Thread Rating:
  • 30 Vote(s) - 2.63 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
নাম না জানা এক সম্পর্কের গল্প (দেয়ালের ওপারে)
#25
 
পর্ব -০৮




 

        জানালার পাশের আম গাছটাতে দুইটা পাখি বসে আছে। তারা বিকাল বিলাস করছে। মাঝেমধ্যে গুনগুন করে গানও গাইছে৷ ইরিনা অনেকটা সময় শুয়ে পাখি দুটোকে দেখছে৷ কারণ এছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। সে চাইলেও শোয়া থেকে উঠে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে না। 

        পাখি দুটোকে দেখে দুই-একবার ফাহিমের কথা মনে পড়েছে তার। ফাহিমের কথা মনে পড়তেই প্রচন্ড রাগ অনুভব করেছে সে। আস্ত একটা ইডিয়েট। এতোদিন হয়ে গেলো কোনো খোঁজ নেই। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। পরক্ষনেই সে বুঝেছে আসলে ভুলটা তারই। জীবনে মাঝেমধ্যে অন্যকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে, নিজেদেরই সারপ্রাইজ হয়ে যেতে হয়। তার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। সে চেয়েছিল কি, আর হলোটা কি? সে এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তার কি এখানে শুয়ে থাকাত কথা? সব দোষ ফাহিমের! 
        এভাবে শুয়ে থাকতে তার একটুও ভাল লাগছে না। সকাল-সন্ধ্যা, সন্ধ্যা-রাত, রাত থেকে আবার সকাল। এভাবে কি সারাক্ষণ শুয়ে থাকা যায়? ইরিনার ভালো লাগছে না। প্রচন্ড একাকিত্ব অনুভব করছে। তার বোরিং লাগছে। 

        ইরিনার বাবা-মা কেউ-ই সারাদিনে কাজের কারণে হাসপাতালে আসতে পারে না। তার ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে তাদের সাথে গল্প করতে। কিন্তু সে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, তার চাওয়ার মত করে সে তার বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাতে পারেনি। তারা সবসময় ব্যস্ত। ছোট থাকতে তার অনেক অভিমান হতো। এখন সেরকমটা হয় না। কিন্তু হাসপাতালে একা একা থাকাটা বড্ড কষ্টের। এই সময়টা অনন্ত তারা পাশে থাকুক এটুকু চায় ইরিনা।

        ইরিনার বাবা-মা দুইজনেই চাকরি করে। তাই তারা আসতে পারে না। কিন্তু রহিমা খালা অবশ্যই তিনবেলা আসে। তার সাথে গল্পগুজব করে। সে খাবার নিয়ে আসে। ইরিনা হাসপাতালে খাবার খেতে পারে না। সে বাসার খাবার ছাড়া অন্য কোনো জায়গার খাবার অতোটা পছন্দ করে না। রহিমা খালা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। সে তাকে খাইয়ে দিয়ে আবার চলে যায়। তখন সে আবার একা হয়ে পড়ে।

        প্রথম দুই-তিন দিন রুদ্র, সাত্যকি, রিয়া সহ অনেকে তার সাথে প্রায়ই দেখা করতে আসতো। খানিকটা সময় থেকে গল্প করত। তার দিনের বোরিং সময়টা কেটে যেতো। পরে অবশ্য দিন যেতে থাকল, সেই সাথে তার বন্ধুদেরও আসা কমতে থাকল। সে অবশ্য বুঝে, সবাই সবার ব্যস্ততা নিয়ে ব্যস্ত। তবুও সে এটুকুতেই খুশি, অনেকে তাকে দেখতে এসেছে।

