11-01-2023, 10:03 PM
: ## কাজের মাসি
? দেবকমল চক্রবর্তী
( সম্পূর্ণ নতুন গল্প)
" একটু কম দামের মধ্যে কিছু শাড়ি দেখান তো।এই বড়জোর চারশো পাঁচশোর মধ্যে।"
দেবাংশুর প্রশ্নের উত্তরে অভিজ্ঞ সেলসম্যান
এক মুহূর্ত চিন্তা করেনি---" আর বলতে হবে না দাদা।বাড়ির কাজের মাসির জন্য পুজোর শাড়ি
চাচ্ছেন তো?"--- বলেই এক গাদা শাড়ির একটা লট নামিয়ে দেয় দেবাংশু আর মধুজার দিকে।
পুজোর আগের আলোকজ্বল বাজার। সবাই পুজোর কেনাকাটা সারতে ব্যস্ত। দেবাংশুর ছুটি খুব কম।তাই এক রোববার দেখেই বেরিয়েছিলো মধুজা কে নিয়ে।একমাত্র মেয়ে টিকলির পোশাক আগেই কেনা হয়ে গেছিল, তাই দুজনেরই ইচ্ছে ছিল ওকে ঠাম্মার কাছে রেখে আসার।এই সময় প্রচন্ড ভীড় হয় দোকানে। কিন্তু বাধ সেধেছিলো টিকলি নিজেই,
----- ওর একটাই ইচ্ছে সবার জিনিস ও নিজে দেখে কিনবে।মাত্র ফোরে পড়লে কি হবে?টিকলি যাকে বলে একটা চলমান বিশ্বকোষ। হেন কোন বিষয় নেই,যা নিয়ে ও কথা বলে না। তাই দশটা ক্যাডবেরির প্রলোভন ও ওকে বিরত করতে পারলো না।
তা টিকলি কোন গোলমাল ও করেনি।দুজনের মাঝে শান্ত হয়ে বসেছিলো।কিন্তু বাবার এই কথা শুনে মুখ খুলতে দেরি করলো না---" কি বলছো গো তুমি বাপি? নিজের, মায়ের, ঠাম্মির, পিসিমণির জন্য এত দামী দামী পোশাক কিনলে আর মাসি ঠাম্মির জন্য মাত্র চারশো? কেন বাপী? মাসি ঠাম্মির তো মোটেই দুটো কাপড়,তাও কত জায়গায় ছিড়ে গেছে।তুমি একটা ভাল শাড়ি মাসি ঠাম্মির জন্য এখুনি কেনো।"
মুখের ওপর কে যেন এক পোচ কালি বুলিয়ে দিয়েছিলো দেবাংশুর। পাশে মধুজার মুখ ও চুণ।মেয়ের কাছ থেকে যে এই এক হাট লোকের মধ্যে এমন একটা প্রতিবাদ আসবে বুঝতেই পারেনি----" ঠিক আছে বেটা,আর একদিন নয় আমরা তিনজনে এসে তোমার মাসি ঠাম্মির জন্য ভাল শাড়ি কিনে নিয়ে যাবো " ---- এই বলে কোনমতে সে যাত্রা সামলাতে পেরেছিলো।
বস্তুত জ্ঞান হবার পর থেকেই বাড়িতে দুটো বয়স্কা মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে এসেছে টিকলি--- এক তার ঠাম্মি আর একজন মাসি ঠাম্মি।এই মাসি ঠাম্মি-- নামটা অবশ্যই তার নিজস্ব উদ্ভাবন। সত্যি বলতে কি এই মাসির নাম কোনদিনই জানার চেষ্টা করেনি দেবাংশু।
তার কলেজ লাইফের সময় থেকেই মাসি এ বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক। মায়ের দেখাদেখি সেও মাসিই বলতো।তারপর কলেজ, কলেজ চাকরির গন্ডী পেরিয়ে যখন মধুজা ঘরে এলো--- সেও তো সেই মাসি বলতে অজ্ঞান।পরে একবার অবশ্য মায়ের কাছে জেনেছিলো দেবাংশু--- যে মাসির নাম আশালতা বাউরি।কিন্তু সেই নাম কোনদিনই মাসির কাজের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি।মাসি সেই মাসি হিসেবেই বহাল ছিল এই ঘরে--- মায়ের সামান্য ছুতমার্গ ছাড়া।
তারপর বছর দুয়েক পরে যখন টিকলি এলো,
তখন মাসির আনন্দ দেখে কে---" কি দাবাবু,
তোমার পিঠে ব্যাথা ট্যাথা হলে কেমন তেল ডলে ঠিক করে দি।আজ থেকে মনার তেল মাখানোর কাজ কিন্তু আমার। দেবাংশুর মা তখন বাতের ব্যাথায় শয্যাশায়ী।মধুজাও এই সব ব্যাপার গুলোর সাথে তেমন পরিচিত ছিল না।কিন্তু সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো মাসি।দু পা সামনে মেলে দিয়ে যখন সদ্যোজাত টিকলি কে ঘষে ঘষে তেল মাখাতো--- সে এক দেখার মত ব্যাপার।
