Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
[Image: Polish-20221214-163011229.png]

(১০)

প্রতিটা মুহূর্ত যেন অসহনীয় হয়ে উঠছিলো সুজাতার কাছে। এই দুর্বিষহ সময়ের অপেক্ষা যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিলো। তার সন্তানতুল্য গোগোল এই কাজ করেছে .. একথা স্বয়ং ভগবান এসে বললেও সে বিশ্বাস করবে না। সে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছে চক্রান্তের শিকার হতে চলেছে গোগোল। তার মনে হতে লাগলো বুক ভরা সীমাহীন স্বপ্ন নিয়ে, মিথ্যে আশা দিয়ে .. কেউ রাখেনি প্রতিশ্রুতি। যখনই সে মনে করে একটু সুখের মুখ হয়তো দেখতে চলেছে .. তখনই এত বাধা বিপত্তি আসে কেনো? হে ঈশ্বর .. এই হতাশ জীবন থেকে এবার আমাকে মুক্তি দাও তুমি। আর কতো পরীক্ষা নেবে তুমি আমার! এই ভালোবাসাহীন পৃথিবীর মানুষগুলো বড্ড পাষাণ। মানুষের কি দোষ বলো? তুমিই তো করেছো পাষাণ হৃদয় সৃষ্টি। কারো চোখে আনন্দের তারা জ্বলে, কারো চোখে দুঃখের বৃষ্টি। রাতের আধাঁরে হারাই চাঁদের দেখা, দিনের মেঘলা আকাশে দেখি না সূর্য। স্বপ্নের প্রদ্বীপ আজ নিভুনিভু .. আর কতো ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে তুমি আমার হে ঈশ্বর! এইরূপ কঠিন বাস্তবতার কাছে হেরে যাই বারংবার। দুঃখ নদীর কূল খুঁজে পাই না, দেখিনা এপার, দেখিনা ওপার।

কে কার রাখে খোঁজ, নিজ স্বার্থে অর্থ লোভে, বিবেক রয়েছে ঘুমিয়ে। মুখে মিথ্যে হাসি এঁকে, আপন জনের নিষ্ঠুরতা, দেখে যাই নীরবে, আর কত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে প্রভু! জীবন শুধুই জীবন ধারণে পরিণত হয়েছে, কেউ কারো আপন নয় আজ। শুধু বেঁচে থাকা মিথ্যে মায়ার বন্ধনে .. তাই আর বেঁচে থাকতে চায় না সে। নিভৃতে অভিষিক্ত নয়ন নৈশ-উপাধান, কেনো ছলা-কলা, উদাস হাসি! পাষাণ হৃদয় মিথ্যে অভিলাষ ..অবোধ উদ্ভ্রান্ত বাণী। শুধু অশ্রুজল, নিরব দীর্ঘশ্বাস, আহত হৃদয় না পাওয়ার বেদনায় বয়ে চলে গ্লানি। দিনের আলো হয় ম্লান হতাশার নিঃশ্বাসে। থেমে যায় হাসি গান, ফুরিয়ে যায় বেলা.. মিছে হাসি খেলা। দিন হয় অবসান .. সুখ দিয়ে বলিদান।

গোগোলের বাইকের চেনা আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো সুজাতা। কোনোরকমে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতপায়ে গোগোলের কাছে গিয়ে আকুতি মিশ্রিত কন্ঠে অথচ মৃদুস্বরে বলে উঠলো "তুই এখানে কেন এলি? চলে যা চলে যা, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা .. কি সব বলছে জানিস ওই পুলিশটা? ও বলছে .. তুই নাকি টগর কে .." এইটুকু বলে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো সুজাতা। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো "আমি অবশ্য .. আমি অবশ্য একটা কথাও বিশ্বাস করিনি। আমি জানি ওই লোকটা মিথ্যা কথা বলছে। আমি বুঝতে পারছি কামরাজ, তারপর মানিক সামন্ত আর ওই পুলিশটা মিলে একটা চক্রান্ত করেছে তোর বিরুদ্ধে। তুই আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না সোনা মানিক আমার .. চলে যা চলে যা .."

