29-11-2022, 08:57 PM
পর্ব- ছয়
আজ সকালে জলের জন্য দাড়ানো লাইনে অনেকক্ষণ ধরেই নিখিল চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পচুইয়ের মা মানে লক্ষ্মী কে দেখতে পারছে না। ধীরে ধীরে লাইনের সবাই জল নিয়ে ঘরে ফিরে গেছে কিন্তু লক্ষ্মীকে দেখতে পেল না। এমনকি পচুইকেও কারও সাথে আসতে দেখলো না। কি হলো ঘটনা কি দুদিন ধরে ওকে কোথাও দেখতে পারছে না কেন। নিখিল কেন জানি প্রতিদিন ওর অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। না ঝগড়ার করার জন্য নয় কেন জানি ওকে না দেখলে নিখিলের কেমন নিজেকে খালি খালি লাগে৷ গতকাল নিজেকে অনেক কষ্টে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আজ তো মন মানতেই চাইছে না। নিখিলের ভেতরটা লক্ষ্মী কে একনজর দেখার জন্য কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। কোন ভাবেই মন টাকে সামলে রাখা যাচ্ছে, কেন এই উচাটন কেন এই অস্থিরতা তার কোন মৌখিক উত্তর নিখিলের কাছে নেই। কিসের জন্য? কোন ভাললাগা কি? তবে এই ভাললাগা কেন কিসের জন্য? তেমন কোন চেনা জানা নেই নেই কোন আলাপচারিতা, দুজনের কারোই তো দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোন মিল নেই। নেই কোন আন্তরিকতার সম্পর্ক তবে কেন ওকে দেখার জন্য অবুঝ মন এতো করে বিহ্বল হয়ে পড়েছে, খুব করে চাইতে শুরু করেছে এক নজর দু নয়ন কে জুড়িয়ে নিতে লক্ষ্মীর শ্রীবদন খানা দেখে নিয়ে। নিখিল ভেবেছিল আজও গতকালের মতই নিরাশ হয়ে ফিরে যাবে কিন্তু মন আর শরীর দুটোই যে বিপরীত মুখী আচরনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পা যেতে চায় কিন্তু মস্তিষ্ক সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্তে অটল। তবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো কোন লাভ হচ্ছে না লক্ষ্মীর দেখা পাবার জন্য তো ওকে খুঁজতে হবে। কিস্তু খুঁজবে কোথায়? কিছুই তো জানা নেই নিখিলের লক্ষ্মীর সম্পর্কে তবুও দেখো এই অশান্ত চঞ্চল মন ওকে দেখার জন্য কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
'যার কেউ নেই তার ভগবান আছে' কথাটা হঠাৎই মনে পড়ে যায় নিখিলের দূরপথে মালা দিদা কে যেতে দেখে৷ এইতো একজন আছে যার কাছে লক্ষ্মীর খবর টা নেয়া যাবে অন্য কাউকে ভরসা নেই কটু কথা ছড়াতে পারে পাড়ায় কিন্তু মালা দিদা সেটা করবে না তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। নিখিল ছুটে যায় মালা দিদার দিকে, মালা দিদা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল তাই নিখিল কে অনেকটা দৌড়েই যেতে হলো। মালা দিদার সামনে গিয়ে হাতের ইশারায় থামতে বলে খানিকটা দম নিয়ে নিখিল জিজ্ঞেস করে
ওহহ দিদা তোমরার লক্ষ্মী কই গো দুদিন ধরে তারে দেহি না কেন?
নিখিলের প্রশ্ন শুনে মালা দিদার ভ্রূদ্বয় খানিকটা কুঞ্চিত হয়, তার বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া মুখাবয়বে রহস্যের উঁকি দিয়ে যায়।
কেন হেরে কিয়ের দরহার?
