13-01-2023, 03:32 PM
পর্ব ২৯
নিরবিচ্ছিন্ন সুখের জীবন কারোরই কাটে না, অসুখ বিসুখ আছে, চড়াই উতরাই আছে, কিন্তু তনিমার সাথে যা হল তার জন্য সে কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না।
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ, জমিতে ধান বোনা চলছে পুরোদমে, ওরা অনেকখানি জমিতে এবারে অরগ্যানিক বাসমতী লাগাচ্ছে। তনিমার খুব উৎসাহ, প্রায়ই অফিস থেকে সোজা ক্ষেতে আসে, ছাতা মাথায় দিয়ে পরমদীপের সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে ধান বোনা দেখে, তারপর বাড়ি ফিরলে সুখমনি চেঁচামেচি করে, 'একি পাগলামি তনু, কোনোদিন করিস নি, অভ্যাস নেই, শরীর খারাপ হবে'। সেদিন শুক্রবার, তনিমা অফিসে এসে তাড়াতাড়ি কাজ সারছে, একটা বড় শিপমেন্ট ইউরোপ যাচ্ছে, তার প্রস্তুতি চলছে। বিকেলে ক্ষেতে যাবে, রাতে ওরা পুরোনো বাড়িতে থাকবে, এমন সময় সুখমনির ফোন এল, 'তনু শীগগিরই আয়, পরমদীপ বেহোঁশ হয়ে গেছে'
তনিমা হাতের কাজ কর্ম ছেড়ে দৌড়ল, সুরিন্দর অফিসে ছিল না, সাথে যোগিন্দর কে নিল। গাড়ি নিয়ে পুরোনো বাড়ি পৌঁছে দেখে ক্ষেতের মজুররা জটলা করছে, পরমদীপকে ধরাধরি করে বাড়ী এনে একতলার ডিভানে শুইয়েছে, জ্ঞান নেই, চোখেমুখে জলের ছিটে দেওয়া হচ্ছে, আলুথালু সুখমনি কাঁদছে, সে জারনেল সিংএর বাইকের পেছনে বসে তখুনি পৌঁছেছে। তনিমা এক মুহুর্ত নস্ট না করে, পরমদীপকে নিয়ে অমৃতসর দৌড়ল।
নার্সিং হোমে নিয়ে যেতেই সি টি স্ক্যান করা হল, ডাক্তার বলল, স্ট্রোক হয়েছে, ব্রেনে বড় একটা ক্লট। পরমদীপকে আই.সি.ইউতে রাখা হয়েছে, ডাক্তার ওষুধ দিয়ে ক্লট গলাবার চেষ্টা করছে, না হলে অপারেশন করতে হবে। দুই জা পাথরের মুর্তির মত বাইরে বসে রইল, সুরিন্দর এল, পরমদীপের খুড়তুতো ভাই বোনেরাও এল। সন্ধ্যার সময় তনিমা জোর করে সুখমনিকে বাড়ী পাঠাল বাড়িতে বাচ্চা দুটো ছিল বলে।
সেই ঘটনার দুই দিনে পরেও পরমদীপের অবস্থার কোনো উন্নতি হল না, তাই সবার সাথে আলোচনা করে তনিমা পরমদীপকে অ্যাম্বুলেন্সে চন্ডীগড় নিয়ে গেল। পরমদীপের খুড়তুতো ভাই আর সুরিন্দর সাথে গেল। কিন্তু... অপারেশন সফল হল না, পরমদীপ কোমায় চলে গেল। দু দিন পর কানাডা থেকে অমনদীপ এসে পৌঁছলেন।
সতেরো দিন কোমায় থাকার পর মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে পরমদীপ মারা গেল। কিন্তু তার মৃত্যুতে তনিমা একটুও কাঁদল না। সে পরমদীপের মৃতদেহ নিয়ে অজনালা ফিরে এল।
সেখানে তখন হাজার লোকের ভীড়, গ্রামশুদ্ধ মানুষ, আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছে, গুরদীপজী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, অমনদীপ ডাক্তার ডেকে এনেছে, সুখমনি পরমদীপের মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়েছে, থেকে থেকেই কান্নার রোল উঠছে, কিন্তু সবাইকে অবাক করে তনিমা চুপ করে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে, 'সেদিনও মানুষটা বলল, রানী তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না, আর আজ চলে গেল?'
