Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
গঙ্গানগর বাস টার্মিনাসে নিষিদ্ধ ড্রাগের ব্রিফকেস সমেত ধরা পড়া লোকটার কাছে থেকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং পরবর্তীতে জেরা করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেলো। এই লাইনে নতুন যোগদান করা কিছুটা দুর্বল-চিত্তের লোকটার পুলিশি জেরার মুখে ভেঙে পড়তে খুব বেশী সময় লাগলো না। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে নারকোটিক্স বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগের ক্রাইম-ব্রাঞ্চ যৌথভাবে স্পেশাল অপারেশন চালিয়ে দু'দিনের মধ্যেই গঙ্গানগরে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে ওঠা অনামী এক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার বেনামী গ্যাংয়ের অনেক সদস্যকেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলো এবং প্রচুর পরিমাণে কোকেন-হেরোইন সম্বলিত নিষিদ্ধ ড্রাগ উদ্ধার হলো। তবে এই নিষিদ্ধ ড্রাগ র‍্যাকেটের যিনি সর্বময় কর্তা অর্থাৎ সবার উপরে যিনি আছেন তার নাম সরকারিভাবে এখনো জানতে পারেনি পুলিশ। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাটির কর্ণধারকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তবে সিনিয়র ইন্সপেক্টর মিস্টার গোস্বামীর ধারণা উপর থেকে ক্রমাগত চাপ না এলে (যেটা ইতিমধ্যেই আসতে শুরু হয়ে গিয়েছে) কান টানলে খুব তাড়াতাড়ি মাথাও আসবে।

"আপনি শুধু আপনার ওই বন্ধুটিকে চব্বিশ ঘন্টার জন্য লকআপে রাখুন। ব্যাস .. তার মধ্যেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে আমাদের। একবার শুধু রেলপাড়ের বস্তিটা আমাদের দখলে চলে আসুক, তারপর আপনার প্রত্যেকটি ডিমান্ড মেটানোর দায়িত্ব আমার। ওই শালা বুড়োভাম সিনিয়র ইন্সপেক্টর গোস্বামীর বিদায় ঘন্টা আমার হাতেই বাজবে .. চিন্তা করবেন না। মিউনিসিপাল হসপিটালের সুপারেনটেনডেন্ট ডক্টর দাশগুপ্তর ট্রান্সফার যেমন আমরা করিয়েছি, তেমনই এখান থেকে ওই ইন্সপেক্টরের বদলি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।" আজ দুপুরে কামরাজের অফিসের চেম্বারে হঠাৎ করেই জরুরি তলব পাওয়ার পর, তারপর সেখানে গিয়ে তার মুখে কথাগুলো শুনে প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলো সন্দীপ।

তারপর কিছুটা উৎকণ্ঠার সঙ্গে কামরাজকে সন্দীপ বলেছিলো "কিন্তু এইভাবে বিনা কেসে অনির্বাণকে লকআপে রাখা শুধু মুশকিলই নয়, প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এতদিনে বুঝে গিয়েছি ও হলো ওই বস্তির বেতাজ বাদশা। ওর উপর অন্যায় হলে থানা ভাঙচুর হয়ে যাবে, এমনকি আমার উপরেও বিপদ নেমে আসতে পারে।"

"আপনি সত্যিই এখনো অনেকে ইম'ম্যাচিওর আছেন সন্দীপ বাবু। এত ভয় নিয়ে পুলিশের চাকরি করতে এসেছেন? একটা কথা ভেবে দেখুন, ও হলো আপনার পথের কাঁটা। সে আপনার পরিবারের সঙ্গে ওদের পরিবারের যতই আগের থেকে কথা হয়ে থাকুক না কেনো, আপনার বন্ধুটিকে সরাতে না পারলে হিয়া ম্যাডামকে কোনোদিনও পাবেন না আপনি। একটা কথা মাথার ভেতর ঢুকিয়ে নিন, ওরা দু'জন দু'জনকে ভালোবাসে। আপনাকে হিয়া ম্যাডাম ঘৃণা করে .. হ্যাঁ ঠিক বলছি .. শুধু ঘৃণা ঘৃণা আর ঘৃণা। কোনোদিন ওকে আপনি পাবেন না। আর হিয়া ম্যাডামের আপনার প্রতি এই ঘৃণা কে তৈরি করেছে জানেন? আপনার ওই বন্ধুটি .. অনির্বাণ।" হাসতে হাসতে অবলীলায় কথাগুলো বলে চললো কামরাজ।

রাগে, ক্ষোভে, হিংসায় চোখ দুটো জ্বলে উঠলো সন্দীপের। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠলো তার চোয়াল, কপালের দুই পাশের শিরাদুটো দপদপ করতে শুরু করলো, "কিন্তু অ্যারেস্ট করার জন্য তো একটা .. মানে আমি বলতে চাইছি .."

