Thread Rating:
  • 49 Vote(s) - 3.24 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL মহাবীর্য্য ভাণ্ডার (নবকাহিনী শ্যামলবাবুর আখ্যান প্রকাশিত)
#34
রাজনন্দিনীর সলিল সমাধি
 © মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা

[Image: 330ee2367b6b1528c3814c4f62fbeaba-1.jpg]



বাপ-মায়ে বড় আদর করিয়া নাম রাখিয়াছিল, "রাজনন্দিনী।" রাজনন্দিনীর কপোলে চুমু দিয়া উহার বাপ কহিয়াছিল,  "মা তুই হলি আমার রাজকন্যা তাই তো তোরে এই নাম দিয়াছি।" আধো আধো কন্ঠে রাজনন্দিনী শুধাইল, "তবে আমার বিয়া দিতেছ কেন? মা কহিয়াছে আমাকে নাকি ইহার পর হইতে শ্বশুরবাটীতে থাকিতে হইবে! তোমরা আমাকে আর ভাত দিবে না!" নিজ কন্যার এমন প্রশ্ন শুনিয়া রাজনন্দিনীর পিতার বুক ফাটিয়া যাইতেছিল তথাপি বুকে পাষাণ বান্ধিয়া কহিল, "এই অভাগা বঙ্গদেশে উহাই দস্তুর মা। পরের ধন কতদিন আর নিজকাছে রাখিব। লোকে কী কহিবে!"
ইহার অনতিকাল অতিক্রান্ত হইতে না হইতে নয় বৎসরের রাজনন্দিনীর সত্তরোর্ধ্ব শ্যামগোপালবাবুর সহিত বিবাহ হইয়া গেল। রাজনন্দিনীর স্বামীর বয়স রাজনন্দিনীর পিতা অপেক্ষাও বেশী! যাঁহার 'পিতৃব্য' হইবার কথা তাহাকে 'স্বামী' কহিতে হইবে ইহার পর হইতে! দুর্ভাগ্য আরও বেশী কারণ রাজনন্দিনী'র, 'স্বামী' যে আদতে কী বস্তু, তাহা গায়ে দেয় না মাথায় লাগায় তাহা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দূরে থাকুক নূন্যতম জ্ঞানখানি নাই! রাজনন্দিনীর মাতা বারম্বার উহাকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, "দেখ মা উহারা হইল কুলীন বামুন আমাদিগের মত নহে। একটু রসিয়া বসিয়া থাকিবি।" রাজনন্দিনী ফের প্রশ্ন করিয়াছে, "আমরাও তো বামুন।" রাজনন্দিনীর মা বুঝাইতে বুঝাইতে কহিয়াছে, "তাহা সত্য তবে কী'না আমরা হইলাম ভটচায‍্যি বামুন আর উহারা বন্দ্যোপাধ্যায়। কূলশ্রেষ্ঠ ', উপরন্তু শাণ্ডীল‍্য গোত্রের। উহাদের সম্মান আমাদের অপেক্ষা সহস্রাধিক উপরে মা। তোমার পতিদেবের তুমি লহিয়া মাত্র দ্বাদশটি পত্নী হইবে। সেটিও উনি করিতে নিমরাজী ছিলেন নিতান্তই তোমার বাবাকে উনি পছন্দ করেন এবং কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কষ্ট বুঝেন তাই সামান্য স্বর্ণ পণ লহিয়াই রাজী হইয়াছেন। তুমি আবার এ লহিয়া কোন প্রশ্ন করিতে যাইও না। উনি যাহা বলিবেন তাহাই করিবে।" 
