11-12-2022, 08:52 AM
পর্ব-০৯
রুদ্র দৌড়ে এসে লিফটের সুইস চাপতেই প্রায় বন্ধ হওয়া লিফটের দরজা খুলে গেলো। দরজা খুলতেই ভিতরে সে রিয়াকে দেখতে পেলো। বেগুনি রঙের শাড়িতে রিয়াকে সুন্দর লাগছে। শুধু সুন্দর বললে ভুল হবে, রিয়াকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রুদ্র একবার চিন্তা করল সে লিফটে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে৷ কিন্তু সেটা অভদ্রতা দেখায়। তাই সে লিফটের ভেতরই ঢুকলো।
রিয়া লিফটের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তারা কেউ কারো সাথে কথা বলল না তবে তাদের চোখাচোখি হলো। একবার, দুইবার।
শাড়িতে রিয়াকে এর আগে কখনো দেখেনি রুদ্র। রুদ্র বারকয়েক অনিচ্ছা শর্তেও রিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে। সে একবার ভাবলো ভদ্রতার দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? কিন্তু দীর্ঘ দিন তাদের কথা হয় না বিধায় একটা জড়তা কাজ করলো রুদ্রের মধ্যে। সেই ঘটনার পর তাদের সেভাবে যোগাযোগ হয়নি। একবার দুইবার দেখা হলেও, রিয়া সূক্ষভাবে রুদ্রকে এড়িয়ে গেছে। রুদ্র তাতে কিছু মনে করেনি।
রুদ্র নানা কিছু ভেবে যেই সিদ্ধান্ত নিল রিয়াকে জিজ্ঞেস করবে কেমন আছেন। সেই সময়ই লিফটে দরজা খুলে গেলো। তারা দুইজনে চুপচাপ বেড়িয়ে একই পথে হেঁটে যেতে লাগল।
দুইজনকে একসাথে রুমে ঢুকতে দেখে ইরিনা বলল, "কিরে তোরা একসাথে?"
"লিফটে দেখা হয়েছে।" রুদ্র বলল।
"আমি আবার ভাবলাম...!" ইরিনাকে কথা শেষ করতে দিলো না রুদ্র।
"কি ভাবলি? তোর মাথার মধ্যে তো সব উলটা পালটা ভাবনা।"
"রুদ্র, তুই যা-ই বলিস, তোদের কিন্তু সুন্দর মানিয়েছে। একজন শাড়ি, অন্যজন পাঞ্জাবি। দেখে মনে হচ্ছে নতুন জামাই-বউ।" কথাটা বলেই ইরিনা হাসতে শুরু করল।
রিয়া কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। এভাবে রুদ্রের সাথে তার দেখা হবে সে কখনো ভাবেনি। সে অবশ্য শাড়ি তেমন একটা পরে না। আজকে তার একটা প্রেজেন্টেশন আছে বিধায় তাকে শাড়ি পরতে হয়েছে।
রুদ্রও আজ ভীষণ অবাক হয়েছে। রিয়াকে আজই শাড়ি পরে আসতে হলো। এদিকে সেও কি-না আজই পাঞ্জাবি পরেছে।
"আজকে একটা প্রেজেন্টেশন আছে। সেই কারণে শাড়ি পরা।" ইরিনাকে ব্যখ্যা করার বৃথা চেষ্টা করলো রিয়া।
"হ্যাঁ, বুঝছি। আমাকে আর বোঝাতে হবে না।" ইরিনা ঠোঁট বাকিকে দুষ্টুমি ভঙ্গিতে কথাটা বলল।
"কেমন আছিস?" ইরিনা কিছুটা সময় চুপ থেকে প্রশ্নটা করল।
"ভালো।" দুইজনে একই সাথে উত্তর দিলো।
ইরিনা আবার হেসে ফেলল। সে ইচ্ছে করেই এমন ভাবে প্রশ্নটা করেছে যাতে দুইজন একই সাথে উত্তর দেয়।
"তুই কেমন আছিস?" রিয়া জিজ্ঞেস করল।
"দেখছিস না, আমি সুস্থ। কিন্তু ডাক্তারই সেটা বুঝতে চাচ্ছে না। আমাকে ডিসচার্জ করছে না।" ইরিনা হতাশ গলায় বলে গেলো। সে আরো বলল, "এখানে বেশিদিন থাকলে এরপরে আমাকে পাগলাগারদে ভর্তি করতে হবে।" কথাটা বলেই সে খিলখিল করে হেসে দিলো।
"এতো বুঝতে হবে না তোকে। ডাক্তার শখ করে তোকে এখানে রাখেনি। সুস্থ হলে তোকে এখান থেকে বের করে দিবে। তাই আগে ভালো মত সুস্থ হয়ে উঠ।" রুদ্র বলল।
"তাহলে কি আর করা। হাসপাতালেই ঘরসংসার খুলে বসতে হবে এখন।"
"ফাহিমের সাথে দেখা হয়েছে?" রুদ্র হঠাৎ কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জানতে চাইল।
"হ্যাঁ, গতকাল সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে এসেছিল। তুই জানলি কি করে?"