সেই থেকেই মাসির সাথে টিকলির নাড়ির সম্পর্ক। ক্লাস থ্রি তে পড়ার সময় টিকলি এক মজার কান্ড বাঁধালো।সেদিন মাসি একটু দেরি করেই কাজে এসেছে।হাঁটাটাও ঠিক স্বাভাবিক নয়।একটু যেন পা টেনে হাঁটছে।
টিকলি কি বুঝলো কে জানে,একটা বাটিতে করে কিছুটা সরষের তেল এনে সরাসরি মাসির পায়ে তেল মালিশ করতে বসলো--- " নিশ্চয়ই তোমার পায়ে ব্যাথা হয়েছে তাই না মাসি ঠাম্মি, এসো তেল মালিশ করে তোমার ব্যাথা কমিয়ে দি।মা আমাকে বলেছে যে ছোটবেলায় আমাকে নাকি তুমি অনেক তেল মাখিয়েছো। এসো এসো। "
এক হাত জিভ কেটে ছিটকে সরে গেছিল মাসি।বামুন বাড়ির মেয়ে,সে যতোই ছোট হোক,
তাই বলে বাউরির পায়ে হাত দেবে।নরকেও তো স্থান হবে না তার।
কিন্তু টিকলি ও নাছোড়বান্দা--- তেল সে লাগাবেই।ব্যাপার টা সামলে নিলো মধুজা---
---- " মাসি তুমি চুপ করে বসো তো ওখানে।নে মা,এইবার তুই তেল লাগা ভাল করে।"
আড়াল থেকে দেবাংশু বারবার চোখের ইশারা করে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলো মা আর মেয়ে কে।কিন্তু তার কথা ধোপে টেকেনি।
মাসির তখন ডাক ছেড়ে কাঁদার অবস্থা।বৌদিমণির কড়া আদেশের সামনে পা ছড়িয়ে বসতেই হলো। আর টিকলি তার ছোট্ট হাতে একটু তেল নিয়ে যেই মাসির পায়ে ঠেকিয়েছে,
মাসির তড়াং করে এক লাফ--- " দেখ লো মনা,
আমার পা কেমন এক বারেই স্যারে গেলো "----
বলে মাসির সে কি সোজা হয়ে হাঁটার কষ্টকর প্রচেষ্টা।
এইভাবেই চলছিলো।একজন বয়স্কা মহিলার ওপর টিকলির অবাধ শাসন।কেন মাসি এ বাড়িতে চায়ে ভিজিয়ে রুটি খাবে,কেন তার মতো দুধ কর্ণফ্লেক্স আর বয়েল এগ খাবে না, এই নিয়ে টিকলির মাথা ব্যথার শেষ ছিল না।কেন মাসি সবসময়ই মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখে এই ব্যাপারেও ছিল টিকলির অদম্য কৌতূহল। সে মাঝেমধ্যেই চেষ্টা করতো মাসির মাথা থেকে ঘোমটা টা নামিয়ে দিতে,আর মাসিও চেষ্টা করতো সাত তাড়াতাড়ি ঘোমটা টা উঠিয়ে দিতে।
ঠাম্মা কে বেশি পেতো না টিকলি।বাতের ব্যাথায় বড্ড কষ্ট পেতো মানুষ টা।তাই তার সমস্ত আবদার গুলো গিয়ে পড়তো মাসি ঠাম্মির ওপর। মাঝে মাঝে টিকলি গান শোনানোর আবদার করতো মাসির কাছে।মাসির হাজার কাকুতি মিনতি ও ধোপে টিকতো না।শেষে গানের একটা হাস্যকর চেষ্টা করতো মাসি:---
" টিপির টিপির জলে
চিটা মাটি গলে
আমি সড়ক্যে গেলি গ
আমি পিছলে গেলি গ
তুকে ভাল্যে ভাল্যে "
এই গানটাই মাসি ফিসফিস করে সুর করে গাইতো।আর টিকলি বসে বসে থালা বাজাতো।
কিন্তু টিকলি হঠাৎই বড় হয়ে গেল ক্লাস সিক্সে
ঠাম্মা হঠাৎই চলে যাওয়ার।রাতে ঠাম্মাই ছিল তার শোওয়ার সঙ্গী।ঠাম্মার মলিন বুকের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তো টিকলি।
সেই ঠাম্মাই চলে গেল--- টিকলিকে অনেক টা বড় করে দিয়ে।কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল টিকলি।মাসির গান শোনার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। মাসি ও কেমন চিন্তিত হয়ে পড়লো।বার বার ছুটে গেল দেবাংশুর কাছে---" উহাকে তোমরা হাঁসানোর চিষ্টা করো দাবাবু।বডো কষ্ট পায়েছ্যে মনা।
