Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
[Image: Polish-20221130-114456602.jpg]

(৭)

"আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া থুড়ি গোগোলুয়া? হিহিহি .. এবার তোমাকে কে বাঁচাবে আমার হাত থেকে শুনি?" দরজাটা বন্ধ করতে করতে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে উক্তি করলো হিয়া।

"ইশ্ শেষমেষ আমার নামের এই অপভ্রংশ? তা আমাকে আর কে বাঁচাবে? পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। কিন্তু একটা কথা বল .. তুই তখন ওইরকম মহিষাসুরমর্দিনীর রূপ ধারণ করলি যে বড়ো! ভয় করলো না একটুও?" মৃদূস্বরে জিজ্ঞাসা করলো গোগোল।

"ভয়? কিসের ভয়? তুমি ওই মেয়েটার .. কি যেন নাম .. হ্যাঁ, রনিতা .. ওর ইঙ্গিত আর শরীরী ভাষা বুঝতে না পারলেও, একজন মেয়ে হিসেবে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি ওর অভিব্যক্তি। আমার ভালোবাসা যেখানে ডেঞ্জার জোনে আছে, সেখানে সমস্ত ভয়, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আমি ঝাঁপাবো না তো কে ঝাঁপাবে শুনি? তাছাড়া আমার সঙ্গে এইরকম একজন লম্বা-চওড়া মাচোম্যান থাকতে আমার ভয় কেনো করবে?" মুচকি হেসে খুব সহজভাবে উত্তর দিলো হিয়া।

- "আচ্ছা .. বুঝলাম .."

- "মানে টা কি, হ্যাঁ?‌ আমি উনাকে ভালোবাসার কথা বললাম, আর উনি 'আচ্ছা' 'বুঝলাম' এইসব বলে যাচ্ছেন! এই মানুষটার তো কোনো তাপ-উত্তাপ নেই দেখছি। আরে উল্টোদিকের সুন্দরী কোনো নারী যদি ভালবাসার কথা বলে, তবে তার কথার প্রত্যুত্তর ভালোবাসাতেই দিতে হয়। বুঝলে হুঁকোমুখো হ্যাংলা?"

- "ঠিক তো? ভেবে বললি তো কথাটা? তারমানে আমার উল্টোদিকে থাকা যেকোনো সুন্দরী নারী আমাকে ভালোবাসার কথা বললে, আমিও তাহলে প্রত্যুত্তরে তাকে .."

"অসভ্য ছেলে একটা .. এই ছিলো তোমার মনে? জানি তো, আমি তো লক্ষ্য করেছি .. যখন ওই শাকচুন্নিটা তোমার সঙ্গে কথা বলছিলো, তখন একেবারে বিগলিত হয়ে পড়েছিলে তুমি।" এই বলে হাত উঁচিয়ে গোগোলের দিকে তেড়ে এলো হিয়া।

এক দৌড়ে খাটের পেছনে চলে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো "আরে ও আমার থেকে বয়সে দুই বছরের বড়ো .. ওকে আমি ছোটবেলায় দিদি বলতাম আর ও আমাকে ভাই বলতো .."

- "ওটা পাস্ট টেন্স .. এখন যা দিনকাল পড়েছে তাতে ওই ধরনের ঢলানি মেয়েরা অল্পবয়সী হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই তাকে ভাইয়া থেকে সাইয়া বানাতে বেশি সময় নেয় না। আর তাছাড়া ও তো নিজের মুখেই বললো 'প্লিজ ডোন্ট কল মি 'দিদি' রাইট নাউ .. কল মি ওনলি রনিতা' .. উফ্ ওই ন্যাকা ন্যাকা গলাটা শুনেই তো মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল আমার .."

- "আচ্ছা বাবা আচ্ছা .. তোর সব কথা মেনে নিলাম .. কিন্তু সন্দীপ?"

