05-11-2022, 03:07 PM
ঘন্টা দুয়েকের ট্রেন যায়নি দেখতে দেখতে কেটে গেল। আসলে ট্রেনে করে যেতে আমার বেশ লাগে, জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখার মজাই আলাদা।
স্টেশন থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই হোটেলের এজেন্ট, ক্যাব ড্রাইভাররা এগিয়ে এলেন। সাধারণত আমি এদের এড়িয়ে চলি। কিন্তু এইবার তো আর হোটেল বুক করা নেই, তাই একজন হোটেলের এজেন্টের সাথে কথা বললাম। ওনার সাথে কথা বলতে বলতে আরো দুই তিনজনে এগিয়ে এলেন। আমি সবাইকে একই কথা জিজ্ঞাসা করলাম, হোটেল কোথায়, রুম আছে কিনা, রুমের ভাড়া কত, ফ্যাসিলিটি কি কি আছে, ব্রেকফাস্ট ফ্রী কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার কথা শুনতে শুনতে এটা বুঝে গেলাম যে কোনো না কোনো হোটেলে রুম ঠিক পেয়ে যাব। এটা নিয়ে আর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই । আমি আসার আগেই রিভিউ পড়ে দু তিনটে হোটেল সিলেক্ট করে নিয়েছিলাম। কাজেই ওনাদের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এলাম।
সামনে এগোতেই একজন এসে বললেন, বহিনজি কাহা জানা হ্যায়? আমি বললাম হোটেলে যাব, উনি জিজ্ঞাসা করলেন হোটেলে আগে থেকে ঠিক করা আছে কিনা। জানালাম যে কোনো হোটেল ঠিক করা নেই । উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, চলুন আমার গাড়িতে চলুন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কত ভাড়া, উনি হাজার টাকা চেয়ে বসলেন। হাজার টাকা দিয়ে হোটেলে পৌঁছানোর কোনো মানেই হয় না। দরকার হলে হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিয়ে ভালো রুমে থাকবো। অবশেষে একটা অটোওয়ালা সাথে কথা হল, উনি আমাকে আমার পছন্দের হোটেলে দিয়ে যাবেন, 200 টাকা নেবেন। যদি হোটেল পছন্দ না হয় তখন অন্য হোটেল দিয়ে যাবেন, কিন্তু তার জন্য আলাদা করে টাকা দিতে হবে।
যেতে যেতে অটো ড্রাইভার বললেন একটা নতুন হোটেল হয়েছে। আগে ওরা শুধু রেস্টুরেন্ট ছিল এখন থাকার রুম বানিয়েছে। আপনি একবার যেতে পারেন, খাবার খুব ভালো আর রুম পছন্দ না হলে অন্য জায়গায় চলে যাবেন। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে খিদে খিদে পাচ্ছিল আর খাবার খুব ভালো শুনে মনে হল যাই একবার।
হোটেলটায় ঢোকার মুখেই রেস্টুরেন্ট আর পেছনের দিকে থাকার জায়গা। রেস্টুরেন্ট বাইরেও বসার জায়গা আছে আর ভেতরে এসিতেও বসা যায়।
রেস্টুরেন্ট দেখে খিদে বেড়ে গেল আর অটো ড্রাইভারকে বললাম আগে খেয়ে নি, পরে রুম দেখা যাবে। উনি শুনে বললে যে দেরি হয়ে যাবে, আপনি আগে হোটেল দেখে নিন কিন্তু শেষমেষ রাজি হয়ে গেলেন। ওনাকে বললাম আপনিও আমার সাথে বসে খেয়ে নিন। উনি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, দুবার বলতে রাজি হয়ে গেলেন।
খাবার অর্ডার দিয়ে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কি কি দেখার জায়গা আছে? কতক্ষণ সময় লাগে অটোতে আর উনি কত ভাড়া নেবেন। ভাড়া উনি ঠিকঠাকই বললেন। মনে মনে ঠিক করে দিয়েছিলাম ওনার অটোতেই যাব, কিন্তু কিছু বলিনি।
আলুর পরোটা খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম ভদ্রলোক বারবার আমার বুকের দিকে তাকাচ্ছেন। বাইরে বসে গরমে কখন যে উইন্ডচিটারের চেন নামিয়ে দিয়েছি সেটার খেয়াল নেই আর উনি এই সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করছেন। মাথাটা এত গরম হয়ে গেল যে আর কি বলব। কিছু কিছু লোকের এই একটা দোষ , আপনি তার সাথে যত ভালো ব্যবহারই করুন না কেন, সে ঠিক আপনার বুকের দিকে তাকাবেই।
খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলাম রুমের জন্য কোথায় কথা বলব। ওয়েটার জানালো যে রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারে রুমের জন্য কথা বলতে হয়। যিনি বুকিং দিচ্ছিলেম উনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন সঙ্গে কে আছে। কেন বাবা একটা একা একা মেয়ে কি ঘুরতে পারে না ! আর আমি তো আর বাচ্চা মেয়ে নই, ২৫ বছর বয়স হয়ে গেছে। যাইহোক আমার একা থাকা নিয়ে কোন সমস্যা হলো না আর উনি আমাকে জানালেন রুম আছে। আবার পরের প্রশ্নই ছিল ঘুরতে যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা। ওনারা বললেন যে হোটেলের গাড়ি আছে, এছাড়াও দরকার হলে ওনারা বাইরে থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অটো ড্রাইভার যে খুশি হচ্ছেন না বুঝতে পারছি। বেশ হয়েছে, আরো তাকা আমার দিকে।
হোটেলের রুম যেটা দেখালো সেটা খারাপ না। রুমে ঢুকলেই একটা ওয়ারড্রব, পাশে দুটো চেয়ার একটা টেবিল আর একটা কুইন সাইজ বেড। আমার একার জন্য যথেষ্ট। রুমের ভাড়াও একটু কম, হয়তো নতুন খুলেছে বলেই। রুম বুক করে ড্রাইভারকে ২০০ টাকা দিয়ে ছেড়ে দিলাম।
রুমে ফিরে সুমনের কথা মনে পড়ছিল। এইসব রুম বুকিং ওর দায়িত্ব ছিল। এমন একটা ভাব করত যেন বুকিং করা কত সাংঘাতিক কাজ। আর রুমে ঢুকে পড়ে আসল কাজ শুরু করে দিত। সুমনের সাথে উইকেন্ডে বেড়াতে গিয়ে একবার হোটেলে ঢুকে পড়লেই হল। তারপরে বাবুকে ভেতরে ঢুকতে দিতে হবে। এখন এখন তো আর সেসব কিছুই নেই। শেষ কয়েক মাসে জীবন কেমন পাল্টে গেছে।
এইসব চাইপাশ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ অটো ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল। কিরকম নির্লজ্জের মত তাকাচ্ছিল। বাকি সব মেয়েদের মত আমিও লোকজনের তাকানোর সাথে অভ্যস্ত, কিন্তু এরকম নির্লজ্জের মত কেউ তাকালে একটা অস্বস্তি হয়, রাগও হয়। আমি না হয় এখন উপসী, তোদের তো স্বভাব দোষ।
রেস্ট নিয়ে রেডি হতে একটু দেরী হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম গাড়ি রেডি তো? উনারা বললেন আপনিতো গাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছু তো কনফার্ম করে যান নি। উনারা বললেন গাড়ির ব্যবস্থা ওরা করে দেবেন কিন্তু একটু দেরি হবে। পাশে একটা সদ্য বিবাহিত কাপেল গাড়ির রেট নিয়ে খুব দরদাম করছিল। কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন আপনারা একটা গাড়িতে চলে যান না, রেট একটু কম পড়বে আর তাড়াতাড়ি গাড়িও পেয়ে যাবেন।
রেট নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিল না, আর অন্য কারো সাথে গাড়ি শেয়ার করার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু পরে ভাবলাম একে তো দেরি হয়ে গেছে, গাড়ি পেতে আরো কত দেরি হবে তার কোন ঠিক নেই। একা একা গেলে সেই লোক কেমন হবে কে জানে, এর চেয়ে ভালো এদের সাথেই যাই।
গাড়িতে আমি আর বউটা পেছনে বসলাম আর বরটা সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলেন। ওদের একটাই সমস্যা, একটু পরে পরেই গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার জন্য নেমে পরে। ড্রাইভার একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন কিন্তু আমার ভালই লাগছিল। তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে টুরিস্ট স্পটে পৌঁছে ভিড়ের মধ্যে একশটা ছবি তোলার থেকে, ওরা যে জার্নিটা এনজয় করছে সেটাই ভালো। আমিও ওদের কিছু ছবি তুলে দিলাম।
