08-01-2023, 12:23 PM
(This post was last modified: 14-06-2023, 12:36 AM by Bangla Golpo. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
সাজু ভাই -সিরিজ- নম্বর-০৩
গল্প:-সরি আব্বাজান।
পর্বঃ- ০১
লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
---------------------------
রাত তিনটা। বাবা কল দিয়ে বললো " তোর মাকে এইমাত্র খুন করেছি আমিও আত্মহত্যা করব। যদি পারিস তাে আমাকে ক্ষমা করে দিস। সকালে এসে আমাদের লাশ দুটো দাফনের ব্যবস্থা করিস, এই পৃথিবীতে তুই একা হয়ে গেলি, চিন্তা করিস না দুরের ওই আকাশ থেকে তোকে আশীর্বাদ সর্বদা করবো। "
- আমি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললাম, বাবা তুমি এসব কি বলছো? মাকে কেন খুন করছো? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না, নাকি মজা করছো? "
- বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করবো না, তোর মা এতক্ষণে পরপারে অনেকদূর চলে গেছে। আমি এখনই আত্মহত্যা করে তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করবো নাহলে সে হারিয়ে যাবে।
- বাবা প্লিজ, মায়ের কাছে মোবাইল দাও আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।
- সে তো গলা কাটা অবস্থায় নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে, তুই সকাল বেলা তাড়াতাড়ি গ্রামের বাড়িতে চলে আয়। আমাদের দুজনের লাশ যেন পুলিশ পোস্টমর্টেম করে কাটাছেঁড়া না করে।
মোবাইল কেটে গেল, সঙ্গে সঙ্গে বাবার নাম্বার আবারও কল দিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ। মায়ের নাম্বারে কল দিলাম, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। বিছানায় বসে কান্না করতে লাগলাম, আমার রুমমেট তৌহিদ ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমার কাছে এলো। তারপর আমি তাকে বললাম আর সে বললো বাড়ির আশেপাশে কারো কাছে কল দিয়ে খবর নিতে।
সঙ্গে সঙ্গে চাচাতো ভাই মনিরুলের কাছে কল দিলাম, প্রায় পাঁচবার কল করার পরে চাচাতো ভাই ঘুমঘুম জড়িত কণ্ঠে বললো " কিরে লিমন? এতরাতে কেউ কল করে? নাকি জরুরি কিছু? "
- আমি কান্না করতে করতে বললাম, মনির ভাই আমাদের বাড়িতে একটু দেখবা মা-বাবা কেমন আছে?
- কেন? চাচা চাচীর কি হয়েছে?
- বাবা নাকি মাকে খুন করেছে আর সে নিজেও এখন আত্মহত্যা করবে। আমাকে কল দিয়ে এসব বলে কল কেটে দিয়েছে, আমি তো শহরে আছি তাই তুমি একটু যাবে?
- বলিস কি? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, হায় আল্লাহ চাচা কেন চাচিকে খুন করবে?
- তুমি একটু তাড়াতাড়ি যাও, আর গিয়ে আমাকে কল দিয়ে জানিও। আমি বরং ততক্ষণে সবকিছু গুছিয়ে রওনা দিচ্ছি, প্লিজ তাড়াতাড়ি যাও।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি খাট থেকে নেমে তাড়াতাড়ি প্যান্ট শার্ট পরা শুরু করেছি, তৌহিদ কি করবে বুঝতে না পেরে আমাকে বললো " আমিও তোর সঙ্গে যাবো। "
- তুই কেন যাবি?
- সত্যি সত্যি যদি চাচা চাচির বিপদ হয়ে যায় তবে তো...
- প্লিজ এমন বলিস না, পৃথিবীতে আমার মা-বাবা ছাড়া কেউ নেই।
- আচ্ছা মাথা ঠান্ডা কর আর চল তাড়াতাড়ি।
রুম থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছি, কোন ধরনের গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। মেইন রাস্তার দিকে গিয়ে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে, তাই স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছি। মুজগুন্নি বাসস্ট্যান্ডে এসে একটা মাহিন্দা পেলাম, রাতের বেলা দু'একটা গাড়ি চলে জানতাম তাই উঠে বসলাম। মাহিন্দার মধ্যে বসা অবস্থায় মনির ভাই কল দিলেন।
- হ্যাঁ মনির ভাই?