"আরে থামুন থামুন ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত। আমি কি আর হোমওয়ার্ক না করে কথাগুলো বলছি! সব খবর থাকে আমার কাছে। রাধা ‌.. আমাদের রাধা হবে আপনার বন্ধু কৃষ্ণ কানাইয়ার জেলে যাওয়ার কারণ। বুঝলেন কিছু?" অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো কামরাজ।

"রাধা? হু ইজ শি? এইরকম কোনো নাম তো আমি আগে শুনিনি! তাছাড়া কৃষ্ণ কানাইয়া .. সে আবার কে? এতক্ষণ তো অনির্বাণকে নিয়ে কথা হচ্ছিলো, এর মধ্যে আবার কৃষ্ণ এলো কোথা থেকে?" কিছুটা অসহিষ্ণু ভাবেই কথাগুলো বললো সন্দীপ।

"হাহাহাহা .. আমার লেভেলে পৌঁছতে এখনো অনেক দেরি আছে আপনার .. সেটাই পরীক্ষা করছিলাম। ঠিক আছে ঠিক আছে আপনাকে আর ধাঁধার মধ্যে রাখবো না। কিষাণজি হলো আপনার বন্ধু অনির্বাণ। আর রাধা? যে আপনার বন্ধু কিষানজিকে কোনোদিন নিজের করে পাবে না জেনেও, তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। কে? বুঝতে পারলেন না তো! টগর .. জো লাড়কি ওইদিন আপনাকে আচ্ছা করে রগড়ে দিলো .. ভুলে গেলেন এর মধ্যেই তার কথা? ইচ্ছে করে না ওকে শাস্তি দিতে? ইচ্ছা করে না হিয়া ম্যাডামের থেকে আপনি এখনো পর্যন্ত যা পাননি, তার বদলে ওই মেয়েটার মধ্যে দিয়ে নিজের কাম চরিতার্থ করতে? ভেবে দেখুন .. খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। এতে কিন্তু এক ঢিলে দুই পাখি খতম হবে। মেয়েটাকে তোলার দায়িত্ব আমার। তারপর নিজের কাম খতম করবেন আপনি। একবার যদি ওই অনির্বাণকে রেপ আর মার্ডারের কেসে অ্যারেস্ট করিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে শুধু চব্বিশ ঘন্টা কেনো! জীবনেও জেল থেকে বের হতে পারবে না আপনার ওই গুণধর বন্ধু। বস্তি আমার আর হিয়া ম্যাডাম আপনার। এবার বলুন প্ল্যানটা কি রকম সাজিয়েছি .. আপনি রাজি তো?" সন্দীপের চোখে চোখ রেখে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো কামরাজ।

"রাজি .. আমি রাজি .." মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো সন্দীপের।

★★★★ 

শিউলি একটু বেশি বয়সের সন্তান স্বপন সাধুখাঁর। দিদি টগরের সঙ্গে ওর বয়সের পার্থক্য প্রায় তেরো বছরের। মেয়েটা হতে গিয়েই তো অপারেশন টেবিলে না ফেরার দেশে চলে যায় স্বপনবাবুর স্ত্রী। সেইদিন থেকে রেলপাড়ের বস্তির মুদিখানার দোকানদার স্বপনবাবুর দুই চোখের বিষ ওই শিউলি। "জন্মেই নিজের মা'কে খেয়ে নিলি সর্বনাশী?" এই কথাটা বলে সেদিন মিউনিসিপাল হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলো স্বপন সাধুখাঁ আর ওইমুখো হয়নি। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বরফ হয়তো কিছুটা গলেছে ঠিকই, বাড়িতেও স্থান হয়েছে শিউলির। কিন্তু কনিষ্ঠা কন্যার প্রতি তার পিতার মানসিক অবস্থানের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। আজও শিউলি তার বাবার কাছে ব্রাত্য। দিদি টগরের কাছেই মানুষ হয়েছে সে। দিদিই তার কাছে বাবা, দিদিই তার কাছে মা .. এমনকি 'শিউলি' নামকরণটাও তার দিদির করা।