        এই যে ইরিনাকে দেখতে হাসপাতালে তার অনেক বন্ধু এসেছে। সে জন্য সে সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। যতই হোক, সবাই ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে নিয়ে ভাবে। তার ভালো-মন্দ চিন্তা করে। কিন্তু এই যে অনেকে এসেছে, তবুও সবসময় সে আরেকটা মানুষের আসার জন্য অপেক্ষা করেছে। প্রতিদিন সকালে ভেবেছে, আজ আসবে। কিন্তু রাতে সে হতাশ হয়েছে। সেই মানুষটা না আসার কারণে সে শূন্যতা এবং অপূর্ণতা অনুভব করেছে। বুকের ভেতর অদ্ভুত ভাবে ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে তার। সে এই প্রথম বুঝতে পেরেছে, ফাহিমকে সে যতই পিছে পিছে ঘুরাক, গুরুত্ব না দিক, অবহেলা করুক কিংবা ভালোবাসি না বলুক, সে আসলে তাকেই পছন্দ করে, ভালোবাসে। পরিস্থিতি মানুষকে বুঝতে শেখায়। সেভাবেই এই প্রথম সে ফাহিমের প্রতি তার ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছে। যাকে সে একদমই দেখতে পারতো না, শেষমেশ কি-না তাকেই সে ভালোবাসে? এই বিষয়টা তার কাছে অদ্ভুত লাগে। মানুষ ঠিকই বলে, ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। কখন, কীভাবে, কোথায়, কার প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায় মানুষ তা জানেনা, বুঝতে পারেনা। মানুষ সত্যি বড় অদ্ভুত। 

        আজ বিকালে রুদ্রের আসার কথা। কিন্তু আসে নি। এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আসার সম্ভব নেই। আজকে রিয়াও তাকে দেখতে আসেনি। এই দুইজন না এলে তার মন খারাপ হয়। অভিমান হয়। যতই হোক, ভার্সিটিতে এই দুইজন তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কেউ যদি তার কাছে তার সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় বন্ধুর নাম জানতে চায় তাহলে প্রথম যে দুইটা নাম তার মাথায় আসবে সেটা নিসন্দেহে রিয়া এবং রুদ্র। সে খুব করে চায় রুদ্র এবং রিয়া মধ্যে কিছু একটা হোক। তারা একে অন্যকে ভালোবাসুক। দুইজন সারাজীবন একসাথে থাকুক। সে সবসময় চায়, এই দুইটা মানুষ ভালো থাকুক। হাসিখুশি থাকুক।
        রিয়া রুদ্রকে অসম্ভব ভালোবাসলেও রুদ্র রিয়াকে ভালোবাসে না। এই নিয়ে প্রায় রুদ্রের সাথে তার কথা হয়। প্রথম দিকে সে অনেকটা কনভিন্স করে ফেলেছিল রুদ্রকে। কিন্তু মাঝখান থেকে তরুর চিঠি এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ইরিনার সব প্লান, পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দেয়। এখন তো রুদ্র তরুর ব্যাপারে কোনো কথা শুনতেই চায় না। তার অবশ্য তরুর উপর কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। কিন্তু এভাবে পরিচয় গোপন করে কেনো চিঠি লিখতে হবে? এই একটা জিনিস সে পছন্দ করে না। রুদ্র কষ্ট পাক, সে সেটা চায় না। তাই রুদ্রকে এমন কোনো ভুল করতে দিতে চায় না, যাতে সে কষ্ট পাবে ভবিষ্যতে।

