19-11-2022, 12:57 PM
দেয়ালের_ওপারে
পর্ব-০২
লেখক-সবুজ আহম্মদ মুরসালিন
===================
আলিফ তার মা'য়ের সাথে ঝগড়া করে, রেগে বাসা থেকে বেড়িয়ে, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে ছিলো। ঠিক সেই মুহুর্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা একটা কিশোরী মেয়ের সাথে তার জোরেসোরে ধাক্কা লাগে এবং সাথেসাথে তারা দু'জনেই পড়ে যায়। আলিফের কিছু না হলেও, সে দেখলো কিশোরী মেয়েটার কপাল কিছুটা কেটে গেছে। মেয়েটার হাতে কিছু শপিং ব্যাগ ছিলো, সেগুলো পড়ে সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।
আলিভ দুঃখিত বলে, পকেট থেকে টিস্যু বের করে মেয়েটার হাতে দেয়। সে টিস্যুটা দিতে দিতে আরেকবার দুঃখিত বলে নেয়। সে লজ্জিত সেটা প্রকাশ করে। মেয়েটা কিছু বলে না। সে শুধু গভীর ভাবে আলিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালের ক্ষত থেকে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে ভ্রুর কাছে আসতেই মেয়েটা আলিফের দেওয়া টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলে।
সিঁড়িতে পড়ে থাকা মেয়েটার ব্যাগগুলো তারাহুরো করে আলিফ উঠিয়ে মেয়েটার হাতে দেয়। মেয়েটা এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই বলেনি। আলিফ ভেবেছিলো মেয়েটা চেচামেচি করবে। কিন্তু মেয়েটা একদম চুপ। সে আলিফের হাত থেকে তার ব্যাগগুলো নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে। আলিফ তাকে ডাকে। মেয়েটা ডাক শুনেনা। আলিফের দিকে ফিরেও তাকায় না। আলিফ সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেয়েটা চলে গেলে সে নিচে নেমে আসে। একবার ভাবে ফার্মাসি থেকে ব্যান্ডেজ কিনে দিয়ে আসবে। কিন্তু সে তা করে না। মেয়েটাকে চিনলে সেটা করা যেতো কিন্তু সে তাকে চিনে না। আজই প্রথম দেখেছে। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে সে তার আড্ডাখানায় চলে আসে।
এখানে এসে সে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। অবাক হওয়ার কারণ গতকাল রাতেই সে মেসেজে তাকে বলেছে, একটা প্রেজেন্টেশনের কাজে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থাকবে। সন্ধ্যার আগে দেখা হবে না। তাই এই ভর দুপুরে তার চায়ের দোকানে বসে থাকার কথা না। সে এগিয়ে রুদ্রের কাছে যায়। রুদ্রের পাশে বসতে বসতে বলে, "কিরে দোস্ত, এই সময় এখানে। ক্যাম্পাসে যাস নেই?"
রুদ্রের ডান হাতের আঙুলের মাঝে সিগারেট। সে শেষ বারের মত সেটাতে দীর্ঘ টান দিয়ে সেটা আলিফের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর সে বাতাসে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, "ভোরের দিকে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখি। সেই থেকে খুব অস্থির লাগছে। ভালো লাগছে না। ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছে করল না, তাই আর যাই নি।"
আলিফ সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে সেটা পায়ের কাছে ফেলে পা দিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিতে দিতে বলল, "এখন কেমন লাগছে?"
"আগের মতই।" রুদ্র উত্তর দিলো।
"বাজে স্বপ্ন মানে কেমন? আই মিন, স্বপ্নে কি দেখেছিস?"
আলিফের করা প্রশ্ন উপেক্ষা করে রুদ্র বলল, "চা খাবি তো?" আলিফের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দোকানদারকে বলল, "মামা, দুইকাপ রঙ চা।"
স্বপ্নটা তরুকে নিয়ে। এই কারণে রুদ্র সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। আজকাল তরুর কথা বা তার চিঠির কথা কারো সাথে শেয়ার করতে ভাল লাগে না তার। অবশ্য প্রথম দিকে সে তার বন্ধু মহলে তরু এবং তার চিঠির কথা শেয়ার করত। কেনো জানি আজকাল সেটা করতে আর একটুও ভালো লাগে না। সে চায়, তরু এবং তার লেখা চিঠি সবটাই শুধু তার মধ্যে থাকুক। কেউ না জানুক। কারো জানার দরকার নেই!
আলিফ বুঝতে পারলো, রুদ্র চাচ্ছে না তার স্বপ্নের কথা তার সাথে শেয়ার করতে। তাই জোর করে শোনার কোনো কারণ দেখল না সে। সেও এই বিষয়টা উপেক্ষা করে বলল, "কি করবি এখন?"
"জানিনা, এখানে বসে আছি, বসেই থাকবো।" রুদ্র উদাস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।
রুদ্র পকেটে থাকা সিগারেট প্যাকেটটা বের করল। সেখান থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে আলিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "যা চা'টা নিয়ে আয়, আর সিগারেট ধরিয়ে আন।"
চা খাওয়ার মধ্যেই রুদ্রে ফোনে একটা কল এলো। নাম্বারটা তার পরিচিত। সেভ করা নেই। তবুও চেনা। এই নাম্বার থেকে প্রায়ই কল আসে। তাই নাম্বারটা সেভ করা না থাকলেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। সে ফোনটা রিসিভ করল না। চা'টা শেষ করল। তারপর উঠে দোকানের বিল পরিশোধ করে আলিফের উদ্দেশ্যে বলল, "দোস্ত, আমি বাসার দিকে যাবো। তুই কি এখানে থাকবি কিছুক্ষণ?"