এমন প্রতিত্তোর আসবে সেটা নিখিলের আগে থেকেই ধারণাই ছিল তাই বিচলিত না হয়ে মালা দিদা কে বুঝানোর চেষ্টা করে
না গো দিদা দরকার নাই, দেহি না তো তাই জিগাইলাম আর কি।
রহস্যাবৃত চামড়ার ভাজ পড়া মুখমণ্ডলে খানিকটা হাসি খেলা করে যায়,
হের জ্বর হইছে, বিছনাত্তে ওঠে না। আমি কাইল খাওন দিসলাম আইজ যাইবার পাই নাই।
কথাটা বলেই মালা দিদা গটগট করে নিজের পথে হাঁটতে থাকে। লক্ষ্মীর জ্বর হয়েছে শুনেই নিখিলের অন্তরাত্মা কেমন হাহুতাশ করতে শুরু করলো। বিচলিত মন এবার লক্ষ্মীকে একনজর দেখার জন্য ওর শরীরের হাল জানার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। কিন্তু যাবে কি করে? লক্ষ্মীদের বাড়ি তো ওর চেনা নেই তবে কি করে যাবে সেখানে, ইশশ! মালা দিদাকে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল। কি করবে বুঝতে পারছে না, তবে লক্ষ্মী কে দেখতে হলে তো একটা রিস্ক নিতেই হবে। শেষমেশ মালা দিদা যে পথে গেল সেই পথেই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে লাগলো।
আলেয়া মাত্রই নাকে মুখে কিছু খাবার খেয়ে কলেজের জন্য দ্রুতই বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে৷ বাড়ির রাস্তা ছেড়ে ছোট্ট পাকা রাস্তাটা ধরতেই আজও সেই পিছু নেবার পায়ের শব্দটা মাথায় খেলতে লাগলো। না আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে, মাঝে দুদিন কেন জানি এই পিছু নেয়া ব্যাপারটা ছিলো না আজ আবার সেটা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করেই আলেয়া পায়ের গতি বাড়ায় আর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিয়ে রাস্তায় নজর রাখে কে পেছন পেছন আসছে সেটা দেখার জন্য। উদ্দেশ্য সফল হবার পথেই কেউ একজন এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে৷ কিন্তু মুখটা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না মাথায় একটা টুপি থাকার কারণে, তবে আজ আলেয়া ঠিক করে রেখে যে করেই হোক মানুষটাকে হাতে নাতেই ধরবে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা কাঠের টুকরো দেখে সেটা হাতে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে৷
অচেনা আগুন্তক আলেয়াকে অতিক্রম করে সামনে এগোতেই পেছন থেকে আলেয়া হাতের লাঠি টা দিয়ে সজোরে পিঠে আঘাত করে। আঘাতে প্রচন্ডতায় আম্মাআআআ গো বলে একটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। পেছন ফেরে তাকাতেই যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকা মুখটা সামনে ভেসে উঠতেই আলেয়া চমকে উঠে, শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় নিয়মেই হাত থেকে লাঠিটা পড়ে যায়।
সুমন ভাই আপনে, সরি সরি আমি বুঝতে পারি নাই। বেশি জোরে লাগছে কি?
সুমন মাথায় থাকা টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে নেয় আর অন্য হাত উল্টো করে পিঠে হাত বুলানোর চেষ্টা করে কুঞ্চিত মুখে বলে উঠে, না না ঠিক আছি।
আপনে এইনে কি করেন? এদিকে কই গেসিলেন? নাকি আপনেই আমার পিছন পিছন আয়েন প্রতিদিন।
আলেয়া প্রশ্ন শুনে সুমন মাথা নিচু করে নেয়। এক হাতে আরেক হাতের নখগুলো ঘসাঘসি করতে করতে নিচু স্বরে বলে উঠে, হুম! আমিই...... প্লিজ তুমি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিও না।(মাথা উঁচু করে আলেয়ার চোখের দিকে চোখ রেখে বলে উঠে) তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
সুমন কে এমন ঘাবড়ে যেতে দেখে আলেয়া খানিকটা হতবাকই হয়ে যায়, কি কথা সুমন ভাই?