        প্রথম দিকে রুদ্র একবার বলেছিল ইরিনাকে, "জানিন ইরিনা, তরু চিঠিগুলো আমাকে ভেবে পাঠাচ্ছে না। চিঠিতে লেখা কথাগুলো আমার সাথে অনেকটা মিললেও বাকী অর্ধেক মিলে না। আমার কি মনে হয় জানিস, ভুল বশতা আমার কাছে চলে আসছে চিঠিগুলো। হয়তো ঠিকানায় কোনো গোলমাল হয়েছে। কিন্তু মেয়েটা কি সুন্দর করে চিঠি লিখে। কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। আর সবচেয়ে সুন্দর ওর হাতের লেখা। কেউ কি করে এতো সুন্দর করে লিখতে পারে? হ্যাঁ, পারে। কেউ এটা আগে বললে আমি বিশ্বাস করতা না। মানুষটা দেখতে কেমন হবে? যে এতো সুন্দর চিঠি লিখে, এতো সুন্দর করে কথা বলে, এতো সুন্দর করে কাউকে ভালোবাসে। সেই মানুষটা কেমন? তুই কল্পনা করে দেখ? ইরিনা, এই রকম একটা মানুষকে ভালোবাসতে তাকে দেখার প্রয়োজন হয় না। না দেখেই বোঝা যায় মানুষটা কেমন।" 

        অবশ্য রুদ্র প্রথম দিকে ইরিনাকে এই কথাগুলো বলেছিল। তখন সে নিজেই তরুর চিঠি পড়ে মজা পেতো। তার বন্ধুদের পড়ে শোনাতো। এভাবে প্রথম চার পাঁচটা চিঠি সে বন্ধুদের পড়ে শুনিয়েছে। সেই চিঠিগুলো স্বাধারণ ছিলো। তেমন বিশেষ কিছু ছিলো না সেখানে। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে কি হলো, কেউ জানেনা?

         তরুর চিঠির কথা রুদ্র হঠাৎ বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা কমিয়ে দেয়। তরুকে নিয়ে কথা বলা কমিয়ে দেয়। তারচেয়ে বড় ব্যাপার রুদ্র প্রায়ই কোনো একটা ভাবনায় ডুবে থাকে। যত দিন যেতে লাগল, এই সমস্যাটা তত বাড়তে থাকল। রুদ্র দিনদিন সবার থেকে দূরে সরে গেলো। একা একা থাকতে শুরু করল। সে সেই আগের মত রইল না। সবার সাথে হইচই, আড্ডা, দুষ্টুমি, মজা, ঘুরাঘুরি, এই সবকিছু থেকে রুদ্র খানিকটা দূরে সরে যায়। এটা সবাই লক্ষ করলেও এটা নিয়ে এই পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি। কিন্তু পরিস্থিতি যেমনটাই হোক, পরিচয়হীন একটা মেয়ে, নিজেকে আড়ালে রেখে, এভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। এটা ইরিনা পছন্দ করে না। ভালোবাসলে সামনে আসতে দোষ কি? কীসের এতো ভয়? এছাড়া চিঠিগুলো যে এই রুদ্রের জন্যই সেটা কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত না। 

        ইরিনার এইখানেই সবচেয়ে বেশি আপত্তি। তরু যদি রুদ্রকে চিঠি না দেয়। চিঠিতে লেখা তার ভালোবাসা যদি রুদ্রের জন্য না হয়। কাকতালীয় ভাবে যদি অন্য কারো নামের সাথে রুদ্র নামটা মিলে যায়। তাহলে, তাহলে কি হবে? রুদ্র কীভাবে সবকিছু মেনে নিবে? এই চিন্তাটা ইরিনাকে প্রায়ই ভাবায়। যতই হোক, সে রুদ্রের ব্যাপারে অনেকটা যত্নশীল। তেমনি যত্নশীল রিয়ার ব্যাপারে। এই দুইজনের ব্যাপারে সে সবসময় চিন্তিত থাকে। কারণ সে তাদের ভালোবাসে।

        এই রকম একটা মেয়ের কারণে রিয়ার প্রপোজাল ফিরিয়ে দেওয়া কোনো মানে হয়? ইরিনা রুদ্রের এই বোকামিটা মেনে নিতে পারে না। রুদ্র আস্ত একটা গাধা। তা না হলে এমনটা কেউ করে? আসলে আমার আশেপাশে সবাই গাধা। ইরিনা রুদ্রের কথা ভাবছিল। তার মধ্যে হঠাৎ ফাহিমের কথা মনে পড়তেই তার মুখে বিরক্তিকর একটা ভাব ফুটে উঠল। সে এখম ফাহিমের কথা ভাবতে চাচ্ছে না। 