অভিমানে, দুঃখে তনিমার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু চোখ শুকনো। আর সেই দেখে গ্রামের এক মহিলা আরেক জনকে বলল, 'দ্যাখ কি রকম দাঁড়িয়ে আছে, চোখে একফোঁটা জল নেই, পড়াশুনা জানা চুড়েল'। 'শালী ভাতারখাকি', অন্যজন জবাব দিল।
এই কথাটা তনিমার মনে অনেকদিন পর্যন্ত ছিল, দুটো পুরুষ মানুষ, সোমেন আর পরমদীপ, সম্পুর্ন বিপরীত মেরুর দুটো মানুষ, দুজনকেই তনিমা গভীরভাবে ভালবেসেছিল, দুজনেই চলে গেল।
স্মৃতি যত দীর্ঘ হয়, ক্ষত তত গভীর। সোমেনের সাথে বেশীদিনের সঙ্গ ছিল না, প্রথম সাক্ষাতের পর মাত্র মাস চারেক। আর সোমেনের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে বেশী সময় লাগেনি, কিন্তু পরমদীপ? সেই সোমেনের সাথে প্রথমবার অমৃতসর এসেছিল, সেবার দেখা হল ধাবায়, বৈশাখীর সময় প্রথম শরীরি সম্পর্ক হল, তারপর বিয়ে, পাঁচ পাঁচটা বছর সুপুরুষ এই যুবক ওকে নিবিড় ভালবাসা দিয়ে ঘিরে রেখেছে। পরমদীপের ভালবাসায় উগ্র যৌনতা ছিল, মেজাজ ছিল, আর ছিল শিশুসুলভ সততা যা তনিমাকে বার বার আপ্লুত করেছে। দু দুটো বাচ্চা হয়েছে, ওদের দাম্পত্য জীবনে নিশা, সীমা, রাজবীরের ছায়া পড়েছে, কিন্তু তনিমার প্রতি পরমদীপের ভালবাসা বিন্দুমাত্র টাল খায় নি।
শেষের দিকে আরো যেন ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল, তনিমা যা বলত তাই করত, কথায় কথায় বলত, রানী তুই রাগ করিস না, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ও কি বুঝতে পেরেছিল যে ওর আর বেশীদিন বাঁচবে না?
পরমদীপ মারা যাওয়ার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল, তনিমা বাড়ি থেকে বেরোয়নি। বেরোনো তো দূরের কথা, বাড়িতেও চুপচাপ থাকে, কারোর সাথে বেশী কথা বলে না, বাচ্চা দুটোর দিকে ফিরেও তাকায় না, যেটুকু কাজ না করলে নয় সেটুকু করে, বাকী সময় চুপচাপ নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকে।
অমনদীপ প্রায় এক মাস থেকে কানাডা ফিরে গেলেন, যাওয়ার সময় বার বার বললেন, 'যে যাওয়ার সে তো গেছে তনিমা, তুমি এই রকম করলে কি করে চলবে? পিতাজী মাতাজী আছেন, ভাবী আছেন, তার থেকে বড় কথা বাচ্চা দুটো আছে, ওদের জন্যেই তোমাকে বাঁচতে হবে'। তবু তনিমার কোনো উৎসাহ নেই, ক্ষেতের কাজ বা অফিসের কাজ, কোনোটাতেই আর আগ্রহ দেখায় না।
ঠিক মত বোয়া হয়নি, দেখাশোনাও হয়নি, অর্ধেকের বেশী ধান নস্ট হয়ে গেছে, ইওরোপে শিপমেন্ট যাওয়ার কথা ছিল সেটা যায়নি, সুরিন্দরকে দোষ দেওয়া যায় না, সেও ওদের সাথে হাসপাতাল দৌড়োদৌড়ি করেছে, পরমদীপের মৃত্যু তাকেও শোকাহত করেছে, রোজ সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে এসে এখানে বসে থাকে, কাজের ব্যাপারে তনিমার সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু তনিমা নীচেও নামে না।