সেই হইতে রাজনন্দিনী শিখিল প্রশ্ন করা নহে বরং প্রশ্নহীনা হইয়া স্রেফ পালন করিয়া যাওয়াই নারীর অধিকার। একটু বড় হইবার পর রাজনন্দিনী দুই-চারিবার ভাবিয়া দেখিয়াছিল উহাদের বাসায় যে নমঃশূদ্রটী বেগার কাজ করে তাহার সহিত রাজনন্দিনীর তেমন প্রভেদ নাই। উহাকে স্রেফ গালি খাইতে হয় আর রাজনন্দিনীকে ত্রুটির কারণে ভদ্রভাষায় কথার চাবুক খাইতে হয়, উহাকে মাটিতে শুইতে হয়, রাজনন্দিনীকে নিজের বৃদ্ধ স্বামীর পদসেবা করিতে করিতে মধ্যরাত্রে শুইতে যাইতে হয় আর শেষ রাত্রে ফের উঠিয়া গৃহকার্য্য করিতে হয়। নইলে সাদা আর কালোর তেমন প্রভেদ নাই। গাধা দুইজনেই তফাৎ এতটুকু একজনকে সরাসরি গাধা বলা হয় আরেকজনকে আচরণে বুঝানো হয় যে বোঝা তাহাকেই টানিতে হইবে।
তৎসত্ত্বেও, রাজনন্দিনী সব মানিয়া লহিয়াছিল, যতদিন না উহার সলিলের সহিত সাক্ষাৎ হইল। সলিল ডাক্তারী পাশ করিয়া বিলাত হইতে আসিয়াছে। শ্যামগোপালবাবুর দূরসম্পর্কের ভ্রাতা হয়। যদিও, সলিলের বয়েস যেথা বিশ-বাইশ বৎসর হইবে শ্যামগোপালবাবু সেইখানে আশি পার করিবেন। মনে মনে রাজনন্দিনী কহিয়াছিল, যাহার দুজনেরই 'তাৎ' হইবার কথা তিনি একজনের 'স্বামী' হইলেন আর অপরজনের 'ভাই'! 
সাক্ষাতে কিছু না বলিলেও শ্যামগোপালবাবু আড়ালে নিজের এই ভ্রাতাটীকে 'ম্লেচ্ছ' বলিয়া থাকেন। তিনি বুঝিতে পারেন না, ওই শ্বেতাঙ্গদের দেশে গিয়া জাতকুল হারাইয়া কীরূপে তাহার এই ভাইটী বাঁচিয়া আছে! আয়ুর্বেদ শিখিয়াও তো কবিরাজ হইতে পারিত বিস্তর খরচা করিয়া ওই ম্লেচ্ছদের দেশে গিয়া ডাক্তারী পাঠের কীই'বা উপকারিতা তাহা শ্যামগোপালবাবুর বোধগম্য হয় নাই। কিন্তু, ভাইটি তাহাকে অ্যালোপেথীতে কিছু ঔষধি দিয়ার কারণে তিনি ইদানীং কিঞ্চিৎ সুস্থ আছেন বলিয়া বোধ করেন তাই নিরুপায় হইয়া সহ্য করিতেছেন। তবে, সিদ্ধান্ত লহিয়াছেন একটু সুস্থ হইলেই তিনি উহাকে পত্রপাঠ বিদায় দিবেন। হোক ভাই, কোন নিজের আপন আত্মজ তো নহে। অমন কূলজাতহীনকে নিজ বাটীতে ঠাঁই দিতে তিনি নারাজ। সকলের আড়ালে গিয়া সলিল প্রদত্ত একখানি বড়ি খাইয়া শ্যামগোপালবাবু ভাবিলেন ছোকরা অবশ্য রোগ ভালই ধরিতে পারে।
রাজনন্দিনীর সহিত সলিলের পরিচয় হইল যবে এক গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে রাজনন্দিনী একখানি শরবতের গেলাস লহিয়া উহার কক্ষে আসিল। "ঠাকুরপো! দিনভর পড়াশুনা কর, রুগী দেখিয়া বেড়াও, মগজখানি তো গরম হইয়া যাইবে। এই শীকঞ্জীর শরবতখানি বানাইয়াছি, খাইয়া লও; মাথা ঠাণ্ডা হইবে!" সলিলের এ বাটীতে আসা ইস্তক একপক্ষকাল অতীত হইয়াছে। এ বাড়ীতে কেহ তাহার সহিত 'রা' অবধি কাড়িতে চাহে না জাত যাইবার ভয়ে, বাটীর সীমানার পেছনে