- "মানে? এখানে আবার ওনার কথা আসছে কোত্থেকে? আগের দিন তো এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে সব কথাই হয়েছে। কেউ যদি আমার সঙ্গে লেজুড় হয়ে কোথাও চলে আসে, সেখানে তো আমার কিছু করার নেই। ওই সিচুয়েশনে তুমি আমাদের দু'জনকে দেখে মিস আন্ডারস্ট্যান্ড করেছো .. দ্যাট ইজ ইওর প্রবলেম। তারপরে নিজেই ইচ্ছাকৃতভাবে টগরের সঙ্গে তোমার নাম জড়িয়ে আমার কাছে দেখাতে চেয়েছো তোমার জীবনেও একজন বিশেষ কেউ এসে গেছে। ভুল তুমি করেছো, আমি নয়। ইনফ্যাক্ট, সবসময় তুমি ভুল করো। নিজেকে এবং নিজের জীবন দর্শনকে নিজের ভালোবাসার মানুষের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া, কাউকে জবাবদিহি না করা, মানুষকে অযথা ভুল বোঝা .. এই দোষগুলো তো তোমার মধ্যে আছেই।"

- "আচ্ছা, সে না হয় বুঝলাম .. সব আমার দোষ। কিন্তু তোর সঙ্গে ইন্সপেক্টর সন্দীপ সেনগুপ্তর বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে .. এই কথাটা যখনই মনে পড়ে তখনই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। পরক্ষণেই মুষড়ে পরি এই ভেবে সময়ের টানে হারিয়ে যাচ্ছে দিন, কাল, বছর .. পরে আছে একাকীত্ব। অন্তরালে লুকিয়ে আছে মোহ, খুব নিরবে পুড়ে প্রেম রেখে যায় শুধু বিষন্নতার ছোপ। একাকীত্ব খুঁজে চলে এক টুকরো আলোর দিশা।"

"আমি একজন স্বাধীন দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। তাই আমার জীবনসঙ্গী ঠিক করার স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আমার আছে। কোনো গুরুদেবের কথায় ছোটবেলায় ঠিক হয়ে থাকা বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে আমি জড়াতে পারবো না। এই কথা আমি আমার মা'কে জানিয়ে দিয়েছি। তবে এটাও ঠিক সন্দীপ বাবুকে আমি এসব কথা বলতে পারবো না, কারণ তিনি নিজে থেকে আমাকে কিছু বলেননি। আর আমি এটাও জানি, মা এই ব্যাপারে সন্দীপ বাবুকে কিছু বলবে না এবং সম্পূর্ণভাবে আমার বিরোধিতা করবে এই ক্ষেত্রে। তাই সেই দায়িত্বটা তোমাকেই নিতে হবে। আরে, এইসব ডায়লগ তো তোমার দেওয়া উচিৎ ছিলো আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য! এই মানুষটার তো দেখছি সত্যিই কোনো হেলদোল নেই। তুমি আদৌ আমাকে ভালোবাসো তো? আচ্ছা প্রেম কাকে বলে জানো? বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু মোটেই প্লেটনিক লাভের কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি শরীরী ভালবাসার কথা। যেখানে প্রেমের সঙ্গে কাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সামাঝরাহে হো না মেরি বাত?" ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো হিয়া।

- "আমি জানিনা আজকাল তুই কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছিস। তবে তারা তোর মাথাটা পুরো বিগড়ে দিয়েছে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। খুব পেকে গেছিস তাই না? আজ তোর ভালোভাবে ক্লাস নিতে হবে। প্রেম প্রধানত কাম থেকেই উদ্ভূত, যদিও তা পুরোপুরি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রেম হলো এক উদ্ভাবন, এক রূপান্তর, এক অনন্যবোধ, এক জাদুরসায়ন। এর কারণেই প্রেমের ক্ষেত্রে দেহ প্রতীক হয় বটে, কিন্তু শুধু তা যৌনতায় পরিণত হয় না। জীবকুলের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে শরীরকে মুক্ত করতে পেরেছে তার মন ও মস্তিষ্ক দিয়ে। দেহের সৌন্দর্যের অনুসদ্ধানের সাথে যখন বাসনা সম্পর্কিত হয়ে সৌন্দর্যের উদ্যাপনে অগ্রসর হয়, তখন সেই তাড়নার নতুন পরিগ্রহণ যে বিজয় অর্জন করে, তাই প্রেম। প্রেম আসলে যৌনসত্যের এক বিনির্মাণ, যা তাকে চরিতার্থতা দেয় যেন শরীর তার প্রাকৃতিক ভূমিকাকে সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারে। প্রেমের এই অগ্রগতি আসলে যৌনসম্পর্ক সৃষ্টির এক ধরনের উদারীকরণ ঘটায়, যৌনতাকে সদগুণে উপনীত করে।"