"হ্যাঁ, একটু কাজ আছে। আচ্ছা তুই তাহলে যা, সমস্যা নেই।" আলিফ বলল।
আলিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুদ্র বাসার দিকে রওনা করল। গেট দিয়ে বাসায় চুকবে সেই মুহুর্তে অপরিচিত এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, "এটা কি এই গলির ২২ নাম্বার বাসা?"
"জি, এটাই। কোনো দরকার?" রুদ্র বলল।
লোকটা রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র আবার বলল, "কাউকে খুঁজছেন?"
লোকটা তার হাতে থাকা খামটা রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "এই ঠিকানাটা খুঁজছি।"
রুদ্র খামটা ধরে ঠিকানার দিকে চোখ দিতেই চোখ দুটো স্থির হয়ে রইল। খামের বাম দিকে ছোট্ট করে লেখা, "প্রেরক, তরু"। এটুকুই। প্রেরকের সম্পর্কে আরো কোনো তথ্য নেই। ঠিকানাও নেই। কিচ্ছু নেই। তবুও রুদ্র এটুকু দেখেই বুঝে গেলো এটা তারই চিঠি। তাই চিঠির ডান দিকে থাকা প্রাপকের ঠিকানা পড়তে হলো না তাকে। সে জানে সেখানে কি লেখা আছে। সে ভদ্র লোকটিকে বলল, "হ্যাঁ, এটা এই বাসারই ঠিকানা।"
"ধন্যবাদ।" ভদ্র লোকটি বলল।
রুদ্র আর কিছু না বলে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে গেলো। সে চাইলেই লোকটাকে বলতে পারতো চিঠিটা তার কাছেই এসেছে। কিন্তু সে সেটা করল না। কারণ তার আগের অভিজ্ঞতা ভালো না। গত মাসেও ঠিক এরকম হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সাথে গেটের বাইরে তার দেখা হয়েছিলো। সেবার রুদ্র তাকে বলেছিল, "চিঠিটা তার কাছেই এসেছে।" তার এই কথা লোকটা বিশ্বাস করেনি। সে আরো বলেছিলো, "আপনি চাইলে এখান থেকেই চিঠিটা আমাকে দিয়ে দিতে পারেন। আপনার কষ্ট করে উপরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।"
এই কথা শুনে লোকটা তাকে বলেছিল, "স্যার, এটা একটা কনফিডেনসিয়াল চিঠি। নির্দেশনা আছে, চিঠিতে যে ফ্লাট নাম্বার উল্লেখ আছে সেখানেই ডেলিভারি করার। তাই আপনার চিঠি হলেও এখানে আপনাকে চিঠিটা দিতে পারছি না।" লোকটা আরো বলেছিল, "সরি, স্যার। আশা করি আমাদের পলিসি আপনি বুঝবেন।"
ভদ্রলোকটার কথা শুনে রুদ্র বলেছিল, "দেখুন, ওখানে ২০৩ নাম্বার ফ্লাট উল্লেখ আছে। ওই ফ্লাটে আমিই থাকি। এবং আমিই রুদ্র।" তবুও ভদ্র লোকটা তাকে চিঠি দেয় নি। তার সাথে উপরে এসে তাকে রুমে ঢুকতে দেখে তারপর চিঠিটা দেয়। তাই সে চায় নি আগের মত আজও সেরকম কোনো ঘটনা ঘটুক।
ভদ্রলোকটি এই মুহুর্তে চিঠিতে উল্লেখিত ২০৩ নাম্বার ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। নিচে যে ভদ্রলোকটির সাথে তার কথা হয়েছে সেই ভদ্রলোকটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তাই তাকে কলিংবেলের বাজাতে হলো না।
রুদ্র তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলো লোকটা বেশ অবাক হয়েছে। চোখে মুখে প্রশ্ন। তবে ভদ্রলোকটির কিছু বলার আগেই রুদ্র বলল, "চিঠিটার প্রাপক আমিই।"
ভদ্রলোকটি চিঠিটা বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। সে কোনো প্রশ্ন করলো না। কিছুটা কৌতুহল জেগেছিল তবুও সেটা নিজের মধ্যেই রেখে দিলো।
রুদ্র চিঠিটা নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল। চিঠিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। গত সপ্তাহে আসা চিঠিটা খুব ছোট ছিলো। সে আশা করছে এই চিঠিটা যেনো দীর্ঘ হয়। তরুর ছোট চিঠিগুলো পড়ে রুদ্র প্রতিবার হতাশ হয়। তাখন তার কেবল মনে হয় চিঠিটা আরো বড় হওয়া দরকার ছিলো। তরু ইচ্ছে করে অনেক কথা উপেক্ষা করে গেছে। কিন্তু তার এটা করা উচিত হয়নি। রুদ্র আজকাল তরুর সব কথা শুনতে চায়। দীর্ঘ সময় ধরে চিঠি পড়তে চায়। সে চিঠিটা খুলতে চেয়েও শেষ মুহুর্তে খুললো না। সেটা একটা বইয়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল।
সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। আজ বুধবার। প্রতি সপ্তাহে এই দিনেই তরুর একটা চিঠি আসে তার ঠিকানায়। সে সপ্তাহে বাকী ছয়টা দিন অপেক্ষা করে। তরুর চিঠির অপেক্ষা। এবং যখন অপেক্ষার সময়টা শেষ হয় তখন রুদ্রের ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগাটা দীর্ঘ হয়না। চিঠিটা পড়া শেষ হলেই পরবর্তী চিঠির অপেক্ষা শুরু হয়। এই অপেক্ষা তাকে মাঝেমধ্যে কষ্ট দেয়। ভীষণ পিড়া দেয়। তরুর কথা ভাবতে ভাবতে রুদ্র ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। তাই এই অসময়ে ঘুমটা তাকে বেশ ভালো ভাবেই পেয়ে বসল।
