Thread Rating:
  • 159 Vote(s) - 3.41 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
WRITER'S SPECIAL গোলকধাঁধায় গোগোল (সমাপ্ত)
(01-11-2022, 08:39 PM)Bumba_1 Wrote:
[Image: Polish-20221030-221537890.jpg]

(২)

কাবেরী দেবীর শেষের কথাগুলো কানে পৌঁছলো না গোগোলের। ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে রেলপাড়ের সার্বজনীন দুর্গা মন্ডপের সামনে যখন সে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ন'টা অতিক্রম করে গিয়েছে। বাইক থেকে নেমেই তার ব্যস্ত এবং বিচলিত দুটি চোখ খুঁজে বেড়াতে লাগলো হিয়াকে। কিন্তু সে তো একা আসেনি .. তার সঙ্গে কাকিমার নাকি এক পরিচিত ভদ্রলোকের ছেলে এসেছে। হলোই বা তার একটু দেরি .. সে যখন ক্লাবের পুজো কমিটির সেক্রেটারি তখন তার তো একটা দায়িত্ব আছে। সবদিক সামলে তো তাকে আসতে হবে, তার উপর আজ মৌমিতার ওই মর্মান্তিক খবরটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গেছিলো তার জীবনে। যদিও হিয়া এইসবের কিছুই জানেনা। তাই বলে সে আসবে জেনেও চেনা নেই জানা নেই একটা ছেলের সঙ্গে ড্যাং ড্যাং করে ঠাকুর দেখতে চলে এলো? দেখা হোক, কোনোদিন সে যা করেনি, আজ তাই করবে। খুব করে শাসন করবে হিয়াকে।

এই চত্বরে দুর্গাপুজোর আধিক্য খুব একটা বেশি নেই। তাই নবমীর রাতে রেলপাড়ের দুর্গা মন্ডপে দর্শনার্থীদের ভিড় বেশ ভালোই হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও মন্ডপের প্রতিটা আনাচ-কানাচ এতক্ষণে চষে ফেলেছে গোগোল। কিন্তু হিয়ার দেখা নেই কোথাও। যেখানে তার শৈশবকাল কেটেছে অর্থাৎ ওরা কি তবে অফিসার্স কম্পাউন্ডের পুজো দেখতে গেছে? কিন্তু ওখান থেকে তো বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যাবে। এতক্ষণ কি কাকিমা অ্যালাও করবে হিয়াকে বাইরে থাকার জন্য কিংবা ওর যদি কোনো বিপদ হয়!কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর থেকে গভীরতর হলো গোগোলের।

"আরে অনির্বাণ বাবু তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে এদিক-সেদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি .. হেহেহে। ক্লাবেও গিয়েছিলাম তোমার খোঁজে, ওখানে বললো তুমি নাকি বাইক নিয়ে কোথাও একটু বেরিয়েছো। যাই হোক, অষ্টমীর ভোগের জন্য চাল ডালের হিসেবটা দিতে এসেছিলাম। না মানে এখনি চাইছি না, পরে তোমাদের সময় মতো দিও .. হেহেহে। আসলে গোবিন্দভোগ চাল, সোনা মুগ ডাল, ঘি, গোটা গরম মসলা, হলুদগুঁড়ো - এছাড়াও অনেকগুলো জিনিস আছে তো .. তাই একটা ফর্দ করে নিয়ে এসেছি .. হেহেহে।" প্রতিটি কথার শেষে একটা গা-জ্বালানি হাসির শব্দ করে গোগোলের হাতে ফর্দটা ধরিয়ে দিলো রেলপাড়ের একমাত্র বড় মুদিখানার মালিক স্বপন সাধুখাঁ।