গন্ডগোল বাঁধলো ফেরার সময়। ঘুরতে এবং খেতে আমাদের বেশ কিছু সময় লেগেছে তাই ফেরার সময় ড্রাইভার একটু স্পিডেই গাড়িটা চালাতে শুরু করল। হঠাৎ বউটা বলে গাড়ি থামাও। আমি ভাবলাম হয়তো আবার ছবি তুলবে, কিন্তু কিছু ভাবার আগেই গাড়ির মধ্যে হরহর করে বমি করে দিল।
আমি ড্রাইভার কে বললাম গাড়িটা দাঁড় করান, উনি একটু রেস্ট নিক, আপনি গাড়ির ভেতরটা একটু পরিষ্কার করে দিন। তারপরে আস্তে আস্তে গাড়ি চালান।
এইসব এইসব করতে করতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট চলে গেল। আমি গাড়িতে উঠে দেখলাম ভেতরটা পরিষ্কার হয়েছে বটে কিন্তু বমির গন্ধ বের হচ্ছে। কিছু বললাম না কারণ কিই বা করার আছে। ড্রাইভার আবার গাড়ি স্টার্ট করলেন, স্টার্ট করার সাথে সাথে আবার বমি। এবারও গাড়ির ভেতরে আর কিছুটা আবার আমার উইন্ডচিটারের হাতায় পড়ল।
এইবার ড্রাইভার দেখলাম বেশ রেগে গেলেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে ফোন করে বললেন যে প্যাসেঞ্জার শুধু বমি করছে, গাড়ি একদম নোংরা হয়ে গেছে, ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। হোটেল থেকে বলল আরেকটা গাড়ি আসছে, বমির ওষুধ দিয়ে আসছে, চিন্তা করার কোন কারণ নেই। পেসেঞ্জাররা রেস্ট নিক, কোনো অসুবিধা হবে না।
আরেকটা গাড়ি আসছে শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। বমির গন্ধে আমার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন নতুন গাড়ি আসবে। তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে, বাইরেটাকে দেখতেও খুব ভালো লাগছিল। বরটাকে দেখলাম খুব আদর করে বউটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ দেখে আমাদের গাড়ির সামনে একটা বাইক এসে থামল। ওনাকে চেনা চেনা লাগছে তারপর মনে পড়ল কাউন্টারে উনি বসে ছিলেন কারো সাথে কথা বলছিলেন। উনি এসে ওষুধ দিলেন তার পরে আমাকে বললেন আপনি বরং আমার সাথে বাইকে চলুন। অচেনা লোকের সাথে বাইকে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু গাড়িতে বমির গন্ধ, আবার যে বমি করবে না তারও নিশ্চয়তা দিই। বরটাও বলল , দিদিভাই আপনি কিছু মনে না করলে বাইকে চলে যান। আমাদের জন্য আপনাকে এই বিরম্বনায় পরতে হলো। শেষমেশ ঠিক হলো আমি বাইকেই যাব, গাড়ি আর বাইক একসাথে চলবে এবং গাড়িটাকে বলা হলো খুব আস্তে আস্তে চালাতে।
বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। বাইক চলতে শুরু করল, উনি খুব আস্তে আস্তেই বাইক চালাচ্ছিলেন। কেউই কারো সাথে কথা বলছিলাম না, কথা কি বলবো কেউ তো কাউকে চিনি না।
আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি হোটেলের ম্যানেজার? উনি হেসে বললেন না না আমি এই হোটেলের ইনভেস্টার। উইকেন্ডে আসি, এছাড়া আমি জব করি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কি করি? আমি বললাম আমি এমবিএ শেষ করে জব করছি। উনি বললেন যে উনিও ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে জোকা থেকে এমবিএ করেছেন। আমিতো জোকা শুনে খুশি হয়ে গেলাম, বললাম আমিও তো জোকা। যাক বেড়াতে এসে জোকার একজন সিনিয়ারের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি বললেন যে আমি কিন্তু তোমার থেকে অনেকটাই সিনিয়ার। কোন ইয়ারে পাস করেছে সেটাও বললেন। আমি মনে মনে হিসাব করলাম, উনি আমার থেকে 16 বছর আগে পাশ করেছেন আর ইঞ্জিনিয়ারিং করতে এক বছর বেশি লাগে। উনি আমার থেকে প্রায় ১৭-১৮ বছরের বয়সে বড়।
ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনার নাম কি। উনি বললেন আমার নাম রাজেশ আর এতক্ষণ যখন স্যার বলে ডাকো নি, তখন আর স্যার বলতে হবে না। তুমি তো বাঙালি, তুমি আমাকে রাজেশদা বলেই ডাকো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমি বাঙালি বুঝলেন কি করে? আমার হিন্দি উচ্চারণ শুনে? রাজেশদা হেসে বলল তোমার হিন্দি উচ্চারণ বেশ ভালো। প্রশংসা কার না ভালো লাগে, রাজেশদা বললোও বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে।
অবশেষে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। ওদের গাড়িটাও আমাদের সাথে সাথেই পৌঁছল। বউটাকে দেখে মনে হল একটু ভালো আছে। ওরা ওদের ঘরে চলে গেল। আমি রাজেশদা কে ধন্যবাদ জানালাম আর হ্যান্ডসেক করলাম। রাজেশদা বলল, অতসী ইভিনিং স্ন্যাক্স তুমি ঘরেও খেতে পারো বা বাইরে এসেও খেতে পারো। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি ঘরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে অর্ডার করছি। রাজেশ দা বলল অর্ডার করে দিও, খাবার রেডি হতে হতে কিন্তু আধঘন্টা লাগিয়ে দেবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি তাড়াতাড়ি অর্ডার করে দেব। রাজেশদা তো তখনও আমার হাত ধরে আছে। আমি একটু হেসে এবার হাতটা ছাড়িয়ে দিলাম, রাজেশদাও একটু হাসলো। আমি রাজেশদাকে টাটা বলে খুশি মনে নিজের রুমে চলে এলাম।
রাজেশদা বেশ স্মার্ট। চাকরি করে সাথে একটা ব্যবসা খুলেছে , কথাবার্তাও খুব ভালো। আমার ডান হাতটা তো এখনো গরম হয়ে আছে।
স্টেশন থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই হোটেলের এজেন্ট, ক্যাব ড্রাইভাররা এগিয়ে এলেন। সাধারণত আমি এদের এড়িয়ে চলি। কিন্তু এইবার তো আর হোটেল বুক করা নেই, তাই একজন হোটেলের এজেন্টের সাথে কথা বললাম। ওনার সাথে কথা বলতে বলতে আরো দুই তিনজনে এগিয়ে এলেন। আমি সবাইকে একই কথা জিজ্ঞাসা করলাম, হোটেল কোথায়, রুম আছে কিনা, রুমের ভাড়া কত, ফ্যাসিলিটি কি কি আছে, ব্রেকফাস্ট ফ্রী কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার কথা শুনতে শুনতে এটা বুঝে গেলাম যে কোনো না কোনো হোটেলে রুম ঠিক পেয়ে যাব। এটা নিয়ে আর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই । আমি আসার আগেই রিভিউ পড়ে দু তিনটে হোটেল সিলেক্ট করে নিয়েছিলাম। কাজেই ওনাদের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এলাম।
সামনে এগোতেই একজন এসে বললেন, বহিনজি কাহা জানা হ্যায়? আমি বললাম হোটেলে যাব, উনি জিজ্ঞাসা করলেন হোটেলে আগে থেকে ঠিক করা আছে কিনা। জানালাম যে কোনো হোটেল ঠিক করা নেই । উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, চলুন আমার গাড়িতে চলুন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কত ভাড়া, উনি হাজার টাকা চেয়ে বসলেন। হাজার টাকা দিয়ে হোটেলে পৌঁছানোর কোনো মানেই হয় না। দরকার হলে হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিয়ে ভালো রুমে থাকবো। অবশেষে একটা অটোওয়ালা সাথে কথা হল, উনি আমাকে আমার পছন্দের হোটেলে দিয়ে যাবেন, 200 টাকা নেবেন। যদি হোটেল পছন্দ না হয় তখন অন্য হোটেল দিয়ে যাবেন, কিন্তু তার জন্য আলাদা করে টাকা দিতে হবে।