আলিফ সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্তে বাসায় ফিরে এসে দেখলো বাসায় কেউ নেই। দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। সে আজ চাবি নিয়ে বের হয়নি। সে গেট খুলে ঢুকতে পারলো না। তাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই, এটা ভেবে সে সিন্ধান্ত নিলো ছাঁদে গিয়ে অপেক্ষা করা যাক।
সে সোজা ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদে এসে দেখে সকালে যে মেয়েটা সাথে তার ধাক্কা লেগেছিল সে দাঁড়িয়ে আছে। সে চুপিসারে এগিয়ে মেয়েটা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আলিফ পাশে দাঁড়াতেই মেয়েটা বুঝতে পেরে অল্প সময়ের জন্য আলিফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। কোনো কৌতুহল দেখালো না।
আলিফ দেখলো, মেয়েটার মাথার ক্ষত স্থানে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। হঠাৎ করে তার মধ্যে আবার অপরাধবোধ কাজ করলো। তার জন্যই সকালে ওভাবে মেয়েটা আঘাত পেয়েছি। সে অপরাধবোধ থেকে মেয়েটাকে আবার দুঃখিত বলল।
মেয়েটা এইবারও কোনো উত্তর দিলো না।
আলিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল। মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করল। মেয়েটা খুব শান্ত প্রকৃতির। মেয়েটার চোখের মধ্যে এক ধরণের গভীরতা আছে। সেই গভীরতা দীর্ঘ। সমুদ্রের তলদেশের মত। মেয়েটার গায়ের রঙ সামান্য ময়লা। নিসন্দেহে তথাকথিত ভাষায় শ্যামলা বলা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ মুখে একটা মায়া আছে। চুলগুলো দীর্ঘ, সিল্কি। সন্ধ্যার বাতাসে সেগুলো উড়ছে।
"আপনার নাম কি?" আলিফ অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা উত্তর দিলো না। চুপচাপ রইল।
"আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?" মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে আলিফ আবার কথাটা বলল।
মেয়েটা এবারও চুপ। আলিফের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ দূরের একগুচ্ছ কবুতরের উপর। সেগুলো আকাশে উড়ছে। এই বাসাটা থেকে আট-দশটা পরে যে বাসাটা আছে সেই বাসার ছাঁদকে ঘিরে কবুতরগুলো উড়ছে।
"আপনি কি সত্যি আমার উপর রেগে আছেন? আমার কাজের জন্য আমি সত্যি লজ্জিত। আসলে তারাহুরো করে নামতে যেয়ে আপনাকে লক্ষ করিনি। আমি সকালের ঘটনার জন্য সত্যিই মন থেকে দুঃখিত। আমাকে এবারের মত ক্ষমা করে দেওয়া যায় কি?"
আলিফ কথাগুলো একটানা বলে গেলেও মেয়াটা আবারো কোনো রেসপন্স করল না। ঠিক সেই মুহুর্তে পাশের একটা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেবে এলো।
আলিফ মেয়েটাকে আর কিছু বলল না। তার রাগ এতোক্ষণে চরম লেভেলের উঠে গেছে। এতোবার দুঃখিত বলার পরেও মেয়েটার কোনো রেসপন্স নেই। কোনো কথার উত্তর পর্যন্ত দিলো না। মেয়েটার মধ্যে কোনো ভদ্রতাও নেই।
আলিফ এটা মেনেই নিতে পারছে না। সে এমনিতেই কখনো কাউকে দুঃখিত বলেনা। তার ভুল থাকলেও সে বলেনা। কিন্তু এবার সে আসলে মন থেকে লজ্জিত। মেয়েটার মাথায় আঘাত পেয়েছে বলে তার মন এতোটা নরম হয়েছে। এছাড়া সকালে তার ভুলের জন্য সে কোনো চেচামেচি করেনি। আলিফের মনে হয়েছিলো মেয়েটা ভদ্র, মার্জিত। কিন্তু এভাবে তাকে উপেক্ষা করা, সে মেনে নিতে পারলো না।
সন্ধ্যা নেমে এলে মেয়েটা নিচে নেমে যায়। আলিফ শেষ পর্যন্ত আশা রেখেছিল যে মেয়েটা যাওয়া আগে কথা বলবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। সে হতাশ হলো। রেগে ছাঁদের উপরে থাকা ছোট একটা ইটের টুকরোয় লাথি মারতেই সে নিজেই আঙুলে ব্যথা পেলো। মনে মনে নিজেকেই বলল, "যা সালা ,আজকের দিনটাই খারাপ।"
জাহানারার ডাকে রুদ্রের ঘুম ভাঙলো রাত ন'টায়। ঘুম ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠলো। "এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি।" কথাটা নিজেকেই শুনিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখল মিলি বসে আছে খাটে। তার হাতে ফোন। রুদ্রের বুঝতে বাকী রইলো না যে মিলি গেম খেলছে। সে প্রতিদিন রাতে পড়াশোনা শেষ করে দৌড়ে এসে বলবে, "ভাইয়া, আমি সব পড়া শেষ করেছি।"
রুদ্র জানে এই কথার মানে কি। মিলি এখন তার ফোন চাচ্ছে। সে গেম খেলবে।
রুদ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মিলিকে বলল, "পড়াশোনা শেষ?"