"আমাকে আলিফ বলল। বসুন্ধরায় ওর সাথে আকস্মিক দেখা হয়েছিল ফাহিমের। আলিফ একটা কাজে গিয়েছিল, এদিকে আলিফ গ্রামে যাওয়া সময় লন্সে ওর ফোন চুরি হয়ে যায়। তাই ও ঢাকায় ফিরেই গতকাল ফোন কিনতে গিয়েছিল বসুন্ধরায়।"
"কি বলিস? আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি আলিফ।"
রুদ্র যেটুকু আলিফের কাছ থেকে জেনেছে তার সবটাই ইরিনাকে খুলে বলল। ইরিনা শুনে খানিকটা অবাক হলো। ফাহিম তার এখানে এতোক্ষণ ছিল, একটা বারও তাকে কিছু ভেঙে বলে নি। এদিকে সে কি-না ফাহিমকে ভুল বুঝে রাগ করে ছিলো। ইরিনার এখন নিজের কাজের জন্য নিজের উপর রাগ হলো। সে চাইলেই ফাহিমের সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে পারতো।
"কি হলো, কি ভাবছি এতো?" রুদ্র জানতে চাইল।
"কই কিছু না।" ইরিনা তাৎক্ষণিক উত্তর দিলো।
"নিশ্চয়ই ফাইমের কথা? একদম প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস।"
"কি যে বলিস।"
"কি আর বলবো? যা দেখার নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি।"
"রিয়া, তুই এতো চুপচাপ কেনো?" ইরিনা টপিক পরিবর্তন করার জন্য কথাটা রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল।
"কি বলল? তোরা কথা বলছিস। তাই তোদের মাঝে কথা বলে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।"
"পাগল কোথাকার। এখানে তুই কি অপরিচিত কেউ? আমরা সবাই-ই বন্ধু। আগে কি হয়েছে সে-সব ভুলে যা। বন্ধুদের মধ্যে সামান্য ভুলবোঝাবুঝি হয়েই থাকে। সেটা মনে ধরে রাখতে হয় না। তুই কি বলিস রুদ্র।" রুদ্রকে দিকে ইঙ্গিত করে শেষ কথা বলল ইরিনা।
"হ্যাঁ।" ছোট্ট করে উত্তর দিলো রুদ্র।
"তুই কি এখনো সেটা ধরে বসে আছিস?" রিয়াকে জিজ্ঞেস করল ইরিনা।
রিয়া এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। সে এখানে এই পরিস্থিতি অস্বস্তি বোধ করছে। সেই সাথে সে নার্ভাস। এমনিতেই রুদ্রের সামনে এলে সে কেমন জেনো চুপচাপ হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ দিন পরে সে রুদ্রকে কাছ থেকে এতোটা সময় ধরে দেখছে তাও পাঞ্জাবিতে। তার এখন ইচ্ছে করছে ড্যাবড্যাব চোখে দীর্ঘ সময় রুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু সে তা করতে পারবে না সেটা সে ভালো করে জানে।
"কি হলো। তুই এতো গম্ভীর হয়ে আছিস কেনো?"
