তাছাড়া ও তো ভাত শেষ হয়ে গিয়েছে এটা বলেছে, আমাকে খেতে দেবে না সেটা তো বলেনি! তাছাড়া ও আমার সঙ্গে অবশ্যই যাবে ডাক্তার দেখাতে, এই ব্যাপারে আপনি নির্দ্বিধায় থাকুন।" গোগোলের কথা শুনে নিশ্চিন্ত মনে দোকানের দিকে পা বাড়ালেন স্বপনবাবু।
- "বাব্বা .. নিজের প্রতি এত কনফিডেন্স?"
- "নিজের প্রতি নয়, আমার অগাধ কনফিডেন্স টগররানী ফরফরানির উপর .."
- "এই আমি তোমাকে বলেছি না, আমাকে ওই নামে ডাকবে না .. আমি মোটেই ফরফরানি নই .."
- "একশো বার ফরফরানি .. তুই যেমন সব সময় ফরফর করে চরে বেড়াস, মানে ঘুরে বেড়াস, ঠিক তেমন সব সময় ফরফর করে কথা বলিস .."
"দেখো ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি গোগোল দাদা, বড় হয়ে একটা ছোট মেয়ের হাতে মার খেতে চাও এই বয়সে?"
কপট রাগ দেখিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো টগর, আর তার পেছন পেছন গোগোল। ঘরে ঢুকেই গোগোল দেখলো শিউলি বিছানায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাই মৃদুস্বরে টগরকে বললো "থাক, আর ভাত বসিয়ে কাজ নেই, তুই বরং তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে .."
- "তুমি চুপটি করে বোনের পাশে খাটের উপর বসো তো! খিদেতে মুখ-চোখ শুকিয়ে গেছে আর মুখে বলছে খাবো না! তাছাড়া তুমি ভাবলে কি করে, তোমাকে আমি না খাইয়ে যেতে দেবো? আর শোনো, তুমি যে আমাকে তোমার সঙ্গে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে বলছো! আমার সেদিনকার দেওয়া শর্ত মনে আছে তো? বাড়িতে জানিয়েছো এই কথা? আচ্ছা বাড়ির কথা নয় ছেড়ে দিলাম হিয়া'দি কে জানিয়েছো? যদি না জানিয়ে থাকো তাহলে কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি না।"
- "হিয়া তোকে বোনের মতো স্নেহ করে, ও যদি শোনে তাহলে খুব খুশি হবে। আর মামণিও তো তোকে একদম এইটুকু বয়স থেকে দেখে আসছে, খুব ভালোবাসে তোকে। তাই মামণি জানলেও ভীষণ খুশি হবে।"
গোগোলের কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো টগর। তারপর ভাত চাপিয়ে ফিরে এসে বললো "তারমানে তুমি কাউকেই বলো নি, তাই তো?"
- "দ্যাখ টগর, রাগ করিস না .. খুব ভালো করে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। তোর যে এতটা শরীর খারাপ সে কথা তো কেউ জানে না। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টটা আজ সকালেই ফাইনাল হয়েছে .. আমি তখন সাইটে। ফোন করে সেই সময় ওদের এই কথাগুলো কি জানাবো বল? তার থেকে বরং আমরা আজ ফিরে এসে না হয় সবকিছু জানাবো! কেমন? তাছাড়া স্বপন কাকু কিন্তু ভীষণ আশা করে বসে আছে যে আমি তোকে নিয়ে যাবো। এবার যদি তুই না যাস, তাহলে কিন্তু উনি ভীষণ কষ্ট পাবেন। এভাবে নিজের বুড়ো বাবাটাকে কষ্ট দিবি? এরপরও তুই যদি না যাস, তাহলে কিন্তু আমি আজ না খেয়ে তোদের বাড়ি থেকে চলে যাবো। এবার বল, কি বলবি?"
- "আমি আর কি বলবো? শুধু ভাবছি মানুষকে কিভাবে ব্ল্যাকমেইল করা যায়, সেটা তোমার কাছ থেকে শেখা উচিৎ সবার। সেই আমাকে রাজি করিয়েই ছাড়লে! দুপুরে তো বাড়ি যাওনি বললে, আমাকে নিয়ে শহরে গেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি বাড়িতে কি বলে এখানে এসেছো?"
- ''সত্যি কথা বললে তুই তো আবার রাগ করবি .. রাগ করবি না বল, তাহলে বলছি .."
- "ঠিক আছে রাগ করবো না, এবার বলো .."
- "কাজের দোহাই দিয়ে এসেছি, সাইটে প্রচন্ড কাজের চাপ যাচ্ছে .. এটা বলেছি।"
- "ছিঃ গোগোল দাদা, তুমি আজকাল মিথ্যে বলতেও শিখে গেছো! কই আগে তো এত সহজে এরকম মিথ্যা কথা বলতে পারতে না? তুমি কেন এরকম করছো বলো তো? তুমি আমাকে নিয়ে শহরে গেছো .. এই কথাটা পরে যখন সবাই জানতে পারবে তখন কি অশান্তি হবে একবার ভেবে দেখেছো?"