"জি ভাইয়া, শেষ।" মিলি উত্তর দিলো।
"আজকে কলেজে কেউ কি আমার বুড়িটাকে বিরক্ত করেছে?"
"না, ভাইয়া। ভাইয়া জানো, আমার নতুন একটা বন্ধু হয়েছে।" মিলি আগ্রহ নিয়ে কথাটা রুদ্রকে বলল।
"নতুন বন্ধুটির নাম কি?"
"ওর নাম জেবিন।"
"বাহ, সুন্দর নাম তো।"
"কি করে আমরা বন্ধু হলাম সেটা শুনবে?"
"হ্যাঁ, শুনবো।"
মিলি আগ্রহ নিয়ে গল্পটা রুদ্রকে শোনানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে জাহানারা এসে বাঁধা দৃষ্টি করল। সে ডিনার করার জন্য দু'জনকেই ডাকল। এবং মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল, "খেয়েই ঘুমাতে হবে। সকালে কলেজ আছে।"
মিলিকে মন খারাপ করতে দেখে রুদ্র বলল, "আমার বুড়িটা কি মন খারাপ করল? দেখি দেখি।" এই বলে মিলিকে কোলের ভেতর টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে করতে রুদ্র আবার বলল, "গল্পটা কাল শুনবো, কেমন।"
"আচ্ছা, ভাইয়া। কাল কিন্তু শুনতেই হবে।"
"আচ্ছা, আচ্ছা। চলো এখন খেতে যাই।"
রুদ্র বেলকনিতে বসে আছে। তার হাতে তরুর চিঠি। বাইরের চাঁদের আলো। তারায় আকাশ ঝিকমিক করছে। রুদ্র খামের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে পড়া শুরু করল।
রুদ্র
আমি হাসপাতালে। শরীরটা ভালো না। আলস বিকালে বসে তোর কথা মনে পড়ছে। তোকে ভীষণ মিস করছি। ঠিক তখনি বাইরে তাকিয়ে দেখি শহর ভিজছে বৃষ্টিতে। মনে পড়ে গেলো আমরা ঠিক এভাবে একদিন ভিজেছিলাম। একটা কবিতা লিখে আমাকে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলি। কিন্তু আমার কাছে সেটা শুধু কবিতা ছিলো না। ওটা আমি ছিলাম। তোর ওইটুকু লেখায় পুরোটা জুরে এক অন্য আমি ছিলাম। লেখাটুকু এতোবার পড়েছিলাম যে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। এখন কেউ আমাকে বলতে বললে এক নিশ্বাসে বলে দিতে পারবো। তোর ওই লেখাটুকুই ঘুরিয়ে তোকেই লিখতে ইচ্ছে করছে। তাই তোর লেখাটা তোকেই দিলাম।
রুদ্র, একটু থাম, একটু জিড়িয়ে নে।
অনন্তমূলের নিচে একটু দাঁড়া,
একটু দেখ—ঝড়ে পড়ছে পাতা।
বিষণ্ণ হলুদ, সন্ধ্যা বেলা, পাখিরাও ফেরে ঘরে৷
এতো তারাহুরো, এতো ব্যস্ততা, জীবনকে কি দিবে?
একটু নিশ্চয়তা, একটা পাকা ছাঁদ।
বৃষ্টি হলে ভিজবে না ঘর, ভিজবে না সুখ।
এইটুকুই-তো? তাহলে আমায় কেনো বললি না?
তোর আকাশের সবটা কালো মেঘ শুষে নিতো আমার হৃদয়।
বৃষ্টি তোকে আর ভেজাতো পারতো না।
রুদ্র, একটু দেখ, একটু নিজেকে বোঝ।
ভয় কিসের? কেনো লুকিয়ে রাখিস নিজেকে?
কে দেখবে? কে করবে উপহাস?
চেয়ে দেখ চারপাশে, মানুষ শুধু হৃদয়ে দুঃখ লুকায়।
তুই-তো ওদের মত না।
যারা হেরে গেলে লুকিয়ে পড়ে।
তুই রুদ্র, তুই শিকল ভাঙা মানুষ।
গুহার ভেতর শিকলে বাঁধা তোকে মানায় না।
আজ বরং তুই বেরিয়ে আয়।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তুমুল এই বৃষ্টিতে;
আমাদের দু-হাত খুঁজে নিক তাদের শেষ গন্তব্য।
আমরা তাদের বারণ করার কে?
রুদ্র, সেদিনের মত আরেকটা দিন কখনোই আসবে না জানি। তবুও চাই আরেকটা দিন আসুক। দুজনে ভিজি শহুরে বৃষ্টিতে। আরেকবার ভিজি। আরেকবার!
ইতি তরু
রুদ্রের চোখে মুখে অতৃপ্তির আভাস। তরু চিঠিটা হুট করেই শেষ করে দিয়েছে। রুদ্র জানে, তরুর বলার আরো অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে সে কিছুই লিখেনি। আচ্ছা, তরু কি কাঁদছিলো? তরু এখন কেমন আছে? এরকম নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলো রুদ্রের মনে। কিন্তু সে জানে এই অহেতুক প্রশ্নের উত্তর সে কখনোই পাবে না। কখনোই না!
চলবে....!
