12-01-2023, 04:34 PM
|| স্বামীজি ||
সালটা ছিল ১৮৯৩, জুলাই মাসের পড়ন্ত বেলায় জাপান থেকে কানাডা জলপথের একই জাহাজের দুই যাত্রী ছিলেন একজন গেরুয়া বসন পরিহিত সন্ন্যাসী ও আর একজন হলেন মধ্যবয়স্ক পার্সি ব্যবসায়ী। ইয়োকোহামা থেকে ভ্যাঙ্কুবার অভিমুখী জাহাজ চলেছে তার নিজের ছন্দে। ১২ দিনের যাত্রাপথেই জমে ওঠে দুজনের আলাপ। একজন যাচ্ছেন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মার্কিন মুলুকে আর অন্যজন চলেছেন শিকাগো ধর্মসভাতে।এনাদের একজন হলেন স্বামী বিবেকানন্দ ও অন্যজন হলেন আধুনিক ভারতবর্ষের শিল্পের জনক জামশেদজি টাটা।
সেদিনের দুইজনের আড্ডাতে উঠে এসেছিল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রসঙ্গ। স্বামী বিবেকানন্দের থেকে তিনি উৎসাহিত হয়েছিলেন দেশে ইস্পাত কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার। এছাড়াও তাদের বার্তালাপ এ উঠে আসে জাপানের দেশলাই কারখানার ব্যবসার কথা।স্বামী বিবেকানন্দ জামশেদজি কে বলেছিলেন জাপান থেকে দেশলাই আমদানি না করে কেন নিজের দেশে কারখানা গড়ে তুলছেন না? তিনি আরও বলেন, কারখানা হলে তো দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মজবুত হবে। দেশের ছেলেরা কাজ পাবে এবং দেশের অর্থ দেশেই থাকবে।১৪ বছরের ছোট সন্ন্যাসীর কাছ থেকে এই রকম একটা অভিমত পেয়ে জামশেদজি টাটা বেশ অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁদের কথোপকথন বেশ অনেক দূর গড়িয়েছিল।ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় জনগণ কতটা অত্যাচারিত হচ্ছে এবং যার জন্য দু’বেলা অন্ন জোগাড় করা কতটা কষ্ট সাধ্য তা নিয়ে জামশেদজির কাছে বিশদে ব্যাখ্যা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
১৮৯৩ সালে ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসভায় বক্তৃতা দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন স্বামী বিবেকানন্দ।তারপর থেকে গোটা দুনিয়া তাঁকে চিনে যায়।তাঁর এই সাফল্যে খুশি হন বোম্বাইতে বসবাসরত জামশেদজি টাটা। ততদিনে তাঁদের দুইজনের জাহাজ যাত্রার গল্প হৃদয়ে গেঁথে যায়। ১৮৯৮ সালে ২৩ নভেম্বর জামশেদজি স্বামী বিবেকানন্দকে এক পত্র লিখলেন, সেই পত্রে জানালেন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। তাই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রচার পত্র লিখে দিতে।
তার মধ্যেই স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ায় জামশেদজির অনুরোধ গ্রহণ করতে না পারলেও ভগিনী নিবেদিতাকে দেখা করতে বলেছিলেন জামশেদজি টাটার সঙ্গে।১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ পরলোকগমন করেন। ঠিক তার দুই বছরের মধ্যেই ১৯০৪ সালে জামশেদজি টাটার মৃত্যু ঘটে।ভারতের ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার স্বপ্ন জামশেদজি টাটা তার উত্তরসূরিদের হাতে অর্পণ করে চলে গেলেন।১৯০৭ সালে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে গড়ে ওঠে টাটা স্টিল। এই কারখানাটি বর্তমানে বৃহত্তম ভাবে দন্ডায়মান বহুজাতিক সংস্থা রূপে।১৯০৯ সালে গড়ে ওঠে টাটাদের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স যা আজ আমাদের গোটা ভারতবর্ষের গর্ব।
খাওয়া-দাওয়া প্রসঙ্গে স্বামীজি
স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের সঙ্গে খাদ্যভ্যাসের সম্পর্ককে চিরকালই অস্বীকার করেছেন। সন্ন্যাসী হয়েও তিনি মাছ-মাংস খাওয়ার সপক্ষেই বলে গেছেন। ধর্মের সঙ্গে নিরামিষ খাওয়ার প্রচলন কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বলেছেন --