মনজোত বিছানা নিয়েছেন, গুরদীপজী একদম চুপচাপ, একমাত্র ব্যতিক্রম সুখমনি। পরমদীপ যেদিন মারা গেল, সেদিন সুখমনি আথালি পাথালি হয়ে কাঁদল, কিছুতেই পরমদীপের মৃতদেহ শশ্মানে নিয়ে যেতে দেব না, কোনো মানুষের চোখে এত জল থাকতে পারে, কেউ এই ভাবে কাঁদতে পারে তনিমার ধারনা ছিল না। গ্রামের মহিলারা জোর করে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেল। পরের দিন চোখের জল মুছে সুখমনি উঠে দাঁড়াল, বাড়ী ভর্তি লোকজন, তাদের খাওয়া দাওয়া শোওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন থেকে পুরো বাড়ি একাই সামলাচ্ছে।
বিকেলবেলা সুরিন্দর এসে সুখমনিকে বলল, 'বড় ভাবী এ ভাবে আর চলতে পারে না। অফিসের কাজকর্ম সব আটকে পড়ে আছে, অনেক পেমেন্ট বাকী, ধান কেনা হচ্ছে না, শিপমেন্ট যায় নি, শুধু শুধু এতগুলো লোককে বসিয়ে মাইনে দেওয়ার কি মানে?'
সুরিন্দর চলে গেলে সুখমনি পিঙ্কি আর কুলদীপকে নিয়ে তনিমার ঘরে এল। ওদের দেখে তনিমা শুকনো হেসে বলল, 'এসো ভাবী'।
- এভাবে আর কতদিন চলবে তনু? সুখমনি তনিমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।
- কি ভাবে ভাবী?
- অফিসের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, ক্ষেতের অবস্থা তেমনি, তুই না দেখলে কে সামলাবে?
- ওগুলো আমার নাকি? আমি কেন সামলাতে যাব?
- না তোর না, আমারও না, ওদের, সুখমনি পিঙ্কি আর কুলদীপকে দেখিয়ে বলল, ওদের জন্য সামলাতে হবে।
বাবার মৃত্যুর তাতপর্য বোঝার বয়স পিঙ্কি আর কুলদীপের হয়নি, ওরা নিজেদের মধ্যে খেলা করছে, তনিমা বলল, 'এগুলো মরলেই সব ঝামেলা মিটে যায়'
তনিমার সেই শুনে সুখমনি তনিমার গালে ঠাস করে একটা চড় কষালো, আর সেই চড়ের আওয়াজে দুটো বাচ্চাই ঘুরে তাকাল।
'তু...তুমি আমাকে মারলে ভাবী?' বলে তনিমা হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। সুখমনি তনিমাকে বাচ্চাদের মত কোলে টেনে নিল। সুখমনির কোলে মাথা রেখে তনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'আমার কি দোষ ভাবী? আমি কি করেছি? বার বার বলত, রানী তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না, তাহলে চলে গেল কেন?'
তনিমার সেই কথা শুনে সুখমনিরও দু চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। সে পিঙ্কি কুলদীপকে নিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, 'কেঁদে নে তনু, এখানে কেউ নেই, কেউ দেখবে না, যত ইচ্ছে কেঁদে নে...'
দুদিন পরে সকালে তনিমা স্নান করে তৈরী হয়ে নীচে এসে বলল, 'আমাকে নাস্তা দাও ভাবী, আমি অফিস যাব'
বছরের সব থেকে ব্যস্ত সময় কোনো কাজ হয়নি, মন্ডী থেকে ধান কেনা হয়নি, গোডাউন প্রায় খালি, এদিকে চালের শিপমেন্ট যায়নি বলে বিদেশের ক্লায়েন্টরা একাধিক ই মেইল লিখেছে, হোলসেলাররা ফোন করছে কবে মাল যাবে, অনেক পেমেন্ট বাকী পড়েছে, সুরিন্দর দিশেহারা।
- এভাবে চলতে পারে না সুরিন্দর, তোমাকে আরো দায়িত্ব নিতে হবে।
- ভাবী এত বড় পেমেন্ট আপনি সই না করলে হবে না, আপনার সাথে আলোচনা না করে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
- কেন? তুমি আমার অনেক আগে থেকে এখানে কাজ করছ, সোমেনের কাছে কাজ শিখেছ, তুমি কেন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না?