মা চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরের কথা।কি যেন একটা কাজে বেলা নটা নাগাদ বেরোতে হলো মধুজা কে।মাসি তখন কাজে চলে এসেছে।বেরোনোর আগে পইপই করে মাসিকে বুঝিয়ে দিলো মধুজা---" আমি ঠিক দশটার মধ্যেই ফিরে টিকলি কে রেডি করে ওকে নিয়ে ওর কলেজে যাবো। আমি আসা পর্যন্ত তুমি কিন্তু থাকবে।এরমধ্যে তোমার দাবাবু আবার সাড়ে নটা নাগাদ অফিস বেরোবে।আমি আসা পর্যন্ত টিকলির দায়িত্ব কিন্তু তোমার। "
পড়িমরি করে বেরিয়ে গেল মধুজা।কিন্তু খেতে বসে দেবাংশু পড়লো মহা গেরোয়।তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেছে মধুজা।কিছুই গুছিয়ে যায়নি।গুছিয়ে দিলে সে খেতে পারে, কিন্তু গুছিয়ে কি করে নিতে হয় তা তার জানা নেই।নিজে যে থালাটায় খায় সেটাও দেখা যাচ্ছে না।অগত্যা একটা ডিশ টেনে নিয়ে হাড়ি থেকে দু মুঠো ভাত বের করলো দেবাংশু।তারপর পট থেকে হাতা করে ডাল নেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্ত মাপ ঠিক না হওয়ায় সেই ডাল ভেসে চলে এলো টেবিলে।কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না দেবাংশু।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাসি। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপ্রাণ ইচ্ছে হচ্ছে এগিয়ে এসে খাওয়ার টা ঠিক করে বেড়ে দেওয়ার। কিন্তু পারছে না।একটা সহজাত বোধ তাকে ',ের হেঁসেলে ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছে।বাউরি সম্প্রদায় ভুক্ত সে---- কিছুতেই বেড়া টা ডিঙোতে পারছে না।
টিকলি পড়ছিলো,কি বুঝলো কে জানে? এক ছুটে এগিয়ে এলো---" যাও না মাসি ঠাম্মি,বাপি কে খাবার টা গুছিয়ে দাও।বাপি তো তোমার ও ছেলের মতো তাই না? তা দেখছো যখন বুড়ো ছেলেটা পারছেনা,তখন মা হয়ে এগিয়ে যাবে না? এ কি,মাসি ঠাম্মি,কাঁদছো কেন তুমি? যাও যাও,বাপির খাওয়া তো শেষ হয়ে যাবে।"
ছুটে গিয়ে হাত দুটো সাবান দিয়ে ধুয়ে এলো মাসি।তারপর সামনে বসে খাওয়ালো তার দাবাবুকে।খাওয়াবে কি,কেঁদেই অস্থির অতো বড়ো মানুষ টা।চোখের কোণ টা ভিজে আসছিলো দেবাংশুর ও।সত্যিই মেয়েটা এই বারো তেরো বছর বয়সেই বড্ড বড় হয়ে গেল।
কিন্তু টিকলির থেকে অনেক শেখা বাকি ছিল দেবাংশুর। টিকলির সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষা।
ঠাম্মা চলে যাওয়ার পর এটাই তার প্রথম পরীক্ষা।প্রতিবার ই বেরোনোর আগে প্রথমে ঠাম্মি আর তারপর মা বাপি কে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে বেরোয় টিকলি। এবার জাস্ট একটু চেঞ্জ করে দিলো।মধুজা কপালে দইয়ের ফোঁটা একে দেওয়ার পর এক ছুটে গিয়ে প্রথমে মাসি ঠাম্মি কে গড় হয়ে প্রণাম করলো।তারপর মা আর বাপিকে প্রণাম করে কলেজ ভ্যানের দিকে হাঁটা দিলো।
ভয়ে শিউরে উঠে মাসি কিছু বলতে যাচ্ছিলো।সে বুঝতেও পারেনি যে এমন অভাবনীয় কান্ড কোনদিন ঘটতে পারে।কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো টিকলি--- " ঠাম্মি তো নেই গো,তাই সেই জায়গাতেই তোমাকে বসিয়েছি।ঠাম্মি তো আমাকে পরীক্ষা দিতে বেরোনোর আগে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতো।তুমি করবেনা?"
