Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
 দু'জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চরমসীমায় পৌঁছেছিল। একসময় নিজের একটা হাত দিয়ে ওসমানের দুটো হাত মাথার উপর তুলে সেটাকে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে বিধর্মীটার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এসে ওসমানের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গোগোল বললো "তুই যতবার আমার মায়ের কথা বলবি .. ততটাই যন্ত্রণাদায়ক হবে তোর মৃত্যু। ঠিক যেভাবে ওই নেপালিটার হয়েছে, ঠিক যেভাবে নিশীথ বটব্যালের হয়েছিলো, আমি অবশ্য আমার দিদাকে এতটা কষ্ট দিয়ে মারিনি। হ্যাঁ, একদম কারেক্ট আছে। আমি তো তোর চোখে এই ভয়টাই দেখতে চেয়েছিলাম। এই বাঁচার আকুতিটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম আমি। এটাকে কি বলে জানিস তো? মরার আগেই মরে যাওয়া। এবার তোর যাওয়ার পালা .. তবে যাওয়ার আগে, এক মিনিট .. তুই তোর এই নোংরা চোখ দিয়ে আমার মায়ের শরীরটাকে দেখেছিলিস, তাই না? সেই চোখ তো আমি অক্ষত অবস্থায় তোমার দেহের সঙ্গে দান করতে পারবো না আঙ্কেল। ও আঙ্কেল, আঙ্কেল গো .. শুনছো আমার কথা? বুঝতে পারছিস আমি কি বলতে চাইছি? আমি আসলে এটাই বলতে চাইছি যে, এইভাবে .. এইভাবে ঠিক এইভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোর চোখ দুটো আগে অন্ধ করে দেবো .." কথা বলা শেষ হলো না তার আগেই ওসমানের মুখটা চেপে ধরে গোগোল মাটি থেকে শলাকাটা তুলে নিয়ে বিধর্মীটার দুই চোখ ক্রমাগত কোপাতে শুরু করে দিলো। 


অপরিসীম যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে যমদূতটার গগনভেদী চিৎকার গোঙানিতে পরিণত হলো গোগোলের বাঘের থাবার মতো পাঞ্জার নিচে। "তোমার যন্ত্রণার এখনো অনেক বাকি আঙ্কেল .. ও আঙ্কেল .. নিরীহ অসহায় মানুষদের চিরতরে ধ্বংস করে যে অমানুষ পৈশাচিক আনন্দলাভ করে তাকে তো এত সহজে মরতে দেওয়া যাবে না। চোখের মাথা তো খেয়ে নিয়েছো। এবার তোমার শরীরের সব থেকে গর্বের যে জিনিসটা, যেটা দিয়ে কত যে অসহায় মহিলার সতীত্ব হরণ করেছো, তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না। তুমি মরে গেলে তোমার বডিটা তো জাহান্নামে চলে যাবে। কিন্তু তোমার হাতিয়ার, যেটা নিয়ে তুমি নাকি ভীষণ গর্ব করো। সেটাকে তো সংরক্ষণ করে রেখে দিতে হবে। তাই না আঙ্কেল?" কথা বলতে বলতেই শলাকার পরিবর্তে গোগলের হাতে উঠে এলো ধারালো চপারটা, তারপর মুহূর্তের মধ্যে বিধর্মীটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরুষাঙ্গটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো তার শরীর থেকে।

ওসমানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিল গোগোল। আসলে তখন আর বাধা দেওয়া, যন্ত্রণায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয় চিৎকার করা .. এর কোনো অবস্থাতেই ছিলো না সে। এতক্ষণ মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকলেও এখন মনে-প্রানে মৃত্যুকেই আহ্বান করে যাচ্ছিলো ওসমান মন্ডল। এই বিভীষিকাময় যন্ত্রণা আর যে তার শরীর নিতে পারছে না। চোখ দুটো আগেই অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই গোগোলকে চাক্ষুষ দেখতে না পেলেও তার উপস্থিতি অনুধাবন করে সেইদিকে হাতজোড় করে বলে উঠলো "আমি আমার সব দোষ স্বীকার করছি, আমি মহাপাতক। এবার .. এবার পুরোপুরি শেষ কর আমাকে, জ্বালা জুড়োক শরীরের। তুই তো আমার সন্তানের মতো, তোর কাছ থেকে আমি মৃত্যুভিক্ষা চাইছি।"

এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো গোগোল। ছলে-বলে-কৌশলে বা শক্তি দিয়ে শত্রুর বিনাশ তো অবশ্যই করা যায়, কিন্তু উল্টো দিকের ব্যক্তি যখন মৃত্যুবরণ করার আগে হাতজোড় করে তার সমস্ত দোষস্বীকার করে মৃত্যুভিক্ষার অনুরোধ করে .. তার মতো তৃপ্তিদায়ক পরিস্থিতি বোধায় খুব কমই হয়। গোগোল আর সময় নষ্ট না করে অর্ধমৃত ওসমানের একটা হাত ধরে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে "তবে তাই হোক .." এইটুকু বলে তার পেটের ভেতর তীক্ষ্ণ শলাকাটা ঢুকিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে তাকে বিছানার উপর ফেলে দিলো। তারপর হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বর্ণালী ম্যাডাম খাটের উপর উঠে বসে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। 

কিন্তু এই ভোররাতে প্রেসারকুকারে সিটি‌ কোথা থেকে আসছে? কিছুই বোধগম্য হলো না তার। "এই গোগোল ওঠ, অনেক বেলা হলো কিন্তু। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। আমাকে দশটার মধ্যে বেরোতে হবে। তাড়াতাড়ি মুখ হাত-পা ধুয়ে বাজারে যা। তুই এলে তবে রান্না চাপাবো।" সুজাতার গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো গোগোলের।

"তুমি তো দুপুরে চলে আসবে বললে, তখন তাহলে একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। আজ আর ভাত খেয়ে যাওয়ার দরকার নেই। রসময় মোদকের দোকান থেকে গরম গরম কচুরি আর মালপোয়া নিয়ে এসেছি। গরম থাকতে থাকতে তাড়াতাড়ি বেড়ে দাও তো, দু'জনে মিলে খাই। আর এই নাও তোমার টাকা। আজ আমি আমার টাকায় বাজার করেছি। ছেলে এখন বড় হয়েছে, এইটুকু স্বাধীনতা তো ছেলেকে দেবে, নাকি?" রান্নাঘরের সামনে বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বললো গোগোল।

- "ঠিক আছে দিতে পারি তোকে স্বাধীনতা, কিন্তু আজ একটা প্রমিস করতে হবে তোর মামণির কাছে। অতীতে যা হয়েছে .. হয়েছে। সেই ব্যাপারে আমি কিছু জানতেও চাই না, কিছু শুনতেও চাই না। এমনকি আমাদের এই বস্তির সমস্যার ব্যাপারেও গতকাল যা বললি, তার সবকিছুই আমি মেনে নিলাম। এই ব্যাপারে তোর সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রাখবো। কিন্তু আমাকে এখন একটা কথা দিতে হবে .. তোকে এই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের হাতে আর কখনো আইন তুলে নিবি না, প্রতিজ্ঞা কর আমার সামনে। যাতে আমি উপরে গিয়ে তোর মায়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, তোর মায়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি।"

- "জানো তো মামণি, কাল রাতে হঠাৎ জীবনের সাথে দেখা। হ্যাঁ গো হ্যাঁ সত্যি বলছি। আরে জীবন, জীবন .. বুঝতে পারলে না? লাইফের কথা বলছি। যাই হোক, ও আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি গিয়ে খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম - অনেক খোঁজার পর আজ পেয়েছি তোকে, কথা না বলে চলে যাচ্ছিস যে বড়! তোকে আজ বলতে হবে সবকিছু, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমার। কেনো আমার চলার পথে প্রতি পদে পদে বাধা? কেনো এত বিপুল অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় সর্বক্ষণ? তারপর কোনো কথা নেই .. সব নিঃস্তব্ধ। দু'জনের দৃষ্টি বিনিময় হলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে। এরপর আমার হাতে এক টুকরো রঙিন কাগজ গুঁজে দিয়ে ও বললো 'এটা জীবন-বীমা নয়, অবসরে পরে নিও না হয় ..' তারপর, তারপর জানো তো মামণি হঠাৎ করেই বলা নেই কওয়া নেই, কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো ও .. আর খুঁজেই পেলাম না।"

- "কি লেখা ছিলো যে, ওই এক টুকরো রঙিন কাগজে?" অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো সুজাতা

- "শুনবে? শুনবে মামণি? অপেক্ষায় থমকে সেই দুঃস্বপ্ন, আজও উৎকণ্ঠায় ধিকি ধিকি আগুনের আঁচে বেঁচে আছে। দু'চোখের বানভাসি জলে ধুয়ে যাক অতীত। থাকুক শুধু আমার সোনালী স্বপ্ন মাখা বর্তমান। জীবনের গাড়িটা পিছনে টার্ন করে ফিরে যাই এক অন্যরকম অতীতে .. যেখানে নেই কোনো দুঃস্বপ্ন, নেই কোনো খারাপ স্মৃতি .. আছে শুধুই ভালোলাগার পরশ। যেখানে তারার চাদরে মোড়া উজ্জ্বল আকাশের নিচে গন্ধরাজ, বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, বকুলফুলের মিষ্টি সুবাস এক ভালোলাগার আবেশে ভরে যেতো মন-প্রাণ। ক্ষমা করো হে স্বপ্নের অতীত, ভাগ্যের পরিহাস আমি মেনে নিয়েছি। এই হাত আর পাপ কাজ করবে না, ধরবে না কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র। আসলে বয়সের যোগফল নিমিত্ত সংখ্যা মাত্র। এভাবেই মনের আনাচে-কানাচে পরে থাকে কিছু ব্যর্থ আশা। সময় সুযোগে ওরা এসে হানা দেয়, আদায় করে নেয় সর্বস্ব সুদে আসলে। দুঃস্বপ্নের অতীত তোমাকে আমি ভুলতে চাই। তুমি অপেক্ষা করো তোমার চতুর্দশীর। আমি চললাম আমার স্বপ্নে সাজানো ভবিষ্যতে। ঠিক যেন বর্ষামুখর রাতে পালতোলা নৌকোর মাঝি পথ হারিয়ে ছুটে চলছে দেখবে বলে নতুন ভোরের সূর্যোদয়।"

সুজাতার চোখ দিয়ে ততক্ষণে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে।

★★★★

লালু আলম আজকাল বেজায় খুশি এবং কৃতজ্ঞ গোগোলের প্রতি। তার ধারণা অনুযায়ী ওর প্রতিটি পদক্ষেপ এখন একেবারে সঠিকভাবে হচ্ছে। বর্তমানে তার সব থেকে বড় শত্রু বিধায়ক মানিক সামন্তর গুটিগুলো একে একে সরে যাচ্ছে আর তার এগিয়ে চলার পথ মসৃণ হয়ে উঠছে। আজ আলম সাহেবের বাংলোতে তাই আইটেম ডান্সের আসর বসবে .. শহর থেকে জোহরাবাঈ আসছে। তার সঙ্গে ছুটবে মদের ফোয়ারা। গোগোল আজ তার কর্মক্ষেত্র মানে ওই মুখো আর হয়নি। কারণ এইসব অপসংস্কৃতি তার ভালো লাগেনা .. একথা আগেই জানিয়ে দিয়েছে আলম সাহেবকে। সেও আর জোর করেনি গোগোলকে .. শুধু শুধু হাতের তুরুপের তাসকে চটিয়ে কি লাভ!

"গুরু .. দুটো গাড়ি ঢুকেছে আমাদের রেলপাড়ের বস্তিতে। বিদেশী গাড়ি .. অনেক দামি হবে মনে হয়। কে এলো বলো তো .. আলম সাহেব নাকি অন্য কেউ? তুমি একবার চলো গুরু .." মধুর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছিলো গোগোল। সেখানে কাঞ্চন এসে তাকে কথাগুলো বলাতে "না না, লালু আলম এখন এদিকে আসবে না, চল তো দেখি .. যাওয়ার আগে সুবীর আর রাজুকে নিবি নিবি।" উঠে পড়লো গোগোল।

ক্লাবের ঠিক সামনে দাঁড় করানো রয়েছে একটা সাদা এবং একটা মেটালিক গ্রে কালারের Audi গাড়ি। খবরটা শুনে গোগোল আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিলো, এই সময় কাদের আগমন ঘটতে পারে এখানে। গাড়ি দুটো দেখে সে নিশ্চিত হলো কামরাজ এসেছে তার দলবল নিয়ে এখানে। নিজের দলের লোকেদের চোখের ইশারায় প্রস্তুত হতে বলে গাড়ি দুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো গোগোল। মেটালিক গ্রে কালারের গাড়িটা থেকে প্রত্যাশা মতোই নেমে এলো বনমানুষের মতো চেহারার, কদাকার মুখের কামরাজ। চেহারার সেই অর্থে কোনো পরিবর্তন হয়নি, বয়সের ভারে শরীরটা আরো মেদবহুল হয়েছে, তার সঙ্গে প্রশস্ত হয়েছে মাথার টাক .. এই পর্যন্তই। লোকটাকে দেখে মুহূর্তের মধ্যে পূর্বের সমস্ত স্মৃতি ঘুরেফিরে আসতে লাগলো গোগোলের মনে। এইতো সেই ব্যক্তি .. যে তাদের পরিবারের ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ। মাথার রগটা দপদপ করতে শুরু করে দিলো, সেই সঙ্গে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেলো তার। আজ সকালে মামণির সামনে প্রতিজ্ঞা না করলে এখনই হয়তো ভালো-মন্দ কিছু একটা ঘটে যেতে পারতো।

"আরে এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ভেবেছিলাম আজ বস্তি খালি থাকবে। কিন্তু তুমি আছো দেখছি। নমস্কার অনির্বাণ বাবু .. তুমি আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট, তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি। দেখো আমি কোনো ঝামেলা বা ঝগড়ায় যেতে চাই না। আজেবাজে কথা না বলে একদম কাজের কথায় আসি তাহলে! আমাদের আটকাতে যার হয়ে কাজ করছো তুমি, তোমার কি ধারনা সে এখানে মন্দির বানাবে? আমরা এখানে যা করবো, সেও এখানে তাই করবে। শুধু তফাৎ একটাই, আমাদের বানানো জিনিসগুলো হবে আরো উন্নতমানের এবং যেহেতু আমরা জনদরদী মানুষ, সর্বোপরি একজন জনদরদী নেতা যখন আমাদের সঙ্গে আছে, তখন এই বস্তির জনগণকে আমরা কেউ বঞ্চিত করবো না। প্রথম ক'দিন বাইরে গিয়ে কোথাও ভাড়া থাকতে হবে তারপর এখানে আমাদের প্রজেক্ট শেষ হলে তোমাদের প্রত্যেককে পুনর্বাসন দেবো। আর যাদের এখানে ব্যবসা আছে, দোকান-টোকান আছে .. তাদের শপিংমলে জায়গা করে দেবো। এবার বলো আমার প্রোপজলটা কেমন লাগলো? রাজি তো তোমরা সবাই?" গাড়ি থেকে নেমে গোগোল আর তার পাশে এবং পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গুটিকয়েক বস্তিবাসীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো কামরাজ।

"তাই নাকি? যে কথাগুলো মুখে বললেন, অর্থাৎ পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যাপারটা। সেটা স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে পারবেন? আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয় .. এই বস্তির যে অংশটুকু জুড়ে ওরা থাকে বা আমরা থাকি, সেখানে প্রত্যেকের নামে অগ্রিম দলিল বানিয়ে দিতে পারবেন? কারণ এই বস্তির বাসিন্দারা সরকারের দেওয়া দানপত্রের জমিতে বাড়ি করে বা ভাড়া থেকে বসবাস করছে। তাদের নিজের নামে এখনো পর্যন্ত কোনো দলিল তৈরি হয়নি। আমাদের কাছে এখানে বসবাস করার একটাই প্রমাণ .. ওই সরকারি দামপত্র। আপনার পার্টনার মানিক সামন্তকে বলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। তবে শীঘ্রই হবে, এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। যাইহোক, আপনারা এখানে প্রজেক্ট শুরু করলে সেই দানপত্র আপনাদের নামে করে দিতে হবে। তাই একবার এখান থেকে তারা উচ্ছেদ হয়ে গেলে এখানে ফিরে আসার কোনো সরকারি প্রমাণ আর থাকবে না আমাদের কাছে। আর শপিংমলে দোকান করে দেওয়ার কথা বলছেন? এইতো আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চন .. ওদের বাসনের দোকান। ওই যে ওই পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুবীর .. ও মাছের ব্যবসা করে। আমার ডান দিকে মধু, যে দাঁড়িয়ে আছে .. ওর চায়ের দোকান আর আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজুর পান বিড়ি সিগারেটের দোকান এই বস্তিতে। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন আপনাদের ওই ঝাঁ চকচকে শপিংমলে এই সবকিছুর ব্যবসা করতে পারবে ওরা?" মুচকি হেসে, কিন্তু দৃঢ় গলায় কথাগুলো বললো গোগোল।

"নেতা .. নেতা হয়েছো তুমি, তাই না এদের সবার? ভেবেছিলাম কোনো বাকবিতণ্ডায় যাবো না। এখন দেখছি চাপকে পিঠের চামড়া তুলে নিলেই ঠিক হতো।" কামরাজের এইরূপ উক্তিতে তার দিকে ক্ষিপ্রতিতে তেড়ে গিয়ে সুবীর বললো "খুব সাবধান .. গুরুর গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা, ওর একটা চুল ছুঁয়ে দেখুন না, মাছ কাটার বটি দিয়ে গলা নামিয়ে দেবো একেবারে।"

সেই মুহূর্তে পেছনের সাদা রঙের Audi গাড়িটার দরজা খুলে গেলো। সেখান থেকে নামলো একজন গৌরবর্ণা, আকর্ষণীয়া বছর পঁচিশের সুন্দরী যুবতী। যা পরনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটি খাটো ঝুলের কালো রঙের ফরমাল স্কার্ট এবং উপরে সাদা শার্টের উপর ওই স্কার্টের রঙের একটি সুদৃশ্য ফর্মাল কোট। "কাম ডাউন কাম ডাউন .. এখানে এত চেঁচামেচি কিসের? উফ্ ভীষণ ডার্টি প্লেস। এখানে মাল্টিজিমটা কোথায় হবে তার পজিশনটা কিন্তু আমি ঠিক করবো ড্যাডি।" গাড়ি থেকে নেমে কামরাজের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে, গোগোলের দিকে তাকিয়ে সেই যুবতী বলে উঠলো "ও মাই গড .. আর ইউ অনির্বাণ? গাড়িতে বসে তোমাকে দেখতে দেখতে আমার সন্দেহ হয়েছিলো। কারণ ড্যাডির কাছ থেকে শুনেছিলাম তোমরা এই বস্তিতেই এসে উঠেছো। কিন্তু এখন গাড়ি থেকে নেমে ভালো করে তোমাকে দেখে সিওর হলাম .. ইয়েস ইউ আর অনির্বাণ। উফফফ ইউ আর লুকিং ভেরি ভেরি হ্যান্ডসাম। তার উপর এই beard look এ জাস্ট ফাটাফাটি লাগছে তোমাকে। আরে আমি রনিতা .. রনিতা দিদি, একসঙ্গে গাড়ি করে কলেজে যেতাম। মনে পড়েছে এবার? বাট প্লিজ ডোন্ট কল মি 'দিদি' রাইট নাউ .. কল মি ওনলি রনিতা .. ডিড ইউ গেট দ্যাট?"

"হ্যাঁ মানে, না মানে এইবার চিনতে পারলাম। আসলে অনেক পুরনো কথা তো, মনে পড়ে না সবকিছু আর মনে রাখতেও চাই না।" কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দিলো গোগোল। "মনে রাখতে চাই না বললে তো হবে না ডিয়ার, এবার থেকে তোমার সব সময় যাতে সব কিছু মনে পড়ে সেই চেষ্টাই করা হবে। এনিওয়েস, এই প্রথম তোমাদের বস্তিতে এলাম, আমাকে একটু ঘুরে দেখাবে না সবকিছু?" গোগোলের আরো কাছে এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বললো রনিতা।

"কোনো দরকার নেই সবকিছু ঘুরে দেখার। আপনি আর আপনার গুণধর বাবা তো এখানে ধান্দায় এসেছেন। আপনার বাবা এসেছে ছলে, বলে, কৌশলে এখানকার লোকগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বস্তিটাকে করায়ত্ত করার জন্য, আর আপনি এসেছেন মাল্টিজিম কোথায় হবে তার পজিশন দেখার জন্য। আপনাদের দেখাশোনা কথাবাত্রা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই, এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ুন তো এখান থেকে।" ঝড়ের গতিতে গোগোল আর রনিতার ঠিক মাঝখানে এসে উপস্থিত হয়ে কথাগুলো বললো হিয়া। 

"হেই .. হু দ্য হেল আর ইউ? এইসব কথা বলার তুমি কে? সাচ এ ডার্টি প্লেস এন্ড ডার্টি পিপল।" বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিরক্তিভরে উক্তি করলো রনিতা।

"এতই যদি ডার্টি প্লেস আর ডার্টি পিপল হয় .. তাহলে ফুটুন না এখান থেকে। দাঁড়িয়ে আছেন কেনো এখনো? আপনার তো বিয়ে হয়েছিলো শুনেছিলাম। অথচ এখনো বাবার বাড়িতেই থাকেন। কি অদ্ভুত সব ব্যাপার স্যাপার! শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এডজাস্ট করতে পারলেন না, নাকি শরীরে কোনো খুঁত-টুঁত আছে .. যে স্বামী এসে বাপের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গেছে? অল্পবয়সী পরপুরুষ দেখলেই খালি ছোঁকছোঁক করা, তাই না? ঢলানি মেয়েমানুষ কোথাকারে। আর এই মানুষটাও হয়েছে তেমনি। এতক্ষণ ওর বাপটার উপর হম্বিতম্বি করছিলো পুরুষমানুষ বলে। যেই দেখেছে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, অমনি মিনমিন করা শুরু করে দিয়েছে। সাধে কি আর বলি .. তোমাদের গুরুর চরিত্রের ঠিক নেই।" ঝাঁঝিয়ে উঠে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো হিয়া।