- যতটা আমার ক্ষমতা সেটা আমি করেছি ভাবী, সুরিন্দর বলল।
- তোমার কি ইচ্ছে সুরিন্দর? আমরা এই কোম্পানী বন্ধ করে দিই? এতগুলো লোক এতদিন ধরে কাজ করছে, তাদের কি হবে? আমি যদি সাত দিন অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে?
সুরিন্দর চুপ করে আছে, তনিমা বলল, 'যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, তা নিয়ে দুঃখ করে কোন লাভ নেই, ভবিষ্যতে যাতে এরকম না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। কালকে আমি আসব না, আমাকে ক্ষেতে যেতে হবে, সেখানেও সব কাজ বন্ধ হয়ে আছে। পরশু আমরা আবার বসব, এই মুহুর্তে আমাদের কি কি করতে হবে তুমি তার একটা লিস্ট বানাও, আমিও ভেবে রাখব'
- ঠিক আছে ভাবী, সুরিন্দর উৎসাহিত হয়ে বলল।
দ্বিতীয় দিন তনিমা জরনেল সিং আর যোগিন্দরকে নিয়ে ক্ষেতে গেল, যত্নের অভাবে ওদের সাধের অরগ্যানিক ফার্মএর বারোটা বেজেছে, যেটুকু ধান কাটা হয়েছে, তা ক্ষেতেই পড়ে আছে, আশেপাশের চাষী যারা এতদিন ওদের ধান দিয়ে এসেছে, তাদের অনেকে আনুগত্যবশতঃ এখনো অপেক্ষা করছে, তবে কিছু চাষী ধৈর্য রাখতে না পেরে মন্ডীতে গিয়ে ধান বেচে দিয়েছে। তনিমা সবার সাথে দেখা করল, যারা ধান বেচেছে তাদের বলল, ওরা চাইলে আগামী বছরের পয়সা আগাম এখনই নিতে পারে, আর যারা বেচেনি তাদের বলল, আগামী সাত দিনের মধ্যে ধান তুলে নেওয়া হবে।
বাড়ি ফিরে তনিমা গুরদীপজী আর সুখমনির সাথে বসল। গুরদীপজী বললেন, 'সবকিছু তোদের, তোরা দুই বৌ, পিঙ্কি আর কুলদীপের, অমনদীপও সেই কথাই বলে গিয়েছে, আমার কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাবার ইচ্ছে নেই, তুই যে কাগজে বলবি আমি তাতেই সই করে দেব'
- পিতাজী আমি কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চাই সেগুলো আপনার জানা দরকার।
- বললাম তো তুই যা ঠিক মনে করবি তাই কর, আমাকে এর মধ্যে জড়াস না।
- তনু যখন বলছে একবার শুনুন পিতাজী, আপনাকে কিছু করতে হবে না, কিন্তু শুনতে ক্ষতি কি? তনুরও তাহলে মনোবল বাড়বে, সুখমনি বলল।
- তুমিও শোনো ভাবী, তনিমা বলল, আমি ভেবেছি সুরিন্দরকে কোম্পানীর পার্টনার করে নেব, সোমেনকে যেমন করা হয়েছিল, এছাড়া দু জন ম্যানেজার রাখব, একজন অফিসে সুরিন্দরকে সাহায্য করবে, আর একজন ক্ষেতের কাজ দেখবে। আমরা আবার অরগ্যানিক ফার্মিং করব।
- হ্যাঁ যে রকম তোরা গতবার করেছিলি, আমার মনে আছে। লোকে খুব প্রশংসা করেছিল, গুরদীপজী বললেন।
- ভাবী এখুনি আমার একটা লোক চাই ক্ষেতের জন্য, যতদিন নতুন লোক না পাচ্ছি, জারনেল সিংকে নিলে তোমার অসুবিধা হবে?