গোগোল তাকিয়ে দেখলো সুজাতার চোখ-মুখের চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে তার প্রিয় মামণি। উস্কো খুসকো চুল আর আলুথালু পোশাকে কিরকম যেন একটা পাগলিনীর মতো লাগছে তাকে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে হিয়া। ফ্যাকাশে মুখে ছলছলে চোখে গোগোলকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সে, ঠিক তখনই "এইতো নায়কের আগমন ঘটিয়াছে রঙ্গমঞ্চে .. হাততালি হাততালি .. সবাই হাততালি দেওয়া শুরু করে দাও। না না, এখন না .. আর একটু অপেক্ষা করো তোমরা। আগে তোমাদের নায়ক তার দুই প্রেয়সীর সঙ্গে বিদায় বেলার বার্তালাপ করে নিক। তারপর যখন ওর কোমরে দড়ি বেঁধে এই বস্তির মধ্যে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাবো .. তখন না হয় হাততালি দিও সবাই .. হেহেহে .." গা জ্বলানি একটা হাসি হেসে উক্তি করলো সন্দীপ।

"দুই প্রেয়সী মানে, এসব আপনি কি বলছেন? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন। বাড়াবাড়ির কিন্তু একটা সীমা থাকে, কি বলতে চাইছেন কি আপনি?" উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সুবীর।

"কুল ডাউন বেবি, কুল ডাউন .. আমি এখন তোমাদের নায়ক মানে তোমাদের হিরোর সঙ্গে কথা বলবো। এখন তোমার মতো চুনোপুটিদের চুপ থাকাই শ্রেয়। তুমি তো মাছের ব্যবসা করো .. আমি কি বলতে চাইছি সেটা না হয় পরে কোতোয়ালিতে তোমার আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে তোমাকে বোঝাবো, কেমন?" কথাটা শেষ করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলো তার ঠিক মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে গোগোল। এতটাই কাছে যে, গোগোলের নিঃশ্বাস তার কপালে পড়ছিল। উচ্চতায় সন্দীপের থেকে গোগোল অনেকটাই লম্বা, তাই মাথা উঁচু করে গোগোলের চোখে চোখ রাখতে হচ্ছিলো সন্দীপের।

"কি ব্যাপার? এখানে কি চাই? কি বললেন একটু আগে .. দু'জন প্রেয়সী .. এই কথার মানে কি? আর মামণি একটু আগে কি বলছিলো .. আপনি আবার কি অভিসন্ধি নিয়ে এসেছেন এখানে?" গম্ভীর অথচ শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো গোগোল।

"ওলে বাবালে .. আমি না ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম! এই বস্তির বেতাজ বাদশা আমাকে ধমকাচ্ছে .. ওরে ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আমাকে বাঁচা .. খুব ভয় করছে আমার .." ব্যঙ্গাত্মক সুরে কথাগুলো বলেই চিৎকার করে উঠলো সন্দীপ "গরম দেখাচ্ছিস আমাকে শুয়োরের বাচ্চা? লকআপে ঢুকিয়ে যখন জামাপ্যান্ট খুলে উল্টো করে ঝুলিয়ে ডান্ডা দিয়ে ক্যালাবো, তখন দেখবো তোর এই গরম কোথায় যায়! দু'জন প্রেয়সী বলতে কি বুঝিয়েছি সেটা পরিষ্কার করে তোকে বলছি শোন। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে হিয়া .. যাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলে প্রেমের জলে ফাঁসিয়েছিস! ও হলো তোর প্রেয়সী নাম্বার টু। আর প্রেয়সী নাম্বার ওয়ান কে জানিস? তোর বাঁধা রেন্ডি .. যাকে সবার সামনে মামণি বলে নাটক করছিস। ওই মহিলার সঙ্গে তোর অবৈধ সম্পর্ক আছে। বুঝে নিয়েছিস? আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?"