একখানি ভাঙ্গাচোরা কুঁড়ে ঘর ছিল তাহাই সামান্য মেরামত করিয়া শ্যামগোপালবাবু উহাকে রহিতে দিয়াছেন। সেইখানে একজন সরাসরি সম্বন্ধ পাতাইয়া তাহাকেই শরবতের গেলাস ধরাইয়া দিতেছে ইহা দেখিয়া সলিলের মনে হইল তাহার বোধকরি স্বপ্নভ্রম হইতেছে। চোখ কচলাইয়া দেখিল, না, সত্য সত্যই রাজনন্দিনী উহার শিয়র সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে হাতে গেলাস লহিয়া। সলিল হাসিয়া কহিল, "বৌঠান তোমার জাত যাইবার ভয় নাই?" রাজনন্দিনী ঘোমটার আড়াল হইতে মৃদু হাসিয়া কহিল, "আসিবার কালে কী জাত ছিলে? আসিয়া তুমি কী জাত নিলে? কী জাত হইবে যাবার কালে?" কাষ্ঠ নির্ম্মিত টেবিলখানির  উপরে ঠক্ করিয়া গেলাসখানি রাখিয়া রাজনন্দিনী বাহির হইয়া গেল। সলিল শীকঞ্জীর স্বাদ বিবরস্থ করিতে করিতে ভাবিল, "লালন আজ বাস্তবিক তোমার জন্ম লওয়া সার্থক হইল! কেহ তো জাতের মর্ম্ম বুঝিল!"
ইহার পর হইতে রাজনন্দিনীর সহিত সলিলের নিত্য কথা হইতে লাগিল। রাজনন্দিনী মাছের মুড়'টী সলিলের পাতে দেয়, সলিল উহাকে সম্বাদ কৌমুদী পড়িয়া শুনায়। রাজনন্দিনী অবাক হইয়া শুনে কী প্রকারে এক ম্লেচ্ছ তিনখানি গ্রাম লহিয়া কলিকাতার পত্তন ঘটাইল, কেমন করিয়া ঢাকা সহর হইতে মুর্শীদাবাদ ফেরৎ আসিল রাজধানী, কীরূপেই বা গৌড়ে রাজা লক্ষণসেন লক্ষণাবতী তৈয়ার করিয়া ছিলেন। সলিল তাহাকে মৈত্রেয়ী-গার্গী-অপালার গল্প কহে, রাজনন্দিনী উহাকে খই আর আম খাইতে দেয়, সলিল হাসিয়া কহে, 'খৈয়াম বড় কবি ছিল জান বৌঠান।' বৌঠান হাসিয়া কহে, 'উনি ওমর ছিলেন তবে তুমি অমর নও, না খাইলে মরিয়া যাইবে তাই খাইয়া লও!' কহিয়া ঘোমটা টানিয়া ছুট দেয়। 
একদিন রাজনন্দিনী আসিল না। সলিল বহু অপেক্ষা করিয়াও যখন উহার দেখা পাহিল না তখন সলিল বাটীর ভিতরে গিয়া দেখিল রাজনন্দিনী পাকশালার মেঝেতে লুটাইয়া পড়িয়া আছে, গায়ে হাত দিয়া দেখিল ধুম জ্বর! সলিল তৎক্ষণাৎ উহাকে বিছানায় শুয়াইয়া শ্যামগোপালবাবুকে ব্যবস্থা লহিতে জানাইল, শ্যামগোপালবাবু হুঁকা টানিতে টানিতে কহিলেন, "কাজ না করিবার জন্য অমন ঢের ঢের জ্বর আসে।" সলিল বহুবার বুঝাইবার চেষ্টা করিল কিন্তু শ্যামগোপালবাবু শুনিলেন না। তখন নিরুপায় সলিল কহিল, "আপনি যদি আমাকে বৌঠানের চিকিৎসা করিতে না দেন তবে আমি আপনারও চিকিৎসা আর করিব না।" শ্যামগোপালবাবু রোষকষায়িত নেত্রে চাহিয়া কহিলেন, "বটে দু'ছত্তর ইংরাজী পড়িয়া তোমার এত আস্পর্ধা! তুমি আমাকে ধমকী দিতেছ!" সলিল দৃঢ় কন্ঠে জানাইল, "জ্ঞান নহে জ্যেষ্ঠ, উহা