মাআআআ..নে তুমি মানে আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমাকে বলবো বলবো করে বলতে পারছি না তাই পেছন পেছন ঘুরি সবসময়।
সুমনের মুখে ওকে পছন্দের কথা শুনতেই আলেয়ার মুখশ্রী পাল্টে যেতে থাকে একটু আগে যেখানে রহস্য খেলা করছিল সেখানেই এখন অদ্ভুত ভালো লাগার মিশ্র এক অনুভূতি ঘিরে ধরেছে। এই প্রথম কারও কাছে এমন কিছু শুনেছে তাই হয়তো আলেয়ার ভেতরের প্রতিক্রিয়া টা নিজেও ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছে না। মনের ভিতরে ভালোলাগার হরমোন গুলো চড় চড় করে বেড়েই চলেছে সেটার প্রভাবেই চেহারার লাবণ্য ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে তবে সেটা আড়াল করার চেষ্টায় রত আলেয়া ওড়না দিয়ে নিজের সদ্য প্রেমে পড়ার পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠা মুখটা ঢেকে নিয়েছে ততোক্ষণে।
সুমন ভাই আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি যাই!
কথা টা বলেই ছোট্ট একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে আলেয়া এগিয়ে যেতে থাকে।
আলেয়ার শতচেষ্টাও ওর ঠোঁটের কিনারে ফোঁটে উঠা হাসির ঢেউটা আড়াল করতে পারে নি। সেটা ঠিকই সুমনের শিকারী বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পরে গেছে। একবার ভেবেছিল সে আলেয়ার পিছু নেবে কিন্তু কিছু একটা ভেবে সেটা আর না করে কিছুটা সময় নিয়ে তারপর সে নিজেও কলেজের পথ ধরে। সুমনও একই কলেজে পড়াশোনা করে কিন্তু তার ডিপার্টমেন্ট আলাদা আবার সে আলেয়ার সিনিয়র, সামনের বছর মাস্টার্স এর ফাইনাল দেবে।
আজ পুরোটা পথ আলেয়ার ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে চলেছিল ক্ষণে ক্ষনেই ছোট্ট হাসি আছড়ে পড়ছিল ঠোঁটের কোনে। সারা শরীর জোড়ে নতুন শরতের হিমেল বাতাস বারবার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিলো। এই অনুভূতির খেলা আলেয়ার মন আর শরীর দুটোর কাছেই একবারে নতুন। ও যে এই ভুবনে একদমই আনকোরা জীবনের নতুন এই পরিস্থিতিতে কেমন করে রিয়্যাক্ট করতে হবে সেটা জানা নেই। তবে হৃদয়ে যে ভালোলাগার উদগীরণ হয়ে চলেছে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে সে। অদ্ভুত এক শিহরনের খেলায় মত্ত হৃদয় আজ ওকে যে সুখ ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সেটায় বুদ হয়ে যাওয়া আলেয়া টেরই পায় নি কখন সে কলেজে পৌঁছে গেছে, ওর কাছে আজ ঘড়ির কাটা হয়তো অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই বয়ে চলেছে। আপাতত সব ভাবনা এক পাশে রেখে ক্লাসের উদ্দেশ্য চলে যায় আলেয়া।
অনেকটা এগিয়ে গিয়েও মালা দিদার দেখা পায় না নিখিল তবে কি করবে এখন? এতটা এসে আবার ফিরে যেতে চায় না মন। মনে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যায় সে একে ওকে জিজ্ঞেস করে লক্ষ্মীর বাড়ির খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ করেই একটা খোলা উঠানে খেলা করতে থাকা কয়েকটা বাচ্চার দিকে চোখ যায় নিখিলের। দূর থেকে মনে হলো ওখানে পচুই কে দেখতে পেলো মনে হয়, এগিয়ে যায় উঠানের দিকে হুম