16-12-2022, 09:24 AM
** একমুঠো আনন্দ **
রামপুরহাট থেকে দমদম ফিরছিলাম ট্রেনে। ভিড় তেমন ছিল না। এক মহিলা উঠলেন চকোলেট নিয়ে। ওরকম তো কতই ওঠে বিক্রেতা। কিন্তু মহিলার আঁচল ধরেই সামনে এলো এক ছোট ছেলে। বয়স আন্দাজ পাঁচ,সাড়ে পাঁচ হবে। মা কি বিক্রি করছে সেদিকে ছেলেটির খেয়ালই নেই। সে নিজের মতো করে ঘুরে ঘুরে যেন চারপাশ দেখছে। আমার ছেলের বয়সী আবার দেখতেও অনেকটা সেরকম। আমি ইশারা করতেই মায়ের আঁচল ছেড়ে আমার কাছে এলো। এসেই জিজ্ঞাসা, তুমি কি এখন নেমে যাবে ?
- না তো এখন নামবো না।
- তবে তোমার পাশে আমি একটু বসি?
এর মধ্যেই মা ঘুরে এদিকে এলো। সে ছেলেকে সামলে নিয়ে বলছে কি রে কি বলছিস তুই ?
আমি ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, আমি চারটে চকোলেট নেব। ওর মা বললো, এই টাকায় তো অনেক চকোলেট হবে।
- তা হোক। আমি চারটেই নেব।
চকোলেটের জারটা আমার সামনে ধরলো। আমি চারটে তুলে নিলাম। ছেলেটা এদিকে বলছে আরো নাও,আরো নাও। খুব ভালো খেতে। চারটে চকোলেটের দুটো ওর হাতে দিয়ে বললাম, আগে তুই খা। তোর মুখ দেখে আমি বুঝে নেব কতটা ভালো চকোলেট।
- তুমি মুখ দেখে বুঝে নিতে পারো?
- হমম খুব পারি।
ওর মা ব্যস্ত হয়ে বললো ওকে আর দেবেন না চকোলেট। সারাদিন ওই খেয়ে যাচ্ছে বমি হয়ে যাবে। আমি ভাবছি,তাহলে কি দেওয়া যায় ওকে?
হঠাৎ আমার মনে হলো মল্লারপুরে বাইনার মোড় থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ কিনে ব্যাগে রেখেছি। খুব ভালো খেতে। গুড়ের অপূর্ব গন্ধ আর মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। তাই নিজে খেয়ে বাড়ির জন্য নিয়ে আসছিলাম। বাড়িতে প্রথমে ঠাকুরকে দেব তারপর প্রসাদ করে সবাই খাবো। সেই প্যাকেটটা বের করলাম। ছেলেটা এর মধ্যেই আমার পাশের সিটে বসে পড়েছে।
- তোমার মোবাইলে কার্টুন আছে?
ওর মা খানিক সঙ্কুচিত কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে যেন বললো, যার হাতেই মোবাইল দেখবে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়বে কার্টুন দেখার জন্য। একে নিয়ে আর পারিনা।
আমার মনে হলো একটা নিষ্পাপ শিশুর যা পাওয়ার কথা সেটা তো ওকেই আমরা, আমাদের সমাজ দিতে পারছি না।পরিবর্তে মা কে সেই বাচ্চা
কে নিয়ে বেরোতে হচ্ছে ফেরি করে জিনিস বিক্রি করতে। এ লজ্জা তো আমাদের সমাজের! যাহোক, ওকে একটা কার্টুন চালিয়ে দিলাম। আর প্যাকেট টা খুলে ওর সামনে ধরলাম। কি আনন্দ করে পরপর চারটে সন্দেশ খেয়ে নিল। অমন আনন্দ আর মুখ নাচিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেতে দেখে আমার মনটা খুশিতে কানায় কানায় ভরে গেল।এমন মায়া ভরা হাসি মুখ দেখলে কেটে যায় সব ক্লান্তি, বেড়ে যায় বাঁচার আনন্দ!সুখী হওয়ার এত শর্টকাট উপায় থাকতেও আমরা তা অবলম্বন করিনা কেন? মায়ের হাতেও দিলাম দুটো। আমিও একটা নিলাম ওদের সাথে সাথ দিতে। মা বললো ছেলেটাকে দুধ কিনে দিতে পারছে না, বেচাকেনা একদম ভালো নেই। সুখী হওয়ার লোভ ততক্ষনে আমাকেও পেয়ে বসেছে। ব্যাগ থেকে যথাসাধ্য বের করে তার হাতে দিলাম। বললাম দুধ আর মাছ কিনে দেবেন। আমার ছেলেটা যে মাছ বড় ভালোবাসে, সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। এবার পনেরো মিনিটের কার্টুন দেখার ইতি হলো। মায়ের তাগাদা - এই এবার চল। দিয়ে দে কাকুকে মোবাইল। ছেলের কাতর মিনতি মা আর একটু থাকি না। কাকুটা খুব ভালো। বিশ্বাস করুন জীবনে অনেকবার শুনেছি 'ভালো' এই কথাটা। কিন্তু এমন সুন্দর করে সার্টিফিকেট তো কেউ দেয়নি !