পর্ব-০২
লেখক-সবুজ আহম্মদ মুরসালিন
===================
আলিফ তার মা'য়ের সাথে ঝগড়া করে, রেগে বাসা থেকে বেড়িয়ে, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে ছিলো। ঠিক সেই মুহুর্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা একটা কিশোরী মেয়ের সাথে তার জোরেসোরে ধাক্কা লাগে এবং সাথেসাথে তারা দু'জনেই পড়ে যায়। আলিফের কিছু না হলেও, সে দেখলো কিশোরী মেয়েটার কপাল কিছুটা কেটে গেছে। মেয়েটার হাতে কিছু শপিং ব্যাগ ছিলো, সেগুলো পড়ে সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।
আলিভ দুঃখিত বলে, পকেট থেকে টিস্যু বের করে মেয়েটার হাতে দেয়। সে টিস্যুটা দিতে দিতে আরেকবার দুঃখিত বলে নেয়। সে লজ্জিত সেটা প্রকাশ করে। মেয়েটা কিছু বলে না। সে শুধু গভীর ভাবে আলিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালের ক্ষত থেকে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে ভ্রুর কাছে আসতেই মেয়েটা আলিফের দেওয়া টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলে।
সিঁড়িতে পড়ে থাকা মেয়েটার ব্যাগগুলো তারাহুরো করে আলিফ উঠিয়ে মেয়েটার হাতে দেয়। মেয়েটা এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই বলেনি। আলিফ ভেবেছিলো মেয়েটা চেচামেচি করবে। কিন্তু মেয়েটা একদম চুপ। সে আলিফের হাত থেকে তার ব্যাগগুলো নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে থাকে। আলিফ তাকে ডাকে। মেয়েটা ডাক শুনেনা। আলিফের দিকে ফিরেও তাকায় না। আলিফ সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেয়েটা চলে গেলে সে নিচে নেমে আসে। একবার ভাবে ফার্মাসি থেকে ব্যান্ডেজ কিনে দিয়ে আসবে। কিন্তু সে তা করে না। মেয়েটাকে চিনলে সেটা করা যেতো কিন্তু সে তাকে চিনে না। আজই প্রথম দেখেছে। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে সে তার আড্ডাখানায় চলে আসে।
এখানে এসে সে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। অবাক হওয়ার কারণ গতকাল রাতেই সে মেসেজে তাকে বলেছে, একটা প্রেজেন্টেশনের কাজে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থাকবে। সন্ধ্যার আগে দেখা হবে না। তাই এই ভর দুপুরে তার চায়ের দোকানে বসে থাকার কথা না। সে এগিয়ে রুদ্রের কাছে যায়। রুদ্রের পাশে বসতে বসতে বলে, "কিরে দোস্ত, এই সময় এখানে। ক্যাম্পাসে যাস নেই?"
রুদ্রের ডান হাতের আঙুলের মাঝে সিগারেট। সে শেষ বারের মত সেটাতে দীর্ঘ টান দিয়ে সেটা আলিফের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর সে বাতাসে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, "ভোরের দিকে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখি। সেই থেকে খুব অস্থির লাগছে। ভালো লাগছে না। ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছে করল না, তাই আর যাই নি।"
আলিফ সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে সেটা পায়ের কাছে ফেলে পা দিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিতে দিতে বলল, "এখন কেমন লাগছে?"
"আগের মতই।" রুদ্র উত্তর দিলো।
"বাজে স্বপ্ন মানে কেমন? আই মিন, স্বপ্নে কি দেখেছিস?"
আলিফের করা প্রশ্ন উপেক্ষা করে রুদ্র বলল, "চা খাবি তো?" আলিফের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে দোকানদারকে বলল, "মামা, দুইকাপ রঙ চা।"
স্বপ্নটা তরুকে নিয়ে। এই কারণে রুদ্র সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। আজকাল তরুর কথা বা তার চিঠির কথা কারো সাথে শেয়ার করতে ভাল লাগে না তার। অবশ্য প্রথম দিকে সে তার বন্ধু মহলে তরু এবং তার চিঠির কথা শেয়ার করত। কেনো জানি আজকাল সেটা করতে আর একটুও ভালো লাগে না। সে চায়, তরু এবং তার লেখা চিঠি সবটাই শুধু তার মধ্যে থাকুক। কেউ না জানুক। কারো জানার দরকার নেই!
আলিফ বুঝতে পারলো, রুদ্র চাচ্ছে না তার স্বপ্নের কথা তার সাথে শেয়ার করতে। তাই জোর করে শোনার কোনো কারণ দেখল না সে। সেও এই বিষয়টা উপেক্ষা করে বলল, "কি করবি এখন?"
"জানিনা, এখানে বসে আছি, বসেই থাকবো।" রুদ্র উদাস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।
রুদ্র পকেটে থাকা সিগারেট প্যাকেটটা বের করল। সেখান থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে আলিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "যা চা'টা নিয়ে আয়, আর সিগারেট ধরিয়ে আন।"
চা খাওয়ার মধ্যেই রুদ্রে ফোনে একটা কল এলো। নাম্বারটা তার পরিচিত। সেভ করা নেই। তবুও চেনা। এই নাম্বার থেকে প্রায়ই কল আসে। তাই নাম্বারটা সেভ করা না থাকলেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। সে ফোনটা রিসিভ করল না। চা'টা শেষ করল। তারপর উঠে দোকানের বিল পরিশোধ করে আলিফের উদ্দেশ্যে বলল, "দোস্ত, আমি বাসার দিকে যাবো। তুই কি এখানে থাকবি কিছুক্ষণ?"