আজ সন্ধ্যে থেকে কেঁদেই চলেছে শিউলি। ক'দিন ধরে কি যে হচ্ছে মেয়েটার .. এমন প্রবল পেটের যন্ত্রণা .. বিছানায় ছটফট করছে। ছ'য় পেরিয়ে সবে সাতে পড়েছে শিউলি। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত বাড়তে লাগলো, কিন্তু যন্ত্রণা যে ক্রমশ বেড়েই চলেছে মেয়েটার। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো .. টগর জেগেই বসেছিলো। এত রাতে কাছেপিঠে কোনো ওষুধের দোকান খোলা নেই। তার উপর মোবাইলে সফটওয়্যার আপডেট করতে গিয়ে সমস্ত পুরোনো নম্বর মুছে গেছে। তা না হলে তো গোগোল দাদাকেই এতক্ষণে .. ভীষণ অসহায় বোধ করছিলো টগর।

বিপদ আসন্ন .. এটা বুঝতে পেরে সে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে অকাতরে ঘুমোতে থাকা তার বাবাকে ঠেলা দিয়ে বললো "তুমি মানুষ ভালো নয় সেটা আমি জানতাম, কিন্তু এখন যে পুরোপুরি অমানুষে পরিণত হয়েছো সেটা আজ বুঝতে পারছি। নিজের মেয়ে যন্ত্রণায় পাশের ঘরে কাতরাচ্ছে আর তুমি নাক ডেকে ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছ? ওর কি দোষ বলো? তোমরাই তো ওকে এই পৃথিবীতে আনতে গিয়েছিলে .. হ্যাঁ মানছি, ওকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু সেই রাগে তুমি তোমার নিজের মেয়েকে আজও কষ্ট দিয়ে চলেছো? আজকে যদি বোনের কিছু হয়ে যায়, তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন। কোনোদিন ক্ষমা করবো না তোমাকে।"

এই পৃথিবীতে একমাত্র তার বড় মেয়েকেই যমের মতো ভয় পায় স্বপন সাধুখাঁ। তাই মেয়ের কথার ঝাঁঝেই হোক কিংবা হঠাৎ করে বোধদয় হওয়াতেই হোক একমুখ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে পাশের ঘরে গিয়ে তার ছোট মেয়ের মুখের দিকে তাকাতেই রাগটা নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গিয়ে ভেতরে ভেতরে সৃষ্টি হলো একটা অদ্ভুত উৎকণ্ঠার। আলনা থেকে একটা হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে স্বপনবাবু সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। 'হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে মেয়েটাকে। কিন্তু তাদের বাড়িটা রেলপাড়ের একদম পশ্চিম প্রান্তে, এখান থেকে মিউনিসিপাল হসপিটাল অনেকটা পথ। কিন্তু তার মেয়ে তো এমত অবস্থায় হেঁটে যেতে পারবে না। এত রাতে গাড়ি পাবে কোথায়! তবে কি তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে? তাই যেতে হবে।' এইসব ভাবতে ভাবতে আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গিয়ে কিছু পরে শিউলিকে দু'হাতে চ্যাংদোলা করে বড়ো রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো স্বপন সাধুখাঁ। তার বাবার পিছনে এক পা এক পা করে আসতে থাকলো টগর। এই মধ্যরাতে চারিদিকে জনমানব শূন্য রাস্তায় ঠিক তখনই একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। 

গাড়িটা দেখেই যন্ত্রচালিতের মতো টগর বলে উঠলো "না গো, আমরা যাব না.." ল্যাম্পপোস্টের অল্প আলোয় ড্রাইভারের মুখ ঠিক দেখা গেল না। তবে ভিতর থেকে একটি গম্ভীর গলা ভেসে এলো "মেয়েটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, হাসপাতালে তিন মিনিটে নামিয়ে দেবো। টাকার কথা ভাববেন পরে, আগে মেয়েটাকে বাঁচান।" 