মা টেনে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। কিন্তু আমি মনে রেখে দিলাম স্মৃতিটা। থাকলো ঈশ্বরের প্রতি কিছু অভিযোগও। তুমি মঙ্গলময় ,কিন্তু ওই ছেলেটাকে রাস্তায় বের করে কার কি মঙ্গল হচ্ছে ?আমাদের সকলকে দুঃখ দিও, কষ্ট দিও, পরীক্ষা নিও কিন্তু কোন শিশুকে এই কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন দাঁড় করিও না প্রভু। তোমার দেওয়া কষ্ট সইতে পারবো কিন্তু বাচ্চাদের এই কষ্ট যে অসহনীয়।এই সব ভাবনার ভিড়ে আনন্দের মাঝেও চোখ ঠেলে জল যেন বেগে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। চলন্ত ট্রেনের জানলার দিকে তাকিয়ে নিবৃত করলাম নিজেকে।মনে হলো আমার ঠাকুরের জন্য বয়ে নিয়ে আসা সন্দেশ ঠাকুর নিজে শিশু বেশে এসে খেয়ে গেল।
-- কৌশিক চৌধুরী--
রামপুরহাট থেকে দমদম ফিরছিলাম ট্রেনে। ভিড় তেমন ছিল না। এক মহিলা উঠলেন চকোলেট নিয়ে। ওরকম তো কতই ওঠে বিক্রেতা। কিন্তু মহিলার আঁচল ধরেই সামনে এলো এক ছোট ছেলে। বয়স আন্দাজ পাঁচ,সাড়ে পাঁচ হবে। মা কি বিক্রি করছে সেদিকে ছেলেটির খেয়ালই নেই। সে নিজের মতো করে ঘুরে ঘুরে যেন চারপাশ দেখছে। আমার ছেলের বয়সী আবার দেখতেও অনেকটা সেরকম। আমি ইশারা করতেই মায়ের আঁচল ছেড়ে আমার কাছে এলো। এসেই জিজ্ঞাসা, তুমি কি এখন নেমে যাবে ?
- না তো এখন নামবো না।
- তবে তোমার পাশে আমি একটু বসি?
এর মধ্যেই মা ঘুরে এদিকে এলো। সে ছেলেকে সামলে নিয়ে বলছে কি রে কি বলছিস তুই ?
আমি ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, আমি চারটে চকোলেট নেব। ওর মা বললো, এই টাকায় তো অনেক চকোলেট হবে।
- তা হোক। আমি চারটেই নেব।
চকোলেটের জারটা আমার সামনে ধরলো। আমি চারটে তুলে নিলাম। ছেলেটা এদিকে বলছে আরো নাও,আরো নাও। খুব ভালো খেতে। চারটে চকোলেটের দুটো ওর হাতে দিয়ে বললাম, আগে তুই খা। তোর মুখ দেখে আমি বুঝে নেব কতটা ভালো চকোলেট।
- তুমি মুখ দেখে বুঝে নিতে পারো?
- হমম খুব পারি।
ওর মা ব্যস্ত হয়ে বললো ওকে আর দেবেন না চকোলেট। সারাদিন ওই খেয়ে যাচ্ছে বমি হয়ে যাবে। আমি ভাবছি,তাহলে কি দেওয়া যায় ওকে?