- লিমন তোদের রুমের দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ করা, ভিতরে বাতি জ্বলে। কিন্তু ডাকাডাকি করে কোন শব্দ পাচ্ছি না, এখন কি করবো?
- আপনি দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করুন, তাড়াতাড়ি করুন মনির ভাই।
- সত্যি সত্যি যদি তেমন কিছু হয়ে যায় তাহলে আবার পুলিশের ঝামেলা হবে না তো? কারণ পুলিশ যদি তখন বলে যে আমি দরজা কেন ভেঙ্গে প্রবেশ করলাম?
- না কিছু হবে না, আমি তখন বলবো যে আমার নির্দেশে আপনারা দরজা ভেঙ্গেছেন।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
কল কেটে দিয়ে এক অস্থিরতার মধ্যে হাহুতাশ করতে লাগলাম। ভিতরে ঢুকে তারা কি খবর দেয় সেটা অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার মা-বাবার মধ্যে তো কোন রাগারাগি দেখিনি কোনোদিন তাহলে কেন এমন করবে বাবা?
- মিনিট দশেক পরে মনির ভাই কল দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো " লিমন তুই কোথায়? "
- আমি চিৎকার করে বললাম, মনির ভাই আমি গাড়িতে আছি, কিন্তু মা-বাবা ঠিক আছে তো?
- কিছু ঠিক নেই লিমন, চাচা চাচী দুজনের লাশ হয়ে গেছে লিমন, তুই তাড়াতাড়ি আয় তোর বাবা মা আর দুনিয়ায় নেই।
আমি তখন একটা চিৎকার করে আর কিছু বলতে পারি নাই, তৌহিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল। মাহিন্দার মধ্যে আরও দুজন যাত্রী ছিল তারা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইল।
রূপসা নদীর ঘাটে গিয়ে কোন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর তৌহিদ বললো " আমাদের বন্ধু পারভেজের তো বাইক আছে, তাকে কল দিয়ে কি আসতে বলবো? "
- হ্যাঁ চেষ্টা কর।
পারভেজের বাসা টুটপাড়া কবরস্থানের কাছেই, সে শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বাইক নিয়ে বেরিয়ে এলো। আধা ঘণ্টা পরে সে যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছাল তখন তিনজনে মিলে রূপসা ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে তৌহিদ শক্ত করে ধরে রেখেছে, পারভেজ তখন যতটা সম্ভব সাবধানে বাইক চালাচ্ছে।
পিরোজপুরে গ্রামের বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এরমধ্যে আমাদের বাড়ি ভর্তি মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, ভোররাত থেকে যারা শুনেছে তারা সবাই চলে এসেছে। থানা থেকে পুলিশ এখনো আসেনি তাই লাশ ঠিক সেভাবেই পরে আছে।
মা-বাবার শোবার ঘরে ফ্লোরে গলাকাটা মরদেহ অবস্থায় পরে আছে আমার প্রিয় মা। তারই কাছে গলাকাটা অবস্থায় পরে আছে বাবা, আর বাবার হাতের কাছেই একটা ছুরি। দেখেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে বাবা নিজেই নিজের গলা কেটে ফেলেছে।
কিন্তু কেন? কিসের জন্য?
বাবার মনে তো এমন কোন কষ্ট ছিল না, যাতে করে সে এভাবে মাকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করতে পারে। তাহলে কারণ কি?