দিবার সাধ্য আমার নাই। আর দিলেও আপনি লহিবেন না তাও আমি বুঝি। আমি শুধু আপনাকে সত্য জ্ঞাপন করাইয়া দিতে চাহিতেছি। আমাদিগের ডাক্তারদিগের একখানি শপথ লহিতে হয় তাহা হইল 'হিপোক্রিটীয় শপথ'। সেই শপথ হেতু সংসার যদি প্রলয়গ্রস্তও হইয়া যায় তথাপি আমাকে চিকিৎসা করিতে হইবে। যদি আপনি আমাকে তাহা হইতে বঞ্চিত করেন তবে আমি এই মুহূর্তে বাটী ত্যাগ করিব।" শ্যামগোপালবাবু হুঁকায় ক্ষণকাল টান দিতে দিতে কীয়ৎ ভাবিয়া চিন্তিয়া কহিলেন, "বেশ! চিকিচ্ছে করিও তবে আমি ওষধির মূল্য চুকাইব না।" সলিল কহিল, "অশেষ ধন্যবাদ!" বলিয়া সে অন্তঃপুরে যাইয়া রাজনন্দিনীর চিকিৎসা আরম্ভ করিল। 
দিনকয়েকের মধ্যেই রাজনন্দিনী সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া গেল। 
এক দ্বিপ্রহরে সলিল একটী ডাক্তারীর মোটা কেতাব লহিয়া বসিয়াছিল এমন সময় রাজনন্দিনী আসিল। প্রতিদিনের ন্যয় সলিল বৌঠানের সহিত হাসিখেলা করিতেছিল হঠাৎ রাজনন্দিনী কোন কারণে পা ফস্কাইয়া সলিলের উপরে গিয়া পড়িল। সলিল তৎক্ষণাৎ উহাকে ধরিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সলিল বুঝিল তাহার করতলে ভীষণ কোমল কোন কিছু রহিয়াছে। সলিল প্রথমে বুঝিতে পারে নাই, "বৌঠান তোমার গা এত নরম!" কহিয়া টিপিতেই সলিলের চক্ষুস্থির হইয়া গেল। সে বুঝিয়া ফেলিয়াছে তাহার হাত কোথায় পড়িয়াছে। রাজনন্দিনীর মুখ রক্তাভ হইয়াছে। লালীমায় রাঙ্গা সে মুখ তুলিয়া রাজনন্দিনী সলিলের দিকে চাহিল। সলিল দেখিল সেই আঁখিপটে ক্রোধের লেশমাত্র নাই, আছে কেবল নারীত্বের লজ্জ্বা আর প্রশ্রয়। সলিল থামিতে পারিল না আর, মুহূর্তেই নিজ বক্ষমাঝে টানিয়া লহিল রাজনন্দিনীকে। তাহার গণ্ডদেশ কপোল-কপাল সমেত সমস্ত মুখমণ্ডলীকে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়া দিল। নিজের অধরে রাজনন্দিনীর ওষ্ঠ ভরিয়া লহিল। রাজনন্দিনী নিজের বিশ বৎসর বয়সে আসিয়া এই প্রথম পুরুষের স্পর্শ পাহিল। এতকাল পুরুষের আদর বুঝিতে সে নিজের জ্বরাগ্রস্ত স্বামীর পদসেবাকেই বুঝিত। শুধু পুকুরপাড়ে স্নানাদি ও বাসন মাজিবার নিমিত্তে যাহিয়া অন্য রমণীদের কাছ হইতে শুনিয়া বুঝিয়া ছিল আদিম খেলা অন্য বস্তু। তাহা জানিয়া রাজনন্দিনী শ্যামগোপালবাবুর নিকট সেই খেলা খেলিবার কথা কথাচ্ছলে উপস্থাপিত করিলে শ্যামগোপালবাবু উহার পুকুরপাড়ে যাইবার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া দিয়াছিলেন। 
