03-01-2023, 08:36 PM
বড় দুলাভাই জেলে আছেন , প্রায় মাস চারেক হলো উনি জেলে । যেদিন বড় দুলাভাই কে ধরে নিয়ে গেলো সেদিন একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করেছিলাম , সেটা হচ্ছে আমি বড় দুলাভাই এর নাম জানি না । এতো বছর একটা মানুষ এর সাথে আমার আত্মীয়তা অথচ আমি মানুষটার নাম জানি না ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য ঠেকেছে । খুব চেষ্টা তদবির চলেছিলো কিন্তু কোন লাভ হয়নি । শেষ পর্যন্ত শরাফত মিয়াঁ উরফে বড় দুলাভাই কে জেলে যেতেই হয়েছে । সবাই অবশ্য বলাবলি করছিলো উনি নাকি বলীর পাঠা , হোমরা চোমড়া যারা আছেন নিজেররা বাঁচার জন্য উনার বলী চড়িয়ে দিয়েছে ।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলো যেটা , সেটা হচ্ছে বড় দুলাভাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি দৌড়া দৌড়ী করেছেন আমাদের মেজো দুলাভাই । উনি তো খাওয়া নাওয়া ছেড়ে কোমর বেধে নেমেছিলো , অবশ্য লাভ তেমন হয়নি । তবে এই সুবাদে বড় আপা আর মেজো আপার পুরনো ফাটল ধরা সম্পর্ক একটু জোড়া লেগেছে । এরি মাঝে একবার আমি দেখি বড় আপা মেজো আপার কাছে ক্ষমা চাওয়ার স্বরে বলছে “ বুঝলি মানুষ চিনতে কি ভুল করেছি , আপন ভাইয়ের চেয়ে শত গুন বেশি কাজে আসলো”
কথা অবশ্য সত্যি আমি তেমন কাজে আসিনি , যেখানে নিয়ে গেছে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারিনি । হ্যাঁ বিল্ডারস কম্পানির কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দিয়েছি সুধু । এ ছাড়া তেমন কোন কাজে লাগিনি । তাও খুব বেশি টাকা দিতে পারিনি । জলের মত যেখানে টাকা খরচ হয়েছে সেখানে আমার এনে দেয়া সাত লক্ষ টাকা আর তেমন কি?
বড় আপা এখন আমার সাথেই আছে, ভাগ্য ভালো বিল্ডারস কম্পানি এখনো কাজ শুরু করেনি । ওদের ফেলে রাখা রড গুলো ঝপ জঙ্গল এর আড়ালে হারিয়ে গেছে ।
তবে বড় আপার আমার এখানে থাকায়, আমার তেমন ডিস্টার্ব হয় না । বড় আপা চুপচাপ মানুষ তার উপর এখন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে । সুধু মেঝ আপা এলেই যা একটু কথা বলে । শুনছি ওরা নাকি দুলাভাই এর গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। অবশ্য সেখানেও হাঙ্গামা চলছে । বড় দুলাভাই এর ছোট ভাই নাকি জায়গা সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করছে । সেটা মিটে গেলেই চলে যাবে , আর ঝামেলা মিটতেও বেশি সময় লাগবে না , মেজো দুলাভাই নেমেছে ফিল্ডে বলেছে “ হারামির বাচ্চার পেটে পারা দিয়া নাড়িভুঁড়ি সহ বাইর কইরা ফালামু , আপা আপনি কোন চিন্তা করবেন না”
যদিও বড় আপা ওনার চেয়ে বয়সে ছোট তাও সামনা সামনি দারুন সম্মান করে মেজো দুলাভাই আপাকে । দেখলে মনে হয় ছেলে মায়ের সাথে কথা বলছে । আমার খুব হাঁসি পায় এই অবস্থা দেখলে , মনে হয় কেউ কি বিশ্বাস করবে এই লোকটাই নিজের মেয়ের বান্ধবিকে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করে , বাড়ির কাজের মেয়েদের হয়রানি করে ।
উনার এতো ভালোমানুষি আমি প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে পারিনি , মনে মনে আমার একটা সঙ্কা কাজ করছিলো । চোখে চোখে রাখছিলাম ওনাকে , মনে মনে পন করেছিলাম এবার যদি কিছু একটা আমার চোখে ধরা পরে তাহলে আর মেজো আপার দিকে তাকাবো না , কিছু একটা করে ফেলবো । তাছাড়া তুবা মেয়েটা খুব চাপা স্বভাব এর মুখ ফুটে কিছু বলবে ও না । হ্যাঁ তুবা আমার ভাগ্নি , ওকে নিয়েই আমার মনে সংসয় এসেছিলো । মেজো দুলাভাই এর চরিত্র যে কেমন সেটা তো আমি জানি । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মেজো দুলাভাই তেমন কিছু করলো না । মনে হয় আমি একটু হতাশ ই হয়েছিলাম । ভেবে ছিলো কি না করতে পারা এই আমি হয়ত সঠিক পরিমান মোটিভেশন পেয়ে নায়ক হয়ে উঠবো হা হা হা ……। অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে , কারন আমার অন্তর এর গভির থেকে কে যেন অট্টহাসি হেসে বলেছিলো , যত মোটিভেশন ই আসুক না কেনো , তুই কখনই সোজা হয়ে দাড়িয়ে কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে পারবি না ।
এবং যেই বলুক না কেন তার কথা গুলো আমি বিশ্বাস করেছি । সত্যি হয়ত দুলাভাই কিছু করলে , আমি কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে ঝামেলা থেকে পিছু হঠে জেতাম । যেমনটা আমি সব সময় করে আসি । মাঝে মাঝে তো আমি নিজেকে এসব আচরণ এর জন্য বাহবা দেই , নিজেই নিজের মন কে ভুল ভাল বোঝাই । বলে আমি মনহয় সাধু সন্তদের পর্যায়ে চলে গেছি । এবং আশ্চর্য জনক ভাবেই আমি নিজের এই মিথ্যা আশ্বাস কে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস ও করি । তবে সেই বিশ্বাস বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না । ধিরে ধিরে আমার আসল চরিত্র আমি বুঝতে পারি ।
আচ্ছা এমন তো আমি সব সময় ছিলাম না । হ্যাঁ একটু চুপচাপ ছিলাম , শান্ত শিষ্ট ছিলাম । কিন্তু ঘোড় অন্যায় মেনে নেয়ার মন মানসিকতা আমার মাঝে কবে জন্ম নিলো ? এই প্রশ্ন আজকাল প্রায় মাথায় আসে , বিশেষ করে আরশির ওই ব্যাপারটার পরে।
আমি অবশ্য উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি , বিস্তর সময় আমার হাতে, তাই এসব জিনিস নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময়ের অভাব হয় না । অবশ্য এখনো উত্তর খুঁজে পাইনি । কিছুদিন আগেও আমি বলতাম আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আশাবাদী মানুষ হয়ে থাকতে চাই । কিন্তু ধিরে ধিরে সেই ইচ্ছাও দূরে সরে যাচ্ছে । আমার কাছে মনে হয় আমি যে নিজেকে আশাবাদী ভাবাতাম সেটা ভুল ভাবতাম , আমি আসলে নিরাশাবাদি, তাই তো আশাবাদি মানুষের মুখোস পরে অনেক কিছু থেকেই পালিয়ে বেড়াতে চাই ।
আরও একটা ঘটনা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে যে আমি নিরাশাবাদি মানুষ । ঘটনা হচ্ছে কদিন বড় আপা আমাকে নিউমার্কেট পাঠিয়ে ছিলো কিছু জিনিস কেনার জন্য । সচরাচর আমি ওখানে যাই না , সেদিন গিয়ে বিশাল মার্কেটে হারিয়ে গিয়েছিলাম । ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । হঠাত এক দম্পতির উপর চোখ আটকে যায় । মেয়েটি আমার বয়সী হবে , সাথে আমার চেয়ে বছর দুই তিন বড় একজন পুরুষ । স্বামী স্ত্রী ওরা এতে কোন সন্দেহ নেই । সাথে একটি ফুটফুটে বছর তিনেক এর মেয়ে বাচ্চা । দেখতে মায়ের মতই হয়েছে ।
দম্পতিটির দিকে কেন এতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম বুঝতে পারছিলাম না । শেষে লজ্জায় পরে গিয়েছিলাম , কারন আমার বয়সী মেয়েটি নিজের সঙ্গিকে আমার দিকে ইশারা করে কি যেন দেখাচ্ছিলো । ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম , ভাবছিলাম এতক্ষন তাকিয়ে আছি তাই হয়ত স্বামীর কাছে নালিশ করছে । আরও ভড়কে গিয়েছিলাম যখন দেখলাম ওরা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদিক ওদিক দেখছিলাম , ভাবছিলাম কোথায় পালানো যায় , কেমন লজ্জার একটা ব্যাপার হবে , আজকাল নাকি এসব নিয়ে মানুষ খুব প্রতিবাদ করে । আগে তো শুনতাম রাস্তা ঘাটে হেনস্থা হয়ে মেয়েরা আত্মহত্যা করে । আজকাল আর সেরকম নয় এই ধরনের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ হয় । আমার সাথেও তেমন কিছু হবে কিনা ভাবছিলাম । কিন্তু এগিয়ে আসা দম্পতির মুখে হাঁসি দেখে কিছুটা অবাক ও হয়েছিলাম ।
“তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনো নাই” কাছে এসেই হাঁসি মুখে বলল মেয়েটি , সাথের পুরুষটিও হাসছে , তবে পুরুষটির হাঁসি কেমন প্রফেশনাল টাইপ । অপর দিকে মেয়েটি খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো । “ তুমি যে একটা ম্যাদা মারা লোক সেটা জানতাম কিন্তু এতটা ম্যাদা মারা সেটা জানতাম না”
সাথে সাথেই চিনতে পেরেছিলাম , সত্যি বলতে চিনেছিলাম আগেই , মাত্র কয়েক বছরে কি ভুলা যায় । কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছিলাম না । ওজন বেড়েছে কম করে হলেও ত্রিশ কেজি । ছিপছিপে ফিগার পরিবর্তন হয়ে নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছে , থুতনির নিচে দ্বিতীয় থুতনি গজিয়েছে , বরফি কাটা মুখ খানা গোলগাল গৃহিণী টাইপ হয়ে উঠেছে । আমার চেনা লীলার সাথে এই লীলার কোন মিল নেই । মিল যেটুকু আছে সেটা ওই হাঁসি , সুধু ঠোঁটের হাঁসি নয় লীলার পুরো মুখমণ্ডল ই হাঁসে ।
কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না , পুরতন প্রেমিকার সাথে স্বামী সহ দেখা হলে কি বলতে হয় আমার জানা ছিলো না ।
“ এই আসিফ এই হচ্ছে আমার পুরনো প্রেম সৌরভ” লীলাই ভেঙ্গেছিলো নীরবতা , তবে আমাকে ফেলে দিয়েছিলো আরও অস্বস্তিতে , নিজেকে ওর স্বামীর সামনে কেমন জানি অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিলো । আসিফ নামক লোকটার মাঝে অবশ্য তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি । প্রফেশনাল সেই হাঁসি টেনে রেখেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ।
চরম অস্বস্তি নিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম , এরি মাঝে লীলা নিজের সভাবসিদ্ধ ভাবে বলে উঠেছিলো “দেখ দেখ কেমন লজ্জা পাচ্ছে হি হিহি……।।যেমন বলেছিলাম ঠিক তেমন না, দেখে মনে হচ্ছে ও নিজে মেয়ে মানুষ স্বামীর সামনে পুরাতন প্রেমিক এর সাথে দেখা হয়েছে হিহ হি হি…?”
এবার আসিফ সাহেব ও হাঁসিতে যোগ দিলো , তবে আমাকে বিব্রত হতে দেখে নিজেকে সংবরণ করে নিয়েছিলেন সাথে সাথে । স্ত্রীর হয়ে সাফাই গেয়ে বলেছিলেন “ কিছু মনে করবেন না সৌরভ সাহেব , ও একটু এমন ই”
“ ধুর তোমার চেয়ে ও আমাকে কম চেনে না” হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মত করে বলেছিলো লীলা , তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো , “ কি করছো আজকাল”
আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম লীলার দৈহিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছুই পরিবর্তন হয়নি । কিন্তু তক্ষুনি মনে পরেছিলো না না এই লীলার সাথে আগের লীলার আরও কিছু পরিবর্তন আছে , আগের লীলা আমাকে তুই করে বলত তুমি করে নয় । যে লীলা ব্যাগ নিয়ে আমার বাসায় চলে এসেছিলো সে এই লীলা নয় । আর আমি নিজেই এই পরিবর্তন এর জন্য দায়ি ।
নয়তো আজ হয়ত লীলা আমাকে তুই তুকারি করতো , মাঝে মাঝে বস্তি ভাষায় গালি দিত । আচ্ছা লীলা কি আসিফ সাহেব কে গালি দেয় ? প্রশ্নটা এসেছিলো মাথায় খুব জান্তেও ইচ্ছে হচ্ছিলো , কিন্তু জিজ্ঞাস করার ইচ্ছা বাঁ সাহস হয়নি । প্রায় আধঘণ্টা কথা হয়েছিলো সেদিন । বেশিরভাগ কথা আসিফ সাহেব আর লীলার মেয়ে টুসি কেই নিয়েই হয়েছিলো । আসিফ সাহেব কি করেন , উনার বদ অভ্যাস কি কি এসব কিছুই আমার জানা হয়ে গিয়েছিলো । তাপর হঠাত করে যেমন দেখা তেমন হঠাত করেই বিদায় মুহূর্ত চলে এসেছিলো । যাওয়ার সময় লীলা বলেছিলো “ বাসায় আইসো” তারপর নিজেই বলেছিলো “ আসবা না সেটাও জানি তবুও বললাম”
আমি হ্যাঁ না কিছুই বলিনি , সুধু শেষ বারের মত লীলার সুখি গৃহিণী মুখ খানা দেখে নিয়েছিলাম । সেদিন ই আমার মাথায় প্রথম প্রশ্ন এসেছিলো সত্যি কি আমি আশাবাদী মানুষ ?
যদি আশাবাদী ই হতাম তাহলে সেদিন লীলাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতাম না , হয়ত বলতাম তুই আমার কাছেই থাক , তুই থাকলে কোন অসুখ আমাকে কাবু করতে পারবে না । আর যদি কাবু করে তুই তোর বিখ্যাত গালি দিয়ে অসুখ কে দূরে ভাগিয়ে দিবি । কিন্তু আমি সেটা করিনি , আমি নিরাশাবাদিদের মত নিজের ভবিষ্যৎ আগেই ঠিক করে ফেলেছি । সেই ভবিষ্যতে আমি একা , আমার সাথে মার্কেটে ঘুরাঘুরি করার জন্য কেউ নেই ।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলো যেটা , সেটা হচ্ছে বড় দুলাভাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি দৌড়া দৌড়ী করেছেন আমাদের মেজো দুলাভাই । উনি তো খাওয়া নাওয়া ছেড়ে কোমর বেধে নেমেছিলো , অবশ্য লাভ তেমন হয়নি । তবে এই সুবাদে বড় আপা আর মেজো আপার পুরনো ফাটল ধরা সম্পর্ক একটু জোড়া লেগেছে । এরি মাঝে একবার আমি দেখি বড় আপা মেজো আপার কাছে ক্ষমা চাওয়ার স্বরে বলছে “ বুঝলি মানুষ চিনতে কি ভুল করেছি , আপন ভাইয়ের চেয়ে শত গুন বেশি কাজে আসলো”
কথা অবশ্য সত্যি আমি তেমন কাজে আসিনি , যেখানে নিয়ে গেছে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারিনি । হ্যাঁ বিল্ডারস কম্পানির কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দিয়েছি সুধু । এ ছাড়া তেমন কোন কাজে লাগিনি । তাও খুব বেশি টাকা দিতে পারিনি । জলের মত যেখানে টাকা খরচ হয়েছে সেখানে আমার এনে দেয়া সাত লক্ষ টাকা আর তেমন কি?
বড় আপা এখন আমার সাথেই আছে, ভাগ্য ভালো বিল্ডারস কম্পানি এখনো কাজ শুরু করেনি । ওদের ফেলে রাখা রড গুলো ঝপ জঙ্গল এর আড়ালে হারিয়ে গেছে ।
তবে বড় আপার আমার এখানে থাকায়, আমার তেমন ডিস্টার্ব হয় না । বড় আপা চুপচাপ মানুষ তার উপর এখন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে । সুধু মেঝ আপা এলেই যা একটু কথা বলে । শুনছি ওরা নাকি দুলাভাই এর গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। অবশ্য সেখানেও হাঙ্গামা চলছে । বড় দুলাভাই এর ছোট ভাই নাকি জায়গা সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করছে । সেটা মিটে গেলেই চলে যাবে , আর ঝামেলা মিটতেও বেশি সময় লাগবে না , মেজো দুলাভাই নেমেছে ফিল্ডে বলেছে “ হারামির বাচ্চার পেটে পারা দিয়া নাড়িভুঁড়ি সহ বাইর কইরা ফালামু , আপা আপনি কোন চিন্তা করবেন না”
যদিও বড় আপা ওনার চেয়ে বয়সে ছোট তাও সামনা সামনি দারুন সম্মান করে মেজো দুলাভাই আপাকে । দেখলে মনে হয় ছেলে মায়ের সাথে কথা বলছে । আমার খুব হাঁসি পায় এই অবস্থা দেখলে , মনে হয় কেউ কি বিশ্বাস করবে এই লোকটাই নিজের মেয়ের বান্ধবিকে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করে , বাড়ির কাজের মেয়েদের হয়রানি করে ।
উনার এতো ভালোমানুষি আমি প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে পারিনি , মনে মনে আমার একটা সঙ্কা কাজ করছিলো । চোখে চোখে রাখছিলাম ওনাকে , মনে মনে পন করেছিলাম এবার যদি কিছু একটা আমার চোখে ধরা পরে তাহলে আর মেজো আপার দিকে তাকাবো না , কিছু একটা করে ফেলবো । তাছাড়া তুবা মেয়েটা খুব চাপা স্বভাব এর মুখ ফুটে কিছু বলবে ও না । হ্যাঁ তুবা আমার ভাগ্নি , ওকে নিয়েই আমার মনে সংসয় এসেছিলো । মেজো দুলাভাই এর চরিত্র যে কেমন সেটা তো আমি জানি । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মেজো দুলাভাই তেমন কিছু করলো না । মনে হয় আমি একটু হতাশ ই হয়েছিলাম । ভেবে ছিলো কি না করতে পারা এই আমি হয়ত সঠিক পরিমান মোটিভেশন পেয়ে নায়ক হয়ে উঠবো হা হা হা ……। অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে , কারন আমার অন্তর এর গভির থেকে কে যেন অট্টহাসি হেসে বলেছিলো , যত মোটিভেশন ই আসুক না কেনো , তুই কখনই সোজা হয়ে দাড়িয়ে কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে পারবি না ।
এবং যেই বলুক না কেন তার কথা গুলো আমি বিশ্বাস করেছি । সত্যি হয়ত দুলাভাই কিছু করলে , আমি কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে ঝামেলা থেকে পিছু হঠে জেতাম । যেমনটা আমি সব সময় করে আসি । মাঝে মাঝে তো আমি নিজেকে এসব আচরণ এর জন্য বাহবা দেই , নিজেই নিজের মন কে ভুল ভাল বোঝাই । বলে আমি মনহয় সাধু সন্তদের পর্যায়ে চলে গেছি । এবং আশ্চর্য জনক ভাবেই আমি নিজের এই মিথ্যা আশ্বাস কে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস ও করি । তবে সেই বিশ্বাস বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না । ধিরে ধিরে আমার আসল চরিত্র আমি বুঝতে পারি ।
আচ্ছা এমন তো আমি সব সময় ছিলাম না । হ্যাঁ একটু চুপচাপ ছিলাম , শান্ত শিষ্ট ছিলাম । কিন্তু ঘোড় অন্যায় মেনে নেয়ার মন মানসিকতা আমার মাঝে কবে জন্ম নিলো ? এই প্রশ্ন আজকাল প্রায় মাথায় আসে , বিশেষ করে আরশির ওই ব্যাপারটার পরে।
আমি অবশ্য উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি , বিস্তর সময় আমার হাতে, তাই এসব জিনিস নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময়ের অভাব হয় না । অবশ্য এখনো উত্তর খুঁজে পাইনি । কিছুদিন আগেও আমি বলতাম আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আশাবাদী মানুষ হয়ে থাকতে চাই । কিন্তু ধিরে ধিরে সেই ইচ্ছাও দূরে সরে যাচ্ছে । আমার কাছে মনে হয় আমি যে নিজেকে আশাবাদী ভাবাতাম সেটা ভুল ভাবতাম , আমি আসলে নিরাশাবাদি, তাই তো আশাবাদি মানুষের মুখোস পরে অনেক কিছু থেকেই পালিয়ে বেড়াতে চাই ।
আরও একটা ঘটনা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে যে আমি নিরাশাবাদি মানুষ । ঘটনা হচ্ছে কদিন বড় আপা আমাকে নিউমার্কেট পাঠিয়ে ছিলো কিছু জিনিস কেনার জন্য । সচরাচর আমি ওখানে যাই না , সেদিন গিয়ে বিশাল মার্কেটে হারিয়ে গিয়েছিলাম । ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । হঠাত এক দম্পতির উপর চোখ আটকে যায় । মেয়েটি আমার বয়সী হবে , সাথে আমার চেয়ে বছর দুই তিন বড় একজন পুরুষ । স্বামী স্ত্রী ওরা এতে কোন সন্দেহ নেই । সাথে একটি ফুটফুটে বছর তিনেক এর মেয়ে বাচ্চা । দেখতে মায়ের মতই হয়েছে ।
দম্পতিটির দিকে কেন এতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম বুঝতে পারছিলাম না । শেষে লজ্জায় পরে গিয়েছিলাম , কারন আমার বয়সী মেয়েটি নিজের সঙ্গিকে আমার দিকে ইশারা করে কি যেন দেখাচ্ছিলো । ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম , ভাবছিলাম এতক্ষন তাকিয়ে আছি তাই হয়ত স্বামীর কাছে নালিশ করছে । আরও ভড়কে গিয়েছিলাম যখন দেখলাম ওরা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এদিক ওদিক দেখছিলাম , ভাবছিলাম কোথায় পালানো যায় , কেমন লজ্জার একটা ব্যাপার হবে , আজকাল নাকি এসব নিয়ে মানুষ খুব প্রতিবাদ করে । আগে তো শুনতাম রাস্তা ঘাটে হেনস্থা হয়ে মেয়েরা আত্মহত্যা করে । আজকাল আর সেরকম নয় এই ধরনের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ হয় । আমার সাথেও তেমন কিছু হবে কিনা ভাবছিলাম । কিন্তু এগিয়ে আসা দম্পতির মুখে হাঁসি দেখে কিছুটা অবাক ও হয়েছিলাম ।
“তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনো নাই” কাছে এসেই হাঁসি মুখে বলল মেয়েটি , সাথের পুরুষটিও হাসছে , তবে পুরুষটির হাঁসি কেমন প্রফেশনাল টাইপ । অপর দিকে মেয়েটি খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো । “ তুমি যে একটা ম্যাদা মারা লোক সেটা জানতাম কিন্তু এতটা ম্যাদা মারা সেটা জানতাম না”
সাথে সাথেই চিনতে পেরেছিলাম , সত্যি বলতে চিনেছিলাম আগেই , মাত্র কয়েক বছরে কি ভুলা যায় । কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছিলাম না । ওজন বেড়েছে কম করে হলেও ত্রিশ কেজি । ছিপছিপে ফিগার পরিবর্তন হয়ে নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছে , থুতনির নিচে দ্বিতীয় থুতনি গজিয়েছে , বরফি কাটা মুখ খানা গোলগাল গৃহিণী টাইপ হয়ে উঠেছে । আমার চেনা লীলার সাথে এই লীলার কোন মিল নেই । মিল যেটুকু আছে সেটা ওই হাঁসি , সুধু ঠোঁটের হাঁসি নয় লীলার পুরো মুখমণ্ডল ই হাঁসে ।
কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না , পুরতন প্রেমিকার সাথে স্বামী সহ দেখা হলে কি বলতে হয় আমার জানা ছিলো না ।
“ এই আসিফ এই হচ্ছে আমার পুরনো প্রেম সৌরভ” লীলাই ভেঙ্গেছিলো নীরবতা , তবে আমাকে ফেলে দিয়েছিলো আরও অস্বস্তিতে , নিজেকে ওর স্বামীর সামনে কেমন জানি অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিলো । আসিফ নামক লোকটার মাঝে অবশ্য তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি । প্রফেশনাল সেই হাঁসি টেনে রেখেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ।
চরম অস্বস্তি নিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম , এরি মাঝে লীলা নিজের সভাবসিদ্ধ ভাবে বলে উঠেছিলো “দেখ দেখ কেমন লজ্জা পাচ্ছে হি হিহি……।।যেমন বলেছিলাম ঠিক তেমন না, দেখে মনে হচ্ছে ও নিজে মেয়ে মানুষ স্বামীর সামনে পুরাতন প্রেমিক এর সাথে দেখা হয়েছে হিহ হি হি…?”
এবার আসিফ সাহেব ও হাঁসিতে যোগ দিলো , তবে আমাকে বিব্রত হতে দেখে নিজেকে সংবরণ করে নিয়েছিলেন সাথে সাথে । স্ত্রীর হয়ে সাফাই গেয়ে বলেছিলেন “ কিছু মনে করবেন না সৌরভ সাহেব , ও একটু এমন ই”
“ ধুর তোমার চেয়ে ও আমাকে কম চেনে না” হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মত করে বলেছিলো লীলা , তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো , “ কি করছো আজকাল”
আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম লীলার দৈহিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছুই পরিবর্তন হয়নি । কিন্তু তক্ষুনি মনে পরেছিলো না না এই লীলার সাথে আগের লীলার আরও কিছু পরিবর্তন আছে , আগের লীলা আমাকে তুই করে বলত তুমি করে নয় । যে লীলা ব্যাগ নিয়ে আমার বাসায় চলে এসেছিলো সে এই লীলা নয় । আর আমি নিজেই এই পরিবর্তন এর জন্য দায়ি ।
নয়তো আজ হয়ত লীলা আমাকে তুই তুকারি করতো , মাঝে মাঝে বস্তি ভাষায় গালি দিত । আচ্ছা লীলা কি আসিফ সাহেব কে গালি দেয় ? প্রশ্নটা এসেছিলো মাথায় খুব জান্তেও ইচ্ছে হচ্ছিলো , কিন্তু জিজ্ঞাস করার ইচ্ছা বাঁ সাহস হয়নি । প্রায় আধঘণ্টা কথা হয়েছিলো সেদিন । বেশিরভাগ কথা আসিফ সাহেব আর লীলার মেয়ে টুসি কেই নিয়েই হয়েছিলো । আসিফ সাহেব কি করেন , উনার বদ অভ্যাস কি কি এসব কিছুই আমার জানা হয়ে গিয়েছিলো । তাপর হঠাত করে যেমন দেখা তেমন হঠাত করেই বিদায় মুহূর্ত চলে এসেছিলো । যাওয়ার সময় লীলা বলেছিলো “ বাসায় আইসো” তারপর নিজেই বলেছিলো “ আসবা না সেটাও জানি তবুও বললাম”
আমি হ্যাঁ না কিছুই বলিনি , সুধু শেষ বারের মত লীলার সুখি গৃহিণী মুখ খানা দেখে নিয়েছিলাম । সেদিন ই আমার মাথায় প্রথম প্রশ্ন এসেছিলো সত্যি কি আমি আশাবাদী মানুষ ?
যদি আশাবাদী ই হতাম তাহলে সেদিন লীলাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতাম না , হয়ত বলতাম তুই আমার কাছেই থাক , তুই থাকলে কোন অসুখ আমাকে কাবু করতে পারবে না । আর যদি কাবু করে তুই তোর বিখ্যাত গালি দিয়ে অসুখ কে দূরে ভাগিয়ে দিবি । কিন্তু আমি সেটা করিনি , আমি নিরাশাবাদিদের মত নিজের ভবিষ্যৎ আগেই ঠিক করে ফেলেছি । সেই ভবিষ্যতে আমি একা , আমার সাথে মার্কেটে ঘুরাঘুরি করার জন্য কেউ নেই ।