'এই গাড়ির অচেনা ড্রাইভারটি কেনো তাদের সাহায্য করবে? তাছাড়া, সে কি করে জানলো তারা হাসপাতালে যাবে?' এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে, বড় মেয়ের হাত ধরে স্বপনবাবু ধীরে ধীরে উঠে পড়লো গাড়িতে। তৎক্ষণাৎ ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে বেরিয়ে গেলো অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা।

★★★★

হিয়াকে বিবাহ করার অভিসন্ধি নিয়েও ওই মেয়েটিকে প্রথম দেখেই প্রলুব্ধ হয়েছিলাম তার শারীরিক বিভঙ্গের ছটায়। সে আমাকে অজান্তেই আহ্বান করেছিলো তার কিশোরী সৌন্দর্যের জগতে। আমি দেখেছিলাম আলোর উৎসার, দেখেছিলাম সেই আপেল বুকে ধরেছিলো সে। আমার মনে সাধ হয়েছিলো স্বাদ গ্রহণ করার .. তৃষা জেগেছিলো বুকে। কিন্তু সে অপমানে অপমানে ভরিয়ে দিয়েছিল আমাকে .. যেখানে লুকিয়েছিলো শুধু অন্ধকার। আলো, জল, হাওয়া ছিলো তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। সে আমাকে দিয়েছিলো এই পৃথিবীতে নির্বাসন।

সেদিনের পর থেকেই তাকে, বলা ভালো তার নারীত্বকে শেষ করার সংকল্প বুকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে পথ চলা শুরু করেছি অচেনা গন্তব্যে। ভিড়াবো তরী আসমুদ্র হিমাচল পাড়ি দিয়ে। অষ্টপ্রহর পেরিয়ে এক শতাব্দী পর দেখা হলেও আমার প্রতিশোধ অক্ষরে অক্ষরে ফিরিয়ে দেবো স্মৃতিসিক্ত চিরকুটে পুরে। সদ্য যৌবনে পা রাখা তার জন্য ছিলো সুদীপ্ত নগরের বুক জুড়ে আমার হাহাকার , স্পন্দনে ছিলো হৃদপিণ্ডে মেশানো তার বিষাক্ত মধুরতা। বুঝিনি ধবংসের স্তুপে লেগে ছিলো দম বন্ধ করা নিঃশ্বাস। এখন সেই ধবংসের স্তুপে একটা গোলাপ গাছ লাগিয়ে দিয়েছি, শিশিরভেজা পায়ে প্রতিদিন হেঁটে যাই। তার সান্নিধ্য আবছায়া কুহেলিকার সঙ্গে তার নিত্য নতুন বসবাস। শেষ করার আগে তাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দেবো আমার স্মৃতিচারণার ইতি কথায় তাকে ছুঁড়ে ফেলা বাস্তবতা।

ফোনের আওয়াজে ঘোর কাটলো সন্দীপের। কলটা রিসিভ করার পর ওই প্রান্ত থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর "কাজ হয়ে গেছে স্যার .. প্রসাদ সাজিয়ে রাখা আছে .. এখন শুধুমাত্র আপনার আসার অপেক্ষা।"

"ঠিক আছে .. আমি ওখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত ওর গায়ে যদি একটাও আঁচড় লাগে, তাহলে সবকটার হাত কেটে ফেলে দেবো .." এইটুকু বলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সন্দীপ .. তখন মাঝরাত।