- না কিসের অসুবিধা, তবে জারনেল বুড়ো হয়েছে, ও কি পারবে? তুই যোগিন্দরকে লাগাস না কেন?
- যোগিন্দরের বয়স কম, চাষবাস বোঝে না, লোকেরা ওর কথা শুনবে না, জরনেল গেলে সুবিধে হবে, তনিমা বলল। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি, যোগিন্দর আমার গাড়ী চালাবে, ও ড্রাইভারিটা ভাল করে।
- আর পুরনো ড্রাইভার? সুখমনি জিজ্ঞেস করল।
- ও বাড়ীতে তোমাদের কাছে থাকবে, পরমদীপের গাড়ীটা তোমরা ব্যবহার করবে।
- তুই এত কিছু ভেবেছিস তনু, সুখমনি বলল, আমার ডেয়ারীর জন্য একটা পড়াশোনা জানা লোক খুঁজে দে, হিসেব টিসেব রাখতে আমার আর ভাল লাগে না।
- হ্যাঁ ভাবী, আমি দেব।
সুরিন্দর একটা লিস্ট বানিয়েছে এখুনি কি কি করা দরকার। তনিমা সেটাকে সরিয়ে রেখে বলল, 'সুরিন্দর তোমাদের কলেজে কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের খুব সুখ্যাতি আছে, তাই না?'
- হ্যাঁ ভাবী, পরমদীপ ওখানেই পড়েছিল।
- আমার দু জন যুবক চাই, একজন এখানে ম্যানেজারের কাজ দেখবে, ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং থাকলে ভাল হয়, আর একজন কৃষি বিজ্ঞানের, বিশেষ করে অরগ্যানিক ফার্মিংএর ব্যাপারটা জানে, সৎ পরিশ্রমী হওয়া চাই, তুমি আজ থেকেই খুঁজতে শুরু কর।
- নতুন ম্যানেজার? সে কি সামলাতে পারবে? সুরিন্দর বলল।
- তুমি শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে, আর আজ থেকে তুমি আমাদের পার্টনার হলে সুরিন্দর, আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি, সাতদিনের মধ্যে কাগজ পত্র তৈরী হয়ে যাবে।
তনিমার সেই কথা শুনে সুরিন্দর হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
- কি হল ভাই সুরিন্দর? এক কাপ চা খাওয়াবে? তনিমা বলল।
- হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবী, সুরিন্দর পিয়নকে ডেকে চা দিতে বলল, তারপরে তনিমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি অফিসে আসবেন না ভাবী?
- কেন আসব না, অবশ্যই আসব, শহরে এলেই এখানে আসব, তোমার সাথে বসে চা খাব।
- ভাবী আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ধান, গম, মন্ডী, চালের, গমের ব্যবসা। আর আপনি বিয়ের আগে এসব কোনদিন দেখেননি, কলেজে ইতিহাস পড়াতেন, তাইতো?