অন্য সময় হলে নবমীর রাতে মুদিখানার ফর্দ নিয়ে এখানে এসে, তাকে ওটা দেওয়ার জন্য কপালে অনেক দুঃখ লেখা ছিলো স্বপনবাবুর। কিন্তু এখন মেটারিয়ালিস্টিক বিষয় নিয়ে ভাবার সময় নেই গোগোলের। "হিয়াকে দেখেছেন কোথাও?" স্বপনবাবুর মুদিখানার মালের ফর্দের ব্যাপারে কোনোরূপ পজিটিভ অথবা নেগেটিভ আলোকপাত না করে, আনমনে এই কথাটা বেরিয়ে গেলো গোগোলের মুখ দিয়ে। গোগোলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর গলাটা ঝেড়ে নিয়ে স্বপন সাধুখাঁ বললো "হিয়া? মানে হসপিটালের ওই ডিভোর্সি  নার্সটার ঢ্যাঙা মেয়েটা? আমি তো একটু আগে তোমার খোঁজে যখন ক্লাবে গিয়েছিলাম, তখন ওকে ওখানেই দেখলাম। ওর সঙ্গে অবশ্য একটা ছেলে ছিলো। শহুরে বড়লোকের ছেলে বলেই মনে হলো .. দেখতে শুনতেও খাসা আর পোশাক পরিচ্ছদও বেশ দামী দেখলাম। একটা কথা কি জানো তো অনির্বাণ বাবু! আসলে যাকে যেখানে মানায় আর কি .. হেহেহেহে। ঠিক আছে, তোমাকে ফর্দটা দিয়ে গেলাম। আমি এখন চলি, তাড়াহুড়ো কিছু নেই। একাদশির পরে না হয় সময় করে এসে .. হেহেহেহে।"

গা-জ্বালানি হাসি হাসতে হাসতে স্বপন সাধুখাঁ বিদায় নিলেও গোগোলের জন্য রেখে গেলো হাজারো অস্বস্তি। মন্ডপের অনতিদূরেই রেলপাড়ের ক্লাব। এমনিতে এখান থেকে পদব্রজে সেখানে যেতে মিনিট দেড়েক সময় লাগলেও, দ্রুত পা চালিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই ক্লাবে পৌঁছে গেলো গোগোল। দু'টো বেশ বড় আকারের ঘর নিয়ে রেলপাড়ের ক্লাব। একটা কমিউনিটি হল, যেখানে মিটিং অথবা ছোটখাটো কোন গেট-টুগেদার হয় .. যেটা বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। তার পাশের ঘরটা ইন্ডোর গেমস খেলার জন্য .. যেখানে ক্যারাম, টেবিল টেনিস, বয়স্কদের জন্য দাবা, তাস - এই সমস্ত খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। সেই ঘরের দরজার সামনে যেতেই চোখ আটকে গেলো গোগোলের। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পঙ্কজকাকুর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলো হিয়া। আজ একদম অন্যরকম সুন্দর লাগছে হিয়াকে .. তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না সে। স্নিগ্ধ লাবণ্যের সঙ্গে বুদ্ধির দীপ্তি ছড়িয়ে থাকা হিয়ার সমগ্ৰ মুখমন্ডলের দ্যুতি যেন ছাপিয়ে গিয়েছিল পুজোর এই আলোর সমারোহকে।

"ও আঙ্কেল .. আপনা মুহ্ তো বন্ধ কার লো .. না হলে মাছি ঢুকে যাবে যে .." এইরকম একটা উক্তিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো গোগোল। এই চত্বরে তার উদ্দেশ্যে এইভাবে কথা বলার মতো কোনো ব্যক্তি নেই, সেটা তার জানা। দেখতে পেলো তার ডানপাশে গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, সুদর্শন চেহারার অধিকারী প্রায় তারই বয়সী একজন দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে তার দিকে। দাড়ি-গোঁফ কামানো যুবকটিকে বাংলা সিনেমার চকলেট হিরো হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়।