"হ্যাঁ, একটু কাজ আছে। আচ্ছা তুই তাহলে যা, সমস্যা নেই।" আলিফ বলল।
আলিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুদ্র বাসার দিকে রওনা করল। গেট দিয়ে বাসায় চুকবে সেই মুহুর্তে অপরিচিত এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, "এটা কি এই গলির ২২ নাম্বার বাসা?"
"জি, এটাই। কোনো দরকার?" রুদ্র বলল।
লোকটা রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র আবার বলল, "কাউকে খুঁজছেন?"
লোকটা তার হাতে থাকা খামটা রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "এই ঠিকানাটা খুঁজছি।"
রুদ্র খামটা ধরে ঠিকানার দিকে চোখ দিতেই চোখ দুটো স্থির হয়ে রইল। খামের বাম দিকে ছোট্ট করে লেখা, "প্রেরক, তরু"। এটুকুই। প্রেরকের সম্পর্কে আরো কোনো তথ্য নেই। ঠিকানাও নেই। কিচ্ছু নেই। তবুও রুদ্র এটুকু দেখেই বুঝে গেলো এটা তারই চিঠি। তাই চিঠির ডান দিকে থাকা প্রাপকের ঠিকানা পড়তে হলো না তাকে। সে জানে সেখানে কি লেখা আছে। সে ভদ্র লোকটিকে বলল, "হ্যাঁ, এটা এই বাসারই ঠিকানা।"
"ধন্যবাদ।" ভদ্র লোকটি বলল।
রুদ্র আর কিছু না বলে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে গেলো। সে চাইলেই লোকটাকে বলতে পারতো চিঠিটা তার কাছেই এসেছে। কিন্তু সে সেটা করল না। কারণ তার আগের অভিজ্ঞতা ভালো না। গত মাসেও ঠিক এরকম হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সাথে গেটের বাইরে তার দেখা হয়েছিলো। সেবার রুদ্র তাকে বলেছিল, "চিঠিটা তার কাছেই এসেছে।" তার এই কথা লোকটা বিশ্বাস করেনি। সে আরো বলেছিলো, "আপনি চাইলে এখান থেকেই চিঠিটা আমাকে দিয়ে দিতে পারেন। আপনার কষ্ট করে উপরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।"
এই কথা শুনে লোকটা তাকে বলেছিল, "স্যার, এটা একটা কনফিডেনসিয়াল চিঠি। নির্দেশনা আছে, চিঠিতে যে ফ্লাট নাম্বার উল্লেখ আছে সেখানেই ডেলিভারি করার। তাই আপনার চিঠি হলেও এখানে আপনাকে চিঠিটা দিতে পারছি না।" লোকটা আরো বলেছিল, "সরি, স্যার। আশা করি আমাদের পলিসি আপনি বুঝবেন।"
ভদ্রলোকটার কথা শুনে রুদ্র বলেছিল, "দেখুন, ওখানে ২০৩ নাম্বার ফ্লাট উল্লেখ আছে। ওই ফ্লাটে আমিই থাকি। এবং আমিই রুদ্র।" তবুও ভদ্র লোকটা তাকে চিঠি দেয় নি। তার সাথে উপরে এসে তাকে রুমে ঢুকতে দেখে তারপর চিঠিটা দেয়। তাই সে চায় নি আগের মত আজও সেরকম কোনো ঘটনা ঘটুক।
ভদ্রলোকটি এই মুহুর্তে চিঠিতে উল্লেখিত ২০৩ নাম্বার ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। নিচে যে ভদ্রলোকটির সাথে তার কথা হয়েছে সেই ভদ্রলোকটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তাই তাকে কলিংবেলের বাজাতে হলো না।
রুদ্র তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলো লোকটা বেশ অবাক হয়েছে। চোখে মুখে প্রশ্ন। তবে ভদ্রলোকটির কিছু বলার আগেই রুদ্র বলল, "চিঠিটার প্রাপক আমিই।"
ভদ্রলোকটি চিঠিটা বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। সে কোনো প্রশ্ন করলো না। কিছুটা কৌতুহল জেগেছিল তবুও সেটা নিজের মধ্যেই রেখে দিলো।
রুদ্র চিঠিটা নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ল। চিঠিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। গত সপ্তাহে আসা চিঠিটা খুব ছোট ছিলো। সে আশা করছে এই চিঠিটা যেনো দীর্ঘ হয়। তরুর ছোট চিঠিগুলো পড়ে রুদ্র প্রতিবার হতাশ হয়। তাখন তার কেবল মনে হয় চিঠিটা আরো বড় হওয়া দরকার ছিলো। তরু ইচ্ছে করে অনেক কথা উপেক্ষা করে গেছে। কিন্তু তার এটা করা উচিত হয়নি। রুদ্র আজকাল তরুর সব কথা শুনতে চায়। দীর্ঘ সময় ধরে চিঠি পড়তে চায়। সে চিঠিটা খুলতে চেয়েও শেষ মুহুর্তে খুললো না। সেটা একটা বইয়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল।
সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। আজ বুধবার। প্রতি সপ্তাহে এই দিনেই তরুর একটা চিঠি আসে তার ঠিকানায়। সে সপ্তাহে বাকী ছয়টা দিন অপেক্ষা করে। তরুর চিঠির অপেক্ষা। এবং যখন অপেক্ষার সময়টা শেষ হয় তখন রুদ্রের ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগাটা দীর্ঘ হয়না। চিঠিটা পড়া শেষ হলেই পরবর্তী চিঠির অপেক্ষা শুরু হয়। এই অপেক্ষা তাকে মাঝেমধ্যে কষ্ট দেয়। ভীষণ পিড়া দেয়। তরুর কথা ভাবতে ভাবতে রুদ্র ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। তাই এই অসময়ে ঘুমটা তাকে বেশ ভালো ভাবেই পেয়ে বসল।