- হ্যাঁ।
- সেই জন্যই আপনার মাথায় এমন সব আইডিয়া আসে যা আমাদের মাথায় কোনোদিন আসবে না, অরগ্যানিক ফার্মিং, নিজেদের চালের ব্রান্ড বাজারে ছাড়া, এসব আমরা ভাবতাম না, এতদিন যা দেখে এসেছি তাই করতাম।
- সুরিন্দর সময় পাল্টাচ্ছে, আমাদেরও পালটাতে হবে, না হলে পিছিয়ে পড়ব।
- আপনি মাথার ওপরে থাকলে খুব ভরসা হয়, আপনাকে রোজ আসতে হবে না, সপ্তাহে দু’ তিন দিন এলেন, দেখলেন কি রকম কাজ চলছে, শলা পরামর্শ দিলেন।
- সুরিন্দর এখানে তুমি আছ, ক্ষেতে কেউ নেই, আমাকে ওদিকে বেশী সময় দিতে হবে।
- আমি আপনাকে একটা খুব ভাল ছেলে খুঁজে দেব, ওই সব সামলাবে, আপনি দুদিন ওখানে যাবেন, দুদিন এখানে আসবেন।
- আমার কোন ছুটি নেই বুঝি? তনিমা হেসে জিজ্ঞেস করল।
- আপনাকে কোন কাজ করতে হবে না ভাবী, শুধু এসে খানিকক্ষন বসবেন,
সুরিন্দর অনুরোধ করল। তনিমা বলল, 'ঠিক আছে আগে লোক খোঁজা যাক, আমার আরো একটা ছেলে দরকার, অ্যাকাউন্টসের কাজ জানা চাই, অজনালায় গিয়ে সুখমনি ভাবীকে ডেয়ারীর কাজে সাহায্য করবে'
সৎ দক্ষ কর্মী চাইলেই পাওয়া যায় না, প্রায় এক মাস লেগে গেল নতুন লোকেদের কাজে যোগ দিতে, ইতিমধ্যে তনিমা যে সব চাষীরা ওদের জন্য ধান নিয়ে অপেক্ষা করছিল, তাদের ন্যয্য মুল্য দিল, খেতের ধান গোডাউনে পাঠাবার ব্যবস্থা করল, রবি মরশুমের শুরুতে অরগ্যানিক সব্জীর চাষ শুরু করল। আদেশ নামে যে ছেলেটা ক্ষেতের কাজ দেখবে বলে এসেছে, তাকে তনিমার বেশ পছন্দ হল। এই এলাকারই ছেলে, পরমদীপের মতই খালসা কলেজ থেকে কৃষি বিজ্ঞান পড়েছে, বুদ্ধিমান আর পরিশ্রমী, খুব তাড়াতাড়ি নিজের দায়িত্ব বুঝে নিল।
তনিমা সপ্তাহে দুদিন অফিস যায়, বাকী কদিন ক্ষেতেই কাটায়, খুব সকাল সকাল চলে আসে, ঘুরে ঘুরে ক্ষেতের কাজকর্ম দেখে, আদেশের সাথে নতুন কি করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা করে, চাষবাসের মধ্যে যে একটা নেশা আছে, সৃস্টির আনন্দ আছে, সেটা তনিমা এবারে পুরো উপভোগ করেছে। দুপুর বেলা তনিমা তাদের পুরোনো বাড়িতে যায়, পরমদীপের স্মৃতিজড়ানো এই বাড়িতে আসতে তনিমার ভাল লাগে, দোতলার বারান্দায় বসে লাঞ্চ খায়, বিছানায় শুয়ে পরমদীপের কথা ভাবে, আশ্চর্যের ব্যাপার এখানে এলে তনিমার যৌনখিদে জেগে ওঠে, ভীষন ইচ্ছে করে চোদন খেতে। কিন্তু তনিমা সেই ইচ্ছেকে দাবিয়ে রেখে নিজের ল্যাপটপ খুলে বসে, অফিস সংক্রান্ত ইমেইল ইত্যাদি দেখে, সুরিন্দরের সাথে ফোনে কথা বলে।
পরমদীপের মৃত্যুর পর তনিমা প্রথম যেদিন অফিসে গেল, ল্যাপটপ খুলে দেখে কেভিনের একাধিক ই মেইল, জানতে চেয়েছেন কি ব্যাপার কোনও খবর নেই কেন? দুদিন পরে কেভিনকে সব জানিয়ে তনিমা ই মেইল লিখেছিল, মর্মাহত কেভিন সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলেন। এখন তনিমা পুরোনো বাড়িতে এলে প্রায় দুপুরেই কেভিনের সাথে ঘন্টা খানেক চ্যাট করে।
বিকেলে তনিমা অজনালা ফিরে যায়, পিঙ্কি নার্সারী কলেজ ছেড়ে গার্লস কলেজের ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে, কুলদীপ নার্সারীতে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরে সুখমনি আর বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ওর ভাল লাগে, ওরাও তনিমার পথ চেয়ে বসে থাকে। গুরদীপজী আরো বুড়ো হয়ে গেছেন, চুপ চাপ শুয়ে বসে থাকেন, মনজোত গুরদ্বোয়ারা যেতে পারে না, হাঁটুতে ব্যাথা, ঘরে বসেই সারাদিন জপজী পড়েন।