“ ঈশ্বর কি তোমাদের মতো আহাম্মক, তিনি কি ফুলের ঘায়ে মূর্চ্ছযান যে একটুকড়ো মাংসে তাঁর দয়ানদীতে চড়া পরে যাবে! ”
বিভিন্ন প্রকার মাছ-মাংস গ্রহণের পক্ষেই ছিল স্বামীজীর সমর্থন। গুরুভাইদের মাংস খাওয়া নিয়ে কুসংস্কার ভাঙতে একদিন সবাই কে নিয়ে বিডন স্ট্রীটে ফাউলকারী খাইয়ে এনেছেন।
একবার ঠাকুর “ কি খেয়েছিস ? ” জানতে চাইলে বললেন --
“ মুরগির ডালনা ”
ঠাকুর বললেন -- “ বেশ করেছিস ”
নরেনের হোটেলে খাওয়া নিয়ে কেউ নালিশ করলে রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন --
“ ওরে শালা, তোর কিরে? তুই শালা যদি হবিষ্যিও খাস আর নরেন যদি হোটেলেও খায়, তাহলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না। ”
শ্রীশ্রীমায়ের কথায়, “ নরেন আমার নানারকমের মাংস রাঁধতে পারতো, চিরে চিরে ভাজতো, আলু চটকে কিসব রাঁধতো। ”
স্বামীজির মত ছিল, “ যে ভালো রাঁধতে পারে না সে ভালো সাধু হতে পারে না, মন শুদ্ধ না হলে রান্না ভালো হয় না। ”
বিবেকানন্দের সংগীত চর্চা
স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই প্রশিক্ষিত গায়ক ছিলেন (যদিও পেশাদার নয়)। তিনি 'বেনি ওস্তাদ' যার আসল নাম 'বেনি গুপ্ত' তাঁর থেকে নরেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা পান।
১৮৮১ সালের শেষের দিকে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের যখন প্রথম সাক্ষাত হয় (যদিও সেসময় স্বামীজি নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামে পরিচিত) তখন নরেন কয়েকটি ভক্তিমূলক গান গেয়েছিলেন। তার কণ্ঠস্বর আর সংগীতের প্রতি তার ভক্তি রামকৃষ্ণকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল, এবং এর মধ্যেদিয়েই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর শ্রেষ্টতম শিষ্যটিকে।
এরপরের ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা.. নরেন থেকে বিবেকানন্দ হয়ে ওটায় এই গানের ছিলো এক বড়ো ভূমিকা।
কেমন ছিলো স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের শেষ সময়?
স্বামীজির মহাপ্রয়াণ হয় ৩৯ বছর বয়েসে ১৯০২ সালে। বেলুড় মঠে তখন রাত ৯ টা ১০ মিনিট। তখন বেলুড় মঠে বা তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু টেলিফোন ছিল তবুও কোন সংবাদমাধ্যম আসেনি এবং পরের দিন বাঙ্গলাদেশের কোন কাগজেই বিবেকানন্দের মৃত্যূ সংবাদ প্রকাশিত হয়নি,এমন কি কোন রাষ্ট্রনেতা বা কোন বিখ্যাত বাঙ্গালী কোন শোকজ্ঞাপনও করেননি।
ভাবতে পারেন..?
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর স্বল্প জীবনে অপমান, অবহেলা বহু পেয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছেন বার বার। পিতার মৃত্যুর পর স্বজ্ঞাতির সঙ্গে কোর্ট কাছারী করতে হয়েছে তাঁকে। বহু বার হাজিরা দিয়েছেন কাঠগড়ায়।
নিদারুণ দরিদ্রের সংসারে সকালে উঠে অফিস পাড়া ঘুরে ঘুরে চাকরির খোঁজে বেরুতেন। দিনের পর দিন মা কে বলতেন মা আজ রাতে বন্ধুর বাড়িতে খেতে যাবো। প্রায় দিন দেখতেন সংসারে চাল,ডাল,নুন ,তেল কিছুই নেই কিন্তু ভাই ও বোন নিয়ে ৫ টা পেটের খাবার কি ভাবে জুটবে ? মুদির দোকানে ধার করে মাকে এক- দুই দিনের চাল ডাল দিয়ে ... মা কে বলতেন আমার রান্না কোরো না.. মা ! দিন দুই বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে কিন্তু.. কোথায় নিমন্ত্রণ ? আনাহার আর অর্ধপেটে থাকতেন তৎ কালীন নরেন্দ্র..
ভাবা যায় !!
