Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
হিয়ার ঝুলন খোঁপার ভাঁজে আজ যেন তার পৃথিবী কাঁপে। তার মায়াবী মুখমণ্ডলের দিকে একবার তাকালে চোখ সরিয়ে নেওয়া ভীষণ কষ্টকর আজ গোগোলের পক্ষে। কপালে সযত্নে আঁকা রয়েছে সুদৃশ্য লাল রঙের টিপ। চোখে ভাসে দূর সমুদ্রে জেগে থাকা কৃষ্ণদ্বীপ। অঙ্গে তার পাতলা ফিনফিনে সুতির একটা স্লিভলেস নাইটি, ঠিক যেন প্রকৃতির একটা অতি ক্ষীণ আচ্ছাদন আবৃত রয়েছে তার পুরুষ্টু দেহতরু জুড়ে।পেলব কব্জিতে আঁটা চিকন সোনার বালা। যেখানে হয়তো অনন্তকাল ধরে তার মন বাঁধা পড়ে আছে এই পাদপীঠে। গলায় সোনার কারুকাজ করা হারে শোভা পাচ্ছে পদ্মনীল পাথর। দুই কানে দুই ধারে ফুটে আছে দু'ফোঁটা রত্ন মহাগৌরবে।


গোগোলের দৃষ্টির অতল আঁধারে আনন্দবর্ষণ। তবে সে কেন চায় না তার প্রেমিকের দিকে? হঠাৎ করেই যেন নিজের সামনে তুলেছে এক স্বচ্ছ অসীম দেওয়াল। হয়তো বা সেটা নারীসত্তার লজ্জায়, হয়তো বা সেটা সাময়িক। কিন্তু হঠাৎ করেই সৃষ্টি হওয়া এই প্রতিকূল স্রোতে কি করে তার প্রেয়সীর কাছে যায় গোগোল! কি করে এই নিঃসঙ্গতার ভেতর তার হিয়াকে পায়! ঝলমলে ত্বকে তার আলোকবন্যা, মৃগনাভী সৌরভে দিশেহারা গোগোল। গর্বিত হিমালয় শৃঙ্গের মতো সুতীক্ষ্ণ নাক তার লজ্জায় রাঙা হয়ে কিছুটা ফুলে গিয়েছে। ভয়ঙ্কর আবেদনময়ী দুই ঠোঁটের সঙ্গমস্থল কেঁপে ওঠে বারবার। প্রেম জোয়ারে ডুব দিয়ে মন সদ্যস্নাতা। নান্দনিক আরাধনায় সে যে এখন দিশেহারা। শুধুমাত্র উষ্ণ আদরের প্রতীক্ষায়।

হিয়া আর গোগোল রয়েছে তাদের পরস্পরের হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে। অনুভবশক্তি সর্বদা চায় পরস্পরকে জড়িয়ে থাকতে। এই সমগ্র জগৎ সাক্ষী তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার। অনন্তকাল ধরে তারা এই ভাবেই বেঁচে থাকার আশা করে পরস্পরের মধ্যে। হিয়ার গভীর অথচ মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে গোগোল। সে যেন কোনো অজানা অতলস্পর্শী গুপ্তধন খুঁজে পায় হিয়ার ওই চোখে। তার দুই নয়নে মায়াবদ্ধ হয়ে সপ্ন দেখে যায় .. যেদিকে তাকিয়ে থাকলে শত কষ্ট, শত বেদনা নিমেষে ভুলে যাওয়া যায়। হিয়া যে তার শুক্লা তিথির ফুটন্ত চাঁপা, রোদেলা বিকেলবেলা। হাতের মাঝে হাত রেখে পথ চলা আর ক্লান্তিহীনভাবে তাকে ভালবেসে জড়িয়ে ধরা। প্রেয়সী হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তৃপ্তির চোখে সেই মহার্ঘ চুম্বন লাভ করা। হাজারো দ্বিধা দ্বন্দ্বের নক্সা বোনা বেগুনি সন্ধ্যা, হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শিরা উপশিরা বেপরোয়া হওয়া। গোগোলের যৌবনের স্রোত ত্বকের ব্যারিকেড ভাঙা ভাষা আর চর্মসুখ ছাপিয়ে অন্য আগুনের অনুভূতি খোঁজা।

তারপর একসময় হিয়াকে আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় উত্তপ্ত শরীরের রক্ত শাখায় হরমোনের মুক্তি লাভ। এমনকি এই অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ মহার্ঘ্য মুহূর্তে গোগোলের কমতে থাকে কার্টিসাল হরমোন চাপ। তাইতো আজ তারা সর্বস্ব ভুলে পরস্পরকে ভালোবাসার আদর-ঘরে বন্দী করেতে চায়। হয়তো বা এতদিন জমে থাকা অবসাদের আয়ু কমবে পরস্পরের প্রতি ছড়িয়ে পড়া ক্রমাগত আদরে। পরস্পরের ঠোঁটে ঠোঁট উপলব্ধি ম্যাজিকের মতো যৌবনের ঝিলিক। এই প্রথম তাদের যৌবন ফিনকি দিয়ে বলবে 'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।' বৈষ্ণব পদাবলীর এলোমেলো পাতা আর রোমকূপের সে কী ভীষণ রতি সিঞ্চন!

"এ্যাই শুনছো .. মা রান্না করে রেখে গেছিলো। আজ কি হয়েছে জানো? তোমার ফেভারিট আলুপোস্ত। ডাল আর তরকারি তো পর্যাপ্ত আছেই, সঙ্গে দু'পিস মাছও আছে দেখছি। আমি শুধু একটু এক্সট্রা ভাত করে নিলাম .. দু'জনের খুব ভালোভাবে হয়ে যাবে, তাই না বলো? তুমি কিন্তু আজ আমার সঙ্গে এখান থেকেই খেয়ে যাবে।" কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল গোগোল, হিয়ার ডাকে ঘোর কাটলো তার। 

আনমনা হয়ে তার দিকে গোগোলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মুচকি হেসে হিয়া বলে উঠলো "এই যে লাটসাহেব .. কি দেখছো অমন করে তাকিয়ে? একটু আগেই তো সবকিছু দেখেছো আমার, এখনো আশ মেটেনি বুঝি? দুষ্টু কোথাকার। এতক্ষণ ধরে দস্যিপনা করার পর কোথায় ভাবলাম আমার একটু সেবাযত্ন করবে এই মানুষটা! তা নয়, দেখি পাশ ফিরে শান্তির নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। কি আর করবো .. ইচ্ছে না থাকলেও খেতে তো হবেই। তাই বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত বানালাম, তারপর টেবিলে খাবার সাজিয়ে এসে দেখি বাবু এখনো ঘুমোচ্ছে! এসো .. খেতে দিয়েছি।"

- "হিয়া ...."

- "কি হয়েছে? বলো .. এ কি তোমার চোখে জল কেনো? তুমি কাঁদছো?"  

- "আরে না না .. কাঁদবো কেনো? চোখে মনে হয় কিছু একটা পড়েছে .. ভীষণ জ্বালা করছে .. তাই বোধহয় .."

- "এ মা .. কি আবার পড়লো .. জ্বালা করছে? কই দেখি .."

- "না না ঠিক আছে, এখন কমেছে। বলছিলাম .. আমি তো রোজ এই সময় বাড়িতে ফিরেই খাই মামণির সঙ্গে .. আজকে মানে এখান থেকে খেয়ে গেলে .."

- "হ্যাঁ, তো কি হয়েছে? একদিন না হয় আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করলাম। তুমি কি বলতে চাও, তুমি বাইরে থেকে লাঞ্চ করে গেলে মামণি রাগ করবে? রোজ যে তোমাকে বাড়িতে ফিরে খেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দিয়েছে? আর শোনো, মামণি এখন একা নেই। উনার জীবনে একজন নতুন মানুষ এসেছে। একটু স্পেস দাও উনাকে। সব সময় 'মামণি' 'মামণি' করো না তো! এবার আমাদের কথাটা একটু ভাবো .. এই যে আজ আমরা এত সুন্দর একটা সময় কাটালাম, সেটা নিয়ে কিছু বলো .."

- "না না, তা নয় .. আসলে .."

গোগোল আর হিয়ার কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ করেই গোগোলের ফোনটা বেজে উঠলো। সুজাতা ফোন করেছে .. ফোনটা ধরে অপর প্রান্ত থেকে 'এত বেলা হয়ে গেলো, সে এখনো ফিরলো না' এটা শোনার পর গোগোল বললো "আসলে এদিকে আজ সাংঘাতিক কাজের চাপ মামণি। আমি বাইরে থেকে লাঞ্চ করে নেবো। তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম .. ঠিক আছে, বাড়িতে ফিরে কথা হবে .. এখন রাখি তাহলে!" জীবনে এই প্রথমবার সুজাতার কাছ থেকে সত্যিটা লুকিয়ে গেলো গোগোল।

- "তুমি মিথ্যে বললে কেন? আমাদের বাড়িতে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে, এটা বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো?"

- "তা নয় হিয়া, কিন্তু কাবেরী আন্টি আর হরিহর কাকা আজ বাড়িতে নেই এটা যখন পরে মামণি জানতে পারবে, তখন নিশ্চয়ই আমার আসার ব্যাপারটা তোমার মা'কে বলবে মামণি। এরপর কাবেরী আন্টি যখন জানতে পারবে আমি উনার অনুপস্থিতিতে তোমাদের বাড়ি এসেছি, তখন আমার প্রতি উনার ধারণাটা কি হবে একবার বুঝতে পারছো? তুমি ভালো করেই জানো এমনিতেই উনি আমাকে পছন্দ করেন না।"

- "তো? কি হয়েছে? তোমার ভয়ে নাকি রেলপাড়ের বস্তিতে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়, আর এই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এতটা ঘাবড়ে যাচ্ছ কেনো? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো .. তাহলে নিজের ভালোবাসার জন্য এইটুকু কথা শুনতে পারবে না?"

- "পারবো হিয়া, ১০০ বার পারবো। আমি আমার কথা বলছি না বা ভাবছি না, আমি ভাবছি তোমার কথা। আসলে আমি এখানে এসেছি জানতে পারলে কাবেরী আন্টি তোমাকেও তো বকাবকি করবে। তাছাড়া আজ যেটা হলো .. আই মিন একটু আগে আমাদের মধ্যে ..  যেটা হলো সেটা বোধহয় ঠিক হলো না .. আশা করি আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পারছো .."

গোগোলের এই উক্তিতে চোখ-মুখের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেলো হিয়ার। প্রচন্ড রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো "না, আমি বুঝতে পারছি না .. আমাকে মা কি বলবে না বলবে সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি, আমাকে বকাবকি করা অতটা সোজা নয়। তাছাড়া, এত সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটানোর পর তুমি এই ধরনের কথাবার্তা বলছো কি করে? তোমাকে আমি সত্যিই চিনতে পারছি না, লাটসাহেব! 'আজ যেটা হলো, সেটা ঠিক হলো না' মানে? আমাদের মধ্যে আজ যা হয়েছে দু'জনের সম্মতিতে পরস্পরকে ভালোবেসে হয়েছে। তাহলে এই ধরনের কথা আসছে কি করে? তোমার এই কথা শোনার পর এখন তো আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। এটাই মনে হচ্ছে যে, তোমাকে এখানে ছল করে ডেকে এনে আমি আমার নিজের বাসনা চরিতার্থ করেছি। তোমার কথা শুনে এটাই মনে হচ্ছে তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না .." নিজের বলা কথাগুলো শেষ করে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো হিয়া।

"হিয়া হিয়া হিয়া .. লক্ষী সোনা আমার .. ভুল বুঝোনা আমাকে। আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে চাইনি। আমি জানি তো যা হয়েছে আমাদের পরস্পরের সম্মতিতেই হয়েছে। আর আমি এটাও জানি আমরা দু'জন দুজনকে নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি .. যাগ্গে বাদ দাও, আমার কিন্তু এবার ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে .. তুমি তো টেবিলে ভাত বেড়ে এসেছো। চলো, খেতে দেবে না আমায়?" হিয়াকে শান্ত করে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, তার দুটো হাত ধরে কথাগুলো বললো গোগোল।

"নাহ্ .. তুমি বরং এখন বাড়ি যাও .. এখানে তোমার খাওয়ার দরকার নেই। আমাকে একটু একা থাকতে দাও এখন।" গম্ভীর গলায় বললো হিয়া।

"ভুল হয়ে গেছে হিয়া .. আমি কথাগুলো ওইভাবে বলতে চাইনি। আচ্ছা ঠিক আছে, এই দেখো আমি তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইছি, তাহলে হবে তো? অভুক্তকে এভাবে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলতে নেই! এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। প্লিজ খেতে দাও .. পেটে ছুঁচো ডন মারছে যে .."  কথাগুলো বলে হিয়ার কপালে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলো গোগোল। 

কিছুক্ষণের জন্য সৃষ্টি হওয়া একবুক অভিমান নিয়ে থেকেও হিয়া বুঝতে পারেনি কার প্রতি তার এই অভিমান! তার মনের মানুষের প্রতি? শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে  তিলে তিলে গড়ে ওঠা এতদিনের ভালবাসার প্রতি? না কি নিজের প্রতি? গোগোলের শেষ কথাগুলো শোনার পর এবং তার কাছ থেকে স্নেহের চুম্বন পাওয়ার পর বাষ্পে কেঁপে ওঠে তার বুক। জ্বালা করে ওঠে তার চোখের কোণ, নিজেকে অপরাধী মনে হয় এতক্ষণ ধরে তার মনের মানুষকে কথার বানে বিদ্ধ করার জন্য। 

কয়েক ঘন্টা পূর্বে প্রকৃতির বুকে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাতের মতোই হিয়ার মনেও বৃষ্টি এলো। কতদিন বর্ষা নামেনি পোড়া এই মনে! ঈশানের কোল ঘেঁষে যে মেঘের নদী, তারই ছায়ায় হারায় তার মনের গোধূলিবেলার স্বপ্নেরা, না শোনা পুরানো অভিমান সন্ধ্যার মায়াজালে। অতঃপর দুপুরের আহারাদি সমাপ্ত করে হিয়াকে নিজের স্নেহের পরশে ভরিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো গোগোল। কিন্তু, এত কিছুর মাঝে কোথাও যেন তার মনে একটা কিঞ্চিত দ্বিধার রেশ রয়ে গেলো।

★★★★

বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম করে আবার সাইটে চলে যায় গোগোল। যদিও আজ হিয়াদের বাড়ি আসার আগে লেবারদের হাফ বেলা ছুটি দিয়ে এসেছিলো গোগোল। কারণ এখানে কি পরিস্থিতি, হিয়ার শরীরের কতটা গুরুতর অবস্থা সে তো এগুলো কিছুই জানতো না! 

কিন্তু বর্তমানে খাওয়া-দাওয়া যখন হয়ে গিয়েছে, তখন এই মুহূর্তে বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছিল না তার। মনটাও কোনো এক অজানা কারণে কিরকম যেন আনচান করছিলো। তাই আবার তার কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে ফিরে গেল সে। একদা জ্যোৎস্না অভিমুখী পাড়ি দিয়েছিল গোগোলের যে স্বপ্ন, হয়তো অতীতে অনেকবার মুখ থুবড়ে পড়েছে সে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে। তার হয়তো মনে হয়েছিলো এবারও চাঁদ ছুঁয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলো না সে। তবুও নিরাশার অন্ধকার দেখেনি সে কখনো। সাফল্যের কোনো ভগ্নাংশ হয় না। হয়ে সে ষোল-কলায় পূর্ণ চন্দ্রের মতো সম্পূর্ণ। নয়তো সেই চন্দ্রহীন অমাবস্যার মতো নিকষ কালো অন্ধকারের ব্যর্থতায় ঢাকা পড়ে যায়। ব্যর্থতার সারণিতে সাফল্য সর্বদা সংখ্যালঘু হলেও, একজন প্রকৃত উদ্যমী নিজের লক্ষ্যে স্থির ব্যক্তির উদ্দাম বারবার ব্যর্থ হতে পারে না। তাই সেই চাঁদ ছোঁয়া স্বপ্নের অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে গোগোল। রেলপাড়ের কলেজবাড়ির দোতলা হওয়ার কাজ খুব ভালোভাবে চলছে। জীবনের প্রথম সুযোগই যদি সে ভালোভাবে এই কাজটা সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে সাফল্য যে তার দরজায় এসে কড়া নাড়বে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

কলেজ বিল্ডিং-এ ঢোকার মুখে হঠাৎ টগরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো গোগোল। প্রধানশিক্ষক পঙ্কজবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলো সে। টগরকে দেখেই বাইক থেকে নেমে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো "কি রে তুই এখানে, হঠাৎ?"

"দরকার ছিলো .." এইটুকু বলে গোগোলের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো টগর। 

- "কি ব্যাপার? আমি একটা প্রশ্ন করলাম, সেটার ঠিকভাবে উত্তর না দিয়ে এভাবে চলে যাচ্ছিস যে .. খুব তাড়া আছে নাকি?" 

- "বললাম তো দরকার ছিলো .. হুঁ একটু তাড়া আছে। বাবা দোকানে, বোন বাড়িতে একা আছে .. তাই যেতে হবে আমাকে .."

- "আরে, কি দরকার সেটাই তো জানতে চাইছি। তুই তো আগে এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতিস না। তাছাড়া শিউলিকে বাড়িতে রেখে তুই তো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াস। অনেকবার তো আমাদের বাড়িতেও এসেছিস, কই তখন তো ফিরে যাওয়ার এত তাড়া দেখিনি .."

- "আগে কি করেছি আর কি করিনি সে কথা থাক না গোগোল দাদা! আর আমি মোটেই বোনকে বাড়িতে একা রেখে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই না .. দরকারে বেরোতে হয় আমাকে। মিড-ডে মিলের মালগুলো তো সব আমাদের দোকান থেকেই আসে, বাবার শরীরটা ক'দিন ধরে বেশ খারাপ যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা করতে পারছে না, তাই আমি হেডস্যারের কাছে এসেছিলাম হিসাবটা দিতে।"

- "ও হো .. স্বপন কাকুর কি হয়েছে রে? আমি তো কিছু জানি না .."

- "তুমি ব্যস্ত মানুষ .. তোমার না জানাটাই তো স্বাভাবিক .. বাবার তো বরাবরই সাইটিকার প্রবলেম আছে .. ব্যথাটা যখন বাড়ে তখন একদম বেশি হাঁটাচলা করতে পারে না। বাড়ির লাগোয়া দোকান তো, তাই শুধু দোকানে যেতে পারছে আবার দোকান থেকে বাড়ি .. ব্যাস ওইটুকুই।"

- "এতটা খারাপ অবস্থা হয়েছে স্বপন কাকুর আমাকে একবার জানাবি তো! ঠিক আছে আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে বলে দেবো, উনি একবার চেক করে নেবেন।"

গোগোলের কথা শুনে মুচকি হাসলো টগর। তার হাসি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়ে গোগোল জিজ্ঞাসা করলো সে হাসছে কেন! উত্তরে টগর জানালো ..

- "আচ্ছা গোগোল দাদা, তুমি কি মনে করো .. তুমি বলে দেবে, তারপর কাজগুলো হবে? একটু আগে বললাম যে তুমি ব্যস্ত মানুষ তাই তোমার না জানাটাই স্বাভাবিক। তোমার ডক্টর আঙ্কেল অর্থাৎ প্রতাপ আঙ্কেলই দেখে গেছেন বাবাকে। উনার ওষুধই খাচ্ছেন আমার বাবা। তোমরা এক বাড়িতেই থাকো, অথচ দেখো তুমি এতটাই ব্যস্ত যে তুমি কিছুই জানো না এসবের। ঠিক আছে তোমার যা জানার তা তো জেনে নিয়েছো, এবার তাহলে আমি যাই?"

- "টগর .. বলছিলাম তুই কি কোনো কারণে রাগ করেছিস আমার উপরে? না মানে, ঠিক রাগ নয় .. আমি বলতে চাইছি তোর কি অভিমান হয়েছে আমার উপর, কোনো কারণে?"

- "অভিমান? হঠাৎ এই প্রশ্ন?" 

- "না মানে তুই এভাবে কথা বলছিস তো আমার সঙ্গে। তাছাড়া .."

- "তাছাড়া?"

- "সেদিনকে .. মানে ওই বিভীষিকাময় রাতে যখন তোকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম আমি ওই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে, তুই তো তখন প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ছিলি। সে সময় রনিতা আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলো তোর সম্পর্কে। মানে .. ওরা তোকে কেন টার্গেট করেছে .. আই মিন .. রনিতা যখন আর নেই, তখন সে কথা আমি এখন আর বলতে চাই না .. শোন না, বলছিলাম এখান থেকে তো তোদের বাড়ি অনেকটাই দূর, তুই সাইকেল এনেছিস নাকি হেঁটে হেঁটে ফিরবি? খাওয়া দাওয়া করেছিস? চল না আমি তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি .."

- "না, আমি সাইকেল আনিনি .. হেঁটেই ফিরবো .. এত তাড়াতাড়ি খাওয়া হয় না আমার, বাড়িতে গিয়ে খাবো বোনের সঙ্গে .. কোনো দরকার নেই তোমার পৌঁছে দিয়ে আসার .. কত ব্যস্ত তুমি এখন .. তোমার এখন কত কাজের চাপ! এতটাই ব্যস্ততা যে আজ বাড়িতে খেতেও যেতে পারোনি, সারাদিন এখানেই থাকতে হচ্ছে তোমাকে।"

- "এক মিনিট এক মিনিট .. তুই কি করে জানলি আমি আজ বাড়িতে খেতে যাইনি .. আমি তো কথাগুলো মামণিকে ফোনে .."

- "হুঁ জানি .. যখন তোমার মামণি তোমাকে ফোন করেছিলো, সেইসময় আমি তোমাদের বাড়িতে ছিলাম .. মুদিখানার কিছু মাল দিতে গিয়েছিলাম। ফোনটা রাখার পর তোমার কর্মব্যস্ততা নিয়ে খুব চিন্তা করছিল সুজাতা মাসি। অথচ এখানে এসে দেখলাম, আজ এখানে কোনো কাজই হচ্ছে না। আরে বাবা মানুষের পার্সোনাল লাইফ বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু সবাই তো আর সেটা বোঝে না .. যাক সে কথা .. আমি এখন যাই, অনেক দেরি হয়ে গেলো .. বোনটা একা না খেয়ে বসে রয়েছে আমার জন্য .."

অন্য সময় হলে হয়তো টগরের এই কথাগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরতো না গোগোল। হয়তো বা তাকে বলতো "আজকাল খুব ডেঁপো হয়েছিস, তাই না?" কিন্তু আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির চোখের কোণে জমে থাকা জল আর করুন মুখে বলা প্রত্যেকটি কথা তীরের ফলা হয়ে বিঁধলো তার বুকে। ঠিক যেন নীরব মৃত্যু যন্ত্রণায় এক অদ্ভুত মলিন শব্দ, যা মনের কোণে আলপনা এঁকে এক নিমিশেই সুনামির জলে ভেসে যায়। লাঙল চোষে টগরের বলা প্রতিটা শব্দের অর্থ খুঁড়ে এনে মাটির পরোতে পরোতে অস্থির মুহূর্তের এই ব্যাকুলতা। কখনো দেখেছে তার চোখে বসন্তের কোকিলের কুহু সুরের আকুলতা আবার কখনো যন্ত্রণাগুলো মনের উঠোনে বসবাস করছে নিবিড়ে .. ঠিকানা বিহীন সীমানা বহুদূরে আকাশ বাতাস সরু রাস্তার মোড়ে। অথচ তার নাকে এখনো হিয়ার শরীরের সুমিষ্ট গন্ধ, তার অঙ্গে এখনো হিয়ার কোমল আদরের স্পর্শ, ভালোবাসার সিঞ্চনের শব্দের বুনিয়াদ মননে জড়িয়ে রয়েছে। 

গোগোলকে কলেজের প্রধান ফটকের সামনে একা রেখে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো টগর। হঠাৎ হয়ে আসা গোগোলের ঝাপসা চোখে ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে লাগলো মেয়েটা .. তারপর ধীরে ধীরে তাদের বাড়ির অভিমুখে যাওয়ার রাস্তায় মিলিয়ে গেলো সে। সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছুটা ইতস্তত করে কলেজ বিল্ডিং-এ প্রবেশ করলো গোগোল।

(ক্রমশ)



ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন

[Image: Animation-resize-gif-f3b601eb23d95beeb4e...911ac0.gif]


[+] 11 users Like Bumba_1's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 03-01-2023, 08:50 PM



Users browsing this thread: 7 Guest(s)