আমার চিৎকারে তখন ঘরের দরজাজানালা সব ভেঙ্গে যাবার উপক্রম, মনির ভাই, পারভেজ ও তৌহিদ মিলে আমাকে ধরে রাখতে ব্যস্ত। এমনটা কেন হয়ে গেল? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? কে আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে আর কে আমার জন্য বাজারের শ্রেষ্ঠ মাছ কিনে নিয়ে আসবে? হঠাৎ করে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সবকিছু চোখের সামনে ঘুরছে, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাচ্ছি।
|
যদি কেউ চোখ মেলে তাকালাম তখন আমি শুয়ে আছি ঘরের সম্মুখের বারান্দায়। এই বিছানায় আমি বাড়িতে এলে ঘুমাতাম, আর বাড়িতে যখন থাকতাম না তখন বাবা বিকেলে বিকেলে এখানে দুপুরের পরে বিশ্রাম করতো। বাবার শরীরের সেই পানখাওয়া গন্ধ নাকে আসছে, ধুম করে বিছানায় উঠে বসলাম।
- তৌহিদকে বললাম " মা-বাবা কোই? "
- পুলিশ এসে নিয়ে গেছে, ময়নাতদন্তের পরে নাকি আমাদের কাছে নিয়ে আসবে।
- অসম্ভব, আমার বাবা বলে গিয়েছে যেন তাদের লাশ কাটাছেঁড়া না করা হয়।
- কিন্তু তুই হয়তো চাইলে রাখতে পারতি, তবে তুই অজ্ঞান থাকার কারণে কিছু করতে পারি নাই। আর পুলিশের কাছে আমি আর মনির ভাই যতটা জানি ততটা বললাম। তোর কাছে আঙ্কেল কল দিয়ে যা যা বলেছে তারপর আমরা দুজন রওনা দিলাম, আর মনির ভাইদের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করার সবকিছু বললাম।
- এখন আমি আমার মা-বাবার লাশ কাটাছেঁড়া থেকে রক্ষা করবো কীভাবে?
- তুই চাইলে একবার চেষ্টা করতে পারো, আঙ্কেল নিজে যদি আন্টিকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয় তাহলে আর কাটাছেঁড়া করে কি হবে? আর বাহিরে দুজন পুলিশ এখনো আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারো।
পুলিশের সঙ্গে আমি আবার সবকিছু বললাম, তারা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে খবর দিতে বলে দিল। আমি চেয়ারম্যানকে কল দিলাম মনির ভাই এর কাছ থেকে নাম্বার নিলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়িতে এলেন, তারপর আমি তাকে বললাম যে মা-বাবার লাশ ময়নাতদন্তের দরকার নেই। তিনি বললেন যে তাহলে এমপির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এবং তিনি থানায় বলে দেবেন।
মানসিকতার এতটা খারাপ অবস্থা তবুও অনেক ঝামেলার মাধ্যমে মা-বাবার লাশ ময়নাতদন্তের হাত থেকে রক্ষা করলাম। কিন্তু মনের মধ্যে সেই একটা প্রশ্ন ঘুরছে " বাবা এমনটা কেন করলো? "
মাগরিবের কিছুক্ষণ আগেই মা-বাবার দাফন করা শেষ হয়ে গেল, বাড়ি থেকে বের হবাে পথে গেটের কাছে রাস্তার পাশেই ডানহাতে একটু ফাঁকা জমি আছে। বছর খানিক আগে একদিন সেখানে কিছু শুপাড়ি গাছের চারা রোপণ করার সময় মা আমার সঙ্গে বলেছিল
" তোর বাবা আর আমি মারা গেলে আমাদেরকে এখানে কবর দিস লিমন, আমরা তো মানুষ বেশি নয়। তুই বাড়ি থেকে বের হবার সময় আমাদের কবরে সালাম দিয়ে বের হতে পারবি। আবার যখন বাড়িতে ফিরবি তখনও আমাদের সালাম দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করবি। রাস্তা দিয়ে যখন মসজিদ এর ইমাম কিংবা কোন ভালো মানুষ হেঁটে যাবে তখন আমাদের জন্য দোয়া করবে। "