ইরিনা আবার জিজ্ঞেস করল।
"কই!" রিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। সে আবার বলল, "ইরিনা, এখন আমি যাই। প্রেজেন্টেশন সময় হয়ে যাচ্ছে।" শেষ কথাটা সে মিথ্যা বলল। সে সময় নিয়ে এখানে এসেছে। তার প্রেজেন্টেশন এখনো ঘন্টা দুই বাকী। কিন্তু সে এখানে এভাবে থাকতে পারছে না। নার্ভাস, সেই সাথে বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে।
"আরে কোথায় যাচ্ছিস। দাঁড়া। রুদ্রও ক্যাম্পাসে যাবে। একসাথে গেলেই হবে।" ইরিনা কথাটা বলে রদ্রের দিলে তাকিয়ে আবার বলল, "তুই কি বলিস রুদ্র?"
"আমার কোনো সমস্যা নেই। হ্যাঁ, আমিও এখন বেড়িয়ে যাবো, রিয়া চাইলে একসাথে যাওয়াই যায়।" রুদ্র বলল।
"তার দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো।" রিয়া বলল।
"এক যাবি মানে?" রিয়ার উত্তরে অপেক্ষা না করে সে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, "কিরে রুদ্র। আমার বেস্টুকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবি না?"
রুদ্র ইরিনাকে না করতে পারলো না। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ার।
ইরিনা বলল, "তাহলে তো হয়েই গেলো। আচ্ছা তাহলে তোরা যা এখন। সময় পেলে পরে আবার আসিস।"
"আচ্ছা। সময় মতো খাওয়া দাওয়া করবি। আর ওষুধ খাবি ঠিক মতো।" রুদ্র বলল।
"আচ্ছা, আচ্ছা। খাবো। তোরা সাবধানে যাস।"
রিয়া এবং রুদ্র বেড়িয়ে গেলো। লিফট দিয়ে নিচে নেমে হাসপাতালে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
"আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি এখান থেকে একাই চলে যেতে পারবো।"
"আমার কেনো কষ্ট হবে? আমি কি আপনাকে কোলে করে নিয়ে যাবো? রিকসাওয়ালা আমাদের নিয়ে যাবে।" রুদ্র পরিবেশটা খানিক সহজ করতে সামান্য রসিকতা করল।
রিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। যে চাচ্ছে রুদ্রের সাথে যেতে, আবার চাচ্ছে না। আসলে, রুদ্রের কথা ভেবে সে চাচ্ছে না। ইরিনার জন্যই হয়তো তার সাথে যেতে রুদ্র রাজি হয়েছে। নিজ ইচ্ছায় রাজি হয়নি। যদি সে এই কারণে বিরক্ত হয়। রিয়া উভয় সংকটে পড়ে গেলো। দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো।
"কি হলো। দাঁড়িয়ে আছেন যে?" রুদ্র বলল।
রিয়া এতোক্ষণ লক্ষ করেনি রুদ্র তাকে আপনি করে বলছে। হঠাৎ খেয়াল করতেই তার সামান্য মন খারাপ হলো। তাহলে রুদ্র কি আসলেই তাকে দূরে ঢেলে দিয়েছে। এখন কি তাকে বন্ধুও ভাবে না? রিয়ার মনে হঠাৎ এই প্রশ্নটা উদয় হলো। সে চাইলেও এটা সে রুদ্রকে জিগ্যেস করতে পারবে না। কিন্তু রুদ্রের মুখে আপনি শুনতে তার ভালো লাগছে না। তুমিই ভালো ছিলো। এই তুমি শোনার জন্য তার দীর্ঘ প্রতিক্ষা করতে হয়েছে। এখন আবার সেই ঘুরেফিরে রুদ্র আপনিতে চলে গেছে। রিয়ার এখন কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
রিয়া মন খারাপ করে নানা কিছু ভাবছিল। এদিকে রুদ্র এর মধ্যে একটা রিকসা ঠিক করে ফেলেছে। সে এখন রিকসা নিয়ে রিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
"আপনি আগে উঠুন।" রুদ্র বলল।