আজ সলিলের প্রেম চুম্বনে রাজনন্দিনী প্রথমবার টের পাহিল পুরুষ ও নারীর ওষ্ঠাধরের খেলা কত গভীর হয়! ধীরে ধীরে তাহার শরীর শিথিল হইয়া আসিল নিজেকে সে সলিলের নিকট সঁপিয়া দিল। সলিল ধীরে ধীরে রাজনন্দিনীর শাড়ীটী খুলিতে লাগিল। রাজনন্দিনী সলিলের জীবনে প্রথম নারী নহে তবে রাজনন্দিনী অবশ্যই সলিলের জীবনের সেই নারী যাহার জন্যে সে 'ট্রয়ের যুদ্ধ' লড়িতে সক্ষম। সলিলের মুখ ধীরে ধীরে রাজনন্দিনীর স্তনদ্বয়ের উপরে নামিয়া আসিল। রাজনন্দিনী পুলকে পুলকে শিহরিত হইতে থাকিল। সলিল যবে তাহার বৃন্ত দুইটী লহিয়া শিশুর মত খাইতে ছিল রাজনন্দিনীর মনে হইতেছিল তাহার প্রতিটী রোমকূপে যেন তড়িৎ প্রবাহিত হইতেছে। সলিল যেন রাজনন্দিনীর প্রতিটি কোষে নিজের আত্মীকরণ করিতেছিল। ধীরে ধীরে সলিল নাভীমূলে আসিয়া রাজনন্দিনীর শায়ার রজ্জুতে টান দিল। পরম লজ্জ্বায় রাঙ্গা হইয়া রাজনন্দিনী শেষ প্রচেষ্টা করিল উহাকে আটকাইতে কিন্তু সলিলের পৌরুষ শক্তি আজ উহার নারীত্বকে পরাজিত করিল। কুঞ্চিত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সদৃশ কেশের আড়ালে সযত্নে রহিত সেই গুহা মধ্যে সলিল নিজ স্তম্ভ প্রবেশ করাইল। এই প্রথম রাজনন্দিনী নিজ কৌমার্য্য হারাইল। কিন্তু ইহা হারাইয়াও সে তৃপ্ত হইল। হৃত হওয়া অপেক্ষা প্রাপ্তির ভাণ্ডার বেশী পূর্ণ হইতেছিল। শারীরিক যন্ত্রণা মানসিক প্রশান্তির সম্মুখে অগ্নি সম্মুখে তুষের ন্যয় উড়িয়া গেল। ইহার পর শয্যা জুড়িয়া কেবল তুফান বহিল।
 সেই ঝড় থামিল! মেঘলা আকাশের ঘোর বর্ষণশেষে জলস্তম্ভ কীয়ৎকাল পর নামিয়া গেলে আননে স্বেদবিন্দু লহিয়া পরিতৃপ্ত রাজনন্দিনী ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। তাহার লজ্জ্বাবনতঃ মুখখানি সলিলের পানে চাহিতে পারিতেছিল না। আপন বস্ত্রখানি কোনক্রমে পরিধান পূর্ব্বক রাজনন্দিনী ঘর হইতে ছুট দিল।
ইহার পর হইতে নিত্য রাজনন্দিনী ও সলিলের দ্বিপ্রহরে রতিমদনের রসের খেলা চলিতে লাগিল। 
একদিন সলিল সন্ধ্যায় ভারতীয় শল্য চিকিৎসার উপর একখানা প্রাচীন পুঁথি পড়িতেছিল, এমন সময় রাজনন্দিনী ত্রস্ত কন্ঠে আসিয়া বলিল, "ঠাকুরপো! বড় বিপদ! উনার শরীরখানি কেমন করিতেছে ঠাকুরপো! একবার শীঘ্র‍্য দেখিবে চল!" সলিল ঝটপট গায়ে পাঞ্জাবীখানি চড়াইয়া ভিতর ঘরে গেল। যাইয়া বুঝিল শ্যামগোপালবাবুর অন্তিম সময় আসন্ন। চট করিয়া একটী ইঞ্জেকশন দিয়া কহিল, 'বৌঠান মাথায় জলপটি দিতে থাক। আর মাঝে মাঝে গরম সরিষার তৈল পায়ে মালিশ করিতে থাক। আমাকে একবারটী সহরে যাইতে হইবে। ঔষধ না দিলে এ যাত্রা ভ্রাতা টিকিবে না মনে হইতেছে!" এই বলিয়া সলিল সহরের পথে রওনা দিল। 
ঔষধ যোগাড় করিয়া দ্রুত আসিবার নিমিত্তে গাড়ী করিয়াও সলিলের গ্রামমধ্যে ফেরৎ আসিতে আসিতে বেশ বেলা হইয়া গেল। আসিয়া দেখিল বাটীমধ্যে বেশ কিছু রমণী বুক চাপড়াইয়া কাঁদিতেছে। সলিলের বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিয়া উঠিল! তবে কী ইঞ্জেকশন কাজ করে নাই! শুধাইয়া জানিল উহাই সত্য। এক বরিষ্ঠ ব্যাক্তি তথায় ছিলেন উনি জানাইলেন যে শেষরাত্রেই শ্যামগোপালবাবু ইহকাল ত্যাগ করিয়াছেন। সলিল জিজ্ঞাসা করিল, "রাজনন্দিনী বৌঠানরে দেখিতেছি না! উনি কোথায়?" ব্যাক্তিটি জানাইলেন, রাজনন্দিনী 'সতীধর্ম্ম পালন' করিতে গিয়াছে! কূলীন দ্বিজ পুরুষের একা স্বর্গারোহন সম্ভব নহে, তাই সহধর্মিণীর কর্ম্মহেতু রাজনন্দিনী শ্যামগোপাল বাবুর সহিত চিতারূঢ় হইতে গিয়াছে! সলিলের পদস্থল হইতে মা বসুধা মুহূর্তেই সরিয়া গেল, আর তালু হইতে বৃহস্পতি! কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় সলিল বুঝিতে পারিতেছিল না সে কী করিবে! ব্যাক্তিটি পুনরায় জানাইলেন, ৺শ্যামগোপালবাবুর বাকী একাদশ পত্নীদিগের আসিতে বেশ বিলম্ব হইতেছিল। প্রত্যেকেই পিতৃগৃহে স্থিত ছিল সুতরাং উহাদের আসিবার পর প্রস্তুত হইতে হইতে আরও বিলম্ব হইয়া যাইত। বিস্তর বিলম্ব করিলে দহন হেতু ডোম্ পাওয়া মুশকিল তাই রাজনন্দিনী সবার কনিষ্ঠা হইয়াও সতী হইবার সৌভাগ্য পাহিয়াছে! সলিল আর শুনিতে পারিল না, জমিনে নিজের মস্তকখানি একবার ঠুকিয়া লহিল! জগদীশ আজ উহাকে সর্বস্রান্ত করিবার চক্রান্ত কষিয়াছেন বোধকরি! সলিল ঊর্ধ্বশ্বাসে শ্মশান সমীপে দৌড় লাগাইল। কাঁটায় লাগিয়া তাহার পা ক্ষতবিক্ষত হইতে লাগিল, ধূতি জীর্ণ হইয়া গেল কিন্তু সলিলের বিকার নাই। যতক্ষণে সে বৈতরণীর স্থানে উপনীত হইল ততক্ষণে  আকাশ ধূম্রাচ্ছন্ন হইয়াছে। ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ সহযোগে রাজনন্দিনী সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় চাপিতেছে। সলিল হাঁফাইতে হাঁফাইতে উন্মাদের ন্যয় চিৎকার করিতে লাগিল, "রাজনন্দিনী! আমার রাজনন্দিনী! হা আমার রাজনন্দিনী!" কিন্তু ঢাকের ঘোর নিনাদে সলিলের সে হাহাকার কাহারও কর্ণগোচর হইল না। সলিল দম লহিয়া ফের ছুটিল এইবার আর থামিল না। "বৌঠান! তুমি কহিয়াছিলে আমরা সমুদ্রস্নানে যাইব একসাথে! উহা যখন হইলই না তখন চল একসাথে অগ্নিস্নান করিয়া লই!" কহিয়া জনারণ্য ভেদ করিয়া সলিল জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিল!

জীবন্ত পুড়িবার যাতনায় রাজনন্দিনীর আত্মা চিৎকার করিতেছিল। বাপ-মায়ে উহার নাম রাখিয়াছিল রাজনন্দিনী! বড় আদরের সেই রাজনন্দিনী আজ সংসারের সকল আদরকে উপেক্ষা করিয়া কাঁদিতেছিল। তাহার একটাই কষ্ট, লোকটা জানিল না তাহার গর্ভে উহার সন্তান পালিত হইতেছে! সলিল! সে শুধু শেষবার ওই লোকটাকে দেখিতে চাহিয়াছিল। "যদি সতী হইতেই হয়, তবে, উহার হইতাম! এই বুড়ার সতী কীসের!" সত্য বলিতে, রাজনন্দিনী তাহার অন্তিম সময়ে কী ভাবিতেছিল, কাহাকেই বা দোষ দিতেছিল এই অধম মহাবীর্য্য অদ্যাবধি উপলব্ধি করিতে পারে নাই শুধু কম্পিত হস্তে তুলিতে কালি যোগাইতে যোগাইতে বুঝিয়াছিল জগদীশ বোধকরি রাজনন্দিনীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করিবা নিমিত্তই সলিলকে আজ পাঠাইয়াছেন!
বাপ-মায়ে বড় আদর করিয়া উহার নাম রাখিয়াছিল রাজনন্দিনী! হতভাগিনী যবে ভাবিল সকলই শেষ তখনই দেখিল চিতার উপরে আসিয়া সলিল উহাকে জাপটাইয়া ধরিয়া আছে! তীব্র আগুনের তাপে দগ্ধ হইতে হইতে সলিল কহিল, "বৌঠান এ জন্মে তো একত্রে মরিলাম; পরজন্ম বলিয়া যদি কিছু থাকিয়া থাকে তবে সে জন্মে কিন্তু আমার বউ হবে আর বৌঠান নহে!" রাজনন্দিনী পুড়িতে পুড়িতেও হাসিল, কোনমতে ঠোঁট দু'খানি স্বল্প ফাঁক করিয়া ধীম কণ্ঠে কহিল, "অগ্নি নহে! অগ্নি নহে! ঠাকুরপো! জগদীশ আমার এই অগ্নিতেই আজ সলিল সমাধি করিলেন।"
দেড়শত লোক অবাক হইয়া দেখিতেছিল এক চিতাতে তিন লাশ পুড়িতেছে! তাহার দুইটি জীবন্ত! কিন্তু উহাদের মুখ হইতে একটা শব্দ নিঃসৃত হইল না! 
বাপ-মায়ে বড় আদর করিয়া নাম রাখিয়াছিল রাজনন্দিনী!

ইহার এক বৎসর পরে খৃষ্টাব্দ ১৮২৯ অব্দে রাজা রামমোহনের বহু প্রচেষ্টার হেতু বড়লাট বেন্টিঙ্ক আইন করিয়া ভারতবর্ষ হইতে সতীদাহপ্রথাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করিয়া দিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বাল্যবিবাহ আর বহুবিবাহ উভয়ই বন্ধ হইল। চালু হইল বিধবাবিবাহ। স্বাধীন ভারতের প্রণেতারা সংবিধানের ধারায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কর্ম্মক্ষেত্রে সমান বেতন ধার্য্য করিলেন। খৃষ্টাব্দ ২০২২ সনে মাননীয় প্রধান ধর্ম্মাধিকরণ আইন করিয়া নারীর শরীরের উপর শুধু সেই নারীরই অধিকার রহিয়াছে বলিয়া রায় দিলেন। সহস্র যোজন অন্ধকারের পথ এই ভারতকে যাইতে হইয়াছে তবে অদ্যের আলোকিত ভারত নির্ম্মিত হইয়াছে। 

“কতকাল পরে বল ভারত রে
দুখ-সাগর সাঁতারি পার হবে…
নিজ বাসভূমে, পরবাসী হলে
পর-দাসখতে সমুদায় দিলে…।”
                     (শ্রী গোবিন্দচন্দ্র রায়)


আক্ষেপ ইহাই শত শত রাজনন্দিনী উহা দেখিতে পারিল না! জানিতে পারিল না!


(সমাপ্ত)



প্রথম প্রকাশঃ ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
                            Namaskar
[Image: 20230923-133529.png]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মহাবীর্য্যের গল্পগুচ্ছ (অসংখ্য স্বরচিত ছোট গল্পের সম্ভার) - by মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা - 05-11-2022, 12:33 PM



Users browsing this thread: 78 Guest(s)