"কে আপনি? আর এই ধরনের কথা বলার .." এই বলে ব্যক্তিটির দিকে এক পা এগোতেই গোগোলকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে যুবকটি মুচকি হেসে বলে উঠলো "hold on hold on my dear friend .. এত উত্তেজনা ভালো নয়। আমি কি এমন বললাম যে আমার দিকে এইভাবে চোয়াল শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে মাস্তানের মত তেরে আসছিস? আঙ্কেল বলেছি বলে রাগ হয়েছে? নাকি মুখে মাছি ঢুকে যাবে বলেছি বলে? কি করবো বল বন্ধু .. তুই যেভাবে আমার সঙ্গে যিনি এসেছেন, তার দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে ছিলি, তাতে করে একজন ভদ্রলোক হিসেবে এই ধরনের উক্তি তো আমাকে করতেই হতো.."

সন্দীপের এইরূপ উক্তিতে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো গোগোলের .. "এবার কিন্তু আপনি আমাকে অপমান করছেন। তুই-তুকারি করছেন কেনো? নেহাত আপনি ওর সঙ্গে এসেছেন, তা না হলে আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলার পরে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হতো না আপনাকে .. বিশ্বাস না হয় এখানে আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন। তাই নিজের সীমার মধ্যে থাকুন .. don't cross your limit , তাছাড়া যাকে ইম্প্রেস করে আপনি কিছু সস্তার বাহবা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য এই ধরনের মন্তব্য করছেন বা করে চলেছেন তাকে একবার আমার পরিচয়টা জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। সে আমাকে কতদিন ধরে চেনে বা তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক! আর একটু আগে বলছিলেন না যে আমি মস্তানের মতো আপনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা ধরুন আমি যদি এখন আপনার সঙ্গে মস্তানি করি, কি করবেন আপনি? এখানে কোনো মায়ের লাল নেই যে আপনাকে বাঁচাবে, এমনকি আপনার সঙ্গে আসা উনিও না।"

"এখানে কোনো মায়ের লাল নীল সবুজ হলুদ আমাকে বাঁচাতে আসবে কিনা জানিনা। তবে আমার সঙ্গে মাস্তানি করা তো দুরস্ত, এই এলাকায় কোনো মাস্তানি দেখলেই ‌সোজা তুলে নিয়ে গিয়ে লকআপে ভরে দেবো, হাহাহাহা .. Hi, this is Sandeep Sengupta .. দিন দুয়েকের মধ্যেই গঙ্গানগর পিএস-এ সাব ইন্সপেক্টর পোস্টে জয়েন করছি .. খুব সাবধান কিন্তু, হাহাহাহা। তুই ছোটবেলায় তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলিস। কিন্তু এখন এরকম ভোঁতা হয়ে গেছিস কেনো? আমার চেহারার তো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, তবুও দ্যাখ আমাকে এখনো চিনতে পারলি না তুই! ওরে বকুরাম, আমি গুরুকুল বিদ্যামন্দিরের তোর বেস্টফ্রেন্ড সন্দীপ। তোকে তুই-তুকারি করবো না তো কি আপনি-আজ্ঞে করবো? তোর চেহারার বরং আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। তুই ছোটবেলায় অনেক ফর্সা ছিলিস, এখন অনেকটা কালো হয়ে গেছিস। তবে চেহারাটা কিন্তু দুর্দান্ত বানিয়েছিস ভাই। পুরো জিম করা ফিগার .. মাচো ম্যান। তার সঙ্গে চাপ দাড়িটাও যথাযথ। কিন্তু দ্যাখ, এত কিছুর পরেও তোকে আমি রেকরগনাইজ করে নিলাম।" উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ে কথাগুলো বললো সন্দীপ।

কথাগুলো শুনে ফ্যালফ্যাল করে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে থাকলো গোগোল। নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। কতো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিলো। তার সঙ্গে পরস্পরের প্রতি করা কতো অঙ্গীকার। 'বন্ধু তুমি একা হলে আমায় জিও ডাক, গল্প করবো তোমার সাথে সারাদিন সারারাত। তুমি যদি কষ্ট পাও আমায় দিও ভাগ, তোমার কষ্ট গ্রহণ করবো হাতে রেখে হাত। বন্ধু হোলো সবার প্রিয় বন্ধু অনেক দামী, বন্ধু মানে খুশীর আমেজ একটু পাগলামি। বন্ধু মানে একলা দুপুর বৃষ্টি রিমঝিম, বন্ধু মানে তুমি-আমি বন্ধু এভ্রিথিং।' এইসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো গোগোলের। কিন্তু তার কঠিন সময়, বিপদের সময়, জীবন একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার সময় তো একবারও তার কথা মনে হয়নি তার বেস্ট ফ্রেন্ডের! গুরুকুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর যখন রেলপাড়ের সরকারি কলেজে এসে সে ভর্তি হলো, কই তখন তো একবারও খোঁজ নেয়নি তার বেস্টু! এরপরে তো কোথায় যেন চলে গিয়েছিল ওরা .. তারপর আজ আবার এইখানে, এইভাবে, এই পরিস্থিতিতে। চোখের কোণদুটো ভিজে উঠেছিল গোগোলের। নাহ্, এটা বহুদিন পর নিজের পুরনো বন্ধুকে দেখতে পাওয়ার পর আনন্দাশ্রু নয়, এটা অভিমানের বহিঃপ্রকাশ।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো গোগোল। তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে ক্লাব ঘরের বারান্দা থেকে নেমে এসে হিয়া বলে উঠলো "আসলে কি জানেন তো সন্দীপ বাবু .. মানুষের সঙ্গে অভদ্রতা করা, মানুষকে অহেতুক অপমান করা, তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নেওয়া .. এগুলো সব মজ্জাগত হয়ে গেছে আপনার বন্ধুর। না হলে দেখুন, আপনি এতক্ষণ ওনার সঙ্গে হেসে হেসে ভদ্রভাবে কথা বলছিলেন আর আপনার সঙ্গে উনার অ্যাটিটিউড কিরকম ছিলো, সেটা এখানে সবাই দেখেছে। আর একটু আগে উনি আপনাকে বলছিলেন না যে উনার পরিচয় আমার থেকে জেনে নিতে, আমি কতদিন ধরে উনাকে চিনি বা ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক .. এইসব আর কি। হ্যাঁ আমরা যবে থেকে এখানে এসেছি, অর্থাৎ লাস্ট ফাইভ ইয়ার্স ধরে উনাকে আমি চিনি। আমার মায়ের সহকর্মীর ছেলে .. ব্যাস এইটুকুই।"

"না না, হিয়া শোনো .. এইসব তুমি কি বলছো? তোমার বোধহয় কোথাও একটা .." হিয়ার উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পঙ্কজবাবুর বলা এই কথাগুলো মাঝপথে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে  অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে গোগোল বললো "মাফ করবেন ইন্সপেক্টর সাহেব, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি .. তাই হয়তো ওইভাবে কথা বলে ফেলেছি। তবে আমি কিন্তু আপনাকে 'আপনি' করেই বলবো। তার কারণ আমি মনে করি পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে যায় আর তার সঙ্গে সম্বোধন। হ্যাঁ ঠিকই আছে .. আপনার বান্ধবী মানে হিয়া একদম ঠিক কথাই বলেছে। উনার মা আর আমার মামনি একই হসপিটালে কাজ করেন, সেই সুবাদেই আমি ওনাকে চিনি। আসলে আমিও আমার এক পরিচিতার সঙ্গে নবমীর রাতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। সেখানে আপনাদের দু'জনের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে বেশ ভালোই লাগলো। পরিচয় করিয়ে দিই, এ হলো টগর .. আমার বিশেষ বন্ধু বলতে পারেন।" কথা শেষ হওয়ার পর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপন সাধুখাঁর মেয়ে টগরকে ইশারা করে তার পাশে এসে দাঁড়াতে বললো গোগোল।

অবাক চোখে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে হিয়া অস্ফুটে বলে উঠলো "এতদূর? সেই জন্যই আজ তুমি এলে না .." তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সন্দীপের দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললো "আরে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করলে চলবে? অনেক রাত হলো, আপনাকে তো আবার কলকাতায় ফিরতে হবে। এখন সবার সঙ্গে আলাপ না করলেও চলবে, দু'দিন পরে তো এখানে পার্মানেন্টলি চলেই আসছেন, তখন না হয় আলাপ করে নেবেন।"

"ঠিক আছে ঠিক আছে .. হিয়া ম্যাডাম যখন একবার বলে দিয়েছে, তখন আমার ঘাড়ে ক'টা মাথা আছে সেই কথা অমান্য করার! না না, আজ সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে .. পরে না হয় একদিন এসে জমিয়ে গল্পগুজব করা যাবে আপনাদের সঙ্গে। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু তোকে 'তুই' করেই বলবো মাই ডিয়ার অনির্বাণ। আর পরিস্থিতির কথা কি যেন সব বলছিলিস .. সেই প্রসঙ্গে বলি .. সিচুয়েশনের দোহাই দিয়ে অনেক সময় অনেকে কিন্তু অনৈতিক কাজ করে ফেলে .. সেদিকেও নজর দেওয়া উচিত। যাই হোক, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চলো হিয়া আমরা বাড়ি যাই।" কথাগুলো বলেই সন্দীপ এবং তার সঙ্গে হিয়া মিউনিসিপাল হসপিটাল কোয়ার্টারে যাওয়ার রাস্তার অভিমুখে রওনা হলো। সেই দিকে স্থির নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো গোগোল। ঠিক তখনই তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো টগর।

★★★★

যে প্রেয়সীর বিদায়ে বিরহী ক্রন্দনে বুক ফেটে যায়, সেই প্রেয়সীই বলে ভালবাসা ছিলো বলেই তো আজ দীর্ঘসময় অপেক্ষার নিত্য আসা-যাওয়া। সে বলে প্রেম! সে তো আছে সারা দেহ জুড়ে, তার অদৃশ্য শিহরণে কেঁপে ওঠে অলিন্দ-নিলয়। বুক পাঁজরের ব্যাথাটাও একটু একটু করে উর্ধ্ব গগনে বিলাপ করে। যে নারীর প্রথম স্পর্শে তার মতো আনকোরা কবির প্রথম কবিতার দাবানল প্রবল বেগে ছুটে চলে, সেই নারীই বলে কবিতার মাল্যে তাকে পরাও অসম্ভব ব্যাকুলতারর সমাপ্তিকথন। হিয়া বলে 'এ্যাই শুনছো তুমি অসমাপ্ত কাব্যে জুড়ে দিও মিলনতিথির আতশবাজি। স্বপ্নগুলোর পাখায় জুড়ে দিও যৌবনের প্রথম প্রেমের ব্যাকুলতা।' যে নারীর ছায়ায় জাগে প্রেম পত্রের দীর্ঘ রচনা। সেই নারীই বলে রচনার শৈলীতে আকাশে ঝড়াও তারার কথোপকথন। রৌদ্রের রুপালী ভোরে বেদনার প্রলেপে মাখাও স্মৃতির রোমন্থন। হিয়া বলে তার প্রেমে অমাবস্যায় জাগে মধু পূর্ণিমা, শ্রাবণে ঝড়ায় প্রেম তৃষ্ণা, বাঁশীর সুরে জাগে ভালবাসার বিনিদ্র রজনী। যে মনের মানুষের বিদায়ে বিরহী যাপনে কাটে অসমাপ্ত প্রহর, সেই মনের মানুষই দিলো নির্বাসিত জীবনে যোজন যোজন অমাবস্যা।

ভাবনার অতলে তলিয়ে গেলো গোগোল। বর্ষার বিদায়ে শরৎ এসেছিল নীল আকাশের আঁচল উড়িয়ে। তবে এবারের মতোই সেবারও সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার হয়েছিল। দু'এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়ে আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছিল বেলার দিকে। গোগোলের তখন সতেরো কি আঠারো বছর হবে .. হিয়া আরো ছোট। হলুদরঙা শাড়ি হিয়ার, প্রথম দেখা পঞ্চমীতে। ঠাকুর দালান ফুল সাজানো, তারুণ্যের চোখে বিস্ময়ের বহিঃপ্রকাশ। ক্লাবের ঘরে গোগোলরা ক'জন আর সামনে? সেখানেই যে হিয়ার সাথে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল গোগোলের, হাজারও চোখ এড়িয়ে, পরস্পরের চোখেতে চোখ রেখেছিল তারা। ভিড়ের মাঝে আড়াল খুঁজে কল্পনার রঙিন স্রোতে যেন ভেসে গিয়েছিল দু'জনে। গোগোলের কাছে সকাল তখন শুধুই সুনীল, বিকেল পলাশ রাঙা, সন্ধ্যে গগন তারায় ভরা, আর রাত্রি? সে তো পরীদের দেশ .. ঠিক যেন হিয়ার মতো পরী। আজও মনে পড়ে তার চোখে হিয়ার ভেসে যাওয়া। মুগ্ধ তার নয়নজোড়া স্তব্ধ, যেন বাক্যহারা।

তারপর পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। জীবনের লক্ষ্য বদলেছে গোগোলের, তার সঙ্গে বদলেছে সম্পর্কের সমীকরণ। কিন্তু এত ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও জীবনযুদ্ধে সে এখনো টিকে আছে শুধু একজনেরই জন্য .. হিয়া .. তার প্রাণভোমরা। সেদিন ক্লাবের সামনের এক ফালি বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো দু'জনে .. তারার চুমকি বসানো রাত। পেঁজা তুলোর মতো পাহাড়ে ফর্মেশান। রেলপাড়ের দক্ষিণের আকাশের দিকে ঘাড় তুলে তাকালে মনে হয় ডনভ্যালিতে পদব্রজে বেরোনো হয়েছে। চোখের সামনে মেঘের মুসৌরী। মৃদুমন্দ বাতাস ঘাড়ের কাছে প্রেয়সীর নিশ্বাসের মতো বলতে চাইছে .. 'আমার রাজা .. শরৎ এলো, মৃগয়ায় যাবে না?' হঠাৎ গোগোল মৃদুস্বরে বলে উঠলো "কোথা সে বন সখী? কোথা সে জল? এখন রাজারা আর মৃগয়ায় যায় না। এখন এই ধরাধাম মৃগয়াভূমিতে পরিণত হয়েছে .. কথায় কথায় লাশ পড়ে যায় .. মানুষের।"

"আজ বছরকার দিন .. মহানবমী .. আর  তুই পুজোর সমারোহ, হই-হট্টগোল ছেড়ে একলা ঘরে বসে আলো নিভিয়ে কি করছিস? কার সাথে কথা বলছিস নাকি আপনমনেই? বাইরে তো সবাই তোকে ডাকাডাকি করছে। বলছে একটা নাকি গ্রুপফটো তোলা হবে .. যে পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা তাকেই পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ঘরে এসেছিলাম শাড়ি পাল্টাতে। এসে দেখি তুই এখানে বসে আছিস। কি ব্যাপার বলতো? রাত অবশ্য অনেক হলো .. দশটা বেজে গেছে। কিন্তু তুই তো এত তাড়াতাড়ি খাস না। তোর কি খিদে পেয়েছে? খেতে দেবো নাকি?"

সুজাতার কথায় ঘোর কাটলো গোগোলের। নিজের বর্তমান অবস্থা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তার মামনির উদ্দেশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠলো "উফফ .. বক বক বক বক করেই যাচ্ছো তাই না? এত কথা বলো কেন তুমি? আমি এখন কোথাও যাবো না আর আমাকে খেতে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। খিদে পেলে আমি নিজে নিয়ে নেবো। তুমি যাও এখান থেকে, প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।"

সে গোগোলকে ছোটবেলা থেকে দেখছে, তার থেকে তাকে ভালো করে এখন আর কেউ চেনে না, কেউ বোঝেনা। তাই গোগোলের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঘরের লাইটটা জালালো সুজাতা। দেখলো বিছানার উপর নিজের দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় গোগোল। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদার পর চোখমুখের যেরকম অবস্থা হয়, ঠিক সেইরকম অবস্থা হয়েছে তার গোগোলের। "কি হয়েছে সোনা? মানিক আমার .. কি হয়েছে বল আমাকে .. আবার কি সেই সমস্ত ছাইপাঁশ স্বপ্ন দেখেছিস? নাকি কোথাও কারোর সঙ্গে ঝামেলা করে এসছিস আবার। অবশ্য তুই তো ঝামেলা করে এসে কান্নাকাটি করার ছেলে নয়। কি হয়েছে?" এক ছুটে খাটের কাছে এসে গোগোলকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠলো সুজাতা।

এই সময় তো তার মামনিকেই দরকার ছিলো। সুজাতাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো গোগোল। কিন্তু গলা দিয়ে তার একটা কথাও বের হলো না। "এই দেখো ছেলে এত বড় হয়ে গেছে, তবুও মামনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, লোকে দেখলে কি বলবে জানিস? আচ্ছা, এই একটু আগে মন্ডপে দু-একজন আলোচনা করছিলো, আজ নাকি হিয়া এসেছিল আমাদের এখানকার পুজোতে। তবে ও একা আসেনি, ওর সঙ্গে কেউ নাকি একজন ছিলো। ভালো কথা, তোর আজকে ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো না? ওর সঙ্গে কে এসেছিলো জানিস কিছু? তোর যা মাথা গরম, ওদের সঙ্গে আবার ঝামেলা-টামেলা কিছু হয়নি তো?" সুজাতার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো গোগোল।

"ওরে মুখপোড়া সর্বনাশী ছেলে .. এটা কি করেছিস তুই? ভালবাসিস হিয়াকে? খুব ভালবাসিস তাই না? কিন্তু এটা তো হওয়ার নয় সোনা মানিক আমার। মুখ মোছ, চোখ মোছ আর কাঁদিস না। সব বলবো আজ, সব বলবো তোকে। কারণ, আজ না বললে অনেক দেরি হয়ে যাবে।" সুজাতা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই গোগোলের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।

একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। দু-একবার রিং হতেই ফোনটা তুলে নিয়ে কানে দিতেই সুজাতা লক্ষ্য করলো গোগোলের মুখের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। তার সমগ্র মুখমন্ডলে এখন বেদনার বহিঃপ্রকাশের বদলে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠেছে। "এক্ষুনি আসছি .." প্রচন্ড গম্ভীর গলায় এইটুকু বলে বিছানা থেকে নেমে মুহূর্তের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো গোগোল।

(ক্রমশ)


ভালো লাগলে আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন
লাইক এবং রেপু দিয়ে উৎসাহিত করবেন

আরো একটু বড়ো আপডেট হলে দারুণ হতো, তাড়াতাড়ি নেক্সট আপডেট নিয়ে ফিরে আসো।।
আর লাইক এবং রেপু নিয়ে চিন্তা নেই ওটা অলরেডি ডান।
I'm the King of Dark
                &
I rule over all Devils
               devil2 devil2
[+] 1 user Likes Monen2000's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: গোলকধাঁধায় গোগোল (চলছে) - by Monen2000 - 01-11-2022, 10:04 PM



Users browsing this thread: 29 Guest(s)