আমি সেদিন হেসেছিলাম, কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আমার মা-বাবা এখনো অনেকদিন বাচবে। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের সন্তানেরা চায় তাদের মা-বাবা চিরকাল বেঁচে থাকুক।
মা-বাবাকে সেখানেই কবর দিলাম, এখন আর চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। দাফনকাজ শেষ করে সবাই চলে গেছে, শুধু আশেপাশের কিছু মানুষ আছে। মনির ভাই বরাবরই আমার কাছে বসে কান্না করছে, বাবা তাকে খুব পছন্দ করতো।
পাশের ঘরের প্রতিবেশী এক চাচি আমাকে মাথায় তেল দিয়ে দিল, কপালে আর আর মুখে হাত দিয়ে আদর করে বললো " এভাবে ওরা চলে যাবে তা কখনো ভাবিনি, যা হবাে হয়ে গেছে মনকে শক্ত কর। আমরা তো আছিই। "
সারাদিনে মোবাইল বের করার সুযোগ হয়নি, সেই যে সকাল বেলা পকেটে রেখেছি সেভাবেই পকেটে পরে আছে। বের করে দেখি মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে, চালু করতে গিয়ে দেখি চার্জ আছে। তাহলে মনে হয় চাপ লেগে বন্ধ হয়েছে কারণ মোবাইলের ব্যাটারি একটু লুজ তাই মাঝে মাঝে ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে যায়। কাগজ দিয়ে জাম করে রাখি।
মোবাইল চালু করলাম, তারপর কললিস্টে গিয়ে বাবার নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গতকাল রাতেও এমন সময় খাবার খেয়ে কল দিয়ে কথা বলেছিলাম, মাত্র ২৪ ঘন্টা ইসসসস।
হঠাৎ করে চোখ গেল উপরে মেসেজের চিন্হের উপর, মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখি অনেক গুলো মেসেজ। সচারাচর সিম কোম্পানির অজস্র অপ্রয়োজনীয় মেসেজের জন্য এখন মেসেজ চেক না করে ডিলিট করতাম।
কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বাবার নাম্বার দিয়ে একটা মেসেজ দেখে অবাক হলাম। গতকাল রাত ২:৫৩ মিনিটে মেসেজ এসেছে, আর বাবা আমাকে কল করেছিল রাত ৩:০৯ মিনিটে।
মেসেজ পড়ে আমার হাত কাঁপছে। লেখা আছে:-
" তোকে বাঁচাতে গিয়ে তোর মা'কে খুন করলাম এইমাত্র, ২৫ বছরের সংসার জীবনে যাকে আমি কখনো একটা চড় মারিনি। তাকেই একটু আগে নিজের হাতে জবাই করেছি, এখন আমার নিজের গলাও কাটবো। ওরা সবাই এখন আমর চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে, তোকে কল দিয়ে বাড়িতে আসার জন্য আমাকে বলছে। আমি সেই ফাঁকে তোকে কল না দিয়ে আগে মেসেজ দিচ্ছি, ওদের বলছি যে নাম্বার খুঁজে পাচ্ছি না। তোকে কল দিয়ে আমি হয়তো নিরুপায় হয়ে বাড়িতে আসতে বলবো, কিন্তু খবরদার তুই আসবি না। কারা এসব করছে সেটা তোর জানার দরকার নেই, কিন্তু তুই আর কোনদিন গ্রামের বাড়িতে আসবি না বাবা। তাহলে ওরা তোকেও খুন করে ফেলবে, আমি চাইনা যে আমাদের মৃত্যুর জন্য তুই প্রতিশোধ নিস তাই সেই খুনিদের নাম বললাম না। আমি আর তোর মা তোর জন্য জীবন দিয়ে গেলাম, আমাদের স্বপ্ন ছিল তুই অনেক বড় হবি রে, আমাদের স্বপ্ন তুমি পুরণ করিস বাবা। আকাশে বসে যেন তোকে দেখে আমি আর তো মা হাসতে পারি। "
বাবার মেসেজ দেখে শরীর কাঁপছে, আমি তো এই মেসেজ গতকাল দেখিনি। বাবা আমাকে গ্রামের বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছে কিন্তু আমি তো না জেনে চলে এসেছি। তাহলে কি আমাকে এখন তারা খুন করবে? কিন্তু কারা খুন করবে?
