03-12-2022, 06:25 PM
শেষ রক্তধারা
© মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা
উৎসর্গ: এই সাইটে আসার প্রথম দিনই যে বন্ধুবর বলে ডাক দিয়েছে সেই পরম সুহৃদ সাহিত্য মহাসূর্য্য বাবানকে
সেই বৎসর, কীরাৎ দেশে সহসা মহামারীর প্রকোপে বিস্তর লোক মরিয়া গেল। মা ত্রিপুরীর কৃপায় যাহারা যমালয়ে যাইতে যাইতে বাঁচিল আমাদিগের অচিন্ত্য তাহাদের একজন। উদয়পুর হইতে প্রাণ বাঁচাইতে অচিন্ত্য তাম্রলিপ্তের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অঙ্গে আসিয়া শুনিল চম্পানদীর দখল লইয়া মগধরাজ ভত্তিয় ও অঙ্গনরেশ ব্রহ্মদত্তের যুদ্ধের কারণে সকল দ্রব্যের দাম বাড়িয়াছে। এই সেদিন অবধি যেখানে এক পানা'তে পাঁচ সের চাউল পাওয়া যাইতে ছিল সেইখানে দেড় ক্ষত্রপানা দিলেও এক সের চাউল পাওয়া যাইতেছে না! সমগ্র চম্পানগরীর বুকে যুদ্ধের করাল গ্রাস থাবা বসাইয়াছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যেইদিকে যাইতেছে তাহাতে বোধ হইতেছে মগধের পরাজয় অনিবার্য্য! নদীবুক পার করিবা নিমিত্ত অচিন্ত্য মাঝি সমীপে গিয়া বাকি যাত্রীসমেত একখানি নৌকা ভাড়া করিল, তথায় দেখিল সকলেই যুদ্ধ লহিয়াই আলোচনা করিতেছে। মাঝি হাল ধরিয়া জলযান বাইতে বাইতে জানাইল, ভত্তিয় হারিয়া গেলে, উঁহার ষোড়শবর্ষীয় পুত্র বিম্বিসার সিংহাসনে বসিবে! বয়স্করা যাহা করিতে পারিতেছে না তাহা এই সেদিনের দুধের দাঁত ভাঙ্গে নাই সে করিয়া দিবে এই আশা মূর্খেও করিবে না! ইহার কেবল একটাই অর্থ হয় মগধ হারিবামাত্র হর্ষঙ্ক বংশের পতন ঘটিবে। নৌকার যাত্রীসকলের মধ্যে ইহা লহিয়া গভীর আলোচনা হইতে লাগিল আর ছাউয়ের ভিতরে এককোণে বসিয়া হাঁটুমধ্যে মুখখানি গুঁজিয়া অচিন্ত্য অনাগত অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে ভাবিতে ম্রিয়মাণ হইতে থাকিল। তাহার এক দূর সম্পর্কের মাতুলালয়ে আশ্রয় লহিবে এই ধারণা তাহার মনোমধ্যে পুষ্ট হইতে ছিল প্রারম্ভে কিন্তু গৌরচণ্ডালী শুনিয়া বুঝিল সে আশা গুড়ে বালি! যুদ্ধকালে কেহ কারো নয়। অচিন্ত্যের অন্তরে বাঁচিয়া থাকিবার আশা লম্ফের বাতির ন্যায় একবার নিভুনিভু হইতেছে পরক্ষণেই পুনরায় জ্বলিতেছে। মাঝি ফের বুঝাইল অঙ্গদেশে হউক আর মগধাঞ্চল হউক যুবা সুঠাম চেহারার পুরুষ দেখিলেই প্রহরী পাকড়াও করিতেছে আর ঢাল আর তরোয়াল ধরাইয়া শত্রুসম্মুখে নিধনহেতু পাঠাইয়া দিতেছে। অচিন্ত্য শুনিয়া ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। মাঝি অবশ্য আশ্বাস দিতেছিল কোনক্রমে যদি বৃজি কেহ যাইতে পারে তবে সমস্যা নাই, অবন্তী বা কোশলও যাওয়া যাইতে পারে! যাত্রীদিগের একজন আপত্তি তুলিল, কোশলের রাজপুত্র প্রসেনজিৎ অঙ্গ-মগধ কাহাকেও পছন্দ করেন নাই, কোশলরাজ বৃদ্ধ হইয়াছেন, তিনি নামেই রাজা, আদতে তাঁহার পুত্র কোশল রাজ্যের দায়ভার সামলাইতেছেন! তবে কাশীগ্রাম যাইতে পারিলে বিশ্বেশ্বরের কৃপায় রক্ষা পাওয়া যাইবে! যাত্রীগণের আলোচনা যেমন যেমন গতিপ্রকৃতি পরিবর্ত্তন করিতেছিল তেমন তেমন অচিন্ত্যের ভাবনাও পরিবর্ত্তিত হইতেছিল! এইখানে সে কাহাকেও জানে না কাহাকেও চিনে না। কীরাৎ দেশেই সে জন্মাবধি রহিয়াছে। কামরূপে দুইএকবার ভ্রমণ হেতু যাইলেও বিদেশ বলিতে ঐটুকুই! সংসার জ্ঞান তাহার তেমন নাই। পুঁটুলীতে সামান্য আতপ চাল আর ঘরের দুইখানি গাছের মর্ত্তমান কলা বান্ধিয়া অচিন্ত্য অচিনদেশে রওনা দিয়াছে আর সেই ইস্তক তাহার তরী টলোমলো হইতেছে! কোন ঘাটে তাহার পার আসিবে সে জানে নাই!
ঘাটে আসিয়া অচিন্ত্য দেখিল বেলা শেষের মুখে। সামনে একখানা বর্ধিষ্ণু গ্রাম দেখা যাইতেছে ঐদিকেই গুটিগুটি পায়ে রওনা দিল।
(অসমাপ্ত)