        আম গাছে পাখি দুটো নেই। কোথায় গেছে? ইরিনা এটা নিয়ে ভাবছে। সেই মুহুর্তে মসজিদ থেকে এশার আজান ভেসে এলো। "সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি হাসপাতালে আরো একটা বোরিং দিন কাটিয়ে দিলাম!" ইরিনা এই কথাগুলো ভাবতেই তার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। 

        সে শুয়ে শুয়ে আজান শুনলো। এই মসজিদের মুয়াজ্জিনের কন্ঠটা ভীষণ সুন্দর। এই কয়দিনে তার কন্ঠটা মুখাস্ত হয়ে গেছে। আজান শুনে তার ভাল লাগল। মন জুড়িয়ে গেলো। মন ভালো হয়ে গেলো।

        ইরিনা এতোক্ষণ সত্যি খুব বিরক্ত ছিলো। এখন তার ভালো লাগছে। এই সন্ধ্যাটা তার ভালো লাগছে। সারাদিন অজস্র ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে ক্লান্ত। এটা ছাড়া তার কোনো কাজও নেই। তাই সে ভেবে যায়। কতকিছু ভাবে তার ঠিক নেই। যখন যেটা মনে আসে সে ভাবে। কেউ তার পাশে থাকলে তার সাথে কথা বললে তার এই বোরিং সময়টা কেটে যেতো। তাকে এতো কিছু ভাবতে হতো না। কিন্তু আজ কেউ এলো না!

        "আমি ক্লান্ত।" ইরিনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ঠিক সেই মুহুর্তে দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে দরজার দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো স্থির হয়ে রইল দরজায়। সে ঘনঘন কয়েকবার পলক ফেললো। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা তার মনের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে সারাক্ষণ ফাহিমের কথা ভাবে, তাই হয়তো এই মুহুর্তে সে দরজার সামনে ফাহিমকেই দেখছে। 

        ইরিনা চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারছে না। মানুষ যখন হঠাৎ খুশি হয়ে যায় কিংবা প্রচন্ড রাগ করে তখন সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে না। একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। অবাক-চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। ইরিনার ক্ষেত্র তেমনটা হয়েছে। কিন্তু ফাহিম আসাতে সে কি প্রচন্ড খুশি হয়েছে, নাকি এতোদিন পর আসাতে অভিমান হচ্ছে? ইরিনা সে-সব জানেনা। সে এখন স্বাভাবিক হতে চায়। ফাহিমের সাথে ঝগড়া করতে চায়। তাকে মন ভরে বকতে চায়, মারতে চায়, আবার ভালোবাসতে চায়। এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি? ইরিনা নিজেকেই বুঝছে না। সে তার মনকে বুঝে উঠতে পারছে। এতোদিন একসাথে থেকেও আজ সে সম্পূর্ণ অচেনা। 

        ফাহিম বসে আছে। রুমে একটা চেয়ার ছিলো, সে সেটা টেনে নিয়ে ইরিনার পাশে এসে বসেছে। সে বলল, "কেমন আছিস?"

        ইরিনা কোনো উত্তর দিলো না। সে বুঝে উঠতে পারছে না ফাহিমকে সে তুমি করে বলবে নাকি তুই। তার কেনো সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? ফাহিম কি তাকে দেখে বুঝতে পারছে, যে সে কতটা নার্ভাস? ফাহিমের সামনে আমি কেনো নার্ভাস হচ্ছি? ইরিনার লজ্জা লাগছে। বুকের কম্পন ধীরে ধীরে বাড়ছে। সে লক্ষ করল, ফাহিমকে সুন্দর লাগছে। নীল রঙের একটা শার্ট পরে আছে সে। কী দারুণ লাগছে ছেলেটাকে। কতিদন পর তাকে দেখলাম। ইরিনা কথাগুলো ভাবলো।

        "কিরে কেমন আছি এখন?" ইরিনার কোনো উত্তর না পেয়ে ফাহিম আবার বলল, "রাগ করে আছিস? কথা বলবি না আমার সাথে?" 