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিরতি নিলো গোগোল। তার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত অবস্থায় মুখ হাঁ করে তাকিয়েছিল হিয়া। পুনরায় বলতে শুরু করলো গোগোল।

- "প্রেম কামকে অসাধারণ ভাবে উপভোগ করার মনোশারীরিক এক উদ্দীপনরথ। প্রেম হলো কামজ, যেমন পদ্ম হলো পঙ্কজ। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রেম ছাড়া কাম সম্ভব, যদিও তার আয়ু হতে পারে ক্ষণিক। প্রেম উপহার চায়, আর এজন্যই উপস্থাপন করে নিজেকে কামের জন্য। কাম বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে শারীরিক মিলন হলো নিকটতম দেহযোগাযোগ আর প্রেম হলো প্রাণের বা আত্মার ঐকতান। কিন্তু কখনও কখনও চূড়ান্তভাবে কামকে পাওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে তাকে আড়াল বা অস্বীকার করে প্রেম, নিজেকে করতে চায় সদগুণসম্ভাবিত। এটা অনেকটা কামের জন্য কামের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। এটার রয়েছে একটি দার্শনিক সৌন্দর্য: অস্বীকৃতির প্রাপ্তি। প্রেম যে-শারীরিক নিদর্শন খুঁজতে চায় কাম তা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। কাম হলো সেই যৌনতা যা বর্তমান ও ক্রিয়াশীল, যা নির্দেশনাপ্রাপ্ত ও অভিমুখী। যৌনতা প্রাকৃতিকভাবে যায় প্রজননে, কামে তা নয়। কামের সমাপ্তি আনন্দেই। যৌনতা জীবগত আর কাম মানবগত। কামক্রিয়ায় সবসময়ই থাকে অদৃশ্য ও চিরক্রিয়াশীল সঙ্গী, থাকে অভীপ্সা ও কল্পনা; থাকে একাধিক অংশগ্রহণকারী। প্রাণিযৌনতা ও মানবকামের মধ্যে আছে পার্থক্য। প্রাণিযৌনতায় কল্পনা নেই, নেই ফ্যান্টাসিও, আছে শুধু অভ্যাস। কিন্তু মানবকামে এগুলো আছে, রয়েছে যৌনমনস্তত্ত্বের খেলাও .. ও কথা থাক। যৌনতায় প্রাণীদের কোনো রূপকথা নেই, নেই কোনো আলাদা জগৎও, কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করেছে এই সবকিছু। তপস্ব্যা ও লাম্পট্য, এ দুটোরই প্রকাশ রয়েছে কামে। এরা বিপরীতধর্মী হলেও কামের সার্থকতায় প্রজননকে বাতিল করে উভয়েই, যদিও একটার উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক বা লৌকিক সাধন ও পরিত্রাণ, অন্যটির উদ্দেশ্য ব্যক্তিক স্বাধীনতা। দুটোই পরিহার করে প্রজননকে। প্রথমটির দেখা মেলে তন্ত্র ও বাউল সাধনায় যেখানে যৌনতাকে ব্যবহার করা হয় যান হিসেবে,আর দ্বিতীয়টির উদাহরণ সাদীয় সাহিত্য ও তাঁর জীবন। প্রেম হলো এমন এক শারীরিক অবস্থা, যখন শরীরের সব ইন্দ্রিয়ই অংশগ্রহণ করে, এবং এই অংশগ্রহণ শরীরকে একটি তূরীয় অবস্থায় নীত করে। মানুষের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে, এবং তার