সন্দীপের এই উক্তিতে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না রাজু, চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলো সন্দীপের উপর। তৎক্ষণাৎ তাকে নিজের দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় গোগোল বলে উঠলো "উঁহু উঁহু .. এখনো সময় আসেনি .. এখনো এই ব্যক্তির পাপের ঘড়া সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হয়নি .. উনি এখানে কেন এসেছেন আর মামণি তখন কি বলছিলো টগরের সম্পর্কে .. সেগুলো সব জানতে হবে তো .. তার আগেই এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে চলবে!"

"নাটক হচ্ছে এখানে? একটা মেয়েকে রেপ করার পর তাকে খুন করে এখানে এসে বড় বড় ভাষণ দিচ্ছিস তুই? পাপের ঘড়া আমার কি পূর্ণ হবে? তোর অলরেডি পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই তোকে এখন এই মুহূর্তে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাবো আমি। তারপর তোর যা ব্যবস্থা করার অবশ্যই করবো। মিস্টার অনির্বাণ মুখার্জি .. আমি আপনাকে কুমারী টগর সাধুখাঁর রেপ এবং মার্ডারের কেসে প্রধান অপরাধী হিসেবে অ্যারেস্ট করছি।" চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ।

★★★★

"বটে? তা এই কাজ যে আমি করেছি তার প্রমাণ কি? মানে আমি বলতে চাইছি কোনো মেডিকেল রিপোর্ট বা নিদেনপক্ষে সাক্ষী অর্থাৎ কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আছে .. যে এই কাজটা আমাকে করতে দেখেছে? নাকি অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোনো প্রমাণ ছাড়াই চলে এসেছেন এখানে?" অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাবে কথাগুলো বললো গোগোল।

"এইরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়েও এতটা স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছিস কি করে, আমি সেটা দেখেই অবাক হয়ে যাচ্ছি! তবে তোর কি ধারণা আমি তৈরি না হয়েই এসেছি এখানে?" গোগোলের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে, ক্লাবঘরের সিঁড়ির উপর বসে থাকা দু'জন কনস্টেবলের মধ্যে একজনের উদ্দেশ্যে গলা তুলে সন্দীপ বললো "শ্যামল .. গাড়ি থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে এসো .."

হিয়া আর সুজাতা সহ রেলপাড়ের বস্তির বাকি আবাসিকদের উৎকণ্ঠায় ভরা মুখগুলো দেখতে পেলো কনস্টেবলের সঙ্গে পুলিশের জিপের ভেতর থেকে নেমে এলো স্বপন সাধুখাঁ। তাকে দেখেই ওখানে উপস্থিত সকলের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হলো .. সেই গুঞ্জন ক্রমে জোরালো কোলাহলে পরিণত হলো। পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে এটা আন্দাজ করতে পেরে সবাইকে চুপ করে থাকার জন্য ইশারা করে সন্দীপ বলে উঠলো "আপনারা এখন একটু শান্ত হয়ে থাকুন। থানাতে নিয়ে গিয়েও আইডেন্টিফিকেশন করাতে পারতাম। কিন্তু আমি একজন অতি দয়ালু পুলিশ অফিসার। মনটা আমার ভীষণ নরম। কেউ কোনো অনুরোধ করলে, সে যদি ক্রিমিনালও হয় .. তবুও তার অনুরোধ ফেলতে পারিনা। তাই আপনাদের হিরো অনির্বাণের কথা অনুযায়ী এখানেই সবার সামনে না হয় অপরাধীকে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটা হোক। তবে আমারও কিন্তু একটা আব্দার আছে, সেটা আপনাদের রাখতেই হবে। স্বপন বাবুর বয়ানের পর অনির্বাণকে কোমরে দড়ি পরিয়ে এখান থেকে হাঁটিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার আগে আপনারা প্রত্যেকে ওর এই সুন্দর হিরোমার্কা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওই কুৎসিত নোংরা মুখে পায়ের থেকে জুতো খুলে মুখে মারবেন।‌ কি, আপনারা রাজি তো? তবেই কিন্তু এখানে আইডেন্টিফিকেশন হবে .. না হলে নয়।"

ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এবং এলাকার সবথেকে সজ্জন ব্যক্তি পঙ্কজ বাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে গলাটা অতিমাত্রায় স্বাভাবিক করে নিয়ে মুচকি হেসে গোগোল বলে উঠলো "আচ্ছা ঠিক আছে, সে হবে খন .. আগে তো আমার আইডেন্টিফিকেশন হোক, তারপর না হয় .."