        ইরিনা এবারও চুপ। সে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। ফাহিম বলল, "আমি কি অসময়ে এসে তোকে বিরক্ত করলাম? আমার কি চলে যাওয়া উচিত?" 

        "তুই কি মনে করিস? চলে যাওয়া উচিত নাকি কিছুক্ষণ থাকা উচিত?" অবশেষে ইরিনা বলল। 
        "আমি কি মনে করবো? তুই যেটাতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করিস আমি সেটাই করবো।"
        "কেনো তোর নিজের কোনো ইচ্ছে নেই?"
        "আমার আবার কি ইচ্ছে। আমি চাইলেই কি জোর করে কিছু করতে পারবো?" 
        "কিছুই করতে পারবি না? 
        "আসলে জোর করে কিছুই করা যায় না। কোনো কোনো সময় কিছু করতে গেলে সেটা আরো নষ্ট হয়ে যায়।" 
        "বাহ! ভালোই কথা শিখেছিস এই কয়দিনে।"
        "সময় মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়।"
        "হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তা সময় তোকে ঠিক কি কি শেখালো?"
        "বাদ দে এ-সব কথা। এখন বল, কেমন আছিস?" 
        "দেখতেই তো পারছিস কেমন আছি? জিজ্ঞেস করার কি আছে? নাকি ভদ্রতার দেখাচ্ছিস?"
        "তোর কাছে যেটা মনে হয় সেটাই।" 

        ইরিনা কিছুটা সময় নিয়ে বলল, "হঠাৎ কি মনে করে এদিকে আসা হলো?" 
        "কেনো, এখানে আমার আসা কি বারণ ছিলো? আমি অবশ্য জানিনা। জানলে হয়তো এসে তোকে বিরক্ত করতাম না।"
        "আমি সেটা বলিনি? এতোদিন পর হঠাৎ কেনো?
        "সরাসরি জিগ্যেস করতেই তো পারিস, এতোদিন কোথায় ছিলাম, কেনো খোঁজ নেই, ফোন কেনো বন্ধ? তাহলে এতো জটিল করছিস কেনো কথোপকথন?" 

        ফাহিমের কথাটা শুনে মন খারাপ হলো ইরিনার। সে বলল, "এখন থেকে দ্রুত যেতে পারলেই কি খুশি?"
        "আমি সেটা বুঝাইনি।"
        "দ্রুত কথোপকথন শেষ করার কথা তো বুঝিয়েছিস?"
        "আচ্ছা, আমরা কেনো একে অন্যের কথায় ভুল ধরছি? এতোদিন পর দেখা, ভালো করে কথা বলবো তা না শুধু একে অন্যকে কথার মারপেঁচে ফেলে দিচ্ছি। মনে হচ্ছে এই কয়দিনে আমাদের মাঝে অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই আগের মত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছি না।" 

        ইরিনা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কথাগুলো শুনে সে হাসল। কেমন উদ্ভট সেই হাসি। ফাহিম বুঝলো না এই হাসির অর্থ কি। ইরিনা বলল, "ফাহিম, আসলে দূরত্ব বলতে কিছুই নেই। সবটাই মানুষের মনের কল্পনা। আমরা নিজেরাই মনে মনে সবটা ভেবে নেই। এখানে, কেউ ভেবে নেয় দূরত্ব বেড়েছে, কেউ ভেবে নেয় দূরত্ব কমেছে। তারপর যখন দু'জনের ভাবনায় বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়। তখন দুইজন আলাদা হয়ে যায়। আসলে এখানে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, যে সময় একজন আরেকজনকে বুঝতে ব্যর্থ হয় তখন তারা নিজের মত করে ভেবে উপসংহার টেনে দেয়।" 