.
চলবে...?
গল্প:-সরি আব্বাজান।
পর্বঃ- ০১
লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)
---------------------------
রাত তিনটা। বাবা কল দিয়ে বললো " তোর মাকে এইমাত্র খুন করেছি আমিও আত্মহত্যা করব। যদি পারিস তাে আমাকে ক্ষমা করে দিস। সকালে এসে আমাদের লাশ দুটো দাফনের ব্যবস্থা করিস, এই পৃথিবীতে তুই একা হয়ে গেলি, চিন্তা করিস না দুরের ওই আকাশ থেকে তোকে আশীর্বাদ সর্বদা করবো। "
- আমি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললাম, বাবা তুমি এসব কি বলছো? মাকে কেন খুন করছো? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না, নাকি মজা করছো? "
- বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করবো না, তোর মা এতক্ষণে পরপারে অনেকদূর চলে গেছে। আমি এখনই আত্মহত্যা করে তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করবো নাহলে সে হারিয়ে যাবে।
- বাবা প্লিজ, মায়ের কাছে মোবাইল দাও আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।
- সে তো গলা কাটা অবস্থায় নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে, তুই সকাল বেলা তাড়াতাড়ি গ্রামের বাড়িতে চলে আয়। আমাদের দুজনের লাশ যেন পুলিশ পোস্টমর্টেম করে কাটাছেঁড়া না করে।
মোবাইল কেটে গেল, সঙ্গে সঙ্গে বাবার নাম্বার আবারও কল দিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ। মায়ের নাম্বারে কল দিলাম, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। বিছানায় বসে কান্না করতে লাগলাম, আমার রুমমেট তৌহিদ ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমার কাছে এলো। তারপর আমি তাকে বললাম আর সে বললো বাড়ির আশেপাশে কারো কাছে কল দিয়ে খবর নিতে।
সঙ্গে সঙ্গে চাচাতো ভাই মনিরুলের কাছে কল দিলাম, প্রায় পাঁচবার কল করার পরে চাচাতো ভাই ঘুমঘুম জড়িত কণ্ঠে বললো " কিরে লিমন? এতরাতে কেউ কল করে? নাকি জরুরি কিছু? "
- আমি কান্না করতে করতে বললাম, মনির ভাই আমাদের বাড়িতে একটু দেখবা মা-বাবা কেমন আছে?
- কেন? চাচা চাচীর কি হয়েছে?
- বাবা নাকি মাকে খুন করেছে আর সে নিজেও এখন আত্মহত্যা করবে। আমাকে কল দিয়ে এসব বলে কল কেটে দিয়েছে, আমি তো শহরে আছি তাই তুমি একটু যাবে?
- বলিস কি? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, হায় আল্লাহ চাচা কেন চাচিকে খুন করবে?
- তুমি একটু তাড়াতাড়ি যাও, আর গিয়ে আমাকে কল দিয়ে জানিও। আমি বরং ততক্ষণে সবকিছু গুছিয়ে রওনা দিচ্ছি, প্লিজ তাড়াতাড়ি যাও।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি খাট থেকে নেমে তাড়াতাড়ি প্যান্ট শার্ট পরা শুরু করেছি, তৌহিদ কি করবে বুঝতে না পেরে আমাকে বললো " আমিও তোর সঙ্গে যাবো। "
- তুই কেন যাবি?
- সত্যি সত্যি যদি চাচা চাচির বিপদ হয়ে যায় তবে তো...
- প্লিজ এমন বলিস না, পৃথিবীতে আমার মা-বাবা ছাড়া কেউ নেই।
- আচ্ছা মাথা ঠান্ডা কর আর চল তাড়াতাড়ি।
রুম থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছি, কোন ধরনের গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। মেইন রাস্তার দিকে গিয়ে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে, তাই স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছি। মুজগুন্নি বাসস্ট্যান্ডে এসে একটা মাহিন্দা পেলাম, রাতের বেলা দু'একটা গাড়ি চলে জানতাম তাই উঠে বসলাম। মাহিন্দার মধ্যে বসা অবস্থায় মনির ভাই কল দিলেন।
- হ্যাঁ মনির ভাই?
- লিমন তোদের রুমের দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ করা, ভিতরে বাতি জ্বলে। কিন্তু ডাকাডাকি করে কোন শব্দ পাচ্ছি না, এখন কি করবো?
- আপনি দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করুন, তাড়াতাড়ি করুন মনির ভাই।
- সত্যি সত্যি যদি তেমন কিছু হয়ে যায় তাহলে আবার পুলিশের ঝামেলা হবে না তো? কারণ পুলিশ যদি তখন বলে যে আমি দরজা কেন ভেঙ্গে প্রবেশ করলাম?
- না কিছু হবে না, আমি তখন বলবো যে আমার নির্দেশে আপনারা দরজা ভেঙ্গেছেন।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
কল কেটে দিয়ে এক অস্থিরতার মধ্যে হাহুতাশ করতে লাগলাম। ভিতরে ঢুকে তারা কি খবর দেয় সেটা অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার মা-বাবার মধ্যে তো কোন রাগারাগি দেখিনি কোনোদিন তাহলে কেন এমন করবে বাবা?
- মিনিট দশেক পরে মনির ভাই কল দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো " লিমন তুই কোথায়? "
- আমি চিৎকার করে বললাম, মনির ভাই আমি গাড়িতে আছি, কিন্তু মা-বাবা ঠিক আছে তো?
- কিছু ঠিক নেই লিমন, চাচা চাচী দুজনের লাশ হয়ে গেছে লিমন, তুই তাড়াতাড়ি আয় তোর বাবা মা আর দুনিয়ায় নেই।
আমি তখন একটা চিৎকার করে আর কিছু বলতে পারি নাই, তৌহিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল। মাহিন্দার মধ্যে আরও দুজন যাত্রী ছিল তারা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইল।
রূপসা নদীর ঘাটে গিয়ে কোন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, কিছুক্ষণ পর তৌহিদ বললো " আমাদের বন্ধু পারভেজের তো বাইক আছে, তাকে কল দিয়ে কি আসতে বলবো? "
- হ্যাঁ চেষ্টা কর।
পারভেজের বাসা টুটপাড়া কবরস্থানের কাছেই, সে শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বাইক নিয়ে বেরিয়ে এলো। আধা ঘণ্টা পরে সে যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছাল তখন তিনজনে মিলে রূপসা ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে তৌহিদ শক্ত করে ধরে রেখেছে, পারভেজ তখন যতটা সম্ভব সাবধানে বাইক চালাচ্ছে।
পিরোজপুরে গ্রামের বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এরমধ্যে আমাদের বাড়ি ভর্তি মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, ভোররাত থেকে যারা শুনেছে তারা সবাই চলে এসেছে। থানা থেকে পুলিশ এখনো আসেনি তাই লাশ ঠিক সেভাবেই পরে আছে।
মা-বাবার শোবার ঘরে ফ্লোরে গলাকাটা মরদেহ অবস্থায় পরে আছে আমার প্রিয় মা। তারই কাছে গলাকাটা অবস্থায় পরে আছে বাবা, আর বাবার হাতের কাছেই একটা ছুরি। দেখেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে বাবা নিজেই নিজের গলা কেটে ফেলেছে।
কিন্তু কেন? কিসের জন্য?
বাবার মনে তো এমন কোন কষ্ট ছিল না, যাতে করে সে এভাবে মাকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করতে পারে। তাহলে কারণ কি?