ঠিকই দেখেছে অর্ধ-উলঙ্গ শরীরে পচুইয়ের ঢিলে হাফ প্যান্ট নামমাত্র বস্ত্র হয়ে কোন মতে কোমড়ে জড়িয়ে আছে। নিখিলকে দেখেই চিনতে পেরে ওর দিকেই ছোটে আসে। নিখিল ওকে ওদের বাসায় কোথায় জানতে চাইতেই ছোট্ট হাতের মুঠোতে নিখিলের গোটা দুয়েক আঙুল পুড়ে নিয়ে এক প্রকার টানতে টানতে ওদের বাসার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। বাসা বলতে এটাকে বাসা বলার চেয়ে ঝুপড়ি বলা ভালো। ঘরের ছাদ টা রঙ বদলে যাওয়া টিনের চাল থাকলেও পাশের দেয়াল গুলো ভাঙাচোরা বাঁশের চাটাই কোন মতে দাঁড়িয়ে আছে আর সেটাকে আড়াল করার জন্য রাস্তার পাশেই নারিকেল পাতার ঝুলানো বেড়া। দরজা টা ঠেলে ভেতরে তাকাতেই দেখতে পায় একটা চকিতে ছেঁড়া কাঁথায় মোড়ানো লক্ষ্মী জ্বরের তীব্রতায় বিড়বিড় করে বিলাপ করে যাচ্ছে। নিখিলের ভেতরট হু হু করে কেঁদে উঠলো, পা চালিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে চকির পাশে গিয়ে লক্ষ্মীর কপালে হাত ছোঁয়ায়। ওর শরীরের তপ্ততা নিখিলের হাত যেন পুড়িয়ে দিতে চাইছে, হঠাৎ করেই নিজের কপালে রুক্ষ শীতল একটা হাতের ছোঁয়া পেতেই আতকে উঠে ভীষন জ্বালা করা চোখ গুলো খুব কষ্ট করে মেলে তাকাতেই নিখিলের চেহারা দেখে খানিকটা ভীতি ভাব চেহারায় ফুটে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই নিখিল নিজের হাতটা লক্ষ্মীর কপাল থেকে সরিয়ে নেয় আর মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করে
ওষুধ খাইছো?
লক্ষ্মী মুখে বলার মত শক্তি পায় না তাই মাথা নাড়িয়েই না সূচক বলার চেষ্টা করে। নিখিল ঘরের চারদিকে তাকিয়ে জলের জোগান খোঁজার চেষ্টা করে। দরজার দিকে একটা বালতি দেখতে পায়, সেটার কাছে যেয়ে দেখে অল্প জল আছে তবে সেটা আজকের না কারণ আয়রনের কারণে রঙ পাল্টে গেছে। এখন জল পাবার কোন আশা নেই বাধ্য হয়ে এটা দিয়েই কাজ চালানোর চেষ্টা করে৷ একটা ছেঁড়া গামছা ভাজ করে জলে ভিজিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে লক্ষ্মীর কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। ফাঁকে ফাঁকে ঘরে কোথাও জ্বরের ঔষধ আছে কিনা সেটা খুঁজতে থাকে কিন্তু বিফল হয়ে নিখিল শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মী কেই জিজ্ঞেস করে। লক্ষ্মী ডান হাতের ইশারায় একটা কৌটা দেখিয়ে দেয়। নিখিল সেটা নিয়ে এসে ভেতরে কয়েকটা প্যারাসিটামল আর ওমিপ্রাজল এন্টাসিড খুঁজে পায়। আপাতত একটা প্যারাসিটামল নিয়ে লক্ষ্মী কে কোন মতে বসিয়ে সেটাই খাইয়ে দেয়। নিখিল খেয়াল করে লক্ষ্মীর জ্বরের ছাপে ঢেকে থাকা মুখে হালকা খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েছে খানিক আগেও যেখানে আতঙ্ক আর ভীতি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছিলো।
আজ কলেজ নেই তাই সারাদিন বাসায় ছিল মাধুরী, সময় একদম কাটতে চাইছে না। ছোট বোন কলেজে চলে গেলে ও বাসায় একদম একা হয়ে পড়ে। মায়ের সাথে ওর বনিবনা একটু কমই তাই কিছুক্ষণ ঠাম্মির সাথে গল্প করেছে তবে এখন নিজের ঘরে এসে বোরিং ফিল করছে। হঠাৎ কি মনে হতেই বাথরুমের রেকের আড়াল থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার টা নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে বাসার নিচে নেমে আসে৷ চোখ পড়ে জংলা বাড়িটার দিকে, এখন আর জংলা বাড়ি বলা যাবে না রঙ তুলির আঁচড়ে আলিশান বাংলোর মত লাগছে। মাধুরী সেদিকেই এগিয়ে যায় গেটের সামনে যেতেই নাম ফলকের দিকে চোখ যায় সেখানে বড় করে লেখা আছে "অতিথি"।
খোলা গেটের কাছে নিখিল কে দেখতে না পেয়ে অবাক হয় মাধুরী। ভেতরে ঢুকে এক দুবার ওর নাম ধরে ডাকার পরও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়৷ রঙ চকচকে বাড়িটা দেখে বেশ ভালোই লাগছে আর এতোদিন কেমন ভূতুড়ে বাড়ির মত দেখা যেত। সিগারেট টা জ্বালিয়ে নিয়ে মাধুরী এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে আর এক কোনে ছোট্ট বাগানের মত নতুন বানানো জায়গার দিতে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কানে একটা শব্দ আসতেই পেছন ফেরে তাকিয়ে দেখে লম্বাচওড়া দেহের একটা মানুষ রঙের বালতি আর তুলি হাতে বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দিকেই তাকিয়ে আছে৷ এমন করে গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাধুরী মেজাজ গরম হয়ে যায়, ওর মনে হয় মেয়ে হয়েও ওকে সিগারেট টানতে দেখেই হয়তো ওমন অদ্ভুত চাওনিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে
কি হলো ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন? সিগারেট খাবে? লাগলে নিতে পারো।
মাঁচায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা হয়তো হাসতেছিল কিন্তু মাথায় মুখ সবটা কাপড় বাঁধা থাকায় শুধু চোখ দুটো ছাড়া সেটা আর দেখা গেল না,
না আমি স্মোকিং করি না। ইটস ওকে, ইউ ক্যারি অন।
বেশভূষায় মূর্খ মনে হলেও লোকটার মুখে ইংরেজি শব্দ আর শুদ্ধ উচ্চারণ শুনে খানিকটা অবাকই হয় মাধুরী। ছিটে আসা রঙে গায়ের জামা প্যান্ট টা রঙবেরঙে রেঙে উঠেছে তাতে সার্কাসের জোকারের একটা ভাইব পাওয়া যায় কিন্তু গলার স্বর কথা বলার স্টাইল কিংবা শুদ্ধ উচ্চারণ কোনটাই তো সাধারণ রঙ মিস্ত্রির সাথে যাচ্ছে না৷ জিজ্ঞাসু মন নিয়ে মাধুরী এগিয়ে যায় ওদিকে, বাঁশের মাঁচাটার কাছে আসতেই দেয়ালের উজ্জ্বলতা তার দিকে মাধুরীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়৷ পুরো দেয়াল জুড়ে চোখ জুড়ানোর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠা প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা মাধুরীকে বিভোর করে তুলে। আকাশে উড়তে থাকা সাদা বকের দল, পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে জেগে উঠা সূর্য কিংবা গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্না সমতলে এসে নদী হয়ে বয়ে চলেছে সেই সাথে ঘড়বাড়ি রাস্তাঘাট মানুষজন সব কিছু এতো ডিটেইল আর স্পষ্ট করে আঁকা হয়েছে যে মনে হয় এটা শুধু কোন ছবি নয় যেটা দেয়াল জুড়ে আছে, এটা যেন পুরো একটা সত্যিকারের গ্রাম যা চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। মাধুরী মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে ও যেন হারিয়ে গেছে ছবির সেই দৃশ্য গুলোর মাঝে কিন্তু বাস্তবে ফিরে আসতে হয় খুব শীঘ্রই হাতের জ্বলন্ত সিগারেট টা পুড়তে পুড়তে শেষ মাথায় এসে ওর কোমল আঙুলে ছ্যাঁকা দিতেই।