আলিফ সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্তে বাসায় ফিরে এসে দেখলো বাসায় কেউ নেই। দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। সে আজ চাবি নিয়ে বের হয়নি। সে গেট খুলে ঢুকতে পারলো না। তাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে নেই, এটা ভেবে সে সিন্ধান্ত নিলো ছাঁদে গিয়ে অপেক্ষা করা যাক।
সে সোজা ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদে এসে দেখে সকালে যে মেয়েটা সাথে তার ধাক্কা লেগেছিল সে দাঁড়িয়ে আছে। সে চুপিসারে এগিয়ে মেয়েটা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আলিফ পাশে দাঁড়াতেই মেয়েটা বুঝতে পেরে অল্প সময়ের জন্য আলিফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। কোনো কৌতুহল দেখালো না।
আলিফ দেখলো, মেয়েটার মাথার ক্ষত স্থানে অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। হঠাৎ করে তার মধ্যে আবার অপরাধবোধ কাজ করলো। তার জন্যই সকালে ওভাবে মেয়েটা আঘাত পেয়েছি। সে অপরাধবোধ থেকে মেয়েটাকে আবার দুঃখিত বলল।
মেয়েটা এইবারও কোনো উত্তর দিলো না।
আলিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল। মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করল। মেয়েটা খুব শান্ত প্রকৃতির। মেয়েটার চোখের মধ্যে এক ধরণের গভীরতা আছে। সেই গভীরতা দীর্ঘ। সমুদ্রের তলদেশের মত। মেয়েটার গায়ের রঙ সামান্য ময়লা। নিসন্দেহে তথাকথিত ভাষায় শ্যামলা বলা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ মুখে একটা মায়া আছে। চুলগুলো দীর্ঘ, সিল্কি। সন্ধ্যার বাতাসে সেগুলো উড়ছে।
"আপনার নাম কি?" আলিফ অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা উত্তর দিলো না। চুপচাপ রইল।
"আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?" মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে আলিফ আবার কথাটা বলল।
মেয়েটা এবারও চুপ। আলিফের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ দূরের একগুচ্ছ কবুতরের উপর। সেগুলো আকাশে উড়ছে। এই বাসাটা থেকে আট-দশটা পরে যে বাসাটা আছে সেই বাসার ছাঁদকে ঘিরে কবুতরগুলো উড়ছে।
"আপনি কি সত্যি আমার উপর রেগে আছেন? আমার কাজের জন্য আমি সত্যি লজ্জিত। আসলে তারাহুরো করে নামতে যেয়ে আপনাকে লক্ষ করিনি। আমি সকালের ঘটনার জন্য সত্যিই মন থেকে দুঃখিত। আমাকে এবারের মত ক্ষমা করে দেওয়া যায় কি?"
আলিফ কথাগুলো একটানা বলে গেলেও মেয়াটা আবারো কোনো রেসপন্স করল না। ঠিক সেই মুহুর্তে পাশের একটা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেবে এলো।
আলিফ মেয়েটাকে আর কিছু বলল না। তার রাগ এতোক্ষণে চরম লেভেলের উঠে গেছে। এতোবার দুঃখিত বলার পরেও মেয়েটার কোনো রেসপন্স নেই। কোনো কথার উত্তর পর্যন্ত দিলো না। মেয়েটার মধ্যে কোনো ভদ্রতাও নেই।
আলিফ এটা মেনেই নিতে পারছে না। সে এমনিতেই কখনো কাউকে দুঃখিত বলেনা। তার ভুল থাকলেও সে বলেনা। কিন্তু এবার সে আসলে মন থেকে লজ্জিত। মেয়েটার মাথায় আঘাত পেয়েছে বলে তার মন এতোটা নরম হয়েছে। এছাড়া সকালে তার ভুলের জন্য সে কোনো চেচামেচি করেনি। আলিফের মনে হয়েছিলো মেয়েটা ভদ্র, মার্জিত। কিন্তু এভাবে তাকে উপেক্ষা করা, সে মেনে নিতে পারলো না।
সন্ধ্যা নেমে এলে মেয়েটা নিচে নেমে যায়। আলিফ শেষ পর্যন্ত আশা রেখেছিল যে মেয়েটা যাওয়া আগে কথা বলবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। সে হতাশ হলো। রেগে ছাঁদের উপরে থাকা ছোট একটা ইটের টুকরোয় লাথি মারতেই সে নিজেই আঙুলে ব্যথা পেলো। মনে মনে নিজেকেই বলল, "যা সালা ,আজকের দিনটাই খারাপ।"
জাহানারার ডাকে রুদ্রের ঘুম ভাঙলো রাত ন'টায়। ঘুম ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠলো। "এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি।" কথাটা নিজেকেই শুনিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখল মিলি বসে আছে খাটে। তার হাতে ফোন। রুদ্রের বুঝতে বাকী রইলো না যে মিলি গেম খেলছে। সে প্রতিদিন রাতে পড়াশোনা শেষ করে দৌড়ে এসে বলবে, "ভাইয়া, আমি সব পড়া শেষ করেছি।"
রুদ্র জানে এই কথার মানে কি। মিলি এখন তার ফোন চাচ্ছে। সে গেম খেলবে।
রুদ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মিলিকে বলল, "পড়াশোনা শেষ?"