যেতে যেতে অটো ড্রাইভার বললেন একটা নতুন হোটেল হয়েছে। আগে ওরা শুধু রেস্টুরেন্ট ছিল এখন থাকার রুম বানিয়েছে। আপনি একবার যেতে পারেন, খাবার খুব ভালো আর রুম পছন্দ না হলে অন্য জায়গায় চলে যাবেন। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে খিদে খিদে পাচ্ছিল আর খাবার খুব ভালো শুনে মনে হল যাই একবার।
হোটেলটায় ঢোকার মুখেই রেস্টুরেন্ট আর পেছনের দিকে থাকার জায়গা। রেস্টুরেন্ট বাইরেও বসার জায়গা আছে আর ভেতরে এসিতেও বসা যায়।
রেস্টুরেন্ট দেখে খিদে বেড়ে গেল আর অটো ড্রাইভারকে বললাম আগে খেয়ে নি, পরে রুম দেখা যাবে। উনি শুনে বললে যে দেরি হয়ে যাবে, আপনি আগে হোটেল দেখে নিন কিন্তু শেষমেষ রাজি হয়ে গেলেন। ওনাকে বললাম আপনিও আমার সাথে বসে খেয়ে নিন। উনি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, দুবার বলতে রাজি হয়ে গেলেন।
খাবার অর্ডার দিয়ে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কি কি দেখার জায়গা আছে? কতক্ষণ সময় লাগে অটোতে আর উনি কত ভাড়া নেবেন। ভাড়া উনি ঠিকঠাকই বললেন। মনে মনে ঠিক করে দিয়েছিলাম ওনার অটোতেই যাব, কিন্তু কিছু বলিনি।
আলুর পরোটা খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম ভদ্রলোক বারবার আমার বুকের দিকে তাকাচ্ছেন। বাইরে বসে গরমে কখন যে উইন্ডচিটারের চেন নামিয়ে দিয়েছি সেটার খেয়াল নেই আর উনি এই সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করছেন। মাথাটা এত গরম হয়ে গেল যে আর কি বলব। কিছু কিছু লোকের এই একটা দোষ , আপনি তার সাথে যত ভালো ব্যবহারই করুন না কেন, সে ঠিক আপনার বুকের দিকে তাকাবেই।
খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলাম রুমের জন্য কোথায় কথা বলব। ওয়েটার জানালো যে রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারে রুমের জন্য কথা বলতে হয়। যিনি বুকিং দিচ্ছিলেম উনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন সঙ্গে কে আছে। কেন বাবা একটা একা একা মেয়ে কি ঘুরতে পারে না ! আর আমি তো আর বাচ্চা মেয়ে নই, ২৫ বছর বয়স হয়ে গেছে। যাইহোক আমার একা থাকা নিয়ে কোন সমস্যা হলো না আর উনি আমাকে জানালেন রুম আছে। আবার পরের প্রশ্নই ছিল ঘুরতে যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা। ওনারা বললেন যে হোটেলের গাড়ি আছে, এছাড়াও দরকার হলে ওনারা বাইরে থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অটো ড্রাইভার যে খুশি হচ্ছেন না বুঝতে পারছি। বেশ হয়েছে, আরো তাকা আমার দিকে।
হোটেলের রুম যেটা দেখালো সেটা খারাপ না। রুমে ঢুকলেই একটা ওয়ারড্রব, পাশে দুটো চেয়ার একটা টেবিল আর একটা কুইন সাইজ বেড। আমার একার জন্য যথেষ্ট। রুমের ভাড়াও একটু কম, হয়তো নতুন খুলেছে বলেই। রুম বুক করে ড্রাইভারকে ২০০ টাকা দিয়ে ছেড়ে দিলাম।
রুমে ফিরে সুমনের কথা মনে পড়ছিল। এইসব রুম বুকিং ওর দায়িত্ব ছিল। এমন একটা ভাব করত যেন বুকিং করা কত সাংঘাতিক কাজ। আর রুমে ঢুকে পড়ে আসল কাজ শুরু করে দিত। সুমনের সাথে উইকেন্ডে বেড়াতে গিয়ে একবার হোটেলে ঢুকে পড়লেই হল। তারপরে বাবুকে ভেতরে ঢুকতে দিতে হবে। এখন এখন তো আর সেসব কিছুই নেই। শেষ কয়েক মাসে জীবন কেমন পাল্টে গেছে।
এইসব চাইপাশ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ অটো ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল। কিরকম নির্লজ্জের মত তাকাচ্ছিল। বাকি সব মেয়েদের মত আমিও লোকজনের তাকানোর সাথে অভ্যস্ত, কিন্তু এরকম নির্লজ্জের মত কেউ তাকালে একটা অস্বস্তি হয়, রাগও হয়। আমি না হয় এখন উপসী, তোদের তো স্বভাব দোষ।
রেস্ট নিয়ে রেডি হতে একটু দেরী হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম গাড়ি রেডি তো? উনারা বললেন আপনিতো গাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিছু তো কনফার্ম করে যান নি। উনারা বললেন গাড়ির ব্যবস্থা ওরা করে দেবেন কিন্তু একটু দেরি হবে। পাশে একটা সদ্য বিবাহিত কাপেল গাড়ির রেট নিয়ে খুব দরদাম করছিল। কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন আপনারা একটা গাড়িতে চলে যান না, রেট একটু কম পড়বে আর তাড়াতাড়ি গাড়িও পেয়ে যাবেন।
রেট নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিল না, আর অন্য কারো সাথে গাড়ি শেয়ার করার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু পরে ভাবলাম একে তো দেরি হয়ে গেছে, গাড়ি পেতে আরো কত দেরি হবে তার কোন ঠিক নেই। একা একা গেলে সেই লোক কেমন হবে কে জানে, এর চেয়ে ভালো এদের সাথেই যাই।
গাড়িতে আমি আর বউটা পেছনে বসলাম আর বরটা সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলেন। ওদের একটাই সমস্যা, একটু পরে পরেই গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার জন্য নেমে পরে। ড্রাইভার একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন কিন্তু আমার ভালই লাগছিল। তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে টুরিস্ট স্পটে পৌঁছে ভিড়ের মধ্যে একশটা ছবি তোলার থেকে, ওরা যে জার্নিটা এনজয় করছে সেটাই ভালো। আমিও ওদের কিছু ছবি তুলে দিলাম।
গন্ডগোল বাঁধলো ফেরার সময়। ঘুরতে এবং খেতে আমাদের বেশ কিছু সময় লেগেছে তাই ফেরার সময় ড্রাইভার একটু স্পিডেই গাড়িটা চালাতে শুরু করল। হঠাৎ বউটা বলে গাড়ি থামাও। আমি ভাবলাম হয়তো আবার ছবি তুলবে, কিন্তু কিছু ভাবার আগেই গাড়ির মধ্যে হরহর করে বমি করে দিল।
আমি ড্রাইভার কে বললাম গাড়িটা দাঁড় করান, উনি একটু রেস্ট নিক, আপনি গাড়ির ভেতরটা একটু পরিষ্কার করে দিন। তারপরে আস্তে আস্তে গাড়ি চালান।
এইসব এইসব করতে করতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট চলে গেল। আমি গাড়িতে উঠে দেখলাম ভেতরটা পরিষ্কার হয়েছে বটে কিন্তু বমির গন্ধ বের হচ্ছে। কিছু বললাম না কারণ কিই বা করার আছে। ড্রাইভার আবার গাড়ি স্টার্ট করলেন, স্টার্ট করার সাথে সাথে আবার বমি। এবারও গাড়ির ভেতরে আর কিছুটা আবার আমার উইন্ডচিটারের হাতায় পড়ল।
এইবার ড্রাইভার দেখলাম বেশ রেগে গেলেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে ফোন করে বললেন যে প্যাসেঞ্জার শুধু বমি করছে, গাড়ি একদম নোংরা হয়ে গেছে, ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। হোটেল থেকে বলল আরেকটা গাড়ি আসছে, বমির ওষুধ দিয়ে আসছে, চিন্তা করার কোন কারণ নেই। পেসেঞ্জাররা রেস্ট নিক, কোনো অসুবিধা হবে না।
