29-11-2022, 11:42 AM
পানিফল
হেমন্তের নরম সকালে মাঝে মাঝে শোনা যায় এই হাঁক, “পানিফল নিবেন গো, পানিফ-অ-অ-অ-ল...”
অভিজাত মানুষজন পানিফল কেনেন না, আর এই গলিতে বাস যত অভিজাত মানুষদেরই। সাইকেলের পিছনে ঝুড়ি-বাঁধা পানিফল-ব্যাপারি তবু এই গলিতে ঢোকে কেন কে জানে। ভুল করেই ঢোকে হয়তো, কিংবা ঢোকে বিক্রির ক্ষীণ আশায়। তবে আজ কেউ তাকে ডাকল। ডাকলেন মৃগাঙ্ক। রানি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বায়না ধরেছে “পাঁইফল খাব!”
অলকা তাকান পুত্রবধূর দিকে। তাঁর দুই ভুরুর মাঝে হালকা কুঞ্চনরেখা। সেটি আরও স্পষ্ট হওয়ার আগেই ধাঁ করে পানিফলওয়ালাকে ডেকে ফেলেন মৃগাঙ্ক।
কেনা তো হল, কিন্তু পানিফল ছাড়াবে কে? খোসা ছাড়ানোর হাঙ্গামা এড়াতেই ও জিনিস কদাপি কেনেন না অলকা। তা ছাড়া স্বাদ গন্ধ কিছুই যার মনকাড়া নয়, তা কিনবেনই বা কেন? অলকার কাজ কি কম পড়িয়াছে?
মৃগাঙ্কই ধুয়েটুয়ে এনে ফলগুলো বধূমাতার হস্তে অর্পণ করলেন এবং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “নে ধর, খোসা ছাড়াতে পারবি তো?”
অলকা বাঁচলেন। যাক, কাজটা রানির ঘাড়ে পড়ল তা হলে। কিন্তু বাঁচার জো কি অলকার আছে? ফলগুলো হাতে পাওয়া মাত্র অদ্ভুত দ্রুততায় আঙুলে কাঁটা ফুটিয়ে ফেলল রানি। অলকা মনে মনে ‘বেশ হয়েছে’ ভেবেছেন কি ভাবেননি, রানির আঙুল নিয়ে হুলস্থুল বাধালেন মৃগাঙ্ক। আঙুলের শুশ্রূষাপর্ব মিটলে দেখা গেল পানিফল ছাড়ানোর কাজটি চেপে গেছে অলকারই ঘাড়ে।
অলকা নিরুপায়। গুমোর দেখিয়ে কাজটা ফেলে রাখলে অনভ্যস্ত হাতে মৃগাঙ্কই যাবেন পানিফল ছাড়াতে। জলখাবারের মেনুতে আজ ছুটি-স্পেশাল কচুরির তোড়জোড় চলছে, তার মাঝে পানিফলের খোসা ছাড়ানোর বরাত দিলে রান্নার মেয়ের গাল ফুলবে। অগত্যা নীরবে বধূমাতার মুণ্ডপাত করতে করতে অলকাকেই বসতে হল পানিফলের বিরক্তিকর খোসা বিয়োজনে।
একটু বাদে রানিসাহেবা হেলেদুলে এলেন, একটি পানিফল তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন এবং দেখতে দেখতে সহসা সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মা দেখেছ, পাঁইফল দেখতে একেবারে বাইসনের মাথার মতো! কাঁটা দুটো হল শিং আর এই এই জায়গাগুলো হল নাক মুখ চোখ। দেখো না, দেখো দেখো...”