★★★★

দুর্ভেদ্য অন্ধকারের বুকে আলোর উৎস বলতে শুধু মধ্য গগনের এক ফালি চাঁদ আর অগণিত নক্ষত্ররাজি। মাঝে মাঝে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো বড় বড় গাছের সারির অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। চার পাশে শুধু অনন্ত অন্ধকার আর মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। কখনো কখনো রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে হায়নার হাসি আর আকাশ কাঁপিয়ে নেকড়ের ডাক ভেসে আসছে। এরকম এক মৃত্যুপুরীর হাত থেকে বাঁচার জন্য মেয়েটি নিজের সমস্ত জীবনী শক্তিকে একত্রিত করে ছুটে চলেছে। তার এখন একটাই লক্ষ্য .. জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোনোরকমে হাইওয়েতে গিয়ে উঠবে। কিন্তু পথের যেন আর শেষ নেই। তার মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে সে শুধু ছুটে চলেছে। এক সময় মেয়েটির মনে হলো তার চলার গতি যেন রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই আর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু থেমে থাকলে তো হবে না, তাকে চলতেই হবে। সে যখন আপ্রাণ চেষ্টা করে সামনের দিকে ছুটে যেতে চাইছে তখন কোথা থেকে যেন একদল বাদুড় তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। মেয়েটি তখন ভয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে গিয়ে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেলো। মেয়েটির ভয়ার্ত কণ্ঠ থেকে শুধু একটা শব্দ উচ্চারিত হলো, "কে?" অন্ধকারের বুক চিরে জঙ্গলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত শুধু এই একটি শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, " কে..... " এই মৃত্যুপুরীতে এইসময় কে আসতে পারে ভেবে মেয়েটি ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে যাকে দেখলো, তাকে দেখে তার মনে হলো ওর হৃদপিন্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার সামনে এক জমাট-বাঁধা ঘন অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে সেই চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকার যখন মানুষের অবয়ব নিতে লাগলো, তখন সে দেখলো তার দিকে দুটো জ্বলন্ত হিংস্র চোখ নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না, ছুটে পালাতে চাইলো, কিন্তু মনে হলো তার পা দুটো যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি মাটির সঙ্গে আটকে রেখেছে।

সেই মেয়েটি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে আজ সবকিছু দিতে হবে ওই দুর্বৃত্তের অধিকারে। তার দুইহাতের বন্ধনে সারারাত কিংবা হয়তো অনির্দিষ্টকাল ধরে চুষতে হবে সেই দুর্বৃত্তের অভিশপ্ত লিঙ্গ। লম্পটের অশ্লীল উরুতে গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের নারীত্ব .. লুন্ঠিত হবে তার সতীত্ব। সেই বিভীষিকাময় সাক্ষাৎ ‌যমরাজরূপী দুর্বৃত্ত তার ওষ্ঠরস পান করবে প্রাণভরে। সেইসব গ্রন্থ, শ্লোক, মুদ্রাযন্ত্র, শিশির, বেহালা, ধান, রাজনীতি, দোয়েলের স্বর, গদ্য-পদ্য, রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ, তার শৈশব, তার কৈশোর, তার যৌবন, তার রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক .. এই সবকিছু আজ যাবে ওই দুর্বৃত্তের অধিকারে।

নিজেকে রক্ষা করার শারীরিক যুদ্ধ থেকে দিকভ্রান্ত হয়ে মেয়েটি একসময় আত্মসমর্পণ করে যৌনতার লেলিহান শিখার কাছে। তার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, ঘর্মাক্ত দেহ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে, কন্ঠে আসে শীৎকার। শুরু হয় পরস্পর বিরোধী ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে জমাট রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, ভালোবাসা চলে যায় দূর থেকে দূরান্তে, হয়তো অনন্তকাল কেটে যায়, যুগ থেকে যুগান্তর .. সব কিছু অতিক্রম করে ফেলে। সেই নারী এখন নদীর গর্ভের মতো, অজানা তার গোপনাঙ্গের গভীরতা, অথচ ঠান্ডা, শুষ্ক, তথাপি কম্পমান। শিশিরে ধুয়েছে তার বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি .. মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা লালচে। মৃত মনন অথচ এখনো পর্যন্ত জাগ্রত এই অপবিত্র দেহে জেগে উঠে মেয়েটি দেখে পরমাণু কিছু নয়, স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখবার সুযোগ হয়েছে। তার হৃদয় গিয়েছে মরে, অথচ হৃদপিণ্ড এখনো বেঁচে রয়েছে স্বপ্নের ঘোরে .. হয়তো আর কিছুক্ষণের জন্য।

 সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিলো, যখন স্বপ্নে বিভোর এক অবয়বের সঙ্গে গলাগলি শুয়ে অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ ঊরু থেকে অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি। নিজের নারীত্বকে সে যখন খুঁজে পেয়েছে, হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছে নিজের নখ, অন্ধকারে হয়তো সেই সুখ ছিলো তার নারীত্বের অন্তরালে। সর্বগ্রাসী মরীচিকাময় যৌনতার কাছে অবশেষে সেই মেয়েটি নিঃশেষে হয়েছে নতজানু। রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা ঊরুর শীৎকার। তার সঙ্গে যন্ত্রচালিতের মতো নিতম্ব দুলিয়ে শারীরিক বিভঙ্গ প্রকাশ করলেও শেষবারের মতো মুক্তি চেয়েছিলো সে এই নারকীয় অবাধ সঙ্গম থেকে।