আরেকটা গাড়ি আসছে শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। বমির গন্ধে আমার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন নতুন গাড়ি আসবে। তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে, বাইরেটাকে দেখতেও খুব ভালো লাগছিল। বরটাকে দেখলাম খুব আদর করে বউটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ দেখে আমাদের গাড়ির সামনে একটা বাইক এসে থামল। ওনাকে চেনা চেনা লাগছে তারপর মনে পড়ল কাউন্টারে উনি বসে ছিলেন কারো সাথে কথা বলছিলেন। উনি এসে ওষুধ দিলেন তার পরে আমাকে বললেন আপনি বরং আমার সাথে বাইকে চলুন। অচেনা লোকের সাথে বাইকে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু গাড়িতে বমির গন্ধ, আবার যে বমি করবে না তারও নিশ্চয়তা দিই। বরটাও বলল , দিদিভাই আপনি কিছু মনে না করলে বাইকে চলে যান। আমাদের জন্য আপনাকে এই বিরম্বনায় পরতে হলো। শেষমেশ ঠিক হলো আমি বাইকেই যাব, গাড়ি আর বাইক একসাথে চলবে এবং গাড়িটাকে বলা হলো খুব আস্তে আস্তে চালাতে।
বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। বাইক চলতে শুরু করল, উনি খুব আস্তে আস্তেই বাইক চালাচ্ছিলেন। কেউই কারো সাথে কথা বলছিলাম না, কথা কি বলবো কেউ তো কাউকে চিনি না।
আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি হোটেলের ম্যানেজার? উনি হেসে বললেন না না আমি এই হোটেলের ইনভেস্টার। উইকেন্ডে আসি, এছাড়া আমি জব করি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কি করি? আমি বললাম আমি এমবিএ শেষ করে জব করছি। উনি বললেন যে উনিও ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে জোকা থেকে এমবিএ করেছেন। আমিতো জোকা শুনে খুশি হয়ে গেলাম, বললাম আমিও তো জোকা। যাক বেড়াতে এসে জোকার একজন সিনিয়ারের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি বললেন যে আমি কিন্তু তোমার থেকে অনেকটাই সিনিয়ার। কোন ইয়ারে পাস করেছে সেটাও বললেন। আমি মনে মনে হিসাব করলাম, উনি আমার থেকে 16 বছর আগে পাশ করেছেন আর ইঞ্জিনিয়ারিং করতে এক বছর বেশি লাগে। উনি আমার থেকে প্রায় ১৭-১৮ বছরের বয়সে বড়।
ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনার নাম কি। উনি বললেন আমার নাম রাজেশ আর এতক্ষণ যখন স্যার বলে ডাকো নি, তখন আর স্যার বলতে হবে না। তুমি তো বাঙালি, তুমি আমাকে রাজেশদা বলেই ডাকো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমি বাঙালি বুঝলেন কি করে? আমার হিন্দি উচ্চারণ শুনে? রাজেশদা হেসে বলল তোমার হিন্দি উচ্চারণ বেশ ভালো। প্রশংসা কার না ভালো লাগে, রাজেশদা বললোও বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে।
অবশেষে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। ওদের গাড়িটাও আমাদের সাথে সাথেই পৌঁছল। বউটাকে দেখে মনে হল একটু ভালো আছে। ওরা ওদের ঘরে চলে গেল। আমি রাজেশদা কে ধন্যবাদ জানালাম আর হ্যান্ডসেক করলাম। রাজেশদা বলল, অতসী ইভিনিং স্ন্যাক্স তুমি ঘরেও খেতে পারো বা বাইরে এসেও খেতে পারো। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি ঘরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে অর্ডার করছি। রাজেশ দা বলল অর্ডার করে দিও, খাবার রেডি হতে হতে কিন্তু আধঘন্টা লাগিয়ে দেবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি তাড়াতাড়ি অর্ডার করে দেব। রাজেশদা তো তখনও আমার হাত ধরে আছে। আমি একটু হেসে এবার হাতটা ছাড়িয়ে দিলাম, রাজেশদাও একটু হাসলো। আমি রাজেশদাকে টাটা বলে খুশি মনে নিজের রুমে চলে এলাম।
রাজেশদা বেশ স্মার্ট। চাকরি করে সাথে একটা ব্যবসা খুলেছে , কথাবার্তাও খুব ভালো। আমার ডান হাতটা তো এখনো গরম হয়ে আছে।
অতসী বন্দোপাধ্যায়