মৃদু একটা ‘হুম্’ ছাড়া অলকার কাছ থেকে আর সাড়া না পেয়ে রানি এ বার ছুটল শ্বশুরের কাছে। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন অলকা, রানির হাতে বাইসনের মাথা দেখতে দেখতে মৃগাঙ্ক ‘তাই তো! তাই তো!’ করে নিজের মাথাখানা দুলিয়েই চলেছেন। এ ছবি বড়ই গাত্রদাহকর। সে দাহ মাথায় পৌঁছেও যায় চট করে। ফলাফল, ক্ষণিকের মনোযোগহীনতা এবং সেই অবকাশে পানিফলরূপী বাইসনের তীক্ষ্ণ শিং গুঁতোয় খোদ অলকাকে।
কিন্তু অলকার তো মৃগাঙ্ক হেন শ্বশুর নেই, তাই বিক্ষত আঙুল টিপে ধরে নিজের ব্যথা নিজেকেই কমানোর চেষ্টা করতে হয়। এমনকি কোটাকুটি শেষ হলে নুন লঙ্কা মাখিয়ে প্লেটে সাজিয়ে ফলগুলো বধূমাতা সমীপে রেখেও আসতে হয়।
আজকাল প্রায়ই কপালে করাঘাত করেন অলকা। কী কুক্ষণে এ মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন তিনি! ছবিতে মিষ্টি মুখখানি দেখে অলকাই গলেছিলেন বেশি। সেকেন্ড রাউন্ডে অর্থাৎ মেয়ে দেখা পর্বে মেয়ের মা-বাবার কথায় আর ব্যবহারে সর্বাধিক কাতও তিনিই হয়েছিলেন। পুকাইও অবশ্য এক দেখাতে পছন্দ করেছিল। তবে অলকার আগ্রহ আতিশয্যেই রানির পদার্পণ এ বাড়িতে। কিন্তু সে মেয়ে যে এমন ন্যাকাষষ্ঠী হবেন, তা কি তখন ঘুণাক্ষরেও বোঝা গেছিল?
মঞ্চে এ বার পা রাখল অলকার সুপুত্র, তথা রানিসাহেবার আর এক খিদমতগার, পুকাই। নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে তার। হাই তুলতে তুলতে এসে অলকাকে বলল, “মা, চা।”
পানিফলজনিত জমে থাকা রাগঝাল এ বার ছেলের ওপরে ঝাড়লেন অলকা, “মা-কে কেন? বৌকে বলো না গিয়ে।” পুকাই অমনি হেসে বলল, “রানি করবে চা? তার চেয়ে বাবা আমিই এক কাপ জল মাইক্রোতে গরম করে খেয়ে নিই।” অলকা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন, কারণ মঞ্চে তখন পুনঃপ্রবেশ ঘটছে রানিসাহেবার। মুখে টকাস টকাস শব্দ করতে করতে এসে অলকাকে জড়িয়ে ধরে এক পাক ঘুরে নিয়ে সাহেবা বললেন, “পাঁইফলটা এত সুন্দর মেখেছিলে মামণি, আমি সবগুলো খেয়ে ফেলেছি। তোমার জন্য একটাও রাখতে পারিনি। কাল লোকটা গেলে আবার কিনব, বেশ?”
অলকা দ্রুত স্থানত্যাগ করলেন। মাথাটা বড্ড তেতে উঠছে, ঠান্ডা না করলেই নয়। মনের গরল কারও কাছে উগরাতে পারলে একটু শান্তি হত, কিন্তু তা করবেন কার কাছে? মৃগাঙ্ককে কিছু বলার উপায় নেই। তাঁর মুখে এক কথা, “ও একটা বাচ্চা মেয়ে, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছে। ওকে একটু আদর যত্ন না করলে চলে, বলো?”
চোখ ফেটে জল আসে অলকার। ধামাচাপা স্মৃতিরা সব ধামার তলা থেকে বেরিয়ে নাচানাচি শুরু করে দেয় মনে। রানির চেয়েও অল্প বয়সে মা-বাবাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন অলকা। বাপসোহাগি বেটি তিনিও ছিলেন, কিন্তু... না থাক, সাত সকালে ও সব স্মৃতি কিছুতেই আজ মনে আনবেন না অলকা। শ্বশুরবাড়িতে যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনা পাওয়াকে এ দেশের মেয়েরা ভবিতব্য বলে মানে, তিনিও মেনে নিয়েছেন। জ্বালা ধরে কেবল রানির প্রতি মৃগাঙ্কর এই আদিখ্যেতাগুলো দেখলে। তাঁর বেলায় মৃগাঙ্ক মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন কেন? সত্যি বলতে, অলকার যত না কষ্ট তখন হয়েছিল, মৃগাঙ্কর ব্যবহার দেখে এখন হয় তার চেয়ে ঢের বেশি।
হেমন্তের নরম সকালে মাঝে মাঝে শোনা যায় এই হাঁক, “পানিফল নিবেন গো, পানিফ-অ-অ-অ-ল...”