জীবনের রসদের জ্বালানি ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে তার, অমাবস্যা এখনো রাত্রির পাহারায়। আরও কতো আশা দুঃস্বপ্নের শ্রোতে, আরও কতকাল ধরে অবিরত বয়ে চলে যাবে। বিশ্বাসের ধূসর কণা এখন রক্তিম, রক্তমাখা দেহ তার পথের একধারে। তার শরীরের নিচের এই ধরিত্রী যেন নীরব শ্রোতা, এখন আর আগের মতো গল্প শুনতে চায়না। হতাশ কন্ঠে তার নেই কিঞ্চিতমাত্র সুখ .. তার রক্ত শ্রোতে নতুন কিছুই নেই। মরিচিকার হাতছানি ছাড়া অন্যকিছু বার বার পথ ভুলে পড়ে থাকা পথে দুঃস্বপ্নের অপবিত্র দেহখানি নিয়ে। দু’চোখ বেয়ে অসহ্য যন্ত্রণার আগুন ঝরে .. পাংশুটে রাত, রক্তমাখা চাঁদের দেহে জোৎস্না উধাও, উল্টে পড়ে রোদের বাটি, তার আকাশজুড়ে দুঃস্বপ্নের দালানকোঠা। উঠোনে বিষধর সাপ, অবিশ্বাসের ভীষণ কালো রক্তজবা, লকলকে জিভ, এখন তার সমস্তটাই লখিন্দরের লোহার বাসর। আঙুলগুলো দিয়ে ঝ’রে পড়ছে রঙীন সুবাসিত ফুল, তার পাশে লক্ষ্মী প্যাঁচার ধাতব গলা, তার এখন শঙ্খচিলের কান্নাভেজা দুপুরবেলা, শূন্য খা-খা একাকী মাঠ, ঘাসের ডগায় নীল ফড়িং-এর নিমগ্নতা। তার  হৃদয় শুধু হাহাকারের দু’হাত মেলা চাতক পাখি, তার এখন বুকের ভেতর কবর .. শুধু কবর খোঁড়ার ভারী শব্দ। দু’চোখ বেয়ে সকাল ঝরে, উল্টে পড়ে স্বপ্নবাটি। তার যে এখন নিজের মধ্যে নিজের কফিন, সমস্ত রাত করাতকলের কষ্টধ্বনি। 

এই কিছুক্ষণ আগেও থাকা শরীরের অসচ্ছ যন্ত্রণাগুলো এখন অনেকটাই অবশ হয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারছে না এত শান্তি কোথা থেকে নেমে এলো তার শরীর জুড়ে! অবাক কান্ড একটুও কষ্ট হচ্ছে না শরীরে তার। চোখ দিয়ে জল পড়ছে না গড়িয়ে .. হয়তো বা শুকিয়ে গেছে। স্মৃতির পাতায় চোখ রাখলে এখন আর নিজেকে হেরে যাওয়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে না তার। হয়তো বা অনুভূতিটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে যে .. স্বপ্নরা কি আসবে আজ তার ঘুমে? নিজেকে কেমন যেন একটা যন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। হাসি, কান্না, স্নেহ, মায়ার কোনো‌ স্বাদ সে আর অনুভব করতে পারছে না। আগের মতো আর ভাঙছে না ধৈর্যের বাঁধ। সবকিছুই যেন কিরকম শান্ত .. ঠাণ্ডা। সে শুনেছিলো মৃত্যু যখন এসে দাঁড়ায়
জীবনের দুয়ারে .. সুখ,শান্তি, দুঃখ, কষ্ট .. সবকিছু এই ভাবেই ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার .. দমটা কিরকম যেন আটকে আসছে। এখন একবার যদি তার হাতটা ধরতে পারতো সে। নেই নেই আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই .. এবার তার যাওয়ার পালা। যাওয়ার বেলায় চোখ দুটো খোলাই রইলো তার, শুধু মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো "আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম .."

(ক্রমশ)


ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন

[Image: Animation-resize-gif-f3b601eb23d95beeb4e...911ac0.gif]


Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 12-12-2022, 09:08 PM



Users browsing this thread: