23-12-2022, 11:20 PM
পর্ব-১২
আজ নদীর জন্মদিন। আলিফ তাকে রাতেই বলে রেখেছে, ভোরে তারা ছাঁদে একসাথে সূর্যোদয় দেখবে। আলিফের কথামতো নদী এলাম দিয়ে রেখেছিল। ভোরে এলাম বাঁচতেই সে ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, লুকিয়ে ছাঁদে চলে এসেছে। সে যখন ছাঁদে আসে তখন তার মা ঘুমিয়ে ছিলো। সে এমনিতেই সর্তকতার সাথে এসেছে, যাতে তার মা'র ঘুম না ভাঙে।
এই মুহুর্তে নদী ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। আলিফের কোনো খোঁজ নেই। এতোক্ষণে তার চলে আসার কথা। ভোর হতে চলল। আলিফ কি তাহলে এখনো ঘুমিয়ে আছে? আলিফের নাম্বারে নদী বার কয়েকবার কল দিলো। আলিফ একবারও ধরলো না। নদীর হঠাৎ মন খারাপ হলো। আলিফ কি তাহলে আমাকে আসতে বলে নিজেই ভুলে গেছে? না, আলিফ এরকম কিছু করতেই পারে না। এই কয়মাসে সে আলিফকে যতটুকু চিনেছে, জেনেছে, ততটুকুতে সে নিশ্চিত আলিফ আজ আসবেই। এই বিশ্বাসটুকু অগোচরেই তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে।
আলিফ ছাঁদে এলো তার পাঁচমিনিটের মধ্যেই। তার বাম হাতে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। শুধুই গোলাপ। তিন রঙের গোলাপ। নদীর গোলাপ ফুল প্রিয়। ভীষণ প্রিয়। গোপাল ফুল বলতে সে পাগল। সে বাইরে বেরুলে তার সামনে ফুলের দোকান পড়লেই সে গোপাল ফুল কিনে নিবে। কোনো কারণ ছাড়াই সে কিনে। তার ভালো লাগে। আলিফের অন্য হাতে ছোট একটা বক্স। নদী জানে সেই বক্সে কি আছে।
আলিফের হাতে এতোগুলা গোলাপ ফুল দেখে নদী তাৎক্ষণিক খুশি হয়ে গেলো। তার মুখে অপার্থিব খুশি এঁটে রইলো। আলিফ হেঁটে নদীর কাছে এলো। ফুলগুলো নদীর দিকে বাড়িয়ে দিতেই সেগুলো নিয়ে নিলো নদী।
নদী এবং আলিফ ছাঁদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। দুইজনের চোখ দূরের আকাশের দিকে। কখন সূর্যের আলো এসে ভোরের আন্ধকার দূর করে দিবে সেটা দেখার অপেক্ষায় তাদের চোখ।
অনেক দূরের একটা বড় বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টিসীমাকে আটকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে একখণ্ড মেঘ এসে। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের মধ্য থেকে একটু পরপর দানব আকৃতির মেঘ বের হচ্ছে। তারা অপেক্ষায় আছে সূর্যের। অপরূপ দৃশ্যাবলীর সমারোহ। পূব আকাশে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তাদের মনে হলো কোনো ষোড়শী লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাওয়ার মতো মেঘের একটা কিনারা লাল হয়ে উঠেছে। ঠিক লাল নয়, কমলা। দিনের শুরুতে ঘোষণা করা আনকোড়া সূর্যের আলতো রশ্মি এসে পড়েছে মেঘের গায়ে। এতটাই মৃদু আলো যে, মেঘ ভেদ করে সে আলো এপারে আসতে পারছে না। সেই সাদা মেঘের উপর কমলা রঙের আভার যে কী রূপ! এই রূপের বর্ণনা করতে কবিদের শব্দভান্ডার যথেষ্ট নয়।
আলিফ তার পকেটে থেকে একটা চিরকুট বের করে নদীকে দিলো।
"জীবনের সকল দুঃখ উড়ে যাক ফানুস হয়ে। চোখের ভেতর লুকিয়ে থাকা মেঘ কেটে যাক সূর্যের আগমনে। জীবনের আগামী প্রতিটা পথচলা হোক মায়াময়, ভালোবাসাময়।"
"শুভ জন্মদিন।"
নদী চিরকুটটা পড়লো। একবার, দুইবার। তারপর আলিফের দিকে তাকালো। তখক্ষণে সূর্যের আলোয় ছেয়ে গেছে চারপাশ। নদী কিছু বলল না। সে বলার মত কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না।
আলিফ কিছুক্ষণ পর নদীকে আরেকটা চিরকুট দিলো। নদী সেটার নিয়ে ভাজ খুলে তাতে চোখ বুলালো।
"শুধু তোমার জন্য আমার এই ছোট্ট উপহার।"
নদী চিরকুটটা পড়ে আলিফের দিকে তাকালো। আলিফ এই প্রথম তাকে তুমি করে বলল। তুমি করে লেখা চিরকুটটা তার পড়তে মন্দ লাগল না। সে হয়তো এতোদিন এই তুমির অপেক্ষায়-ই ছিলো।
তার জন্য কি উপহার আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে নদী। সে আলিফের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে।
আলিফ ধীরপায়ে নদীর পাশ থেকে সরে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর সে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে নদীকে বলল, "আজ থেকে আমি তোমার ভাষায় তোমার সাথে কথা বলল। তোমার জন্মদিনে আমার পক্ষ থেকে এটা ছোট্ট উপহার।"
"তুমি! কীভাবে?" নদীর চোখেম বিস্ময়।
"আমি মাসখানেক ধরেই তোমার ভাষাটা শিখছি। সারপ্রাইজ দিবো বলে আগে জানাই নি।"
নদী প্রচন্ড খুশি হয়েছে। তার জন্য কেউ তার ভাষা শিখেছে এটা ভাবতেই তার প্রচন্ড ভালো লাগছে। সে কারো জীবনে এতোটা স্পেশাল? সারাটা জীবন সে মানুষের কাছ থেকে অবহেলা পেয়েছে। এই প্রথম তাকে কেউ এতোটা গুরুত্ব দিলো। তাকে স্পেশাল অনুভব করালো। নদীর চোখ বেয়ে হঠাৎ পানি বেরিয়ে এলো।
আলিফ বাকরুদ্ধ। নদীকে এভাবে কাঁদতে দেখে সে কি করবে বা কি বলবে তাৎক্ষণিক ভেবে পাচ্ছে না। সে কি কোনো ভুল করেছে? আলিফ ভেবে পাচ্ছে না, নদী এভাবে কাঁদছে কেনো? হটাৎ তার কি হয়েছে?
নদীর কাছে এসে আলিফ হাত দিয়ে নদীর চোখের পানি মুছে দিলো। কিন্তু নদীর কান্না থামলো না। আলিফের এই স্পর্শটুকু তাকে আরো এলোমেলো করে দিলো। এতোটা মমতা আলিফের স্পর্শে।
নদী আরো কিছুটা সময় কাঁদল। আলিফ সেই সময়টুকু নদীর পাশে নদীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আলিফ একমুহুর্তের জন্যও নদীকে অনুভব করতে দিলো না সে একা। আলিফের এই স্পর্শটুকু, সকালের সূর্যের মত করে নদীর বুকের মধ্যে আলো ছড়ালো। পুরো বুকটা একমুহূর্তে জন্য আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। অন্ধকারটুকু নিমিষেই যোজন বিয়োজন দূরে সরে গেলো।
নদী এখন অনেকটা স্বাভাবিক। স্থির। শান্ত। সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে কেনো এভাবে কাঁদলো, তার ব্যাখ্যা আলিফ জানতে চাইলেও সে তাকে কিছুই বলল না। মনের মধ্যে লুকানো জীবনের কালো অধ্যায়টার কথা আলিফকে জানাতে চায় না সে। আলিফও জানলো না সে জাদুর কাঠির মত নদীকে ছুঁয়ে দিয়ে, এক মুহুর্তে জন্য তার বুকের সকল অন্ধকার দূর করে দিয়েছে। কিন্তু সে চাইলেও সারাজীবনের জন্য সেই অন্ধকার দূর করতে পারবে না।
তারা দুইজন ভোরের প্রথম আলোতে কেক কাটলো। নদীর মনে পড়ছে না তার জীবনে আগে কখনো এতোটা সুন্দর মুহূর্ত এসেছে কি না? নদী মনেও করতে চায় না। সে শুধু চায় এই সকাল, আলিফ, সূর্য, সবকিছু চিরকাল এভাবেই থাকুক। কিন্তু মানুষের সব চাওয়া কি পূর্ণতা পায়? পায় না!
নদী এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আলিফ নদীর হাত ধরে আছে। অনেকক্ষণ। নদী কয়েকবার ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছে কিন্তু সে কিছুতেই হাত ছাড়লো না। একটা সময় আলিফের হাতের মধ্যে থেকে নদীও আর তার হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো না। তারা দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের অন্ধকার পুরোটা কেটে গেছে।
হঠাৎ নদী আলিফের দিকে তাকালো। আলিফও নদীর দিকে তাকালো। তারা কেবল একে অন্যর চোখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। দুইজনে দুইজনের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। এভাবে দীর্ঘ সময় তারা একে অন্যর দিকে তাকিয়ে রইল। দুই জনের মনের মধ্যে হাজারো এলোমেলো অবলা শব্দের ঝড় বয়ে গেলো। কিন্তু কেউ সেই ঝড়ের খবর জানলো না।
হঠাৎ আলিফ কিছু একটা ভেবে নদীর দিকে খানিকটা এগিয়ে এলো। নদী নির্বাক। সে কোনো বাঁধা দিলো না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আলিফ যখন নদীর ঠোঁটে তার ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে যাবে অমনি এরকম আকস্মিক ঘটনায় নদী কিছু বুঝতে না পেরে তার শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আলিফকে। তাৎক্ষণিক আলিফ হুড়মুড়িয়ে ছাঁদের এক কোনে পড়ে গেলো। শুধু পড়ে গেলো চলত, কিন্তু কে জানতো আলিফের ভাগ্য আজ প্রচন্ড খারাপ। সে যেখানে পড়লো সেখানে কিছু ভাঙ্গা ইট ছিলো। সে সেখানে পড়ে যেতেই তার মাথা ফেটে গেলো। মুহুর্তেই ফাঁটা জায়গা থেকে তরতর করে রক্ত বের হতে শুরু হলো। সেই রক্ত বন্ধ হওয়ার নাম নেই।
আলিফের উপর রাগটা নদীর দীর্ঘায়ু হলো না। সে এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে এরকম কিছুই চাই নি। আলিফের ওরকম আকস্মিক ঘটনায় সে নার্ভাস হয়ে যায়। তখন সে কিছু না বুঝেই তাকে ধাক্কা দিয়ে বসে। কিন্তু এতো জোরে ধাক্কা দিবে সে কল্পনাও করেনি। তার এখন খারাপ লাগছে। এতোক্ষণে আলিফের শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। আলিফ তার মাথায় ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। সে হতবাক হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, এক মুহুর্তে কি-সব হয়ে গেলো।
আলিফ কেনো ওরকমটা করলো সে জানেনা। হঠাৎ তার কি মনে হলো, আর তখনি সে কাজটা করতে গেলো। নেনো সেকেন্ডের মধ্যেই সবকিছু ঘটে গেলো। সে-ও এখন লজ্জিত। এরকম কিছু করার আগে নদীর অনুমতি নেওয়া দরকার ছিলো। সে এই কাজটা করার আগ মুহুর্তেও ভাবেনি সে এরকম কিছু করতে যাচ্ছে। সে হঠাৎ নিজেকেই বুঝে উঠতে পারছে না। তার এখন গিল্টি ফিলিং হচ্ছে। নদী তার সম্পর্কে কি ভাবছে এখন? সে কি আসলেই এতোটা জঘন্য। আলিফের সবকিছু কেমন জট বেঁধে যাচ্ছে। সে কি সবকিছু নষ্ট করে ফেললো। নদী কি করবে এখন? আমাকে কি ক্ষমা করতে পারবে? আলিফ নানা কিছু ভেবে যাচ্ছে।
আলিফ ভুলেই গেলো তার মাথা থেকে এখনো রক্ত বেরুচ্ছে। সে শুধু ভেবে যাচ্ছে, নদী তার সম্পর্কে এখন কি ভাবছে। তাকে কি ধরণের মানুষ মনে করছে। সে এই রকম না। এটা জাস্ট একটা ভুল। একটা এক্সিডেন্ট। আলিফের হঠাৎ কান্না পেয়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা সে আমলেই নিলো না। তার এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
নদী এই মুহুর্তে তার সকল রাগ ভুলে গিয়ে আলিফের মাথা থেকে রক্ত পড়া কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা ভেবে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সে তার উর্ণা দিয়ে আলিফের মাথা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তাতে রক্ত বন্ধ হয়েছে কি-না সেটা বোঝা যাচ্ছে না। উর্ণাটা যে রক্তে ভিজে যাচ্ছে সেটা কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেলো।