আমার চিৎকারে তখন ঘরের দরজাজানালা সব ভেঙ্গে যাবার উপক্রম, মনির ভাই, পারভেজ ও তৌহিদ মিলে আমাকে ধরে রাখতে ব্যস্ত। এমনটা কেন হয়ে গেল? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? কে আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে আর কে আমার জন্য বাজারের শ্রেষ্ঠ মাছ কিনে নিয়ে আসবে? হঠাৎ করে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সবকিছু চোখের সামনে ঘুরছে, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাচ্ছি।
|
যদি কেউ চোখ মেলে তাকালাম তখন আমি শুয়ে আছি ঘরের সম্মুখের বারান্দায়। এই বিছানায় আমি বাড়িতে এলে ঘুমাতাম, আর বাড়িতে যখন থাকতাম না তখন বাবা বিকেলে বিকেলে এখানে দুপুরের পরে বিশ্রাম করতো। বাবার শরীরের সেই পানখাওয়া গন্ধ নাকে আসছে, ধুম করে বিছানায় উঠে বসলাম।
- তৌহিদকে বললাম " মা-বাবা কোই? "
- পুলিশ এসে নিয়ে গেছে, ময়নাতদন্তের পরে নাকি আমাদের কাছে নিয়ে আসবে।
- অসম্ভব, আমার বাবা বলে গিয়েছে যেন তাদের লাশ কাটাছেঁড়া না করা হয়।
- কিন্তু তুই হয়তো চাইলে রাখতে পারতি, তবে তুই অজ্ঞান থাকার কারণে কিছু করতে পারি নাই। আর পুলিশের কাছে আমি আর মনির ভাই যতটা জানি ততটা বললাম। তোর কাছে আঙ্কেল কল দিয়ে যা যা বলেছে তারপর আমরা দুজন রওনা দিলাম, আর মনির ভাইদের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করার সবকিছু বললাম।
- এখন আমি আমার মা-বাবার লাশ কাটাছেঁড়া থেকে রক্ষা করবো কীভাবে?
- তুই চাইলে একবার চেষ্টা করতে পারো, আঙ্কেল নিজে যদি আন্টিকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয় তাহলে আর কাটাছেঁড়া করে কি হবে? আর বাহিরে দুজন পুলিশ এখনো আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারো।
পুলিশের সঙ্গে আমি আবার সবকিছু বললাম, তারা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে খবর দিতে বলে দিল। আমি চেয়ারম্যানকে কল দিলাম মনির ভাই এর কাছ থেকে নাম্বার নিলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়িতে এলেন, তারপর আমি তাকে বললাম যে মা-বাবার লাশ ময়নাতদন্তের দরকার নেই। তিনি বললেন যে তাহলে এমপির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এবং তিনি থানায় বলে দেবেন।
মানসিকতার এতটা খারাপ অবস্থা তবুও অনেক ঝামেলার মাধ্যমে মা-বাবার লাশ ময়নাতদন্তের হাত থেকে রক্ষা করলাম। কিন্তু মনের মধ্যে সেই একটা প্রশ্ন ঘুরছে " বাবা এমনটা কেন করলো? "
মাগরিবের কিছুক্ষণ আগেই মা-বাবার দাফন করা শেষ হয়ে গেল, বাড়ি থেকে বের হবাে পথে গেটের কাছে রাস্তার পাশেই ডানহাতে একটু ফাঁকা জমি আছে। বছর খানিক আগে একদিন সেখানে কিছু শুপাড়ি গাছের চারা রোপণ করার সময় মা আমার সঙ্গে বলেছিল
" তোর বাবা আর আমি মারা গেলে আমাদেরকে এখানে কবর দিস লিমন, আমরা তো মানুষ বেশি নয়। তুই বাড়ি থেকে বের হবার সময় আমাদের কবরে সালাম দিয়ে বের হতে পারবি। আবার যখন বাড়িতে ফিরবি তখনও আমাদের সালাম দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করবি। রাস্তা দিয়ে যখন মসজিদ এর ইমাম কিংবা কোন ভালো মানুষ হেঁটে যাবে তখন আমাদের জন্য দোয়া করবে। "