"জি ভাইয়া, শেষ।" মিলি উত্তর দিলো।
"আজকে কলেজে কেউ কি আমার বুড়িটাকে বিরক্ত করেছে?"
"না, ভাইয়া। ভাইয়া জানো, আমার নতুন একটা বন্ধু হয়েছে।" মিলি আগ্রহ নিয়ে কথাটা রুদ্রকে বলল।
"নতুন বন্ধুটির নাম কি?"
"ওর নাম জেবিন।"
"বাহ, সুন্দর নাম তো।"
"কি করে আমরা বন্ধু হলাম সেটা শুনবে?"
"হ্যাঁ, শুনবো।"
মিলি আগ্রহ নিয়ে গল্পটা রুদ্রকে শোনানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে জাহানারা এসে বাঁধা দৃষ্টি করল। সে ডিনার করার জন্য দু'জনকেই ডাকল। এবং মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল, "খেয়েই ঘুমাতে হবে। সকালে কলেজ আছে।"
মিলিকে মন খারাপ করতে দেখে রুদ্র বলল, "আমার বুড়িটা কি মন খারাপ করল? দেখি দেখি।" এই বলে মিলিকে কোলের ভেতর টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে করতে রুদ্র আবার বলল, "গল্পটা কাল শুনবো, কেমন।"
"আচ্ছা, ভাইয়া। কাল কিন্তু শুনতেই হবে।"
"আচ্ছা, আচ্ছা। চলো এখন খেতে যাই।"
রুদ্র বেলকনিতে বসে আছে। তার হাতে তরুর চিঠি। বাইরের চাঁদের আলো। তারায় আকাশ ঝিকমিক করছে। রুদ্র খামের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে পড়া শুরু করল।
রুদ্র
আমি হাসপাতালে। শরীরটা ভালো না। আলস বিকালে বসে তোর কথা মনে পড়ছে। তোকে ভীষণ মিস করছি। ঠিক তখনি বাইরে তাকিয়ে দেখি শহর ভিজছে বৃষ্টিতে। মনে পড়ে গেলো আমরা ঠিক এভাবে একদিন ভিজেছিলাম। একটা কবিতা লিখে আমাকে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলি। কিন্তু আমার কাছে সেটা শুধু কবিতা ছিলো না। ওটা আমি ছিলাম। তোর ওইটুকু লেখায় পুরোটা জুরে এক অন্য আমি ছিলাম। লেখাটুকু এতোবার পড়েছিলাম যে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। এখন কেউ আমাকে বলতে বললে এক নিশ্বাসে বলে দিতে পারবো। তোর ওই লেখাটুকুই ঘুরিয়ে তোকেই লিখতে ইচ্ছে করছে। তাই তোর লেখাটা তোকেই দিলাম।
রুদ্র, একটু থাম, একটু জিড়িয়ে নে।
অনন্তমূলের নিচে একটু দাঁড়া,
একটু দেখ—ঝড়ে পড়ছে পাতা।
বিষণ্ণ হলুদ, সন্ধ্যা বেলা, পাখিরাও ফেরে ঘরে৷
এতো তারাহুরো, এতো ব্যস্ততা, জীবনকে কি দিবে?
একটু নিশ্চয়তা, একটা পাকা ছাঁদ।
বৃষ্টি হলে ভিজবে না ঘর, ভিজবে না সুখ।
এইটুকুই-তো? তাহলে আমায় কেনো বললি না?
তোর আকাশের সবটা কালো মেঘ শুষে নিতো আমার হৃদয়।
বৃষ্টি তোকে আর ভেজাতো পারতো না।
রুদ্র, একটু দেখ, একটু নিজেকে বোঝ।
ভয় কিসের? কেনো লুকিয়ে রাখিস নিজেকে?
কে দেখবে? কে করবে উপহাস?
চেয়ে দেখ চারপাশে, মানুষ শুধু হৃদয়ে দুঃখ লুকায়।
তুই-তো ওদের মত না।
যারা হেরে গেলে লুকিয়ে পড়ে।
তুই রুদ্র, তুই শিকল ভাঙা মানুষ।
গুহার ভেতর শিকলে বাঁধা তোকে মানায় না।
আজ বরং তুই বেরিয়ে আয়।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তুমুল এই বৃষ্টিতে;
আমাদের দু-হাত খুঁজে নিক তাদের শেষ গন্তব্য।
আমরা তাদের বারণ করার কে?
রুদ্র, সেদিনের মত আরেকটা দিন কখনোই আসবে না জানি। তবুও চাই আরেকটা দিন আসুক। দুজনে ভিজি শহুরে বৃষ্টিতে। আরেকবার ভিজি। আরেকবার!
ইতি তরু
রুদ্রের চোখে মুখে অতৃপ্তির আভাস। তরু চিঠিটা হুট করেই শেষ করে দিয়েছে। রুদ্র জানে, তরুর বলার আরো অনেক কিছু ছিলো। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে সে কিছুই লিখেনি। আচ্ছা, তরু কি কাঁদছিলো? তরু এখন কেমন আছে? এরকম নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলো রুদ্রের মনে। কিন্তু সে জানে এই অহেতুক প্রশ্নের উত্তর সে কখনোই পাবে না। কখনোই না!
চলবে....!
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)