- "হোক .. আমি পরোয়া করি না .. আমার পেটে কিন্তু এবার ছুঁচো ডন মারছে, তোর ভাত এখনো হয়নি? তাড়াতাড়ি খেতে দে, এরপর আমাদের বেরোতে দেরি হয়ে যাবে কিন্তু .."
অতঃপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর আড়াইটে নাগাদ রেডি হয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো টগর। কালোর উপর সোনালী জরির কাজ করা একটি সুতির সালোয়ার কামিজ পড়েছিলো সে। তার দিকে তাকিয়ে গোগোল গুনগুন করে গেয়ে উঠলো "এক যে আছে কন্যা তার দুধে আলতা বরণ, দেখতে সে নয় মন্দ, আহা পুতুল পুতুল গড়ন। মেয়ে শান্ত নয়কো মোটে, কিছু বলতে গেলেই ফোঁস করে সে ওঠে। হায়, বলবো কি আর, উল্টো যে তার অনুরাগের ধরণ।" ছোটখাটো চেহারার গোলাকার মুখমন্ডলের ফর্সা ধবধবে টগরকে ছোট্ট টিপ, হাল্কা লিপস্টিক আর এই পোশাকে অপরূপ সুন্দর লাগছিলো। শিউলি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল, গোগোলের গান শুনে তার দিকে তাকিয়ে জিভ উল্টিয়ে ভেংচি কেটে তার বোন শিউলিকে আদর করে টগর বেরিয়ে পড়লো গোগোলের সাথে। রয়্যাল এনফিল্ড বাইকে গোগোলের পিছনে তার মেয়ে বসে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই দিকে তাকিয়ে স্বপন সাধুখাঁ নিজের দুই হাত জড়ো করে মাথার উপর উঠিয়ে বলে উঠলেন "দুগ্গা দুগ্গা .."
★★★★
ডাক্তারবাবু চারটের আগেই ডাকলেন ওদেরকে। টগরের মুখ থেকে ওর মেডিকেল কেস হিস্ট্রি এবং সিম্পটম গুলো শুনে গোগোলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন "মেয়েটি আপনার কে হয় মিস্টার মুখার্জি .. বোন?"
কথাটা শোনার পর টগর কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গেলে, তাকে থামিয়ে দিয়ে গোগোল বললো "নাহ্ , আমার বিশেষ বন্ধু .." গোগোলের কথা শুনে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো টগর।
"আই সি .. দেখুন উনার কথা শুনে এবং উনাকে পরীক্ষা করে আমি যেটুকু বুঝলাম তার ওপর এখনই কিছু বলা সম্ভবপর নয়। তাই আমি উনার একটা এম.আর.আই করাবো এখনই। এমনিতে অফিসিয়াল রিপোর্ট পেতে আপনাদের চব্বিশ ঘন্টা সময় লাগবে। কিন্তু কেসটা যেহেতু ক্রিটিকাল বলে আমি মনে করছি, তাই আমি চাইবো আপনারা ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে যান .. তার মধ্যে আশা করি আমি আপনাকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিতে পারবো আসলে উনার কি হয়েছে।" জানালেন ডাক্তার বসাক।
কথাগুলো শুনে উসখুস করতে থাকা টগর ফিসফিস করে গোগোলকে বললো "এখনই সাড়ে চারটে বেজে গেছে, এরপর টেস্ট হবে। তারপর আরো দুই ঘন্টা অপেক্ষা করলে বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে গোগোল দাদা। তাছাড়া উনি যে টেস্টের কথা বললেন, সেটা করতে তো অনেক টাকা লাগে .. আমি বলছি তো আমার সেরকম কিছু হয়নি আর এখন আমি ভালো আছি। এসব টেস্ট করার দরকার নেই, চলো আমরা এখন বেরিয়ে পরি।"
"একদম না .. ডাক্তারবাবু যা বলছেন, সব কথা শুনতে হবে। তোর টেস্ট হবে এবং তারপর আমরা অপেক্ষাও করবো। আর টাকাপয়সা নিয়ে তোকে পাকামি করতে হবে না, আমি আছি তো! তুই চিন্তা করিস না আমি স্বপন কাকুকে ফোন করে সব জানিয়ে দিচ্ছি।" গম্ভীর গলায় জানালো গোগোল।
"আমি বাবার কথা বলছি না .. বাবা তো জানেই তোমার সঙ্গে আমি এসেছি এবং যত রাতেই ফিরি আমাদের বাড়িতে কোনো অসুবিধা হবে না .. আমি বলছি .." টগরের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিস্টার এসে ওকে ভেতরে নিয়ে চলে গেলো।
প্রায় জনশূন্য ওয়েটিংরুমে বসে এই দু-ঘন্টা যে কোথা দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেলো, টের পেলো না ওরা দু'জন। মাঝের সময়টা কোলাহলে কিংবা নির্জনে, নৈঃশব্দে কিংবা গর্জনে, স্বপ্নে কিংবা জাগরণে, প্রলয়ে কিংবা সৃজনে, পরস্পরকে নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করলো দু'জন .. একান্তে, নিভৃতে। কেবিনের ভেতর থেকে যখন ডাক এলো, তখন চমক ভাঙলো পরস্পরের। "আপনি একটু বাইরে বসুন, ওনাকে ডাক্তারবাবু একা ডেকেছেন .." এই বলে টগরকে বাইরে বসিয়ে রেখে গোগোলকে কেবিনের ভেতর নিয়ে গেলো সিস্টার।