হঠাৎ আমার মনে হলো মল্লারপুরে বাইনার মোড় থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ কিনে ব্যাগে রেখেছি। খুব ভালো খেতে। গুড়ের অপূর্ব গন্ধ আর মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। তাই নিজে খেয়ে বাড়ির জন্য নিয়ে আসছিলাম। বাড়িতে প্রথমে ঠাকুরকে দেব তারপর প্রসাদ করে সবাই খাবো। সেই প্যাকেটটা বের করলাম। ছেলেটা এর মধ্যেই আমার পাশের সিটে বসে পড়েছে।
- তোমার মোবাইলে কার্টুন আছে?
ওর মা খানিক সঙ্কুচিত কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে যেন বললো, যার হাতেই মোবাইল দেখবে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়বে কার্টুন দেখার জন্য। একে নিয়ে আর পারিনা।
আমার মনে হলো একটা নিষ্পাপ শিশুর যা পাওয়ার কথা সেটা তো ওকেই আমরা, আমাদের সমাজ দিতে পারছি না।পরিবর্তে মা কে সেই বাচ্চা
কে নিয়ে বেরোতে হচ্ছে ফেরি করে জিনিস বিক্রি করতে। এ লজ্জা তো আমাদের সমাজের! যাহোক, ওকে একটা কার্টুন চালিয়ে দিলাম। আর প্যাকেট টা খুলে ওর সামনে ধরলাম। কি আনন্দ করে পরপর চারটে সন্দেশ খেয়ে নিল। অমন আনন্দ আর মুখ নাচিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেতে দেখে আমার মনটা খুশিতে কানায় কানায় ভরে গেল।এমন মায়া ভরা হাসি মুখ দেখলে কেটে যায় সব ক্লান্তি, বেড়ে যায় বাঁচার আনন্দ!সুখী হওয়ার এত শর্টকাট উপায় থাকতেও আমরা তা অবলম্বন করিনা কেন? মায়ের হাতেও দিলাম দুটো। আমিও একটা নিলাম ওদের সাথে সাথ দিতে। মা বললো ছেলেটাকে দুধ কিনে দিতে পারছে না, বেচাকেনা একদম ভালো নেই। সুখী হওয়ার লোভ ততক্ষনে আমাকেও পেয়ে বসেছে। ব্যাগ থেকে যথাসাধ্য বের করে তার হাতে দিলাম। বললাম দুধ আর মাছ কিনে দেবেন। আমার ছেলেটা যে মাছ বড় ভালোবাসে, সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। এবার পনেরো মিনিটের কার্টুন দেখার ইতি হলো। মায়ের তাগাদা - এই এবার চল। দিয়ে দে কাকুকে মোবাইল। ছেলের কাতর মিনতি মা আর একটু থাকি না। কাকুটা খুব ভালো। বিশ্বাস করুন জীবনে অনেকবার শুনেছি 'ভালো' এই কথাটা। কিন্তু এমন সুন্দর করে সার্টিফিকেট তো কেউ দেয়নি !
মা টেনে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। কিন্তু আমি মনে রেখে দিলাম স্মৃতিটা। থাকলো ঈশ্বরের প্রতি কিছু অভিযোগও। তুমি মঙ্গলময় ,কিন্তু ওই ছেলেটাকে রাস্তায় বের করে কার কি মঙ্গল হচ্ছে ?আমাদের সকলকে দুঃখ দিও, কষ্ট দিও, পরীক্ষা নিও কিন্তু কোন শিশুকে এই কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন দাঁড় করিও না প্রভু। তোমার দেওয়া কষ্ট সইতে পারবো কিন্তু বাচ্চাদের এই কষ্ট যে অসহনীয়।এই সব ভাবনার ভিড়ে আনন্দের মাঝেও চোখ ঠেলে জল যেন বেগে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। চলন্ত ট্রেনের জানলার দিকে তাকিয়ে নিবৃত করলাম নিজেকে।মনে হলো আমার ঠাকুরের জন্য বয়ে নিয়ে আসা সন্দেশ ঠাকুর নিজে শিশু বেশে এসে খেয়ে গেল।
-- কৌশিক চৌধুরী--