26-11-2022, 09:47 PM
(This post was last modified: 27-11-2022, 03:44 PM by Bumba_1. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
~ অশনি সংকেত ~
প্রায় পাঁচ ঘন্টার জার্নি। ক্লান্তিতে কিছুটা ঝিমুনি এসে গিয়েছিলো অভীকের। আর মাত্র দুটো স্টেশন, তারপরেই তো নামতে হবে .. তার পিসতুতো ভাই সুব্রত সেরকমই বলেছিলো। এই শীতের রাতে তার চন্দননগরের বাড়ির নরম বিছানা ছেড়ে সুদূর ঝাড়খন্ডের এই প্রত্যন্ত রেলরুটের বকুলতলা গ্রামে আসার কারণ তার রাঙাপিসি।
বকুলতলায় অভীক শেষবার তার মা-বাবার সঙ্গে এসেছিল প্রায় বছর কুড়ি আগে। তারপর থেকে আর কখনও আসা হয় নি। কিছুটা দূরত্বের জন্য তো বটেই আর কিছুটা অবশ্যই তার বাবার জেদ। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পিসেমশাইয়ের সাথে অভীকের বাবার নাকি তুমুল অশান্তি হয়। তারপর থেকেই মা ফোনে যোগাযোগ রাখলেও বাবা এড়িয়েই চলতো রাঙাপিসির পরিবারকে। এখন আর বাবা বেঁচে নেই, পিসেমশাইও গত হয়েছেন। অভীকের বাবার বাড়ির তরফে আর কেউ এই পৃথিবীতে নেই, এই এক রাঙাপিসি ছাড়া। এবার তার মাও আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু চিরদিনের অ্যাজমার পেশেণ্ট তার মা ভারতী দেবীকে নিয়ে এই ঠাণ্ডায় এতদূর নিয়ে আসার 'রিস্ক' নেয়নি অভীক।
হঠাৎ একটা ঝাকুনিতে ঝিমুনিটা কেটে যায় অভীকের। কম্পার্টমেন্টের অল্প আলোয় তার চশমার ওপারে কাউকে দেখতে পায় না সে। 'আরে .. কম্পার্টমেন্টের সবাই নেমে গেলো নাকি!' কিছুটা হলেও অবাক হয় অভীক। ভীড় ছিলো না তেমন, তবে সামান্য দু-একজন যারা ছিলো, গেলো কোথায় সব? আরও অবাক হয় এটা ভেবে যে, 'ট্রেন কি তবে কোনো জংশন স্টেশনে পৌঁছে গেলো নাকি?' না, তাও তো নয় ! ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে আবছায়াতে কোনো এক 'পলাশপুর' রেল স্টেশনের নাম পড়তে পারলো সে। কিন্তু তার পিসতুতো ভাই সুব্রত বারবার তাকে যে বলে দিয়েছিলো দক্ষিণগঞ্জের পরেই বকুলতলা।
তার তো হিসেবমতো একটা স্টেশন পার হওয়ার কথা ! তবে কি সুব্রত ভুল বললো? পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখতে পেলো ফোনের চার্জ ২% দেখাচ্ছে। ব্যাগের ভেতর অনেক খুঁজেও সেই মুহূর্তে ফোনের চার্জার পেলো না সে, তবে কি আনতেই ভুলে গেছে চার্জারটা! এবার সামান্য হলেও একটু ভয় পেলো অভীক। আকাশের সিলুয়েটে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের ভেতর পাবলিক টয়লেট ছিলো না। এতক্ষণ ধরে হাল্কা হতে না পারার জন্য ভিতরে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। তাই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কিছুটাই ইতস্ততঃ করেই প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লো অভীক।
খুব একটা বড়ো স্টেশন নয়। ঘড়িতে তখন রাত দশটা পঁচিশ। প্লাটফর্মে দু-একটা অল্প পাওয়ারের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। একটা গা শিরশির করা ঠাণ্ডা হাওয়া, তার সঙ্গে কিসের যেন চাপা দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। আর এর বাইরে শুধুই শ্মশানের নিস্তব্ধতা। কিন্তু এতবড় একটা ট্রেনে কি সে একাই একজন যাত্রী ছিলো! তার থেকেও বড় ব্যাপার হলো তার আগে যারা এখানে নেমেছিলো, তাদের দেখতে পেলো না অভীক। যে কারণের জন্য অর্থাৎ একটু হাল্কা হওয়ার উদ্দেশ্যে এই প্ল্যাটফর্মে নামা .. আবছায়া আলোয় একটা টয়লেট চোখে পড়াতে সেইদিকে দ্রুতপায় এগিয়ে গেলো অভীক। সবে টয়লেট করা শেষ হয়েছে, সেই মুহূর্তে অভীক দেখতে পেলো সাইরেন বাজিয়ে ট্রেনটা আচমকা সরে পড়তে শুরু করেছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। হঠাৎ করে ট্রেনের গতি এতটাই বেড়ে গেলো যে দৌড়ে ট্রেনের কামড়ায় উঠতে গিয়ে পা মচকালো তার .. মাটিতে পড়ে গেলো অভীক। ট্রেনের পিছনের লাল আলোটা টিপ টিপ করে জ্বলতে জ্বলতে শেষ আশার মতো দূরের কুয়াশাতে মিলিয়ে গেলো।