আলিফকে উদ্দেশ্য করে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে নদী বলল, "সরি।"
আলিফ কিছু বলল না। সে নদীকে অবাক করে দিয়ে কেঁদে দিলো। এতো বড় একটা ছেলে এভাবে কাঁদছে, নদীর এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সে আরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আলিফের কি হলো? তার কি মাথায় ব্যথা হচ্ছে? নদী কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে এখন কি করবে? সে অসহায় বোধ করতে লাগল।
"কি হয়েছে? কাঁদছ কেনো? মাথায় যন্ত্রণা করছে?" নদী নানা প্রশ্ন করতে থাকলো আলিফকে। আলিফ তার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো না। উলটো তার কান্না আরো বেড়ে গেলো। সে আবার ছাঁদে বসে পড়লো। হাত দিয়ে চোখ দুটো আড়াল করে নিলো নদীর সামনে দিয়ে। সে একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে।
নদী বিরাট ঝামেলায় পড়ে গেলো। তার এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত সে ঠিক করতে পারছে না। তার রাগ করা উচিত। কিন্তু সবকিছু কেমন উলটো ঘটছে। আলিফ কেনো এভাবে কাঁদছে? আলিফের কি হয়েছে? আলিফের কান্না দেখে নদীর ঠিক থাকতে পারছে না। তার বুকের মধ্যেও তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। তারও কান্না পাচ্ছে। তার কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে? তার তো রাগ করা উচিত, আলিফের যেটা করতে গেছিল সেটার জন্য। নদী সত্যি অসহায় হয়ে পড়লো। এদিকে সে আলিফের কান্না দেখতে পারছে না। আলিফ কেনো বুঝছে না, এভাবে কান্না করছে বলে তারও কষ্ট হচ্ছে।
"কি হয়েছে? প্লিজ, কিছু একটা-তো বলো? এভাবে কান্না করছ কেনো?" নদী হাত নেড়ে নেড়ে জিজ্ঞেস করতে থাকলো আলিফকে। কিন্তু আলিফ তা দেখলো না। আলিফ দুই হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কান্না করছে।
নদীর এখন ইচ্ছে করছে সব মানুষের মত চিৎকার করে আলিফের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে পারছে না। সে কেনো এমন? সৃষ্টিকর্তা কেনো তাকে এই অক্ষমতা দিয়ে তৈরি করে? নদীর নিজের উপর রাগ হলো।
আলিফ এখনো চুপচাপ। এদিকে তার মাথা থেকে এখনো রক্ত বেরুচ্ছে। তার উচিত এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া। কিন্তু আলিফ ছাঁদে বসে কান্না করছে। সে স্বাভাবিক হতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কেনো এমন হচ্ছে?
আলিফের সামনে নদী হাটু গেড়ে বসে পড়ল। আলিফের হাত দুইটা চোখ থেকে সরিয়ে নিয়ে চোখের অশ্রু মুঁছে দিলো নদী। তারপর সে আলিফকে বলল, "প্লিজ, এভাবে কান্না করো না। কি হয়েছে?" কথাগুলো নদীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলেও সে কেবল তার নীরব ভাষায় বলতে পারল।
আলিফ কান্না থামালো। সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, "আমি খুব খারাপ তাই না? খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছি। আসলে, তখন যে কি হলো হঠাৎ আমার, আমি নিজেই বুঝতে পারিনি।" এটুকু বলেই আলিফের চোখ আবার অশ্রুসিক্ত হলো। সে অল্প কিছুটা সময় নীরব থেকে আবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলতে লাগল, "সরি, নদী। আমি সত্যি লজ্জিত। আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেও। আমি জানি, তুমি ভাবছ আমি সুবিধাবাদী মানুষ। এরকম সুযোগের আশায় ছিলাম। আর এখন একটু সুযোগ পেয়েই জঘন্য একটা কাজ করে ফেললাম। আসলে আমি এমন না। আমি এরকম কিছু করতে চাই নি। এক মুহুর্ত আগেও ভাবিনি এমন কিছু করবো। কিন্তু তখন যে কি হলো, মাথাটাই ঠিক ছিলো না। আমি বুঝতে পারছি আমি খুব খারাপ। জঘন্য। সরি....!"