আমি সেদিন হেসেছিলাম, কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আমার মা-বাবা এখনো অনেকদিন বাচবে। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের সন্তানেরা চায় তাদের মা-বাবা চিরকাল বেঁচে থাকুক।
মা-বাবাকে সেখানেই কবর দিলাম, এখন আর চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। দাফনকাজ শেষ করে সবাই চলে গেছে, শুধু আশেপাশের কিছু মানুষ আছে। মনির ভাই বরাবরই আমার কাছে বসে কান্না করছে, বাবা তাকে খুব পছন্দ করতো।
পাশের ঘরের প্রতিবেশী এক চাচি আমাকে মাথায় তেল দিয়ে দিল, কপালে আর আর মুখে হাত দিয়ে আদর করে বললো " এভাবে ওরা চলে যাবে তা কখনো ভাবিনি, যা হবাে হয়ে গেছে মনকে শক্ত কর। আমরা তো আছিই। "
সারাদিনে মোবাইল বের করার সুযোগ হয়নি, সেই যে সকাল বেলা পকেটে রেখেছি সেভাবেই পকেটে পরে আছে। বের করে দেখি মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে, চালু করতে গিয়ে দেখি চার্জ আছে। তাহলে মনে হয় চাপ লেগে বন্ধ হয়েছে কারণ মোবাইলের ব্যাটারি একটু লুজ তাই মাঝে মাঝে ধাক্কা লেগে বন্ধ হয়ে যায়। কাগজ দিয়ে জাম করে রাখি।
মোবাইল চালু করলাম, তারপর কললিস্টে গিয়ে বাবার নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গতকাল রাতেও এমন সময় খাবার খেয়ে কল দিয়ে কথা বলেছিলাম, মাত্র ২৪ ঘন্টা ইসসসস।
হঠাৎ করে চোখ গেল উপরে মেসেজের চিন্হের উপর, মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখি অনেক গুলো মেসেজ। সচারাচর সিম কোম্পানির অজস্র অপ্রয়োজনীয় মেসেজের জন্য এখন মেসেজ চেক না করে ডিলিট করতাম।
কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বাবার নাম্বার দিয়ে একটা মেসেজ দেখে অবাক হলাম। গতকাল রাত ২:৫৩ মিনিটে মেসেজ এসেছে, আর বাবা আমাকে কল করেছিল রাত ৩:০৯ মিনিটে।
মেসেজ পড়ে আমার হাত কাঁপছে। লেখা আছে:-
" তোকে বাঁচাতে গিয়ে তোর মা'কে খুন করলাম এইমাত্র, ২৫ বছরের সংসার জীবনে যাকে আমি কখনো একটা চড় মারিনি। তাকেই একটু আগে নিজের হাতে জবাই করেছি, এখন আমার নিজের গলাও কাটবো। ওরা সবাই এখন আমর চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে, তোকে কল দিয়ে বাড়িতে আসার জন্য আমাকে বলছে। আমি সেই ফাঁকে তোকে কল না দিয়ে আগে মেসেজ দিচ্ছি, ওদের বলছি যে নাম্বার খুঁজে পাচ্ছি না। তোকে কল দিয়ে আমি হয়তো নিরুপায় হয়ে বাড়িতে আসতে বলবো, কিন্তু খবরদার তুই আসবি না। কারা এসব করছে সেটা তোর জানার দরকার নেই, কিন্তু তুই আর কোনদিন গ্রামের বাড়িতে আসবি না বাবা। তাহলে ওরা তোকেও খুন করে ফেলবে, আমি চাইনা যে আমাদের মৃত্যুর জন্য তুই প্রতিশোধ নিস তাই সেই খুনিদের নাম বললাম না। আমি আর তোর মা তোর জন্য জীবন দিয়ে গেলাম, আমাদের স্বপ্ন ছিল তুই অনেক বড় হবি রে, আমাদের স্বপ্ন তুমি পুরণ করিস বাবা। আকাশে বসে যেন তোকে দেখে আমি আর তো মা হাসতে পারি। "
বাবার মেসেজ দেখে শরীর কাঁপছে, আমি তো এই মেসেজ গতকাল দেখিনি। বাবা আমাকে গ্রামের বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছে কিন্তু আমি তো না জেনে চলে এসেছি। তাহলে কি আমাকে এখন তারা খুন করবে? কিন্তু কারা খুন করবে?
.
চলবে...?
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)