হিয়া লক্ষ্য করছিলো এইরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যেখানে একজন ব্যক্তির উপর পুলিশের পক্ষ থেকে এত বড় একটা এলিগেশন আনার পর সেই ব্যক্তির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কথা, লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে, দুঃখে .. তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার কথা। সেখানে তার গোগোল দাদা এতটা স্বাভাবিকভাবে অথচ এইরকম দৃঢ় ভঙ্গিতে কথা বলছে কি করে! এদিকে গোগোলের মুখে এইরূপ উক্তি শুনে মনের ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠলো সন্দীপের। স্বপন সাধুখাঁর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো, "কি ব্যাপার? আপনার মেয়ের ধর্ষক এবং খুনি আপনার চোখের সামনে দণ্ডায়মান, আর আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন? বলুন বলুন .. মুখ ফুটে কিছু বলুন। আপনার কোনো ভয় নেই, এই শুয়োরের বাচ্চা আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আপনি নির্ভয় বলুন কাল আপনি নিজের চোখে যা দেখেছেন .."

"কি বলবো?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো স্বপন সাধুখাঁ।

"আরে কি মুশকিল .. আপনি হঠাৎ এরকম ইডিয়েটের মতো কথা আচরণ করছেন কেন? একটু আগেই আপনাকে যেগুলো বলতে বললাম, আই মিন .. আই মিন, আপনি আমাকে যে কথাগুলো বললেন .. সেগুলোই এখানে বলুন। দেরি করবেন না .. সময়ের দাম আছে আমার।" বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ।

এতক্ষণ স্বপনবাবু সন্দীপের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এই মুহূর্তে কয়েক পা এগিয়ে এসে গোগোলের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে সন্দীপের দিকে ঘুরে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো "আপনি তো আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে এসেছেন এখানে, কিন্তু আমি তো এখনো‌ পর্যন্ত আমার মেয়েটাকেই দেখতে পেলাম না .. কাল রাতের ওই ঘটনার পর যে কি হলো, সেটাই তো আমি এখনো পর্যন্ত জানতে পারিনি। আমার মেয়েকে এখনো দেখিনি আমি .."

"একটু আগে এত কথা হলো আপনার সঙ্গে। তখন তো আমার সব কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এখন এসব আপনি কি বলছেন? ন্যাকামি হচ্ছে? আপনার মেয়ের নাগরকে দেখে হঠাৎ তার প্রতি দরদ উথলে উঠলো নাকি? আপনাকে তো তখন বললাম যে  আপনার মেয়েকে রেপ করার পর তাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে আপনার মেয়ের এই নাগর। গায়ে জামাকাপড়ও কিছু ছিলো না আপনার মেয়ের, এখনো পর্যন্ত কোনো জামাকাপড় খুঁজেও পাওয়া যায়নি। ওইরকম একটা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে ঝলসে যাওয়া বিকৃত বডি দেখে আপনি চিনতে পারতেন? লাশটা ফরেেন্সিকে পাঠানো হয়েছে, ওখান থেকে একটু পরেই চলে আসবে। তখন প্রাণ খুলে আপনার মেয়েকে দেখে নেবেন। এখন যেটা আপনার বলার কথা, অর্থাৎ অপরাধীকে চিহ্নিত করার কথা সেটা করুন।" উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ।