ফলাফল হিসেবে আসে জননেন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত উদ্দীপন। কোনোকিছুই বাকি থাকে না .. চোখ, কান, সুগন্ধ,স্পর্শ, মর্দন এমনকি স্বাদও ক্রীড়াময় হয়ে ওঠে। প্রেম যদি কোনো গোপন রসায়ন হয় তবে পেমে পড়া মানুষেরা যেন হয়ে ওঠে অলীক সত্তা, তাদের ভাষা ও আচরণ যেন হয়ে ওঠে অবাস্তব, ও অচেনা। সামাজিক বা ধর্মীয় নৈতিকতাও এই প্রবৃত্তির জাগরণকে থামাতে পারে না। তখন প্রেম হয়ে ওঠে বিশেষ ধারণা বা লক্ষণ। প্রেমিকের কাছে তার প্রিয়তমা বা প্রেমিকার কাছে তার প্রিয়তম হলো পৃথিবীর পরিচিতিকরণের অবতার, একজন অন্যজনকে উপহার দেয় এক নতুন পৃথিবী যার নিরন্তর অন্বেষক হয়ে ওঠে তারা পরস্পর। এজন্যই প্রেমে বিভ্রম বলে কিছু থাকে না, কারণ তা স্বচ্ছতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সম্পর্কের স্থায়ীকরণের মাধ্যমে। প্রতিটি প্রাণীর শরীররই ইন্দ্রিয়ের মহোৎসব, সেখানে পূজা পায় এক ইন্দ্রিয়দেবতা। কিন্তু সাধারণ প্রাণীর ইন্দ্রিয়দেবতাটি একটি উদ্দেশ্যকে নিয়ে অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য পূরণ হলেই সে থাকে তৃপ্ত। তার মানে, প্রাণীর এই দেবতা সুস্থ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। কিন্তু মানুষের এই দেবতা মাতাল, শৃঙ্খলাহীন। একই সময়ে সে পূরণ করতে চায় অনেক উদ্দেশ্য। এই বহুগুণিত প্রবণতাই উপহার দেয় প্রেম যা কামের পথ ধরে হাজির হয়। শুধু তা-ই নয়, তা মানুষকে করে তোলে নতুনের অভিলাসী, আবিষ্কারমুখী। মানুষের ভেতরে বাস করা ইন্দ্রিয়দেবতাই এই পুনরাবিষ্কারের ও নবীকরণের কাজ করে যায়। এই সৃষ্টিশীলতা তাকে বহুসৃষ্টিশীল হওয়ার শক্তি জোগায়। শুধু এটুকুই নয়, সে উপহার দেয় আকস্মিকতা ও পুনর্নির্মাণের ইচ্ছা, দেয় পরিবর্তনের মানসিকতা, দেয় অঙ্গীকারও। যৌনবাস্তবতার বাইরে একটি কল্পনাকে স্বাগত জানায় সে যা সৃষ্টি করে সৌন্দর্য। নৈতিক প্রত্যয়গুলোকেও সে নির্দ্বিধায় ভেঙে ফেলে। এ অর্থে প্রেম লঙ্ঘনকারী। প্রেম কামকে পূরণের মুখোশ হলেও এটা ইন্দ্রিয়ের একধরনের সৌন্দর্যকে আবাহন জানায়। এটা এক আনন্দের জন্ম দেয় যাকে উপভোগ করে শরীর। শুধু কাম প্রেম নয় কখনোই, অতি কাম বা অসুন্দর কাম বরং প্রেমকে হত্যা করতে পারে। প্রেম নিজে সুন্দর নয় কিন্তু তা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রেম এক ভুল যা থেকে সুন্দরের জন্ম। বোদল্যের বলেছেন, প্রেমের অসাধারণ এবং সর্বোচ্চ আনন্দ রয়েছে ভুল করার নিশ্চিততার মধ্যে। আর এ কারণেই কখনও কখনও মনে হয় প্রেম বুঝি দেহাতীত বা কামাতীত কোনো কিছু। এর কারণ হলো সেই সৃষ্টসৌন্দর্য যা কামকে ঢেকে রাখে।"