        ফাহিম কিছু একটা ভাবছে। হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে ঘরের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। জানালার বাইরে একটা বড় আম গাছ। এখন সেখানে দুইটা পাখি বসে আছে। ফাহিম সেই পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। সে কতকিছু বলবে বলে এখানে এসেছিল। সারা পথ সব কথা মনের মধ্যে সাজাতে সাজাতে এসেছে। কিন্তু এখানে এসে সে সেই সব কথার মধ্যে একটা কথা বলতে পারে নি। সে অনেককিছু বলতে চায় ইরিনাকে। কীভাবে বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না। 

        এতোক্ষণ ফাহিমের দিলে তাকিয়ে ছিল ইরিনা। তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে বাইরে তাকাতেই বিকালে যেদুটি পাখিকে সে দেখেছিল, সেই দুটি পাখি সেই একই ডালে একই ভাবে বসে আছে। সে আশ্চর্য হলো। কখন এসেছে পাখি দুটো? 

        "ইরিনা!"
        "হ্যাঁ বল।" 
        "তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?"
        "রেগে থাকবো কেনো? রাগ করার মত তুই কি কিছু করেছিস?"
        "হ্যাঁ, করেছি। এই সে আমি এভাবে কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম। ফোনটা বন্ধ করে রাখলাম। কেউ খুঁজে পেলো না। সবাইকে অযথাই চিন্তায় ফেলে দিলাম। তোর খবর নিলাম না। তোকে দেখতে আসতে এতোটা দেরি করে ফেললাম। আমার উপর রাগ করাটা স্বাভাবিক। প্লিজ তুই রাগ কর। রাগ করে আগের মত আমাকে বকাঝকার কর। কিন্তু প্লিজ, একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর। এই তোকে আমি ঠিক বুঝ উঠতে পারছি না। কেমন অচেনা লাগছে।"

        "একটা মানুষের সাথে সারাজীবন থেকেও কেউ কাউকে সম্পূর্ণ ভাবে চিনে উঠতে পারে না। আর আমাদের এই কয়দিনের বন্ধুত্বে কি সেটা সম্ভব?"
        "তুই ভুল। মানুষকে বুঝতে, চিনতে সারাজীবন লাগে না যদি তারা মন থেকে একে অন্যকে বুঝতে চায়, চিনতে চায়। আর যদি তারা মন থেকেই সেটা না চায় তাহলে সাত জনমেও কেউ কাউকে চিনে উঠতে পারবে না।" 

        ইরিনা কিছু বলল না। ফাহিম ঠিকই বলেছে। যদি দুইজন দুইজনকে মন থেকেই ভালোবাসে তাহলে এক মুহুর্তেও একে অন্যকে সম্পূর্ণটা চিনে ফেলা যায়। ইরিনা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, "জানালার বাইরে আম গাছে দুটো পাখি বসে আছে, দেখছিস?"
        "হ্যাঁ, দেখেছি।"
        "পাখি দুটোকে প্রায়ই ওখানে বসে থাকতে দেখি।" ইরিনা এটুকু বলে থামলো। ফাহিম জানে, ইরিনার কথা শেষ হয় নি। সে অন্য কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। তাই সে চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকল ইরিনার মূল কথাটা শোনার জন্য। 

        "তোকে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম, দেখেছিস?"
        "কি মেসেজ? কি লিখেছিলি?" 