অভিজাত মানুষজন পানিফল কেনেন না, আর এই গলিতে বাস যত অভিজাত মানুষদেরই। সাইকেলের পিছনে ঝুড়ি-বাঁধা পানিফল-ব্যাপারি তবু এই গলিতে ঢোকে কেন কে জানে। ভুল করেই ঢোকে হয়তো, কিংবা ঢোকে বিক্রির ক্ষীণ আশায়। তবে আজ কেউ তাকে ডাকল। ডাকলেন মৃগাঙ্ক। রানি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বায়না ধরেছে “পাঁইফল খাব!”
অলকা তাকান পুত্রবধূর দিকে। তাঁর দুই ভুরুর মাঝে হালকা কুঞ্চনরেখা। সেটি আরও স্পষ্ট হওয়ার আগেই ধাঁ করে পানিফলওয়ালাকে ডেকে ফেলেন মৃগাঙ্ক।
কেনা তো হল, কিন্তু পানিফল ছাড়াবে কে? খোসা ছাড়ানোর হাঙ্গামা এড়াতেই ও জিনিস কদাপি কেনেন না অলকা। তা ছাড়া স্বাদ গন্ধ কিছুই যার মনকাড়া নয়, তা কিনবেনই বা কেন? অলকার কাজ কি কম পড়িয়াছে?
মৃগাঙ্কই ধুয়েটুয়ে এনে ফলগুলো বধূমাতার হস্তে অর্পণ করলেন এবং উজ্জ্বল মুখে বললেন, “নে ধর, খোসা ছাড়াতে পারবি তো?”
অলকা বাঁচলেন। যাক, কাজটা রানির ঘাড়ে পড়ল তা হলে। কিন্তু বাঁচার জো কি অলকার আছে? ফলগুলো হাতে পাওয়া মাত্র অদ্ভুত দ্রুততায় আঙুলে কাঁটা ফুটিয়ে ফেলল রানি। অলকা মনে মনে ‘বেশ হয়েছে’ ভেবেছেন কি ভাবেননি, রানির আঙুল নিয়ে হুলস্থুল বাধালেন মৃগাঙ্ক। আঙুলের শুশ্রূষাপর্ব মিটলে দেখা গেল পানিফল ছাড়ানোর কাজটি চেপে গেছে অলকারই ঘাড়ে।
অলকা নিরুপায়। গুমোর দেখিয়ে কাজটা ফেলে রাখলে অনভ্যস্ত হাতে মৃগাঙ্কই যাবেন পানিফল ছাড়াতে। জলখাবারের মেনুতে আজ ছুটি-স্পেশাল কচুরির তোড়জোড় চলছে, তার মাঝে পানিফলের খোসা ছাড়ানোর বরাত দিলে রান্নার মেয়ের গাল ফুলবে। অগত্যা নীরবে বধূমাতার মুণ্ডপাত করতে করতে অলকাকেই বসতে হল পানিফলের বিরক্তিকর খোসা বিয়োজনে।
একটু বাদে রানিসাহেবা হেলেদুলে এলেন, একটি পানিফল তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন এবং দেখতে দেখতে সহসা সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মা দেখেছ, পাঁইফল দেখতে একেবারে বাইসনের মাথার মতো! কাঁটা দুটো হল শিং আর এই এই জায়গাগুলো হল নাক মুখ চোখ। দেখো না, দেখো দেখো...”