"হোল্ড অন .. হোল্ড অন .. তখন থেকে এইসব কি বলে যাচ্ছ তুমি? এখানে কি প্রেম এবং কাম সাহিত্য, তার সঙ্গে তোমার স্নাতক স্তরের সাবজেক্ট ফিজিওলজির সংমিশ্রণে একটা হচপচ ক্লাস হচ্ছে? তোমার এই জ্ঞানের সম্ভাষণের একটা শব্দও আমার মাথায় ঢোকেনি, বিশ্বাস করো। একটা সহজ প্রশ্ন করেছিলাম, তার সহজভাবে উত্তর চাই। ডু ইউ লাভ মি অর নট .. আমি জানি উত্তরটা, কিন্তু তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।" গোগোল হয়তো আরো অনেক কিছু বলতো, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বেশ রাগত স্বরে কথাগুলো বলল হিয়া।

"তৃষিত বুকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলছে অবিরত। চাঁদের আলো কেঁপে ওঠে অজানা এক সঙ্কেতে। রূপকথারা প্রেম লিখে যায় কাব্য গাঁথা মালায়, না বলা স্বপ্নগুলো তুষের অনল জ্বালায়। ঈশান কোণের মেঘের রামধনু রঙ ছুঁয়ে দেখার বড্ড সাধ। সন্ধ্যাবেলা শঙ্খের আওয়াজে ছুটে যায় পাবে বলে পরশ। ইচ্ছেরা কথা কয় সঙ্গোপনে ধ্রুবতারার সাথে একলা ভাসবে বলে। বুকের মণিকোঠায় জমাটকষ্ট এখনও বাঁধ ভাঙ্গেনি চোখের জলে, যদি কখনো দেখা হয়ে যায় সেই বালুকাবেলায়। আর তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করছিস আমি তোকে ভালোবাসি কিনা? নিজের থেকেও বেশি, এই পৃথিবীর সবার থেকে বেশি, এমন কি তোর থেকেও বেশি ভালোবাসি তোকে আমি।" চাপা অথচ দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো বললো গোগোল।

"সত্যি বলছো .. সত্যি বলছো তুমি? আমার ভালোবাসা যে শুধুই তোমাকে ঘিরে। দিয়েছি মন, দিতে পারি প্রাণ। বেঁধেছি তোমায় নিয়ে কত স্বপ্ন, আরও কত শত গান। তুমি আমার অন্তরে সুখের ছায়া, শূন্য দেহে প্রাণ। তোমায় ছেড়ে যায়না থাকা, মনকে বাঁধে পিছুটান। তুমিও সপ্ন সাজিয়ো আমায় নিয়ে, এটাই একমাত্র চাওয়া তোমার কাছে।" গোগোলের খুব কাছে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর কন্ঠে উক্তি করলো হিয়া।

কথাগুলো শুনতে শুনতে হিয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো গোগোল। এই দৃষ্টি আগে কখনো দেখেনি হিয়া। বেলার পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে হিয়ার মুখে .. সেই আলো এক অদ্ভুত মোহময়ী রূপ সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে। গোগোলের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো হিয়া যেন পৃথিবীর বুকে যেন সর্বশ্রেষ্ঠ সদ্য ফোটা একটি গোলাপ ফুল, যার মোহনীয় সৌরভে মন মুগ্ধতায় আকুল হয়ে যায়। এ যেন সমগ্র রূপের শ্রেষ্ঠ বাহার, যার ভেতর নেই কোনো ভ্রান্তি, পুরোটাই স্বচ্ছ। যার ভুবন মোহিনী হাসিতে যেন মেঘেরাও থমকে তাকায়, হীরে-মুক্তো ঝরে পরে প্রতিটি হাসির লহমায়। যার অভিসার অলৌকিত সিগ্ধতায় এই হৃদয় ছুঁয়ে যায়, অসহায় চিত্ত স্বপ্নীল সন্ধানে বার বার ওর ওই এক চিলতে হাসিতে হারায়।