"বসুন মিস্টার মুখার্জি .. এই হসপিটালে আমি অত্যন্ত কটুভাষী এবং কঠিন হৃদয়ের মানুষ বলে পরিচিত। তাই সাইড টক না করে আসল প্রসঙ্গে আসি। দেখুন আপনার বিশেষ বন্ধুকে বাইরে বসতে বলে আপনাকে একা যখন ভিতরে ডেকেছি, তখন কোনো সুখবর যে দেবো না, সেটা নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছেন। সি ইজ সাফারিং ফ্রম লাস্ট স্টেজ অফ ব্রেইন টিউমার। এই সিচুয়েশনে অপারেশন করা সম্ভব নয়, সবকিছুই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। আমি মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি .. এরপর পুরোটাই ভগবানের উপর। আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কি বলতে চাইছি? আদ্যোপান্ত প্রফেশনাল এবং কঠিন হৃদয়ের মানুষ হলেও আজ ওই মেয়েটিকে দেখে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছে মিস্টার মুখার্জি। এইরকম একটা অল্পবয়সী ফুটফুটে মেয়ের এই অসুখ কি করে হতে পারে, আমি ভেবে পাই না। যাই হোক, একজন ডক্টর হিসেবে আমার কথাগুলো অত্যন্ত নাটকীয় শোনাচ্ছে বোধহয়। ওষুধ যেগুলো দিয়েছি সেগুলো চলবে। পনেরো দিন পর একবার নিয়ে আসবেন আপনার বন্ধুটিকে। এখন আপনি আসতে পারেন .. খুব যত্নে রাখবেন, খুব ভালো রাখবেন আপনার বন্ধুকে .. কোনোরকম মানসিক দুশ্চিন্তা এবং আঘাত কিন্তু ওর জন্য এই মুহূর্তে ঠিক নয়।" ধীরস্থির অথচ গম্ভীর গলায় গোগোলকে কথাগুলো জানালেন ডক্টর বসাক।
"হে ঈশ্বর .. তোমার দেওয়া প্রতিটা আঘাত আমি সযত্নে গ্রহণ করেছি, এখনো গ্রহণ করে চলেছি।
নাহ্ , সেই আঘাত তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নয়। আসলে আমি তো তোমার মতো আজও পাষাণ হতে পারি নি। কেন জানো? কারণ তোমার দেওয়া এই নীল আঘাতগুলোই আমার এগিয়ে চলার পথের পাথেয় হয়ে থেকেছে চিরকাল, ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি তোমার প্রচেষ্টা সফল হতে দেবো না .. আর কাউকে হারাবো না। আমি জিতবই .." ডক্টর বসাকের কেবিন থেকে বেরিয়ে স্বগতক্তি করে উঠলো গোগোল।
"কি হয়েছে গোগোল দাদা, তোমাকে এরকম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেনো? ডাক্তারবাবু কি বললেন? আমার খুব কঠিন অসুখ হয়েছে, আমি আর বাঁচবো না .. তাই তো?" গোগোলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার দুটো হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলো টগর।
নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে টগরের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে গোগোল বললো "নাহ্ .. একদমই না, কে বলেছে এ কথা? কিচ্ছু হয়নি তোর, আমি কিছু হতে দেবো না .. আমি আছি তো! আমি সব ঠিক করে দেবো, দেখে নিস .. সব ঠিক করে দেবো .." কথা শেষ হওয়ার পর টগর দেখলো গোগোলের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।
"আমি জানিনা আমার কি হয়েছে, জানতেও চাই না। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার কিচ্ছু হতে দেবে না, সব ঠিক করে দেবে তুমি .. তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। শুধু একটাই অনুরোধ .. আমার এই অসুখের কথা তুমি কাউকে বলতে পারবে না। এমনকি আমার বাবাকেও না। অন্যের করুনা নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না .. আমার মাথার দিব্যি রইলো। আর একটা অনুরোধ .. যদি একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে যাই দূরে .. বহুদূরে, নীল আকাশে ওই মেঘেদের দলে। বলো, খুঁজবে কি আমায়? সাদা-কালো মেঘমালায় চাতক চোখে, আকাশ দেখার ছলে?" কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে এলো টগরের।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন