28-12-2022, 08:59 PM
(১১)
নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সে এগিয়ে চলে সর্বদা। সবাই তো চলার পথে একটু হলেও থামে, বিশ্রাম নেয়। কিন্তু তার যে উপায় নেই থামার .. তাহলেই তো ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী। মাঝে মাঝে তার জন্য বড় কষ্ট হয়। সে থামে না কখনও, শুধু তার পশ্চাতে ছুটে চলা জীবনভর। কোনো অবকাশ নেই যে তার। তার পিছনে ছুটে চলতে চলতে চলতে এক সময় ক্লান্ত হয় জনজীবন। তবুও সে থমকে দাড়ায় না .. একটু সুখের মাঝে। জীবনের ডুব সাঁতারেও তার পশ্চাতে চলা, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সুখ, দুঃখ সবই থাকে তার মাঝে .. তবুও তো সে থামে না .. বিষাদগ্রস্ত হয়ে। এই ছুটে চলার পথে ক্লান্ত হয় যখন মন .. সে থামবে না, হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এই জনসমাজ কোনো এক পথের বাঁকে .. তবুও থামবে না সে।
দুরন্ত কোনো এক গতিতে নতুন কোনো এক জীবনে সে উপস্থিত হবে। হয়তো কোনো একদিন সেই জীবনকেও সে ক্লান্ত করে তুলবে, তারপর তাকেও সে ফেলে যাবে স্বার্থপরের মতো। অতঃপর যখন তার মাঝে অবসাদ আসে, তখনো সে ছুটে চলে অবিরাম গতিতে। এতো স্বার্থপর কেন সে? জীবনের শুরু থেকে ছোটা তার পিছে। অথচ কখনও শেষ হয় না তার পথ চলা, শেষ বারের মতো ঘুমিয়ে পড়ার আগে। সময় তুমি এমন কেন? কেন তোমার এই ছুটে চলা? কেন খেলা এই মন নিয়ে? কেনই বা অসময়ে ফেলে চলে যাও আমাদের এই শৈশব, কৈশোর, যৌবনকে!
মানুষের জীবন সীমিত পরিসরের গণ্ডিতে বাঁধা। নানান স্বপ্ন, আশা প্রত্যাশার বিভিন্ন কল্পনা নিয়েই মানুষ বাঁচে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে জীবনের নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময় তো কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। সন্দীপ চলে গিয়েছে প্রায় একমাস অতিক্রান্ত হতে চললো। ওর বাবা শশাঙ্কবাবু যেদিন এখানকার কোয়ার্টার থেকে সন্দীপের জিনিসপত্রগুলো নিতে এসেছিলেন, সেদিন সুজাতা এবং হিয়ার হাজার বারণ করা সত্ত্বেও গোগোল গেছিলো সন্দীপের বাবার সঙ্গে দেখা করতে। গোগোল ভেবেছিলো তাকে দেখে নিশ্চয়ই ভীষণ রেগে যাবেন শশাঙ্কবাবু এবং হয়তো খারাপ কথাও বলতে পারেন। তবুও সে একবার ক্ষমা চাইবে সন্দীপের বাবার কাছে .. অন্তত এইটুকু বলার জন্য যে ওর মৃত্যুতে সে কোনোভাবেই দায়ী নয়। কিন্তু তাকে দেখে শশাঙ্কবাবু কোনো কটুক্তি করা তো দুরস্ত, যাওয়ার সময় গোগোলের হাত ধরে বলে গিয়েছিলেন "আমার ছেলে যে অপরাধ করেছে তার জন্য কোনো কথা বলার মুখ আমার নেই। তবুও বলবো যে মানুষটা আজ আর নেই তার উপর রাগ পুষে না রেখে পারলে তাকে ক্ষমা করে দিও।"
ডক্টর দাশগুপ্তের রেকর্ড করা ভিডিওটিতে রনিতার বলা কথা অনুযায়ী সেদিনকার রাতের ওই ন্যক্কারজনক ঘটনার পিছনে যে সন্দীপ, রনিতা এবং তার বাবা কামরাজের হাত ছিলো এ কথা পুলিশের কাছে স্পষ্ট হলেও যেহেতু সন্দীপ আর রনিতা দু'জনের আর কেউই বেঁচে নেই, সেহেতু ওই দু'জনকে জেরা করা সম্ভবপর নয়, তাই 'বেনিফিট অফ ডাউট' এর দোহাই দিয়ে আইনের দ্বারা অব্যাহতি পেলো কামরাজ। কিন্তু সে বর্তমানে গঙ্গানগর এলাকা ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না এবং গোগোল আর তার পরিবারের প্রতি কোনোরকম আঘাত নেমে আসলে, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে এ কথাও জানিয়ে দেওয়া হলো আদালতের পক্ষ থেকে।
আর যে ব্যক্তির জন্য আদালতের এত নির্দেশিকা, সেই কামরাজ? সে এখনো তার মেয়ের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। সর্বদা নিস্তেজ, নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। হয়তো তার মেয়ের স্মৃতিতে বিভোর হয়ে থাকে সবসময়। নিজের মেয়েকে অনুভবের বৃথা চেষ্টায় পরাজিত সৈনিকের মতো একাকী বসে থাকে এক কোণে। তার কণ্ঠে আজ হাজারো সুরের মূর্ছনা খুঁজে বেড়ায় সে। মেয়েকে আর কোনোদিন না ফিরে পাওয়ার বেদনায়, বিষাদে নিজেকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করে ছাই। দিনের শেষে নিজেকে বারবার বিধ্বস্ত রূপে খুঁজে পায় এক কন্যাহারা অভাগা পিতা। গঙ্গানগর মানসিক হাসপাতালের ১০ নম্বর কেবিন এবং তার সামনের ছোট্ট বারান্দাটা এখন কামরাজের সর্বক্ষণের সঙ্গী।
★★★★
সময়ের মূল্য দিতে পারলে এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই করা সম্ভব। সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। যে সময় চলে যায় সেই সময়কে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই সময়ের মূল্যায়ন করে তার প্রকৃত সদ্ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। সময় হলো জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান মুদ্রা। এই মুদ্রাটি কীভাবে ব্যয় করা হবে এই বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি অপরকে নির্ধারণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সময়ের গোলকধাঁধায় চিরজীবনের মতো আটকা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে হয়।
এতদিন তার জীবন যে খাতে বয়ে চলছিলো - অর্থাৎ মানিক সামন্তর হস্তক্ষেপে হঠাৎ করে গঙ্গানগর মিউনিসিপাল হসপিটাল থেকে বদলি হয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ রোগভোগের পর তার অসুস্থ স্ত্রীর প্রয়াণ .. এই দুই ক্ষেত্রেই তার কোনো হাত ছিলো না, বলা ভালো কিছুই করার ছিলো না। পুরোটাই সময়ের উপর ছেড়ে দিতে হয়েছিলো তাকে। কিন্তু এখন যখন তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই এবং তিনি অত ভালো মেডিকেল অফিসারের সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার ভালোবাসার টানে গঙ্গানগরে ফিরে এসেছেন, তখন সেই অতল সময়ের গোলকধাঁধায় চিরজীবনের মতো আটকা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে রাজি নন ডক্টর দাশগুপ্ত।
তাই আজ বিকেল বেলায় পেশেন্ট দেখে ফেরার পথে রেলপাড়ের বস্তিতে সুজাতার বাড়িতে এসেছিলেন ডক্টর দাশগুপ্ত। সুজাতার আজকে ছুটি ছিলো। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুম ভাঙতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল .. এরকম সচরাচর হয় না। আসলে এই ক'দিন শরীর এবং মনের উপর দিয়ে যা ধকল গেলো! গোধূলি বেলার সোনালী আলোয় অপরূপ দেখতে লাগছিলো সুজাতাকে। তার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডক্টর দাশগুপ্ত বললেন "এখন যদি আমি হাতভর্তি গোলাপ এনে বলতাম তোমাকে ভালবাসি .. খুব ভালবাসি! তুমি চাইলে এনে দিতে পারি আকাশের ওই মেঘমালা, রোদ্দুর। পাড়ি দিতে পারি প্রেমের সমুদ্দুর। যদি বলতাম তুমি চাইলেই নদী হয়ে বয়ে যাবো, পাড়ি দেবো দূর্গম সব পর্বতমালা। তুমি কি আমার সঙ্গে ভেসে যেতে পারবে দূর থেকে দুরান্তরে! কিন্তু আমি তো এত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না সুজাতা, তাহলে কি তুমি আমার হবে না? গ্রহণ করবে না আমাকে? হবে না আমার চিরদিনের সাথী? উইল ইউ ম্যারি মি সুজাতা?"
সূর্যের শেষ রক্তিম আলো ছরিয়ে পরছে গুঁড়ো গুঁড়ো। সিঁদুরের অভ্র অন্ধকারে এখনও গাঢ় হয়ে ওঠেনি নির্লিপ্ততায় মাখামাখি সাঁঝবেলা। দূরে .. জলাশয়ে জল থেকে উঠে আসছে বাষ্পীয় কুয়াশা, নিঃশব্ধে কান পেতে। শুনলে মনে হয় শিশিরের শব্দের সাথে এক মিহি ক্রন্দনের সংমিশ্রণ। সন্ধ্যাবেলার আঁতুররশ্মি রহস্যময়ী এমনি একটা বয়স .. ছুরিও না বুড়িও না ..
প্রায় হাসতে ভুলে যাওয়া চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এক আদ্যোপান্ত সংসারী, 'বায়োলজিক্যাল মা' না হয়েও এক সন্তানের জননী। বিগত দিনে এই যার মন তথা শরীরকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক অন্যায়, অনেক অবিচার, হয়েছে বহু রক্তক্ষরণ। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছে সংগ্রাম করে টিকে এই চল্লিশ ছুঁতে চলা মেয়েটি। জিজ্ঞাসা করেনা কেও চল্লিশ পার করা সংসারী কোনো মেয়ের কথা .. কেমন আছিস! অথচ চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মেয়েটির বিয়ে হয়নি বলে সবার যত শোকতাপ, যত কৌতুহল .. হয়তো বা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা। চল্লিশ ছুঁতে চলা মেয়েটির মনের ওলিগলিতে লুকিয়ে থাকে কিশোরীবেলা। নতুন করে বাঁচতে বড্ড সাধ জাগে .. পুরোনোকে নতুন করে পেতে চায় .. নতুন করে প্রেমে পরতে বড়ই যে সাধ জাগে মনে।
ডক্টর দাশগুপ্ত হয়তো অন্য কোনোরকম উত্তর আশা করেছিলেন সুজাতার কাছ থেকে। হয়তো ভেবেছিলেন বরাবরের চাপা স্বভাবের ব্যক্তিত্বময়ী সুজাতা কিছুতেই তার কাছে সহজে ধরা দেবে না। বরং এতদিন তাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার অভিমানে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সলজ্জ ভঙ্গিতে মৃদু হেসে সুজাতা জবাব দিয়েছিলো "ইশশ .. সবকিছুই তো তুমি বলে দিলে প্রতাপ .. আবার বলছো তুমি নাকি গুছিয়ে কথা বলতে পারো না! কি বলি বলতো আমি এখন .. তোমার মতো এরকম একজন সৎ , খোলা মনের মানুষই তো আমার পছন্দ। কিন্তু আমার না ভীষণ লজ্জা করছে। এই বয়সে যদি বিয়ের পিঁড়িতে বসি, তাহলে লোকে কি বলবে! অবশ্য আমি জানি লোকের কথা তুমি কোনোদিনই গ্ৰাহ্য করো না। তবে আমি তো এখন একা নই, আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার জন্য আরেকজন আছে, তুমি তো তাকে জানোই। একবার গোগোলের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলে নিই প্লিজ। কাল তোমাকে জানাচ্ছি .. কেমন!"
★★★★
রেলপাড়ের হাইকলেজ এবার দোতলা হবে। প্ল্যান স্যাঙ্কশন হওয়ার পরেও অনেকদিন ধরেই বিষয়টা আটকে পড়েছিলো। সপ্তাহ দুয়েক হলো মিউনিসিপালিটি অনুমোদন দিয়েছে। সরকারি কলেজের কাজ, তার উপর বিশাল কিছু বড় নয়। তাই এলাকার বড় বড় ঠিকাদার সংস্থাগুলি সেই অর্থে আগ্রহ না দেখালেও, অনেকগুলি ছোট সংস্থা নিজেদের আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলো। কিন্তু শেষমেষ এই কাজের বরাত পায় আমাদের গোগোল। প্রথমদিকে বিধায়ক মানিক সমান্তর এই বিষয়ে অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও লালু আলমের হস্তক্ষেপে গোগোল পেয়ে যায় কাজটা। "সৎ ভাবে, ঠিক করে এই কাজটা সম্পন্ন করো কিন্তু। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক ঝগড়াঝাটি করে তোমাকে এই টেন্ডারটা পাইয়ে দিয়েছি। আমার মুখটা যেন থাকে দোস্তো!" গোগোলের হাতে এগ্রিমেন্টের কাগজটা দেওয়ার সময় বলেছিলো আলম সাহেব। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিলো গোগোল।
বরাত পাওয়ার পরেরদিন থেকেই নিজের টিম, বলা ভালো রেলপাড়ের এই বস্তির তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পুরোদমে কাজে নেমে পড়েছিলো গোগোল। সে এতদিন রোজগার করলেও সেটাকে ভালো চোখে দেখেনি সুজাতা। কারণ তার বরাবর মনে হয়েছিলো এই বস্তি দখলের থেকে একদল শয়তানকে ঠেকাতে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার জন্য যে টাকা সে পায় .. সেটা আর যাই হোক সৎপথে রোজগার নয়। তাই গোগোলের কলেজ তৈরির এই কন্ট্রাক্ট পাওয়াতে সুজাতা সহ হিয়া দুজনেই ভীষণ খুশি। তাদের দুজনেরই আশা যদি ঠিকমতো সৎ ভাবে এই কাজ চালিয়ে যেতে পারে গোগোল, তাহলে একদিন সে এই এলাকার এক মস্ত বড় ঠিকাদার হবে।
আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে গোগোল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ফোনে কথা বলছিল সে। এমনিতে যখন তার কাজের ফোন আসে, তখন গোগোলের গলাই বেশি শোনা যায়। ফোনের এই প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ইন্সট্রাকশনস দিয়ে ফোন কেটে দেয়। কিন্তু হিয়া যখন ফোন করে তখন গোগোলকে বক্তা কম, শ্রোতা হয়ে থাকতে হয় বেশি .. না হলেই অভিমান, অশান্তি, তারপরে এক কেলেঙ্কারি কান্ড বেঁধে যায়। ও প্রান্ত থেকে কাজের কথা, অকাজের কথা, নানারকম আব্দার .. এই সবকিছু অবিরতভাবে চলতে থাকে আর ফোনের এই পাশ থেকে 'হুঁ' 'হ্যাঁ' 'ঠিক আছে' 'দেখছি' 'হয়ে যাবে' .. এর বেশি আর কিছু বলতে শোনা যায় না সচরাচর। আজ সাইট থেকে বেরিয়ে ওর সঙ্গে দেখা না করে কেন সে নিজের বাড়িতে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে .. এটা নিয়েই সম্ভবত ফোনের ওদিক থেকে অনুযোগের তীর ভেসে আসছিলো একটার পর একটা। তাই ফোনের অপরপ্রান্তে যে হিয়া আছে, এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না সুজাতার।
"সারাদিন শুধু কাজ আর তারপর বাড়ি ফিরে ফোনে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে গল্প। মামণির কথা তো আজকাল ভুলেই গেছে আমার গোগোল .." অভিমানের সুরে কথাগুলো বলে গোগোলের ঠিক সামনে বিছানার উপর এসে বসলো সুজাতা।
"এই শোনো না এখন একটু রাখছি .. এতক্ষণ ধরে তোমার অভিমান ভাঙালাম .. এখন আরেকজন অভিমানিনী এসে উপস্থিত হয়েছে আমার সামনে .. দেখি তার দাবি-দাবা মেটাতে পারি কিনা .." মৃদুস্বরে কথাগুলো বলে ফোনে হিয়াকে বিদায় জানিয়ে, সুজাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গোগোল জিজ্ঞাসা করলো "ঠিকই তো, এ আমার ভারী অন্যায় .. বলুন ম্যাডাম আপনার কি সেবা করতে পারি? বাহ্ , আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তা এই সাজ কার জন্য? তিনি এসেছিলেন নাকি?"
"ইশশশ .. এসব আবার কি কথা? মোটেই আমি কারোর জন্য সাজিনি। আমি সাজগোজ করি আর নাই করি, দেখতে আমাকে এমনিতেই ভালো লাগে .. এ কথা কিন্তু এলাকার অনেকেই বলে। তবে .. তবে আজ বিকেলে অবশ্য তোর ডাক্তারকাকু এসেছিলেন।" সলজ্জ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো সুজাতা।
"এইতো, মিলেছে .. মিলেছে .. ইয়ে হুই না বাত! সেই জন্যই তবে আজ এত সাজুগুজু! তাহলে আমি ঠিকই ধরেছি .." হাসতে হাসতে বললো গোগোল।
"খুব ইয়ার্কি হচ্ছে, তাই না? এই শোন, আমি না তোর মামণি .. দেবো না কানটা মুলে, তখন বুঝবি।" কপট রাগ দেখিয়ে বললো সুজাতা।
"আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, এবার বলো কি বলবে .." হাসতে হাসতে জানতে চাইলো গোগোল।
"সেটাই তো হচ্ছে মুশকিল .. এমন পরিস্থিতিতে আমি পড়েছি যে না পারছি কথাটা বলতে, আবার না পারছি চেপে রাখতে। এইরকম পরিস্থিতি যেন পৃথিবীর আর কারোর না হয়। এই শোন না, বলছি আজ উনি এসে আমাকে একটা কথা বলেছেন মানে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি অবশ্য 'না' বলে দিয়েছি। আমি বলেছি - এক্ষেত্রে গোগোলের পারমিশন ছাড়া কিচ্ছু হবে না। যদি আমার গোগোল এতে মত না দেয়, তাহলে আমিও রাজি নই।" আমতা আমতা করে কথাগুলো বললো সুজাতা।
"কি মুশকিল .. তখন থেকে শুধু 'আমি না বলে দিয়েছি' 'গোগোল পারমিশন না দিলে হবে না' এইসব কথাই বলে যাচ্ছো! আসল কথাটাই তো বললে না .. ডাক্তার আঙ্কেল কেন এসেছিলেন? কি প্রস্তাব দিয়েছেন উনি তোমাকে?" কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো গোগোল।
"না মানে, সেটাই বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু .. কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছি না। দ্যাখ, বলছি আমার কোনো দরকার নেই, আমি তো বেশ আছি তোকে নিয়ে। এরপর ভগবান যদি মুখ তুলে চান, এই কাজের পর তোর রোজগার যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে হয়তো একদিন হিয়াও চলে আসবে আমাদের সংসারে। আমরা তিনজনে খুব ভালো থাকবো। আমি শুধু ভাবছিলাম ওই লোকটার কথা। মানে তোর ডাক্তার আঙ্কেলের কথা বলছি আর কি। উনারও তো একটু একটু করে বয়স বাড়ছে, একা থাকে .. নিজেকেই হাত পুড়িয়ে খেতে হয়। এরপর আরো বয়স বাড়বে .. শেষ জীবনে তো দেখার জন্যেও একজনকে লাগে! তাই বলছিলাম আর কি .." নিজের কথা অসম্পূর্ণ রেখেই পুনরায় থেমে গেলো সুজাতা।
"এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেলো দেখছি .. তখন থেকে কি বলে যাচ্ছো, তার মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি। তুমি আর আমি বেশ ভালো আছি, এরপর আমার রোজগার বাড়লে হিয়া চলে আসবে, আমরা তিনজনে খুব ভালো থাকবো .. এই সবকিছু না হয় বোঝা গেলো। কিন্তু এখানে ডাক্তার আঙ্কেলের একা থাকা এবং তার শেষ জীবনে উনাকে দেখার ব্যাপারটা আসছে কোথা থেকে? আর উনি তোমাকে কি প্রস্তাব দিয়েছেন? রান্নাটান্না করে উনার বাড়ি পাঠানোর কথা বলেছেন কি? হ্যাঁ, তা পাঠাতেই পারো, এই ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই।" বেশ গম্ভীরভাবে কথাগুলো বললো গোগোল।
"না না তা নয় .. ইশশ, কি করে যে বলি কথাটা .. উনি আজ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। তোর ডাক্তার আঙ্কেল আমাকে বিয়ে করতে চান .." মৃদুস্বরে কথাগুলো বলে দু'হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো সুজাতা।
বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ধীরে ধীরে মুখমন্ডল থেকে নিজের দুই হাত সরিয়ে সুজাতা দেখলো মুখটা যতটাসম্ভব গম্ভীর করা যায়, ততটা করে মাথা নামিয়ে বসে আছে গোগোল। সুজাতা বুঝতে পারলো এই কথার আকস্মিকতায় যতটা না অবাক হয়েছে গোগোল, তার থেকেও বেশিমাত্রায় বিরক্ত হয়েছে সে। তার ডক্টর আঙ্কেলের এই প্রস্তাব সে মেনে নিতে পারেনি। "না না ঠিক আছে, আমি তো একপ্রকার বারণ করেই দিয়েছি। তবুও উনি বারবার অনুরোধ করছিলেন তাই বলেছিলাম তোকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। তোর যখন মত নেই, তাহলে উনাকে আমি কালকে সকালেই জানিয়ে দেবো .. যেন উনি আর কোনো আশা না রাখেন এই ব্যাপারে। তোকে আর মুখ গোমড়া করে থাকতে হবে না। আমার আর কি! অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, বাকিটা জীবন না হয় এই ভাবেই .. তাছাড়া ক'দিন পর হিয়া আসবে আমাদের সংসারে। তোদের সবাইকে নিয়ে খুব আনন্দে কাটবে আমার। আচ্ছা চল, রাত কিন্তু অনেক হলো এবার খাওয়া দাওয়া করতে হবে তো!" শেষ কথাগুলো বলার সময় গলাটা ধরে আসছিলো সুজাতার।
বিছানা থেকে উঠতে যাবে এমন সময় তার মামণির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে গোগোল বললো "আচ্ছা তুমি কি মনে করো বলো তো আমাকে? খুব স্বার্থপর, যে সবসময় নিজের কথাই ভাবে, তাই না? তুমি আমার জীবনে কি .. তোমার গুরুত্ব আমার জীবনে কতটা, তুমি জানো না? ওইটুকু বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে সর্বশ্রান্ত হয়ে অনিশ্চয়তার স্রোতে যখন খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিলাম, তখন তুমি না থাকলে আমার কি হতো বলো তো? তখন আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় মা'কে আমি হারিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঈশ্বর সেইসময় এমন একজনকে পাঠিয়েছিলেন আমার জীবনে, যে আমার যশোদা মা হয়ে নতুন জন্ম দিয়েছিলো আমাকে। যে নিজের সমস্ত শখ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে মানুষ করেছে আমাকে, আজ সেই মামণির প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারি আমি? আমি জানি মামণি তুমি কতটা ভালোবাসো ডাক্তার আঙ্কেলকে আর উনিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর তুমি যখন প্রথম বললে যে আজ উনি এসেছিলেন, তখনই আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম আসল কথাটা। কিন্তু এতক্ষণ তোমার সঙ্গে ইচ্ছে করে মজা করছিলাম। তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আমি। সেই পরীক্ষায় তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছো। আর একটা কথা শুনলে তুমি অবাক হবে .. শুধু আমি নই, হিয়াও মনে মনে চায় তুমি আর ডাক্তার আঙ্কেল এবার নিজেদের নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবো এবং আমাকে এ কথা সে বলেওছে। তবে হ্যাঁ, আমার একটা শর্ত আছে।"
গোগোলের কথা শুনতে শুনতে আনন্দাশ্রু ঝরছিলো সুজাতার দুই চোখ বেয়ে। কিন্তু শেষে গোগোলের শেষ কথাটা শুনে ভয় ভয় জিজ্ঞাসা করলো "কি শর্ত?"