হিয়ার অপরূপ লাবণ্য এবং সৌন্দর্য অবলোকন করে আদ্যোপান্ত সিরিয়াস এবং কঠিন থেকে কঠিনতর হৃদয়ের অধিকারী গোগোলের মধ্যেও সাহিত্যের ভাব প্রকাশ পেয়েছিলো - "তোমাকে মনের মণিকোঠায় রাখি, তবু মেলাতে পারি না ভালোবাসা। তখন বড্ড ক্লান্ত আমি, রাজ্যের ক্লান্তি যেন আমার শরীরে। জানো তুমি? আমার সব অনুভূতিটুকু নিয়েও আমাকে বোঝোনি তুমি কিংবা হয়তো বুঝতে চাও না। চোখের মণিতে তুমিই তো ছিলে, দেখোইনি কিংবা হয়তো দেখতেই চাও না। বড়োই অবহেলিত আমি। কিন্তু আর হারতে চাই না, আমার আমিকে পরাজিত করে। এখন আকাশের বুক পুড়ে খায় বিকের রোদ, মেঘ পোড়া লাল আভাগুলো চুমু খায় অশান্ত জলের পাঁজর। জ্যোৎস্নার দীপ্তি ছুঁয়ে দেয় হলুদ বনের শরীর। বাতাসে সুগন্ধি ছড়িয়ে প্রেমের সেই চিরন্তন গান গেয়ে যায় রাত পাখিরা।"

গোগোলের মুখে জীবনে এই প্রথমবার 'তুই' থেকে 'তুমি' এবং নিজের সম্পর্কে ওই কথাগুলো শুনতে শুনতে আনন্দে চোখ ভিজে গিয়েছিল হিয়ার, তিরতির করে কাঁপছিল তার গোলাপী ওষ্ঠদ্বয়। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ .. সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত চুম্বনের মুহূর্ত .. ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে পারস্পরিক অস্তিত্বের অনুভব .. এতদিন পরে আজ বুঝি বা প্লাবন এলো .. কিন্তু একি! যে বেগে প্লাবন .. সেই বেগেই কি ভাঁটা! চুম্বকের বিপরীত মেরুর মতো যে বেগে আকর্ষণ তার চেয়েও দ্রুত বেগে দূরে সরে যাওয়া .. যেনো সমমেরুতে তুমুল বিকর্ষণ। তৃষ্ণার এক ফোঁটা জল যেমন স্বস্তির চেয়ে তৃষ্ণাকে আরো বাড়ায় তেমনি অসমাপ্ত সেই চুম্বন যেনো ওদের দুজনের অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে দিলো।‌ এতদিনকার তৃষ্ণার্ত চাওয়া কি আর এই ক’সেকেন্ডে নিবারণ সম্ভব! হয়তো আবার প্লাবন আসবে .. চুম্বনের বন্যায় ছাপিয়ে যাবে দু’কূল .. হয়তো বা এই অসমাপ্ত চুম্বনের হাহাকার বোধহয় এ জন্মে আর ঘুচবে না।

★★★★

হিয়া বাড়ি ফিরে গেছে অনেকক্ষণ। গোগোল অবশ্য তাকে অনেকবার অনুরোধ করে বলেছিলো "মামণি তো একটু পরেই চলে আসবে। একসঙ্গে লাঞ্চ করে  বাড়ি যেও, আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।" উত্তরে হিয়া জানিয়েছিল - আজ সে এমন অমৃত পান করেছে যে, পৃথিবীর কোনো ভালো খাবার আজ আর তার মুখে রুচবে না। বাড়ি থেকে গানের কলেজে যাচ্ছে বলে সে বেরিয়েছে। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, আর বেশি দেরি করলে তার মা চিন্তা করবে। তাছাড়া গোগোল এখন তাকে পৌঁছে দিতে গেলে সেটা যদি তার মায়ের চোখে পড়ে, তাহলে আবার হাজারটা কথা উঠবে। গোগোলকে হয়তো অনেক অপমান সহ্য করতে হবে। তাই হিয়া জানিয়ে দিলো .. সে একাই ফিরবে। তবে রেলপাড়ের বস্তি থেকে বেরোনোর পর একজোড়া চোখ যে তাকে ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করছিলো, সেটা হিয়া বুঝতে পারেনি।

কামরাজের ফোন এসেছিলো গঙ্গানগর পুলিশ স্টেশনে নতুন জয়েন করা সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে। একদা গঙ্গানগর ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের জেনারেল ম্যানেজার, অধুনা এলাকার সবথেকে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট কামরাজের বাড়িতে আজ সন্দীপের দুপুরের খাবার নিমন্ত্রণ।

গন্তব্যে পৌঁছাতে গেলে রেলপাড়ের বস্তির উপর দিয়ে যেতে হবে তাকে .. এটা ভেবেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো সন্দীপের। দুপুরবেলা থানা থেকে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে ফ্রেশ হয়ে গাড়ি চালিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার সময় সন্দীপ ফুটপাথের ধারে একজন অর্ধোলঙ্গ মাঝবয়সী মহিলাকে বসে থাকতে দেখলো। প্রথম দর্শনেই তার পুলিশের চোখ বুঝতে পারলো মহিলাটি মানসিক ভারসাম্যহীন। পাগলী গোছের মহিলাটির মাথায় একটা গামছা বাঁধা আর শরীরের বস্ত্র বলতে .. একটি শতচ্ছিন্ন শাড়ি কোনোরকমে গায়ে জড়ানো রয়েছে। যার ভেতরে না আছে কোনো অতিরিক্ত বস্ত্রখন্ড, না আছে কোনো অন্তর্বাস।

দৃশ্যটা দেখেই সন্দীপের দুই পায়ের মাঝের পুংদন্ডটি অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অর্ধনগ্ন নারীর রূপ দেখার লোভ সামলাতে না পেরে গাড়ি থামিয়ে দাঁড় করালো ফুটপাতের পাশেই। গাড়ি থেকে নেমে সামনেই একটা পান-বিড়ির দোকান থেকে সিগারেট কিনলো। তারপর এমন একটা ভাব করে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করতে লাগলো, যেনো কিছুই ঘটেনি, এই মুহূর্তে এই ভাবেই তাকে ধূমপান করতে হবে। নিজেকে অতি চালাক ভেবে নেওয়া সন্দীপের সিগারেট কেনাটাতো শুধুমাত্র একটা অজুহাত, আসলে মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাটির শতচ্ছিন্ন কাপড়ের মধ্যে দিয়ে উঁকি মারা গোপন অঙ্গগুলি দেখে নেওয়াই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো।

রাজকীয় কায়দায় সিগারেট টানতে টানতে পুনরায় পান বিড়ির দোকানটার কাছে গিয়ে দোকানদারকে সন্দীপ জিজ্ঞাসা করলো "এই শোন, ওই পাগলীটা কবে থেকে এখানে আছে রে? ওর বাড়ি কোথায়? তোদের এলাকাতেই থাকে, নাকি অন্য কোনো জায়গা থেকে উদয় হয়েছে?"

"তুই-তুকারি করবেন না স্যার, সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখুন, তাহলেই সম্মান পাবেন .. না হলে নয়। আর ওর বাড়ি কোথায় জেনে আপনার কি দরকার?" উত্তর করলো দোকানদার।

"এই .. একদম গলা উঁচু করে কথা নয় .. তোকে আমি চিনতে পেরেছি। তোর নাম তো রাজু .. তোদের বস্তির নেতা অনির্বাণের পেছনে ঘুরঘুর করিস।" একটু মেজাজ দেখিয়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ। "অনির্বাণ মানে গোগোল আমাদের সকলের বন্ধু .. ওকে আমরা সবাই চোখ বন্ধ করে ভরসা করি এবং ভালোবাসি। আপনার সঙ্গে কোনো এক কালে ও পড়াশোনা করতো বলে হয়তো ওকে আপনার করা তুই-তুকারি ও মেনে নিলেও আমি কিন্তু নেবো না, শেষবারের মতো বলছি স্যার।" বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো রাজু।
[+] 9 users Like Bumba_1's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 30-11-2022, 08:56 PM



Users browsing this thread: 59 Guest(s)