"বাবা গোগোল, কালকের ওই ঘটনার পর .. সবই তো তুমি জানো, তোমাকে আর নতুন করে কি বলবো! তুমি না থাকলে যে কি হতো! যাইহোক, ডাক্তারবাবুর বাড়িতে আমার ছোট মেয়ে শিউলিকে রেখে ভোররাতে যখন নিজের ফিরছি, তখন রাস্তায় আমাকে ধরে এই পুলিশ ইন্সপেক্টর। তারপর আমাকে থানায় নিয়ে গিয়ে আমার মেয়ের মৃত্যুসংবাদ দেয়। খবরটা শুনে আমি প্রথমে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম .. জানো তো বাবা! কাল সন্ধে থেকেই ছোট মেয়ে শিউলিকে নিয়ে ভীষণ টেনশন যাচ্ছে, তার উপর টগরের খবরটা শুনে .. এতটা চাপ নিতে পারিনি আসলে। জ্ঞান ফেরার পর এই পুলিশটা আমাকে বলে - এখানে এসে সবার সামনে আমাকে বলতে হবে আমার বড় মেয়ে টগরকে তুমি প্রথমে নষ্ট করেছো, তারপর খুন করে জ্বালিয়ে দিয়েছো ওর দেহটাকে। এই কথা যদি আমি বলি তাহলে এই বস্তি অধিগ্রহণের পর এখানে আমার থাকার থাকার বন্দোবস্ত করে দেবে ওরা .. আমাকে পাকা দলিল দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে প্রচুর টাকাও দেয়া হবে .. যাতে ভবিষ্যতে আমাকে আর মুদিখানার দোকান চালাতে না হয়। আর যদি না বলি তাহলে আমাকে খুন করার ভয় দেখায় এই পুলিশটা। আমি ভয় তখন কিছু বলতে পারিনি বাবা। খুব অসহায় বোধ করছিলাম একা একা .. তাই ওনার সব কথায় রাজি হয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমি একটা কথা উঠতে পারছি না আমার মেয়ে কি সত্যি সত্যি আর নেই? তবে কি ওরা সত্যি বলছে  তোমার নামে? কিন্তু এই কথা তো আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করতে পারবো না। তাহলে কি ওকে অন্য কেউ! হায় ভগবান, এ কি সর্বনাশ হলো আমার! হ্যাঁ আমি মানছি .. ওদের মা চলে যাওয়ার পর সেই রাগে আমি আমার ছোট মেয়ে শিউলির প্রতি অনেক অন্যায় করেছি, অনেক অবিচার করেছি .. কিন্তু তাই বলে ভগবান আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন!" কথাগুলো বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে মাটিতে বসে পড়লো স্বপন সাধুখাঁ।

"হারামি বজ্জাত বুড়ো কোথাকার .. তোর সাহস তো কম নয় .. তোকে আমি সাহায্য করার চেষ্টা করছি, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি, আর তুই এখানে এসেই নিজের স্বরূপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছিস? বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলছিস এখন আমার নামে? আর একটু আগে কি বললি তোর মেয়ের নাগরকে? 'তুমি না থাকলে যে কি হতো' এই কথার মানে কি? এই কথা তো তখন আমাকে বলা হয়নি। ও ওখানে কি করে পৌঁছলো?" চিৎকার করে উঠলো সন্দীপ।

"বাঃ রে .. কাউকে রেপ করতে গেলে তারপর তাকে খুন করতে গেলে আমাকে তো সেই জায়গায় পৌঁছতেই হবে, তা না হলে কাজগুলো করবো কি করে? এতে এত অবাক হচ্ছেন কেন ইন্সপেক্টর সাহেব?" টগরের বাবাকে মাটি থেকে তুলে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কথাগুলো বললো গোগোল।

"টগর কাল রাতে খুন হয়েছে, আর ওকে রেপ করে খুন করেছিস তুই, এটাতো জলের মতো পরিষ্কার। তাই ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভার স্মার্ট! এখন মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মাথার ঠিক নেই এই বুড়োটার। পরে ওকে দিয়ে ঠিক সত্যি কথা বলিয়ে নেবো আমরা। এখন আর সময় নষ্ট না করে থানায় চল আমার সঙ্গে, তোকে এই মুহূর্তে অ্যারেস্ট করলাম আমি।" শশব্যস্ত হয়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ।