হাউ হাউ করে কান্নার ভেঙে পড়েছিল পাকা চুলের বুড়িটা।সে কোনদিন মনেহয় প্রণাম পায়নি।কি করে আশীর্বাদ করে তাও জানে না।তাও টিকলির মাথায় হাত দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললো,তারপর আঁচলের খুট খুলে একটা মলিন দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো টিকলির হাতে--" কাল তুমার বাপি কে বইলব্যে ডাব আইনত্যে।"
অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দেবাংশু আর মধুজা।দর্শকের চোখের আড়ালে কি সুন্দর একটা সিনেমা সংগঠিত হয়ে গেলো কেউ জানতেও পারলো না।"
টিকলি গাড়িতে ওঠার আগে এগিয়ে গেল মধুজা।মুখটা নামিয়ে আনলো টিকলির কানের কাছে----" এই দশ টাকা তুই কোনদিন খরচ করিস না মা।এর মূল্য তুই বড় হলে ঠিক বুঝবি।"
( শেষ )
? দেবকমল চক্রবর্তী
( সম্পূর্ণ নতুন গল্প)
" একটু কম দামের মধ্যে কিছু শাড়ি দেখান তো।এই বড়জোর চারশো পাঁচশোর মধ্যে।"
দেবাংশুর প্রশ্নের উত্তরে অভিজ্ঞ সেলসম্যান
এক মুহূর্ত চিন্তা করেনি---" আর বলতে হবে না দাদা।বাড়ির কাজের মাসির জন্য পুজোর শাড়ি
চাচ্ছেন তো?"--- বলেই এক গাদা শাড়ির একটা লট নামিয়ে দেয় দেবাংশু আর মধুজার দিকে।
পুজোর আগের আলোকজ্বল বাজার। সবাই পুজোর কেনাকাটা সারতে ব্যস্ত। দেবাংশুর ছুটি খুব কম।তাই এক রোববার দেখেই বেরিয়েছিলো মধুজা কে নিয়ে।একমাত্র মেয়ে টিকলির পোশাক আগেই কেনা হয়ে গেছিল, তাই দুজনেরই ইচ্ছে ছিল ওকে ঠাম্মার কাছে রেখে আসার।এই সময় প্রচন্ড ভীড় হয় দোকানে। কিন্তু বাধ সেধেছিলো টিকলি নিজেই,
----- ওর একটাই ইচ্ছে সবার জিনিস ও নিজে দেখে কিনবে।মাত্র ফোরে পড়লে কি হবে?টিকলি যাকে বলে একটা চলমান বিশ্বকোষ। হেন কোন বিষয় নেই,যা নিয়ে ও কথা বলে না। তাই দশটা ক্যাডবেরির প্রলোভন ও ওকে বিরত করতে পারলো না।
তা টিকলি কোন গোলমাল ও করেনি।দুজনের মাঝে শান্ত হয়ে বসেছিলো।কিন্তু বাবার এই কথা শুনে মুখ খুলতে দেরি করলো না---" কি বলছো গো তুমি বাপি? নিজের, মায়ের, ঠাম্মির, পিসিমণির জন্য এত দামী দামী পোশাক কিনলে আর মাসি ঠাম্মির জন্য মাত্র চারশো? কেন বাপী? মাসি ঠাম্মির তো মোটেই দুটো কাপড়,তাও কত জায়গায় ছিড়ে গেছে।তুমি একটা ভাল শাড়ি মাসি ঠাম্মির জন্য এখুনি কেনো।"
মুখের ওপর কে যেন এক পোচ কালি বুলিয়ে দিয়েছিলো দেবাংশুর। পাশে মধুজার মুখ ও চুণ।মেয়ের কাছ থেকে যে এই এক হাট লোকের মধ্যে এমন একটা প্রতিবাদ আসবে বুঝতেই পারেনি----" ঠিক আছে বেটা,আর একদিন নয় আমরা তিনজনে এসে তোমার মাসি ঠাম্মির জন্য ভাল শাড়ি কিনে নিয়ে যাবো " ---- এই বলে কোনমতে সে যাত্রা সামলাতে পেরেছিলো।