হিয়ার এইরকম রণচন্ডী মূর্তি আর মুখে এই ধরনের অজানা-অচেনা ভাষা এর আগে কোনোদিন দেখেনি বা শোনেনি গোগোল। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সে স্বপ্ন দেখছে নাকি এটা ঘোরতর বাস্তব সেটা বোঝার জন্য এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকেই একবার চিমটি কেটে দেখলো সে। 

"হাউ ডেয়ার ইউ? এই মেয়েটা এখানে দাঁড়িয়ে একভাবে আমাকে অপমান করে যাচ্ছে, আর তুমি কিচ্ছু বলবে না অনির্বাণ? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে? এই নাকি তুমি এদের গুরু, এদের হিরো?" কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো রনিতা।

"আ..আমি আবার কি বলবো? কিছু না বলে, কিছু না করেই যখন এত কথা শুনছি! তাহলে এরপর আর একটা কথা বললে যে কি হবে, সেটা শুধু আমিই বুঝতে পারছি। আপনি মানে তুমি বরং যাও এখান থেকে। এলাকার লোকজন কিন্তু তেতে আছে, তোমাদেরই বিপদ হবে।" এইটুকু বলে রাজুর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো গোগোল।

"এত কথা শোনার পরেও যে আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা দেখেই আমি অবাক হচ্ছি। রিড মাই লিপস .. জাস্ট গেট লস্ট.." রনিতার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কথাগুলো বললো হিয়া। "ঠিক আছে এখন চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসবো .. তখন কিন্তু ঝড় উঠবে। আর একটা কথা মনে রেখো - আমার কোনো জিনিস চোখে লেগে গেলে, সেটা জড়বস্তু হোক বা রক্তমাংসের মানুষ .. আমি কিন্তু সেটা হাসিল করে তবেই ছাড়ি। চলো ড্যাডি .." হিয়ার উদ্দেশ্যে রনিতা কথাগুলো বলার পর, দু'জন দুই গাড়িতে উঠে হুশ করে বেরিয়ে গেলো।

"আর এই যে মশাই .. পেত্নীটাকে তো বিদায় করলাম। এবার তোমার ভূত কি করে ছাড়াতে হয় সেটা দেখছি। বাড়ি চলো .. কথা আছে।" জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গোগোলের উদ্দেশ্যে হিয়ার কথাগুলো শুনে সুবীর বলে উঠলো "হ্যাঁ বৌদি, এই ব্যাপারে আমরা কেউ গুরুকে সাপোর্ট করবো না। আমরা সবাই কিন্তু তোমার দলে, তুমিই একমাত্র পারো গুরুকে সোজা করতে।" চারিদিকে একটা হাসির রোল উঠলো।

"এ্যাই .. আমি কিছু বলছি না বলে তোদের সাহস বড্ড বেড়ে গেছে তাই না? ওকে 'বৌদি' বলে ডাকছিস কেনো? কথাটা যদি পাঁচকান হয়ে যায়, তাহলে আবার একটা অশান্তি শুরু হবে কিন্তু।" সুবীর এবং বাকিদের উদ্দেশ্যে কিঞ্চিত প্রশ্রয়সূচক ভর্ৎসনার সুরে কথাগুলো বললো গোগোল। 

"আজ বৌদি হয়নি, কিন্তু একদিন তো হবেই .. তাই এখন থেকেই সম্বোধনের প্র্যাকটিসটা সেরে রাখা ভালো .." এই কথা বলে কাঞ্চন এবং তার সঙ্গে বাকিরা  যে যার কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এদিকে গোগোল আর হিয়া পরস্পরের হাত ধরে বাড়ির অভিমুখে হাঁটতে লাগলো।

(ক্রমশ)



ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন

[Image: Animation-resize-gif-f3b601eb23d95beeb4e...911ac0.gif]


Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Bumba_1 - 24-11-2022, 08:49 PM



Users browsing this thread: 61 Guest(s)