        "ফাহিম তাহলে মেসেজ দেখেনি" ইরিনা মনে মনে বলল। সে বলল, "না, তেমন কিছু না।" 
        "আসলে হয়েছে কি..!" এটুকু বলতেই দরজা খোলার শব্দ শুনে দুজনেই দরজার দিকে তাকালো। ফাহিম তার কথা শেষ করতে পারলো না। 

        দরজা দিয়ে ইরিনার মা নাহার ঢুকল। সে খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। তার দিকে তার মেয়ে এবং জানালার কাছে থাকা ছেলেটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে সে চেনার চেষ্টা করল। তাকে খাটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। এই কয়দিনে ইরিনার প্রায় অনেক বন্ধুদের সাথে তার দেখা হয়েছে। ইরিনাকে দেখতে অনেকে এসেছে, সেই সুত্রে। ছেলেটাকে সে চিনল না। নাহার নিশ্চিত সে আগে কখনো এই ছেলেটাকে দেখে নি। 

        "আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।" ফাহিম বলল। 
        "ওয়ালাইকুম আসসালাম।" নাহার সালামের উত্তর দিলো। 
        "আমি ফাহিম। ইরিনার বন্ধু। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি।" 
        "ওহ, আচ্ছা।" নাহার এটুকু বলে ইরিনার দিকে এগিয়ে গেলো। 

        নাহার ব্যস্ততা হয়ে পড়লো ইরিনার খোঁজ খবর নিতে। ইরিনার সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছে সে। হঠাৎ ফাহিম বলল, "আন্টি, আজ আমি আসি।" 

        নাহারকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। ফাহিম আবার বলল, "ইরিনা, তাহলে আজ আমি যাই। অন্য কোনো সময় এসে আবার দেখা করে যাবো।" 

        "চলে যাবে কেনো। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। সরাসরি অফিস থেকে এসেছি মেয়েটাকে দেখেই বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর আবার আসবো।"
ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে সে এবার ইরিনাকে বলল, "আমি এসে তোমাদের বিরক্ত করলাম না তো?"
        "কি যে বলো আম্মু।" ইরিনা বলল।
        "সমস্যা নেই আন্টি। আমি কাল আরেকবার এসে ইরিনাকে দেখে যাবো। দোয়া রইল। ওর দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। এদিকে ইরিনার ক্লাস মিস যাচ্ছে।" 

        "হ্যাঁ, কিন্তু কি আর করা। মেয়েটা হঠাৎ দূর্ঘটনা ঘটিয়ে নিলো।" নাহার বলল। 
        "আম্মু, তুমি আবার মন খারাপ করছ।" ইরিনা বলল। 

        ফাহিম বাইরে বেরিয়ে এলো। সে কি করবে এখন সেটা ভাবছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে সে ভুলে গেছে, ইরিনা মেসেজে তাকে ঠিক কি লিখেছিল? আর কবে মেসেজ দিয়েছিল? এই প্রথম চোরের উপর তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। চোরটাই সবকিছু নষ্টের মূল। চোরকে মনে মনে গালমন্দ করে তার মনে পড়ল সে ফোন কেনার জন্য বেরিয়েছিল। সিমটাও উঠাতে হবে তাকে। 

        সে রিকসা ঠিক করে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স দিকে রওনা করল। যেতে যেতে তার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইরিনা হঠাৎ এভাবে মেসেজের কথা কেনো জিজ্ঞেস করল তাকে? সে কি লিখেছিল সেই মেসেজে? ফাহিম হতাশ হলো। এখন এটা জানার তার কাছে কোনো উপায় নেই। যদি ইরিনা আবার তাকে সেই একই মেসেজটা না দেয় তাহলে সে জানতে পারবে। কিন্তু সে জানে ইরিনা সেই মেসেজটা তাকে আর পাঠাবে না। 
        ফোন চোরের উপর ফাহিমের রাগটা ক্রমত বাড়তে থাকল। সে এখন তাকে সামলে পেলে, কি করতো সেটাই সে মনে মনে ঠিক করছে। 

চলবে.....!
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: নাম না জানা এক সম্পর্কের গল্প (দেয়ালের ওপারে) - by Bangla Golpo - 06-12-2022, 08:59 PM



Users browsing this thread: 17 Guest(s)