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা এসে যাওয়ায় এই শীতেও তার বেশ গরম লাগতে শুরু করলো। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা আছে; তাই ব্যাগটাকে চেপে ধরে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে এগোলো সে। অবাক কান্ড! এই অদ্ভুতদর্শন স্টেশনে কি কোনো স্টেশন মাস্টারও নেই? পলেস্তারা খসা ঘরটার গায়ে একটা নোটিস দেখে থমকে গেলো অভীক। জংধরা প্রায় ফিকে হয়ে আসা লাল রঙের একটি নোটিশবোর্ডে লেখা আছে 'আ লো নি ভি য়ে রা খু ন'। উপর থেকে নীচে আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষরগুলো সাজানো। এমন অদ্ভুত নোটিশ কেনো, এগুলো কি কোনো অশনি সংকেত .. সে ভেবে অবাক হলো। তাই কি স্টেশনটা এমনধারা অন্ধকারাচ্ছন্ন? আর তখনই স্টেশন চত্বরে ধীরে ধীরে অন্ধকারের বুক চিরে একটা ট্রেন এসে থামলো।
যাক, শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া গেলো তাহলে। অভীক লক্ষ্য করলো এই ট্রেনটিও এত রাতে প্রায় জনশূন্য। 'প্রায়' জনশূন্য এই কারণে যে, ট্রেন থেকে কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট দূরে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে নামতে দেখলো সে। তারপর দেখলো ট্রেন থেকে নামা লোকগুলি হাত নেড়ে তাকে ডাকছে ! ছ্যাঁৎ করে উঠলো তার বুকটা। ডাকাত নাকি ? মুহূর্তের মধ্যে অভীকের পা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গেলো .. চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ট্রেনটা। চাপা অস্বস্তিকর দুর্গন্ধটা আরো প্রকট থেকে প্রকটতার হতে শুরু করলো। মুহূর্তের মধ্যে লোকগুলো তাকে ঘিরে ফেললো .. মোট আটজন ব্যক্তি। তাদের মুখের দিকে তাকাতেই সে লক্ষ্য করলো সবাইকে যেন হুবহু একরকম দেখতে, কিন্তু কারোর চোখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না .. ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শব্দটা মনে পড়লো তার। ভয়, উত্তেজনায় এবং কনকনে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো অভীক। বিস্ময়ের চরম মুহূর্তে তাকে অতিমাত্রায় বিস্মিত এবং আতঙ্কিত করে সেই অদ্ভুত নোটিশবোর্ডটা চকচক করে উঠলো। সেখানে তখন পাশাপাশি লেখা আছে 'আটজন লোকের নির্জন ভিড় হয়ে খুন হবে নয়'। লোকগুলোর প্রত্যেকের হাতে তখন দড়ির ফাঁস। তারপর ? তারপর সব অন্ধকার।
অভীকের ঘুম ভাঙলো তার রাঙাপিসির বাড়িতে। পিসিমা তার আসার দিন রাতেই বিপদমুক্ত হয়েছিলেন। সুব্রত অনেক খুঁজে সেই রাতের পরেরদিন দুপুরে পরিত্যক্ত 'পলাশপুর' স্টেশনের ধার থেকে তাকে উদ্ধার করে। পরে অভীক জানতে পেরেছিলো, পলাশপুর স্টেশনে বহুকাল আগে ট্রেন থামতো ঠিকই। কিন্তু কোনো এক মড়কে ওই জনপদের বেশীরভাগ লোক মারা যায় আর বাকিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। তারপর থেকে রেল কর্তৃপক্ষ ওই স্টেশন যাত্রী অভাবে বন্ধ করে দেয়। তবে সিগনাল না পেয়ে কখনও কখনও ট্রেন ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে।
রাঙাপিসির বাড়ির বহুদিনের পুরনো বুড়ো চাকর হরি'দা তাকে আরও জানিয়েছিলো বছর পঁচিশ আগে দূরে কোনো এক গ্রামের আটজন ব্যক্তি কোনো একটি বিষয়ের বদলা নিতে তাদের আর এক বন্ধুকে খুন করার উদ্দেশ্যে ডেকেছিলো ওই পরিত্যক্ত স্টেশনে। নবম বন্ধুটি না এলেও সেই আটজনেই রহস্যজনকভাবে মারা পড়ে ওখানে .. যার কারণ আজও অজানা। তবে সেই আটটি অতৃপ্ত আত্মা নাকি সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আর নির্জন ওই স্টেশনে রাতে কেউ একা নামলেই তাদের সেই নয় নম্বর বন্ধু ভেবে তাকে খুন করার চেষ্টা করে। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর নিজেকে সামলে নিয়ে অভীকের কাছে মোটামুটি সবকিছু পরিষ্কার হলেও সেই অদ্ভুতুড়ে নোটিশবোর্ডের সংকেতগুলো তাকে আজও ভাবায়। আরও একটা ব্যাপারে সে অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি .. সেদিনের ট্রেনে তার সহযাত্রীরা ওই স্টেশনে নেমে গিয়েছিলো কোথায়?