বস্তুত জ্ঞান হবার পর থেকেই বাড়িতে দুটো বয়স্কা মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে এসেছে টিকলি--- এক তার ঠাম্মি আর একজন মাসি ঠাম্মি।এই মাসি ঠাম্মি-- নামটা অবশ্যই তার নিজস্ব উদ্ভাবন। সত্যি বলতে কি এই মাসির নাম কোনদিনই জানার চেষ্টা করেনি দেবাংশু।
তার কলেজ লাইফের সময় থেকেই মাসি এ বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক। মায়ের দেখাদেখি সেও মাসিই বলতো।তারপর কলেজ, কলেজ চাকরির গন্ডী পেরিয়ে যখন মধুজা ঘরে এলো--- সেও তো সেই মাসি বলতে অজ্ঞান।পরে একবার অবশ্য মায়ের কাছে জেনেছিলো দেবাংশু--- যে মাসির নাম আশালতা বাউরি।কিন্তু সেই নাম কোনদিনই মাসির কাজের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি।মাসি সেই মাসি হিসেবেই বহাল ছিল এই ঘরে--- মায়ের সামান্য ছুতমার্গ ছাড়া।
তারপর বছর দুয়েক পরে যখন টিকলি এলো,
তখন মাসির আনন্দ দেখে কে---" কি দাবাবু,
তোমার পিঠে ব্যাথা ট্যাথা হলে কেমন তেল ডলে ঠিক করে দি।আজ থেকে মনার তেল মাখানোর কাজ কিন্তু আমার। দেবাংশুর মা তখন বাতের ব্যাথায় শয্যাশায়ী।মধুজাও এই সব ব্যাপার গুলোর সাথে তেমন পরিচিত ছিল না।কিন্তু সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলো মাসি।দু পা সামনে মেলে দিয়ে যখন সদ্যোজাত টিকলি কে ঘষে ঘষে তেল মাখাতো--- সে এক দেখার মত ব্যাপার।
সেই থেকেই মাসির সাথে টিকলির নাড়ির সম্পর্ক। ক্লাস থ্রি তে পড়ার সময় টিকলি এক মজার কান্ড বাঁধালো।সেদিন মাসি একটু দেরি করেই কাজে এসেছে।হাঁটাটাও ঠিক স্বাভাবিক নয়।একটু যেন পা টেনে হাঁটছে।
টিকলি কি বুঝলো কে জানে,একটা বাটিতে করে কিছুটা সরষের তেল এনে সরাসরি মাসির পায়ে তেল মালিশ করতে বসলো--- " নিশ্চয়ই তোমার পায়ে ব্যাথা হয়েছে তাই না মাসি ঠাম্মি, এসো তেল মালিশ করে তোমার ব্যাথা কমিয়ে দি।মা আমাকে বলেছে যে ছোটবেলায় আমাকে নাকি তুমি অনেক তেল মাখিয়েছো। এসো এসো। "
এক হাত জিভ কেটে ছিটকে সরে গেছিল মাসি।বামুন বাড়ির মেয়ে,সে যতোই ছোট হোক,
তাই বলে বাউরির পায়ে হাত দেবে।নরকেও তো স্থান হবে না তার।
কিন্তু টিকলি ও নাছোড়বান্দা--- তেল সে লাগাবেই।ব্যাপার টা সামলে নিলো মধুজা---
---- " মাসি তুমি চুপ করে বসো তো ওখানে।নে মা,এইবার তুই তেল লাগা ভাল করে।"
আড়াল থেকে দেবাংশু বারবার চোখের ইশারা করে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলো মা আর মেয়ে কে।কিন্তু তার কথা ধোপে টেকেনি।
মাসির তখন ডাক ছেড়ে কাঁদার অবস্থা।বৌদিমণির কড়া আদেশের সামনে পা ছড়িয়ে বসতেই হলো। আর টিকলি তার ছোট্ট হাতে একটু তেল নিয়ে যেই মাসির পায়ে ঠেকিয়েছে,
মাসির তড়াং করে এক লাফ--- " দেখ লো মনা,
আমার পা কেমন এক বারেই স্যারে গেলো "----
বলে মাসির সে কি সোজা হয়ে হাঁটার কষ্টকর প্রচেষ্টা।
এইভাবেই চলছিলো।একজন বয়স্কা মহিলার ওপর টিকলির অবাধ শাসন।কেন মাসি এ বাড়িতে চায়ে ভিজিয়ে রুটি খাবে,কেন তার মতো দুধ কর্ণফ্লেক্স আর বয়েল এগ খাবে না, এই নিয়ে টিকলির মাথা ব্যথার শেষ ছিল না।কেন মাসি সবসময়ই মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখে এই ব্যাপারেও ছিল টিকলির অদম্য কৌতূহল। সে মাঝেমধ্যেই চেষ্টা করতো মাসির মাথা থেকে ঘোমটা টা নামিয়ে দিতে,আর মাসিও চেষ্টা করতো সাত তাড়াতাড়ি ঘোমটা টা উঠিয়ে দিতে।
ঠাম্মা কে বেশি পেতো না টিকলি।বাতের ব্যাথায় বড্ড কষ্ট পেতো মানুষ টা।তাই তার সমস্ত আবদার গুলো গিয়ে পড়তো মাসি ঠাম্মির ওপর। মাঝে মাঝে টিকলি গান শোনানোর আবদার করতো মাসির কাছে।মাসির হাজার কাকুতি মিনতি ও ধোপে টিকতো না।শেষে গানের একটা হাস্যকর চেষ্টা করতো মাসি:---
" টিপির টিপির জলে
চিটা মাটি গলে
আমি সড়ক্যে গেলি গ
আমি পিছলে গেলি গ
তুকে ভাল্যে ভাল্যে "
এই গানটাই মাসি ফিসফিস করে সুর করে গাইতো।আর টিকলি বসে বসে থালা বাজাতো।
কিন্তু টিকলি হঠাৎই বড় হয়ে গেল ক্লাস সিক্সে
ঠাম্মা হঠাৎই চলে যাওয়ার।রাতে ঠাম্মাই ছিল তার শোওয়ার সঙ্গী।ঠাম্মার মলিন বুকের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তো টিকলি।
সেই ঠাম্মাই চলে গেল--- টিকলিকে অনেক টা বড় করে দিয়ে।কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল টিকলি।মাসির গান শোনার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। মাসি ও কেমন চিন্তিত হয়ে পড়লো।বার বার ছুটে গেল দেবাংশুর কাছে---" উহাকে তোমরা হাঁসানোর চিষ্টা করো দাবাবু।বডো কষ্ট পায়েছ্যে মনা।
মা চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরের কথা।কি যেন একটা কাজে বেলা নটা নাগাদ বেরোতে হলো মধুজা কে।মাসি তখন কাজে চলে এসেছে।বেরোনোর আগে পইপই করে মাসিকে বুঝিয়ে দিলো মধুজা---" আমি ঠিক দশটার মধ্যেই ফিরে টিকলি কে রেডি করে ওকে নিয়ে ওর কলেজে যাবো। আমি আসা পর্যন্ত তুমি কিন্তু থাকবে।এরমধ্যে তোমার দাবাবু আবার সাড়ে নটা নাগাদ অফিস বেরোবে।আমি আসা পর্যন্ত টিকলির দায়িত্ব কিন্তু তোমার। "
পড়িমরি করে বেরিয়ে গেল মধুজা।কিন্তু খেতে বসে দেবাংশু পড়লো মহা গেরোয়।তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেছে মধুজা।কিছুই গুছিয়ে যায়নি।গুছিয়ে দিলে সে খেতে পারে, কিন্তু গুছিয়ে কি করে নিতে হয় তা তার জানা নেই।নিজে যে থালাটায় খায় সেটাও দেখা যাচ্ছে না।অগত্যা একটা ডিশ টেনে নিয়ে হাড়ি থেকে দু মুঠো ভাত বের করলো দেবাংশু।তারপর পট থেকে হাতা করে ডাল নেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্ত মাপ ঠিক না হওয়ায় সেই ডাল ভেসে চলে এলো টেবিলে।কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না দেবাংশু।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাসি। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপ্রাণ ইচ্ছে হচ্ছে এগিয়ে এসে খাওয়ার টা ঠিক করে বেড়ে দেওয়ার। কিন্তু পারছে না।একটা সহজাত বোধ তাকে ',ের হেঁসেলে ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছে।বাউরি সম্প্রদায় ভুক্ত সে---- কিছুতেই বেড়া টা ডিঙোতে পারছে না।
টিকলি পড়ছিলো,কি বুঝলো কে জানে? এক ছুটে এগিয়ে এলো---" যাও না মাসি ঠাম্মি,বাপি কে খাবার টা গুছিয়ে দাও।বাপি তো তোমার ও ছেলের মতো তাই না? তা দেখছো যখন বুড়ো ছেলেটা পারছেনা,তখন মা হয়ে এগিয়ে যাবে না? এ কি,মাসি ঠাম্মি,কাঁদছো কেন তুমি? যাও যাও,বাপির খাওয়া তো শেষ হয়ে যাবে।"
ছুটে গিয়ে হাত দুটো সাবান দিয়ে ধুয়ে এলো মাসি।তারপর সামনে বসে খাওয়ালো তার দাবাবুকে।খাওয়াবে কি,কেঁদেই অস্থির অতো বড়ো মানুষ টা।চোখের কোণ টা ভিজে আসছিলো দেবাংশুর ও।সত্যিই মেয়েটা এই বারো তেরো বছর বয়সেই বড্ড বড় হয়ে গেল।
কিন্তু টিকলির থেকে অনেক শেখা বাকি ছিল দেবাংশুর। টিকলির সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষা।
ঠাম্মা চলে যাওয়ার পর এটাই তার প্রথম পরীক্ষা।প্রতিবার ই বেরোনোর আগে প্রথমে ঠাম্মি আর তারপর মা বাপি কে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে বেরোয় টিকলি। এবার জাস্ট একটু চেঞ্জ করে দিলো।মধুজা কপালে দইয়ের ফোঁটা একে দেওয়ার পর এক ছুটে গিয়ে প্রথমে মাসি ঠাম্মি কে গড় হয়ে প্রণাম করলো।তারপর মা আর বাপিকে প্রণাম করে কলেজ ভ্যানের দিকে হাঁটা দিলো।
ভয়ে শিউরে উঠে মাসি কিছু বলতে যাচ্ছিলো।সে বুঝতেও পারেনি যে এমন অভাবনীয় কান্ড কোনদিন ঘটতে পারে।কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলো টিকলি--- " ঠাম্মি তো নেই গো,তাই সেই জায়গাতেই তোমাকে বসিয়েছি।ঠাম্মি তো আমাকে পরীক্ষা দিতে বেরোনোর আগে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতো।তুমি করবেনা?"
হাউ হাউ করে কান্নার ভেঙে পড়েছিল পাকা চুলের বুড়িটা।সে কোনদিন মনেহয় প্রণাম পায়নি।কি করে আশীর্বাদ করে তাও জানে না।তাও টিকলির মাথায় হাত দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললো,তারপর আঁচলের খুট খুলে একটা মলিন দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো টিকলির হাতে--" কাল তুমার বাপি কে বইলব্যে ডাব আইনত্যে।"
অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দেবাংশু আর মধুজা।দর্শকের চোখের আড়ালে কি সুন্দর একটা সিনেমা সংগঠিত হয়ে গেলো কেউ জানতেও পারলো না।"
টিকলি গাড়িতে ওঠার আগে এগিয়ে গেল মধুজা।মুখটা নামিয়ে আনলো টিকলির কানের কাছে----" এই দশ টাকা তুই কোনদিন খরচ করিস না মা।এর মূল্য তুই বড় হলে ঠিক বুঝবি।"
( শেষ )