নদী বলল, "আলিফ, এরকম বাচ্চাদের মত কেনো করছো? আচ্ছা, আমি কিছু মনে করিনি। হয়েছে? এবার তো কান্না বন্ধ করো।"
"আমি জানি তুমি অনেক কিছু মনে করেছ। আমাকে খারাপ ভাবছ। আমি খারাপ।"
"আহ! আমি বললাম তো আমি কিছু মনে করি নি। তবুও কান্না কেনো করছ? মাথায় যন্ত্রণা করছে? চলো, আগে ডাক্তারের কাছে যাই। এই সব নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।"
"না, আমি কোথাও যাবো না। আমার শাস্তি পাওয়ার দরকার। এটাই আমার শাস্তি।"
"এবার কিন্তু সত্যি আমার রাগ হচ্ছে। তুমি কি জানো, তুমি একদম ছোট্ট বাচ্চাদের মত করছ। এভাবে কেউ কান্না করে? আর, শাস্তি মানে কি? যা শাস্তি দেওয়া আমি দিবো, কিন্তু তার আগে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে তোমাকে।"
"আমার নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে। আমি কাজটা ঠিক করি নি। আমি ভুল করেছি। আমি তখন কি ভাবছিলাম কে জানে। আমি খুব খারাপ একজন মানুষ হয়ে গেলাম তোমার কাছে। আমি খুব খারাপ। খুব।"
নদী হঠাৎ আলিফের গালে একটা চড় দিলো। আলিফ একদম চুপ হয়ে গেলো। হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিলো। বড় বড় চোখ করে সে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল।
নদী কেনো এমনটা করলো সে জানেনা। সে কিছুটা সময় নিয়ে বলল, "আবারও সেই এক কথা বলে যাচ্ছ। আমি বললাম তো আমি কিছু মনে করি নি। তাও কান্না করে যাচ্ছ। আমার রাগ হচ্ছে। তুমি যেটা করেছ, তারচেয়ে এখন যা করছ সেই কারণে রাগ বেশি হচ্ছে। এমনটা করলে সত্যি রাগ করবো আমি। আর কখনো তোমার সামনে আসবো না।"
"আচ্ছা, আমি আর কান্না করছি না।" কথাটা বলেও আলিফ আবার কেঁদে দিলো। তার এতো খারাপ লাগছে কেনো? সে ভয় পাচ্ছে নদী যদি তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে যায়। এই ভয়ের জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। সে নদীকে ছাড়া কীভাবে থাকবে, কখন যে সে নদীকে ভালোবেসে ফেলেছে সে জানেনা। নদীকে সে ভীষণ ভালোবাসে। এই মানুষটা তাকে ছেড়ে দিলে সে বাঁচতেই পারবে না।
আলিফকে অবাক করে দিয়ে নদী হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরল। আলিফ যতটা সময় শান্ত না হলো সে এভাবেই তাকে বুকে ছড়িয়ে রাখলো।
পরিস্থিতি অনেকটা নদীর নিয়ন্ত্রণে এলো। সে আগে আলিফকে শান্ত করতে চায়। রাগটা না হয় পরেও দেখানো যাবে। কিন্তু এই অবস্থায় আগে আলিফকে ডাক্তার দেখানো উচিত।
আলিফ নিজেকে শান্ত করেছে। মাথা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। তবুও আলিফের উচিত এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া, তাই নদী বলল, "চলো।"
"কোথায়?" আলিফ জিজ্ঞেস করে।
"ডাক্তারের কাছে। ক্ষত স্থানে ড্রেসিং করে এখনই ব্যান্ডেজ লাগানো দরকার।"
"আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি বাসায় গিয়ে পরিস্কার করে নিবো।"
আলিফের কথা নদী শুনলো না। সে তাকে জোর করে নিচে নামালো। তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। অবশ্য এই ভোর সকালে ডাক্তারের পেতে তাদের কষ্ট-ই হলো।
ডাক্তার মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিলো। সেই সাথে কিছু ব্যথার ওষুধ দিয়ে দিলো। তারা ডাক্তারের কাছ থেকে সরাসরি বাসায় চলে এলো। আলিফকে তার বাসার দরজা দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে, সে উপরের তলায় এসে ধীরে শব্দ বিহীন ভাবে দরজা খুললো। ভাগ্য ভালো তার মা তখনো ঘুমিয়ে ছিলো। সে নিশ্চিন্তে তার রুমে চলে গেলো।
নদীর এখন রাগ হচ্ছে। রাগটা অন্য কারণে। আজকের দিনেই এই রকম একটা ঘটনা ঘটতে হলো।
নদী শুয়ে আছে। সে ভাবছে তার ঠিক কার উপর রাগ করা উচিত। আলিফের ওরকম কাজের জন্য তার উপর রাগ করা যায়। কিন্তু এখন আলিফের প্রতি তার রাগ হচ্ছে না। আলিফ একদম বাচ্চা। বাচ্চাদের মত ওভাবে কান্না করতে পারে নদীর কল্পনাও করেনি। নদীর একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। এই মিশ্র অনুভূতির মানে কি? নদী কোনো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো না। সে কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে গেলো। তার ক্লান্ত লাগছে। রাতেও তার ভালো ঘুম হয় নি। তার এখন দীর্ঘ একটা ঘুম দরকার।
চলবে....
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)