রুদ্রের ভদ্রতায় রিয়া খুশি হলো। কিন্তু সমস্যা হলো রুদ্র যখন তার পাশে বসল। সে প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে গেলো। ক্রমশ ঘামতে থাকল। সে বারবার টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে থাকল। রুদ্র অবশ্য সেসব লক্ষ করল। কিন্তু সে এই নিয়ে কিছু বলল না।
তারা দুইজনে চুপচাপ অনেকটা পথ চলে এসেছে। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। কি দিয়ে কথা শুরু করবে সেটাই কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে হঠাৎ রিয়া বলল, "আমি পানি খাবো।"
রিয়ার আচমকা এই কথায় রুদ্র বিপদে পরে গেলো। সে আশেপাশে তাকালো, কোনো দোকান আছে কি-না দেখার জন্য। কিন্তু কোনো দোকান দেখতে পেলো না। সে বলল, "এখানে আশেপাশে কোনো দোকান দেখছি না।" রিয়াকে কথাটা বলে সে রিকসা মামাকে বলল, "মামা, সামনে কোনো দোকান বাঁধলে রিকসা একটু থামিয়েন।"
পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলো। কোনো দোকান কিংবা চায়ের স্টলও তাদের সামনে পড়লো না। রুদ্র রিয়াকে লক্ষ করেছে, মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে। সে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে।
রিয়া আবার বলল, "প্লিজ, আমি পানি খাবো। আমার ভাল লাগছে না। শরীরটা খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে। খুব পানি পিপাসা পেয়েছে।"
রুদ্র মহা ঝামেলায় পরে গেলো। সে এখন পানি কোথায় পাবে? সে রিয়াকে কিছু বলল না। সে রিকসাওয়ালাকে আবার বলল, "মামা একটু দ্রুত চালান।"
রিকসাওয়ালা রিকসার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিলো। তারা আরো কিছুটা সামনে গিয়ে একটা দোকানের দেখা পেলো। রুদ্র হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে রিকসা থেকে নেমে দোকান থেকে একটা ঠান্ডা পানি কিনে দ্রুত ফিরে এলো। সে পানির বোতলের মুখ খুলে রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। রিয়া ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেকটা পানি খেয়ে ফেলল। রুদ্র রিয়ার দিকে এক সৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পানি খাওয়া অবস্থায় মেয়েটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কি মায়াময় চোখ। চোখের উপর দিয়ে কিছু অবাধ্য চুল এসে ঘামে মুখের সাথে লেগে আছে। কপালে ছোট্ট টিপ। কী ভীষণ সুন্দর। মায়াময়। রুদ্র একমুহূর্তে জন্য মুগ্ধ হলো। সুন্দর কিছু দেখে মানুষ খুশি না হতে পারলে, তার জীবনটাই বৃথা। রুদ্রের মুখে হাসি ফুটে উঠল। অতিরিক্ত সুন্দর কোনো কিছু দেখলে মানুষের মন ভালো হয়ে যায়। তার এই কথাটা মনে পড়লো। সে কোথায় জেনো লেখাটা পড়েছিল। আজ তার সাথেই কথাটা মিলে গেলো।
রিয়ার পানি খাওয়া শেষ হলে সে রুদ্রকে বলল, "আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।"
রিয়ার কথা শুনে রুদ্র ভাবনা থেকে ফিরে এলো। তখন সে অবাক হলো। সে রিয়াকে নিয়ে কি সব ভাবছিলো এতোক্ষণ। রুদ্রের হঠাৎ লজ্জা লাগছে। কিন্তু সে স্বীকার করলো, রিয়াকে এই অবস্থা ভীষণ সুন্দর লাগছে। কোমলপ্রাণ এক মানুষ।
"কেমন লাগছে এখন?" রুদ্র বলল।
"কিছুটা ভালো বোধ করছি।"
"আলহামদুলিল্লাহ।"
"আমরা কি এখানে কিছুটা সময় থামতে পারি?"
তারা রাস্তার পাশে একটা গাছের ছায়ায় নিচে আছে। রিয়া রিকসায় বসা। রুদ্র রাস্তায় তার পাশে দাঁড়িয়ে। রিকসাওয়ালা মামা কিছুটা দূরে রাস্তার পাশে বসে তাদের দুইজনকে দেখছে। সে এরকম যাত্রী আগে কখনো পায়নি। সে তাদের দুইজনকে বেশ খুটিয়ে দেখেছে এতোক্ষণ। দুইজনকে একত্রে ভালো লাগছে। ভালো মানিয়েছে। তার দেখে মনে হয়েছে, এই দুইজন একে অন্যের জন্যই সৃষ্টি। মেয়েটার চোখে ছেলেটার জন্য কী ভীষণ মায়া। এটা তার চোখ এড়িয়ে যায় নি। সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে। তার এই রকম চাহনি চেনা। কারণ তার বিয়ের পরের দিন সে অসুস্থ হয়ে যায়। তখন সে তার বউটার চোখে তার জন্য ঠিক এই রকমই মায়া দেখেছিল। কয়দিনের পরিচয়ে মানুষ এতোটা ভালোবাসতে পারে, সে বিয়ে করার আগে ভাবতেই পারতো না। সেও তার বউটাকে ভীষণ ভালোবাসে। কেউ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসলে তাকে ভালোনাবেসে থাকা যায় না।
রিকসাওয়ালা পাশ দিয়ে তাদের কথা শুনে বলল, "মামা, আপনারা চাইলে এইখানে পাঁচ দশ মিনিট বইসা থাকতে পারেন। আমার কোনো সমস্যা হইবো না। আমি বরং পাশে দোকান থেইক্কা এক কাপ চা খাইয়া আসি।" রিকসাওয়ালা কথাটা বলে চায়ের দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করল।
রুদ্র রিকসার সাথে হালকা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়া বসে আছে সিটে। সেখান থেকে সে রুদ্রকে দেখছে। মুখে খোচাখোচা দাড়ি। জলপাই রঙের একটা পাঞ্জাবি। হাতে ঘড়ি। সে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে। রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে, তার জন্য সে বিরক্ত কি-না। রুদ্রকে দেখা মনে হচ্ছে না সে বিরক্ত। হঠাৎই রিয়ার ভয় একটু কমল। সে এতোক্ষণে ভয়ে ছিল, সে কোনো ভুল করে বসে কি-না। এই মানুষটার সামনে সে আর কোনো ভুল করতে চায় না। এই মানুষটাকে সে দূরে চলে যেতে দিতে চায় না। এই অল্প খানিকটা থাকলেই তার চলবে। এর বেশি তার কিছু চাই না। ভালোবাসায় লোভ করতে নেই। যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
"আমাকে কি আপনি ভয় পান?" রুদ্র না তাকিয়ে রিয়াকে প্রশ্নটা করল।
"না!" এইটুকু বলতে রিয়ার কন্ঠ কেমন কেপে উঠল।
"আপনাকে দেখে সেটা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি খুব নার্ভাস। ভয়ের মধ্যে আছেন। আমাকে ভয় পাওয়া কিছু নেই। আমি খারাপ মানুষ না। আমি যে সম্পূর্ণ ভালো মানুষ সেটাও বলছি না। কিন্তু এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনি অসম্মান বোধ করবেন তেমন কিছুই করবো না আমি। এছাড়া আমি বাঘ ও না, ভাল্লুক ও না যে আমাকে দেখে এতো ভয় পেতে হবে।"
"আমি সেটা বোঝাতে চাই নি। আসলে...!"