"উহহ" আওয়াজ করে এক ঝটকায় হাত থেকে সিগারেটের শেষ প্রান্তটা মাটিতে ছুড়ে মারে। মাধুরীর আওয়াজে ওর দিকে এগিয়ে আসে উপরের মাঁচায় থাকা অচেনা লোকটা, কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাধুরী হাতটা টেনে নিয়ে সামনেই রাখা জলের বাটিতে আঙুল গুলো ডুবিয়ে দেয়। খানিকটা অবাক হয়েই অস্বস্তি নিয়েই সামনের অচেনা অজানা মানুষটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আর বেশি বিস্ময় ওকে ঘিরে ধরে৷ ও যে নিজের হাতে আগুনের ছ্যাঁকা খাওয়ার যন্ত্রণা টা সেই মানুষটার মাথায় মুখে বাঁধা থাকা কাপড়ের ফাঁক গলা দুটো চোখে দেখতে পাচ্ছিলো।
সুমনের ক্লাস আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই কলেজের গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল সে এখানে কার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা হয়তো না বললেও চলবে। বারবার ঘড়ি দেখছে আর কলেজের ভেতরের দিকে পরিচিত মুখটা খুঁজে চলেছে।
আলেয়া মাত্রই ক্লাস শেষ হলো এবার একটা টিউশনি করাতে যেতে হবে ওকে। গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই ওখানে সুমন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সকালের ঘটনা টা আবার মনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক অনুভূতির জোয়ার বইতে শুরু করে। সুমনের বলা কথা টা আরেকবার মনের মাঝে বেজে উঠতে থাকে আলেয়ার মনে হয় কেউ যেন সেই কথাটাই বারবার ওর কানের সামনে বলে চলেছে। সেই কথা গুলো ভাবতেই সারা শরীরে শিহরণ জেগে উঠে। ধীর পায়ে চলতে চলতে গেটের কাছে চলেছে এসেছে আলেয়া ওকে দেখেই সুমনও এগিয়ে আসে আর ওর পাশে হাটতে থাকে
এখন টিউশনি করাতে যাবে!
কথাটা শুনে আলেয়ার হঠাৎ মনে হয় সেটা সুমন ভাই জানলো কি করে? তারপর আবার মনে হলো যে সুমন ভাই তো তার পিছে পিছে সবখানেই যেতো। সেটা ভাবতেই লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠে তার, মাথাটা নিচু করে কি ভেবে যেন বলে উঠে,
আপনার তো জানার কথা সুমন ভাই।
সুমন মুচকি হেসে উঠে, এর মাঝেই আলেয়ার টিউশনির জায়গায় এসে গেছে তাই সুমন কিছু বলার জন্য আলেয়া কে ডেকে উঠে,
আলেয়া একটু শুনবে?
সুমনের আওয়াজে আলেয়ার হৃদয়ে কেমন একটা ঝড় উঠেছে সেটা কিসের এখনো জানা হয় নি ওর,
কি সুমন ভাই?
খানিকটা এগিয়ে এসে আলেয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
সকালের কথা টা একটু ভেবে দেখো। না..না.. আমি কোন চাপ দিচ্ছি না তুমি সময় নিয়ে ভেবে আমাকে জানিও। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।
"ভালোবাসি" কথাটা শুনতেই যেন আলেয়ার রক্তের গতি হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। হৃদপিণ্ড টা আজ যেন একটু বেশিই লাবভাব করতে শুরু করেছে। হাত পা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে সমস্ত শরীর শিউরে উঠেছে অদ্ভুত অনুভূতির ছোঁয়া তে।