"শর্ত হলো এই .. তুমি বিয়ে করো আর যাই করো, আমি কিন্তু আমার মামণিকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না। আর সত্যি কথা বলতে কি আমরা থাকতে উনি মানে ডাক্তার আঙ্কেল শুধু শুধু বাড়িভাড়া করে থাকবেন কেনো? আমি চাই উনি এখানে, মানে আমাদের বাড়িতে এসে থাকুন। এই শর্তে উনি বা তুমি যদি রাজি হও, তবেই আমি তোমাদের বিয়েতে রাজি, না হলে কিন্তু নয়।
গোগোলের কথাগুলো শোনার পর রাতে ঘুমোতে পারেনি সুজাতা .. নতুন ভোরের অপেক্ষায় ছটফট করছিলো সারারাত। বহুবছর আগে গোগোলের বাবা অনিরুদ্ধদাকে কনকপুরের মেলাতে দেখার পর সেই রাতটা তার অনেকটা এইরকমই কেটেছিলো। তবে পরেরদিন সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠার পর আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা চাপা আশঙ্কা হচ্ছিলো সুজাতার। গোগোলের দেওয়া শর্তে অর্থাৎ এই বাড়িতে থাকার কথায় যদি রাজি না হয় প্রতাপ .. এই কথা ভেবে। আসলে আমাদের এই সমাজে নারীর নিজের চাওয়া-পাওয়া বলে বোধহয় কিছুই থাকেনা। প্রথম জীবনে বাবা, পরবর্তীতে স্বামী আর শেষ জীবনে ছেলের ইচ্ছা অনুযায়ী সম্ভবত চলতে হয় তাকে। বাবাকে তো কিশোরী বয়সেই হারিয়েছে। তারপর স্বামীর সোহাগ বা স্বামীর অস্তিত্ব তার জীবনে তো সে পায়নি এখনো পর্যন্ত। বর্তমানে তার ছেলের কথাই শিরোধার্য ধরে নিয়ে দুরুদুরু বুকে ডক্টর দাশগুপ্তকে ফোন করে গোগোলের শর্তের কথা জানালো সুজাতা। এক্ষেত্রেও প্রথমে ফোনের অপরপ্রান্তে কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেল না। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা .. মনের আশঙ্কা ক্রমশ বিশ্বাসে পরিণত হতে লাগলো সুজাতার .. তাহলে বোধহয় শেষপর্যন্ত তার আর সুখের মুখ দেখা হলো না, এ জীবনে।
ঠিক সেই মুহূর্তে অপর প্রান্ত থেকে ডঃ দাশগুপ্তের ভারী কন্ঠ ভেসে এলো "তোমার ওই রেলপাড়ের একতলার বাড়ির সামনের উঠোনের সিঁড়ি আর ঘরের দরজাগুলোকে বলে রেখো তারা যেন শত উৎসুকতায় পেতে রাখে বুক। মেঘেদের কাছে খবর পাঠিয়ে দিও বৃষ্টিতে যেন না ভিজে যায় রাস্তা। প্রখর সূর্যের তাপ ভালোবাসার কোমলতায় যেন আগলে রাখে তার দিন। দুঃখ ভুলে যেন চাঁদ হাসে ভরা পূর্ণিমায়। সরকার কিংবা বিরোধী দলকে বলে দিও তারা যেন না নেয় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। পুলিশবাহিনীকে কাছাকাছি থেকেই দিতে বলো টহল। অসভ্য কাকেরা যখন তখন যেন ডেকে না ওঠে। আমার জন্য গরম খাবার ঢেখে রেখে, বারবার আয়নায় দেখে নিও মুখ। যত কাজ থাক সাজগোজ একটুও যেন না হয় নষ্ট। সর্বাঙ্গে সুখের আবেশে ভরা দক্ষিণা হাওয়াদের খানিকটা বসে শোনাতে বলো বিমুগ্ধতার গান। তারপর শুধুই প্রতিক্ষার প্রহর জুড়ে বোবা ভাষার খুনসুটি হবে আমাদের মধ্যে। যার অমোঘ স্পর্শতা বাহুর বন্ধন বেয়ে নিয়ে যাবে বহুদূরে .. আরও বহুদূরে। তোমার আর তোমার গোগোলের শর্তে আমি রাজি সুজাতা। আমি আসছি .. খুব তাড়াতাড়ি আসছি তোমার কাছে।"