★★★★

"খামোশ .." হুঙ্কার দিয়ে উঠলো গোগোল। বাঘের গর্জনে যেমন কুকুর ভয় পেয়ে গিয়ে কুঁই কুঁই করে লেজ গুটিয়ে কোণা খোঁজার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনি এতক্ষণ ধরে হেসে হেসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকা গোগোলের হঠাৎ এইরূপ হুঙ্কারে‌ সন্দীপ থতমত খেয়ে দু'পা পিছিয়ে যেতে গিয়ে নিজের গাড়ির সঙ্গে অতর্কিতে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। তারপর আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাড়ির দরজা ধরে উঠে দাঁড়ালো।

এলাকায় গোগোলের থেকেও মাথা গরম এবং রাগী স্বভাবের বলে পরিচিত সুবীর এখনো পর্যন্ত সেই অর্থে নিজের স্বরূপ প্রকাশ না করলেও সন্দীপের অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললো "গুরুর একটা হুঙ্কারেই মালটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো .. ভাবা যায়! এ আবার নাকি আমার গা থেকে আঁশ ছাড়ানোর কথা বলছিলো একটু আগে। শালা এখন নিজের প্যান্টের ভেতরেই পেচ্ছাপ করে ফেলেছে কিনা সন্দেহ!"

"ব্যাস .. হয়েছে .. এবার সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ করছি। এতক্ষণ ধরে এই ইন্সপেক্টর আপনাদের অনেক ভাষণ দিয়ে গেছে এবং আপনারা চুপ করে সব কথা শুনেছেন। এবার আমি কাল রাত থেকে আজ ভোর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা আপনাদের সামনে বলতে চলেছি। আমি ছাড়াও যে ঘটনার তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী এখানেই উপস্থিত আছে। হ্যাঁ তিনজন .. আপনারা ঠিকই শুনেছেন। খুব মন দিয়ে আমার প্রতিটা কথা শুনবেন, তারপর আপনারা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই আমি মাথা পেতে নেবো।" কথাগুলো বলে সুবীরের দিকে ইশারা করলো গোগোল।গোগোলের ইশারা পাওয়া মাত্রই সুবীর, কাঞ্চন, রাজু আর মধু .. এই চারজনে সন্দীপকে ঘিরে তার দুই পাশে দাঁড়ালো।

এদিকে গোগোল আবার বলতে শুরু করলো "তখন রাত সাড়ে এগারোটা হবে হঠাৎ আমার মোবাইলে মধুর ফোন এলো। আপনারা সবাই জানেন মধুর চায়ের দোকান রেলপাড়ের পশ্চিমদিকের ওই বড় রাস্তার মোড়ে, স্বপন কাকুর বাড়ির কাছেই। দু-একটা কাজের কথার পর মধু বললো - 'সন্ধ্যের দিকে টগর আমার দোকানে এসেছিলো চিনি আর চা পাতা দিতে .. ওদের দোকান থেকেই তো আমি নিই ওগুলো। আমি নিজেই নিয়ে আসি, কিন্তু আজ কাজের চাপে যেতে পারিনি, তাই টগর দিতে এসেছিল। ও বললো কয়েকদিন ধরেই নাকি শিউলির শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। তবে আজ বাড়াবাড়ি রকমের পেটের ব্যথা হচ্ছে। ওর ফোনে নাকি সফটওয়্যার আপলোডের জন্য ফরম্যাট করার ফলে সমস্ত নম্বর উড়ে গেছে তাই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। যদি দরকার হয় তাহলে খবর দেবে .. এই বলে চলে গেলো। আমার দোকানে আজ এত ভিড় ছিলো যে মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো ব্যাপারটা। এখন দোকান বন্ধ করতে করতে হঠাৎ মনে পড়লো, তাই তোমাকে জানালাম। একবার খোঁজ নিও তো মেয়েটা কেমন আছে।' কথাগুলো শোনার পর মধুর ফোনটা কেটে দিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ টগরকে ফোন করলাম। মধু যা বলেছিলো সেগুলোই ও বললো, তার সঙ্গে এটাও জানালো স্বপন কাকু মানে ওদের বাবা শিউলিকে নিয়ে এইমাত্র বাড়ি থেকে বেরোলো, আর ও জামাকাপড় চেঞ্জ করে এখন ওর বাবার সঙ্গে যাবে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ওর গলা শুনেই আমি বুঝতে পারলাম শিউলির অবস্থা একদমই ভালো নয়। স্বপন কাকু মাঝে মধ্যে একটু খ্যাচ খ্যাচ করে বটে তবে, টগর এবং তার পরিবার সময় অসময় যেভাবে আমার পরিবারের পাশে থেকেছে তাতে ওদের এই বিপদের দিনে আমি যদি ওদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে ভগবান কোনদিনও আমাকে ক্ষমা করবে না। তাছাড়া শিউলিকে আমি নিজের বোনের থেকেও বেশি ভালোবাসি, তাই ওর দাদা হিসেবে সব দায়িত্ব তো আমাকেই পালন করতে হবে। আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে মামণিকে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।"

একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা দম নিলো গোগোল, তারপর আবার বলতে শুরু করলো "বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইকে স্টার্ট দিতে যাবো, হঠাৎ দেখি পেছনের চাকাটা পাংচার হয়ে গেছে। অথচ সন্ধ্যেবেলা যখন ফিরলাম তখনো একদম ঠিক ছিলো। আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো .. এমত অবস্থায় এত রাতে আমি যাবো কি করে অতদূর ওদের বাড়িতে! সুবীর কে ফোন করলাম, ও আমার বাড়ির পাশেই থাকে। আমার ফোন পেয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো। দু'জনে মিলে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটায় এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি যদি পথচলতি কোনো গাড়ির থেকে লিফট নেওয়া যায়। কিন্তু জনমানব শূন্য রাস্তায় গাড়ি তো দুরস্ত, রাস্তার কয়েকটা কুকুর ছাড়া কোনো মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছিলো না। হঠাৎ করেই সেইসময় আমাদের সামনে ধুমকেতুর মতো একটা সবুজ রঙের মারুতি সুজুকি আর্টিগা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমরা কিছু বলার আগেই গাড়ির কাচ নামিয়ে দাশগুপ্ত আঙ্কেল আমাকে হাতের ইশারায় ওনার কাছে ডাকলেন। হ্যাঁ আমি মিউনিসিপাল হসপিটালের প্রাক্তন সুপার ডক্টর প্রতাপ দাশগুপ্তর কথা বলছি‌ .. যিনি বর্তমানে এখানে উপস্থিত আছেন। আমি গাড়ির কাছে যাওয়ার পর উনি জানালেন একটা এমারজেন্সি কলে পেশেন্টের বাড়িতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই ফিরছেন এবং জানতে চাইলেন এত রাতে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছি? উনাকে সব কথা বলার পর উনি বললেন 'তাড়াতাড়ি আমার গাড়িতে উঠে এসো তোমরা। আমি তোমাদের নিয়ে যাবো গন্তব্যে।' উনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন গাড়ি। ডাক্তার আঙ্কেলের গাড়িতে বসে স্বপন কাকুর বাড়ি পৌঁছতে মিনিট চারেকের বেশি সময় লাগলো না। কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখলাম ওদের বাড়িতে তালা ঝুলছে। তৎক্ষণাৎ টগরকে ফোন করে জানতে পারলাম ওরা এইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে এত রাতে কোথাও কোনো যানবাহন না দেখে বড় রাস্তার মোড়ের দিকে গেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখতে পেলাম স্বপনকাকু শিউলিকে কোলে নিয়ে একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে উঠে বসলো, তারপর টগরও উঠলো গাড়িটাতে। ওরা গাড়িতে ওঠার পর অ্যাম্বাসেডরটা ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো .."
[+] 8 users Like Bumba_1's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 23-12-2022, 08:53 PM



Users browsing this thread: 20 Guest(s)