মৃদু একটা ‘হুম্’ ছাড়া অলকার কাছ থেকে আর সাড়া না পেয়ে রানি এ বার ছুটল শ্বশুরের কাছে। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছেন অলকা, রানির হাতে বাইসনের মাথা দেখতে দেখতে মৃগাঙ্ক ‘তাই তো! তাই তো!’ করে নিজের মাথাখানা দুলিয়েই চলেছেন। এ ছবি বড়ই গাত্রদাহকর। সে দাহ মাথায় পৌঁছেও যায় চট করে। ফলাফল, ক্ষণিকের মনোযোগহীনতা এবং সেই অবকাশে পানিফলরূপী বাইসনের তীক্ষ্ণ শিং গুঁতোয় খোদ অলকাকে।
কিন্তু অলকার তো মৃগাঙ্ক হেন শ্বশুর নেই, তাই বিক্ষত আঙুল টিপে ধরে নিজের ব্যথা নিজেকেই কমানোর চেষ্টা করতে হয়। এমনকি কোটাকুটি শেষ হলে নুন লঙ্কা মাখিয়ে প্লেটে সাজিয়ে ফলগুলো বধূমাতা সমীপে রেখেও আসতে হয়।
আজকাল প্রায়ই কপালে করাঘাত করেন অলকা। কী কুক্ষণে এ মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন তিনি! ছবিতে মিষ্টি মুখখানি দেখে অলকাই গলেছিলেন বেশি। সেকেন্ড রাউন্ডে অর্থাৎ মেয়ে দেখা পর্বে মেয়ের মা-বাবার কথায় আর ব্যবহারে সর্বাধিক কাতও তিনিই হয়েছিলেন। পুকাইও অবশ্য এক দেখাতে পছন্দ করেছিল। তবে অলকার আগ্রহ আতিশয্যেই রানির পদার্পণ এ বাড়িতে। কিন্তু সে মেয়ে যে এমন ন্যাকাষষ্ঠী হবেন, তা কি তখন ঘুণাক্ষরেও বোঝা গেছিল?
মঞ্চে এ বার পা রাখল অলকার সুপুত্র, তথা রানিসাহেবার আর এক খিদমতগার, পুকাই। নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে তার। হাই তুলতে তুলতে এসে অলকাকে বলল, “মা, চা।”
পানিফলজনিত জমে থাকা রাগঝাল এ বার ছেলের ওপরে ঝাড়লেন অলকা, “মা-কে কেন? বৌকে বলো না গিয়ে।” পুকাই অমনি হেসে বলল, “রানি করবে চা? তার চেয়ে বাবা আমিই এক কাপ জল মাইক্রোতে গরম করে খেয়ে নিই।” অলকা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন, কারণ মঞ্চে তখন পুনঃপ্রবেশ ঘটছে রানিসাহেবার। মুখে টকাস টকাস শব্দ করতে করতে এসে অলকাকে জড়িয়ে ধরে এক পাক ঘুরে নিয়ে সাহেবা বললেন, “পাঁইফলটা এত সুন্দর মেখেছিলে মামণি, আমি সবগুলো খেয়ে ফেলেছি। তোমার জন্য একটাও রাখতে পারিনি। কাল লোকটা গেলে আবার কিনব, বেশ?”
অলকা দ্রুত স্থানত্যাগ করলেন। মাথাটা বড্ড তেতে উঠছে, ঠান্ডা না করলেই নয়। মনের গরল কারও কাছে উগরাতে পারলে একটু শান্তি হত, কিন্তু তা করবেন কার কাছে? মৃগাঙ্ককে কিছু বলার উপায় নেই। তাঁর মুখে এক কথা, “ও একটা বাচ্চা মেয়ে, নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছে। ওকে একটু আদর যত্ন না করলে চলে, বলো?”
চোখ ফেটে জল আসে অলকার। ধামাচাপা স্মৃতিরা সব ধামার তলা থেকে বেরিয়ে নাচানাচি শুরু করে দেয় মনে। রানির চেয়েও অল্প বয়সে মা-বাবাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন অলকা। বাপসোহাগি বেটি তিনিও ছিলেন, কিন্তু... না থাক, সাত সকালে ও সব স্মৃতি কিছুতেই আজ মনে আনবেন না অলকা। শ্বশুরবাড়িতে যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনা পাওয়াকে এ দেশের মেয়েরা ভবিতব্য বলে মানে, তিনিও মেনে নিয়েছেন। জ্বালা ধরে কেবল রানির প্রতি মৃগাঙ্কর এই আদিখ্যেতাগুলো দেখলে। তাঁর বেলায় মৃগাঙ্ক মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন কেন? সত্যি বলতে, অলকার যত না কষ্ট তখন হয়েছিল, মৃগাঙ্কর ব্যবহার দেখে এখন হয় তার চেয়ে ঢের বেশি।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)