চরম দারিদ্রের মধ্যে সারা জীবনটাই টেনে নিয়ে গেছেন। ২৩ বছর বয়েসে শিক্ষকের চাকরি পেলেন মেট্রোপলিটন কলেজে। যাঁর প্রতিষ্ঠাতা বিদ্যাসাগর মশাই আর হেডমাস্টার বিদ্যাসাগরের জামাতা। জামাতা পছন্দ করতেন না নরেন্দ্রনাথ দত্তকে .. শ্বশুরকে বলে...“ খারাপ পড়ানোর অপরাধে ” বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিলেন বিবেকানন্দকে। অথছ, যাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, ব্যুৎপত্তি তর্কাতীত, অন্তত সেই সময়েও।
আবার বেকার বিবেকানন্দ। বিদেশেও তাঁর নামে এক বাঙ্গালি গুরু প্রচার করেন .. বিবেকানন্দ বেশ কয়েকটি বৌ ও দশ-বারো ছেলে পুলের পিতা ও এক আস্ত ভন্ড ও জুয়াখোর।
দেশে ও বিদেশে অর্ধপেটে বা অভুক্ত থেকেছেন দিন থেকে দিনান্তে...
চিঠিতে লিখেছিলেন :
“কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছি। মনে হয়েছে আজই হয়ত মরে যাবো ... জয় ব্রহ্ম বলে উঠে দাঁড়িয়েছি .... বলেছি ...আমার ভয় নেই, নেই মৃত্যূ, নেই ক্ষুধা, আমি পিপাসা বিহীন। জগতের কি ক্ষমতা আমাকে ধ্বংস করে ?”
অসুস্থ বিবেকানন্দ বিশ্ব জয় করে কলকাতায় এলে তাঁর সংবর্ধনা দিতে বা সংবর্ধনা সভা তে আসতে রাজি হয় নি অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালী ( নাম গুলি অব্যক্ত রইল) শেষে প্যারিচাঁদ মিত্র রাজি হলেও ... তিনি বলেছিলেন .. ', নয় বিবেকানন্দ। ও কায়েত... তাই সন্ন্যাসী হতে পারে না ,আমি ওকে brother বিবেকানন্দ বলে মঞ্চে সম্বোধন করবো।
১৮৯৮, বিদেশের কাগজে তাঁর বাণী ও ভাষণ পড়ে আমেরিকানরা অভিভূত আর বাঙ্গালীরা !
সেই বছরই অক্টোবরে অসুস্থ স্বামীজি কলকাতার বিখ্যাত ডক্টর রসিকলাল দত্তকে দেখাতে যান,(চেম্বার- ২ সদর স্ট্রিট। কলকাতা যাদুঘরে পাশের রাস্তা )। রুগী বিবেকানন্দ কে দেখে সেই সময় ৪০ টাকা ও ঔষুধের জন্যে ১০ টাকা মানে আজ ২০২২ এর হিসাবে প্রায় ১৬০০০ টাকা নিলেন বিবিধ রোগে আক্রান্ত বিশ্বজয়ী দরিদ্র সন্ন্যাসীর কাছ থেকে ... বেলুড় মঠের জন্যে তোলা অর্থ থেকে স্বামী ব্রহ্মনন্দ এই টাকা বিখ্যাত বাঙ্গালী ডক্টর রসিকলাল কে দিয়েছিলেন।
আরও আছে ...
বিবেকানন্দের মৃত্যুর কোন ফটো নেই। এমনকি বীরপুরুষের কোন ডেথ সার্টিফিকেটও নেই কিন্তু সে সময় বালি-বেলুড় মিউনিসিপালিটি ছিলো।
আর এই municipality বেলুড় মঠে প্রমোদ কর বা amusement tax ধার্য করেছিলো।
বলা হয়েছিল ওটা ছেলে ছোকরাদের আড্ডার ঠেক আর সাধারণ মানুষ বিবেকানন্দকে ব্যঙ্গ করে মঠকে বলতো .. "বিচিত্র আনন্দ" বা "বিবি- কা আনন্দ"। ( মহিলা /বধূ / ... নিয়ে আনন্দ ধাম)। এই ছিলো তৎকালীন মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীদের মনোবৃত্তি।
সাধে কি শেষ সময় বলে গিয়েছিলেন -- “একমাত্র আর একজন বিবেকানন্দই বুঝেতে পারবে যে এই বিবেকানন্দ কি করে গেল।”
আজ আমরা যে বিবেকানন্দকে কে নিয়ে এত মাতামাতি করছি, সেই বিবেকানন্দ কেই নিজের জীবদ্দশাতেই সহ্য করতে হয়েছিলো এত বঞ্চনা এত অপমান। ভালোই হয়তো করেছিলেন স্বামীজী এত তারাতারি এই পৃথিবীকে ত্যাগ করে.. নইলে হয়তো আজকের এইসব লোকদেখানো শ্রদ্ধা দেখে বলতেন ‘আদিখ্যেতা সব.."
তথ্যসূত্রঃ- অজানা বিবেকানন্দ