"সমস্যা নেই। আমিও সেটা বলতে চাই না। কিন্তু এবার একটু স্বাভাবিক হলে ভালো হয়। এছাড়া আমরা-তো বন্ধুই।"
রুদ্রের শেষ কথটা শুনে রিয়ার ভালো লাগল। সে মারাত্মক খুশি হয়েছে। তার মুখ ঝলমলিয়ে উঠল মুহুর্তেই। রুদ্র তাহলে তাকে পর করে দেয় নি। রিয়ার এখন অনেক ভালো লাগছে। তার মনে হচ্ছে তার বুক থেকে একটা ভাড়ী পাথর নেমে গেছে। সে এখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে।
"এখন আমরা কি যেতে পারি? আপনার-তো আবার প্রেজেন্টেশন আছে।"
রুদ্রের মুখে প্রেজেন্টেশনের কথা শুনে তার মনে পড়ে গেলো। সে এতোক্ষণে ভুলেই গেছিল এই ব্যাপারটা। সে বলল, "হ্যাঁ, এখন যাওয়া যায়।"
রুদ্র রিকসাওয়ালাকে ডেকে তাকে যেতে বলল। রিকসাওয়ালা রিকসা চালাতে চালাতে দুই একটা কথা বললো তাদের সাথে। সে-ও তার কথা জানালো। তার বউ'য়ের কথা। সে বাবা হতে যাচ্ছে, এই কথাটা আনন্দের সাথে শেয়ার করল। রিয়া এবং রুদ্রের সেইসব কথা শুনতে খারাপ লাগল না। তারাও আগ্রহ নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করলো তাকে।
রিকসা থেকে নেমে রিকসাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে রুদ্র বলল, 'শুনুন, আমি আপনার উপর রেগে নেই। আপনি নিজে নিজে ভেবে বসে থাকবেন না যে আমি রেগে আছি।"
"ধন্যবাদ।" রিয়া হাসি জড়ানো মুখে বলল। রুদ্রের এইটুকু কথা তার জন্য অনেক।
এতোক্ষণ পরে মেয়েটার মুখে হাসি দেখে রুদ্রের ভালো লাগল। এতো সুন্দর হাসিটা কি-না সে এতক্ষণ নিজের মধ্যে রেখে গুরুগম্ভীর করে রেখেছিল মুখখানা। রুদ্র বলল, "আচ্ছা, আজ চলি। আপনার প্রেজেন্টেশনের জন্য শুভ কামনা।"
"আবারো ধন্যবাদ। অন্য কোনো সময় দেখা হবে।" শেষ কথাটা রিয়া হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।
"অবশ্যই। কোনো সমস্যা নেই।" রুদ্র বলল।
রিয়া মুখে হাসি নিয়েই চলে গেলো। রুদ্র কিছুটা সময় রিয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার হাসিটাও সুন্দর। সে আজ কতবার মেয়েটাকে মনে মনে সুন্দর বলেছে তার হিসাব নেই। সুন্দরকে সুন্দর বলা দোষের কিছু না!
সময় দ্রুত অতিবাহিত হতে থাকল। আজ বৃহস্পতিবার। কাল ক্যাম্পাস বন্ধ। হাতে কিছু কাজ জমে আছে, সে সেগুলো কাল করবে বলে ঠিক করলো রুদ্র।
ক্লাস করতে করতে রুদ্র নানা কথা ভাবছিল। ক্লাসে তার মনোযোগ নেই। ক্লাস শেষ হতেই সে বন্ধুদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে এলো।
বাসায় ফিরতেই জাহানারা তাকে জানালো, "রুদ্র, গতকাল তোর নামে একটা চিঠি এসেছে।"
"কখন এসেছে?"
"গতকাল সন্ধ্যায়। আমি বাসায় ফিরছিলাম ঠিক তখনই।"
"সেই কথা তুমি আজ জানাচ্ছো আমাকে?"
"নানা কাজে ভুলে গেছিলাম বাবা।"
"কে পাঠিয়েছে?"
"তরু নামের কেউ। আগেও কয়েকবার মেয়েটার কাছ থেকে চিঠি এসেছে। কে রে মেয়েটা? প্রায়ই কি তোকে চিঠি পাঠায়?"
"পুরনো এক ফ্রেন্ড, মা। চিঠিটা কোথায় রেখেছ তুমি?"
"আমার রুমে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে, গিয়ে সেখানে দেখ বাবা।"
রুদ্র আর কিছু না বলে দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে চিঠিটা নিয়ে তার নিজের রুমে চলে এলো। দীর্ঘ দেড় মাস পরে তরুর চিঠি এসেছে। তার দীর্ঘ অপেক্ষা আজ সমাপ্তি হয়েছে। চিঠিটা হাতে নিতেই তার বুকটা খুশিতে ভরে উঠেছে। ঠোঁট হাসিটা লেগে আছে। সেই সাথে সম্পূর্ণ মুখেও। সে আজ খুশি। অনেক খুশি। অনেক দিন পর তার এতোটা ভালো অনুভূতি হচ্ছে। তরুর চিঠিগুলো তার কাছে নেশার মত। এগুলো ছাড়া তার বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠে। সে এতোদিন নামমাত্রে বেঁচে ছিলো। যে বেঁচে থাকা অর্থহীন।
চলবে...!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)